কাদিয়ানী মতবাদ
কাদিয়ানী মতবাদ সম্পর্কিত আলোচনাটি একটি ঐতিহাসিক ব্যাখ্যার উপর নির্ভরশীল। এতে আমরা কাদিয়ানী মতবাদের সূচনা, তাদের অবস্থান এবং তাদের ভাবমূর্তি সম্পর্কে সঠিক ও যথাযথ উপলব্ধি করতে পারব ইনশাআল্লাহ ।
যুগ যুগ ধরে খৃষ্টান জগত মুসলমানদের সাথে চরম শত্রুতা পোষণ করে আসছে, এ আমরা সকলেই জানি। ১০৯৯ খৃষ্টাব্দে ক্রুসেড যুদ্ধে সুলতান সালাহউদ্দীন আয়ুবীর হাতে পরাজিত হওয়ার ফলে খৃষ্টান জগতের ভ্রান্ত অহমিকার পরিসমাপ্তি ঘটে। ভুলে যায় তারা সকল শৌর্যবীর্য, আত্মগরিমার কথা। হারিয়ে ফেলে পুনরায় মুসলমানদের মোকাবিলায় রুখে দাঁড়াবার সেই কঠিন মানসিকতা। মোকাবিলার শক্তি নেই, সাহস নেই, নেই কোন হিম্মত। তথাপিও পরাজয়ের গ্লানি এবং প্রতিহিংসার দাবানলে খাক হয়ে যাচ্ছে তাদের মন। তাই প্রতিশোধ নেয়ার তীব্র প্রয়াসে আবিষ্কার করে তারা বহু চোরাগলি এবং দাঁড় করায় এ গলিতে বহু গুপ্তচর বা অরিয়েন্টালিস্টদের এক এক বিরাট জামাত। ইসলাহে মাযহাব, ইসলামে নতুন সংস্কার, ইসলাহে দীনে ইসলাম ইত্যাদি আকর্ষণীয় শ্লোগান দিতে প্রতিষ্ঠা করে তারা বহু সংস্থা ও সংগঠন। উদ্দেশ্য হল, অতি সন্তর্পণে ইসলামের মৌলিক আকীদায় কুঠারাঘাত করে মুসলমানদেরকে ধর্মচ্যুত করত তাদের নিজেদের মত এক অভিশপ্ত সম্প্রদায়ে পরিণত করা। এ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য তারা নিম্নে বর্ণিত কতিপয় কূটকৌশলের আশ্রয় নেয় :
১. তাদের ধারণা, মুসলমানদের ঈমানী দৃঢ়তার প্রধান কারণ হল তারা উলামামুখী। ছোট বড়, সাধারণ অসাধারণ সব ব্যাপারেই তারা আলিমদের শরণাপন্ন হয়। তাই তাদেরকে প্রথমে আলিমদের থেকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। এ জন্য তারা কয়েকটি পন্থা অবলম্বন করে।
ক. অরিয়েন্টালিস্টগণ মুসলমানদের মাঝে ব্যাপকভাবে প্রচার করতে থাকে যে, আল্লাহ তাআলা স্বয়ং বলেছেন: আমি কুরআনকে অত্যন্ত সহজ ও সরল ভাষায় নাযিল করেছি। সুতরাং কুরআন বুঝার জন্য আলিমনের ব্যাখ্যার কোন প্রয়োজন নেই। যে কেউ কুরআনের ব্যাখ্যা ও গবেষণা করতে পারে। পবিত্র কুরআনকে বিকৃত বা মুহাররাফ করাই হল তাদের এ বক্তব্যের মূল উদ্দেশ্য। এ হীন স্বার্থ চরিতার্থের পথে উলামায়ে কেরামই হলেন একমাত্র বাধা। তাই উল্লেখিত কৌশলের মাধ্যমে যদি এ পথ থেকে আলিমদেরকে হটিয়ে দেয়া যায় তাহলে কুরআনের তাহরীফ এবং কালামে ইলাহীকে বিকৃত করার পথ অত্যন্ত সুগম হয়ে যাবে তাদের জন্য, কথাটি নিশ্চিতভাবেই হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছিল তারা। আলিমদের থেকে মুসলিম জনসাধারণকে বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে অভিশপ্ত গুপ্তচরের দলেরা আলিমদের সম্পর্কে জনমনে ঘৃণা সৃষ্টি করতে আরম্ভ করে। তারা বলতে থাকে, এরা মোল্লা, এরা কিছু জানে না, এরা হল সমাজের জন্য বোঝা এবং এরাই হল প্রগতির পথে একমাত্র বাধা। তাই প্রগতিশীল প্রতিটি মানুষের জন্য এদের অনুকরণ এবং সঙ্গ ত্যাগ করা একান্তভাবে অপরিহার্য।
খ. অরিয়েন্টালিস্টদের বক্তব্য হল, ইসলামে ব্যক্তিপূজা নেই। আম্বিয়ায়ে কেরাম ব্যতীত কেউ সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। তাদের এ কথার মূল উদ্দেশ্য হল কুরআন ও হাদীসকে অনির্ভরযোগ্য প্রমাণ করা। কারণ, সাহাবীদেরকে যদি কোন মতে অনির্ভরযোগ্য বা গায়রে ছিকাহ প্রমাণ করা যায় তাহলে তাদের সংকলিত কুরআন এবং হাদীস ভাণ্ডারও হয়ে যাবে। অনির্ভরযোগ্য।
গ. অরিয়েন্টালিস্টদের তৃতীয় দাবীটি হল, মানুষের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে টানাহেঁচড়া করা চরম অভদ্রতা। এ মনোরম শ্লোগানের অন্তরালে তারা যেন এ কথাই বলতে চান যে, সনদের প্রয়োজনীয়তা বলতে কোন জিনিস নেই। বরং রাবী বা হাদীস বর্ণনাকারীর ব্যক্তিগত অবস্থা নিয়ে আলোচনা ও পর্যালোচনা করা নিতান্তই অভদ্রতা। তাই ভাল কথা যে কেউ বলুক না কেন তা অবশ্যই গ্রহণযোগ্য। এ যেন ভাল কথার ফাঁকে ফাঁকে অরিয়েন্টালিস্টদের বিষ মিশ্রিত ঈমান বিধ্বংসী কথাসমূহ ঢুকিয়ে দেয়ার এক দারুণ প্রবণতা। অথচ ইসলাম শিক্ষা দিয়েছে, দীন সম্পর্কিত যে কোন কথা ব্যক্তি যাচাই করেই গ্রহণ করবে।
ঘ. মুসলমানদেরকে ঈমানহারা করার জন্য আরেকটি বিষাক্ত কৌশল হল, কতিপয় দালাল তৈরি করা। যারা ইসলামের মূলোৎপাটনের জন্য উলামায়ে হক্কানীর বিপক্ষে দিবে নানা বিভ্রান্তিকর ফতোয়া এবং সৃষ্টি করবে ইসলামের মাঝে নতুন পথ ও নতুন মত। এ কাজের জন্য তৈরি করে তারা দুটি দল।
এক. এ দলটি অরিয়েন্টালিস্টদের কৃপাদৃষ্টি লাভের জন্য আযাদীপ্রিয় আলিমদের বিরুদ্ধে হামেশা নতুন নতুন ফতোয়া প্রচার করতে আরম্ভ করে। তারা বলতে থাকে, ওরা ওয়াহাবী, ওরা নজদী, ওরা বেয়াদব, ওরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি তাযীম করে না, ওরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিজেদের বড় ভাই বলে মনে করে, ওরা কাফির। এ ধরনের আরো বহু ফতোয়া, আরো বহু কথা। বর্তমানে আমাদের দেশেও এ ধরনের লোকদের পদচারণা দেখা যাচ্ছে অত্যন্ত ব্যাপকভাবে।
দুই. আযাদীপ্রিয় মুসলমানদের মন থেকে জিহাদের স্পৃহা চিরতরে নিঃশেষ করে দেয়ার লক্ষ্যে অরিয়েন্টালিস্টগণ যে দলটি দাঁড় করায় এদের কর্ণধারই হলেন মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী। জনাব মির্জা সাহের ১৮৩৯ বা ১৮৪০ খৃষ্টাব্দে পাঞ্জাবের গুরুদাসপুর জেলার কাদিয়ান নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তাই গোলামীতে পূর্ণতা বিধানের লক্ষ্যে ইংরেজ কর্তৃক নির্দেশিত হয়ে প্রথম তিনি নিজেকে মুবাল্লিগ বা ধর্মপ্রচারক বলে ঘোষণা করেন। এরপর ১৮৮৮ সনে মুবাল্লিগ পদ ত্যাগ করে তিনি নিজেকে মুজাদ্দিদ এবং মারয়াম তনয় ঈসা মসীহ বলে দাবী করেন। অবশেষে ১৯০১ সনে আরো একধাপ অগ্রসর হয়ে তিনি নিজেকে নবী বলে। ঘোষণা দেন। তৎকালীন বিজ্ঞ উলামায়ে হক্বানী তার এ মিথ্যা নবুওয়াতকে অস্বীকার করে দল মত নির্বিশেষে সকলেই তাকে কাফির বলে ফতোয়া দেন। এতে মির্জা সাহেব ক্ষান্ত হননি। বরং তিনি তার এ ভ্রান্ত দাবীকে আরো মজবুত করার জন্য কুরআন ও হাদীসের ভুল এবং মনগড়া ব্যাখ্যা দিতে আরম্ভ করেন। তিনি বলেন, আমিই হলাম কুরআনে বর্ণিত আহমদ নামের নবী। আমার উপর বিশ পারার মত কুরআন নাযিল হয়েছে। যে আমাকে মানবে না সে হারামজাদা বা জারজ সন্তান। ইসলামের অন্যতম মৌলিক আকীদা হল খতমে নবুওয়াতের আকীদা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই হলেন আখেরী নবী, তাঁর পর আর কোন নবী আসবে না, এ বিশ্বাস হল ঈমানেরই অঙ্গ। কুরআন, হাদীস, ইজমা, কিয়াস মোট কথা শরীয়তের সকল দলীলের দ্বারাই এ আকীদা প্রমাণিত। তাই মির্জা সাহেবের ইসলামবিরোধী এ মতবাদ কারো নিকট গ্রহণযোগ্য নয়।
কাদিয়ানীদের ইসলামবিরোধী আকীদাসমূহ
১. কাদিয়ানীরা বলেন, নবুওয়াতের সিলসিলা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত শেষ নয় এবং তিনি শেষ নবী নন। বরং তাঁর পরও নবুওয়াতি মিশনের কাজ চলতে থাকবে এবং চলতে থাকবে নবুওয়াতের সিলসিলা। এ দাবীর প্রেক্ষিতে মির্জা সাহেবের বক্তব্য হল, আমিও পূর্ববর্তী নবীগণের মত একজন নবী। যে ব্যক্তি আমার নবুওয়াতকে অস্বীকার করবে সে মুসলমান নয়, সে হল কাফির।
২. মির্জা গোলাম আহমদ এবং তার অনুসারীদের আকীদা হল মিথ্যা। নবুওয়াতের দাবীদার জনাব মির্জা সাহেবের উপর বারিধারার মত সর্বদাই আল্লাহর তরফ থেকে ওহী আসছে, তা কখনো আরবী ভাষায়, আবার কখনো উর্দু ভাষায়, আবার কখনো হিন্দী ভাষায়, আবার কখনো ইবরানী ভাষায়, আবার কখনো এমন ভাষায় যা বুঝে আসে না।
৩. মির্জা সাহেব এবং তার ভক্তদের ধারণা- পরকালের সফলতা এবং মুক্তি মির্জা সাহেবের তালীম ও তার উপর অবতীর্ণ শয়তানী ওহীর প্রতি ঈমান রাখার উপরই নির্ভরশীল। এ আকীদা ও বিশ্বাস ব্যতীত কোন মানুষ নাজাত লাভ করতে পারবে না। এ যেন প্লাবনকালে হযরত নূহ (আ.)-এর তরণীর মত।
৪. কাদিয়ানীদের বিশ্বাস, মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী হল আল্লাহর পক্ষ হতে মনোনীত পয়গাম্বর। যে ব্যক্তি এ আকীদা পোষণ করবে না সে জাহান্নামী, কাফির। খতমে নবুওয়াতের আকীদা অভিশপ্ত এবং মারদুদ আকীদা ৷
৫. মির্জা সাহেবের দাবী- তার মুজিযার সংখ্যা দশ লাখ এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মুজিযার সংখ্যা তিন হাজার।
৬. কাদিয়ানীদের আকীদা- মির্জা গোলাম আহমদ হযরত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সমতুল্য। বরং হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকেও আরো অধিক সম্মানিত এবং আরো অধিক মর্যাদার অধিকারী।
৭. মির্জা গোলাম আহমদ নিজেকে সমস্ত সাহাবায়ে কেরাম, হুসাইন (রা.) এবং বনী ইসরাঈলের সকল নবীদের থেকে আফযল বা শ্রেষ্ঠ বলে দাবী করে এবং বলে, মারয়াম তনয় ঈসা মসীহের কথা বাদ দাও, মির্জা গোলাম আহমদই এর থেকে শ্রেষ্ঠ।
৮. মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী হযরত ঈসা (আ.)-এর প্রতি অত্যন্ত তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ভাব প্রদর্শন করেছে এবং স্বীয় পুস্তক ও পুস্তিকাতে হযরত ঈসা (আ.)-এর প্রতি ধৃষ্টতাপূর্ণ কটুবাক্য ব্যবহার করেছে।
৯. মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী এবং তার অন্ধ ভক্তদের বিশ্বাস হল- মির্জা সাহেবই নিম্ন বর্ণিত আয়াতের মিসদাক এবং উক্ত আয়াতে আহমদ বলে তাকেই বুঝানো হয়েছে।
‘এবং (স্মরণ করুন সেই ঘটনা) যখন মারয়াম পুত্র ঈসা বলেছিল- হে বনী ইসরাঈলগণ! আমি তোমাদের নিকট আল্লাহর রাসূল, তোমাদের নিকট পূর্ব হতে যে তাওরাত রয়েছে তার সমর্থক এবং আমার পরে যে রাসূল আসবে আহমদ নামে, তার সুসংবাদদাতা। অতঃপর সে যখন তাদের কাছে সুস্পষ্ট প্রমাণ নিয়ে এলো তারা বললো, এ তো স্পষ্ট যাদু।’ ১০. মির্জা গোলাম আহমদ ও তার অনুসারীদের আকীদা- হযরত ঈসা (আ.)-এর তিনটি ভবিষ্যদ্বাণী অবাস্তব এবং মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।
১১. মির্জা সাহেব বলেন, জিহাদ একটি অমানুষিক বর্বরতাপূর্ণ কাজ। তাই কাফিরদের সাথে মোকাবিলা করা, জিহাদ করা আমার উপর হারাম করে দেয়া হয়েছে। সুতরাং আমার ধারণা, বৃটিশ সরকারের সহযোগিতা করা এবং জিহাদের অমানুষিক বর্বরতা ও হিংসাত্মক কার্যকলাপ থেকে বেঁচে থাকা সকলের জন্য অপরিহার্য।
১২. কাদিয়ানী সম্প্রদায় হযরত ঈসা (আ.)-এর যাবতীয় মুজেযা তথা মৃতকে জীবিত করা, জন্মান্ধ এবং কুষ্ঠ ব্যাধিগ্রস্তকে সুস্থ করা প্রভৃতি বিষয়গুলোকে অস্বীকার করে। তারা বলে, কলিকাতা এবং বোম্বাইতে এ ধরনের খেলাধুলা প্রচুর পরিমাণে দেখা যায়। সুতরাং ঈসা (আ.) কর্তৃক সংঘটিত কাজগুলো অলৌকিক কোন বিষয় নয়।
১৩. কিয়ামতের দিন শিঙায় ফুঁ দেয়ার পর মৃত লোকেরা কবর থেকে উঠে হাশরের ময়দানে জমা হবে, এ কথাটি কাদিয়ানী সম্প্রদায় বিশ্বাস করে না। তারা বলে, মৃত্যুর পরই জান্নাতী লোক জান্নাতে এবং জাহান্নামী লোক জাহান্নামে চলে যায়। তাই কিয়ামতের দিন কাউকে জান্নাত এবং জাহান্নাম থেকে বের করা হবে না। তবে এদিনে তাদেরকে এক স্তর থেকে অন্য স্ত রে উন্নীত করা হবে। হাশর বলতে এ কথাই মূলত বুঝানো হয়েছে।
১৪. কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের আকীদা- আরওয়াহে কাওয়াকিবের অপর নামই হল ফিরিশতা। তারা নিজস্ব স্থান ছেড়ে কখনো এ পৃথিবীতে পদার্পণ করার ক্ষমতা রাখে না। হযরত জিবরাঈলও এ পৃথিবীতে অবতীর্ণ হতে সক্ষম নয়। নক্ষত্রাত্মার জ্যোতিষ্কের এক অলৌকিক প্রভাবের নামই হল নুযুলে ওহী।
১৫. মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী তার প্রণীত কিতাবের বিভিন্ন স্থানে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি বহু অপবাদ দিয়েছে এবং বহু স্থানে আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত ওহীকে মিথ্যা বলে দাবী করেছে।
১৬. কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের আকীদা- হযরত ঈসা (আ.) মৃত্যুবরণ করেছেন। তাকে জীবিত মনে করা শিরক। কিয়ামতের পূর্বে আর কখনো তিনি এ পৃথিবীতে আসবেন না। কিয়ামতের পূর্বে এ পৃথিবীতে যে ঈসা ইবন মারয়ামের আগমনবার্তা কিতাবে পাওয়া যায়, আমিই হলাম সে ঈসা ইবন মারয়াম।
১৭. মির্জা সাহেব বলেন- দাজ্জাল খৃষ্টান পাদ্রীদেরই একটি দল এবং ইয়াজুজ-মাজুজ হল রাশিয়ার এক বিশেষ সম্প্রদায়ের নাম। আর আমিই হলাম মসীহে মাওউদ ।
পর্যালোচনা
১. ইসলামের আকীদা : কুরআন ও হাদীসের আলোকে কাদিয়ানীদের উপরোল্লিখিত সকল আকীদাই ভ্রান্ত ও ইসলামবিরোধী। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হচ্ছেন সর্বশেষ নবী ও সর্বশেষ রাসূল। তাঁর পর আর কোন নবী নেই। সমস্ত জিন ও মানুষ এবং সারা জাহানের জন্য হল তাঁর নবুওয়ত। এই বৈশিষ্ট্য এবং গুণাবলীতে এবং এই ধরনের আরো কতিপয় বৈশিষ্ট্যে তিনি নবীদের মধ্যে আফযল এবং শ্রেষ্ঠ। তাঁর রিসালাত এবং নবুওয়াতের উপর ঈমান আনা ব্যতিরেকে কারো ঈমান গ্রহণযোগ্য নয়। নবুওয়াতী সিলসিলার পরিসমাপ্তি তাঁর দ্বারাই হয়েছে। তাঁর পর থেকে নবুওয়াতের দাবীদার প্রতিটি ব্যক্তিই হল কাফির এবং ইসলামের গণ্ডি থেকে বহির্ভূত। তাই মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী এবং কাদিয়ানী সম্প্রদায় হল মুরতাদ, যিন্দিক, মুলহিদ এবং কাফির।
২. হযরত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পর থেকে ওহীর দরোজা চিরতরে বন্ধ। অন্য কারো নিকট ওহী আসার আর বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই। সুতরাং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পর নবুওয়াতের দাবীদার প্রতিটি ব্যক্তিই হল কাফির এবং মুরতাদ ।
৩. কিয়ামত পর্যন্ত আগত সমস্ত মানুষের নাজাত এবং সফলতা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর অবতীর্ণ ওহীর উপরই নির্ভরশীল। হুযুরের পর কোনো ওহীই মাদারে নাজাত নয় বা নাজাতের জন্য যথেষ্ট নয়।
৪. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পর নবুওয়াত বা রিসালাতের দাবীদার প্রতিটি ব্যক্তিই ইসলামের দায়েরা এবং ইসলামের গণ্ডি থেকে বহির্ভূত। ৫. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইস্তেকালের পর কারো থেকে কোন মুজিযা বা অলৌকিক ঘটনার বহিঃপ্রকাশ সম্ভব নয়। সুতরাং মির্জা সাহেবের মুজিযা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মুজিযা থেকে কস্মিনকালেও অধিক হতে পারে না।
৬. এ সৃষ্টি জগতের মধ্যে কেউই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সমতুল্য নয়। সুতরাং মির্জা সাহেব কি করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শ্রেষ্ঠ হবেন? এ কখনো হতেই পারে না।
৭. এ উম্মতের কোন ব্যক্তি হযরত ঈসা (আ.) এবং অন্যান্য নবীর থেকে
শ্রেষ্ঠ হতে পারেন না। অ-নবীর শ্রেষ্ঠত্ব নবীর উপর, এ কোনক্রমেই হতে পারে না। ৮. নবীদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করা ফরয। তাঁদের প্রতি তুচ্ছ- তাচ্ছিল্য ভাব প্রদর্শন করা কুফরী।
৯. নিম্নবর্ণিত আয়াতের মিসদাক একমাত্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, এ আয়াতে আহমদ বলে তাঁকেই বুঝানো হয়েছে।
‘এবং (স্মরণ করুন সেই ঘটনা) যখন মারয়াম পুত্র ঈসা বলেছিল- হে বনী ইসরাঈল! আমি তোমাদের নিকট আল্লাহর রাসূল, তোমাদের নিকট পূর্ব হতে যে তাওরাত রয়েছে তার সমর্থক এবং আমার পরে যে রাসূল আসবে আহমদ নামে, তার সুসংবাদদাতা। অতঃপর সে যখন তোমাদের কাছে সুস্পষ্ট প্রমাণ নিয়ে এলো তারা বললো- এ তো স্পষ্ট যাদু।’
১০. কোন নবীর ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা হতে পারে না।
১১. কুরআনে বর্ণিত জিহাদের হুকুম এক পবিত্র ও প্রয়োজনীয় হুকুম। জিহাদ মুসলমানদের জন্য ফরয। কতিপয় শর্ত সাপেক্ষে তা কিয়ামত পর্যন্তই ফরয হিসাবে অবশিষ্ট থাকবে।
১২. আল্লাহ তাআলা হযরত ঈসা (আ.)-এর বহু মুজেযার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। এর মধ্যে কুরআনে উল্লেখিত মৃতকে জীবিত করা, মৃত্তিকা থেকে পাখি সৃষ্টি করা এবং জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ রোগীকে সুস্থ করার ঘটনাবলী নিঃসন্দেহে সত্য এবং সুপ্রসিদ্ধ। এগুলোর সততা এবং হক্কানিয়্যাত সম্পর্কে আমরা সকলেই আস্থাশীল।
১৩. কিয়ামতের দিন শিঙায় ফুঁক দেয়ার পর এ জমিন-আসমান, পাহাড়- পর্বত সবকিছুই তুলার মত উড়তে থাকবে। মানুষ কবর থেকে উঠে হাশরের ময়দানে জমা হবে। এখানে তাদের হিসাব-নিকাশ হবে। মানুষ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে নবীদের নিকট ছুটাছুটি করতে থাকবে। কেউ তাদের জন্য সুপারিশ করবেন না। সর্বশেষ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। বহু জাহান্নামী মানুষকে তিনি সুপারিশ করে জান্নাতে প্রবেশ করার ব্যবস্থা করে দিবেন। সে পুলসিরাত কায়েম করা হবে। সকলেই এর উপর দিয়ে অতিবাহিত হবে। ইত্যাদি আরো অনেক কিছু।
১৪. ফিরিশতা আল্লাহ তাআলার আনুগত্যশীল এক সম্মানিত মাখলুক। তারা নূরের তৈরি, তারা বিভিন্ন আকৃতি ধারণ করতে পারেন। আল্লাহর হুকুম পালনার্থে তারা কখনো এ জমিনে অবতীর্ণ হয়। হযরত জিবরাঈল (আ.) হলেন ওহী বাহক। তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে আম্বিয়ায়ে কেরাম (আ.)-এর নিকট ওহী নিয়ে আসতেন।
১৫. আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি অপবাদকারী ব্যক্তি এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত ওহী মিথ্যা হওয়ার দাবীদার ব্যক্তি কাফির এবং ইসলামের গণ্ডি থেকে বহির্ভূত।
১৬. আল্লাহ তাআলা হযরত ঈসা (আ.)কে অভিশপ্ত ইহুদী সম্প্রদায়ের হাত থেকে রক্ষা করে জীবিত অবস্থায় তাঁকে আকাশে উঠিয়ে নিয়েছেন। তিনি এখনও জীবিত। কিয়ামতের পূর্বে তিনি পুনরায় এ পৃথিবীতে তাশরিফ আনবেন।
১৭. দলমত নির্বিশেষে সকল মুসলমানই এ আকীদা পোষণ করেন যে, ইহুদী নমূলের এক কানা ব্যক্তিই দাজ্জাল। তার অনুসারী সকলেই হবে ইহুদী, সে শেষ যুগে এ পৃথিবীতে এসে দারুণ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে। খোদায়ী দাবী করবে। হযরত ঈসা (আ.) দ্বিতীয়বার এসে তাকে হত্যা করবেন। ইয়াজুজ-মাজুজ দুটি বিশেষ সম্প্রদায়ের নাম। হযরত ঈসা (আ.)-এর বদদুআয় তারা এক মুহূর্তে নিঃশেষ হয়ে যাবে। তাদের মরা লাশের দুর্গন্ধে গোটা পৃথিবী তখন দুর্গন্ধযুক্ত হয়ে যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
মির্জা সাহেবের মিথ্যাবাদী হওয়ার একটি আকর্ষণীয় কাহিনী
হুশয়ারপুর নিবাসী মির্জা আহমদ বেগের একটি মেয়ে ছিল। নাম ছিল তার মুহাম্মদী বেগম। মেয়েটির প্রতি আসক্ত হয়ে তাকে বিয়ে করার জন্য মির্জা সাহেব আহমদ বেগের নিকট পয়গাম পাঠায়। আহমদ বেগ তার এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দেন। বহু প্রচেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার পর মিথ্যাবাদী মির্জা গোলাম আহমদ শঠতা ও ধোকাবাজির আশ্রয় নেয়। সে বলতে থাকে, মুহাম্মদী বেগমের সাথে আমার বিবাহের বিষয়টি আমি ওহী এবং ইলহামের মাধ্যমে জানতে পেরেছি। আল্লাহর নির্দেশেই আমি পয়গাম দিয়েছি। আল্লাহ বলেছেন, নিঃসন্দেহে মুহাম্মদী বেগমের সাথে তোমার এ বিবাহ হবেই হবে। যদি তার পরিবারের লোকেরা এ পয়গামকে উপেক্ষা করে তাহলে মুহাম্মদী বেগমসহ পরিবারের সকলেই অসহ্যকর বিপদে আক্রান্ত হবে। দীর্ঘদিন পর্যন্ত মির্জা সাহেব পত্র-পত্রিকা এবং পুস্তক-পুস্তি কার মাধ্যমে এ কথাগুলো প্রচার করতে থাকেন। ধোকাবাজ-মিথ্যাবাদীর খপ্পর থেকে মেয়েকে বাঁচানোর লক্ষ্যে মির্জা আহমদ বেগ পাত্র খোঁজে বেড়াচ্ছেন। প্রস্তাব এল সুলতান মুহম্মদ নামক এক যুবকের সম্পর্কে। আলোচনা চলছে মুহাম্মদী বেগমের বিয়ে সম্পর্কে। এ সংবাদ শুনতে পেয়ে মির্জা সাহেব দারুণভাবে ক্ষেপে যান। নিজেকে সামাল দিতে না পেরে ইলহামের দোহাই দিয়ে মিথ্যাবাদী কাদিয়ানী বলতে থাকে- যদি মুহাম্মদী বেগমের সাথে সুলতান মুহাম্মদের বিবাহ হয়ে যায়, তাহলে তাদের উপর আল্লাহর গযব অনিবার্য। আর এ গযবেই খতম হবে সুলতান মুহাম্মদ আড়াই বছর পর এবং মির্জা আহমদ বৈগ তিন বছর পর। অতএব, ইলহাম এবং ওহীর দোহাই দেয়া সত্ত্বেও মির্জা গোলাম আহমদ তাদেরকে কোন রকমেই আটকিয়ে রাখতে পারলো না। মিথ্যা ওহীর গোলক ধাঁধার তোয়াক্কা না করে সুলতান মুহাম্মদ মুহাম্মদী বেগমকে বিয়ে করে নেয় অবশেষে। বিবাহের পর চার বছর অতিবাহিত হওয়ার পর মির্জা সাহেবের ভণ্ডামী ধরা পড়ে যায় সকলের নিকট। বিপাকে পড়ে যায় ভণ্ড নবী মির্জা গোলাম আহমদ। ভক্তদের নিকট ধরা পড়ে যাওয়ার প্রবল আশংকায় পুনরায় প্রচার করতে থাকে মির্জা সাহেব মিথ্যা ইলহাম ও মিথ্যা ওহীর কথা। এবার তিনি বলতে লাগলেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন- যদিও মুহাম্মদী বেগমের সাথে সুলতান মুহাম্মদের বিয়ে সম্পন্ন হয়ে গেছে এবং এতে তোমার বিরুদ্ধাচরণকারী লোকেরা খুশি উদযাপন করছে, তথাপিও তুমি চিন্তিত হয়ো না । আমি নিজেই তাদেরকে পরাজিত করা এবং তোমার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য যথেষ্ট। স্মরণ রাখবে, সুলতান মুহাম্মদ তোমার জীবদ্দশায়ই মারা যাবে এবং এরপর মুহাম্মদী বেগম তোমার নিকাহতে আসবে। এতে বিন্দুমাত্রও সন্দেহ নেই।
আল্লাহর উপর মিথ্যা অপবাদ দেয়া সত্ত্বেও তার জীবনে মুহাম্মদী বেগমের চরণ দুটো দেখে যাওয়া সম্ভব হয়ে উঠল না। অবশেষে মুহাম্মদী বেগমের জ্বলন্ত প্রেম নিয়ে সুলতান মুহাম্মদ এবং মুহাম্মদী বেগমের আগেই তাকে এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়। অভিশপ্ত কাফির মির্জা গোলাম আহমদের মৃত্যুর পরও আল্লাহর মর্জিতে সুলতান মুহাম্মদ প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ বছর বেঁচে থাকেন।
মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী কত বড় দাজ্জাল, কায্যাব এবং মিথ্যাবাদী ছিল উল্লেখিত ঘটনা থেকেই তা অনুমান করা যায়। তাই মুসলিম সম্প্রদায়ের সকল উলামায়ে কেরাম ঐক্যবদ্ধভাবে ঘোষণা দিয়েছেন যে, মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী হল কাফির, মুরতাদ, মুলহিদ, যিন্দিক, মিথ্যাবাদী, ধোকাবাজ, প্রবঞ্চক এবং ধর্মত্যাগী। তাদের সঙ্গ ত্যাগ করা মুসলমান মাত্র সকলের জন্যই ওয়াজিব বা অপরিহার্য।