ফ্রয়েডের কাম সর্বস্ববাদ বা যৌনবাদ
অস্ট্রিয়ার বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েডের কামসর্বস্ববাদ বা যৌনবাদ সকল জ্ঞানীজনের নিকটই সুপরিচিত। মন কি, মনের প্রকৃত স্বরূপ কি? এ সবের বিশ্লেষণে আধুনিক জগতে যে সব প্রক্রিয়া চালানো হয়েছে, এ সবের মাঝে ফ্রয়েডের চিন্তাধারা হল অভিনব। মনকে চেতনাশীল মানসিক প্রক্রিয়া বা বিবেকসম্পন্ন বলে এতদিন যে মতবাদগুলো প্রচলিত ছিল ফ্রয়েড সেগুলোর বাইরে মনের আরেকটি নতুন দিকের সন্ধান দিলেন। এ দিকটি হল মনের অচেতন বুদ্ধিহীন দিক। ফ্রয়েড এবং তার অনুসারীদের মতে মন শুধু কতক চেতনা, প্রতীতিবোধ এবং বিবেক ইত্যাদি সম্পন্ন প্রক্রিয়ার সমষ্টি নয়। মন চিন্তাশীল আধ্যাত্মিক দ্রব্যও নয় বরং মন হল রহস্যময় সমুদ্র তলদেশের ন্যায়। ফ্রয়েডের মতে মনের উপরিভাগের প্রতি লক্ষ্য করে মনের রহস্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব নয়। বরং রহস্য উদ্ঘাটন করতে হলে আমাদেরকে আরো গভীরে যেতে হবে অর্থাৎ মনের অচেতন ও অজ্ঞান ভাগের গভীরে। কারণ, চেতনের চেয়ে অচেতন অনেক গভীর ও সুবিস্তৃত। ফ্রয়েডের মতে বিবেকের চেয়ে আবেগ বেশি অর্থপূর্ণ। তার মতে মানুষের শিক্ষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতির মূলে রয়েছে শুধুমাত্র কাম। তবে বিবেক যেহেতু সর্বদা পাহারাদারের মত টহল দিচ্ছে তাই আমরা অশোভন কাজ ও অন্যায় আচরণ থেকে অনেকটা বিরত থাকি। ফলে বাইরে বাইরে আমরা যথেষ্ট 1 ভদ্র এবং মার্জিত কিন্তু বিবেকের শাসনে আমরা জোর করে ভদ্র হয়ে উঠি। ফলে আমরা আমাদের অনেক কামনা, বাসনা ও ইচ্ছাকে অবদমন করি এবং ঠেলে দেই এগুলোকে মনের গভীরে। সেখানে এগুলো সৃষ্টি করে নানা অশান্তি। পরিশেষে সাইকসিস, নিউরোসিস, হিসটেরিয়া এবং আরো অনেক অশান্তিকর মানসিক রোগে ভোগতে শুরু করি আমরা অত্যন্ত ভীষণভাবে। ফ্রয়েড এ মানসিক রোগের বর্ণনা ও চিকিৎসার জন্য মনঃসমীক্ষণ নামে এক বিশেষ পদ্ধতির কথা উল্লেখ করেন এবং সমীক্ষণে মনের তিনটি স্তরের বর্ণনা করেন। যথা : ১. চেতন (কনসাচ), ২. প্রাকচেতন (প্রি-কনসাচ) ও ৩. অচেতন (আনকনসাচ)। তার মতে অন্য দিক থেকেও মনকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। ফ্রয়েড বলেন, শিক্ষা ও কৃষ্টির বিরোধী সচেতন ইচ্ছাগুলো অবদমনের ফলে অচেতন মনে নির্বাসিত হয়ে অজ্ঞাতভাবে বাস করতে থাকে যার সম্পর্কে আমরা অবগত নই। মূলত এসব ইচ্ছা ও প্রয়াসগুলো হল কামজ বা যৌন। এদের সমষ্টিকে ফ্রয়েড বলেন ‘ঈদ’। ঈদ অন্ধভাবে কামজ ইচ্ছাগুলোকে সচেতন মনে প্রকাশ করতে সর্বদা সচেষ্ট। তার মানে ছোট ছোট শিশুরাও আত্মকামী। কারণ, তাদের শরীরে কামকেন্দ্র বিদ্যমান রয়েছে। এ কারণেই আদর, সোহাগ করাতে তারা আংশিকভাবে কামতৃপ্তি লাভ করে এবং আনন্দ উপভোগ করে। এমনকি দুধের শিশুরাও কামভাবের তাগিদেই দুগ্ধপান করার সময় মাতৃস্তন্য স্পর্শ করে থাকে। এ জন্যই আমরা ছেলেদেরকে পিতৃবিদ্বেষী এবং মেয়েদেরকে পিতৃসঙ্গ কামনা করতে দেখতে পাই।
ফ্রয়েডের মতে, মনের আরেকটি অংশের প্রধান প্রচেষ্টা হল আত্মরক্ষা করা। এর নাম হল ‘ইগো’। ‘ঈদ’ এবং ‘ইগো’র অতিরিক্ত মনের তৃতীয় স্ত রটির নাম হল বিবেক বা সুপার ইগো। এ বিবেককে আবার কনসায়েন্স, ইগো-আইডিয়্যাল বা সেন্সর নামে অভিহিত করা হয়। এর কাজ ঈদের অন্ধ ইচ্ছাগুলোকে দমন করা। বস্তুত ইগোর অবস্থাটি সঙ্গীন। একে ঈদের প্রবল চাপ এবং বিবেকের শাসন সহ্য করতে হয়। ফ্রয়েড বলেন, আত্মরক্ষার জন্য ইগোর উপরোক্ত দুটি মনিবকেই সন্তুষ্ট রাখতে হয়।
এসব অযৌক্তিক বৈজ্ঞানিক থিউরী অবতারণা করে ফ্রয়েড এ কথাই প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, মানুষ তার আদি কাম দ্বারা পরিচালিত। তাই জীবন সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে মানুষের জন্য কামজ ও যৌন স্বাধীনতা একান্ত ভাবে অপরিহার্য। এর জন্যই ছিল তার সংগ্রাম ও সাধনা।
পর্যালোচনা
ফ্রয়েডের এ কথাগুলো তার শিষ্যদের নিকট স্বর্গীয় বাণী হিসাবে সমাদৃত হলেও পরবর্তী বিজ্ঞানীদের মনে তেমন কোন আকর্ষণ সৃষ্টি করতে পারেনি। বরং কার্লং এবং এ্যাডলরের বিশ্লেষণে এতে নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরা পড়েছে। নিম্নে এর কয়েকটি উদাহরণ পেশ করা গেল।
১. ঈদ, ইগো ও সুপার ইগো এ তিনভাগে মনকে বিভক্ত করে ফ্রয়েড মনের যে ব্যাখ্যা দিতে চেয়েছেন এগুলো শুধু কেবল তার কল্পনা এবং অনুমান মাত্র। এ অনুমানের ভিত্তিতে তিনি চেয়েছিলেন কতগুলো বাস্তব ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে, তিনি তা পারেননি। মূলত ফ্রয়েড কোন মনোদর্শন সম্পর্কে আলোচনা করেননি। তিনি কেবল মনের বিষয়গুলো দিয়ে মনকে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছিলেন, এই যা। তিনি মনের আলোচনায় যৌন কামনাকেই অধিক প্রাধান্য দিয়েছেন। কাজেই অভিনব হলেও মনের স্বরূপ সম্পর্কে তার আলোচনাকে আমরা মেনে নিতে পারি না।
২. অন্তর্হিত বাসনা মাত্রই যে কামজ বা যৌন, এ কথাও ঠিক নয়। কেননা, এগুলো কামজ না হয়ে নানাবিধ বাসনাও হতে পারে যার সম্পর্কে আমরা সকলেই জ্ঞাত। এ সত্যটি অস্বীকার করে ফ্রয়েড শুধু কেবল সত্যের অবমাননাই করেননি বরং চরম ধৃষ্টতাও প্রদর্শন করেছেন।
৩. ‘মানুষ আদি কাম দ্বারা পরিচালিত’ ফ্রয়েডের এ কথার দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, অবদমন শক্তিগুলোর উৎপত্তিও আদি কাম থেকেই। কিন্তু এ তো কখনো হতে পারে না। কারণ, পাপ থেকে জন্ম নিয়ে পাপ বাসনাগুলোকে অবদমন করা চোরের মুখে ধর্মের কাহিনী বলার মতই আজগুবি ব্যাপার। আর যদি বলা হয় যে, পাপ বাসনা থেকে এগুলোর উৎপত্তি নয় বরং অর্থনৈতিক পারিপার্শ্বিক বা জীবনযুদ্ধের প্রয়োজনে এগুলোর উৎপত্তি, তাহলে মানব জীবনে কাম ব্যতীত আরো নানাবিধ ফ্যাক্টর কার্যকরী বলে স্বীকার করে নিতে হয় অকপটে। এতে স্ব-বিরোধিতাই করতে হচ্ছে। অবশেষে ফ্রয়েডের কথা গ্রহণযোগ্য নয়।
৪. পশুবাদ ও বানরবাদের প্রবর্তক ডারউইন যেন পরোক্ষভাবে এ কথাটিই বলতে চেয়েছিলেন যে, মানবেতর জীব বানরের মাঝে যেমন মা, বোন, খালা, ফুফু, নানী, দাদীর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই অনুরূপভাবে জীবশ্রেষ্ঠ মানুষের মাঝেও এ পার্থক্য জিইয়ে রাখার কোন প্রয়োজন নেই। তবে সময়ের অভাবে তিনি এ কথাটি বলে যেতে পারেননি। পরে তারই আশীর্বাদে যৌনবাদের অবতার হিসাবে এ পৃথিবীতে আবির্ভূত হন জনাব ফ্রয়েড সাহেব। আবহমান কাল থেকে মানুষ যা ভেবেছে মাথা দিয়ে, কালমার্কস তা ভেবেছিলেন পেট দিয়ে, আর ফ্রয়েড ভাবলেন আরো এক ধাপ নিচে এসে। সন্দেহ নেই মানুষ মাথা দিয়ে ভাবে, জীবেরা পেটের তাগাদায় চলে, আর তারও নীচের তাড়নায় উন্মাদ হয়ে ছুটে ষাঁড়ের পালেরা। ফ্রয়েডের এ থিউরী জংলী জানোয়ারদের জন্য তো প্রযোজ্য। আশরাফুল মাখলুকাত সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের জন্যও কি প্রযোজ্য? ব্রুয়েডিয়ানদের এহেন ধর্মহীন মতাদর্শ এবং যৌনবাদের অভিশাপে আজ সারা পৃথিবী অভিশপ্ত। কলুষিত আজ বিশ্বমানবতা, ধর্ষণের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হয়ে দেশে দেশে মহিলারা মিছিল নিয়ে ঘুরছে। কেউ তাদের ইজ্জতের নিশ্চয়তা দিতে পারছে না, আর পারবেও না ।
তাই মনোবিজ্ঞানের অন্তরালে যৌন স্বাধীনতাকামী লোকদের কথায় কান দেয়া আমাদের জন্য সমীচীন নয়। আর মন কি ও মনের হাকীকত কি? এ পর্যায়ে সঠিক ব্যাখ্যা লাভ করতে হলে আমাদেরকে যেতে হবে মনের খালেক আল্লাহ পাক এবং ইলমে ওহীর অন্যতম বাহক হযরত আম্বিয়া আলাইহিমুস্ সালাম ও তাঁদের যোগ্য উত্তরসুরীদের নিকট, তাঁরাই দিতে পারেন এ সম্পর্কে সঠিক এবং নির্ভরযোগ্য তথ্য ।
মনের হাকীকত এবং যৌন সংযমশীলতা
শ্রেষ্ঠ দার্শনিক ইমাম গাযালী (রহ.) বলেন, কুরআন ও হাদীসে সাধারণত মন বলে দুটি বস্তুকেই বুঝান হয়েছে। প্রথমত বুকের বাম দিকে রক্ষিত গাঁজর সদৃশ গোশতের টুকরাটিকেও মন বলা হয়েছে। আর দ্বিতীয়ত রব্বানী বা রূহানী লতীফাকে মন বলে অভিহিত করা হয়েছে। তবে এ দুয়ের মাঝে রূহানী লতীফাটিই হল আসল। এটিই হল উপলব্ধি, অনুভূতি এবং জ্ঞান লাভের মাধ্যম বা যরীয়া এবং এই হল উপহাস, পরিহাস ও সম্বোধনের একমাত্র উপযোগী সত্তা। তবে এ রূহানী লতীফার সাথে ঐ গোশতের টুকরাটির রয়েছে বিরাট যোগসূত্র। ফলে একটি অপরটি থেকে বিচ্ছিন্ন হয় না কখনো।
ইমাম গাযালীর মতে মনের অবস্থা খুব সঙ্গীন। কারণ, বিবেক ও কামনা এতদুভয়ই এতে বিদ্যমান। প্রত্যেকেরই রয়েছে সুসজ্জিত বিরাট বাহিনী। সর্বদাই এ দুই-এর মাঝে সংঘর্ষ চলতে থাকে। এ সংঘর্ষে বিবেক যদি জয়ী হয় তাহলে সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাঝে এর আছর বা ক্রিয়া পরিস্ফুটিত হয়ে উঠে। পরিচালিত হয় তখন সবকিছুই সঠিক পথে। অন্যথায় সব কিছুই হয়ে যায় বিপথগামী। নবীয়ে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অতি উত্তমভাবে এ বিষয়টি তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, মানুষের শরীরে গোশতের একটি টুকরা রয়েছে। যখন সে টুকরাটি ঠিক থাকে তখন সমস্ত শরীরই ঠিক থাকে, আর যখন ওটি খারাপ হয়ে যায় তখন সারা শরীরই খারাপ হয়ে যায়। মনে রেখো, সে গোশতের টুকরাটি আর কিছু নয়, ওটির নামই হল অন্তর বা মন। এতে প্রমাণিত হচ্ছে যে, সমস্ত শরীরের সংশোধন মনের সংশোধনের উপর নির্ভরশীল। তাই ভাল মানুষ হতে হলে ভাল সমাজ গড়তে হলে আমাদের প্রত্যেককে নিজের মনের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখতে হবে, যেন এ রত্নে সামান্যতম ময়লা, পংকিলতা ও দূষণীয় কোন কিছু স্পর্শ করতে না পারে।
মানুষ আদি কাম দ্বারা পরিচালিত এবং তার ইচ্ছা ও প্রয়াসগুলো হল মূলত কামজ বা যৌন- এ কথা বলে ফ্রয়েড যৌন স্বাধীনতার যে শ্লোগান নিয়েছেন এ পথে মূলত কোন দেশ বা জাতির শান্তি আসতে পারে না এবং হবে না এর দ্বারা কোন সমস্যার সমাধান। বরং এতে সমস্যাই বাড়তে থাকবে অত্যন্ত প্রবলভাবে। পচন ধরবে সমাজ, দেশ, জাতি সব কিছুতেই। কারণ, আবহমান কাল থেকেই এ কথা সর্বজন স্বীকৃত যে, যদি কোন সমাজে যৌন অভিশাপ নেমে আসে তাহলে সে সমাজের ধ্বংস নিশ্চিত। তাই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যৌন অভিশাপ থেকে বেঁচে থেকে সত্যিকার কল্যাণের পথে এগিয়ে আসার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বলেছেন- উভয় পা’র মাঝে যা আছে (লজ্জাস্থান) এবং উভয় পাটির মাঝে যা আছে (জিহ্বা)-এর জামানত যে দিতে পারবে, আমি তার জান্নাতের জামানত দেব। [বুখারী, তিরমিযী শরীফ
দৃষ্টির কারণেই মানুষ সাধারণত যৌনব্যাধিতে আক্রান্ত হয়, আটকে পড়ে অশোভনীয় কার্যকলাপে, ডেকে আনে ব্যক্তি ও সমাজের জন্য ভয়াবহ পরিণাম। ইসলাম তাই এ যৌনবন্যার ভয়াবহ সয়লাব থেকে এ পৃথিবীকে রক্ষা করার জন্য নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেকের দৃষ্টিকে সংযত রাখার জন্য দ্ব্যর্থহীন আহ্বান জানিয়েছে। কুরআন বলছে- মুমিনদেরকে বল, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে এবং নিজেদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করে। এটাই তাদের জন্য উত্তম। এরা যা করে আল্লাহ সে বিষয়ে অবহিত। মুমিন নারীদেরকে বল, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে ও নিজেদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করে। [সূরা নূর : ৩০-৩১ আয়াত]
মূলত একজন মানুষের কামিয়াবী ও সফলতা এ সংযমের উপরই নির্ভরশীল, যৌনস্বার্থ চরিতার্থের উপর নয় । আল্লাহ বলেছেন- অবশ্যই সফলকাম হয়েছে মুমিনগণ, যারা বিনয়ী নম্র নিজেদের সালাতে, যারা বিরত থাকে অসার ক্রিয়াকলাপ হতে, যারা
সক্রিয় যাকাত প্রদানে এবং যারা সংযত রাখে নিজেদের যৌন অঙ্গকে।
[সূরা মুমিন : ১-৫]
যৌন জীবনের আবেগে পুরুষ যেভাবে অস্থির হয় সাধারণত নারীরা সেভাবে অস্থির হয় না। কারণ, তাদের মাঝে সংযম, ধৈর্য এবং সহ্যক্ষমতা অনেক বেশি। তাই নারী সমাজে যখন যৌনকাতরতা দেখা দেয় এবং যখন তারা সামনে অগ্রসর হয়ে পুরুষের সঙ্গ কামনা করে, দুর্বলচিত্ত পুরুষ তাতে অতি সহজেই নিজের গা এলিয়ে দেয়, বইতে থাকে তখন সমাজ জীবনে ব্যভিচারের বন্যাস্রোত। এ দূষিত আবর্জনাযুক্ত পানির স্রোত থেকে দেশ ও সমাজকে রক্ষা কল্পে নারীদেরকে সতর্ক করে কুরআন অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় বলছে- তোমরা স্বগৃহে অবস্থান করবে, প্রাচীন অজ্ঞতার যুগের মত নিজেদেরকে প্রদর্শন করে বেড়াবে না। তোমরা সালাত কায়েম করবে, যাকাত প্রদান করবে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুগত থাকবে। [সূরা আহযাব : ৩৩ আয়াত]
যৌনস্বাধীনতা এবং যৌনক্ষুধা নিবারণের ব্যাপক ও অনিয়ন্ত্রিত অধিকার জীবশ্রেষ্ঠ মানুষের জন্য এক চরম লজ্জাষ্কর কাজ এবং অত্যন্ত হীনতম কথা। কারণ, এতে বিবেকসম্পন্ন মানুষ এবং পশুদের মাঝে কোন তারতম্য আর বাকী থাকে না। তাই ইসলাম প্রথম থেকেই এ সবের বিরুদ্ধে অত্যন্ত সোচ্চার। পক্ষান্তরে ইসলামী তামাদ্দুনের গোটা ইবাদত ব্যবস্থাই তাহারাত বা পবিত্রতার সাথে বিজড়িত। উদাহরণস্বরূপ সাওমের কথাটিই ধরে নেয়া যাক। আমরা সকলেই জানি যে, শুধু উপবাস থাকার নামই সাওম নয়, অভিধানগত অর্থও এ কথার দিকে ইংগিত করে। কারণ, সাওমের আভিধানিক অর্থ হল নিবৃত্তি। কিসের নিবৃত্তি? এ সম্বন্ধে শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী (রহ.) বলেছেন, যেহেতু পাশবিক কামনার প্রাবল্য ফেরেশতাসুলভ চরিত্র অর্জনের পক্ষে অন্তরায় সুতরাং এসব উপকরণকে পরাভূত করত পাশবিক শক্তিকে আয়ত্তাধীন করাই হচ্ছে সাওমের সূক্ষ্মতম তাৎপর্য। এতে স্পষ্টই প্রমাণিত হয় যে, সাওমের প্রকৃত লক্ষ্য হচ্ছে পাশবিক প্রবৃত্তির দমন ও উন্নত প্রকৃতির বিকাশ। এজন্য দেখা যায়, এ দুনিয়ায় যারা সত্যিকার মনুষ্যত্ব লাভ করেছেন তারা সকলেই আল্লাহর প্রত্যাদেশ পাওয়ার পূর্বে দীর্ঘকাল সিয়াম সাধনা করেছেন। মরহুম মাওলানা সুলায়মান নদভীর বর্ণনা থেকে পাওয়া যায়, হযরত মুসা আলাইহিস্ সালাম তুর পাহাড়ে আল্লাহর প্রত্যাদেশ হিসাবে তাওরাত গ্রহণ করার সময় দীর্ঘ চল্লিশ দিন পর্যন্ত আহার-পানীয় ত্যাগ করে মানবিক জীবনের বহু ঊর্ধ্বে আরোহণ করেছিলেন। হযরত ঈসা (আ.) ইঞ্জিল প্রাপ্ত হওয়ার লগ্নে অনুরূপ সাধনায় চল্লিশ দিন অতিবাহিত করেছিলেন। সর্বশেষ রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও কুরআনুল কারীম নাযিলের পূর্বে দীর্ঘ ছয় মাস কাল পর্যন্ত হেরার গুহায় সাধনায় জীবনযাপন করেছিলেন। সৈয়দ সুলায়মান নদভী বলেন, পাশবিক শক্তিকে আয়ত্তাধীন করার ব্যাপারে সিয়ামের প্রধানতম শিক্ষা হল মানব জীবন ভোগের জন্য নয়, মানব জীবন হল ত্যাগের জন্য। এ শিক্ষা লাভ করে যাতে গোটা বিশ্ববাসী দৃষ্টি, হৃদয় এমনকি কল্পনার নির্মলতা অর্জনের সাথে সাথে জীবনের সর্বস্তরে কলুষহীনতা ও ইফাতের অধিকারী হতে পারে। তাই আল্লাহ তাআলা একটি নির্দিষ্ট চাঁদে তাঁর কালামে প্রত্যয়শীল সকল মানুষের জন্য সিয়াম সাধনাকে বাধ্য করে দেন। তাই প্রকৃত মানবিক চরিত্রের বিকাশ এবং এ পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বাতলানো তরীকা মতে পাশবিক প্রবৃত্তিকে পূর্ণাঙ্গ দমন করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া আমাদের জন্য একান্তভাবে অপরিহার্য। আল্লাহ আমাদের সকলকে তাওফিক দিন।