এক.
জান্নাত আরা ঝর্ণা হাফিজ মাওলানা মামুনুল হকের বিয়ে করা স্ত্রী কি না তা আমার জানা নেই। তিনি দাবী করছেন এবং তার বন্ধুদের কেউ কেউ সাক্ষীও দিচ্ছেন। ইসলামী আইনে হয়তো বিয়ে হয়েগেছে। তবে রাষ্ট্রীয় আইনে কাবিন ছাড়া বিয়ে গ্রহণযোগ্য নয়। দ্বিতীয় বিয়ের ক্ষেত্রে ইসলামের বিধানকে আমরা যত সহজ মনে করি প্রকৃত অর্থে তত সহজ নয়। এক্ষেত্রে শর্ত খুব কঠিন। অনেক পুরুষ মনে করেন, ইসলাম দ্বিতীয় বিয়ের প্রতি উৎসাহিত করেছে। কিন্তু তা এভাবে সত্য নয়। ইসলাম প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ বিয়েকে বৈধতা দিয়েছে শর্ত-সাপেক্ষ। এই শর্ত পাওয়া না গেলে ইসলাম বলেছে বিয়ে না করে রোজা রাখতে। মাওলানা মামুনুল হকের এই শর্তগুলোর কথা অবশ্যই জানা আছে। আমাদের ধারণা তিনি এই শর্তগুলো পূর্ণ করেই দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। কিন্তু পরবর্তীতে আলোচনা থেকে বেরিয়ে আসছে তিনি সকল শর্ত পূর্ণ করেন নি। যদিও সকল শর্ত পূর্ণ হয় নি, তবু তার দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে বিয়ের পর মিলনে শরিয়তের দৃষ্টিতে পাপ বা অন্যায় নয়। এক্ষেত্রে মানুষকে পাপ থেকে রক্ষা করতে শরিয়তের কিছু বিধান রয়েছে। যেমন কোন কোন ফেকার কিতাবে রয়েছে, আল্লাহ-রাসুল সাক্ষী রেখেও বিয়ে হয়। তবে এই বিয়ে সামাজিক এবং আমাদের রাষ্ট্রীয় আইনে বৈধ নয়। স্মরণ রাখতে হবে, শরিয়ত বা আইনের বৈধতা আর ভদ্রতা ও তাকওয়া এক জিনিষ নয়। আইনের ফাঁক দিয়ে আদালত থেকে বাঁচা আর পূর্ণাঙ্গ আইন সম্মত হওয়া কি সমার্থক? দ্বিতীয় বিয়ের ক্ষেত্রে শর্তে হলো, প্রথম স্ত্রীর অনুমতি। শরিয়ত লিখিত অনুমতির কথা হয়তো বলছে না, তবে নিশ্চয় প্রথম স্ত্রীকে গোপন করে দ্বিতীয় বিয়ের অনুমতিও দিচ্ছে না। হাফিজ মাওলানা মামুনুল হক প্রথম স্ত্রীর অনুমতি নিয়েছেন কি না তা জানি না। থাকলে ভালো। না-থাকলে আশা করি ইতোমধ্যে বিপদে পড়ে ইজ্জত রক্ষার্থে আপোষ হয়েগেছে। সংসার জীবন আইন-আদালত আর বিচার দিয়ে চলে না, তা চলে আপোষের মাধ্যমে। সংসারে আপোষ হওয়াটা সুখ-শান্তির জন্য জরুরী। বৈধতা এবং অবৈধতা আইন এবং শরিয়তের বিষয়। তা দেখবেন বিশেষজ্ঞরা।
দুই.
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে দাবী করেছেন, জান্নাত আরা ঝর্ণা পার্লালের মেয়ে। হেফাজতে ইসলামের গোপন বৈঠকেও নাকি মাওলানা মামুনুল হক স্বীকার করেছেন তিনি মেয়েটির আয়-ইনকামের জন্য পার্লারে চাকুরী যোগর করে দিয়েছেন। পার্লারে চাকুরী করা পাপ নয়, পার্লারের কর্মচারীকে বিয়ে করাও পাপ নয়। তবু মামুনুল হকের জন্য তা বেমানান। আমার কথা নয়, স্বয়ং হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নেতাদের কথা। হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় এক নেতা তো সরাসরি মামুনুল হককে প্রশ্ন করেছেন মিটিং-এ; তুমি কি জানো তুমি কোন পরিবারের ছেলে? তুমি কি জানো সমাজ ও রাষ্ট্রে তোমার অবস্থান কী? তুমি যদি ভরণ-পোষণ দিতে না পারো তবে দ্বিতীয় বিয়ে করবে কেন? আমাদের আর কোন বক্তব্য নেই, হেফাজতে ইসলামের ঐ নেতার প্রশ্নটাই এ বিষয়ে আমাদের বক্তব্য।
তিন.
হাফিজ মাওলানা মামুনুল হকের অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় রয়েছে। আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো তাঁর বাবার পরিচয়। মামুনুল হকের বাবা সহীহ বোখারী শরিফের প্রথম বাংলা অনুবাদকারী শায়খুলহাদিস আল্লামা আজিজুল হক (র.)। আমাদের বাঙালী জাতির জন্য বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। শায়খুলহাদিস আল্লামা আজিজুল হক (র.)-কে আমি শ্রদ্ধা করি-ভালোবাসি। আমাকেও তিনি স্নেহ করতেন। আমি তাঁকে খুব কাছাকাছি থেকে দেখেছি। এমন উত্তম চরিত্রওয়ালা, সাহসী এবং সচেতন মানুষ তাঁর সময়ে বাঙালি পণ্ডিত কিংবা আলেমদের মধ্যে খুব কমই ছিলেন। তিনি আল্লাহ প্রেমিক ছিলেন, রাসুল প্রেমিক ছিলেন। তাঁর অন্তরে উম্মাহ প্রেমও ছিলো। মামুনুল হকের কৃতকর্মে তাঁর শ্রদ্ধেয় পিতাকে যারা সোনারগাও-এ গালি দিয়েছেন আমরা তার প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করছি এবং তাকে অনুরোধ করছি তাওবাহ করতে। কারণ, আল্লাহর ওলিদেরকে গালি দিলে ওলিদের ক্ষতি হয় না, ক্ষতি হয় নিজেরই। অবশ্য মামুনুল হকেরও তাওবাহ করা উচিৎ দুটি কারণে, প্রথমত আল্লামা আহমদ শফি (র.)-এর সাথে যে খারাপ আচরণ হয়েছে তার জন্য মামুনুল হকও কিছু দায়ী। দ্বিতীয় কারণ, তিনি এমন কর্ম করেছেন যার জন্য মানুষ তাকে বাপ উঠিয়ে গালি দিতে সাহস পাচ্ছে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাওবাহ নসিব করুন।
চার.
হাফিজ মাওলানা মামুনুল হকের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বগুলোর মধ্যে অন্যতম তিনি হেফাজতে ইসলাম (বাবুনগরী গ্রুপ)-এর কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব এবং শায়খুলহাদিস। তিনটা পদই দায়িত্ব এবং আদর্শিক দিকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হাফিজ মাওলানা মামুনুল হক যে কাজ করেছেন তা আইনের ফাঁকে বাঁচার মতো হলেও পদ ও আদর্শিক স্থান থেকে খুবই মারাত্মক কাঁচা কাজ হয়েছে। এই কাঁচা কাজকে হেফাজতে ইসলাম কিংবা খেলাফত মজলিস যদি পাঁকা করতে ময়দানে আন্দোলন-সংগ্রাম করেন তবে তা হবে আরও কাঁচা কাজ এবং তা হয়তো মামুনুল হককে রক্ষা করতে পারবে, কিন্তু ধ্বংস করে দিবে হেফাজত ঘরের কিংবা দেওবন্দি দাবীদার সকল আদর্শিক প্রতিষ্ঠানের উজ্জল কর্মগুলোকে। জামায়াতে ইসলাম যেমন ধ্বংস হয়েছে রাজাকার-আলবদর-আল শামসদেরকে রক্ষার আন্দোলনে দীর্ঘ সময় ব্যয় করে, তেমনি ধ্বংস হয়ে যাবে এই ধারাও একজন ব্যক্তিকে রক্ষা করতে গিয়ে। অনেকে স্বাধীনতার পর জামায়াতকে পরামর্শ দিয়েছিলেন দলের নাম পরিবর্তন করে নতুন নেতৃত্ব নিয়ে আসতে। কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতাদের একগুয়েমি চিন্তা শুধু কিছু ব্যক্তিকে রক্ষার জন্য শত শত কর্মিকে মৃত্যুর মুখে ফেলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তবু ঐ ব্যক্তিদেরকে রক্ষা করা যায়নি। তেমনি যদি আবেগে কোন দল বা গোষ্টি মামুনুল হকের কর্মকে বৈধতা এনেদিতে আন্দোলন-সংগ্রামে যান তবে স্মরণ রাখবেন তাতে কোন উপকার হবে না, বরং হেফাজতের বাবুনগরী ধারাটি ধ্বংসের মুখোমুখি হবে। স্মরণ রাখবেন, সরকারের কাছে ব্যক্তি মামুনুল হকের দ্বিতীয় বিয়ে কিংবা চতুর্থ বিয়ের কোন মূল্য নেই। কোন মূল্য নেই মামুনুল হক কার সাথে বৈধ কিংবা অবৈধ সম্পর্ক গড়েছেন। সরকারের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, হেফাজতে ইসলামের নেতা মামুনুল হক। তাই সরকার হেফাজতে ইসলামকে আটকাতে মামুনুল হককে আপমানের চেষ্টা করবে। কিন্তু মামুনুল হক যখন এই পদগুলো ছেড়ে দিবেন কিংবা তাকে যখন এই পদগুলো থেকে অভ্যাহতি দেওয়া হবে তখন সরকারী গোয়েন্দা সংস্থার তার দিক থেকে দৃষ্টি সরে যাবে। এতে মামুনুল হকের যেমন ফায়দা, তেমনি ফায়দা হেফাজতে ইসলাম ও খেলাফত মজলিসের। এই দুই দলের উচিৎ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যেমন ভেতরে বিচার ব্যবস্থা থাকে তেমনি এই দুই দলের মধ্যেও বিচারের ব্যবস্থা করে মামুনুল হকের এই কর্মগুলোকে পর্যবেক্ষণ করা এবং ইন্টারন্যাল বিচারে গোষ্ঠীতান্ত্রিকতা ছেড়ে অপরাধ অনুযায়ি অতিগোপনে কিছু শাস্তির ব্যবস্থা করা। তাঁর এবং অন্যদের ইসলাহের জন্য তা জরুরী। আদর্শিক কারণে উচিৎ কিছুদিনের জন্য হলেও হাফিজ মাওলানা মামুনুল হককে তাঁর দায়িত্বগুলো থেকে অব্যাহতি দেওয়া। বিষয়গুলো সংশ্লিষ্টরা ভাবতে পারেন।
পাঁচ.
হাফিজ মাওলানা মামুনুল হকের প্রতি আমার যথেষ্ট প্রেম আছে। তাঁর শৈশব থেকে এই পর্যন্ত অনেক জিনিষই তো আমাদের চোখের সামনে। আমার মনে হয়, তাঁর অবস্থান, চিন্তা এমন নয় যে সে আমার মতো মানুষের কথাকে গুরুত্ব দিবে। যদি দিত তবে নিশ্চয় শায়খুলইসলাম আল্লামা আহমদ শফি (র.) বেঁচে থাকতে কিংবা মারা যাওয়ার পর তাওবাহ করে একবার হাটাজারীতে গিয়ে শায়খের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে রুনাজারি করতেন। এখনও সময় যায়নি। এখনও মামুনুল হকের বয়স তেমন হয়নি। যা হারিয়েছে তা ফিরে পেতে বেশি সময় লাগবে না। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমি মামুনুল হককে বলবো; দুজন মানুষের কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছু শিখার আছে। ১. বিশ্ব তাবলিগের আমির আল্লামা সাদ কান্দালভী। ২. শায়খুল ইসলামের ছোট ছেলে মাওলানা আনাস মাদানী। তাদের উপর দিয়ে কত ঝড় গেলো, তুফান গেলো, অপবাদের পর অপবাদ গেলো কিন্তু তারা মুখ খুলেননি। তারা হয়তো নিরবে বসে তাওবাহ করে আল্লাহর সাহায্য কামনা করেছেন। মানুষ যত বড় অপরাধীই হোক না কেন, আল্লাহ তো দুনিয়ার জন্য রাহমান এবং গাফ্ফার। মামুনুল হকের উচিৎ মুখ বন্ধ করে ইসতেগফার করে আল্লাহর কাছে সাহায্য কামনা করা। নতুবা কথা যত হবে ততই বিপদ বৃদ্ধি পাবে। অবশেষে মিথ্যার পাহাড়ে দাঁড়িয়ে ধ্বংসের পথে হাটতে হবে। আল্লাহ আমার প্রিয় শায়খুলহাদিসের সন্তানদের উপর রহম করুন।