মওদূদীবাদের আয়নায় কাদিয়ানী চেহারা
কাদিয়ানীদের বিশেষ পরিচয়
হিজরী তেরশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে চৌদ্দ শতাব্দীর শুরু লগ্নে পাঞ্জাব প্রদেশের কাদিয়ান নামক এলাকায় মীর্জা গোলাম আহমদ নামে এক ব্যক্তির উদ্ভব ঘটে। তৎকালীন ইংরেজ সরকারের ইঙ্গিতে নবুওয়াতের একটি নতুন ব্যাখ্যা সে দিতে শুরু করল এবং এক পর্যায়ে নবুওয়াতের দাবীও করে বসল। যার সংক্ষিপ্ত ঘটনা এই ঃ
কাদিয়ানী মতবাদের প্রেক্ষাপট
১৮৫৭ খৃষ্টাব্দের ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনে মুসলমানদের আপতঃ ব্যর্থতার পর সেই সময় মুসলমানদের কর্তব্য নির্ধারণে ইসলামী চিন্তাবিদদের সিদ্ধান্ত বিভিন্ন ধরনের ছিল ঃ
(১) কোন কোন ইসলামী চিন্তাবিদ মনে করেছিলেন যে, মুসলমানদের জন্য এখন অফিসিয়াল ও সরকারী কিছু কর্মচারীদের নিয়ে পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গির সাথে আপোষ করে নেয়া উচিৎ এবং মুসলমানদেরকে পার্থিব শিক্ষা-দীক্ষায় এতটুকু অগ্রসর হতে হবে যাতে হিন্দুস্থানের জমীনে মুসলমানগণ বিজাতীদের থেকে পিছিয়ে না থাকে। এই পথটি প্রাথমিকভাবে একেবারেই কষ্টহীন সহজ-সরল ছিল। কিন্তু পশ্চিমা-দৃষ্টি ভঙ্গি আর চিন্তা চেতনার সাথে আপোষ করার পরিণতি এই হল যে, অতীত আদর্শ থেকে নিজেদের সম্পর্ক কেটে দেয়া জরুরী ছিল। সুতরাং অতি দ্রুত তার পরিণাম এই দাড়াল যে, আকীদা-বিশ্বাস ও চিন্তা-চেতনায় ধ্বস নামতে শুরু করল। ইংরেজদের কর্মকাণ্ড হৃদয়ের প্রসারতার (মুক্তচিন্তা) উপহার মুসলমানদের মধ্যে প্রবেশ করতে লাগল। যার সাথে প্রকৃত ইসলামের কোন সম্পর্কই ছিল না।
(২) শাইখ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলভী (রঃ) এর অনুসারীরা একথার প্রবক্তা ছিলেন যে, পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তা-চেতনার সাথে সমঝোতা না করা উচিত। ইংরেজী ভাষা অবশ্যই শিক্ষা করা জরুরী। কিন্তু ইংরেজদের সভ্যতা, সংস্কৃতিকে গ্রহণ করা যাবে না। দরস- তাদরীস, শিক্ষা-দীক্ষা, আত্মশুদ্ধি এবং তালীমের মাধ্যমে ইসলামী জ্ঞানও ইসলামী আদর্শকে সংরক্ষিত করতে হবে। যার দ্বারা হয়তো ব অদূর ভবিষ্যতে কোন মুক্তির পথের আলো জ্বলে উঠবে। এসকল বুযর্গানে দীন নিজস্ব চিন্তা-চেতনার আবিষ্কারক ও স্থপতিই শুধু ছিলেন না বরং ইলমে নবুওয়াতের রুপকার ও প্রকৃত ইসলামের দা’ঈ ছিলেন। এবং এ পথের দিশা দ্বারাই তাঁরা মুসলিম মিল্লাতকে পথ প্রদর্শন করতে চেয়েছিলেন। তাঁদের সূত্রগত দিক সাহাবায়ে কিরাম, আকাবিরে ইসলাম এবং শাইখ মুহাদ্দেসে দেহলভী (রঃ) এর সাথে গাঁথা ছিল।
(৩) হিন্দুস্তানের মুসলমানদের মধ্য থেকে একটি দলের মধ্যে এ চিন্তা-চেতনা কাজ করছিল যে, নামায, রোজা ইত্যাদি বিশেষ কিছু ইসলামের আমল বাকী রেখে ইংরেজদের সামগ্রিক আমলকে গ্রহণ করে নিতে হবে। ইংরেজদেরকে নিজেদের উলুল আমর তথা মুসলমানদের মান্যবর নেতা হিসেবে মনে করতে হবে। দুনিয়াবী পোষ্ট অর্জন করা ব্যতীত তাদের ভিন্ন কোন উদ্দেশ্য ছিল না। ইংরেজদের পরিপূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করার পর এ সকল লোকেরা শাইখ মুহাদ্দেসে দেহলভীর অনুসারীদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাতে লাগল এবং তাদের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ ও দীনের রাহবারদেরকে অনেক ষড়যন্ত্রের ধুম্রজালে ফেলতে চেয়েছিল। ইতিমধ্যে ঐ যুগের নিকটবর্তী কিছু দুনিয়াদার মওদূদী মতবাদ- এক আয়নায় তিন চেহারা
মাশায়েখকে তারা তাদের সমর্থনকারী পেয়ে গেল। যারা পূর্ব থেকেই ষড়যন্ত্রের সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করে রেখেছিল। কিন্তু ইংরেজদেরকে উলুল আমর (তথা মান্যবর নেতা) এর অন্তর্ভুক্ত করতে তাদের এ সম্মিলিত আওয়াজ যথেষ্ট ছিল না। এ কাজের জন্য নবুওয়াতের হিদায়েত প্রয়োজন ছিল। তাই ইংরেজরা প্রয়োজন অনুভব করল যে, হিন্দুস্থানের অধীনে একজন নবুওয়াতের দাবীদারকে দাড় করানো হোক, যিনি তাদেরকে উলুল আমরের অন্তর্ভুক্ত করবেন। সুতরাং ১৮৬৯ খৃষ্টাব্দে ইংরেজরা লণ্ডন থেকে একটি তদন্ত কমিশন হিন্দুস্থানে পাঠাল। যাতে তারা ইংরেজদের ব্যাপারে মুসলমানদের ধ্যান-ধারণা সম্পর্কে জানতে পারে এবং ভবিষ্যতে মুসলমানদেরকে পরাজিত করার কৌশল নির্ণয় করতে পারে।
ঐ তদন্ত কমিশন হিন্দুস্থানে পূর্ণ এক বৎসর অবস্থান করে মুসলমানদের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে অবগত হয়। অতঃপর ১৮৭০ খৃষ্টাব্দে লণ্ডনের হোয়াইট হাউজে একটি কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। যাতে তদন্ত কমিশনের প্রতিনিধিগণ ছাড়াও হিন্দুস্তানে অবস্থানরত খৃষ্টান মিশনরীর পাদ্রীগণ অংশ গ্রহণ করেন।
পাদ্রীদের রিপোর্ট : উক্ত অনুষ্ঠানে পাদ্রীগণ এ রিপোর্ট পেশ করে যে, হিন্দুস্তানের বাসিন্দাদের মধ্য থেকে একটি বৃহৎ দল পীর-মুরীদীর ভক্ত। এখন যদি আমরা তাদের মধ্য থেকে এমন কোন বিশ্বাসঘাতক গাদ্দারকে তালাশ করে পেয়ে যাই, যে ছাঁয়া নবুওয়াতের দাবীদার হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকবে তাহলে তার নবুওয়াতের ছায়াতলে হাজারো মানুষ দলে দলে শামিল হয়ে যাবে। কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে এই ধরনের দাবীর জন্য কাউকে প্রস্তুত করাই মৌলিকভাবে কঠিন কাজ। যদি এমন ব্যক্তি যোগাড় হয়ে যায়, তাহলে তার নবুওয়াতকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার 8 তত্ত্বাবধানে সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। আমরা ইতিপূর্বে উপমহাদেশের প্রধান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে এ জাতীয় গাদ্দার নিযুক্ত করার মাধ্যমেই দখল করেছিলাম। আর সে সময়টা ছিল তখন- যখন সৈন্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে গাদ্দারদের তালাশ করে কৌশলে নিযুক্ত করতে হয়েছিল। কিন্তু এখন তো আমরা উপমহাদেশের ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র সকল রাষ্ট্রের উপর রাজত্ব করছি এবং সকল দিকে নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তাও রয়েছে। তাই সকল পরিস্থিতিতে আমাদেরকে এমন কোন কূট-কৌশল বের করতে হবে যা এখানের বাসিন্দাদের পরস্পরের মধ্যে বিবেধ সৃষ্টি করে দেয়। (১৮৭০ সালে লণ্ডনের হোয়াইট হাউসে অনুষ্ঠিত প্রকাশিত রিপোর্টের সার সংক্ষেপ। (সূত্র : আর-রশীদ, দারুল উলুম, পৃঃ ১০৫ থেকে ১০৭)
উক্ত প্রেক্ষাপটেই মীর্জা গোলাম আহমদের জন্ম হয়েছিল। সে প্রাথমিকভাবে নিজে নিজেকে অন্য ধর্মের মুকাবিলায় একজন মুনাজির বা বহসকারী হিসেবে পেশ করেছিল। এভাবে সে মুসলমানদের মধ্যে একটি ভিন্ন স্থান করে নিয়েছিল। তাছাড়া মানুষদের থেকে অন্য প্রশংসাও কুড়িয়েছিল। কিছুদিন পর সে নিজে নিজেকে “মুজাদ্দিদ” বলা শুরু করে দিল। নিজের (দাবীকৃত) ইলহামের (অন্তর্দৃষ্টির) কথাগুলোকে আল্লাহর ওহী হিসেবে “বারাহেনে আহমদিয়া” নামক পুস্তিকায় প্রকাশ করে দিল। কিন্তু তার প্রকাশিত বিভ্রান্তিমূলক বিষয় পাঠ করে কিছু উলামায়ে কিরাম চিন্তায় পড়ে গেল। যার ফলে ১৩০১ হিজরীতে প্রথবার তার বিরুদ্ধে ফাতওয়া প্রকাশ করা হয় যে, এ ব্যক্তি অমুসলিম এবং নিজস্ব আকীদা ও দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে সে ধর্মত্যাগী, ইসলাম থেকে খারেজ। ঐ বৎসরই দারুল উলুম দেওবন্দের বার্ষিক মাহফিলে তৎকালীন সকল উলামায়ে কিরাম একত্রিত হলেন। সকলেই তখন দারুল উলুম দেওবন্দের প্রথম সিনিয়র মুদাররিস হযরত মাওঃ মুহাম্মদ ইয়াকুব সাহেব নানুতবী রঃ) এর নিকট সার্বিক অবস্থা বর্ণনা করে ফাতওয়া চাইলেন। তখন হযরত নানুতবী (রঃ) লিখিতভাবে এ জবাব দিলেন-
এই ব্যক্তি মীর্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী ধর্মহীন (নাস্তিক) মনে হয়। এই ব্যক্তি কোন আল্লাহ ওয়ালার সুহবতে থেকে আত্মিক-বাতেনী ফয়্যে অর্জন করে নাই। তাছাড়া তার সাথে কারো রুহের যোগসাজশ রয়েছে বলে মনে হয়। (শয়তানের রুহের সাথে হতে পারে) তার যে সকল ইলহাম রয়েছে এগুলোর প্রকৃত আল্লাহ ওয়ালাদের ইলহামের সাথে কোন ধরনের সম্পর্ক নেই। (সূত্রঃ দারুল উলুম আর-রশীদ পৃঃ (৬৭৬)
নবুওয়াতের দাবীর জন্য মারাত্মক প্রতারণা :
মীর্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী প্রথম প্রথম নিজেকে মুজাদ্দিদ মাহদী হওয়ার মিথ্যা দাবী করে। পরবর্তীতে সম্পূর্ণ প্রতারণামূলকভাবে নবুওয়াতের দাবী করার জন্য রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম) এর দু’বার প্রেরিত হওয়ার মত জঘন্য দৃষ্টিভঙ্গি আবিস্কার করে। যার সারাংশ এই যে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম) একবার ষষ্ঠ খৃষ্ট শতাব্দীতে মক্কায় আরব দেশে প্রেরিত হয়েছিলেন। আরেকবার (নাউযুবিল্লাহ!) এই গালগল্পকারী প্রতারক মীর্জা গোলাম আহমদের আকৃতিতে কাদিয়ান নামক স্থানে প্রেরিত হয়েছেন। মক্কায় প্রেরিত হওয়া নবুওয়াতের ধারাবাহিকতা হিজরী ১৩ শতাব্দীতে শেষ হয়ে গেছে। এখন হিজরী ১৪ শতাব্দী থেকে কিয়ামত পর্যন্ত ভণ্ড নবুওয়াতের দাবীদার কাদিয়ানীর নবুওয়াতের যুগ চলবে। এভাবে সেই মিথ্যুক, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম) এর নবুওয়াতকে হিজরী ১৩ শতাব্দীতে সমাপ্ত ও নিঃশেষ সাব্যস্ত করে দিয়ে খাতামুন্নাবিয়ীন বা শেষ নবীর পদ নিজেই দখল করে নিল এবং রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম) এর সকল বিশেষ বৈশিষ্ট্যাবলীকে নিজের দিকে সম্পৃক্ত করে কুরআনে কারীম ও হাদীস শরীফের মধ্যে নির্দ্বিধায় বিকৃতি সাধন করল। ইসলামী আকীদাগুলো নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করল। নবীদেরকে গালি- গালাজও করল (নাউযুবিল্লাহ) নিজের দল ব্যতীত দুনিয়ার সকল উম্মতে মুসলিমানকে পথভ্রষ্ট, কাফের, মুশরিক সাব্যস্ত করল। ইসলামের সুমহান প্রাচীরকে ধ্বংস করে নতুন খৃষ্ট ধর্মের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছে। ইংরেজদের আজীবন দাসত্বের জিঞ্জিরকে মুসলমানদের জন্য ফরয-ওয়াযিব করে দিয়ে জিহাদকে হারাম ও রহিত বলে ঘোষণা দিল ইসলামের জন্য জিহাদকারীদেরকে আল্লাহকে অস্বীকারকারী সাব্যস্ত করল।
যদি মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী নবুওয়াতের এ মিথ্যা দাবী হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) এর যুগে নয় বরং তুর্কী খেলাফতের আমলেও করত তাহলে ভণ্ড নবুওয়াতের দাবীদার আসওয়াদে উনাইসী ও মুসাইলিমাতুল কাজ্জাবের পরিণতি থেকে তার পরিণতি ভিন্ন হত না। বরং আরো মারাত্মক হত। এতদস্বত্ত্বেও সে কুফরী রাষ্ট্রে যতদূর পর্যন্ত বৃটিশের শাসন ছিল, দীর্ঘ এক যুগ পর্যন্ত সে ভয়-ভীতি ও আতংকগ্রস্ত ছিল। নিম্নে আমরা তার একটি লেখা নকল করছি, যাতে সে নিজের দলের প্রতি বৃটিশ গভর্নরের অনুগ্রহের প্রকৃত মূল্যায়নের অনুভূতি প্রকাশ করেছে। সে নিজ গ্রন্থ তাবলীগে রিসালাতের দশম খণ্ডের ১২২ পৃষ্ঠায় লিখেছে-
আল্লাহ তা’আলার বড়ই হিকমত এবং মঙ্গল কামনা যে, তিনি বৃটিশ গভর্নরকে একথার জন্য নির্বাচন করে নিয়েছেন যে, আহমদিয়া জামাত (কাদিয়ানীরা) তাদের ছায়াতলে থেকে জালেমদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ থেকে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রাখবে এবং দিনের দিন উন্নতি করবে। হে কাদিয়ানীরা। তোমরা কি ধারণা করছ যে, তোমরা রোম সম্রাট (তুর্কী খিলাফত) এর আমল থেকে অথবা মক্কা-মদীনায় নিজেদের ঘর-বাড়ী বানিয়ে অনিষ্টকারী লোকদের (মুসলমান) আক্রমণ থেকে বাঁচতে পারতে? না, কক্ষনো না। বরং এক সপ্তাহের মধ্যেই তোমাদেরকে টুকরা-টুকরা করে দেয়া হত। তোমরা হয়তো বা শুনেছ যে, কিভাবে সাহেবজাদা আব্দুল লতীফ যখন আমার দলে প্রবেশ করল। তখন শুধু এই একটি ত্রুটির কারণে যে, সে আমার শিক্ষা অনুসারে জিহাদ বিরোধী হয়ে গিয়েছিল। যার ফলে আমীর হাবীবুল্লাহ সাহেব অত্যন্ত নির্দয়ভাবে তাকে প্রস্তরাঘাতে হত্যা করে ফেলে। সুতরাং তোমাদের কোন ভরসা আছে? ইসলামী হুকুমতের অধীনে কি তোমাদের কোন দিন আনন্দ-সুখ আসবে? কক্ষনো নয়। বরং তোমরা সকলেই তোমাদের বিরোধী ইসলামের বড় বড় উলামায়ে কিরামের দৃষ্টিতে ওয়াজিবুল কতল তথা জরুরী মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত হয়ে গিয়েছ।
আরো দু-একটি বিশেষ বিশেষ অংশ
তিনি আরো বলেন- আহমাদিয়াদের স্বাধীনতার তাজ বৃটিশ গভর্নরের সাথে সম্পর্কযুক্ত। সুতরাং সকল সত্যনিষ্ঠ আহমদী যারা হযরত মির্জা সাহেবকে আল্লাহর পক্ষ থেকে আদিষ্ট এবং একজন পবিত্র মানুষ মনে করে, তারা যেন কোন খোশামোদ ও চাটুকারীতা ব্যতীতই একথা অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করে নেয় যে, বৃটিশ গভমেন্ট তাদের জন্য বিশেষ অনুগ্রহ ও রহমতের ছায়া। এবং বৃটিশের অস্তিত্ব যেন নিজের অস্তিত্বের মতই মনে করে। (সূত্রঃ আখবারুল ফজল, ১৩ ডিসেম্বর ১৯১৪ খৃস্টাব্দ)
মীর্যা সাহেব আরো বলেন- বর্তমান মুসলমানদের উপর ফরয হল বৃটিশ গভমেন্টের জন্য সত্যিকার শুভাকাংখী, বন্ধু ও নিবেদিত প্রাণ হওয়া। এই ফরয দায়িত্ব তরক করলে আল্লাহর নিকট গুনাহগার বলে সাব্যস্ত হবে। (সূত্রঃ তিরয়াকুল কুলুব, খ-৩, পৃঃ ৩০৭)
খতমে নবুওয়াতের আকীদা অস্বীকার ঃ
একথা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট যে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম) এর পরও নবুওয়াতের দরওয়াজা খোলা আছে। (সূত্রঃ হাকীকাতুন্নবুওয়াহ-২২৮)
প্রকৃত নবী হওয়ার দাবী :
অনেক কাদিয়ানী লোকেরা এখনও পর্যন্ত মানুষদেরকে ভুল বুঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে এবং নবুওয়াতের বিভিন্ন প্রকার (বুরুজী, জিল্লী, তাশরীয়ী গাইরে তাশরীয়ী) বর্ণনা করে কথাকে উল্টিয়ে মানুষরদেকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু বৃটিশ সরকার খলীফা মির্জা জীকে হাকীকী নবী হওয়ার কথা বলে সমস্ত পর্দা উঠিয়ে দিয়েছেন। লক্ষ্য করুণ- তিনি বলেন- শরীআতে ইসলামী নবীর যে অর্থর্ণনা করে সে অর্থে হযরত মির্জা সাহেব কক্ষনই মাজাযী বা অপ্রকৃত নবী নন। বরং তিনি হাকীকী বা বাস্তবিকই নবী । (সূত্রঃ হাকীকাতুন নবুওয়াহ-১৭৪)উপরোল্লেখিত আলোচনা দ্বারা কাদিয়ানীদের বাস্তবিক প্রেক্ষাপট এবং বিভ্রান্তিকর বিশ্বাসের একটি সংক্ষিপ্ত ডাটা, প্রিয় পাঠক হয়তো অবলোকন করতে পেরেছেন। এখন আমরা পাঠকদের সম্মুখে ঐ আয়নাও উপস্থাপন করে দেওয়া উপযোগী মনে করছি যার মাধ্যমে একই আয়নায় কাদিয়ানীদের সাথে সাথে মওদূদীবাদের চেহারাও দেখা যাবে।
মওদূদীবাদের আয়নায় কাদিয়ানী চেহারা
(১) দাজ্জাল সম্পর্কে আল্লামা মওদূদী বলেন-
(ক) কানা দাজ্জালের কথা একটি প্রলাপ মাত্র। যার শরীআতে কোন ভিত্তি নেই। এটা প্রকৃত পক্ষে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম) এর অনুমান মাত্র। যে ব্যাপারে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম) নিজেই সন্দিহান ছিলেন কিন্তু বর্তমানে সাড়ে তের শত বছরের ইতিহাস কি একথা প্রমাণ করে দেয়নি যে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম) এর এ অনুমানটি সঠিক ছিল না? (সূত্রঃ তরজমানুল কুরআন-১৩৬৫ হিজরী)
(খ) কানা দাজ্জালের কথা তো একটি কাল্পনিক প্রলাপ মাত্র। যার কোন শরীআতের ভিত্তি নেই। এবং এটা তালাশ করাও আমাদের কোন প্রয়োজন নেই। সাধারণ মানুষের মধ্যে এ জাতীয় কথা যা প্রসিদ্ধ রয়েছে সে ব্যাপারে কোন যিম্মাদারী ইসলামের উপর নেই। সেগুলোর মধ্য থেকে কোন জিনিস যদি ভুল প্রমাণিত হয় তা দ্বারা ইসলামের কোন ক্ষতি হবে না। (সূত্রঃ কুরআন ওয়া হাদীস আওর সাইন্টিি হাকায়েক)
উক্ত কথার আয়নায় কাদিয়ানীদের চেহারাও লক্ষ্য করুন-
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম) এর নিকট ইবনে মারইম তথা হযরত ঈসা (আঃ) এবং দাজ্জালের পরিপূর্ণ বাস্তবতা চাক্ষুস না থাকায় কোন নমুনা পরিপূর্ণ স্পষ্ট হয় নাই। (সূত্রঃ ইজালায়ে আওহাম)
প্রিয় পাঠক! একটু গভীর দৃষ্টিতে লক্ষ্য করলেই পরিস্কার বুঝা যাবে যে, উল্লেখিত উভয় বক্তব্যের উৎস মূল একই।
(২) হযরত ঈসা (আঃ)কে আকাশে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্পর্কে
মওদূদী সাহেবের গবেষণা :
(ক) হযরত ঈসা মসীহ (আঃ) কে আসমানে উঠিয়ে নেওয়ার মাসআলাটি মুতাশাবিহাত তথা অস্পষ্টতার মধ্যে গণ্য। (সূত্রঃ কাওছার- ২১ ফেব্রুয়ারী-১৯৫১ খৃঃ)
(খ) ঈসা এর (আঃ) জীবিত থাকা এবং আকাশে উঠিয়ে নেওয়ার মাসআলাটি অকাট্যভাবে প্রমাণিত নয়। কুরআনে কারীমের বিভিন্ন আয়াত দ্বারা এ বিষয়টি পরিপূর্ণ বিশ্বাস হয় না। (লাহোরের আচহারা নামক স্থানে মওদূদী সাহেবের প্রদত্ত ভাষণের একাংশ নাওয়ায়ে পাকিস্তান-পত্রিকা ৪ঠা সেপ্টেম্বর- ১৯৫৫ খৃঃ থেকে সংগৃহিত।)
(গ) কুরআন এ সম্পর্কে স্পষ্ট কোন বর্ণনা দেয়নি যে, আল্লাহ তা’আলা তাকে শরীর ও আত্মার সাথে ভূ-পৃষ্ঠ থেকে উঠিয়ে আকাশের কোথাও নিয়ে গেছেন । এবং একথাও স্পষ্ট বলে দেয়নি যে, তিনি ভূ- পৃষ্ঠে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেছেন। অথবা শুধু তার রুহ উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। এজন্য কুরআনে কারীমের ভিত্তিতে এর মধ্য থেকে কোন এক দিককে অস্বীকারও করা যায় না। আবার প্রমাণিতও বলা যায় না। (সূত্রঃ তাফহীমুল কুরআন, খণ্ড-১, পৃঃ ৪২০ ) বিঃ দ্রঃ উল্লেখিত বিষয়ের আলোচনা রসায়েল ওয়া মাসায়েলের তৃতীয় খণ্ডের ৫৭ পৃষ্ঠায়ও রয়েছে।
এই একই আয়নায় খতমে নবুওয়াত অস্বীকারকারী মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর ভয়াল চেহারাও লক্ষ্য করুন-
মাসীহে মাওউদ (হযরত ঈসা (আঃ)-এর আকাশ থেকে অবতরণের আকীদা, ইহা এমন কোন আকীদা নয়, যা আমাদের ঈমানের শাখা এবং দীনের কোন রুকন হতে পারে। (সূত্রঃ ইজালায়ে আওহাম-মির্জা গোলাম আহমাদ-১৪০ )
প্রিয় পাঠক! বিস্ময়বোধ হয় আল্লামা মওদূদীর এ পরিমাণ জ্ঞান ও অধ্যাবসায় থাকা স্বত্ত্বেও চিন্তা-চেতনার দিক দিয়ে মির্জা গোলাম আহমদ থেকে উপরে উঠতে পারেননি। বরং ঐ স্থানেই থেমে গেছেন যেখানে মির্জা সাহেব আরম্ভ করেছিল।
হযরত ইমাম মাহদী সম্পর্কে গবেষণা
মওদূদী মতবাদের আয়নায় এ ছবিগুলোও প্রদর্শন করানো হয়। মওদূদী সাহেব বলেন- প্রথমতঃ মাহদী শব্দের প্রতি মনযোগ দেয়া উচিত যা হাদীসে ব্যবহার করা হয়েছে। হুজুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম) মাহদী শব্দ বলেছেন যার অর্থ হেদায়েত প্রাপ্ত। হাদী শব্দ ব্যবহার করেননি। মাহদী প্রত্যেক ঐ সর্দার, নেতা, আমীর ও হতে পারে যে সঠিক পথের উপর রয়েছে। (সূত্রঃ তাজদীদ ওয়া ইয়াহুয়ায়ে দীন)
এ স্থানে আল্লামা মওদূদীর সুক্ষ্ম গবেষণা দেখে স্বাভাবিকভাবে হাসি পায়। এবং তাকে আশীর্বাদ দেয়া উচিত যে, তিনি মাহদী শব্দের মধ্যে হাদিয়াত তথা পথ প্রদর্শনকারীর অর্থ না থাকা সত্ত্বেও মাহদী শব্দটিকে সর্দার-নেতার সমার্থোবোধক স্থির করে দিয়েছেন। এ ধরনের ইজতেহাদ সাধু মুকাল্লিদরা কোথায় অর্জন করতে পারে?
উল্লেখিত বক্তব্যে মওদূদীবাদের আয়নায় কাদিয়ানী চেহারাও ভেসে উঠে । লক্ষ্য করুন মির্যা সাহেব বলেন- ইমাম মাহদী সম্পর্কে যে সকল ভবিষ্যত বাণী রয়েছে এগুলো দ্বারা বুঝা যায় যে, ইমাম মাহদী কয়েকজন হবেন। (সূত্রঃ আল্ ফযল ২৭ ফ্রেব্রুয়ারী ১৯৪৭ খৃঃ)
একই কথা বিভিন্ন শব্দে ব্যক্ত করার মধ্যে পার্থক্য কেন হল? – আল্লামা মওদূদীর বক্তব্য যে মাহদী প্রত্যেক ঐ ব্যক্তি —- যে নেতা সেও হতে পারে। আর কাদিয়ানীদের দাবী যে কয়েজন মাহদী হবেন। এ উভয়ের মধ্যে সামান্য যে শাব্দিক পার্থক্য তা শুধু এজন্য যে, কাদিয়ানী নিজেই স্বয়ং মাহদী দাবী করেছিল। যখন আল্লামা মওদূদী বলেছিলেন মাহদী হওয়া এটা দাবী করার কোন জিনিষ নয়। তিনি বলেন- মাহদী হওয়া দাবী করার কোন জিনিস নয়, আমল করে দেখানোর জিনিস। এ ধরনের দাবী যারা করে এবং যারা তাদের প্রতি বিশ্বাস করে আমার নিকট উভয়ে নিজের জ্ঞানের কমতি এবং ব্রেনের দূর্বলতা প্রমাণিত করছে । (সূত্রঃ তাজদীদ ওয়া ইয়াহয়ায়ে দীন)
উক্ত ইবারতের কয়েক লাইন পূর্বে মওদূদী সাহেব স্পষ্টভাবে ইহাও বলে দিয়েছেন যে, আমি এই আশাও করতাম না যে, তিনি নিজে মাহদী হওয়ার দাবী করবেন বরং সম্ভবত তিনি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে মাহদী হওয়ার আগ্রহী ছিলেন না। (কিন্তু লিখকের ধারণা হচ্ছে যে, মওদূদী সাহেব হয়ত এ কথাটুকু নিজেকে ছোট মনে করে বলে ফেলেছেন। অন্যথায় কোন সঠিক পথের উপর প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তির জন্য তো এতটুকু পরিমাণ ইলম অবশ্যই হওয়ার কথা যে, তিনি মাহদী এবং সঠিক পথে প্রতিষ্ঠিত।) এবং তার মৃত্যুর পর তার কার্যাবলী দ্বারা দুনিয়াবাসী এটাই বুঝবে যে, স্বাভাবিক ভাবেই তিনি খিলাফত আলা মিনহাজিন নবুওয়াহ প্রতিষ্ঠাকারী ছিলেন। যার আগমনের সুসংবাদ পূর্বেই শুনানো হয়েছিল। (সূত্রঃ তাজদীদ ওয়া ইয়াহুয়ায়ে দীন)
পূর্বসূরীদের থেকে উপদেশ গ্রহণ
মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর মিথ্যা দাবীসমূহের অশুভ পরিণতি মওদূদী সাহেবের সামনেই ছিল। সকল হক্কানী উলামায়ে কিরাম কিভাবে তার পশ্চাদধাবন করেছিলেন। তাঁরা তার বিরুদ্ধে কাফের হওয়ার সর্বসম্মত ফতওয়া প্রকাশ করেছিলেন। এমতাবস্তায় একথা কখনো যুক্তিসঙ্গত হতে পারে না যে, মওদূদী সাহেব মির্জা গোলাম আহমদের করুন পরিণতি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবেন না। সুতরাং মওদূদী সাহেব এ স্থানে অত্যন্ত সুকৌশলে নবী ও মাহদী হওয়ার অবমাননাকর দাবী থেকে নিজের আঁচলকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। এবং নিজে মাহদী হওয়া বা না হওয়ার ফায়সালা ঐ সব লোকদের মাথার উপর রেখে গিয়েছেন যারা তার পরবর্তীতে একত্রিত হয়ে বসে এ ফায়সালা করবে যে, মওদূদী সাহেবকে তার নিজের লিখনী, রচনাবলী, নিদর্শনাবলীও বৈশিষ্ট্যাবলীর ভিত্তিতে মাহদী হওয়ার আসনে সমাসীন করা যায় কি না? এই অবস্থায় যদি মওদূদী সাহেবের স্থলাভিষিক্তরা সর্বস্মতিক্রমে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় যে, আল্লামা মওদূদীই শেষ জমানার প্রতিশ্রুত মাহদী। তাহলে একথা স্পষ্ট যে, এতে মওদূদী সাহেবের কি অপরাধ বলা যেতে পারে? তিনি যখন ফাতেমা জিন্নাহর নেতৃত্বাধীন নির্বাচনের সময় জামাআতে ইসলামীর সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করার সাহস দেখতে পারেন নি। তাহলে এখন কি আর তিনি কবর থেকে উঠে এসে এ দাবীকে প্রত্যাখ্যান করতে পারবেন? এটা কিভাবে সম্ভব। এর কোন যিম্মাদারী বা জবাবদিহীতার দায়িত্ব কি তার উপর চাপানো যায়। এটা তো অসম্ভব। মওদূদী সাহেবের কাজ বা মিশন তো শুধু কাজ করে রেখে যাওয়া। আন্দোলনের লেটারেচার তৈরি করা এবং অন্যদের মাধ্যমে আরবী, ইংরেজী বিভিন্ন ভাষায় তার অনুবাদ করিয়ে এগুলোর প্রচার-প্রসার করতে থাকা। যেগুলোকে তিনি অত্যন্ত নিপুণভাবে সুচারুরূপে আঞ্জাম দিয়ে গেছেন। তার মৃত্যুর পর তার অমর স্মৃতি কার্যাবলীর ভিত্তিতে তাকে মাহদী সাব্যস্ত করা এবং পুরস্কার ও সম্মান জ্ঞাপন করা এগুলো তো অন্যদের জিম্মাদারী। মওদূদী সাহেব এ থেকে একেবারেই মুক্ত ও সম্পূর্ণ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।
মীর্জা সাহেবের এই কঠিন পরিণতি থেকে মওদুদী সাহেব এই শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন যে, মীর্জা গোলাম আহমদের মত নবুওয়াতের দাবীর জন্য এভাবে সমতল ভূমিতে পরিবেশ তৈরী করতে চেষ্টা করেননি যাতে নবুওয়াতের জিন্নি, হাকীকী ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকার করে নবী হওয়ার দাবী করা যায়। হ্যাঁ তবে তিনি মুজাদ্দিদ, শিরোনামের অধীনে যে বিশদ আলোচনা করেছেন, বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা বের করেছেন। তার সবগুলো যদি এক দিকে সকল মুজাদ্দিদীনে কিরামের দূর্বলতা ও অভিযোগ প্রমাণিত করে তাহলে অন্যদিকে কিছু কিছু শাখা দিক এমনও আছে, যার দ্বারা কারে নবুওয়াত তথা নবুওয়াতের কার্যাবলীতে এমন কিছু প্রকারও সামনে চলে আসে যার থেকে কাদিয়ানীর মত অসুস্থ (ভ্রান্ত) ব্রেন নিজ অসুস্থতায় আরো উন্নতির শিক্ষা নিতে পারবে। তাজদীদ ওয়া ইয়াহয়ায়ে দীনের কিছু ইবারতের প্রতি লক্ষ্য করুন- (ক) মওদূদী সাহেব বলেন- মুজাদ্দিদকে সার্বিকভাবে ঐ প্রকারের কাজই করতে হয় যা নবীর কাজের ধরণ ছিল।
মওদূদী সাহেবের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ অনুসারে মুজাদ্দিদ এবং নবীর মধ্যে মৌলিক পার্থক্য এই যে, নবীগণ ওহীর ধারক হন। আর মুজাদ্দিদের উপর ওহী অবতীর্ণ হয় না এবং মুজাদ্দিদের ঐ ধরনের মর্যাদাও অর্জন হয় না যা ওহীর ধারক হিসেবে নবীদের অর্জন হয়। মুজাদ্দিদের কাজের প্রকার বা ধরন নির্দিষ্ট করে বলার পর তিনি এক স্থানে ইহাও ব্যক্ত করেছেন-
(খ) ইতিহাসের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে বুঝা যায় এখনও পর্যন্ত কোন “মুজাদ্দিদে কামিল” সৃষ্টি হয় নাই। — মুজাদ্দিদে কামিলের পদ এখনও শুন্য রয়েছে। এখন তৃতীয় আরেকটি ইবারতও লক্ষ্য করুন যার মধ্যে আল্লামা মওদূদী এ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে চেয়েছেন যে, আম্বিয়া (আঃ) সকলেই কামেল ছিলেন না। কেউ কেউ নবুওয়াতের যিম্মাদারী পুরাপুরিই আদায় করেছেন, আবার কেউ কেউ নবুওয়াতের যিম্মাদারী অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিযুক্ত করে রেখে গেছেন। তিনি আরো বলেনঃ
(গ) একারণেই সমস্ত আম্বিয়া (আঃ) রাজনৈতিক বিপ্লব ঘটানোর চেষ্টা করেছিলেন। তবে কোন কোন নবীর চেষ্টা-মেহনত শুধু জমীন তৈরি করা পর্যন্ত সীমিত ছিল। যেমন হযরত ইবরাহীম (আঃ)। কেউ কেউ বিপ্লবী আন্দোলন বাস্তবে শুরু করেছিলেন। কিন্তু আল্লাহর হুকুমত প্রতিষ্ঠিত করার পূর্বেই তার কাজ খতম হয়ে গিয়েছিল। যেমনঃ হযরত ঈসা মসীহ (আঃ)। এবং কেউ কেউ এ আন্দোলনকে সফলতার শেষ প্রান্তে পৌছে দিয়েছেন। যেমনঃ হযরত মূসা (আঃ) ও সাইয়্যেদিনা হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম)। (সূত্রঃ তাজদীদ ওয়া ইয়াহুয়ায়ে দীন) উল্লেখিত ইবারতের সমষ্টি দ্বারা কি একথা প্রতীয়মান হয় না যে, যেমনিভাবে তাজদীদ দু প্রকার (১) আংশিক বা জুযয়ী (২) পরিপূর্ণ বা কামেল। ঠিক তেমনিভাবে নবুওয়াত ও দুই প্রকার (১) আংশিক বা জুযয়ী (২) পরিপূর্ণ বা কামেল। বাস্তবিক পক্ষে যদি উক্ত ইবারত থেকে এ কথা বুঝে আসে আর প্রবল ধারণা হল অবশ্যই একথা বুঝে আসে। তাহলে এর ফলাফল হল এই যে, মওদূদীবাদে কাদিয়ানী হওয়ার ঘ্রাণ পাওয়া যায়। যা অস্বীকার করার উপায় নেই। কেননা মওদূদী সাহেব উক্ত বক্তব্যে কেমন যেন নিজেকেই মুজাদ্দিদে কামিল ও নবীয়ে কামেল দাবী করছেন।
ইতিহাস নিজের পুনরাবৃত্তি ঘটায়
আল্লামা মওদূদীর লিখনীতে এ ধরনের খোলামেলা বক্রতা ও ভ্রষ্টতাপূর্ণ বাক্যাবলী এবং শব্দ প্রয়োগ আর এ জাতীয় ঔদ্ধত্যপূর্ণ প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্য দেখার পর গভীর চিন্তায় পড়ে গেলাম। মনে মনে ভাবলাম হে প্রভু। দুনিয়াতে একি চলছে? শেষ পর্যন্ত মানুষ এত সব চিন্তা-চেতনা, দৃষ্টিভঙ্গি, মুক্ত বুদ্ধি খোলা চোখে দেখার পরও কি নিরবে সহ্য করে নিচ্ছে? শুধু সহ্যই করা হচ্ছে না, বরং একটি দল তাকে যুগ শ্রেষ্ঠ মুবাল্লিগে ইসলাম ও দাঈএ ইসলাম মনে করে সম্মান ও পুরস্কারের সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করছে। কিন্তু যখন এ যুগের পূর্বের যুগ মির্জা গোলাম আহমদের প্রাথমিক যুগের প্রতি দৃষ্টি ফিরানো হয় তখন ঐ সময়ও একই ধনের দৃশ্য পরিলক্ষিত হয়েছিল।
দুর্ভাগ্যবশতঃ মির্জা সাহেবের যুগে সাধারণভাবেই মানুষ ইফরাত ও তাফরীত তথা সীমালংঘন ও সীমা বর্জনের শিকার ছিল। হক্কানী উলামায়ে কিরাম একনিকে তাকে কাফের মুরতাদ, যিন্দিক বলে ফাতওয়া নিচ্ছিল। আর অপরদিকে ইংরেজ ও তাদের ভক্তরা তাকে সম্মানিত নবী, প্রতিশ্রুত মাসীহ-ঈসা, মাহদী, মুজাদ্দিদ ইত্যাদি উপাধীতে ভূষিত করেছিল।
বর্তমানে কিছু কিছু লোক ইসলাম ও কুফরীর মধ্যে ফয়সালা করার জন্য একটি সহজ উসুল এটা খোজে নিয়েছে যে, যে ব্যক্তি কালিমা পড়ে এবং নিজে নিজেকে মুসলমান বলে সেই মুসলমান। কিন্তু বাহ্যিকভাবে এ উসূলটি স্পষ্ট ভুল। কেননা যদি এমন ব্যক্তি কুরআনে কারীমের কোন আয়াতকে অস্বীকারকারী হয়। তাহলে সে নিজের কালিমা এবং না যে থাকা সত্ত্বেও কাফির। এরকমভাবে দীন-ইসলামের যে সকল বিষয় সর্বস্বীকৃতভাবে চলে আসছে তার মধ্য থেকে কোন একটিকে অস্বীকার করাও কুফরী। কুরআনে কারীমের কোন আয়াত অথবা কোন মুতাওয়াতির আকীদার অর্থ যা সদা সর্বস্বীকৃত রয়েছে তা মেনে নেয়াও জরুরী । ইহাকে অস্বীকার করে কুরআনে কারীম অথবা হাদীসে মুতাওয়াতিরের কোন নতুন অর্থ বের করাও এক ধরনের কুফরী। যা মওদূদী সাহেব সচরাচর অহরহ করে রেখেছেন। তার পরেও কি এটা কুফরী নয়? নাকি দীন কায়েম?
বর্তমানে যখন “কুরআনে কারীমের চারটি মৌলিক পরিভাষার” নতুন ব্যাখ্যার নামে নতুন তাফসীরুল কুরআন পেশ করা হচ্ছে। তাফহীমুল কুরআনের মাধ্যমে দীনে হাকীকী বা প্রকৃত দীন থেকে আল্লাহর পবিত্র স্বত্তা ও ইবাদতের রুহ বের করে তার স্থানে রাজনীতির রুহ বপন করা হচ্ছে। এই সময় পৃথিবীতে আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মিরী (রঃ) এর মত গভীর জ্ঞানের অধিকারী, ইলমের বুৎপত্তিশীল ব্যক্তিত্বের প্রয়োজন ছিল। যিনি কাদিয়ানী ফেনার যৌবন কালে নিজের স্বরচিত বে-নযীর কিতাব “ইকফারুল মুলহিদীন” নামক গ্রন্থ লিখে কাদিয়ানী ফেত্নাকে চিরদিনের জন্য মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছিয়ে দিয়েছিলেন।
আল্লামা মওদূদীর ক্ষুরধার লিখনী ও রচনায় মূল বিষয় ও নিজস্ব বক্রতা ও ভ্রষ্টতার ছায়ায় নির্মিত রচনাবলীর বিরাট একটি খাজানা প্রকাশিত অবস্থায় বাজার দখল করে আছে। যার সয়লাব ও ভয়াবহতা দাবী করে যে আল্লামা কাশ্মিরী (রঃ) যেভাবে কাদিয়ানী আন্দোলনের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছিলেন ও তার পশ্চাদাবন করেছিলেন ঐভাবেই যেন বর্তমান যুগের উলামায়ে কিরাম তার জবাব দিয়ে দেন। তাকে উচিত শিক্ষা দিয়ে দেন। উলামায়ে কিরামের নিকট এটাই জাতির কামনা। আল্লাহ তা’আলা সমগ্র মুসলিম জাহানকে সকল ধরনের ফেত্না-ফাসাদ ও অনিষ্টতা থেকে রক্ষা করুন। উলামায়ে কিরামকে তাঁদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হওয়ার তৌফিক দান করুন। আমিন।