পবিত্র কুরআনুল কারীম ইসলাম ধর্মের মূল ও চূড়ান্ত ধর্মগ্রন্থ। এটি এমন এক কিতাব, যার সংরক্ষণের দায়িত্ব স্বয়ং মহান আল্লাহ তা’আলা নিয়েছেন। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন—
إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ
“নিশ্চয়ই আমি নিজেই এ উপদেশ (কুরআন) নাযিল করেছি, এবং আমিই এর সংরক্ষক।”
(সূরা আল-হিজর : ৯)
আরও স্পষ্ট করে আল্লাহ বলেন—
وَإِنَّهُ لَكِتَابٌ عَزِيزٌ لَا يَأْتِيهِ الْبَاطِلُ مِن بَيْنِ يَدَيْهِ وَلَا مِنْ خَلْفِهِ
“এটি এক মর্যাদাপূর্ণ কিতাব, যার সামনে বা পেছন দিয়ে কোনো মিথ্যা প্রবেশ করতে পারে না।”
(সূরা ফুসসিলাত : ৪১–৪২)
এই আয়াতদ্বয়ই যথেষ্ট প্রমাণ যে, কুরআনের সামান্যতম অংশও কখনো হারাবে না, বিকৃত হবে না, মুছে যাবে না। কারণ, এটি আল্লাহর অঙ্গীকার ও চ্যালেঞ্জ—যা কিয়ামত পর্যন্ত সত্য থাকবে।
কিন্তু ইসলামী চিন্তার ইতিহাসে এমন কিছু ব্যক্তি ও মতবাদ দেখা গেছে, যারা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাখ্যা ও মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়ে কুরআনের প্রকৃত ব্যাখ্যা বিকৃত করার চেষ্টা করেছে।
এর মধ্যে অন্যতম নাম আবুল আ’লা মওদুদী।
তার রচিত বই “কুরআন কি চাঁর বুনিয়াদী ইস্তেলাহোঁ” (পৃ. ১০)-এ তিনি লিখেছেন—
“پس یہ حقیقت ہے کہ محض ان چار بنیادی اصطلاحوں کے مفہوم پر پردہ پڑ جانے کی بدولت قرآن کی تین چوتھائی سے زیادہ تعلیم بلکہ اس کی روح نگاہوں سے مستور ہوگئی ہے।”
এর অনুবাদ তিনি নিজেই এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন—
“সুতরাং এটাই সত্য যে, শুধু এই চারটি মৌলিক পরিভাষার (ইলাহ, দ্বীন, রব, ইবাদত) অর্থের উপর পর্দা পড়ে যাওয়ায়, কুরআনের তিন চতুর্থাংশ শিক্ষা এমনকি এর রূহ পর্যন্ত আমাদের দৃষ্টির অগোচরে চলে গেছে।”
মওদুদীর এই বক্তব্যের অর্থ দাঁড়ায়—
➡ কুরআনের শিক্ষা ও রূহ (আধ্যাত্মিক সত্তা) হারিয়ে গেছে,
➡ অর্থাৎ মানুষ কুরআনের প্রকৃত মর্মার্থ বুঝতে পারছে না,
➡ এবং কুরআনের সত্য বার্তা ‘আড়াল’ হয়ে গেছে।
কিন্তু আল্লাহর নিজস্ব ঘোষণা অনুযায়ী কুরআন কখনো হারাবে না, বরং আল্লাহ নিজেই এর রক্ষাকর্তা।
তাহলে প্রশ্ন জাগে—
যদি সত্যিই কুরআনের রূহ হারিয়ে যায়, তবে আল্লাহর এই ঘোষণা কি ব্যর্থ হয়ে যাবে না?
নাউযুবিল্লাহ! এটি তো আল্লাহর কালাম ও তাঁর চ্যালেঞ্জের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবমাননা ও বিদ্রোহের ইঙ্গিত।
ইসলামী আকীদা অনুযায়ী কুরআনের কোনো অংশ হারিয়ে যাওয়া বা এর শিক্ষা বিলুপ্ত হওয়া অসম্ভব ও অবিশ্বাসযোগ্য।
কারণ—
-
আল্লাহ স্বয়ং সংরক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছেন—তাহলে কেউ বা কোনো গোষ্ঠী এর রূহ আড়াল করতে পারে না।
-
কুরআনের ব্যাখ্যা নবী করিম ﷺ নিজে করে গেছেন, সাহাবায়ে কিরাম ও তাবেয়িনরা তা হুবহু পৌঁছে দিয়েছেন।
-
ইসলাম কখনোই কোনো নির্দিষ্ট পরিভাষা বা ভাষাগত রুদ্ধতায় সীমাবদ্ধ নয়; এটি সর্বজনীন, সহজবোধ্য ও সবার জন্য উন্মুক্ত।
সুতরাং, মওদুদীর দাবি যে “কুরআনের তিন চতুর্থাংশ শিক্ষা ও রূহ আড়াল হয়ে গেছে”—
তা কুরআনের ঘোষণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক, এবং ইসলামী বিশ্বাসের দৃষ্টিতে অগ্রহণযোগ্য ও বিপজ্জনক।
মদীনার ইসলামী চিন্তাধারা বলছে—
কুরআন কোনো নির্জীব বই নয়; এটি এক জীবন্ত, আলোকিত ও অলৌকিক কিতাব।
যে মুমিন তার উপর আমল করে, সে-ই কুরআনের রূহকে অনুভব করে।
يُرِيدُونَ لِيُطْفِؤُوا نُورَ اللَّهِ بِأَفْوَاهِهِمْ وَاللَّهُ مُتِمُّ نُورِهِ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَ
“তারা মুখ দিয়ে আল্লাহর নূর নিভিয়ে দিতে চায়, কিন্তু আল্লাহ তাঁর নূরকে অবশ্যই পরিপূর্ণ করবেন, যদিও কাফেররা তা অপছন্দ করে।”
(সূরা সফ : ৮)
অতএব, আল্লাহর নূর (কুরআন) কখনো নিভে না, হারায় না, আড়াল হয় না।
বরং মুমিনের হৃদয়ে তা আরও উজ্জ্বল হয় যুগে যুগে।
মওদুদীর এ ধরণের বক্তব্য কুরআনের সংরক্ষণ ও আল্লাহর প্রতিশ্রুতির বিরুদ্ধে এক অন্তর্নিহিত সন্দেহ সৃষ্টি করে, যা ঈমানের দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত বিপজ্জনক।
মুমিনের কাজ হলো কুরআনের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রাখা, আল্লাহর প্রতিশ্রুতিকে নিরঙ্কুশভাবে মেনে নেওয়া, এবং কোনো মানব-রচিত মতবাদকে কুরআনের উপরে স্থান না দেওয়া।
কুরআনের রূহ হারিয়ে যায়নি, হারিয়েছেন সেইসব লোক, যারা কুরআনের চেতনা থেকে বিচ্যুত হয়েছেন।
আল্লাহর কালাম আজও আগের মতো উজ্জ্বল, অনন্তকাল পর্যন্ত থাকবে অক্ষত—
إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ —এই চিরন্তন ঘোষণা তারই সাক্ষী।
যারা বলে “কুরআনের রূহ হারিয়ে গেছে”,
আসলে তাদের নিজেদের হৃদয়ের রূহই হারিয়ে গেছে।
কুরআন নয়—কুরআনের আলো কখনো নিভে না।
