بسم الله الرحمن الرحيم
মওদূদী সাহেবের ব্যাপারে কতিপয় প্রশ্নের সমাধান
প্রশ্ন এক: মওদূদী সাহেবের চিন্তাধারাকে উলামায়ে কিরাম নিয়মিতই ভ্রান্ত ও গোমরাহ বলে থাকেন, এর আসল কারণ কি ? সঠিক ইসলামী চিন্তাধারার সাথে মওদূদী চিন্তাধারার মৌলিক
সংঘাতগুলো কি কি ? নির্ভরযোগ্য প্রমাণসহ জানানোর আবেদন রইল ।
প্রশ্ন দুই : মওদূদী সাহেবের লিখিত বই-পুস্তক তথা তাফহীমুল কুরআন, তাফহীমাত, তানকীহাত, খুতবাত, রাসায়েল মাসায়েল, তাজদীদ ও ইয়ায়ে দ্বীন, খেলাফত ও মুলুকিয়াত, ইসলামী রিয়াসাত, কুরআন কী চার বুনিয়াদী ইস্তেলাহেঁ ইত্যাদি পড়া যাবে কি না ?
প্রশ্ন তিন ঃ মওদূদী পন্থী ইমামের পিছনে নামায আদায় করলে নামায সহীহ হবে কি-না ? এবং তাদেরকে ইমাম বা মুয়াজ্জিন হিসাবে নিয়োগ দেয়া যাবে কি না ?
১নং প্রশ্নের জবাব :
মাসিক তরজুমানুল কুরআন ১৩৫৫ হিজরী রবিউল আউয়াল সংখ্যায় জনাব মওদূদী সাহেব নিজের সম্পর্কে লিখেন :
مجھے گروہ علما ء میں شامل ہونے کا شرف حاصل نہیں ہے ، میں ایک بیچ کی راس کا آدمی ہوں جس نے جدید اور قدیم دونوں طریقہ ہائے تعلیم سے کچھ کچھ حصہ پایا ہے ، اور
دونوں کوچوں کوچل پھر کر دیکھا ہے ،
অর্থ : উলামা সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়নি। আমি মধ্য বিন্দুর লোক, যে নতুন-পুরাতন উভয় শিক্ষাব্যবস্থার কিছু কিছু অংশ পেয়েছে এবং উভয় গলিতেই হেঁটে চলে দেখেছে।
অপরদিকে “মাওলানা মওদূদী” নামক বইতে জনাব আব্বাস আলী খান লিখেন : ঊনিশ শ’ চৌদ্দ খৃঃ এ বালক মওদূদী মৌলভী (তথা তার বর্ণনা মতে) মেট্রিক পরীক্ষা দেন। ১৯১৬ খৃষ্টাব্দে (তার পিতা) আওরাংগাবাদ থেকে হায়দারাদ গমন করেন এবং সেখানে দারুল উলূমে (তথা ডিগ্রী কলেজে) পুত্র মওদূদীকে ভর্তি করে দেন, কিন্তু ছ’মাস অতীত না হতেই ভূপাল থেকে দুঃসংবাদ এলো যে, পিতা মৃত্যু শয্যায় শায়িত । এ সময় থেকেই বালক মওদূদীকে জীবিকা অন্বেষণের উপায় অবলম্বন করতে হয়। (মাওলানা মওদূদী পূঃ ৩৬)
মাসিক তরজুমানুল কুরআন রবিউল আউয়াল সংখ্যায় উদৃত নিজ ভাষ্য ও “মাওলানা মওদূদী” নামক বইতে উদ্ধৃত জামাআতের সাবেক ভারপ্রাপ্ত আমীর আব্বাস আলী খানের উক্ত বর্ণনা অনুযায়ী বুঝা গেল যে জনাব মওদূদী সাহেব দ্বীনী ও দুনিয়াবী শিক্ষার কোনটিতেই পরিপূর্ণ শিক্ষিত নন।
একদিকে যেমন নিয়মিত কোন শিক্ষা গ্রহণ করে আলেম হওয়ার সুযোগ তিনি পাননি অপর দিকে কোন কামেল ও দক্ষ আলিমের দিক নির্দেশনার অধীনে থেকে দ্বীনী কাজ করার প্রয়োজনীয়তাও তিনি স্বীকার করেননি। বরং নিজ মেধার উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল ও চরম মুক্ত স্বভাবের অধিকারী ছিলেন। উম্মতের রাহবার আঈম্মায়ে মাযহাব থেকে শুরু করে আঈম্মায়ে হাদীস ও যামানার মুজাদ্দিদগণ সহ অতীতের প্রায় সকল দক্ষ উলামায়ে কিরাম তাঁর নিকটে ছিল অতিতুচ্ছ। যা তার বিভিন্ন লেখনির মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।
এই ধরনের লোক ইসলামকে নিয়ে গবেষণা করলে পরিণতি যা হওয়ার তাই ঘটেছে। বিষয়টি মওদূদী সাহেব পর্যন্ত সীমিত থাকলে উলামায়ে কিরামের তেমন বিচলিত হওয়ার কিছু ছিল না, কিন্তু যখন তিনি নিজ গবেষণার ফসলগুলো জামায়াতে ইসলাম নামে একটি দল গঠনের মাধ্যমে উম্মতের মাঝে ছড়ানোর প্রয়াস পেলেন তখন শরয়ী মৌলনীতির আলোকে তার চিন্তাধারাকে যাচাই বাছাই করে উম্মতের সামনে পেশ করার জরুরী দায়িত্ব দক্ষ ও পরিপক্ক, মুত্তাকী ও স্বচেতন উলামাদের যিম্মায় বর্তায়।
উপমহাদেশের খ্যাতনামা উলামাদের প্রায় সকলেই মওদূদী সাহেবের চিন্তা ধারায় যে সব মারাত্মক ভুল ভ্রান্তি স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে প্রথমে তা মওদূদী সাহেব ও তার প্রতিষ্ঠিত জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবর্গকে বিভিন্ন ভাবে অবহিত করে সেগুলো প্রকাশ্যে প্রত্যাহার করতে বলেছেন। কিন্তু যখন দেখা গেল মওদূদী সাহেব বা জামায়াতের নেতৃবর্গ তা প্রত্যাহার করার পরিবর্তে বাড়তি কিছু বিভ্রান্তি যোগ করে ক্রমাগত তা প্রতিষ্ঠিত করতেই চেষ্টা করেছেন। তখন মুসলিম জন সাধারণকে গোমরাহী থেকে বাঁচানোর স্বার্থে উলাময়ে কেরাম মওদূদী সাহেবের মৌলিক ভুলগুলো সুদৃঢ় প্রমাণসহ মুসলিম উম্মাহর সামনে তুলে ধরতে বাধ্য হয়েছেন, এমনকি মওদূদী সাহেবের প্রাথমিক পর্যায়ের তুলনামূলক ভ্রান্তিমুক্ত রচনা-প্রবন্ধ ইত্যাদি দেখে যেসব বিদগ্ধ উলামায়েকেরাম ও ইসলামী বুদ্ধিজীবীগণ জামাআতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠালগ্নে জনাব মওদূদী সাহেবের সঙ্গে এমনকি জামায়াতের অতি গুরুত্বপূর্ণ পদ সমূহে অধিষ্ঠিত হয়ে মওদূদী সাহেবকে খুব কাছে থেকে পর্যবেক্ষণ করেছেন। অতঃপর মওদূদী সাহেবকে ক্রমশঃ ভুলপথে চলতে দেখে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁরাও একে একে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে জামায়াত হতে পৃথক হয়ে গেছেন। উদাহরণতঃ জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা নায়েবে আমীর মাওঃ মনজুর নো’মানী, সেক্রেটারী জনাব কমরুদ্দীন (এম,এ) বেনারসী। মজলিসে শুরার অন্যতম সদস্য হাকীম আঃ রহীম আশরাফ ও মাওলানা আমীন আহসান এসলাহী বিশ্ব বরেণ্য দাঈয়ে ইসলাম মাওঃ আবুল হাসান আলী নদভী। জামায়াতের অন্যতম রুকন ও মওদূদী সাহেবের জন্যে নিবেদিত প্রাণ ডক্টর এসরার আহমাদ সাহেব প্রমূখ সহ প্রথম সারীর প্রায় আরো সত্তর জন নেতৃবর্গ।
দ্রঃ মাওঃ মনযুর নো’মানী লিখিত “মাওদূদী সাহেবের সাথে আমার সাহচর্যের ইতিবৃত্ত।”
যুগসেরা মুহাক্কিক উলামায়েকিরাম সঠিক বরাতের ভিত্তিতে মওদূদী সাহেবের গোমরাহ চিন্তাধারাগুলোর তাত্ত্বিক পর্যালোচনা করে অনেক বই-পুস্তক ও প্রবন্ধ লিখেছেন। তন্মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কয়েকটির নাম যথাক্রমে-
১। মাওঃ মনজুর নোমানীর “মাওঃ মওদূদী ছে মেরী রেফাকৄতকী ছার গুয়াত” অনুবাদ “মাওঃ মওদূদীর সাথে আমার সাহচর্যের ইতিবৃত্ত”।
২। শাইখুল হাদীস যাকারিয়া রঃ-এর “ফিতনায়ে
মওদূদীয়্যাত”।
৩। বিশ্ববরেণ্য আলেম ও ইসলামী দার্শনিক জাষ্টিস মুফতী,
মাওঃ মুহাম্মাদ তক্বী উসমানীর “হযরত মুআবিয়া আওর তারিখী
হাক্কায়েক” বাংলা অনুবাদ “ইতিহাসের কাঠগড়ায় হযরত মুআবিয়া”
৪ | মুজাহিদে আযম আল্লামা শামছুল হক ফরীদপুরী রঃ-এর “ভুল সংশোধন”
ও হযরত মাওঃ ইউসুফ বিন্নোরী রঃ-এর ……….. ইত্যাদি, বিস্তারিত দেখার প্রয়োজন বোধ করলে উপরোক্ত বইগুলো দেখুন । আপনার প্রশ্নের প্রেক্ষিতে আমরা নিম্নে কয়েকটি মারাত্মক ভ্রান্তির
উল্লেখ করে সেগুলোর সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা করছি।
১। মওদূদী সাহেব “কুরআন কী চার বুনিয়াদী ইস্তেলাহেঁ” নামক পুস্তকে লিখেন :
اله ، رب ، دین اور عبادت یہ چار لفظ قرآن کی اصطلاحی زبان میں بنیادی اہمیت رکھتے ہیں ۔ عرب میں جب قرآن پیش کیا گیا اسوقت ہر شخص جانتا تها که الہ کے کیا معنی ہیں لیکن بعد کی صدیوں میں رفته اور رب کسے کہتے ہیں رفتہ ان سب کے وہ اصل معنی جو نزول قرآن کے وقت سمجھے ……. محض ان چار بنیادی اصطلاحوں جاتے تھے بدلتے چلے گئے کے مفہوم پر پردہ پڑ جانکی بدولت قرآن کی تین چوتھائی سے زیادہ تعلیم بلکه اسکی حقیقی روح نگاہوں سے مستور ہوگئی ۔
অর্থঃ ইলাহ, রব, দ্বীন ও ইবাদত এই চারটি শব্দ কুরআনের পরিভাষায় মৌলিক গুরুত্ব রাখে, আরবে যখন কুরআন নাযিল হয় এই শব্দগুলোর মর্ম সকলেই জানত, কিন্তু পরবর্তী শতাব্দিসমূহে ক্রমে ক্রমে কুরআন নাযিলের সময়কার অর্থ নিজ ব্যাপকতা হারিয়ে একেবারে সীমিত বরং অস্পষ্ট অর্থের জন্যে নির্দিষ্ট হয়ে যায়………। আর বাস্তবে এই চারটি মৌলিক পরিভাষার অর্থে আবরণ পড়ে যাওয়ায় কুরআনের তিন চতুর্থাংশেরও বেশী শিক্ষা বরং মূল স্পীটই দৃষ্টির অগোচরে চলে যায় । পৃষ্ঠা ৮,৯,১০
পর্যালোচনা ও বাস্তবেই ইলাহ, রব, ধীন ইবাদত শব্দগুলো কুরআনের মৌলিক পরিভাষার অন্তর্ভুক্ত। কুরআনের অধিকাংশ বিষয় বস্তুর সাথে শব্দগুলোর যে কোন ভাবে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে । শব্দগুলোর সহীত মর্ম অস্পষ্ট হয়ে গেলে কুরআন বুঝা সম্ভব হবে না এবং তদনুযায়ী আমল করাও যাবে না। মওদূদী সাহেবের মতে সাহাবাদের যামানা তথা ১ম শতাব্দীর পর হতে এগুলোর সঠিক মর্ম অদৃশ্য হয়ে গেছে, সাথে সাথে কুরআনের তিন চতুর্থাংশ শিক্ষা বরং মূল শ্রীটই পর্দার অন্তরালে চলে গেছে।
অথচ কুরআন আল্লাহ তা’আলার সর্বশেষ কিতাব। পূর্ববর্তী সব আসমানী কিতাব এর দ্বারা রহিত হলেও পূর্ণাঙ্গ নাযিলের পর কিয়ামত অবধি এ কিতাব কোন অংশেও কখনো রহিত হবে না। কিয়ামত পর্যন্ত মানুষের পরিপূর্ণ হিদায়াতের একমাত্র মাধ্যম এ কুরআন। সকল যুগের সর্বজনের জন্যেই পথ প্রদর্শক এ কুরআন। কাজেই কিয়ামতের আগ পর্যন্ত এর শব্দাবলী হুবহু বিদ্যমান থাকা চাই, তেমনিভাবে সব সময়ের জন্যে এর মর্মার্থও থাকা চাই অবিকৃত ও সহজবোধ্য, সাথেই কুরআনের আমল নমুনাও থাকতে হবে নাযিল হওয়া থেকে কিয়ামত পূর্বপর্যন্ত একই সূত্রে গাঁথা ।
শব্দ, অর্থ ও বাস্তব নমুনা কোন একটিও যদি অস্পষ্ট ও বিকৃত হয়ে যায় বা মাঝপথে তা পর্দার অন্তরালে চলে যায়। তাহলে পরবর্তীদের জন্যে এ কিতাব আর হিদায়াতের কাজ দিতে পারবে না। পক্ষান্তরে এ গুলোর যথাযথ সংরক্ষণ একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কারো পক্ষে সম্ভব নয় কাজেই আল্লাহ তাআ’লা-ই এগুলোকে সংরক্ষণ করবেন এটাই স্বাভাবিক, তাই তো আল্লাহ তাআ’লা নিজ কালামে পাকে অত্যন্ত জোরালো ভাবে ঘোষণা করেছেন-
انا نحن نزلنا الذكر وانا له لحافظون
অর্থঃ নিশ্চয়ই আমিই যিক্ তথা এ কুরআন নাযিল করেছি, এবং নিশ্চয়ই আমিই তা সংরক্ষণ করবো। আর সংরক্ষণের আওতায় উপরোক্ত সবগুলো বিষয় শামিল থাকা
(সূরায়ে হিজর আয়াত-৯)
জরুরী। তাইতো শ্রেষ্ঠ মুফাসসির আল্লামা আলুসী বাগদাদী “আমিই তা
সংরক্ষণ করবো” এর তাফসীরে বলেন –
(وانا له لحافظون) اى من كل ما يقدح فيه كالتحريف وقال الحسن حفظه بابقاء شر بحثه
والزيادة والنقصان
إلى يوم القيامة .
অর্থ : (এবং নিশ্চয় আমিই তা সংরক্ষণ করবো) তথা অর্থগত বিকৃতি, সংযোজন ও বিয়োজন জাতীয় সব ধরনের ত্রুটি হইতে এবং হযরত হাসান বছরী বলেন কুরআনের সংরক্ষণের অর্থ কুরআনের শরীয়ত (আমল পদ্ধতি)কে কিয়ামত পর্যন্ত বাকি রাখা।
(রুহুল মাআনী ১৪ পারা পৃঃ ২৪)
অপর এক আয়াতে ইরশাদ করেন-
لاياتيه الباطل من بين يديه ولامن خلفه الخ অর্থঃ সম্মুখ কিংবা পশ্চাৎদিক হতে কোন বাতিল (বিকৃতি ও মিথ্যা) এই কিতাবে প্রবেশ করতে পারবে না। (সূরায়ে হা-মীম সিজদা আয়াত ৪২) তেমনিভাবে আল্লাহর রাসূলও ঘোষণা করে গেছেন –
يحمل هذا العلم من كل خلف عدوله الخ
অর্থঃ এই ইম (কুরআন ও হাদীস)কে সঠিক ভাবে ধারণ করে যাবে পরবর্তী প্রত্যেক যুগের যোগ্য বান্দারা- যারা দ্বীনের ব্যাপারে সীমালংঘন কারীদের বিকৃতি, বাতিলদের বিভ্রান্তি ও অজ্ঞদের অপব্যাখ্যা হতে কুরআন ও হাদীসের ইলমকে মুক্ত রাখবে ।
(মিশকাত শরীফ ৩২ পৃঃ)
অপর এক হাদীসে ইরশাদ ফরমান-
لا تزال من امتى امة قائمة بأمر الله لا يضرهم من خذلهم ولا من خالفهم حتى يأتى امرالله وهم على ذلك . متفق عليه .
অর্থ : আমার উম্মতের একটি দল সব সময়েই হকের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। কোন হেয় প্রতিপন্নকারী কিংবা বিরুদ্ধাচারী তাদেরকে হক হতে বিচ্যুত করতে পারবে না।
(মিশকাত শরীফ ৫৮৩ পৃঃ)
উল্লেখিত আয়াতদ্বয় ও হাদীস দু’টির দ্বারা এ কথা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট যে, কুরআনে পাকের শব্দ, অর্থ ও আমল পদ্ধতি সর্বদা স্বয়ং আল্লাহ তাআ’লা কর্তৃক সংরক্ষিত ছিল, আছে ও থাকবে। সেই সূত্রে উম্মতের একটি দলকে আল্লাহ তাআ’লা সর্বদা কুরআন হাদীসের সঠিকভাবে ধারণকারী ও হকের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখবেন।
কিন্তু উপরোক্ত আয়াত ও হাদীসগুলোর সাথে মওদূদী সাহেবের বক্তব্য সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। তাছাড়া অযৌক্তিকও বটে। কারণ প্রথম শতাব্দীর পর হতে কুরআনের মৌলিক পরিভাষা সহ তিনচতুর্থাংশ শিক্ষা বরং মূল স্পীটই লোকান্তরে চলে গেলে উক্ত কুরআন সর্বকালীন ও সার্বজনীন পূর্ণ হিদায়াতের কিতাব হওয়ার কি অর্থ থাকে ?
তাছাড়া ইলাহ রব এ শব্দগুলোর সাথে মানুষের ঈমানের সম্পর্ক। যদি ইলাহের অর্থই অস্পষ্ট থাকে বা বিকৃত থাকে তবে মানুষ I Y পড়ে ঈমান আনবে কি করে? তেমনি ভাবে ১ম শতাব্দীর পর হতে এ শব্দ চতুষ্ঠয়ের অর্থ যদি ব্যাপক ভাবে মানুষ ভুলে বসে তাহলে তেরশত বছর পর মওদূদী সাহেবই বা এগুলোর সঠিক অর্থ উদ্ঘাটন করে তাফসীর লিখে বসলেন কি ভাবে?
বস্তুত কুরআনের মৌলিক পরিভাষা সমূহের সম্পর্কে মওদূদী সাহেবের উক্ত বক্তব্য মেনে নিলে এবং সাহাবায়ে কিরামের যামানা হতে এ যাবত তাফসীরে কুরআনের বড় একটি ধারাকে অব্যাহত না ধরলে, কুরআান ও দ্বীন বিকৃতির দ্বার একেবারেই উন্মুক্ত হয়ে যায়। কারণ যে কেউ পূর্ববর্তী তাফসীর সমূহকে ভুল আখ্যা দিয়ে নিজে মনগড়া একটি তাফসীর করে সেটাকেই সঠিক বলতে সুযোগ পাবে; তখন তার ভুল ব্যাখ্যাকে ভুল বলার দলীল কোথায় পাওয়া যাবে ?
(২) মওদূদী সাহেব তানকীহাত নামক বইয়ে লিখেন-
قرآن اور سنت رسول عليه الصلوة والسلام کی تعلیم سب پر مقدم مگر تفسیر وحدیث کے پرانے ذخیروں سے نھیں ……… اسلامی قانون کی تعلیم بھی ضروری ہے مگر یہاں بھی پرانی کتابیں کام نه دین گی .
অর্থঃ কুরআন, সুন্নাহর শিক্ষাই সবার উপরে। কিন্তু তা তাফসীর ও হাদীসের পুরাতন ভান্ডার হতে নয়। ইসলামী আইনের শিক্ষাও আবশ্যক, তবে এক্ষেত্রেও পূর্বের কিতাব সমূহ কাজে আসবে না। তানকীহাত – ১৭৫
অন্যত্র লিখেন :
……….قرآن کے لئے کسی تفسیر کی حاجت نہيں ايك أعلى درجه کا پرو فیسر کا فی ہے ۔ جس نے قرآن کا بنظر غائر مطالعہ کیا ہو اور جو طرز جدید پر قرآن پڑھانے اور سمجھانے کی
অর্থঃ কুরআনের জন্যে কোন তাফসীরের প্রয়োজন নাই। একজন উঁচু মানের প্রফেসরই যথেষ্ট যে গভীর দৃষ্টিতে কুরআন অধ্যয়ন করেছে এবং নতুন পদ্ধতিতে কুরআন পড়ানোর ও বুঝানোর যোগ্যতা রাখে।
তানকীহাত ২৯১
পর্যালোচনা ঃ
মাওদূদী সাহেবের মতে কুরআন, সুন্নাহ ও ইসলামী আইন শিক্ষার জন্যে একদিকে যেমন তাফসীর ও হাদীসের পুরাতন ভান্ডারের প্রয়োজন নাই অপর দিকে এর জন্যে আলেম হওয়াও কোন জরুরী নয়, বরং গভীর দৃষ্টিতে অধ্যয়ন করলে এসবের জন্যে একজন প্রফেসরও যথেষ্ট।
অথচ সর্বজনবিদিত যে, কুরআনের প্রথম ব্যাখ্যাকার হলেন স্বয়ং রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। আর তাঁর ব্যাখ্যার নামই হল হাদীস। রাসূলের হাদীসের আলোকে ও কুরআন নাযিলের প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে দ্বিতীয় ব্যাখ্যাকার হলেন জামাআতে সাহাবা, যে ব্যাখ্যার নাম হল আ-ছা-রে সাহাবা। হাদীস ও আছারে সাহাবার আলোকে কুরআনের তাফসীর ও ইসলামী আইনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে গেছেন, এ কাজের জন্যে প্রয়োজনীয় সকল জ্ঞানে সর্বোচ্চ পারদর্শী আঈম্মায়ে কিরামগণ, যা নিশ্ছিদ্র সূত্র পরম্পরায় আজো উম্মতের নিকট হুবহু সংরক্ষিত। পরবর্তী বিদগ্ধ উলামাগণ সময় ও প্রেক্ষাপটভেদে সেই পুরাতন
ভান্ডারেরই যুগপোযুগী বিশ্লেষণ করেছেন। গ্রহণযোগ্য বরাতের হাদীস ও আছারে সাহাবা এবং উৎসদ্বয়ের আলোকে কৃত তাফসীরের সাথে সাংঘর্ষিক কোন তাফসীর যেমন তারা নিজেরা করেননি, তেমনি কেউ করে থাকলে তাকে বাতিল বলে বর্জন করেছেন। এটাই মূলতঃ সঠিক ও নিরাপদ রাস্তা, এ রাস্তার কোন বিকল্প নাই। কারণ হাদীস ও আছারে সাহাবার ভাণ্ডার পুরাতন হয়ে গেছে। সেগুলোর আলোকে কৃত তাফসীরও পুরাতন। নতুন হয়ে আবির্ভূত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নাই, এখন যদি সে গুলো হতে বিমূখ হয়ে কোন তাসীর, সুন্নাত বা আইন আবিষ্কার করা হয়। তাহলে সেটা হবে মনগড়া, যার পরিণতি নিশ্চিত গোমরাহী বিশ্বাস না হলে খুলে দেখুন গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী ও স্যার সৈয়দ আহমাদ খানের তাফসীরের কিতাবগুলো।
এমন গোমরাহী হতে উম্মতকে বাঁচানোর জন্যেই আল্লাহর রাসূল অত্যন্ত স্পষ্ট ও কঠোর ভাষায় বলে গেছেন :
من قال في القرآن برأيه فليتبوأ مقعده من النار .
অর্থঃ যে ব্যক্তি কুরআনের মনগড়া ব্যাখ্যা করবে সে যেন নিজ ঠিকানা জাহান্নামে বানিয়ে নেয়। -তিরমিযী ২ঃ১২৩ ও মিশকাত শরীফ ৩৫ পৃঃ
অপর হাদীসে ইরশাদ হচ্ছে –
من قال في القرآن براً به فاصاب فقد اخطأ অর্থ : যে ব্যক্তি কুরআনের মনগড়া ব্যাখ্যা করবে সে (ঘটনাক্রমে) সঠিক ব্যাখ্যা করলে ও তা ভুল গণ্য হবে ।
-তিরমিযী ২ঃ১২৩ ও মিশকাত শরীফ ৩৫ পৃঃ মোটকথা হাদীস ও আছারে সাহাবার সেই পুরানো ভাণ্ডার বাদ দিয়ে মনগড়া তাফসীর গোমরাহীর মোক্ষম হাতিয়ার; যার কারণে এর পরিনতি জাহান্নাম এবং এমন তাফসীর সর্বাংশেই ভুল গণ্য হবে। হাদীসের আলোকে এমন তাফসীরের মোটেও অনুমতি নাই। এক্ষেত্রে মওদূদী সাহেবের পূর্বোক্ত দুইটি বক্তব্যই সরাসরি হাদীস পরিপন্থী।
তাছাড়া মওদূদী সাহেবের বক্তব্য পরস্পর বিরোধীও বটে। কারণ “কুরআনের চারটি মৌলিক পরিভাষা নামক পুস্তকের বক্তব্য অনুসারে ছাহাবায়ে কিরামের পরবর্তী যুগে কুরআনের তিন চতুর্থাংশের শিক্ষায় পর্দা পড়ে গেছে অর্থাৎ তাঁর মতে আঈম্মায়ে মুজতাহেদ্বীন, মুফাচ্ছেরীন ও মুহাদ্দেসীনদের মত যুগশ্রেষ্ঠ মহা মনীষীগণের দ্বারাও কুরআনের এক চতুর্থাংশের বেশী সঠিক শিক্ষা উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়নি। যদি তাই বাস্তব হয়ে থাকে তাহলে তেরশত বছর পর কি করে মওদূদী সাহেবের মত একজন অপূর্ণ শিক্ষিতের জন্যে তাফসীর ও কুরআনের শিক্ষা উদ্ঘাটন এত সহজ হয়ে গেল? কিভাবে তিনি একজন প্রফেসরের জন্যে তাফসীরের সনদবিতরণ করতে সক্ষম হন? তাও আবার হাদীস ও পূর্বের তাফসীরের ভান্ডারকে বাদ দিয়ে।
সারকথা তাকীহাতে উদ্ধৃত মওদুদী সাহেবের কথা দু’টি শরীয়াত ও বিবেক বিরোধী। স্বয়ং তারই অপর বক্তব্যের পরিপন্থী। অথচ তিনি তার তাফসীর গ্রন্থে তানকীহাতে উদ্ধৃত বক্তব্যকেই প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন । যথাঃ মওদূদী সাহেব তাঁর তাফসীরের ভূমিকার পূর্বে “প্রসঙ্গ কথায়” লিখেছেন যে, আমি “তাফহীমুল কুরআনে” কুরআনের শব্দাবলীকে উদূর লেবাস পরানোর পরিবর্তে এই চেষ্টাই করেছি যে, কুরআনের বাক্য সমূহ পড়ে যে অর্থ আমার বুঝে এসেছে এবং উক্ত আয়াত সম্পর্কে আমার মনে যে প্রভাব পড়েছে যথা সাধ্য সঠিক ভাবে উহাকে নিজ ভাষায় ব্যক্ত করে দেই । (তাফহীমুল কুরআন উর্দূ পৃঃ ১০ ১ম খন্ড)
কথাটির ব্যাপারে চিন্তা করে দেখুন! আয়াতের সম্পর্কে রাসূল কি বলেছেন, ছাহাবাগণ কি বলেছেন, তাবেঈন, তাবে তাবেঈনগণ কি বলেছেন এসব কিছু বাদ দিয়ে তাঁর মনে যে প্রভাব পড়েছে তা দিয়ে তিনি তাফসীর লিখে ফেললেন। এটা ভ্রান্তি না হলে মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়ে যারা খতমে নবুওয়াতকে অস্বীকার করেছে, যারা আম্বিয়ায়ে কিরামের মু’জিযা সমূহকে অস্বীকার করেছে, তাদেরকে কেন ভ্রান্ত বলা হবে ? হাদীস ও আছারে সাহাবা এবং পুরাতন তাফসীর ভান্ডার ছাড়া মওদূদী সাহেবের তাফসীর ও কাদিয়ানীর তাফসীরের মধ্যকার পার্থক্যটা কি দিয়ে নির্ণয় করা হবে ?
Leave a Reply