📚 শিক্ষার সঙ্গে বাণিজ্য-এক আকর্ষণীয় কিন্তু বিভ্রান্তিকর স্লোগান আলেমদের দায়িত্ব ও বাস্তবতা

🌿 ভূমিকা

আজকের সমাজে নানা নতুন চিন্তা, নতুন স্লোগান ও নতুন ধারণা উঠছে। এর মধ্যে একটি প্রচলিত কথা হলো—

“আলেমরা যেন শিক্ষা ও পাঠদানের পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যেও যুক্ত হন।”

এই বক্তব্যটি প্রথমে শুনলে খুব সুন্দর ও বাস্তবসম্মত মনে হয়। মানুষ ভাবে— এতে আলেমরা স্বনির্ভর হবেন, আর্থিক কষ্ট কমবে, সমাজে মর্যাদা বাড়বে।

কিন্তু প্রশ্ন হলো— এই ভাবনাটি কি সত্যিই কল্যাণকর? নাকি এটি এমন এক চিন্তা, যা দেখতে মিষ্টি কিন্তু ভিতরে বিষময়?
গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়— এই স্লোগানটি আসলে শিক্ষার মূল কাঠামো ও দীনী মেহনতের চেতনাকে দুর্বল করার এক সূক্ষ্ম কৌশল।

⚖️ শিক্ষার উদ্দেশ্য ও বাণিজ্যের প্রকৃতি

শিক্ষা ও বাণিজ্য— উভয়ই ইসলামী সমাজে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু এদের লক্ষ্য ও প্রকৃতি সম্পূর্ণ আলাদা।

• শিক্ষা ও পাঠদান হলো এক আধ্যাত্মিক দায়িত্ব। এটি মস্তিষ্ক, হৃদয় ও আত্মার পূর্ণ মনোযোগ দাবি করে। শিক্ষক বা আলেমের কাজ কেবল জ্ঞান দেওয়া নয়, বরং চরিত্র গঠন, মননের শুদ্ধি, সমাজকে সত্য ও ন্যায়ের পথে পরিচালিত করা।

• বাণিজ্য হলো জীবিকার উপায়। এর মূল লক্ষ্য আর্থিক সাফল্য, লাভ-ক্ষতির হিসাব, বাজারের প্রতিযোগিতা ইত্যাদি।

এ দুটি ক্ষেত্রের মানসিকতা একে অপরের বিপরীত। একটিতে দুনিয়ার চিন্তা, অন্যটিতে আখিরাতের মনোযোগ।
যখন এ দুটিকে একত্র করার চেষ্টা হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই একটির ক্ষতি হয়— এবং সাধারণত ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্র।

📘 অভিজ্ঞতার আলোকে বাস্তব চিত্র

মুফতি মুহাম্মদ সালমান মনসুরপুরী সাহেব তাঁর দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বলেন—
যারা একসাথে পাঠদান ও ব্যবসা চালানোর চেষ্টা করেছেন, তাদের জীবনে দুই ধরনের ফল দেখা গেছে—

১️⃣ শিক্ষা ও পাঠদান পরিত্যাগ

অনেকে শুরুতে বলেন, “সামান্য ব্যবসা করছি, এতে শিক্ষার ক্ষতি হবে না।” কিন্তু ব্যবসা এমন এক ক্ষেত্র, যেখানে মনোযোগ ও সময় ক্রমে গ্রাস করে নেয়।
একবার বাজারে লাভ-ক্ষতির রস আস্বাদন করলে, জ্ঞানের নীরবতা আর আকর্ষণীয় মনে হয় না।
ফলে দেখা যায়—

• ক্লাসে অনুপস্থিতি বাড়ে,

• বইপত্র ধুলোমাখা পড়ে থাকে,

• ছাত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক দুর্বল হয়।
  অবশেষে শিক্ষা পুরোপুরি ত্যাগ হয়ে যায়, আর সেই “আলেম” ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত হয়ে পড়েন।

২️⃣ জ্ঞানের গভীরতা হারিয়ে ফেলা

কিছু মানুষ ব্যবসার পাশাপাশি কোনোভাবে পাঠদান চালিয়ে যান, কিন্তু তখন তাদের জ্ঞানের মান পৃষ্ঠস্থ হয়ে পড়ে।
তারা বই পড়েন, কিন্তু চিন্তা করেন না; ক্লাস নেন, কিন্তু গবেষণা করেন না।
এমন আলেমদের মধ্যে “আলিম” উপাধি থেকে “বিজনেসম্যান” চরিত্রটাই বেশি স্পষ্ট হয়।

🧠 জ্ঞানের জন্য একাগ্রতা অপরিহার্য

জ্ঞান এমন এক নদী, যাতে মন পুরোপুরি নিমজ্জিত না হলে মুক্তা পাওয়া যায় না।
যে ব্যক্তি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্যবসার চিন্তায় ব্যস্ত, রাতে হিসাব-নিকাশে মগ্ন— তার মন জ্ঞানের গভীরে প্রবেশ করতে পারে না।

শিক্ষার জগৎ দাবি করে—

• মানসিক প্রশান্তি,

• চিন্তায় একাগ্রতা,

• গবেষণার প্রতি ভালোবাসা,

• আর আত্মিক পবিত্রতা।

যখন এগুলোর জায়গায় আসে ব্যবসার উদ্বেগ, লেনদেনের হিসাব ও দুনিয়াবি চিন্তা, তখন জ্ঞানের আলো নিভে যায়।

💼 “প্রত্যেকে মহাপুরুষ হতে পারে না”

কেউ কেউ যুক্তি দেন— অতীতে অনেক আলেম ব্যবসা করতেন। যেমন— ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর কথা বলা হয়।

হ্যাঁ, তিনি ব্যবসা করতেন, কিন্তু মনে রাখতে হবে— তিনি ছিলেন ব্যতিক্রমী প্রতিভা, যার প্রতিটি মুহূর্তে আল্লাহর বরকত ছিল।
তার সময়ের সমাজ, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও শিক্ষার পরিবেশ আজকের মতো ছিল না।

আজকের যুগে, যেখানে মোবাইল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বাজারের প্রতিযোগিতা ও অর্থলোভ মানুষের চিন্তা দখল করে রেখেছে— সেখানে একজন শিক্ষক বা আলেম যদি ব্যবসায় জড়ান, তার মনোযোগ শিক্ষায় ধরে রাখা প্রায় অসম্ভব।

ব্যতিক্রম দিয়ে নিয়ম তৈরি করা যায় না। সবাই ইমাম আবু হানিফা হতে পারে না, কিন্তু সবাই সহজেই ব্যবসার দাস হয়ে যেতে পারে।

🕌 আলেম সমাজ ও মাদ্রাসার মূল দায়িত্ব

মাদ্রাসা হলো সমাজের আত্মিক কেন্দ্র, যেখানে মানুষকে দুনিয়া থেকে আখিরাতের পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত করা হয়।
সেখানে যদি শিক্ষকের মনই দুনিয়ার দিকে ঝুঁকে যায়, তাহলে ছাত্রদের মনে দীনপ্রেম জাগবে কীভাবে?

আলেম সমাজের দায়িত্ব কেবল বই পড়ানো নয়; বরং সমাজে নৈতিকতা, সততা ও আল্লাহভীতির বীজ রোপণ করা।
যখন আলেমরা ব্যবসায় মগ্ন হন, তখন সমাজে শিক্ষার মর্যাদা কমে, জ্ঞানের পরিবেশ নষ্ট হয়, এবং ধীরে ধীরে দীন শিক্ষা এক প্রকার “পেশা”তে রূপ নেয়— যা অত্যন্ত ভয়াবহ পরিণতি।

🌸 বাণিজ্য ও আত্মনির্ভরতার সঠিক পথ

এ কথা সত্য যে, আলেমদের অর্থনৈতিক কষ্ট একটি বাস্তব সমস্যা। কিন্তু এর সমাধান বাণিজ্য নয়।
বরং সমাজের দায়িত্ব—

• মাদ্রাসা ও শিক্ষকদের যথাযথ সম্মান ও আর্থিক সহায়তা দেওয়া,

• আলেমদের জন্য সম্মানজনক জীবনযাপনের সুযোগ তৈরি করা,

• এবং দীন শিক্ষাকে একটি যৌথ দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করা।

আলেম যদি ব্যবসায় নামেন, তবে তিনি আর পূর্ণ আলেম থাকেন না; আর সমাজ যদি আলেমকে সঠিক সম্মান না দেয়, তবে সেই সমাজও আলোর উৎস হারায়।

🌾 উপসংহার

শিক্ষা ও পাঠদান কেবল একটি পেশা নয়, এটি এক মহান আমানত।
একজন আলেমের সময়, মন, ও চিন্তা সম্পূর্ণভাবে দীন শিক্ষার জন্য নিবেদিত থাকা উচিত।
ব্যবসা নিজে খারাপ নয়, কিন্তু এটি যখন শিক্ষার সাথী হয়, তখন তা জ্ঞানের শত্রু হয়ে দাঁড়ায়।

“শিক্ষার সঙ্গে বাণিজ্য” নামের এই আকর্ষণীয় স্লোগান আসলে বিভ্রান্তিকর—
এটি ধীরে ধীরে আলেম সমাজের মনোযোগ ছিনিয়ে নিচ্ছে, এবং মাদ্রাসাগুলোকে জ্ঞানের পরিবর্তে জীবিকার কেন্দ্র বানিয়ে ফেলছে।

আমাদের উচিত—

• জ্ঞানের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখা,

• শিক্ষকদের একাগ্রতা সংরক্ষণ করা,

• এবং সমাজে এমন পরিবেশ তৈরি করা, যেখানে আলেমরা অর্থের চিন্তা নয়, বরং জ্ঞানের আলো ছড়াতে ব্যস্ত থাকবেন।

✒️ লেখক পরিচিতি

মুহাম্মদ কাসিদ মেওয়াতি
দারুল উলূম দেওবন্দের প্রাক্তন ছাত্র, লেখক ও গবেষক।