নিজস্ব প্রতিবেদন | ঢাকা, ২৯ অক্টোবর ২০২৫
একজন চিন্তাশীল আলেম সমাজে ঠিক যেমন ভূমিকা রাখেন, যেমন লবণ খাবারে রাখে — পরিমাণে কম হলেও তার প্রভাব পুরো সমাজজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, আজকের বাংলাদেশসহ গোটা মুসলিম সমাজেই এমন চিন্তাশীল, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন আলেমদের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। এই সংকটের ফলেই আমরা আমাদের বিশাল সম্ভাবনাময় ভূমিকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারছি না।
🔹 আলেম মানে শুধু ধর্মীয় শিক্ষক নয়, সমাজের চিন্তার দিশারি
একজন প্রকৃত আলেম কেবল কিতাব ও ফিকহের ব্যাখ্যাকারী নন — তিনি সমাজের বিবেক, জাতির দিকনির্দেশক। তাঁর চিন্তা, প্রজ্ঞা ও নেতৃত্ব সমাজকে ন্যায়, নৈতিকতা ও সঠিক পথে রাখে। ইসলামের ইতিহাসে দেখা যায়, চিন্তাশীল আলেমরাই সমাজের সংস্কারক ছিলেন। তাঁরা শুধু মসজিদ বা মাদরাসার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলেন না; বরং তাঁরা জাতির বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব দিয়েছেন।
আজ সেই ধারা ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে। অনেক আলেম কেবল আচারিক বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছেন; গভীর চিন্তা, সমাজ বিশ্লেষণ ও সমসাময়িক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার দক্ষতা হারাচ্ছেন।
🔹 কেন চিন্তাশীল আলেমের অভাব?
বিশ্লেষকদের মতে, এই সংকটের পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে—
-
গবেষণার অনুপস্থিতি: মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় গবেষণামূলক পড়াশোনার প্রচলন কম। ফলে আলেমদের মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক ও বিশ্লেষণধর্মী দক্ষতা গড়ে উঠছে না।
-
সমাজ বাস্তবতা থেকে দূরত্ব: অনেক আলেম সাধারণ জনগণের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা বোঝেন না, যার ফলে সমাজের সমস্যাগুলোতে তারা বাস্তবসম্মত দিকনির্দেশনা দিতে পারছেন না।
-
নতুন প্রজন্মের বিমুখতা: আধুনিক তরুণেরা আলেমদের জ্ঞান ও চিন্তার ধারায় আগ্রহ হারাচ্ছেন, কারণ তারা প্রায়ই যুগোপযোগী আলাপ ও বাস্তব জীবনের সংযোগ দেখতে পান না।
-
বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলনের অভাব: সমাজে ধর্মীয় আলোচনা প্রায়ই একমুখী হয়ে যাচ্ছে—গভীর চিন্তা, বিতর্ক, ও বিশ্লেষণমুখী আলোচনা কমে গেছে।
🔹 এই সংকটের প্রভাব সমাজে কেমন?
চিন্তাশীল আলেমের অভাবে সমাজে নৈতিক ও আদর্শিক নেতৃত্বের ঘাটতি তৈরি হচ্ছে।
👉 জাতির সমস্যাগুলোর ইসলামী সমাধান সামনে আসছে না।
👉 তরুণ প্রজন্ম বিভ্রান্ত চিন্তাধারার শিকার হচ্ছে।
👉 ধর্মীয় বিষয়ে চরমপন্থা বা অতিরিক্ত উদাসীনতা—দুই প্রবণতাই বাড়ছে।
একজন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ মন্তব্য করেন—
“চিন্তাশীল আলেম না থাকলে সমাজ দিকহীন হয়ে পড়ে। তখন ধর্মের ভাষায়ও আবেগ বেশি, জ্ঞান কম থাকে।”
🔹 কীভাবে এই সংকট কাটানো যায়?
🔸 মাদরাসা শিক্ষায় সংস্কার:
আধুনিক জ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস ও দর্শনকে ইসলামী পাঠ্যক্রমের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে।
🔸 গবেষণা সংস্কৃতি গড়ে তোলা:
আলেমদের মধ্যে গবেষণাভিত্তিক আলোচনা, প্রবন্ধ লেখা, ও বুদ্ধিবৃত্তিক সংলাপের পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
🔸 তরুণ প্রজন্মকে যুক্ত করা:
মেধাবী তরুণদের আলেমদের চিন্তা ও গবেষণায় সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে তারা ইসলামি চিন্তাধারার আধুনিক রূপ দেখতে পারে।
🔸 মিডিয়া ও সমাজে আলেমদের ইতিবাচক ভূমিকা:
ধর্মীয় প্রচার শুধু ওয়াজ বা বক্তৃতায় সীমাবদ্ধ না রেখে, সমাজের সমস্যা সমাধানে বাস্তব পদক্ষেপে অংশগ্রহণ জরুরি।
🔹 একজন চিন্তাশীল আলেম সমাজের হৃদস্পন্দনের মতো—অদৃশ্য কিন্তু অপরিহার্য। তাঁর উপস্থিতি সমাজে ভারসাম্য, চিন্তা ও নৈতিকতা বজায় রাখে।
আজ আমাদের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন এমন আলেমদের — যারা সময়ের চ্যালেঞ্জ বুঝে ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে নতুন চিন্তার দ্বার খুলতে পারেন।
যদি আমরা আজ থেকেই চিন্তাশীল আলেমদের বিকাশে মনোযোগ না দিই, তবে আমাদের সমাজ শুধু দিকহীনই হবে না, বরং আত্মিক দারিদ্র্যের গভীর গহ্বরে হারিয়ে যাবে।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সমাজে এমন চিন্তাশীল ও প্রজ্ঞাবান আলেমদের উত্থান ঘটান, যারা জাতিকে সত্যিকার অর্থে আলো দেখাতে পারবেন। 🌙
