ঢাকা, বৃহস্পতিবার ১৩ নভেম্বর ২০২৫:
বাংলাদেশ ও পাকিস্তান রাষ্ট্রীয়ভাবে ভৌগোলিকভাবে পৃথক হলেও আত্মিক ও ইসলামী বন্ধনে তারা এখনো অখণ্ড — এই ঐক্যের কথা দৃঢ়ভাবে উচ্চারণ করেছেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম পাকিস্তানের সভাপতি মাওলানা ফজলুর রহমান।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশের স্বাধীনতা কোনো বিভাজনের প্রতীক নয়, বরং এটি মুসলিম জাতিসত্তার আত্মমর্যাদার বহিঃপ্রকাশ।”
এই মন্তব্য তিনি করেন রাজধানীর কাকরাইলস্থ ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স মিলনায়তনে আয়োজিত ‘আন্তর্জাতিক ফিদায়ে মিল্লাত কনফারেন্সে’ প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে।
সম্মেলনটি আয়োজন করে ফিদায়ে মিল্লাত ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, যেখানে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশিষ্ট ইসলামিক স্কলার, মুহাদ্দিস, মুফতি ও দাওয়াতি নেতারা অংশ নেন।
এই কনফারেন্সটি ছিল উপমহাদেশের অন্যতম প্রভাবশালী আলেম, ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের প্রাক্তন সভাপতি ফিদায়ে মিল্লাত হযরত মাওলানা সাইয়েদ আস‘আদ মাদানী (রহ.)-এর জীবন ও কর্মকে স্মরণ করার জন্য আয়োজন করা একটি আন্তর্জাতিক আয়োজন।
তাঁর ত্যাগ, নেতৃত্ব ও মুসলিম ঐক্যের জন্য অবদানের স্মৃতিচারণ করতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের দেওবন্দি আলেমরা এতে একত্রিত হন।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম পাকিস্তানের সভাপতি মাওলানা ফজলুর রহমান তাঁর বক্তব্যে বলেন,
“মানুষের প্রথম ও মৌলিক অধিকার হলো স্বাধীনতা। ভারত উপমহাদেশে স্বাধীনতার জন্য যেভাবে আলেমরা প্রাণ দিয়েছেন, তা ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে। আমার পিতা হযরত মুফতি মাহমুদ (রহ.) এবং ফিদায়ে মিল্লাত মাওলানা আস‘আদ মাদানী (রহ.) বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। তারা উভয়েই উপমহাদেশের মুসলমানদের জন্য স্বাধীনতা, ন্যায় ও আত্মমর্যাদার আন্দোলনের প্রতীক।”
তিনি আরও বলেন,
“বাংলাদেশের আলেম সমাজ ও সাধারণ মানুষ ইসলামি মূল্যবোধের প্রতি অনুগত। তাই পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ভ্রাতৃত্বের বন্ধন কখনো ছিন্ন হবে না। এই সম্পর্ক রাজনৈতিক নয়, আত্মিক ও ঈমানি বন্ধন।”
ভারতের জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সভাপতি মাওলানা সাইয়েদ মাহমুদ মাদানী আবেগঘন কণ্ঠে বলেন,
“আমার পিতা ফিদায়ে মিল্লাত মাওলানা সাইয়েদ আস‘আদ মাদানী (রহ.) ছিলেন এক সংগ্রামী ও সেবাধর্মী আলেম। ইসলাম, মানবতা ও উম্মাহর কল্যাণে তিনি যে অবদান রেখে গেছেন, তা ইতিহাসে চিরস্মরণীয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় তিনি দিল্লির রাজপথে নেমে এসেছিলেন, নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।”
তিনি বলেন,
“দেওবন্দি মিশন শুধু ভারতের নয়; এটি সমগ্র বিশ্বের মুসলমানদের ঐক্যের প্রতীক। ফিদায়ে মিল্লাত ছিলেন সেই ঐক্যের বার্তাবাহক।”
বাংলাদেশের ইসলামি নেতৃত্ব ও দেওবন্দি ধারার শীর্ষস্থানীয় আলেমরাও সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সভাপতি মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক বলেন,
“বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে দেওবন্দি চিন্তাধারার আলেমরা সবসময় নেতৃত্ব দিয়েছেন। আস‘আদ মাদানী (রহ.) ও মুফতি মাহমুদ (রহ.) ছিলেন সেই ধারার আন্তর্জাতিক রূপ। আমরা আজ সেই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা ধরে রাখছি।”
জমিয়তে উলামা বাংলাদেশের আমীর মাওলানা আলিমুদ্দিন দুর্লভপুরী বলেন,
“এই সম্মেলন প্রমাণ করেছে—উপমহাদেশের আলেম সমাজ এখনো এক সুতোয় বাঁধা। একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও দাওয়াতি বন্ধনই আমাদের শক্তি।”
সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন—
মাওলানা মওদুদ মাদানী (ভারত), মাওলানা আব্দুল গফুর হায়দারী (পাকিস্তান), মাওলানা খালেদ সিদ্দিকী এমপি (নেপাল), মাওলানা নাজমুল হাসান কাসেমী, মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী, মুফতি মনির হোসাইন কাসেমী, মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব, মাওলানা গোলাম রব্বানী, মাওলানা রশিদ বিন ওয়াক্কাস, মাওলানা ড. গোলাম মহিউদ্দিন ইকরাম, মাওলানা তৈয়বুর রহমান চৌধুরী, মাওলানা ওয়ালী উল্লাহ আরমান, মাওলানা শেখ নূরে আলম হামিদী, মুফতি রেদওয়ানুল বারী সিরাজী, মাওলানা আবুল হোসেন চতুলী, মাওলানা আবির প্রমুখ।
সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেন মাওলানা বাহাউদ্দীন যাকারিয়া এবং ফিদায়ে মিল্লাত ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান হাফেজ মাওলানা মাসরুর আহমদ।
সম্মেলনটি সঞ্চালনা করেন মুফতি ইমরানুল বারী সিরাজী, মুফতি নাছির উদ্দিন খান, মুফতি জাবের কাসেমী, ও মাওলানা সাইফুদ্দিন ইউছুফ ফাহিম।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, আজকের পৃথিবীতে মুসলমানদের বিভাজনের কারণ অজ্ঞতা ও পরস্পরবিরোধিতা। এই অবস্থায় দক্ষিণ এশিয়ার আলেমদের ঐক্যই হতে পারে বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর প্রেরণার উৎস।
তারা বলেন, ফিদায়ে মিল্লাতের জীবন আমাদের শেখায়—“ইলম, আমল ও খেদমতের মাধ্যমে উম্মাহকে এক করা।”
এই কনফারেন্স প্রমাণ করেছে যে,
- দেওবন্দি ঐতিহ্য শুধু ভারতীয় সীমার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়;
- এটি দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের মুসলমানদের জন্যও এক প্রেরণার উৎস;
- বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তান ও ভারতের শীর্ষ আলেমদের উপস্থিতি মুসলিম ঐক্যের নতুন অধ্যায় সূচনা করেছে।
