বাংলাদেশের ধর্মীয় ও ইসলামপন্থী রাজনীতির ময়দানে “ঐক্য” একটি বহুল ব্যবহৃত কিন্তু সবচেয়ে বিতর্কিত শব্দে পরিণত হয়েছে। বিশেষত, কওমি আলেম সমাজের মধ্যে জামায়াতে ইসলামী ও মওদুদীপন্থী চিন্তাধারার প্রতি দীর্ঘদিনের বিরাগ নতুন করে আলোচনায় এসেছে। হেফাজতে ইসলামের বর্তমান আমির আল্লামা শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী (দা.বা.)-কে নিয়ে সাম্প্রতিক মন্তব্য ও অতীতের ঘটনার পুনরাবৃত্তি এ বিতর্ককে আরও জোরালো করেছে।
কওমি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত রাজনীতির বাইরে থেকেও ইসলামী সমাজে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করে। কিন্তু ২০০০ সালের দিকে জামায়াতে ইসলামী ও কওমি আলেমদের মধ্যে একাধিকবার তীব্র সংঘর্ষ ঘটে, যার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত দুটি ঘটনা হলো—
চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী পটিয়া মাদরাসা দীর্ঘদিন ধরে কওমি শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। ২০০০-এর দশকে জামায়াতপন্থী তৎকালীন মন্ত্রী আলহাজ মুজাহিদ (পরে যুদ্ধাপরাধে দণ্ডিত) মাদরাসাটির এতিমখানার প্রায় ৮০ জন শিক্ষার্থীর সরকারি অনুদান বন্ধ করে দেন বলে অভিযোগ ওঠে।
এতে মাদরাসা প্রশাসন ও আলেম সমাজে তীব্র ক্ষোভ দেখা দেয়। স্থানীয় আলেমরা তখনই বলেছিলেন —
“যারা আলেমদের অনুদান বন্ধ করে দেয়, তারা আলেমদের ঐক্যের কথা বলার নৈতিক অধিকার হারিয়েছে।”
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দাওরায়ে হাদীস প্রতিষ্ঠান আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া হাটহাজারী-তেও সংঘর্ষের ইতিহাস রয়েছে। এখানে জামায়াতের সঙ্গে কওমি ছাত্রদের একাধিকবার উত্তেজনাকর পরিস্থিতি দেখা দেয়।
সেসময় হেফাজতের সিনিয়র নেতাদের মতে, এই হামলার মূল কারণ ছিল মওদুদী মতবাদের প্রচার ও কওমি আকীদার বিরোধিতা।
একজন প্রত্যক্ষদর্শী তৎকালীন শিক্ষক বলেন—
“তারা (জামায়াত) আমাদের উলামায়ে কেরামকে ‘অসহিষ্ণু’ বলে অপমান করেছিল। অথচ তারাই অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়।”
আলেম সমাজের বৃহৎ অংশের মতে, সৈয়দ আবুল আলা মওদুদী ইসলামী শরীয়াহকে রাজনৈতিক ইদিওলজির মধ্যে সীমাবদ্ধ করেছেন।
মওদুদী তাঁর লেখনীতে নবী-রাসূলদের মিশনকে রাজনৈতিক বিপ্লবের রূপে উপস্থাপন করেন, যা কওমি ধারার মতে অত্যন্ত বিপজ্জনক একটি বিভ্রান্তি।
একজন সিনিয়র হাদীস শিক্ষক বলেন—
“মওদুদী ইসলামকে দাওয়াত ও তাযকিয়ার বদলে রাজনীতির যন্ত্রে পরিণত করেছেন। এই চিন্তা ইসলাম নয়, বরং পশ্চিমা রাজনৈতিক মতবাদের অনুকরণ।”
ফলে কওমি আলেম সমাজ মনে করেন —
মওদুদী মতবাদই ঐক্যের সবচেয়ে বড় অন্তরায়, কারণ এটি শরীয়াহ নয়, বরং দলের আনুগত্য শেখায়।
সম্প্রতি জামায়াত নেতা তাহের আহমদ এক টেলিভিশন আলোচনায় ইসলামি শরীয়াহ কায়েমের প্রশ্নে স্পষ্টভাবে বলেন,
“আমরা কোনো ধর্মীয় রাষ্ট্র চাই না, আমরা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিশ্বাস করি।”
এই বক্তব্যে আলেম সমাজে ক্ষোভের ঝড় ওঠে।
একজন মুফতি মন্তব্য করেন—
“যারা ইসলামী রাজনীতির দাবিদার, তারা যদি শরীয়াহ কায়েমের প্রশ্নে পিছিয়ে যায়, তাহলে তারা কিসের ইসলামি দল?”
অনেকে আরও বলেন, এ বক্তব্য প্রমাণ করে যে জামায়াতের রাজনৈতিক ইসলামের মুখোশের পেছনে ধর্মনিরপেক্ষতার ছায়া লুকিয়ে আছে।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যখন কওমি আলেমরা প্রকাশ্যে পূজা-পার্বণ ও ধর্মনিরপেক্ষ উন্মাদনার বিরুদ্ধে ঈমানি অবস্থান নেন, তখন কিছু জামায়াতপন্থী নেতা ও বুদ্ধিজীবী অভিযোগ তোলেন— “এতে ইসলামী ঐক্য নষ্ট হচ্ছে।”
আলেমদের প্রশ্ন,
“ঐক্য মানে কি অন্যায়ের প্রতিবাদ না করা? ইসলামের অপমান হলে চুপ থাকা? যদি প্রতিবাদ করলেই ঐক্য ভাঙে, তবে সেই ঐক্য ইসলামী নয়—রাজনৈতিক।”
আলেম সমাজ আরও প্রশ্ন তুলেছেন—
-
বাবুনগরী হযরতের ওপর গুলি চালানো হয়েছিল, তখন তারা (জামায়াতপন্থীরা) নীরব ছিলেন কেন?
-
এতিমদের অনুদান বন্ধ করা হয়েছিল, তখন ঐক্যের কথা উঠেনি কেন?
-
মওদুদী মতবাদ যখন কওমি আকীদাকে চ্যালেঞ্জ করলো, তখন প্রতিবাদ কোথায় ছিল?
এখন যখন আলেম সমাজ ইসলামবিরোধী কার্যক্রমের প্রতিবাদ করছে, তখন ঐক্যের বুলি তুলছে কেন?
একজন হেফাজত নেতা বলেন—
“যারা মওদুদী মতবাদে বিশ্বাস করে, তারা আমাদের ঈমানি ঐক্যের কথা বললে সেটা ভণ্ডামি ছাড়া কিছু নয়।”
ইসলামী ঐক্য মানে শুধু রাজনৈতিক স্লোগান নয়; এটি একটি বিশ্বাস, একটি আকীদা ও মানহাজের সমন্বয়।
যেখানে ইসলামের মৌলিক ব্যাখ্যা, শরীয়াহর শাসন ও নববী মানহাজে ভিন্নতা আছে, সেখানে “ঐক্য” কেবল বাহ্যিক সমঝোতা হতে পারে, কিন্তু আত্মিক ঐক্য নয়।
একজন সিনিয়র আলেমের ভাষায়—
“আমরা ঐক্য চাই, কিন্তু সেই ঐক্য হবে ঈমানের ভিত্তিতে; মওদুদী মতবাদের নয়। যারা ইসলামকে রাজনীতির হাতিয়ার বানিয়েছে, তাদের সাথে আমাদের পথ আলাদা।”
