বাংলাদেশের ইসলামি রাজনীতির ইতিহাসে “জামায়াতে ইসলামী” একটি আলোচিত, প্রভাবশালী এবং বিতর্কিত সংগঠন। তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি যেমন প্রশংসিত, তেমনি তাদের ভাবাদর্শ নিয়ে রয়েছে দীর্ঘ আলোচনার ইতিহাস। বিশেষত জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মওদূদী -এর চিন্তা ও দর্শন নিয়ে মুসলিম বিশ্বে যেমন সমর্থন, তেমনি সমালোচনাও রয়েছে। আজ প্রশ্ন উঠেছে—জামায়াতের আকীদাগত অবস্থান কী? তারা কি সত্যিই আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আকীদায় দৃঢ়, নাকি মওদূদীর ব্যাখ্যাভিত্তিক একটি স্বতন্ত্র ধারার অনুসারী?
🌙 ১. মওদূদী সাহেব: ব্যক্তিত্ব ও প্রভাব
সৈয়দ আবুল আ’লা মওদূদী ছিলেন ২০শ শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী মুসলিম চিন্তাবিদ। তাঁর কলমে ইসলামি রাজনীতির আধুনিক তত্ত্ব নতুন রূপ পায়। “ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা”, “খিলাফত ও মুলকিয়ত”, “তাফহিমুল কুরআন”—ইত্যাদি গ্রন্থ তাঁকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়।
তবে একই সঙ্গে তাঁর অনেক মতামত ইসলামী জগতের স্বনামধন্য ওলামায়ে কেরামের কঠোর সমালোচনার মুখে পড়ে।
দেওবন্দের মুহাদ্দিস মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী (রহ.), মাওলানা আবদুল্লাহ রূপনগরী, আল্লামা ইউসুফ বান্নুরি, আল্লামা মুফতী শফী (রহ.) প্রমুখ বহু আলেম তাঁর কিছু বক্তব্যকে কুরআন-সুন্নাহর ব্যাখ্যার পরিপন্থী বলেছেন। এমনকি পাকিস্তানের দারুল উলুম করাচির পণ্ডিত আলেমরাও তাঁকে “বুদ্ধিবাদী ব্যাখ্যার” মাধ্যমে ধর্মীয় সত্যকে বিকৃত করার অভিযোগ আনেন।
তবে ন্যায্যতার খাতিরে এটাও স্বীকার করতে হয়—মওদূদী সাহেব ইসলামের শত্রু ছিলেন না; বরং ইসলাম প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষাই ছিল তাঁর চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু তাঁর ব্যাখ্যার ধরন ও পদ্ধতি অনেক ক্ষেত্রেই প্রচলিত আকীদাগত ধারা থেকে ভিন্ন হয়ে যায়, যার ফলেই সৃষ্টি হয় মতবিরোধ।
📖 ২. “মওদূদীবাদ” বিতর্ক: বাস্তবতা নাকি অপবাদ?
অনেকেই দাবি করেন, “মওদূদীবাদ” বলে কোনো স্বতন্ত্র মতবাদ নেই; এটি কেবল সমালোচকদের দেওয়া নামমাত্র। তাদের যুক্তি হলো, মওদূদীর প্রতিটি বক্তব্য কুরআন ও সুন্নাহ থেকে যুক্তিনির্ভরভাবে প্রমাণিত।
অন্যদিকে, সমালোচকরা বলেন—যখন কোনো চিন্তাবিদ ইসলামী সূত্রকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করেন, যা পূর্ববর্তী উলামায়ে কেরামের ঐকমত্যের বিপরীত, তখন তা এক প্রকার নতুন মতবাদ বা চিন্তাধারা হয়ে দাঁড়ায়।
তারা মওদূদীর কয়েকটি বক্তব্যের উদাহরণ দেন—যেমন নবী-রাসুলদের বিষয়ে তাঁর ভাষাশৈলী, সাহাবায়ে কেরামদের রাজনৈতিক মতপার্থক্য বিশ্লেষণ, ওহীর ব্যাখ্যায় তাঁর যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি। এই জায়গাগুলোই “মওদূদীবাদ” শব্দটির জন্ম দেয়।
🕌 ৩. জামায়াতে ইসলামী ও আকীদাগত প্রশ্ন
বাংলাদেশে জামায়াতের বহু নেতা-কর্মী বলেন—“আমরা আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আকীদায় বিশ্বাসী; মওদূদীর ব্যক্তিগত মতভেদে আমরা আবদ্ধ নই।”
তাদের দাবি অনুযায়ী, সংগঠনের মূলনীতি কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমা–কিয়াসের ওপর প্রতিষ্ঠিত।
কিন্তু বাস্তব সমস্যাটি হলো—এই অবস্থান কখনও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ পায়নি। সংগঠনগত নথিপত্রে, ম্যানিফেস্টো বা বিবৃতিতে এমন কোনো ঘোষণা নেই যেখানে বলা হয়েছে,
“জামায়াতে ইসলামী আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আকীদা ও ফিকহ মাযহাব অনুসরণ করে।”
এ কারণেই উলামায়ে কেরাম ও সাধারণ জনগণের মধ্যে সন্দেহ থেকে যায়—জামায়াত কি সত্যিই ঐতিহ্যবাহী সুন্নি ধারার অনুসারী, নাকি মওদূদীর নিজস্ব চিন্তাভাবনাকেই মূল হিসেবে ধরে রেখেছে?
🧭 ৪. আকীদাগত স্বচ্ছতা কেন জরুরি
ইসলামি রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য হলো—মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু যদি আকীদা ও বিশ্বাসের ভিত্তি নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়, তাহলে ইসলামি ঐক্য কখনোই বাস্তব রূপ নিতে পারে না।
বাংলাদেশে ইসলামী দলগুলোর মধ্যে বিভাজনের অন্যতম কারণও এ আকীদাগত অস্পষ্টতা। একদল মওদূদী সাহেবকে “মুজাদ্দিদ” বলে মানেন, অন্যদল তাঁকে “বিদআত উদ্ভাবক” হিসেবে দেখেন। এই দ্বন্দ্ব ইসলামি আন্দোলনের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
যদি জামায়াতে ইসলামী সত্যিই আহলে সুন্নত আকীদায় বিশ্বাসী হয়, তাহলে তাদের উচিত হবে একটি আনুষ্ঠানিক আকীদা ঘোষণা দেওয়া—
“আমরা কুরআন ও সহিহ সুন্নাহ অনুসারী, চার ইমামের ফিকহ ও সালাফে সালেহীনের পথে অবিচল।”
এই ঘোষণার মাধ্যমে ইসলামি শক্তিগুলোর মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি দূর হবে, এবং জামায়াতের প্রতি আস্থা ফিরে আসবে।
⚖️ ৫. রাজনৈতিক বাস্তবতা ও ঐক্যের প্রশ্ন
বর্তমান বাংলাদেশে ইসলামি রাজনৈতিক শক্তি নানা কারণে বিচ্ছিন্ন। কেউ দেওবন্দীয়, কেউ আহলে হাদীস, কেউ মওদূদীবাদী—এই বিভাজনের ফলে জাতীয় রাজনীতিতে ইসলামের প্রভাব দুর্বল হয়ে পড়েছে।
যদি জামায়াত সত্যিই ইসলামী ঐক্য চায়, তাহলে তাদের উচিত—আকীদার বিষয়ে স্পষ্টতা এনে সবাইকে এক কাতারে দাঁড় করানো।
কারণ বিএনপি বা অন্য রাজনৈতিক দল যদি ইসলামি দলগুলোর মধ্যে বিভাজন তৈরি করতে চায়, তাহলে জামায়াতের একটি স্বচ্ছ আকীদা ঘোষণা সেই “রাজনৈতিক খেলা”কে মাঠে মেরে ফেলতে পারবে।
🌿 ৬. উপসংহার: সাহসী স্বীকারোক্তিই ঐক্যের সূচনা
মওদূদী সাহেব ছিলেন যুগপ্রয়োজিত এক চিন্তাবিদ। তাঁর ভালো দিক যেমন গ্রহণীয়, তেমনি ভুল ব্যাখ্যা থাকলে তা সংশোধন করাও জরুরি।
আকীদা ও বিশ্বাস এমন একটি ক্ষেত্র, যেখানে “সমঝোতা” নয়—শুধু “সত্য”ই টিকে থাকে।
আজ সময় এসেছে জামায়াতে ইসলামীকে এক নির্ভেজাল, দ্ব্যর্থহীন অবস্থান নিতে—
“আমরা আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আকীদার অনুসারী, এবং ইসলামী ঐক্যের পথে অগ্রসর।”
এই এক ঘোষণাই মুসলমানদের আস্থা ফিরিয়ে আনবে, বিভাজনের দেয়াল ভাঙবে এবং ইসলামি রাজনীতিকে প্রকৃত অর্থে নবজাগরণের পথে নিয়ে যাবে।
