ডারউইনের মতবাদ
জীববিজ্ঞান সম্বন্ধে ডারউইনের বিবর্তনবাদ জ্ঞানীজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে অত্যন্ত দারুণভাবে। ১৮৫০ সনের দিকে ইংলেন্ডের বীগল জাহাজে চড়ে ডারউইন আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যবর্তী দ্বীপপুঞ্জ এবং উপকূলবর্তী দেশগুলো ভ্রমণ করেন। তার এ ভ্রমণের মূল উদ্দেশ্য ছিল পশু ও পাখির প্রকৃতি এবং জীবনযাত্রা সম্বন্ধে গবেষণা করা। এ গবেষণার ফল হিসাবেই তার যুগান্তকারী ‘প্রজাতির উৎপত্তি’ নামক গ্রন্থখানি প্রকাশিত হয়। এর এক যুগ পর মানুষের আবির্ভাব’ নামক আলোড়ন সৃষ্টিকারী গ্রন্থখানি বিজ্ঞান জগতে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি করে। ফাটল ধরায় বৈজ্ঞানিকদের বহু চিন্তাধারা ও ব্যাখ্যায়। অনেকেই স্বীকৃতি দেয় তাকে একজন স্বার্থক যুগ প্রবর্তক হিসাবে।
মূলত ডারউইনের জৈবিক অভিব্যক্তিবাদ নতুন জাতির উদ্ভবে নিম্নলিখিত নিয়মগুলো মেনে চলে।
১. আত্মবিভাজনের সাহায্যে বংশবৃদ্ধি।
২. আকস্মিক পরিবর্তন।
৩. বংশানুক্রমে অর্জিত বৈশিষ্ট্যের সংক্রমণ।
৪. জীবন সংগ্রাম।
৫. প্রথমে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আবির্ভাব, তারপর তাদের ক্রিয়া।
→ আত্মবিভাজনের সাহায্যে বংশবৃদ্ধি। ডারউইনের মতে পৃথিবীর আদিম এক বা একাধিক কোষ নিজেকে দ্বিধা বিভক্ত করে বংশবৃদ্ধি করতে থাকে। একটি জীবকোষ নিজেকে দ্বিধা বিভক্ত করে দুটি জীবকোষে পরিণত হয়। আবার এ জীবকোষ দুটির প্রত্যেকটি নিজেদেরকে দ্বিধা বিভক্ত করে। এ আত্মবিভাজন ক্রিয়া ক্রমাগত চলতে থাকে। ফলে অসংখ্য জীবকোষের সৃষ্টি হয়। এবার এ জীবকোষগুলো অসংখ্যভাবে বংশবৃদ্ধি করতে থাকে।
> বংশানুক্রমে অর্জিত বৈশিষ্ট্যের সংক্রমণ এ সম্পর্কে ডারউইন বলেন, জীবকোষের আকস্মিক পরিবর্তন বংশানুক্রমে সংক্রামিত হয়। এ
সংক্রমণের ফলে জীবদেহে সাধিত হয় আমূল পরিবর্তন। ব্যক্তি-দেহের এ পরিবর্তন দেহের অনুকূল হলে সমস্ত জাতিই বেঁচে থাকে। কেননা, জাতি তখন জীবনযুদ্ধে জয়ী হতে পারে। আর যদি পরিবর্তন দেহের প্রতিকূল হয়। তবে কালক্রমে ব্যক্তির সঙ্গে সঙ্গে জাতিও বিলুপ্ত হয়ে যায় অতীতের অতল গহ্বরে।
→ জীবন সংগ্রাম ডারউইন মনে করেন, জগতে জীবকে বেঁচে থাকার জন্য কঠোর সংগ্রাম করতে হয়। কারণ, এ জগতে যত জীব আছে সে অনুপাতে বেঁচে থাকার উপকরণ নেই। যা আছে তা একেবারেই অপ্রতুল অপর্যাপ্ত। ফলে বেঁচে থাকার জন্য আরম্ভ হয় জীবদের ভেতরে বিরামহীন প্রতিযোগিতা। এ প্রতিযোগিতা এত তীব্র যে, স্বাভাবিকভাবেই তা দ্বন্দ্বের আকারে প্রকাশ পায়। ডারউইন এ দ্বন্দ্বের নাম দিয়েছেন জীবনযুদ্ধ বা জীবন সংগ্রাম। এ সংগ্রামে যারা জয়ী হয় প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য বিধান করে তারাই বেঁচে থাকে। তারাই হল যোগ্যতম। প্রকৃতি তাদেরকেই উপযুক্ত বলে নির্বাচন করে নেয়। তাদের জীবকোষের পরিবর্তন দেহের অনুকূলে হয়। আর যারা জীবনযুদ্ধে হেরে যায় তাদের কোষের পরিবর্তন দেহের প্রতিকূলে হয়। তারা ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে যায়। তাদের বেঁচে থাকার অধিকার থাকে না আর তখন। প্রকৃতিও তাদেরকে আর যোগ্যতম বলে মনে করে না। অবশেষে তারা হয়ে যায় ধ্বংস।
→ প্রথমে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আবির্ভাব তারপর তাদের ক্রিয়া : ডারউইন মনে করেন, জীবকোষের আকস্মিক পরিবর্তন জীবের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সৃষ্টি করে। সুতরাং বলা যায়, আকস্মিকভাবে জীবের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সৃষ্টি হয়, পরে এ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো বিভিন্ন কার্য সম্পাদনের জন্য নিযুক্ত হয়। আকস্মিকভাবেই চোখ, কান, নাক প্রভৃতির সৃষ্টি হয়। তারপর এগুলো নিজ নিজ কাজে নিযুক্ত হয়। ডারউইনের মতে, চোখের সৃষ্টির পরই তা দেখার কাজে নিযুক্ত হয়, কানের সৃষ্টির পরই তা শ্রবণ কাজে নিয়োজিত হয়। অনুরূপ অবস্থা অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বেলায়ও সত্য। তার মতে, অঙ্গ- প্রত্যঙ্গগুলোর উৎপত্তির ব্যাপারে পরিবেশের কোন প্রভাবই কার্যকর হয় না; বরং এগুলোর উৎপত্তি আকস্মিক এবং পরে এগুলোর কাজের প্রয়োজন দেখা দেয়। সুতরাং বলা যায়, প্রথমে জীবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আবির্ভাব হয়, তারপর তাদের ক্রিয়ার প্রয়োজন হয়।
ডারউইনের মতবাদের দুটি বৈশিষ্ট্য
উপরের আলোচনা থেকে ডারউইনের মতবাদের দুটি বৈশিষ্ট্য আমরা খোঁজে পাই। প্রথমত জীব জগতের ক্রমবিবর্তন বা অভিব্যক্তির মূলে কোন উদ্দেশ্য নেই এবং এর পেছনে কোন আধ্যাত্মিক শক্তিরও প্রেরণা নেই। বরং আত্মবিভাজন, জৈবিক ক্রমবিবর্তন এবং প্রাকৃতিক নির্বাচননীতি অনুযায়ীই এ পৃথিবীতে নতুন জাতির উদ্ভব হয়।
দ্বিতীয়ত অভিব্যক্তির ধারা অনুসারে কোন বিশেষ প্রাণীর বংশধরের সাথে তার সাদৃশ্য থাকলেও পূর্ণ সাদৃশ্য থাকা বৈশিষ্ট্য নয় এবং সম্ভবও নয়। যেমন- মানুষ ও বানরের মাঝে তা সম্ভব হয়নি, অথচ বানর থেকেই মানুষের উৎপত্তি।
পর্যালোচনা
ডারউইন সাহেবের এ বিবর্তনবাদী দর্শন একটি সুগভীর ও সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের ক্রমবিবর্তিত রূপ মাত্র। ষড়যন্ত্রটি হল, অভিশপ্ত ইহুদী জাতির। বারংবার ধৃষ্টতার অপরাধে লাঞ্ছিত হয়ে দুনিয়ার ডালে ডালে ফিরছিল তারা। ফলে আল্লাহ ও তাঁর বান্দাদের প্রতি জন্ম নিয়েছে তাদের মনে চরম আক্রোশ।
তাই গোটা পৃথিবী থেকে আল্লাহর নাম নিশানা মুছে ফেলে তাঁর বান্দাদেরকে জঙ্গলের বানরে পরিণত করার জন্য তারা এ ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয়। কতিপয় মূর্খ, জাহেল ও অপরিণামদর্শী ভক্তের কারণে তার এ ষড়যন্ত্র সাময়িক ও আংশিকভাবে সাফল্য লাভ করলেও চিন্তাশীল এবং বুদ্ধিমান লোকের দরবারে এ কখনো স্থান পায়নি। সমাদৃত হয়নি এ থিউরী তার সহবিজ্ঞানীদের নিকট। কারণ, তার এ মতবাদে অসংখ্য ভ্রান্তি, অত্যধিক দুর্বলতা বিদ্যমান রয়েছে। নিম্নে ডারউইনের মতবাদের অযৌক্তিক দিকগুলো তুলে ধরছি।
১. ডারউইন বলেছেন, আদিম এক বা একাধিক জীবকোষ থেকে বিবর্তন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বর্তমান জীব জগতের উৎপত্তি হয়েছে এবং জীবকোষগুলো আত্মবিভাজনের মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি করে চলছে। কিন্তু কোন্ বিশেষ নিয়মে এদের দ্বিধা বিভাজন চলছে ডারউইন তার কোন সঠিক
উত্তর দেননি। তিনি প্রকারান্তরে এখানে আকস্মিকতার কথা ভেবে নিয়মের কথা এড়িয়ে যেতে চেয়েছেন। অধিক পৃথিবীর আদি জীবকোষটিকে জীবকোষগুলোকে কে সৃষ্টি করেছেন, এর উত্তরে ডারউইন বলেন- ব ঈশ্বর পৃথিবীর বুকে প্রথমত আদি জীবকোষগুলোকে সৃষ্টি করেছেন। এখানে তিনি একটু পরোক্ষভাবে এবং হালকাভাবে খোদার অস্তিত্বে বিশ্বাস করতে চেয়েছেন। যা তার আকীদা, বিশ্বাস এবং দর্শনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
২. জীবকোষের পরিবর্তনের ক্ষেত্রে আকস্মিকতার উপর গুরুত্ব আরোপ করে ডারউইন সাহেব আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকার করার সাথে সাথে নিজের অজ্ঞতারও পরিচয় দিয়েছেন অত্যন্ত হালকাভাবে। কারণ, কোন কিছুকে আকস্মিক বলার উদ্দেশ্য বা অর্থ হল তার বাস্তব ব্যাখ্যাকে এড়িয়ে যাওয়া। আর বাস্তব ভিত্তিক কোন বস্তুর ব্যাখ্যাকে এড়িয়ে যাওয়া বা না দিতে পারাই হল মূর্খতা। সুতরাং নতুন জাতির উৎপত্তি সম্পর্কে ডারউইনের ব্যাখ্যা কোনক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয় ।
৩. “জীবকোষের আকস্মিক পরিবর্তন বংশানুক্রমে সংক্রামিত হয় বলে ডারউইন যে দাবী করেছেন তা যুক্তিসঙ্গত নয়। কারণ, মাতা-পিতার সকল বৈশিষ্ট্যই আগন্তুক সন্তানের মাঝে সংক্রামিত হতে পারে না। তাই বুঝা যাচ্ছে যে, ডারউইনের বক্তব্য হল অবাস্তব এবং কল্পনাপ্রসূত।
8, জীবন সংগ্রামকে ডারউইন সাহেব প্রাকৃতিক নির্বাচনের অন্যতম নিয়ম বলে উল্লেখ করেছেন। এ কথাটিও একেবারে অযৌক্তিক। জায়গা ও খাদ্যের জন্য জীবনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া যে কোন প্রাণীর পক্ষে সম্ভব এবং স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে প্রাণীর ভেতর যে কেবল হিংসা এবং স্বার্থ উদ্ধারের জন্য হত্যালীলাই প্রচলিত তা নয়। আত্মত্যাগ এবং গোষ্ঠীর স্বার্থ ত্যাগ ইত্যাদিও দেখা যায় তাদের মাঝে অত্যন্ত বিপুলভাবে।
৫. প্রাকৃতিক নির্বাচনের নামে ডারউইন যে কথাটি বলেছেন তাও নিছক কল্পনা বিলাস মাত্র। কেননা, তিনি প্রকৃতিতে মানব সত্তা আরোপ করে তার উপর দিয়েছেন নির্বাচনের ভার। তবে এ অচেতন প্রকৃতি কি করে নির্বাচনের কাজ আঞ্জাম দিবে তা কারো বোধগম্য নয়। কেননা, নির্বাচন হল বুদ্ধিনির্ভর প্রক্রিয়া। গ্রহণ ও বর্জনের প্রশ্ন আছে এতে। বুদ্ধি-বিবেচনা প্রয়োগ করে ভাল মন্দের যাচাই করতে হয় এ নির্বাচনের মধ্যে। কোন আকস্মিক নিয়মে এ কাজ আঞ্জাম দেয়া সম্ভব নয়। তাই বুদ্ধিহীন প্রকৃতির উপর নির্বাচনের দায়িত্ব আরোপ করে পশুবাদের প্রবর্তক জনাব ডারউইন সাহেব কী চরম জড়বোধের পরিচয় দিয়েছেন বিশ্ববাসীর নিকট।
৬. ‘জীবন সংগ্রামে জয়ী জীবই এ পৃথিবীতে টিকে থাকে’ ডারউইনের এ কথাটির মানে হল- ‘জোর যার মুল্লুক তার’। ডারউইনের এ থিউরী জঙ্গলের জীবদের জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু বিবেকসম্পন্ন জীবন মানুষের বেলায় কি তা আদৌ প্রযোজ্য? তাহলে মানুষ এ কথাটিকে জংলী বলে আখ্যা দেয় কেন? এখানেই শেষ নয়, বরং এসব বর্বরতাকে বন্ধ করার জন্য মানুষ আইন-আদালত, পুলিশ, সৈন্য, ধর্ম, রাষ্ট্র প্রভৃতি সবকিছুরই ব্যবস্থা রেখেছে এ পৃথিবীর বুকে। বিবেক বিরহিত, বিবেচনা বিবর্জিত নিছক জীবেরা এ সবের সন্ধান পাবে কোথায়? মূলত পশুবাদের অবতার জনাব ডারউইন জীবশ্রেষ্ঠ মানুষের জীবোত্তর বৈশিষ্ট্যটি তাহকীক করার বা তলিয়ে দেখার সুযোগ পাননি জীবনে।
তাই তিনি আবহমান কালের জাতি ধর্ম নির্বিশেষে গোটা মানবের ন্যায়- অন্যায়, পাপ-পুণ্য, ভাল-মন্দ, ইহকাল-পরকাল প্রভৃতি বিষয়ের ধ্যান- ধারণার মূলে কুঠারাঘাত করে বসলেন অবলীলায়। বস্তুত এসব নীতিমালা হল মানব সন্তানের জন্য। পশুর জঙ্গলে এ সবের প্রয়োজন কোথায়? তাই তাদের থেকে কোন ভাল কিছুর আশা করা বলদ কিনে দুধ খাওয়ার আশা করার মতই। বলদ থেকে যেমন দুধ খাওয়ার আশা করা যায় না, ডারউইনের থেকেও তেমন ভাল কথার আশা করা যায় না।
বিবর্তনবাদের এসব অসারতা এবং অযৌক্তিকতা সত্ত্বেও আমাদের যুব মানসিকতা আজ বিভ্রান্ত। তারা আজ গতিহারা, তারা আজ সন্ধিহান। এহেন বিভ্রান্তিকর নাযুক পরিস্থিতিতে সৃষ্টিতত্ত্ব, মানুষ ও সমাজকে পরিচালনা করা আমাদের জন্য একান্ত কর্তব্য। আর এ সম্পর্কে সহীহ, সঠিক এবং বিশুদ্ধতম তথ্য পরিবেশন করেছেন যুগে যুগে আগত আল্লাহ প্রেরিত হযরাত আম্বিয়ায়ে কিরাম আলাইহিমুসালাতু ওয়াস সালাম ।
আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে কুরআন ও মনীষীদের বাণী
ডারউইনের বিবর্তনবাদ প্রমাণ করেছে যে, যাবতীয় সৃষ্টি নিতান্ত নীচু স্তর হতে উন্নতি লাভ করে বর্তমান অবস্থায় উপনীত হয়েছে। যে মানব জাতি সৃষ্টির সেরা তা ছিল নীচ ধরনের প্রাণী বিশেষ। পরে উন্নতি লাভ করে বানরের সীমারেখায় উপনীত হয়। অতঃপর তা তাদের আকার অতিক্রম করে মানুষে পরিণত হয়। এতে বুঝা যাচ্ছে যে, এ পৃথিবীর সৃষ্টির মূে কোনই উদ্দেশ্য নেই এবং এর পেছনে কোন আধ্যাত্মিক শক্তিরও প্রেরণা নেই ।
ডারউইনের এ কথা সম্পূর্ণভাবেই অবাস্তব। কারণ, যে যুগ থেকে পৃথিবীর ইতিহাস শুরু হয়েছে সে যুগ থেকেই মানুষ আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করে আসছে অব্যাহত গতিতে। আসুরী, মিসরী, কালদানী, ইহুদী সবাই আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাসী ছিল। এ বিষয়টি বর্ণনা করে কুরআন বলছে- আল্লাহ যখন বনী আদমের পিঠ থেকে তাদের বংশ নির্গত করলেন এবং তাদেরকেই তাদের উপর সাক্ষী করে বললেন- ‘আমি কি তোমাদের আল্লাহ নই? তখন সবাই বলে উঠলো- হ্যাঁ, আমরা সাক্ষী রইলাম। [আরাফ : ১৭২ নং আয়াত]
অনেক সময় বাহ্যিক কারণে আল্লাহর অস্তিত্বের এ অনুভূতিটি চাপা পড়ে যায়। তাই আল্লাহ বিভিন্ন স্থানে তাঁর প্রাকৃতিক আইন-কানুন ও নিয়ন্ত্রণের কথা স্মরণ করিয়ে বলেন-
হে মানুষ! পুনরুত্থান সম্বন্ধে যদি তোমরা সন্ধিগ্ধ হও, তবে অবধান কর, আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি মৃত্তিকা হতে, তারপর শুক্র হতে, তারপর আলাকা হতে, তারপর পূর্ণাকৃতি অথবা অপূর্ণাকৃতি মাংসপিণ্ড হতে, তোমাদের নিকট ব্যক্ত করার জন্য, আমি যা ইচ্ছা করি তা এক নির্দিষ্টকালের জন্য। মাতৃগর্ভে স্থির রাখি, তারপর আমি তোমাদেরকে শিশুরূপে বের করি, পরে যাতে তোমরা পরিণত বয়সে উপনীত হও। তোমাদের মাঝে কারো কারো মৃত্যু ঘটানো হয় এবং তোমাদের মধ্যে কাউকে প্রত্যাবৃত্ত করা হয় হীনতম বয়সে, যার ফলে তারা যা জানতো সে সম্বন্ধেও তারা আর সজ্ঞান থাকে না। তুমি ভূমিকে দেখ শুষ্ক, অতঃপর তাতে আমি বারি বর্ষণ করলে শস্য শ্যামল হয়ে আন্দোলিত ও স্ফীত হয় এবং উদ্গাত করে সর্বপ্রকার নয়নাভিরাম উদ্ভিদ। [সূরা হাজ্জ : ৫ নং আয়াত]
এ আয়াতের দ্বারা সুস্পষ্টভাবে বুঝা যাচ্ছে যে, জীব শ্রেষ্ঠ মানুষের উৎপত্তি এবং তাদের বংশবৃদ্ধি আকস্মিক এ্যাক্সিডেন্টের বহিঃপ্রকাশ নয়; বরং এর পেছনে রয়েছে বিরাট সৃষ্টি রহস্য ও সুদূরপ্রসারী আধ্যাত্মিক পরিকল্পনা।
অধিকন্তু এ বিশাল পৃথিবীও আল্লাহর অস্তিত্ব এবং একত্ববাদের জ্বলন্ত প্রমাণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের সামনে। সত্য অনুসন্ধানের মানসিকতা নিয়ে এ পৃথিবীর প্রতি গভীরভাবে নজর করলেও ডারউইন এবং তার শিষ্যদের নিকট এ বিষয়টি অস্পষ্ট থাকত না। কারণ, মানুষ যখন কোন বস্তুকে সুন্দর ও সুশৃঙ্খল দেখতে পায় তখন সে এ কথা বিশ্বাস করে যে, নিশ্চয়ই কোন সুদক্ষ শিল্পী বা কোন বুদ্ধিমান সত্তাই এটি শৃঙ্খলাবদ্ধ করেছেন। স্বতঃস্ফূর্তভাবে এমনিতেই এটি শৃঙ্খলাবদ্ধ এবং নিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়নি। তাহলে বুঝা যাচ্ছে যে, যে বিশ্ব এত সুন্দরভাবে নিয়ন্ত্রিত এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ তাও এমনি করে হয়ে যায়নি। বরং এর পেছনেও রয়েছে এক সুদক্ষ শিল্পীর অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ। কুরআন মজীদে এ সুনিয়ন্ত্রণের কথা উল্লেখ করে নিয়ন্ত্রণকারী সত্তার অস্তিত্বের উপর জোরালো ভাষায় প্রমাণ পেশ করা হয়েছে।
‘(আল্লাহর কারিগরি দেখ) যিনি সৃষ্টি করেছেন স্তরে স্তরে সপ্তাকাশ, দয়াময় আল্লাহর সৃষ্টিতে তুমি কোন খুঁত দেখতে পাবে না। আবার তাকিয়ে দেখ, কোন ত্রুটি দেখতে পাও কি না? অতঃপর তুমি বারবার দৃষ্টি ফিরাও, সে দৃষ্টি ব্যর্থ হয়ে তোমার দিকেই ফিরে আসবে।’
এ আয়াতের দ্বারাও পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে যে, এ পৃথিবী পূর্ণাঙ্গভাবে চিরনিয়ন্ত্রিত, স্বতঃস্ফূর্তভাবে সৃষ্ট নয় বরং কোন শক্তিমান সত্তাই তা সৃষ্টি করেছেন।
বর্তমান যুগ বিজ্ঞান ও গবেষণার যুগ। গবেষণা আজ বহু দূর পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছে। বিশ্বের শত শত রহস্য উদ্ঘাটিত হয়েছে, অনেক সত্য ঘোমটা ফেলে আত্মপ্রকাশ করেছে। জন্ম দিয়েছে বড় বড় দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক । তারাও বহু চিন্তা-ভাবনার পর আল্লাহর অস্তিত্ব এবং একত্ববাদের কথা স্বীকার করেছেন, যা দীর্ঘ চৌদ্দশ’ বছর পূর্বে কুরআন মজীদ অত্যন্ত সাদাসিধে ভাষায় পেশ করেছিল।
নিউটন বলেন, বিশ্বের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের উপর দিয়ে স্থান ও কালের হাজার হাজার বিপ্লব অতিক্রম করেছে। তা সত্ত্বেও তাতে যে শৃঙ্খলা ও সুনিয়ন্ত্রণ পরিলক্ষিত হয় তা একজন নিয়ন্ত্রক ছাড়া সম্ভব নয়। এ নিয়ন্ত্রকই হলেন সর্বাদি সত্তা, জ্ঞানবান ও শক্তিমান মহান আল্লাহ ।
এ কালের সবচেয়ে বড় দার্শনিক হার্বাট স্পেন্সার বলেন, এ রহস্যগুলো নিয়ে যতই চিন্তা-ভাবনা করি ততই তা সূক্ষ্ম বলে মনে হয়। এতে নিশ্চিত বুঝা যায় যে, মানুষের উপর এমন একটি চিরন্তন এবং চিরস্থায়ী ক্ষমতা রয়েছে যেখান থেকে হয়েছে সকল বস্তুর উৎপত্তি।
ক্যামিল গ্লামারিয়ন বলেন, কোন শিক্ষাগুরুই এটা বুঝতে পারছে না যে, বিশ্বের অস্তিত্ব কি করে হল এবং কিভাবে তা অটুট রয়েছে। বাধ্য হয়ে তারা এমন একজন স্রষ্টা স্বীকার করে নিলেন, যিনি সদা বিরাজমান ও সক্রিয়।
অধ্যাপক লিনি বলেন, শক্তিমান ও বুদ্ধিমান আল্লাহ নিজ অদ্ভূত কারিগরির মহিমা নিয়ে আমার সামনে এভাবে উদ্ভাসিত হল যে, আমার চোখ দুটি তাঁর প্রতি পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে এবং আমি পুরোপুরি তন্ময় হয়ে পড়ি। প্রত্যেকটি বস্তুতেই, তা যতই ছোট হোক না কেন, তাঁর অদ্ভুত শক্তি, আশ্চর্য কৌশল ও বিচিত্র অনবৈদ্যতা পরিলক্ষিত হয়।
ফুন্টন বিশ্বকোষে বলেন, আমাদের জ্ঞানপিপাসা নিবারণ করাই পদার্থবিদ্যার একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। এর মহৎ উদ্দেশ্য হল বুদ্ধি সজ্ঞাত দৃষ্টি দিয়ে বিশ্ব স্রষ্টার মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব উদ্ঘাটনে নিজেদেরকে উদ্বুদ্ধ করা।
তাই আমাদের আকীদা হল, এ মহাবিশ্বের অবশ্যই একজন সৃষ্টিকর্তা রয়েছেন। তিনি অনাদি, অনন্ত। তাঁর অস্তিত্ব সন্দেহাতীত ও অবশ্যম্ভাবী। তাঁর না থাকা অসম্ভব। প্রশংসনীয় সব গুণাবলী দ্বারা তিনি মণ্ডিত ও সব ধরনের দোষ ও ত্রুটি থেকে তিনি পবিত্র ও মুক্ত। সকল কিছুই তাঁর জ্ঞানের আওতাভুক্ত। সকল সম্ভাব্য বস্তুর উপর তিনি ক্ষমতাশীল। সকল সৃষ্টি তাঁর ইচ্ছায় আবর্তিত। তিনি সর্বশ্রোতা, তিনি সম্যক দ্রষ্টা, তাঁর কোন উদাহরণ নেই। তাঁর কোন প্রতিদ্বন্দ্বি নেই এবং কোন সহযোগীও নেই। তাঁর নযীর নেই কিছুই, তিনিই হলেন বে-মিছাল। তাঁর অবশ্যম্ভাবী ও নিত্য অস্তিত্বে, ইবাদত ও উপাসনা লাভের অধিকারে, বিশ্বজাহানের শৃঙ্খলা বিধান ও সবকিছুর পোষণে কেউ বা কোন কিছুই তাঁর শরীক নেই, সহকারী নেই। ইবাদত ও চূড়ান্ত সম্মান প্রদর্শন এবং পবিত্রতার অধিকারী কেবল তিনিই। তিনি অসুস্থকে সুস্থ করেন, সকল সৃষ্ট বস্তুর রিযিক দান করেন, সবকিছুর অসুবিধা ও কষ্ট দূর করেন। আল্লাহ তাআলা অন্য কোন সত্তায় প্রবিষ্ট ও একীভূত হওয়া থেকে পবিত্র, তিনি তাঁর সত্তা ও গুণাবলী সবকিছুতেই অনিত্যতা ও আদিত্ব থেকে মুক্ত তিনি জওহার আর নন। তিনি দেহ বিশিষ্ট নন এবং কোন দিক বা স্থানের গণ্ডিতেও আবদ্ধ নন, তিনি আছেন আরশের উপর। কিয়ামতের পর তাঁর দীদার হবে মুমিনদের। তিনি যা চান তা হয়, যা চান না তা হয় না। তিনি অনপেক্ষ, কোন কিছুর মুখাপেক্ষী নন। তাঁর উপর কারো আইন, কারো নির্দেশ চলে না। তাঁর নিজ কাজ সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হয় না। কিছু করা তাঁর জন্য অবশ্য কর্তব্য নয়। তাঁর প্রতিটি কাজই হিকমতপূর্ণ এবং প্রজ্ঞাসম্পন্ন, তিনি ব্যতীত যথার্থ কোন নির্দেশদাতা নেই, নেই কোন হাকিম। তকদীর, ভাল মন্দ সবকিছু আল্লাহর তরফ থেকেই আসে, তাঁর অন্তহীন ও অসীম নিজস্ব জ্ঞান যা কিছু ঘটছে বা ঘটবে সবকিছুই বেষ্টন করে আছে। সকল বিষয়কেই ঘটবার পূর্বে ঘটবার যোগ্য করেন তিনি।