বিয়ের মাস পাঁচেক পর ফারিয়ার গর্ভে বাচ্চা আসে।বাচ্চাটির জন্য তামিম -ফারিয়ার সে কি আনন্দ! কি উচ্ছ্বাস! কতো শতো পরিকল্পনা। সন্ধ্যা না হতেই তামিম অফিস থেকে বাসায় ফিরে। স্ত্রীর পাশে বসে।খোঁজ-খবর নেই। চায়ের কাপে তাদের বেশ গল্প জমে। ফারিয়ার সারাটা দিন কেমন কাটলো, দুপুরে কিছু খেয়েছো কি না, গতকালের মতো আজো খুব বমি হলো কি না, এসবেই গল্পের আসর গভীর হতে থাকে।
ওদের আনন্দ দেখে কে!
সন্ধ্যা ঘনিয়ে, একটু পরই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবে পশ্চিমাকাশে হেলে পড়া লাল সূর্য।
ফারিয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে সূর্যের চলে যাওয়া দেখছে।ক’দিন ধরে বুকের মধ্যে চিনচিন ব্যথা করে। ব্যথাটা অবশ্য দীর্ঘস্থায়ী হয় না। তাই ডাক্তারের কাছেও যাওয়া হয় না। ফারিয়া ভাবে, একবার তামিমকে বিষয়টা খোলে বলবে। কিন্তু বলা হয় না। ইদানীং তামিম অফিসের কাজে খুব ব্যস্ত । বাসায় এসেও কাজ করতে হয় তাকে। বেচারা দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে। খুব মায়া হয় ফারিয়ার। মনে মনে ভাবে, কাজের ঝামেলা কমুক। পরে না হয় বলা যাবে। আমার জন্য বাড়তি টেনশন করে ওকে পেরেশান করা ঠিক হবে না বোধয়। এসব ভাবতে ভাবতেই কলিংবেল বেজে ওঠে। তামিম দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে। ফারিয়া দরজা খুলতে দেরি হচ্ছে দেখে সে আরেকবার কলিংবেল চাপল।
— এত দেরি হলো যে?
— আমি একটু পশ্চিম বারান্দায় ছিলাম। বুঝতে পারি নি।আজ এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলে?
— আজ কাজের চাপ তেমন ছিল না। শুনো,এক কাপ চা দাও। চায়ের তৃষ্ণা পেয়েছে। তুমি দ্রুত রেডি হয়ে আসো। শপিংয়ে যাব। মাসের শেষে কাজের চাপ বেড়ে যেতে পারে। তখন নিঃশ্বাস ফেলারও সময় পাব না।
— আজ না গেলে হয় না? ভালো লাগছে না।
তা ছাড়া…। ফারিয়া বলতে গিয়েও থেমে গেল।বুকের ব্যথাটার কথা। থাক,অন্য কোনো দিন বলা যাবে।
ঘণ্টা দু’য়েক মার্কেটে ঘুরাফেরা করল। ফারিয়ার এখন অবশ্য খারাপ লাগছে না। কিন্তু বারবার কপাল ঘেমে যাচ্ছে। তামিম আজ তাকে দু’দুটো শাড়ি কিনে দিয়েছে। বেশ চড়া দামে। ফারিয়া তামিমকেও কিছু কিনতে বলল। সে কিছুই কিনল না। বলল, ‘আগামী মাসে কিনব। এ মাসের এখনো এগারো দিন বাকি। আল্লাহ আল্লাহ করে মাসটা সুন্দর করে শেষ হলেই হলো। কারো কাছে টাকা ধার চাইতেও এখন আর ভালো লাগে না। নিজের সামান্য যা আছে তাতেই চলবে। বাকটা আল্লার ইচ্ছে…!’
— অন্তত একটা শার্ট কিনো। এক শার্ট আর ক’দিন পরা যায়? আমি তো কোথাও যাই না। সারাদিন ঘরেই থাকি। আমার না হলেও চলবে। তুমি তো বাইরে যাও।অফিস করো। কতো মানুষের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হয়।আমারচে’ তোমার প্রয়োজন বেশি।
— আচ্ছা ঠিকাছে, আগামী মাসে বেশ আয়োজন করে শপিং করব। কেমন? এখন বলো আর কিছু লাগবে?
— হুম। তবে আমার না। আমাদের মেহমানের জন্য। ফারিয়ার কথা শুনে তামিম না হেসে পারল না। বলল,
— এখনো তো মেহমান আসেন নি। যখন আসবে তখন তাকে সঙ্গে নিয়েই শপিং করব।
— না না, ওর জন্য একজোড়া জুতো নিয়ে যাই।শিশুদের জুতো নিব। দাম বেশি না। তবে বেশি দামে কিনব!
এক জোড়া জুতোর জন্য অনেক কসরত করতে হলো। জুতো জিনিসটা পৃথিবীর কেউ মনের মতো কিনতে পারে না। কেনার পর ভাবে__ইশশ,পাশের জুতোটা কিনলে হয়তো বেশ মানাতো। অবশেষে পেলো।দুই মাসের বাচ্চার জুতো। এরচে’ কম বয়সী বাচ্চার জুতো পেলো না। তবুও খুশি। পছন্দের জিনিস।আগত মেহমানের জিনিস।
ফেরার পথে রাস্তার এপাশে তারা দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় কুড়ি মিনিট হল, ওপাশে যেতে পারছে না। আশেপাশে পথচারীদের জন্য ওভার ব্রিজও নেই। বাস,ট্রাক নিজের মতো করে চলছে। আপন গন্তব্যের দিকে।
কিছুক্ষণ পর তামিম দেখলো রাস্তা এখন বেশ ফাঁকা।
পার হওয়া যাবে। তবে দ্রুত। দেরি করা যাবে না। সে ফারিয়ার হাত ধরে হাঁটছে। যেন আজ আর পথ ফুরাচ্ছে না। হঠাৎ কোত্থেকে দূরপাল্লার এক বাস এসে কী থেকে কী…
পুরো রাস্তা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। সোডিয়াম লাইটের আলোয় লাল রক্তকে আলকাতরার মতো কালো মনে হচ্ছে। আশেপাশের লোকজন এসে দাঁড়িয়ে ভয়ংকর দৃশ্য উপভোগ করছে!
কী অদ্ভুত! কেউ কাছে আসছে না। দূরে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। মেঘ গলা ছেড়ে বিশাল গর্জন দিচ্ছে। একটু পর বৃষ্টি নামলো।ঝুম বৃষ্টি। মনে হচ্ছে পুরো শহর, শহরের মানুষের পাপ বৃষ্টির ফোঁটার সঙ্গে ভেসে যাবে। লোকজন দ্রুত হাঁটা দিল আপন নীড়ে। দূরপাল্লার ঘাতক বাসটিও চলে গেল দূরে, বহু দূরে।একবারের জন্যও ফিরে তাকালো না! বৃষ্টিকে ঘীরে শুধু পড়ে থাকলো ‘ দু’টি মৃত দেহ’।