মওদুদী ফিতনা
জনাব আবুল আলা মওদুদী একজন প্রতিভাধর ব্যক্তি, এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে তিনি সনদপ্রাপ্ত মাওলানা এবং দীনি ইলমে সুশিক্ষিত ব্যক্তি নন। তিনি হচ্ছেন একজন স্বঘোষিত মাওলানা। পাশ্চাত্য বস্তুবাদের ব্যাপক হামলা থেকে ইসলামকে হিফাযত করার নামে তার ক্ষুরধার লিখনি আধুনিক যুক্তিবিদ্যার লাগামহীন পথ ধরে এমন বেপরোয়াভাবে পরিচালিত হয়েছে, যার ফলে ইসলামের মৌল প্রাসাদটি এক বিরাট হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে এবং ধসে যাওয়ার উপক্রম হয়ে পড়েছে। কারণ, তার কলম যেমনিভাবে বস্তুবাদী অমুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছে অনুরূপভাবে দীন ও দীনদার লোকদের বিরুদ্ধেও তা পরিচালিত হয়েছে। ক্ষিপ্তভাবে। মোট কথা, আনাড়ী ও অনভিজ্ঞ ডাক্তারের বেপরোয়া অপারেশনের ফলে রোগীর যে গুরুদশা হয় তার হাতেও ঠিক ইসলামের অনুরূপ অবস্থাই হয়েছে। কোন কোন বুযুর্গের মতে এ ফিতনা কাদিয়ানীদের চেয়েও আরো মারাত্মক। নিম্ন বর্ণিত কতিপয় বিষয়ে অহেতুক বাড়াবাড়ি এবং বিভ্রান্তিকর ব্যাখ্যার উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে মওদুদী ফিতনা :
১. আম্বিয়ায়ে কেরাম (আ.)।
২. সাহাবায়ে কেরাম (রা.)।
৩. সলফে সালেহীন ও আকাবিরে দীন।
৪. মুজাদ্দিদীনে উম্মত।
৫. ইসলামী উলুম ।
৬. আত্মম্ভরিতা।
৭. ইসলামের রাজনৈতিক ব্যবহার ।
৮. কুরআন শরীফ
আম্বিয়ায়ে কেরাম (আ.)
নবীগণ সকলেই মাসুম, তাঁরা সকলেই নিষ্পাপ । ছোট বড় কোন গুনাহই তাঁদের থেকে হয়নি- এই হলো ইসলামী আকীদা। তবে বিংশ শতাব্দীর জাহিলিয়াতের নিশানবরদার জনাব আবুল আলা মওদুদী ইসলামের বদ্ধমূল এ আকীদার উপর কুঠারাঘাত করে এবং কুরআন ও সুন্নাহর চিরন্তন শিক্ষাকে পদদলিত করে আম্বিয়ায়ে কেরামের এ পূত পবিত্র মহান জামাতের প্রতি কলংক লেপন করার উদ্দেশ্যে এমন ধৃষ্টতাপূর্ণ কথা বলেছেন, যা কোন মুসলমানের পক্ষে বরদাশত করা সম্ভব নয়। তিনি প্রসিদ্ধ নবী হযরত দাউদ (আ.) সম্পর্কে বলেছেন-
) হযরত দাউদ (আ.) তৎকালীন যুগে ইসরাঈলী সোসাইটির দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়ে নিজে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে আওরিয়ার নিকট তার স্ত্রীকে তালাক দেয়ার জন্য আবেদন করেছিলেন। [তাফহীমাত, ২য় খণ্ড : ৪২ পৃষ্ঠা, ২য় সংস্করণ]
) হযরত দাউদ (আ.)-এর কাজের মধ্যে নফস এবং আভ্যন্তরীণ কুপ্রবৃত্তির কিছুটা দখল ছিল। অনুরূপভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহারের সাথেও তার কিছুটা সম্পর্ক ছিল। আর তা এমন একটি কাজকে কেন্দ্র করে হয়েছিল যা কোন ন্যায়পরায়ণ রাষ্ট্রপতির জন্যও শোভনীয় নয়। [তাফহীমুল কুরআন : ৪র্থ খণ্ড, সূরা সাদ ৩৭২ পৃ., ১ম সংস্করণ, অক্টোবর ১৯৬৬ ইং]
→ হযরত নূহ (আ.) সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে মাওলানা বলেছেন, অনেক সময় নফসের কোন নাজুক বিষয়ে নবীর ন্যায় উঁচু মর্যাদাসম্পন্ন মানুষও মানবীয় দুর্বলতার সামনে ক্ষণিকের জন্য পরাভূত হয়ে পড়েন। তবে আল্লাহ তাআলা যখন তাদেরকে সতর্ক করে দেন যে, যে ছেলে হককে বর্জন করে বাতিলের পথ ধরেছে, তাকে নিজ ঔরসজাত হওয়ার দরুন আপন মনে করা জয়বায়ে জাহিলিয়াত বা মূর্খতা সুলভ আবেগ ব্যতীত আর কিছুই নয়, তখন সে নিজের মনের গতিকে উপেক্ষা করে ইসলামী তাকাযার দিকে ফিরে আসে। (তাফহীমূল কুরআন : ২য় খণ্ড, ৩৪৪ পৃ. তৃতীয় সংস্করণ ১৯৬৪ ইং]
• হযরত ইউসুফ (আ.)-এর বাণী- ‘আমাকে মিসরের রাজকোষের পরিচালক নিয়োগ করুন’- এ কথাটি বলে হযরত ইউসুফ (আ.) শুধু অর্থমন্ত্রী হওয়ার জন্যই প্রার্থনা করেননি। যেমন- কারো কারো ধারণা, বরং তিনি এ বলে ডিকটিটরীই চেয়েছিলেন মৌলিকভাবে। এরই ফলশ্রুতিতে বর্তমান ইটালীর মধ্যে মুসোলিনির যে মর্যাদা তিনিও এর কাছাকাছি মর্যাদার অধিকারী হয়েছিলেন। (তাফহীমাত, ২য় খণ্ড, ১২২ পৃ. ৫ ১৯৭০ ইং]
→ হযরত ইউনুস (আ.) থেকে রিসালাতের দায়িত্ব আদায় করার ব্যাপারে কিছু দুর্বলতা হয়ে গিয়েছিল। সম্ভবত তিনি ধৈর্যহারা হয়ে নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই নিজের স্থান ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন। (তাফহীমুল কুরআন : ২য় খণ্ড : সূরা ইউনুস, ৩১২-৩১২ টীকা, পৃ., ৩য় সংস্করণ ১৯৬৪ ইং]
→ হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম না অতিমানব ছিলেন এবং না তিনি মানবীয় দুর্বলতার ঊর্ধ্বে ছিলেন। [তরজুমানুল কুরআন : ৮৫ খণ্ড ১৯৭৬ ইং, এপ্রিল সংখ্যা : ইসলাম কিছ চী কা আলম বরদার হায় শীর্ষক প্রবন্ধ)
→ জনাব মওদুদী সাহেব তাফহীমাত ২য় খণ্ড, ৪র্থ সংস্করণ ৫৬-৫৭ পৃষ্ঠায় হযরত দাউদ (আ.) সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, পবিত্রতা নবীগণের জাতিগত অপরিহার্য গুণ নয়; বরং নবুওয়াতের দায়িত্ব যাতে তাঁরা সঠিকভাবে আদায় করতে পারে এজন্য আল্লাহ তাআলা তাদেরকে ভুলত্রুটি থেকে হেফাযত করেছেন। তবে আল্লাহ তাআলা ইচ্ছাকৃতভাবে কখনো কখনো নবীদের থেকে ইসমতের পর্দা উঠিয়েও নিয়েছেন যাতে মানুষ তাঁদেরকে খোদা বলে মনে না করেন এবং যাতে লোকেরা এ কথা জানতে পারে যে, তাঁরা মানব বিশেষ খোদা নন। অথচ ইসলামের বিশ্বাস হলো ইসমত বা পাপমুক্ততা নবীগণের অপরিহার্য গুণ। শরীরের রঙ যেমন শরীর থেকে পৃথক হয় না তেমনি ইসমত বা পাপমুক্ততার গুণ নবীগণ থেকে কোন সময় পৃথক হয় না।
সাহাবায়ে কেরাম (রা.)
আম্বিয়ায়ে কেরামের পর সাহাবীগণই হলেন এ উম্মতের সর্বাধিক সম্মানিত মানুষ। এ পূত পবিত্রতম মহান জামাতও মওদুদী সাহেবের কটাক্ষ এবং শ্যেনদৃষ্টি থেকে রেহাই পাননি। এ মহান জামাতের প্রতি কটাক্ষ করে মাওলানা তার লিখিত গ্রন্থ তাজদীদ ও ইহয়ায়েদীন, খিলাফত ও মুলকিয়্যাত এবং তাফহীমুল কুরআনে যেসব মন্তব্য করেছেন উদাহরণস্বরূপ নিয়ে এর কয়েকটির বিবরণ পেশ করা হলো :
” জনাব মওদুদী সাহেব বলেন, সাহাবীগণ সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন। তাঁদের দোষ বর্ণনা করা যায়। সাহাবীদের সম্মান করার জন্য এ যদি জরুরি মনে করা হয় যে, কোনভাবেই তাঁদের দোষ বর্ণনা করা যাবে না, তাহলে আমার দৃষ্টিতে এ ধারণা মোটেই সম্মান নয়; বরং এ তো মূর্তিপূজারই নামান্তর, যার মূলোৎপাটনের জন্য জামাআতে ইসলামীর জন্ম। (তরজুমানুল কুরআন : ৩৫শ’ সংখ্যা : ৩২৭ পৃ.]
• জনাব মওদুদী হযরত উসমান (রা.) সম্পর্কে বলেন, কিন্তু বদকিসমতের কারণে তৃতীয় খলীফা হযরত উসমান গনি (রা.) উক্ত (হযরত উমরের নির্বাচন পদ্ধতি) মানদণ্ডকে কায়েম রাখতে পারেননি। [খিলাফত ওয়া মুলুকিয়্যাত : ৯২ পৃ., ৫ম সংস্করণ এপ্রিল ১৯৮৩ ইং
” হযরত উসমান গনি (রা.) যাঁর উপর খিলাফতের বিরাট গুরু দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল, তিনি ঐ সমস্ত গুণাবলী মণ্ডিত ছিলেন না যা তাঁর পূর্ববর্তী দুই খলীফার মধ্যে বিদ্যমান ছিল। এ জন্যই তাঁর খিলাফতকালে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার মাঝে জাহিলিয়াতের অনুপ্রবেশ করার বিরাট সুযোগ মিলে যায়। [তাজদীদে ইহয়ায়ে দীন : আ. মান্নান তালিব কৃত অনুবাদ : ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন, ১ম সংস্করণ জাহিলিয়াতের আক্রমণ শিরোনাম ১৯৬৬ ইং]
→ হযরত উসমান গনি (রা.) খলীফা নির্বাচিত হবার পর ধীরে ধীরে তিনি পূর্ব নির্ধারিত পলিসি থেকে দূরে সরে যান এবং নিজের নিকটাত্মীয় লোকদেরকে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে সমাসীন করতে শুরু করেন। অধিকন্তু তিনি তাদের সাথে এমন (স্বজনপ্রীতিমূলক) আচরণ করতে আরম্ভ করেন যা জনসাধারণের মনে সমালোচনার লক্ষ্যস্থলে রূপান্তরিত হয়। খিলাফত ওয়া মুলুকিয়াত : ৯৭ পৃ. ৫ম সংস্করণ এপ্রিল ১৯৮৩ ইং
• এর চেয়েও মারাত্মক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী বিষয়টি ছিল এই যে, (হযরত উসমান গনি (রা.) কর্তৃক) মারওয়ান ইবনুল হাকামকে খলীফার সেক্রেটারী পদে অধিষ্ঠিত করা। কারণ, মারওয়ান হযরত উসমানের নরম মিজাযের সুযোগে এমন এমন কাজ করেছেন যার যিম্মাদারী এবং দোষ মৌলিকভাবে হযরত উসমানের ঘাড়েই আপতিত হয়। [খিলাফত ওয়া মুলুকিয়াত : ১০৬ পৃ. ৫ম সংস্করণ এপ্রিল ১৯৮৩ ইং
→ হযরত উসমান গনি (রা.)-এর পলিসির এ দিকটি সন্দেহাতীতভাবেই গলদ ছিল। গলদ গলদই বটে, তা যে কেউ-ই করুক না কেন, অহেতুকভাবে বানাওয়াট করে একে সহীহ এবং সঠিক সাব্যস্ত করার চেষ্টা করা আকল-ইনসাফের তাকাযাও নয় এবং ধর্মীয় চাহিদাও নয় যে কোন সাহাবীর গলদকে গলদ না মানা । ( খিলাফত ওয়া মুকিয়াত : ১০৭ পৃ. ৫ সংস্করণ: এপ্রিল ১৯৮৩ ইং
ওহী সংকলনকারী সাহাবী হযরত মুআবিয়া সম্পর্কে জনাব মওদুদী বলেছেন-
→ হযরত মুআবিয়ার যমানায় আর একটি ঘৃণিত জঘন্য বিদআত এই শুরু হয়েছিল যে, তিনি নিজে এবং তাঁর আদেশে তাঁর সমস্ত গভর্নর মিসরে বসে হযরত আলী (রা.)-এর উপর গালি গালাজ এবং প্রতিবাদের ঝড় বইয়ে দিতেন। এমনকি মসজিদে নববীর মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মিম্বরের উপর বসে ঠিক রওযা শরীফের সামনে হুযুরের পরম প্রিয়তম পাত্রকে গালি দেয়া হত। [খিলাফত ওয়া মুকিয়াত : ১৬২ পৃ., ৫ম সংস্করণ : এপ্রিল ১৯৮৩ ইং]
→ গনীমতের মাল বণ্টনের ক্ষেত্রেও হযরত মুআবিয়া (রা.) কুরআন ও সুন্নাহর প্রকাশ্য হুকুমের বিরুদ্ধাচরণ করেছেন। [খিলাফত ওয়া মুকিয়াত : ১৬২ পৃ. ৫ম সংস্করণ এপ্রিল ১৯৮৩ ইং
→ যিয়াদ ইবন সুময়্যাহকে নিজের ভাই বানিয়ে নেয়া, হযরত মুআবিয়ার ঐ সমস্ত কার্যকলাপেরই অন্তর্ভুক্ত যা তিনি রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য করেছেন। হযরত মুআবিয়ার এ কাজটি শরীয়ত স্বীকৃত একটি নিয়মের সম্পূর্ণ পরিপন্থী ছিল। [খিলাফত ওয়া মুকিয়াত : ১৬২ পৃ., ৫ম সংস্করণ : এপ্রিল ১৯৮৩ ইং) হযরত মুআবিয়া (রা.) তাঁর গভর্নরদেরকে আইনের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন এবং শরীয়ত মুতাবেক তাদের জুলুম ও অত্যাচারের বিচার করতে পরিষ্কার অস্বীকার করে দিয়েছেন। [ খিলাফত ওয়া মুকিয়াত : ১৬২ পৃ., ৫ম সংস্করণ ১৯৮৩ ইং
→ (হযরত আলীর পর) অবশেষে নবুওয়তের পদ্ধতির পরিচালিত খিলাফতের যমানা শেষ হয়ে আসে। স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র তার স্থান দখল করে। এভাবে রাষ্ট্রের বুনিয়াদ ইসলামের পরিবর্তে আবার জাহিলিয়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করার পর জাহিলিয়াত ক্যানসার ব্যাধির ন্যায় ধীরে ধীরে সমাজ দেহে বাহু বিস্তার করতে থাকে। ইিসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন : ২৯ পৃ. প্রকাশকাল ৩১ জানুয়ারী ১৯৮০ ইং
* হযরত মুআবিয়া (রা.)-এর খিলাফতকাল সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে জনাব মওদুদী সাহেব বলেছেন, নির্ভেজাল জাহিলিয়াত রাষ্ট্র ও সম্পদ করায়ত্ত করে। নামে খিলাফত কিন্তু আসলে ছিল সেই রাজতন্ত্র যাকে খতম করার জন্য ইসলামের আগমন হয়েছিল। বাদশাহকে ইলাহ বলার হিম্মত কারুর ছিল না। তাই ‘আস-সুলতানু যিল্লুল্লাহ’র বাহানা তালাশ করা হয়। আর এ বাহানায় ‘ইলাহ’ যে আনুগত্যের অধিকারী হন বাদশাহরাও তা লাভ করেন। এ রাজতন্ত্রের ছত্রছায়ায় আমীর উমরা, শাসকবর্গ, গভর্নরবৃন্দ, সেনাবাহিনী ও সমাজের কর্তৃত্বশালী লোকদের জীবনে কম বেশি নির্ভেজাল জাহিলিয়াতের দৃষ্টিভঙ্গি বিস্তার লাভ করে। এ দৃষ্টিভঙ্গি তাদের নৈতিক ভিত্তি ও সামাজিকতাকে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করে দেয়। [ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন : ৩০ পৃ. প্রকাশকাল ৩১ জানুয়ারী ১৯৮০ ইং।
) হযরত মুআবিয়া এবং হযরত মুগীরা ইবন শোবা (রা.) সম্পর্কে মন্তব্য করে জনাব মওদুদী সাহেব বলেন যে, ইয়াযিদকে যুবরাজ নিয়োগ করার প্রাথমিক আন্দোলনটি মূলত কোন সহীহ জ্যবার উপর হয়নি। বরং এক বুযুর্গ স্বীয় স্বার্থ চরিতার্থের জন্য অপর এক বুযুর্গের ব্যক্তিগত ফায়দার উদ্দেশ্যে এ প্রস্তাবের জন্ম দিয়েছেন। তারা ভেবেও দেখেননি যে, তারা এ উম্মতকে কোন পথে নিক্ষেপ করছেন। [খিলাফত ওয়া মুকিয়াত : ১৪১ পৃ. ৫ম সংস্করণ: এপ্রিল ১৯৮৩ ইং)
অথচ ইবনে খালদুন ও ইবনে কাছীরের মত ঐতিহাসিকগণের তথ্যে জানা যায় যে, এ সবই ছিল হযরত মুআবিয়া (রা.)-এর প্রতি আরোপিত অপবাদমাত্র।
সলফে সালিহীন ও আকাবিরেদীন
সাহাবায়ে কেরামের পূতঃপবিত্রতম জামাআত যেখানে জনাব মওদুদী সাহেবের শ্যেনদৃষ্টি থেকে রেহাই পাননি সেখানে সলফে সালিহীন, আকাবিরেদীন, ফুকাহা, মুহাদ্দিসীন ও সোলাহারে উম্মতও তার আক্র থেকে কি করে রক্ষা পেতে পারেন? এ সমস্ত মনীষী সম্পর্কে তিনি বলেছেন-
• রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যতীত অন্য কাউকে সত্যের মাপকাঠি বানাবে না, কাউকে সমালোচনার ঊর্ধ্বে মনে করবে না এবং কারো যেহনী গোলামীতে আবদ্ধ হবে না; বরং প্রত্যেককে আল্লাহর নির্দেশিত পূর্ণাঙ্গ মাপকাঠিতে যাচাই করবে এবং এ মাপকাঠি অনুপাতে যে যেই স্তরের প্রমাণিত হয় তাকে সেই স্তরেই রাখবে। [ ইসলামী : ৩ নং দফা, ৩৪ পৃ. ৩য় সংস্করণ ১৯৬২ ইং দপ্তরে জামাআতে
• রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যতীত আর কেউ জনাব মওদুদী সাহেবের নিকট নির্ভরযোগ্য নয়। তাই নির্ভরযোগ্য লোক তৈরি করে সঠিক এবং সার্থক আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে তিনি সলফে সালিহীন এবং আকাবিরদের (অনুসরণীয় পূর্বসূরিদের) সমালোচনা করে বলেন- শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ২৩ বছরের মধ্যে এ সমস্ত কার্য পূর্ণরূপে সম্পাদন করেন। তারপর আবু বকর সিদ্দীক (রা.) ও উমর ফারুক (রা.)-এর ন্যায় দু’জন আদর্শ নেতার নেতৃত্ব লাভের সৌভাগ্য ইসলামের হয়। তাঁরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ন্যায় এ সর্বব্যাপী কাজের সিলসিলা জারি রাখেন। অতঃপর হযরত উসমান (রা.)- এর হাতে এর কর্তৃত্ব আসে এবং প্রথম প্রথম কয়েক বছর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি পূর্ণরূপে জারি থাকে। | তাজদীদে ইহইয়ায়ে দীনের অনুবাদ, ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন : ২৮ পৃ. প্ৰকাশকাল : ৩১ জানুয়ারী ১৯৮০ ইং
এরপর ‘জাহিলিয়াতের আক্রমণ’ শিরোনামে তিনি বলেন, কিন্তু একদিকে ইসলামী রাষ্ট্রের দ্রুত বিস্তারের কারণে প্রতিদিন কাজ অধিকতর কঠিন হতে যাচ্ছিল এবং অন্যদিকে হযরত উসমান (রা.) যার উপর এ বিরাট কাজের বোঝা রক্ষিত হয়েছিল, তিনি তাঁর মহান পূর্বসূরিদের প্রদত্ত যাবতীয় বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন না। তাই তাঁর খিলাফত আমলে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে জাহিলিয়াত অনুপ্রবেশ করার সুযোগ লাভ করে। হযরত উসমান (রা.) নিজের শির দান করে এ বিপদের পথ রোধ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তা রুদ্ধ হয়নি। অতঃপর হযরত আলী (রা.) অগ্রসর হন। তিনি ইসলামের রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে জাহিলিয়াতের পাঞ্জা থেকে উদ্ধার করার জন্য চরম প্রচেষ্টা চালান, কিন্তু তিনি জীবন দান করেও এই প্রতি বিপ্লবের পথ রোধ করতে পারেননি। অবশেষে নবুওয়াতের পদ্ধতির পরিচালিত খিলাফতের যামানা শেষ হয়ে আসে। স্বৈরচারী রাজতন্ত্র তার স্থান দখল করে। এভাবে রাষ্ট্রের বুনিয়াদ ইসলামের পরিবর্তে আবার জাহিলিয়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করার পর জাহিলিয়াত ক্যানসার ব্যাধির ন্যায় ধীরে ধীরে সমাজদেহে তার বাহু বিস্তার করতে থাকে। কেননা, কর্তৃত্বের চাবিকাঠি এখন ইসলামের পরিবর্তে তার হাতে ছিল এবং রাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত হবার পর তার প্রভাবের অগ্রগতি রোধ করার ক্ষমতা ইসলামের ছিল না। সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল এই যে, জাহিলিয়াত উলঙ্গ এবং আবরণমুক্ত হয়ে আত্মপ্রকাশ করেনি; বরং মুসলমানের রূপ ধারণ করে এসেছিল। প্রকাশ্য নাস্তিক, মুশরিক বা কাফিরের মুখোমুখি হয়ে হয়তো মুকাবিলা করা সহজ হতো। কিন্তু সেখানে প্রথমেই ছিল তৌহিদের স্বীকৃতি। রিসালাতের স্বীকৃতি, নামায ও রোযা সম্পাদন এবং কুরআন ও হাদীস থেকে যুক্তি-প্রমাণ গ্রহণ, আর তার পেছনে জাহিলিয়াত নিজের কাজ করে যাচ্ছিল। [তাজদীদ ও ইহইয়ায়ে দীনের অনুবাদ : ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন : ২৮-২৯ পৃ. প্রকাশকাল ৩১ জানুয়ারী ১৯৮০ ইং
এ সময় ইসলাম ও মুসলমানদের অবস্থা কি হয়েছিল, এর চিত্র অংকন করে মাওলানা বলেছেন, জাহিলী নেতৃত্বের সিংহাসনে এবং রাজনীতির মসনদে ‘মুসলমানের’ সমাসীন হওয়া, জাহিলী শিক্ষায়তনে মুসলমানের শিক্ষকতা করা এবং জাহিলিয়াতের আসনে ‘মুসলমানের’ মুর্শিদ হিসাবে উপবেশন করা এক বিরাট প্রতারণা বৈ আর কিছুই নয়। খুব কম লোকই এ প্রতারণা থেকে বাঁচতে পারে।
এ প্রতি বিপ্লবের সবচেয়ে ভয়াবহ দিক ছিল এই যে, ইসলামের আবরণে তিন ধরনের জাহিলিয়াতই তাদের শিকড় গাড়তে শুরু করে এবং তাদের প্রভাব প্রতিদিন অধিকতর বিস্তার লাভ করতে থাকে।
১. নির্ভেজাল জাহিলিয়াত রাষ্ট্র ও সম্পদ করায়ত্ত করে। নামে খিলাফত কিন্তু আসলে ছিল সে রাজতন্ত্র, যাকে খতম করার জন্য ইসলামের আগমন হয়েছিল। বাদশাহকে ইলাহ বলার হিম্মত কারো ছিল না। তাই ‘আস- সুলতানু যিলুল্লাহ’র বাহানা তালাশ করা হয়। আর এ বাহানায় ইলাহ যে আনুগত্য লাভের অধিকারী হন বাদশাহরাও তার অধিকার লাভ করেন।
২. শিরক মিশ্রিত জাহিলিয়াত জনগণের উপর হামলা করে তাদেরকে তৌহিদের পথ থেকে সরিয়ে গোমরাহীর অসংখ্য পথে বিক্ষিপ্ত করে দেয়। কেবলমাত্র সুস্পষ্ট মূর্তিপূজা অনুষ্ঠান সম্ভব হয়নি। নয় তো এমন কোনো ধরনের শিরক ছিল না যা মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত হয়নি।
৩. বৈরাগ্যবাদী জাহিলিয়াত উলামা, মাশায়েখ, সুফী ও পরহেযগার লোকদের উপর হামলা করে এবং তাদের মধ্যে সেসব ত্রুটি বিস্তার করতে থাকে (যেগুলোর দিকে আমি ইতোপূর্বেই ইশারা করেছি।)। এই জাহিলিয়াতের প্রভাবে মুসলিম সমাজে প্লেটুবাদী দর্শন, বৈরাগ্যবাদী চারিত্রিক আদর্শ এবং জীবনের প্রতিক্ষেত্রে নৈরাশ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রসার লাভ করে। এ জীবন দর্শনটি শুধু সাহিত্য ও জ্ঞান সাধনাকেই প্রভাবিত করেনি বরং প্রকৃতপক্ষে সমাজের সৎলোকদেরকে মরফিয়া ইনজেকশান দিয়ে স্থবিরত্বে পৌছিয়ে দিয়েছে, রাজতন্ত্রের জাহিলী ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করেছে, ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পের মধ্যে জড়তা ও সংকীর্ণ চিন্তার উদ্ভব ঘটিয়েছে এবং সমগ্র দীনদারকে কতিপয় বিশেষ ধর্মকর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ করেছে। [তাজদীদ ও ইহইয়ায়ে দীন অনুবাদ ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন : ৩০-৩২ পৃ. প্রকাশকাল : ৩১ জানুয়ারী ১৯৮০ ইং]
এরপর তিনি ‘মুজাদ্দিদের প্রয়োজন‘ শিরোনামে বলেছেন-
এই তিন ধরনের জাহিলিয়াতের ভীড় থেকে ইসলামকে উদ্ধার করে পুনর্বার তাকে সবল ও সতেজ করার জন্য মুজাদ্দিদগণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। [তাজদীদ ও ইহইয়ায়ে দীন : অনুবাদ- ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন : প্রকাশকাল- ৩১ জানুয়ারী ১৯৮০ ইং তবে মুজাদ্দিদের কাজ কি?
এ বিষয়টি চিহ্নিত করে জনাব মওদুদী বলেছেন- মুজাদ্দিদের কাজের নিম্নলিখিত বিভাগসমূহ উল্লেখযোগ্য
১. নিজের পরিবেশের নির্ভুল চিত্রাংকন।
২. সস্কারের পরিকল্পনা প্রণয়ন।
৩. নিজের সীমা-পরিসীমা নির্ধারণ।
৪. চিন্তারাজ্যে বিপ্লব সৃষ্টির প্রচেষ্টা।
৫. সক্রিয় সংস্কার প্রচেষ্টা।
৬. দীনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইজতিহাদ করার প্রচেষ্টা।
৭. প্রতিরক্ষামূলক প্রচেষ্টা।
৮. ইসলামী ব্যবস্থার পুনরুজ্জীবন।
৯. বিশ্বজনীন বিপ্লব সৃষ্টি ।
এ নয়টি বিষয়ের ব্যাখ্যা করার পর তিনি বলেছেন, এ বিভাগগুলো গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে বুঝা যায় যে, ইসলামী পুনরুজ্জীবনের কার্য সম্পাদনকারী ব্যক্তিদের জন্য প্রথম বিভাগ তিনটি অপরিহার্য। কিন্তু অবশিষ্ট ছয়টি বিভাগের প্রত্যেকটি মুজাদ্দিদ হবার জন্য অপরিহার্য শর্তের মধ্যে গণ্য নয়। বরং এগুলোর থেকে কোনো একটি, দুটি, তিনটি, চারটি বিভাগে উল্লেখযোগ্য কার্য সম্পাদন করলে তাকে মুজাদ্দিদ বলে গণ্য করা যেতে পারে। তবে এ ধরনের মুজাদ্দিদ আংশিক মুজাদ্দিদ হবেন। পূর্ণ মুজাদ্দিদ কেবল তিনিই হবেন, যিনি উল্লেখিত বিভাগের প্রত্যেকটিতে পূর্ণ কার্য সম্পাদন করে নবুওয়াতের উত্তরাধিকারিত্বের হক আদায় করবেন। এরপর তিনি কামিল মুজাদ্দিদের আগমন ঘটেছে কি না এবং তারা ওয়ারাছাতে নবুওয়াতের দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়েছেন কি না? এ সম্পর্কে পর্যালোচনা করে বলেছেন-
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এখনো কোনো কামিল মুজাদ্দিদের আবির্ভাব ঘটেনি। হযরত উমর ইবন আবদুল আজীজ (রহ.) এ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তিনি সফলকাম হতে পারেননি। তারপর যত মুজাদ্দিদ জন্মগ্রহণ করেছেন তাঁরা প্রত্যেকে কোন একটি বিশেষ বিভাগে অথবা একাধিক বিভাগে কাজ করেছেন। কামিল মুজাদ্দিদের স্থান এখনো শূন্য আছে। কিন্তু বিবেক-বুদ্ধি, মানব প্রকৃতি ও বিশ্ব পরিস্থিতি এমনি একজন নেতার জন্ম দাবী করে। যিনি এ যুগে অথবা যুগের হাজারো আবর্তনের পর জন্মলাভ করতে পারেন। তাঁরই নাম ইমামুল মাহদী । (তাজদীদ এ ইহইয়ায়ে দীন : অনুবাদ- ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন : ১৯-২১ পৃ. প্রকাশকাল : ৩১ জানুয়ারী ১৯৮০ ইং।
মওদুদী সাহেব উম্মতের যে চিত্র অংকন করেছেন তা বিশ্লেষণ করে বুঝা যায়, এর মাধ্যমে তিনি এ কথাই বলতে চেয়েছেন যে, সাহাবীদের প্রাথমিক যুগ থেকে নিয়েই ইসলামের উপর জাহিলিয়াতের আগ্রাসন চলে আসছে। বাদশাহ ইলাহ হয়ে বসে আছে। জনসাধারণ শিরক মিশ্রিত জাহিলিয়াতের জালে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। উলামা-মাশায়েখ সাধারণ লোকদেরকে মরফিয়া ইনজেকশান দিতে আরম্ভ করেছে। ইসলাম জাহিলিয়াতের অন্ধকারাচ্ছন্ন ময়দানে দিশেহারা হয়ে ধুকে ধুকে মরছে। কিন্তু সাহাবী, তাবেঈ, ইমাম, মুহাদ্দিস, মুজাদ্দিদ ও ফুকাহাদের থেকে কেউ অগ্রসর হয়ে আসেননি এহেন জাহিলিয়াতের খপ্পর থেকে উম্মতকে উদ্ধার করার জন্য এবং যথাযথভাবে ওয়ারাছাতে নবুওয়াতের দায়িত্ব আঞ্জাম দেয়ার জন্য। হয়তো বা তাঁরা জাহিলিয়াতের এজেন্টরূপে কাজ করেছেন নতুবা তারা জাহিলিয়াতের প্রতারণায় নিজস্ব স্বকীয়তাকে হারিয়ে ফেলেছেন। ফলে ইসলাম তাদের নিকট দ্বিতীয় স্তরে নেমে এসেছে। তবে গোনাবাছা কতিপয় ব্যক্তি নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনে কোন রকমে ইসলামী তালীমাতকে ধরে রেখেছেন। এ কথাটিই প্রকাশ করে তিনি বলেছেন-
১. রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা জাহিলিয়াতের হাতে, আর ইসলাম চলছে শুধু কেবল দ্বিতীয় স্তরে। ২. অথবা এখানে কয়েকজন এবং সেখানে কয়েকজন নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনে ইসলাম মেনে চলছে, অথচ সমষ্টিগতভাবে জীবনের এক ব্যাপক পরিধিতে ইসলাম ও জাহিলিয়াত মিশ্রিত হয়ে এক সাথে মিলে ঝুলে চলছে, প্রচলিত উভয় ব্যবস্থাই নবী প্রেরণের মূল উদ্দেশ্যের জন্য সহায়ক নয়। তাই দীনের জন্য প্রত্যেক যুগে এমন শক্তিশালী ব্যক্তি, দল এবং প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন ছিল এবং বর্তমানেও আছে যা বিকৃত এবং আদর্শবিবর্জিত জাতির গতি পাল্টিয়ে পুনরায় ইসলামের দিকে ফিরিয়ে দিবে। [তাজদীদে ইহইয়ায়ে দীন : ৪২ পৃ.]
জনাব মওদুদীর লেখায় এ কথাই প্রতিভাত হচ্ছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর তিরোধানের পর পঁচিশ বছর যেতে না যেতেই গোটা মুসলিম সমাজ নবী প্রেরণের মূল উদ্দেশ্যের কথা ভুলে যায়- এ চরম ঘৃণিত ও জঘন্যতম অপরাধ। এ বক্তব্যের পেছনে সম্ভবত তার উদ্দেশ্য হল আসলাফ ও আকাবির সম্পর্কে ভবিষ্যত বংশধরদের মনে কুভাব ও খারাপ ধারণা সৃষ্টি করা। এ জঘন্যতম ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিয়ে তিনি এমন খেদমতই আঞ্জাম দিয়েছেন যা পূর্ববর্তীকালে শিয়া, রাফিযী ও অন্যান্য বাতিল সম্প্রদায় এবং পরবর্তীকালে কাদিয়ানী চক্রালোভী, পারতেয়ী, কমিউনিস্ট এবং সমস্ত নাস্তিক ও বস্তুবাদী লোকেরা আঞ্জাম দিয়েছিলেন।
মুজাদ্দিদীনে উম্মত
কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও বিভ্রান্ত মানব সমাজকে সুপথে আনয়নের জন্য এবং সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য যুগে যুগে আল্লাহ তাআলা এ পৃথিবীতে বহু মুজাদ্দিদ ও যুগ সংস্কারক পাঠিয়েছেন। এদের মধ্যে হযরত উমর ইবন আবদুল আযীয, ইমাম আবু হানীফা, ইমাম মালিক, ইমাম শাফী, ইমাম আহমদ, ইমাম ইবন হাম্বল, ইমাম গাযালী, ইমাম ইবন তায়মিয়্যা, মুজাদ্দিদে আলফেসানী, শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী, আমীরুল মুমিনীন হযরত সায়্যিদ আহমদ বেরলভী, হযরত মাওলানা ইসমাঈল শহীদ (রহ.) প্রমুখ ব্যক্তির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এদের তাজদীদী কারনামা সর্বজন স্বীকৃত। এতদসত্ত্বেও এ সমস্ত মনীষীগণ জনাব মওদুদী সাহেবের তীক্ষ্ণ আক্রমণ থেকে রেহাই পাননি। তিনি সর্বজন শ্রদ্ধেয় বুযুর্গ, যুগের সার্থক সংস্কারক জনাব উমর ইবন আবদুল আযীয (রহ.) সম্বন্ধে মন্তব্য প্রকাশ করে বলেন- হযরত উমর ইবন আবদুল আযীয (রহ.) এ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তিনি সফলকাম হতে পারেননি।’
চার ইমাম তথা ইমাম আবু হানীফা, মালিক, শাফেয়ী ও আহমদ ইবন হাম্বল (রহ.) সম্পর্কে বলেন- তাঁরা উসূলে দীন থেকে ইসলামের মৌলিক কানুনসমূহকে সুবিন্যস্ত করেছেন বটে কিন্তু তাঁরা আম্বিয়ায়ে কেরামের মিশনের জন্য কোন কাজই করে যাননি। অর্থাৎ যে কাজ অবশ্য করণীয় ছিল সে কাজে তাদের হস্ত স্পর্শও হয়নি।
দার্শনিক আলেম ইমাম গাযালী সম্পর্কে তিনি বলেন, ইমাম গাযালীর সংস্কারমূলক কাজের মধ্যে কতিপয় তত্ত্ব ও চিন্তাগত ত্রুটিও ছিল। এগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। ১. হাদীসশাস্ত্রে দুর্বল হবার কারণে তার কার্যাবলীতে এক ধরনের ত্রুটি দেখা দেয়। ২. দ্বিতীয় ধরনের ত্রুটি তার বুদ্ধিবৃত্তির উপর যুক্তিবাদিতা ও ন্যায়শাস্ত্রের কর্তৃত্বের কারণে সৃষ্টি হয়। ৩. আর তৃতীয় ধরনের ত্রুটির উৎপত্তি হয় তাসাউফের দিকে তাঁর প্রয়োজনাতিরিক্ত ঝুঁকে পড়ার কারণে। [তাজদীদে ইহইয়ায়ে দীন অনুবাদ- ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন : ৪৯ পৃ. প্রকাশকাল : ৩১ জানুয়ারী ১৯৮০ ই ইমাম গাযালীর পর আল্লামা ইবন তায়মিয়্যার পালা। আল্লামা ইবন তায়মিয়্যা সম্পর্কে মওদুদী সাহেব বলেন, তবুও সত্য যে, তিনি এমন কোন রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হননি যার ফলে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বিপ্লব সূচিত হতো এবং কর্তৃত্বের চাবিকাঠি জাহিলিয়াতের হাত থেকে ইসলামের হাতে স্থানান্তরিত হতো। [ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন : ৫৫ পূ.]
এরপর তিনি মুজাদ্দিদে আলফেসানী, শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী, হযরত সাইয়্যেদ আহমদ বেরেলভী ও মাওলানা ইসমাঈল শহীদ (রহ.) সম্পর্কে সমালোচনা করে বলেন-
হযরত মুজাদ্দিদে আলফেসানীর যুগ থেকে নিয়ে শাহ ওয়ালী উল্লাহ ও তাঁর প্রতিনিধিবৃন্দের সময় পর্যন্ত যাবতীয় সংস্কারমূলক কাজে যে জিনিসটি প্রথম আমার চোখে বাধে তা হলো এই যে, তারা তাসাউফের ব্যাপারে মুসলমানদের রোগ পুরোপুরি অনুধাবন করতে পারেননি এবং অজানিতভাবে তাদেরকে পুনর্বার সেই খাদ্য দান করেন যা থেকে তাদেরকে পূর্ণরূপে দূরে রাখার প্রয়োজন ছিল। তারা যে তাসাউফ পেশ করেন তার মূল কাঠামোর বিরুদ্ধে আমার কোন আপত্তি নেই; বরং প্রাণবস্তুর দিক থেকে তা ইসলামের আসল তাসাউফ। এ তাসাউফ ‘ইহসান’ থেকে মোটেই ভিন্নতর নয়। কিন্তু যে বস্তুটি আমি পরিত্যাজ্য বলছি তা হল তাসাউফের রূপক, উপমা ও ভাষা ব্যবহার এবং তাসাউফের সাথে সামঞ্জস্যশীল পদ্ধতি জারী রাখা। বলা বাহুল্য, সত্যিকার ইসলামী তাসাউফ এ বিশেষ খোলসের মুখাপেক্ষী নয়।
তাসাউফের প্রতি ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে জনাব মাওলানা এর কয়েক লাইন পর লিখছেন :
বর্তমান পরিস্থিতি এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, কোন ব্যক্তি যতই নির্ভুল শিক্ষা দান করুক না কেন এ ছাঁচ ব্যবহার করার সাথে সাথেই শত শত বছরের প্রচলনের ফলে এর সাথে যে সব রোগ সংশ্লিষ্ট হয়েছে সেগুলোর পুনরাবির্ভাব ঘটে। কাজেই পানির ন্যায় হালাল বস্তুও যেমন ক্ষতিকর প্রমাণিত হলে রোগীর জন্য নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় অনুরূপভাবে এ ছাঁচ বৈধ হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র এ কারণেই পরিত্যাজ্য যে, এরই আবরণে মুসলমানদের মধ্যে আফিমের নেশা সৃষ্টি করা হয়েছে। এর নিকটবর্তী হতেই পুরাতন রোগীদের মানসপটে আবার সেই ঘুম পাড়ানীর কথা ভেসে উঠে যা শত শত বছর থেকে গায়ে পিঠে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে তাদেরকে নিদ্রাভিভূত করেছে।
এরপর তিনি আরো বলেছেন-
মুসলমানদের এ রোগ সম্পর্কে হযরত মুজাদ্দিদে আলফেসানী ও শাহ ওয়ালী উল্লাহ অনবগত ছিলেন না। উভয়ের রচনায় এর সমালোচনা করা হয়েছে। সম্ভবত এ রোগের ব্যাপকতা সম্পর্কে তাঁদের পূর্ণ ধারণা ছিল না। এ কারণেই তাঁরা এই রোগীদেরকে পুনর্বার এমন পথ্য দান করেন যা এই রোগে ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছিল। ফলে তাঁদের উভয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ধীরে ধীরে আবার সেই পুরাতন রোগে আক্রান্ত হতে থাকে। যদিও মাওলানা শাহ ইসমাইল শহীদ (রহ.) এ সত্য যথার্থরূপে উপলব্ধি করে ইমাম ইবন তায়মিয়্যার নীতি অনুসরণ করেন। কিন্তু শাহ ওয়ালী উল্লাহর রচনাবলীতে এর যথেষ্ট সাজ-সরঞ্জাম মজুদ ছিল। তাই শাহ ইসমাঈল শহীদের রচনাবলী এ থেকে প্রভাব মুক্ত থাকতে পারেনি। কাজেই সাইয়্যেদ আহমদের আন্দোলনেও পীর-মুরিদীর সিলসিলা চালু হয়ে গিয়েছিল। তাই সুফিবাদের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে এ আন্দোলনও মুক্ত থাকতে পারেনি । এমনকি সাইয়্যেদ আহমদের শাহাদাত লাভের পরই তাঁর সমর্থকদের মধ্যে এমন একটি দলের উদ্ভব হয় যারা শিয়াদের ন্যায়। তার অদৃশ্য হবার কথা বিশ্বাস করেন এবং আজও তার পুনরাবির্ভাবের প্রতীক্ষায় আছেন। [তাজদীদে ইহইয়ায়ে দীন, অনুবাদ: ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন : ৮৬-৮৮ পৃ., প্রকাশকাল ৩১ জানুয়ারী ১৯৮০ ইং]
ইসলামী উলুম ও জ্ঞান-বিজ্ঞান
জনাব মওদুদীর দৃষ্টিতে আকাবিরে উম্মত তথা পূর্বসূরি উলামায়ে কেরামের কেউ যেহেতু নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী নন তাই তাদের সিলসিলায় আগত ইলমও তার নিকট কবুলিয়াতের মর্যাদা লাভ করতে সক্ষম হয়নি। পূর্বসূরি আকাবিরদের সিলসিলায় আগত ইলমের মাঝে ‘নতুন ইজতিহাদের প্রয়োজন’ এ কথার প্রতি জোর দিয়ে তিনি ইসলামী উলুম ও জ্ঞান- বিজ্ঞানের উপর যে কটাক্ষ করেছেন নমুনাস্বরূপ সংক্ষিপ্তাকারে পাঠক ভাইদের সামনে তা তুলে ধরলাম ।
→ কুরআন মজীদের ব্যাখ্যার জন্য কোন তাফসীরের প্রয়োজন নেই। একজন উঁচু স্তরের প্রফেসরই এর জন্য যথেষ্ট, যিনি অত্যন্ত সুগভীরভাবে কুরআন অধ্যয়ন করেছেন এবং নতুন পদ্ধতিতে কুরআন পড়াতে ও বুঝাতে সক্ষম। তিনি নিজ বক্তৃতার মাধ্যমে আই,এ ক্লাসে অধ্যয়নরত ছাত্রদের মাঝে কুরআন বুঝার প্রয়োজনীয় যোগ্যতা সৃষ্টি করতে পারেন। এরপর বি,এ ক্লাসে তিনি ছাত্রদেরকে এমনভাবে কুরআন শিক্ষা দেবেন যাতে ছাত্ররা আরবী ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ করার পাশাপাশি ইসলামের মূল প্রাণবস্তু সম্পর্কেও যথাযথ অবগতি লাভ করতে সক্ষম হবে। [তানকীহাত : ১৯৩ পৃ. ৪র্থ সংস্করণ])
ইলমে হাদীস সম্পর্কে তাফহীমাত গ্রন্থে ‘মাসলাকে ইতিদাল’-এর শিরোনামে ২৮৭ পৃষ্ঠা থেকে ২৯৮ পৃষ্ঠা পর্যন্ত মওদুদীর একটি আলোচনা রয়েছে। এতে তিনি যে খিয়ালাত প্রকাশ করেছেন, এর মূল বক্তব্য হল এই যে, হাদীস সহীহ হওয়া মুহাদ্দিসগণের বর্ণনার উপর নির্ভরশীল নয়; বরং তা মূলত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মিয়াজ বুঝার উপর নির্ভরশীল।
৯) তিনি বলেন, হাদীস তো কতিপয় মানুষ হতে কতিপয় মানুষের নিকট পৌঁছেছে। কাজেই এর সত্যতা সম্বন্ধে নিশ্চিত বিশ্বাস জন্মিতে পারে না। বড় জোর ধারণা করা যেতে পারে। [তরজুমানুল কুরআন : রবিউল আউয়াল সংখ্যা : ১৩৬৫ হি.]
→ মানুষের কাজের মধ্যে ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে যাওয়া স্বাভাবিক। ত্রুটি বিচ্যুতি থেকে মানুষ সংরক্ষিত নয়। সুতরাং এ কথা কি করে বলা যায় যে, মুহাদ্দিসীনে কেরাম যে হাদীসকে সহীহ বলে অবিহিত করেছেন, আসলেও তা সহীহ্? [তাফহীমাত : ২৯২ পৃ. ৪র্থ সংস্করণ])
তাফসীর ও হাদীসের পর ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ইলমে ফিকাহ বা ফিকাহশাস্ত্রই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ বিষয়ের উপরও জনাব মওদুদীর কোন এতেমাদ ও আস্থা নেই। আছে শুধু ঘৃণা, নিন্দা ও তুচ্ছ- তাচ্ছিল্যমূলক কথা। ইলমে ফিকাহর তীব্র সমালোচনা করে ‘হুকূকুয্ ‘যাওজায়ন’ নামক গ্রন্থে তিনি বলেছেন-
→ কিয়ামতের দিন গুনাহগার লোকদের সাথে তাদের ধর্মীয় নেতৃস্থানীয় লোকদেরকেও আল্লাহর দরবারে উপস্থিত করা হবে। আল্লাহ তাআলা তাদেরকে জিজ্ঞেস করবেন, আমি কি তোমাদেরকে জ্ঞান ও বিবেচনা শক্তি এ জন্য প্রদান করেছি যে, তোমরা এর দ্বারা কোন কাজ নিবে না? আমার কিতাব এবং আমার নবীর সুন্নাত এ জন্যই কি তোমাদের নিকট ছিল যে, তোমরা এ নিয়ে কেবল ঘরের কোণায় বসে থাকবে আর অন্যদিকে মুসলিম সম্প্রদায় গোমরাহী এবং বিভ্রান্তির মধ্যে নিমজ্জিত হবে! আমি তো আমার দীনকে সহজ বানিয়ে ছিলাম, কি অধিকার ছিল তোমাদের এ দীনকে কঠিন বানানোর? আমি তো কেবল কুরআন এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুকরণের নির্দেশ দিয়েছিলাম, কে তোমাদের উপর ফরয করেছে এর থেকে অগ্রসর হয়ে আসলাফ ও আকাবিরদের অনুসরণ করার? সব সমস্যার সমাধান আমি কুরআনে দিয়েছি। কুরআনে হাত না লাগিয়ে মানব রচিত গ্রন্থাদিকে নিজেদের জন্য যথেষ্ট মনে করার কে তোমাদের নির্দেশ দিয়েছে? এ প্রশ্নের উত্তরে কোন আলেম কানযুদ্দাকায়েক, হেদায়া এবং আলমগীরী গ্রন্থত্রয়ের লেখকবৃন্দের আশ্রয় নিতে পারবেন বলে আশা করা যায় না। তবে মূর্খ লোকদের তো এ জবাব দেয়ার অবশ্যই সুযোগ থেকে যাবে যে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আমাদের নেতা ও বড় লোকদের আনুগত্য করেছিলাম, তারাই আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিল। [হুকুকুয্ যাওজায়ন ৯৮ পৃ.]
• পুরাতন ফিকাহ অচল হয়ে গিয়েছে, নতুন ফিকাহর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। [তরজুমানুল কুরআন : ১৩৫৩ হিজরী]
আত্মম্ভরিতা
পূর্বসূরি আলিমদের প্রতি যেহেতু জনাব মওদুদী সাহেব আস্থাশীল নন, তাই তিনি দীনের ইহাম ও তাহীমও অনুধাবনের ক্ষেত্রে নিজের জ্ঞান- গরিমা, বুদ্ধি-বিবেচনা এবং যোগ্যতার উপরই আস্থাশীল হতে বাধ্য হন। এ অবাস্তব বাহাদুরী ও আত্মম্ভরিতার শ্লোগান দিয়ে তিনি বলেন-
• আমি দীন বুঝবার জন্য ছোট বড় কোন আলেমের প্রতি মুহতাজ ও মুখাপেক্ষী নই। বরং আমি নিজেই কুরআন ও সুন্নাহ মন্থন করে দীনের মূল উসুল এবং এ দেশের ধর্মীয় নেতৃস্থানীয় লোকেরা কোন বিশেষ মাসআলাতে সহীহ পথ অবলম্বন করছেন, না গরল পথ অবলম্বন করছেন, তার তাহকীক ও বিশ্লেষণে সম্পূর্ণভাবে সক্ষম। তাই কুরআন ও সুন্নাহ থেকে যে হকের আমি সন্ধান পাই তাই আমি হক হিসাবে বুঝি ও হক হিসাবে প্রকাশ করি। এ ক্ষেত্রে আমি যেন একেবারে মজবুর এবং নিতান্তই অপারগ। [রোয়েনাদে ইজতিমায়ে জামাতে ইসলামী, ইলাহবান : ৪৩ পৃ. তরজুমানুল কুরআন মে সংখ্যা ১৯৪৬ ইং
‘দীনের কথা সনদ ব্যতীত গ্রহণযোগ্য নয়’- এ নীতির প্রতি চরম ধৃষ্ঠতা প্রদর্শন করে তিনি বলেছেন-
● আমি দীন ইসলামকে বর্তমান কি অতীতের ব্যক্তিদের নিকট থেকে বুঝার চেষ্টা না করে সব সময়ই কুরআন ও নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাত থেকে বুঝার চেষ্টা করেছি। এ জন্য খোদার দীন আমার নিকট এবং অন্যান্য ঈমানদার ব্যক্তিদের নিকট কি দাবী করে তা জানার জন্য কোন বুযুর্গ ব্যক্তি কি করেন আর কি বলেন, সেদিকে আদৌ ভ্রূক্ষেপ করিনি। বরং আমি সর্বদাই কুরআন কি বলে আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি বলেছেন এ কথাই বুঝার চেষ্টা করেছি। সর্বাত্মকভাবে। [রোয়েদানে জামাতে ইসলামী, ৩য় খণ্ড : ১০৬ পৃ. ৩য় সংস্করণ : মার্চ ১৯৬০ ইং।
ইসলামের রাজনৈতিক ব্যবস্থা
সলফে সালেহীন এবং আকাবিরদের উপর আস্থাশীল না হয়ে নিজ বুদ্ধিবৃত্তির উপর আস্থাশীল হওয়ার ফলশ্রুতিতে আকাবিরে উম্মত দীনকে যে আঙ্গিকে উপলব্ধি করেছিলেন জনাব মওদুদী এর থেকে ভিন্নতর পদ্ধতিতে দীনকে উপলব্ধি করেন। তাঁর নিকট একটি রাজনৈতিক আন্দোলনেরই নাম দীন ইসলাম, যা এ পৃথিবীতে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব কায়েন করার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। তাই তিনি বলেছেন-
→ ইসলামী আন্দোলনের মাঝে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই হলেন এমন এক অদ্বিতীয় লীডার যাঁর জীবনে আন্দোলনের প্রাথমিক আহ্বান থেকে আরম্ভ করে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্রের রূপরেখা এবং এর সংবিধান রচনা করা পর্যন্ত প্রতিটি দিক ও প্রতিটি ক্ষেত্রের বিস্তারিত এবং নির্ভরযোগ্য বিবরণ পাওয়া যায়।
এ সময় (ইসলামী) আন্দোলনের লীডার হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় আন্দোলনের মূলনীতি এবং এর মূল প্রতিপাদ্য বিষয়গুলোও সুস্পষ্টভাবে সমাজের সামনে তুলে ধরেন। তবে যে লীডারকে আল্লাহ রাহনুমায়ী এবং পথ প্রদর্শনের জন্য পাঠিয়েছিলেন, তিনি তৎকালীন পৃথিবী এবং নিজ দেশীয় সমস্যাবলীর থেকে কোন সমস্যার দিকেই মাথা উঁচু করে দেখেননি। তিনি তো কেবল আহ্বান জানিয়েছিলেন সমস্ত মনগড়া ইলাহকে বর্জন করে এক আল্লাহর দাসত্ব মেনে নেয়ার জন্য। [ইসলামী হুকুমত কিস তরাহ কায়েম হুতি হায় : ২৩, ২৪, ৩২ পৃ.]
ইসলাম কি এবং মুসলমান কাকে বলে? এ সম্পর্কে এক নতুন তথ্য সংযোজন করে তিনি বলেন- ) প্রকৃতপক্ষে ইসলাম কোন ধর্ম এবং মুসলমান কোন জাতি বিশেষের নাম
নয়। বরং ইসলাম হল এক বৈপ্লবিক আহ্বান, মতাদর্শ ও বৈপ্লবিক মতবাদ। যা প্রচলিত সকল মতাদর্শকে উৎখাত করে নিজ দৃষ্টিভঙ্গি মোতাবেক এ পৃথিবীকে গড়ে তুলতে চায়। [তাফহীমাত : ৬২ পৃ.] (দ্র. ফিতনায়ে মওদুদিয়াত : ৪৪ পৃ.
মওদুদীর নিকট রাজনৈতিক কর্তৃত্ব লাভ করাই হল মূল ইবাদত। নামায,
রোযা, হজ, যাকাত ইত্যাদি ইবাদত হল ফৌজী ট্রেনিং এবং অনুশীলনের
মত অনুশীলনী বৈ আর কিছু নয়। তিনি বলেছেন-
• এই হল ঐ ইবাদতের হাকীকত, যার সম্পর্কে মানুষ এ ধারণা পোষণ করে আসছে যে, নামায, রোযা, তাসবীহ-তাহলীল ইত্যাদিই হল একমাত্র ইবাদত। পার্থিব মু’আমালাত, লেনদেন ইত্যাদির সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। অথচ নামায, রোযা, হজ, যাকাত, যিকর, তাসবীহ-তাহলীল প্রভৃতি বিষয়গুলো এক বৃহৎ ইবাদতের জন্য তৈরি করার লক্ষ্যে এক বিশেষ প্রশিক্ষণ ও ট্রেনিং মাত্র। [তাফহীমাত : ৪র্থ সংস্করণ: ৫৬ পৃ.J
● ইবাদতের প্রতি তিনি ব্যঙ্গ করে বলেন, বিশেষ বিশেষ লোকেরা উল্টো পথ অবলম্বন করেন। অর্থাৎ তারা তাসবীহ ও মুসল্লা নিয়ে হুজরায় বসে যান। অথচ আল্লাহর বান্দাগণ বিভ্রান্তিতে নিমজ্জিত হচ্ছে, দুনিয়ার মধ্যে জুলুম ও অন্যায় সম্প্রসারিত হচ্ছে, বাতিলের অন্ধকার হকের আলোকে গ্রাস করে নিচ্ছে, জালিম ও খোদাদ্রোহী লোকেরা জমিনের কর্তৃত্ব কেড়ে নিচ্ছে, খোদায়ী অনুশাসনের পরিবর্তে তাগুতী অনুশাসনের আনুগত্য করানো হচ্ছে। কিন্তু তারা নফলের পর নফল পড়ছে, তাসবীহর দানা টানছে আর ‘হু’ ‘হক’ বলে যিকরের লহরী তুলছে। এমনকি তারা শুধু কেবল তিলাওয়াতের উদ্দেশ্যে হাদীস পাঠ করছে আর সীরাতে রাসূল ও সাহাবায়ে কেরামের আদর্শের উপর জোরালো ভাষায় ওয়ায করছে। কিসসা-কাহিনী বয়ান করাই তাদের এ আলোচনার মূল উদ্দেশ্য। তারা সত্যের প্রতি আহ্বান, সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ এবং আল্লাহর পথে লড়াই করার শিক্ষা না কুরআন ও হাদীস থেকে গ্রহণ করছে, না রাসূলের সীরাত ও সাহাবীদের আদর্শ থেকে হাসিল করছে। এ কি ইবাদত? [তাফহীমাত : ৫৯ পৃ., ৪র্থ সংস্করণ ১৯৪৭ ইং]
জনাব মওদুদীর নিকট ইসলামের মূল প্রাণ হল রাজনৈতিক কর্তৃত্ব। তাই ইবাদত যতই গুরুত্বপূর্ণ হউক না কেন যদি তা রাজনৈতিক আন্দোলনের পক্ষে সহায়ক না হয় তাহলে এ ইবাদত তাঁর নিকট কোন ইবাদতই নয়। এ কারণে তিনি স্থানে স্থানে ইবাদতের প্রতি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ভাব প্রকাশ করেছেন। তাজদীদে ইহইয়ায়ে দীন পুস্তকে জনাব আল্লামা সাহেব ইমাম মাহদী সম্পর্কিত আলোচনায় বলেন-
মুসলমানদের মধ্যে যারা ইমাম মাহদীর আগমনের উপর বিশ্বাস রাখেন, তারা যথেষ্ট বিভ্রান্তির মধ্যে অবস্থান করছেন এবং তাদের এ বিভ্রান্তি মাহদীর আগমনে অবিশ্বাসী নতুন প্রথা প্রবর্তনকারী মুতাজাদ্দিদীন এর থেকে কোন অংশে কম নয়। তারা মনে করেন, ইমাম মাহদী পুরাতন যুগের কোন সুফী ধরনের লোক হবেন। তাসবীহ হাতে নিয়ে আকস্মিক কোন মাদ্রাসা বা খানকাহ থেকে বের হবেন। বাইরে এসে ‘আনাল মাহদী’ ‘আমিই মাহদী’ বলে চতুর্দিকে ঘোষণা করে দেবেন। উলামা ও শায়খগণ কিতাব পত্র বগলে দাবিয়ে তার নিকট পৌঁছে যাবেন এবং লিখিত চিহ্নসমূহের সঙ্গে তাঁর দেহের গঠন প্রকৃতি মিলিয়ে দেখে তাঁকে চিনে ফেলবেন। অতঃপর বায়আত গ্রহণ শুরু হবে এবং জিহাদের এলান করা হবে। সাধনা সিদ্ধ দরবেশ এবং এ ধরনের গোড়া ধর্মবিশ্বাসীরা তাঁর পতাকাতলে সমবেত হবেন, নেহাত শর্ত পূরণ করার জন্য নামমাত্র তলোয়ার ব্যবহার করার প্রয়োজন হবে, নয়তো আসলে সমস্ত কাজ বরকত এবং রুহানী শক্তি বলেই সমাধা হয়ে যাবে। দুআ-দরূদ যিকর আযকার ও ফুৎকারের মাধ্যমেই ময়দান করায়ত্ব হবে। যে কাফিরের প্রতি দৃষ্টিপাত করা হবে সেই মুষড়ে পড়ে বেহুশ হয়ে যাবে এবং নিছক বদদুআর প্রভাবে ট্যাংক ও জঙ্গী বিমানসমূহ ধ্বংস হয়ে যাবে। মাহদীর আবির্ভাব সম্বন্ধে সাধারণ লোকদের মধ্যে এ ধরনের বিশ্বাসীর অস্তিত্ব পাওয়া যায়। কিন্তু আমি যা অনুধাবন করছি তাতে দেখছি ব্যাপার সম্পূর্ণ উল্টো। আমার মতে আগমনকারী ব্যক্তি তাঁর নিজের যুগের একজন সম্পূর্ণ আধুনিক ধরনের নেতা হবেন। সমকালীন সকল জ্ঞান-বিজ্ঞানে তিনি হবেন মুজতাহিদের ন্যায় গভীর জ্ঞানসম্পন্ন, জীবনের সকল প্রধান সমস্যাকে তিনি ভালভাবে উপলব্ধি করবেন। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতা এবং যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শিতার দিক দিয়ে সমগ্র বিশ্বে তিনি নিজেকে শ্রেষ্ঠ বলে প্রমাণিত করবেন এবং সকল আধুনিকদের চাইতে বেশি আধুনিক প্রমাণিত হবেন। আমার আশংকা হয় তাঁর নতুনত্বের বিরুদ্ধে মৌলভী ও সুফী সাহেবরাই সবার আগে চিৎকার শুরু করবেন। [তাজদীদে ইহইয়ায়ে দীন : ৫৫ পৃ. ৬ষ্ঠ সংস্করণ: মার্চ ১৯৫৫ ইং]
কুরআন শরীফ মুক্ত মুতালাআ বা মুক্ত অধ্যয়নের প্রবক্তা জনাব আবুল আলা মওদুদী সাহেব দীনের অন্যতম উৎস কুরআন শরীফ সম্পর্কে এমন সব মন্তব্য করেছেন যার ফলে হিফাযতে কুরআনের ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি পালন না করার ব্যাপারে আল্লাহ তাআলার উপর এক জটিল অভিযোগ আপতিত হয়। নিম্নে মাওলানার আলোচনা থেকেই এ কথার প্রমাণ পেশ করছি-
কুরআনের শিক্ষা অনুধাবন করার জন্য পরিভাষা চতুষ্টয় (ইলাহ, রব, দীন, ইবাদত)-এর সঠিক এবং পরিপূর্ণ তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করা একান্তভাবে অপরিহার্য। ইলাহ, রব শব্দের অর্থ কি, ইবাদতের সংজ্ঞা কি, দীন কাকে বলে, কোন ব্যক্তি যদি তা না জানে তবে তার কাছে সম্পূর্ণ কুরআনই অর্থহীন হয়ে পড়বে। সে তাওহীদ জানতে পারবে না, শিরক বুঝতে পারবে না, ইবাদতকে একান্তভাবে আল্লাহর জন্য নিবেদিত করতে পারবে না এবং দীনকে করতে পারবে না আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট। অনুরূপভাবে কারো মানসপটে যদি এ পরিভাষাগুলোর তাৎপর্য অস্পষ্ট এবং অসম্পূর্ণ থাকে, তবে তার জন্য কুরআনের গোটা শিক্ষাই হবে অস্পষ্ট। কুরআনের প্রতি ঈমান রাখা সত্ত্বেও তার আকীদা এবং আমল বিশ্বাস বা ধর্ম উভয়ই থেকে যাবে অসম্পূর্ণ। সে মুখে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, ‘আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই’ বলবে আর তা সত্ত্বেও অনেককে ইলাহ বানাতে থাকবে। *আল্লাহ ছাড়া কোন রব নেই’ এ কথা মুখে ঘোষণা করলেও কার্যত অনেকেই তার রব সেজে বসবে। সে একান্ত নেক নিয়তের সাথে বলবে, আল্লাহ ছাড়া আর কারো ইবাদত করি না, কিন্তু এতদসত্ত্বেও আরো অনেক মাবুদের ইবাদত্বে মশগুল থাকবে। সে একান্ত জোর দিয়ে বলবে, আমি আল্লাহর দীনে আছি। অন্য কোন দীনে আছে বলে বলা হলে সে লড়াই করতে উদ্যত হবে। কুরআন কী চার বুনয়াদী ইসতিলাহেঁ ১-১০ পু. এরপর তিনি ‘ভুল ধারণার মূল কারণ’ শিরোনামে বলেছেন-
আরবে যখন কুরআন পেশ করা হয় তখন প্রত্যেকেই জানতো ইলাহ শব্দের অর্থ কি, রব কাকে বলা হয়। কারণ, তাদের কথোপকথনে এ শব্দদ্বয় পূর্ব হতেই ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। কিন্তু কুরআন নাযিলকালে এ শব্দগুলোর যে অর্থ প্রচলিত ছিল, পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে ধীরে ধীরে সে অর্থ পরিবর্তিত হতে থাকলো। শেষ পর্যন্ত এক একটি শব্দ তার সম্পূর্ণ ব্যাপকতা থেকে দূরে সরে একান্ত সীমিত বরং অস্পষ্ট অর্থের জন্য নির্দিষ্ট হয়ে পড়লো। এর এক কারণ ছিল, আরবী ভাষার প্রতি সঠিক স্পৃহার অভাব, দ্বিতীয় কারণ ছিল ইসলামী সমাজে যেসব ব্যক্তির উদ্ভব হয়েছে তাদের কাছে ইলাহ, রব, দীন ও ইবাদতের সে অর্থ অবশিষ্ট ছিল না, যা কুরআন নাযিলকালে অমুসলিম সমাজেও প্রচলিত ছিল। এ কারণে পরবর্তীকালের অভিধান এবং তাফসীর গ্রন্থে কুরআনী শব্দের ব্যাখ্যা করা হয়েছে আভিধানিক অর্থের পরিবর্তে এমন সব অর্থে যা পরবর্তীকালের মুসলমানরা বুঝতো। কুরআন কী চার বুনিয়াদী ইসতিলাহেঁ : ১২ পৃ.]
কুরআনের এ মূল পরিভাষা সম্পর্কে অনবগতির কারণে কি ভয়াবহ পরিণাম দাঁড়াল, এর সম্বন্ধে জনাব মওদুদী বলেন- এটা সত্য যে, কেবল এ চারটি মৌলিক পরিভাষার তাৎপর্য ঢাকা পড়ে যাওয়ার কারণে কুরআনের তিন চতুর্থাংশের চেয়েও বেশি শিক্ষা বরং তার সত্যিকার স্পিরিটই দৃষ্টি হতে প্রচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। [কুরআন কী চার বুনিয়াদী ইসতিলাহেঁ : দশম সংস্করণ : ১৪ পৃ.
জনাব মওদুদী এ সম্বন্ধে স্পষ্ট করে উল্লেখ করেন যে, তিন চতুর্থ… শিক্ষা বর্তমানে দৃষ্টির অন্তরালে রয়ে গেছে। অথচ আল্লাহ তাআলা নিজে কুরআনের হিকমতের কথা দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন।
এখন আমরা উপরোক্ত বিষয়গুলো সম্পর্কে ইসলামের সঠিক আকীদা, দর্শন ও ব্যাখ্যা কি তা তুলে ধরার প্রয়াস পাব।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদা
ইসমত ও নিষ্পাপতা নবুওয়াতের অপরিহার্থ গুণ। নবী থেকে, রাসূল থেকে রিসালাতের পৃথক হওয়া যেমন এক মুহূর্তের জন্যও চিন্তা করা যায়। না, তেমনি এ কথারও কল্পনা করা যায় না যে, নবী ও নবুওয়াত হতে, রাসূল ও রিসালাত হতে পলক মাত্র সময়ের জন্যও ইসমত আলাদা হতে পারে। তাই ইসলামের আকীদা হল, আম্বিয়ায়ে কেরাম হলেন মাসুম। পাপাচার ও নাফরমানী তাঁদের থেকে প্রকাশ পাওয়া একেবারেই অসম্ভব। সুতরাং ‘নবীগণ মানুষ’ এ কথা প্রমাণ করার জন্য, নবীগণ দু’একটি পাপকার্য করেছেন অথবা অমুক নবী দায়িত্ব পালনে কুতাহী ও ত্রুটি করে গিয়েছেন বা অমুক নবী আল্লাহ তাআলার অনুমতি না নিয়েই স্বীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে সরে পড়েছেন। এমনতর উক্তি করা নবী ও রাসূলগণ সম্পর্কে চরম ধৃষ্ঠতা বৈ কিছুই নয়। কারণ, এতে নবীদের অযোগ্যতা ছাবিত হওয়ার সাথে সাথে মহাজ্ঞানী সর্বদ্রষ্টা আল্লাহর উপরও নবী নির্বাচনে ভ্রান্ত ও অযোগ্য হওয়ার অপবাদ আপতিত হয়।
→ ইমাম আবুল হাসান আশআরী (রহ.) ইবানাহ নামক গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে, সকল সাহাবীই মুজতাহিদ ছিলেন। নবী করীম সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদেরকে জান্নাতী ও সাক্ষ্য দেয়ার উপযুক্ত বলে খোশ-খবরী দিয়েছেন। এর দ্বারা বুঝা যায় যে, তাঁরা সকলেই নিজ ইজতিহাদের মধ্যে হকের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। ধর্ম সম্বন্ধে তাঁদের কাউকে কোন দোষারোপ করা যাবে না। কারণ, আল্লাহ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদের প্রশংসা করেছেন এবং আমাদেরকে তাঁদের সম্মান করার ও তাঁদের প্রতি ভালবাসা রক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছেন। আর যারা তাঁদের প্রতি ঘৃণাভাব পোষণ করে, আমাদেরকে তাদের থেকে বেযার ও মুখ ফিরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা তাঁদের সকলের উপর রাজি হোন। ইবনে হাজর আসকালানী (রহ.) এসাবা গ্রন্থে এবং খতীবে বাগদাদী কেফায়াহ গ্রন্থে আবু যুরআ’ থেকে বর্ণনা করেছেন যে, যদি কোন ব্যক্তিকে
কোন সাহাবীর দোষ বর্ণনা করতে দেখ, তাহলে নিশ্চিত জানবে যে সে হল যিন্দিক ।
ইমাম তাহাবী (রহ.) আকীদাতুত্তাহাবী গ্রন্থে লিখেছেন, যারা সাহাবীদের সঙ্গে শত্রুতা ভাব পোষণ করে অথবা তাঁদের কুৎসা রটায় আমরা তাদেরকে শত্রু বলে মনে করি। সাহাবীদেরকে আমরা ভাল ধারণার সঙ্গে স্মরণ করব।
শরহে ফিকহে আকবর নামক গ্রন্থে ইমাম আবু হানীফা (রহ.) বলেছেন, আমরা সাহাবীদের গুণচর্চা ব্যতিরেকে কখনো দোষচর্চা করব না। আকায়েদের বিখ্যাত কিতাব আলমুসামারার ৩১৩ পৃষ্ঠায় বর্ণিত আছে, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদা হল, প্রত্যেক সাহাবীকে সত্যবাদী, ন্যায়পরায়ণ, মুত্তাকী, পরহেযগার, ইসলামের ও উম্মতের স্বার্থকে ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থান দানকারী মনে করা; তাঁদের প্রতি কটাক্ষ করা এবং তাঁদের দোষচর্চা করা কারো জন্য জায়েয নেই বরং সকলকেই সর্বদা তাঁদের গুণচর্চা করতে হবে।
→ কুরআনের ভাষায় হিদায়েত কিতাবুল্লাহ এবং রিজালুল্লাহ কিতাব অনুসারী মনীষীগণ উভয়ের উপরই মওকুফ। শুধু কিতাব পড়ে যেমন হিদায়েত লাভ করা যায় না অনুরূপভাবে শুধু রিজালের অনুসরণ করেও হিদায়েত হাসিল করা যায় না। বরং হিদায়েত লাভ করতে হলে আঁকড়িয়ে ধরতে হবে উভয় সূত্রকেই। তাই মুহাদ্দিসীনে কেরাম বলেছেন, সনদ ব্যতীত ধর্মীয় কোন কথাই গ্রহণযোগ্য নয়। অতএব, দীনের ইফহাম ও তাফহীম, দীনের প্রচার ও প্রসার এবং দীন বাস্তবায়ন প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবা, আইম্মা, ফুকাহা, মুজাদ্দিদীন ও মুহাদ্দিসীন ও সুলাহায়ে উম্মতের নিরলস প্রচেষ্টাকে খাটো করে দেখা, তাঁদের প্রতি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ভাব প্রদর্শন করা এবং তাঁদেরকে হেয় প্রতিপন্ন করা, তাঁদেরকে অনির্ভরযোগ্য এবং দায়িত্বহীন ঘোষণা করারই নামান্তর। এতে তারা খুদ বখুদই সিলসিলায়ে সনদ থেকে হটে যাচ্ছে। তাই হিফাযতে দীনের প্রয়োজনেই আকাবিরদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া এবং তাঁদের প্রতি ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করা থেকে বিরত থাকা আমাদের জন্য একান্ত কর্তব্য ।
” আল্লাহর ঘোষণা ও নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশ অনুযায়ী সাহাবা, তাবেঈন, তাবে-তাবেঈন এবং আইম্মায়ে মুজতাহিদীন কুরআন মজীদের যেরূপ ব্যাখ্যা করেছেন যা হাদীস ও তাফসীরের মূল্যবান ভাণ্ডারে বিদ্যমান রয়েছে, কুরআন মজীদের সেরূপ ব্যাখ্যা করা আমাদের জন্য অপরিহার্য, অন্যথায় পথচ্যুত হওয়া অবশ্যম্ভাবী।
পবিত্র হাদীসসমূহ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে মহামনীষী সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-এর বর্ণনার মাধ্যমে নির্ভরযোগ্য সূত্রে মুহাদ্দিসীনে কেরামের নিকট পৌঁছেছে। এরপর মুহাদ্দিসীনে কেরাম সাধ্যাতীত সতর্কতা অবলম্বন করত বর্ণনাকারীর সার্বিক অবস্থাদি, যোগসূত্র ইত্যাদি যাচাই বাছাই ও উসূলে হাদীসের ভিত্তিতে যাবতীয় পরীক্ষা- নিরীক্ষার পর তা গ্রহণ করেছেন। কাজেই হাদীসশাস্ত্র সত্য, বিশ্বাস্য ও নির্ভরযোগ্য।
আকাবিরে উম্মত ও আইম্মায়ে মুজতাহিদীন পবিত্র কুরআন ও হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে ইজতিহাদ বা গবেষণা ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে নির্ধারিত উসূল ও মূলনীতির ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় যাবতীয় মাসআলার সঠিক হুকুম নির্ণয় করেছেন। এটাই ফিকাহ নামে পরিচিত। ফিকাহর কিতাবসমূহ অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ও অত্যাবশ্যকীয় কিতাব। আধ্যাত্মিক রোগসমূহ দূর করে যথাযথ তাআল্লুক মাআল্লাহ আল্লাহর সঙ্গে সঠিক ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে ইবাদতের মান উন্নীত করার লক্ষ্যে নির্দিষ্ট এক হক্কানী পথ প্রদর্শক মুরব্বীর পথ ও তরীকত নির্দেশ অনুযায়ী আধ্যাত্মিক সাধনা করাকে তাসাওউফ বলে। আমাদের দেশের প্রচলিত ভাষায় এ তাসাওউফের পথ প্রদর্শককে পীর ও তার পথনির্দেশ অনুযায়ী সাধনাকারীকে মুরীদ বলে। পরিভাষায় তাসাওউফের আমলকারীকে সুফী বলে। এ তাসাওউফ বা ধর্মীয় সাধনার প্রতি ইসলামে যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
→ যেমনিভাবে পুঁথিগত বিদ্যার দ্বারা কেউ কাপড় সেলাই করতে পারে না, ডাক্তারী পুঁথিপত্র পাঠ করে কেউ ডাক্তার হতে পারে না, অনুরূপভাবে শুধু কুরআন ও হাদীস পাঠ করাই কোন মানুষের পরিপূর্ণ তালীম ও তরবিয়্যাতের জন্য যথার্থ হতে পারে না। যে পর্যন্ত কোন বিজ্ঞ লোকের নিকট বাস্তবভাবে শিক্ষা গ্রহণ না করে সে পর্যন্ত দীনের তালীম অসম্পূর্ণ থেকে যায়। ‘কুরআন ও তাফসীর পাঠ করে কুরআন ও হাদীস সম্পর্কে গভীর জ্ঞানের অধিকারী হওয়া যায়’- এ কথা একেবারেই অবাস্তব এবং প্রকৃতি বিরুদ্ধ কথা। কারণ, উস্তাদ ব্যতীত যদি পূর্ণাঙ্গ তালীম ও তরবিয়্যাত সম্ভব হত তাহলে কিতাবের সাথে নবী-রাসূল প্রেরণের কোন প্রয়োজনই ছিল না। এ কারণেই ইমাম বুখারী (রহ.) বলেছেন, সহীহ এবং বিশুদ্ধতম জ্ঞান লাভ করার অন্যতম উপায় হল কামেল উত্তাদের নিকট শিক্ষা গ্রহণ করা।
→ আকীদা ও ঈমানের পর ইসলামে যে জিনিসটির প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে সেটি হল ইবাদত। আর এ-ই হচ্ছে মানব সৃষ্টির সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। তাই আল্লাহ বলেছেন, মানুষ এবং জিনকে কেবল ইবাদত করার জন্যই আমি সৃষ্টি করেছি। এমনকি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী হওয়াও ইকামতে সালাতের জন্যই। তাই যথাযথভাবে নামায আদায় করাকে বুনিয়াদী আমল ঘোষণা দিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেছেন-
এরা হচ্ছেন তারা যে, এদের যদি আমি রাজ্য ক্ষমতার অধিকারী বানাই তবে এরা সালাত কায়েম করে, যাকাত আদায় করে, সৎ কাজের আদেশ দেয় এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখে। আল্লাহর হাতেই সকল কাজের পরিণাম। সুতরাং মৌল ইবাদত সালাত, সিয়াম, যাকাত, হজ ইত্যাদির গুরুত্বকে খাটো করে দেখা, এগুলোর প্রতি ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা দীনের বিষয়ে তাহরীফ বা বিকৃতি এবং কুফর ও ইলহাদের দরজা খুলে দেয়ারই নামান্ত র।
• ইসলামের আকীদা হল, নিশ্চয়ই কিয়ামতের পূর্বে ইমাম মাহদীর আগমন হবে। তিনি হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বংশে হযরত ফাতেমার খান্দানের সন্তান হয়ে জন্মগ্রহণ করবেন। তাঁর চেহারা নূরানী ও নাক সুগঠিত হবে। তাঁর চরিত্র হবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর চরিত্রের ন্যায়। তিনি সুন্নাতের পরিপূর্ণ অনুসারী হবেন এবং সমাজ থেকে অন্যায়-অবিচার দূরীভূত করে ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করবেন।
খিলাফতের দায়িত্ব অর্পিত হওয়ার ভয়ে তিনি মদীনা হতে মক্কায় চলে আসবেন, তখন লোকেরা তাঁকে চিনে ফেলবেন এবং তাঁর হাতে বায়আত গ্রহণ করবেন। ইহইয়ায়ে দীন, ইশাআতে ও হিফাযতে দীনের ক্ষেত্রে তাঁর এ মুবারক উদ্যোগের প্রতি সক্রিয় সহযোগিতা তৎকালীন সকল মুসলমানের জন্য অপরিহার্য হবে। ইমাম মাহদী সম্পর্কে কল্পনাপ্রসূতভাবে নতুন কোন ধারণা পোষণ করা বা তিনি তৎকালীন যুগের সর্বাধুনিক ব্যক্তি হবেন বলে প্রচার করা হাদীস ও ইজমায়ে উম্মতকে অস্বীকার করারই নামান্তর। এহেন উক্তি ও মন্তব্য থেকে বেঁচে থাকা প্রতিটি মুসলমানের জন্য অবশ্য কর্তব্য।
→ কুরআন শরীফ আল্লাহর কালাম। এর মর্ম ও শব্দ সবকিছু আল্লাহর তরফ থেকে অবতীর্ণ পরিপূর্ণ একটি কিতাব। সকল প্রকার তাহরীফ মানুষের পরিবর্তন পরিবর্ধন ও পরিমার্জন থেকে এটা সম্পূর্ণভাবে মুক্ত ও সংরক্ষিত। তাহরীফ হয়েছে বলে যদি কেউ বলে তবে সে ইসলামের গণ্ডিভুক্ত নয়। শব্দগত দিক থেকে কুরআন যেমনিভাবে সংরক্ষিত অনুরূপভাবে অর্থের দিক থেকেও তা পূর্ণাঙ্গভাবে সংরক্ষিত। ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরামের পরবর্তী যুগে কোন বিশেষ পারিভাষিক শব্দের পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান না থাকার কারণে কুরআনের তিন চতুর্থাংশের চেয়েও বেশি শিক্ষা মুসলমানদের দৃষ্টি থেকে প্রচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে’- মন্তব্য করা কুরআন অস্বীকার করারই নামান্তর। এহেন বিভ্রান্তি কর উক্তি থেকে বেঁচে থাকা প্রতিটি মুসলমানের জন্য অপরিহার্য।
মনীষীদের বাণী
শায়খুল আরব ওয়াল আজম হযরত মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী (রহ.) বলেছেন, মওদুদী জামাত একটি গোমরাহ ও ধর্মের মুখোশধারী ক্ষতিকারক একটি জামাত। এর আকায়েদ কুরআন ও হাদীসের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। তাদের প্রচেষ্টা পক্ষান্তরে ইসলামের জন্য নয় বরং নবগঠিত মওদুদী জামাতের জন্য। সুতরাং মুসলমানদের তা থেকে দূরে থাকা উচিত।
হযরত মাওলানা জাফর আহমদ উসমানী (রহ.) বলেছেন, জনাব মওদুদী সাহেব হাদীস অস্বীকারকারী, গোমরাহ ও বিদআতী। এরূপ লোকের সঙ্গ হতে মুসলমানদের দূরে থাকা, তার কথায় কর্ণপাত না করা এবং তাকে সবচে’ বড় জাহেল মনে করা একান্ত কর্তব্য।
দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রসার ভূতপূর্ব প্রিন্সিপাল হযরত মাওলানা কারী মুহাম্মদ তৈয়্যব সাহেব (রহ.) সতর্ক বাণী উচ্চারণ করে বলেছেন, জনাব মওদুদী সাহেব ইসলামের পুরাতন ফিকাহকে বাদ দিয়ে মনগড়া নতুন ফিকাহ তৈরি করেছেন। অতএব, মুসলমানগণ তার ফিতনা থেকে দূরে থাকুন। দেওবন্দ মাদ্রাসার শায়খুল আদব হযরত মাওলানা এজায আলী (রহ.) বলেছেন, মওদুদীর কর্মধারা সম্পর্কে অবহিত হয়ে আমি এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে, মওদুদী জামাত কাদয়ানী জামাত থেকেও অত্যন্ত মারাত্মক। আলেমকুল শিরোমণি, শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা সাঈদ আহমদ কাযেমী (রহ.) বলেছেন, জনাব মওদুদী সাহেবের সাথে আমি ব্যক্তিগতভাবে দীর্ঘ আলোচনার পর আমার নিকট এ সত্য উদঘাটিত হয়েছে যে, মওদুদী সাহেব কুরআন ও হাদীসের ভুল ব্যাখ্যা দ্বারা এক নতুন মাযহাবের ভিত্তি স্থাপন করেন। তিনি নিজেকে একজন পূর্ণাঙ্গ মুজাদ্দিদ ও ইমাম মাহদী বলে মনে করেন। কিন্তু বিশেষ কারণে তিনি তা প্রকাশ করেন না। হয়তো বা সময় আসলে তা প্রকাশ করতে পারেন।
‘আল হাবীব’ পত্রিকার সম্পাদক মাওলানা মুহাম্মদ শরীফ লাহোরী সাহেব বলেছেন, আমি মওদুদী সাহেবের পুস্তকাদি বিশদভাবে পড়ে দেখেছি। মওদুদী সাহেব ইসলামের যে অপব্যাখ্যা করেছেন তার প্রেক্ষিতে আমি স্বজ্ঞানে এ কথা বলতে পারি যে, তার প্রদত্ত ইসলাম আল্লাহ প্রদত্ত এবং নবীয়ে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈনে ইযাম ও সুফিয়ায়ে ইসলাম কর্তৃক গৃহীত মূল ইসলামের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মুকাররমের প্রাক্তন খতীব হযরত মুফতী আবদুল মুঈয সাহেব (রহ.) বলেছেন, মওদুদী সাহেব প্রকৃতপক্ষে কোন আলেম নন। কুরআন হাদীস সম্পর্কে কোন সঠিক ধারণা বা জ্ঞান তার নেই। দীনের আকায়েদ সম্পর্কে অপব্যাখ্যা করে মুসলিম সমাজকে গোমরাহ করাই তার মূল লক্ষ্য। তার প্রবর্তিত ফিতনা থেকে দূরে থাকা প্রত্যেক মুসলমানের দীনি দায়িত্ব ।
দারুল উলুম দেওবন্দের মুহাদ্দিস হযরত মাওলানা রিয়াসত আলী বিজনৌরী সাহেব বলেছেন, এ শতাব্দীর বিরাট ফিতনা হল জামাতে ইসলামী। এ দল নিজেদের সঙ্গে ইসলামের সুন্দর নাম লাগিয়ে ইসলামের মূল রূপকে পাল্টিয়ে দিয়েছে। পরকালের সফলতার জন্য আল্লাহ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সীমা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন মওদুদী তা লঙ্ঘন করে গিয়েছেন। আজ থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর যুগ পর্যন্ত সমস্ত নির্ভরযোগ্য বুযুর্গানেদীনকে তিনি হেয় প্রতিপন্ন করার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র করেছেন। সর্বজন স্বীকৃত মুসলমানদের আকায়েদের উপর তিনি কুঠারাঘাত করেছেন। হাদীসে বর্ণিত গোমরাহ দলগুলো চৌদ্দশত বছরের ইতিহাসে যেসব বিভ্রান্তিকর কাজ করেছে, এ দলটি একাই সে সমস্ত কাজ আঞ্জাম দিয়েছে।
এ ছাড়া আরো বহু উলামায়ে কেরাম মওদুদী ও তার জামাত সম্পর্কে মুসলমানদেরকে সতর্ক করেছেন। এদের মধ্যে মাওলানা আহমদ আলী লাহোরী, পশ্চিমবঙ্গ তাবলীগী জামাতের আমীর হযরত মাওলানা আবদুল হক সাহেব, তাবলীগী নেসাবের রচয়িতা শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা যাকারিয়া সাহেব, পাকিস্তান জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সেক্রেটারী হযরত মাওলানা গোলাম গাউছ হাজারুবী, চরমোনাইর পীর হযরত মাওলানা ইসহাক সাহেব, শর্ষিনার মরহুম পীর হযরত মাওলানা নেছারউদ্দীন আহমদ সাহেব, ফুরফুরা শরীফের পীর হযরত মাওলানা আবদুল হাই সিদ্দিকী সাহেব, জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সভাপতি হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ কেফায়েত উল্লাহ সাহেব, দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসার মুফতী হযরত মাওলানা মাহদী হাসান সাহেব, মুলতান খায়রুল মাদারিসের প্রিন্সিপাল হযরত মাওলানা খায়ের মুহাম্মদ প্রমুখ।
সুতরাং আমাদের যদি নিজের ঈমান, দীন ও ইসলামকে হিফাযত করতে হয় তবে এসব ভ্রান্ত আকীদা ও দল থেকে নিজেদের রক্ষা করতে হবে এবং অন্যদেরকেও রক্ষা করার প্রয়াস চালাতে হবে।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে সিরাতে মুস্তাকিমের উপর কায়েম রাখুন। আমীন!