কালমার্কসের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদ
কালমার্কস হলেন বর্তমানকালের এক অমর নাম। তিনি হলেন আধুনিক কালের সর্বাপেক্ষা পরিচিত ব্যক্তি। তিনিই সমাজতন্ত্রকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে স্থাপন করে চিন্তার সীমা-রেখাকে বিস্তৃত করার প্রয়াস পেয়েছেন। তাই কালমার্কসই হলেন এ মতবাদের প্রধান প্রবর্তক।
১৮৬৭ সালে কালমার্কস তার ডাসক্যাপিটাল নামক যুগান্তকারী গ্রন্থে বিজ্ঞানসম্মত ভিত্তিতে সমাজতন্ত্রবাদের এক অভিনব ব্যাখ্যা পেশ করেন। এতে চিন্তা ও কর্মজগতে বিপুল আলোড়ন সৃষ্টি হয়। শোষিত জনগণের মনে এক নতুন আশার সঞ্চার হয়। তাই পবিত্র গ্রন্থ হিসাবে এটাকে গ্রহণ করে মার্কসের মন্ত্রশিষ্য কমিউনিস্ট জগতের লোকেরা। মার্কসীয় সমাজতান্ত্রিক মতবাদ প্রধানত তিনটি সূত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত। এর ব্যাখ্যা নিম্নে প্রদত্ত হল :
১. ইতিহাসের জড়বাদী ব্যাখ্যা ।
২. উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব।
৩. শ্ৰেণী সংগ্ৰাম মতবাদ ।
১. ইতিহাসের জড়বাদী ব্যাখ্যা : শিক্ষাগুরু দার্শনিক হেগেলের দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়ে কালমার্কস ইতিহাসকে দ্বন্দ্ববাদের দ্বারা বিশ্লেষণ করেছেন। তবে হেগেলের দ্বন্দ্ববাদের মূলে ছিল ভাবের ক্রিয়া, আর মার্কসের মতে এর মূলে রয়েছে বস্তু ও আর্থিক পরিবেশ। তার ধারণা মতে, প্রত্যেক সমাজের আইন-কানুন, রাজনৈতিক অবস্থা, নৈতিক মূল্যবোধ, শিক্ষা-সংস্কৃতি, তাহযীব-তামাদ্দুন, জীবনের মান প্রভৃতি নির্ণীত হয় তৎকালীন সমাজে প্রচলিত অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে। মার্কস বলেন, ধনোৎপাদন রীতিই সমাজ ব্যবস্থার মূল নিয়ামক এবং আর্থিক পরিবেশই মানুষের চিন্তাধারা ও আদর্শকে সার্বিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই ধনোৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে গড়ে উঠে বহু রাজনৈতিক সংগঠন। ফলে শ্রেণী বিভাগ সংগঠিত হয় সমাজ জীবনে। তখন সমাজ নতুন হতে নতুনতর পথে প্রবাহিত হয় এবং প্রতীক্ষায় থাকে এক অনাগত সমাজ জীবনের ।
২. উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব : মার্কস বলেন, উৎপাদনে যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ফলে উৎপাদন ব্যবস্থায় যে পরিবর্তন সাধিত হয়, এর ফলেই সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামোতে রূপান্তর ঘটে। কারণ, যান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় প্রচুর পরিমাণ মূলধনের প্রয়োজন হয়। এ কারণে যান্ত্রিক যুগের মূলধনে মালিক কৃষি যুগের জমিদার শ্রেণীর স্থান দখল করে নেয় এককভাবে। অর্থবলে মূলধনের মালিকগণ উৎপাদন ব্যবস্থায় একচ্ছত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার ফলে বিত্তহীন শ্রেণী অনন্যোপায় হয়ে সংস্থানের উদ্দেশ্যে মালিক শ্রেণীর নিকট নিজেদের শ্রম বিক্রি করতে বাধ্য হয়। মালিক শ্ৰেণী এ বিত্তহীন শ্রমজীবী সম্প্রদায়ের নিঃসহায় অবস্থার সুযোগ গ্রহণ করে শ্রমজীবীগণকে তাদের শ্রম দ্বারা উৎপাদিত দ্রব্যের বাজারমূল্য অপেক্ষা কম মূল্য পারিশ্রমিক হিসাবে দিতে আরম্ভ করে, অথচ শ্রমই হল একমাত্র উৎপাদনের উপাদান।
শ্রম দ্বারা উৎপাদিত দ্রব্যের বাজারমূল্য ও শ্রমিকদেরকে দেয়া মজুরীর মাঝে বিরাজমান এ পার্থক্যকেই মার্কস উদ্বৃত্ত মূল্য বলে আখ্যা দিয়েছেন। মার্কসের মতে, আধুনিক ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ধনিক শ্রেণী উদ্বৃত্ত মূল্য নিজেরাই ভোগ করে বলে বর্তমানে শ্রেণী সংগ্রাম উগ্রতার রূপ ধারণ করেছে। তাই সংঘবদ্ধ আন্দোলন চালিয়ে একদিন তারা কেড়ে নিয়ে আসবে ধনীদের হাত থেকে ক্ষমতার মসনদ। ফলে ধনতন্ত্রের কবরে রচিত হবে এক শ্রেণীহীন সমাজ ব্যবস্থা।
৩. শ্রেণী সংগ্রাম মতবাদ : কালমার্কস বলেন, সামাজিক ইতিহাস নিছক শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস। ধনী, গরীব, বিত্তশালী ও বিত্তহীনের মাঝে বিরাজমান এ সংগ্রাম আবহমানকাল থেকেই চলে আসছে অব্যাহত গতিতে ।
অর্থনৈতিক পরিবেশই হল এ দ্বন্দ্বের মূল কারণ। কেননা, ধনোৎপাদন পদ্ধতি পরিবর্তনের সাথে সাথে সমাজের মাঝে নতুন নতুন শ্রেণীর উদ্ভব হচ্ছে। এ পৃথিবীতে যাদের হাতে ধনোৎপাদন উপাদান আছে তা। অন্য শ্রেণীকে পদানত করছে ক্রমান্বয়ে। ফলে ইতিহাসের নাট্যমঞ্চে সর্বদা শ্রেণী সংগ্রামের অভিব্যক্তিই পরিলক্ষিত হচ্ছে। ইতিহাসের দিকে তাকালে এ সত্যটিই আমাদের চোখে পড়ে অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে। যেমন- গ্রীসের নাগরিকগণ দাসগণকে পদানত রেখে নিজেরা সুযোগ সুবিধা ভোগ করেছে প্রাথমিক যুগে। রোমের পেটিসিয়ানগণ প্লেবিয়নদেরকে, মধ্যযুগে সামন্তবর্গ ভূমিদাসদেরকে এবং শিল্প বিপ্লবের যুগে কলকারখানার মালিকগণ শ্রমিকদেরকে খাটিয়ে নিজেদের সমৃদ্ধি অর্জন করেছেন। এ যেন পৃথিবীর অমোঘ বিধান।
মার্কসের মতে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে শ্রমিক-মালিক বিরোধের সম্ভাবনা নিহিত রয়েছে এবং এর ধ্বংসের বীজ এতেই লুকায়িত আছে। কারণ, বিত্তশালী লোকদের হাতে সম্পদ যখন বিপুল পরিমাণে কুক্ষিগত হবে তখন এক শ্রেণীর লোক হুড়হুড় করে রাতারাতি বিত্তহীন হয়ে যাবে। ফলে শুরু হবে বিত্তশালী ও বিত্তহীন সম্প্রদায়ের মাঝে সম্পদ কুক্ষিগত করা এবং অধিকার প্রতিষ্ঠা করার অবিরাম সংগ্রাম। সাধারণত এ সংগ্রামে বিত্তহীন সম্প্রদায় ক্ষমতা দখল করে নেয়। মার্কস এ ঐতিহাসিক সূত্রটি ধরে বলেন, শ্রমিক ও পুঁজিপতি সম্প্রদায়ের মাঝে বিরাজমান এ সংগ্রাম একদিন তীব্ররূপ ধারণ করবে। তখন শ্রমিকগণ পুঁজিপতিদেরকে আঘাত করে নিজেরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবে এবং কায়েম করবে তারা তথায় শ্রমিক রাজ, অবসান ঘটবে তখন শ্রেণী সংগ্রামের। মার্কসের মতে সংগ্রামরত যুগটিকে বলা হবে বিপ্লব যুগ। আর ধনতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে যখন শ্রেণীহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে তখন এ শ্রেণীহীন অবস্থাকে বলা হবে বিপ্লবোত্তর যুগ। এ অবস্থায় আর রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা থাকবে না। আস্তে আস্তে রাষ্ট্রব্যবস্থা অন্তর্হিত হয়ে যাবে। একে মার্কসের ভাষায় সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থা বলে অভিহিত করা হয়েছে।
পর্যালোচনা
হেগেলের দ্বন্দ্ববাদের পাথায় করে তথাকথিত বৈজ্ঞানিক ভর সমাজতন্ত্রবাদকে দাঁড় করাতে গিয়ে কালমার্কস সত্যকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেছেন অত্যন্ত নগ্নভাবে। সমাজতন্ত্রের মাধ্যমে তিনি যে পৃথিবীকে স্বর্গীয় রাজ্যে পরিণত করার আকাশ-কুসুম স্বপ্ন দেখেছিলেন, বাস্তবের সাথে এর আদৌ কোন সম্পর্ক ছিল না। অধিকন্তু নৈতিকতার দিক থেকে এ থিউরী হল একেবারে অন্তসার শূন্য। তাই বিদগ্ধজনেরা মার্কস সাহেবের এ ভ্রান্তনীতির সমালোচনা করেছেন অত্যন্ত তীব্রভাবে। তার কতিপয় ভ্রান্তি নিম্নে প্রদত্ত হল :
১. মার্কসের বর্ণনা ও সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ধনতন্ত্র তার অন্তর্নিহিত বিরোধের ফলে অচিরেই ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার এ ভবিষ্যত বাণী সফল হয়নি। বরং বর্তমানে বহু পুঁজিবাদী দেশ নিজেকে সংশোধন করে পূর্বের তুলনায় আরো দ্রুত উন্নতির পথে এগিয়ে চলছে, অগ্রসর হচ্ছে ক্রমশ তথাকার শ্রমিকদের অবস্থা এবং তাদের জীবনের মান। ফলে সমাজতন্ত্রের পুরোহিত মার্কসের কথাগুলো দিন দিন অবাস্তব এবং অন্ত সারশূন্য বলে পরিস্ফুটিত হয়ে উঠছে আজকের জনমনে।
২. অর্থনৈতিক উন্নতি ও অবনতিই হল সামাজিক উন্নতি ও অবনতির মূল প্রতিবিম্ব। কাল মার্কসের এ কথাটিও ঠিক নয়। কেননা সামাজিক বিবর্তনের ক্ষেত্রে মৌলিক এবং সর্বাধিক প্রভাব রয়েছে ধর্মনীতির। যা কোনক্রমেই অস্বীকার করা যায় না। আবহমানকাল থেকে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলের নিকট স্বীকৃত এ চির সত্যটিকে অস্বীকার করে মার্কস নিজের অর্বাচীনতারই পরিচয় দিয়েছেন বৈ আর কি ।
৩. মার্কসের ভবিষ্যতবাণী হিসাবে সমাজবাদ সর্বপ্রথম ইংল্যান্ড বা জার্মানীর মত শিল্পায়িত দেশসমূহেই প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তা না হয়ে রাশিয়া ও চীনের মত কৃষিপ্রধান বা শিল্পে অনগ্রসর দেশসমূহেই প্রতিষ্ঠিত হতে দেখা যাচ্ছে। এতে মার্কসের দর্শন বাস্তবের সাথে সম্পূর্ণ অসামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
৪. ‘মানুষের ইতিহাস নিছক একটি শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস।’ মার্কসের এ কথাটিও একটু নাটকীয় বলে মনে হচ্ছে। কারণ, মানুষের ইতিহাসে শ্রেণীগত সংঘৰ্ষ যেমন সত্য পরস্পর সহযোগিতা, সহমর্মিতা, সহানুভূতি, প্রেম-ভালোবাসা এবং সৌহার্দ্যের কথাটিও এর চেয়ে অধিক সত্য। এ সমস্ত গুণাবলীই করেছে মানুষকে আদর্শস্থানীয়। আবু বকর (রা.)-এর টাকায় কত কৃতদাস মুক্তি পেয়েছে, উসমান (রা.)-এর টাকায় কত সর্বহারা স্বচ্ছল হয়ে যাকাত নিতে অস্বীকার করেছে, মানুষের খলীফা খাদ্যের বোঝা মাথায় নিয়ে কিভাবে খাবার দুর্বলের বাড়ি পৌঁছিয়ে দিয়েছেন, কিভাবে সুলতান স্বয়ং আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কাজীর কঠোর হুকুম পেয়ে কাজীকে পুরস্কৃত করেছেন, কি করে চিরশত্রুর বিরাট বাহিনীকে হাতের মুঠোয় পেয়ে মুহূর্তে ক্ষমা করে দিয়েছেন, মানব প্রেমের জয়গান গাওয়ার শিক্ষা দিতে গিয়ে মানুষ কিভাবে সানন্দে ফাঁসির মঞ্চে আরোহণ করেছেন। এরা কি এসব ইতিহাস পড়েননি? পড়বেনই বা কি করে? এসব কথা জানবার জন্য তো তাদের কোন বিধান নেই। যদি থাকত তাহলে তারা শ্রেণী সংগ্রামের উন্মাদনা জাগিয়ে দু’মুঠো ভাতের ভাওতা দিয়ে জীবশ্রেষ্ঠ মানব জাতিকে গরু-ছাগলের মত নিকৃষ্টতম পোষা জীবে পরিণত করার চক্রান্তে লিপ্ত হতো না ।
মার্কসবাদীরা মূলত মানুষের মহত্ত্ব ভুলিয়ে দিয়ে হিংস্র পাশবিকতা জাগিয়ে তুলে মানবীয় সমস্যার সমাধান কামনা করেছে। অতএব, এরা হল মানুষের শত্রু, মানবতার শত্রু। তাদের পথে কোন কামিয়াবী নেই এবং নেই কোন কল্যাণ। সুতরাং এ ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ অশান্ত পৃথিবীতে আমরা যদি কামিয়াবী চাই তাহলে আমাদেরকে পুনরায় ফিরে যেতে হবে সুন্নাতে উলার’ দিকে, ফিরে যেতে হবে মহান স্রষ্টা, প্রজ্ঞাময় আল্লাহ ও তাঁর প্রেরিত রাসূল হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহর দিকে।