মওদূদীবাদের আয়নায় মু’তাজিলী হওয়ার চেহারা
ইতিহাসের প্রাচীন ঘটনা :
হিজরী প্রথম শতাব্দীর পরিসমাপ্তি ও দ্বিতীয় শতাব্দীর সূচনালগ্নে মু’তাযিলী সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে। যাদের মূল নেতা ছিল প্রখ্যাত তাবিয়ী হযরত ইমাম হাসান বসরী (রঃ) এর ক্লাশের একজন অবাধ্য শাগরিদ। যার নাম ওয়াসিল ইবনে আতা। সে এক সময় স্বীয় উস্তাদের সাথে মতভেদ করে পৃথক হয়ে যায়। যার ফলে তাকে মু’তাযিলী বা ভিন্নতা অবলম্বনকারী বলা হত। পরবর্তীতে তার অনুসারীরাই ফিরকায়ে মু’তাযিলা নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে।
মু’তাযিলা সম্প্রদায়ের লোকেরা নিজেদেরকে “আসহাবুল আকল ওয়াত তাওহীদ” দাবী করত। যেমন নাকি মওদূদীর অনুসারীরা নিজেদেরকে ইকামতে দীনের আন্দোলনকারী বলে দাবী করে থাকে।
ঐ সম্প্রদায়ের বুদ্ধির অসভ্য কুটচালের কারণেই (যখন ঐ সম্প্রদায়ের পুরাতন ও বস্তাপচা চেতনা, বিশ্বাস, ইসলামী ইতিহাসের প্রাচীন ঘটনায় পরিণত হয়েছে।) আমরা তাহরীকে মওদূদীবাদের আয়নায় ঐ মতবাদের কিছু ঝলক দেখানোর প্রয়োজন মনে করেছি ।
* মুতা’যিলী সম্প্রদায়ের বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্বাস মু’তাযিলী সম্প্রদায়ের মৌলিক আকীদাসমূহ নিম্নরূপ ঃ
(১) আল্লাহ তা’আলার গুণাবলীকে অস্বীকার করা। (২) আল্লাহ তা’আলার ক্ষেত্রে আরশে সমাসীন হওয়াকে অবিশ্বাস করা। (৩) আল্লাহ তা’আলা শেষ রাতে নিকটতম আকাশে নেমে আসেন ইহা অস্বীকার করা।
(৪) একত্ববাদী মুমিন যদি বে-আমল হয় তাহলে সে ঈমান থেকে বের হয়ে যায়। যদিও সে কাফের হয় না। কিন্তু ঈমান থেকে বের হয়ে যাওয়ার কারণে সর্বদাই সে দোযখে থাকবে।
(৫) জীবিতদের দুআ অথবা দান-সদকা মৃতদের জন্য কোন ধরনের উপকার পৌঁছাতে পারে একথা অস্বীকার করা। (সূত্রঃ গুনয়াতুত্তালিবীন পৃঃ ১৯৬)
মওদূদী সাহেবের দৃষ্টিতে মু’তাযিলা ও খারিজী সম্প্রদায়
খারিজী স্প্রেদায়ের পরিচয় দিতে যেয়ে মওদূদী সাহেব নিজেই খিলাফত ও মুলুকিয়্যাত নামক গ্রন্থে এভাবে পরিচয় উল্লেখ করেছেন- (১) গুণাহ তাদের নিকট কুফরীর সমপর্যায়ের ছিল এবং প্রত্যেক কবীরা গুনাহকারীকে তারা কাফের সাব্যস্ত করত ।
(২) হযর উসমান (রাযিঃ) তাদের মত অনুযায়ী স্বীয় খিলাফতের শেষকালে ইনসাফ ও হক থেকে বিচ্যুত হয়ে গিয়েছিলেন। যার ফলে তিনি হত্যা বা পদচ্যুতির উপযুক্ত ছিলেন। ইসলামী বিধানের মৌলিক উৎসের মধ্য থেকে শুধু কুরআনে কারীমকে তিনি মানতেন। কিন্তু হাদীস ইজমা উভয়টার ক্ষেত্রে তার মতাদর্শ সাধারণ মুসলমানদের থেকে ভিন্ন ছিল। (সূত্রঃ খিলাফত ওয়া মুলুকিয়্যাত পূঃ ২১৪) তিনি মু’তাযিলীদের পরিচয় দিতে যেয়ে আরো উল্লেখ করেছেন- তাদের নিকট ইমাম নির্দিষ্ট করা (অর্থাৎ রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করা) শরীআতের দৃষ্টিতে ওয়াজিব ছিল। (সূত্রঃ খিলাফত ওয়া মুলুকিয়াত : ২১৮)
পাপী মুসলমান তাদের নিকট মুমিনও নয় কাফিরও নয়। বরং মধ্যবর্তী এক অবস্থায় রয়েছে। (সূত্রঃ খিলাফত-২১৯)
উল্লেখিত দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়াও তারা সাহাবায়ে কিরামের মতভেদ, তাঁদের রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে নিজেদের ধৃষ্টতাপূর্ণ বক্তব্য প্রকাশ করেছে। হযরত উসমান (রাযিঃ) এর ব্যাপারেও তারা মারাত্মক অভিযোগ উত্থাপন করেছে। (সূত্রঃ খিলাফত ওয়া মুলুকিয়্যাত-২১৯)
মওদূদীবাদের আয়নায় মু’তাযিলী হওয়ার প্রতিচ্ছবি
যেমনিভাবে উপরে মু’তাযিলী সম্প্রদায়ের কথা আলোচনা করা হয়েছে যে, তারা প্রত্যেক বেআমল ও কবীরা গুনাহকারী সৃমিনকে ঈমান থেকে বহির্ভুত মনে করে। ঠিক তেমনিভাবে একই অবস্থা মওদূদীবাদের প্রবর্তক আল্লামা মওদূদীর। মওদূদী সাহেব স্বীয় খোতবাতে সকল বে-আমল মুসলমানদেরকে এক তরফাভাবে ঈমান ও ইসলাম থেকে খারেজ বলে দিয়েছেন। এবং ফেরকায়ে মু’তাযিলীর ডাল-পালাহীন বৃক্ষকে নিজেরই সাফাই গাওয়ার পানি দিয়ে পুনরায় সতেজ করার অপচেষ্টা করেছেন। নিম্নে মওদূদী সাহেবের খোতবাত থেকে নির্বাচিত অংশ উল্লেখ করে মওদূদী সাহেবের নিজস্ব মতামতের ভিত্তিতে তার মু’তাযিলী হওয়ার প্রকৃত চেহারা উম্মোচন করা হবে ।
মওদুদী সাহেবের খোতবাতের নির্বাচিত অংশসমূহ ঃ
(ক) একটু ব্রেনের উপর চাপ সৃষ্টি করে ভেবে দেখুন যে, আপনি মুসলমানের শব্দ যা দাবী করছেন তার দ্বারা উদ্দেশ্য কি? মানুষ কি পিতা-মাতার গর্ভ থেকে ইসলাম সাথে নিয়ে আসে? কোন ব্যক্তি কি শুধু এ ভিত্তিতে মুসলমান হতে পারে যে, সে মুসলমানের সন্তান বা মুসলমান বংশের। আপনি কি এমনই বলবেন, না অন্য কিছু?
বাস্তবে মুসলমান তাকে বলে না। মুসলমান তো সৃষ্টি হওয়ার জিনিস। নয়। বরং ইসলাম গ্রহণ করা বা কবুল করার দ্বারাই একমাত্র মুসলমান হওয়া যায়। (সুত্রঃ খোতবাত-১/৬)
(খ) এক ব্যক্তি চাই সে ব্রাহ্মণ হোক বা রাজপুত, ইংরেজ হোক বা হিন্দু হোক—- যখন সে ইসলাম কবুল করে নিবে তখনই সে মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। অন্য আরেক ব্যক্তি, যে মুসলমানের ঘরে জন্ম নিয়েছে, যদি সে ইসলামের অনুসরণ ছেড়ে দেয় তাহলে সে মুসলমানদের জামাআত থেকে বের হয়ে যাবে। (সূত্রঃ খোতবাত-১/৬)
(গ) ইসলাম কোন বংশ, গোত্র বা কোন পঞ্চায়েতের নাম নয় যে, ইসলাম পিতা থেকে ছেলের, ছেলের থেকে নাতীর নিকট এমনিতেই নিজে নিজে পৌঁছে যাবে। (সূত্রঃ খোতবাত-২/১৩)
(ঘ) ছোট্ট একটি কালিমার মধ্যে কি আছে? শুধু কয়েকটি অক্ষরই তো আছে। এসকল অক্ষরগুলোকে একত্রিত করে মুখ দিয়ে বের করলেই কি এমন কোন যাদু বা শক্তি আছে যে, অটোমেটিক মানুষের দৈহিক, আত্মিক পরিবর্তন হয়ে যাবে?—– শুধু মুখ খোলা এবং যবানকে হেলিয়ে কিছু অক্ষর বলে দেওয়ার দ্বারা এত বড় প্রভাব- প্রতিক্রিয়া হতে পারে না। (সূত্রঃ খোতবাত খণ্ড ৪ পৃঃ ২৭) ঙ) একথাটাকে একটি সুন্দর দৃষ্টান্ত দিয়ে তোমাদেরকে বুঝাচ্ছি— ধরে নাও তোমাদের ঠাণ্ডা বা শীত লেগেছে, এখন যদি তোমরা মুখে মুখে লেপ-লেপ বলে ডাকতে থাক তাহলে কখনোই শীত লাগা বন্ধ হবে না। যদিও তুমি সারা রাত্রে এক লাখ বার লেপের জপ করে তাসবীহ পড়ে নিয়েছে। হ্যাঁ, যদি লেপের মধ্যে তুলা দিয়ে গায়ের উপর নিয়ে নাও তাহলে তৎক্ষণাত ঠাণ্ডা বা শীত লাগা বন্ধ হয়ে যাবে। সুতরাং উল্লেখিত অবস্থার মতই হল কালিমা তাইয়েবার অবস্থা। শুধু ছয়-সাতটি শব্দ বলে দিলেই এত বড় পার্থক্য হতে পারে না যে, মানুষ কাফের থেকে মুসলমান হয়ে যাবে। অপবিত্র থেকে পরিত্র হয়ে যাবে। অভিশপ্ত থেকে অতিপ্রিয় হয়ে যাবে। জাহান্নামী থেকে জান্নাতী হয়ে যাবে। (সূত্রঃ খোতবাতঃ খণ্ড-৪, পৃষ্টঃ১৭)
(চ) এমন কোন ব্যক্তিকে মুসলমান মনে করার অবকাশ নেই, যে নামায পড়েনা। কেননা ইসলাম শুধু একটি বিশ্বাসগত জিনিসের নাম নয়। বরং ইহা একটি বাস্তবিক আমলী জিনিস। (সূত্রঃ খোতবাত-খণ্ড- ১২ পৃঃ ৯৫)
(ছ) অনেক মুসলমান এ মনে করে যে, নামায না পড়লে এবং যাকাত না দিলেও সে মুসলমানই থেকে যায়। কিন্তু কুরআনে কারীম এটাকে পরিষ্কার ভাষায় অস্বীকার করে দিয়েছে। কুরআনের দৃষ্টিতে শুধু কালিমায়ে তাইয়েবার স্বীকারুক্তি অনর্থক, যদি মানুষ কালিমার উপর অটল থেকে নামায় এবং যাকাতের পাবন্দ না হয়। (সূত্রঃ খোতবাত- খণ্ড-১৮ পূঃ ১৪৭)
(জ) ঐ সমস্ত লোক যাদের সারা জীবন কখনো এ ধারণাও আসে নাই যে, তার উপর হজ্ব ফরজের গুরুত্বপূর্ণ যিম্মাদারী রয়েছে—— হজের ইচ্ছা ও সে অন্তরে পোষণ করে না। তাহলে সে নিশ্চিতভাবে মুসলমান নয়। যদি সে নিজেকে নিজে মুসলমান বলে তাহলে সে মিথ্যা বলছে। আর এমন ব্যক্তিকে সে মুসলমান মনে করে, যে কুরআনে কারীম সম্পর্কে অজ্ঞ। (সূত্রঃ খোতবাত- খণ্ড-২৪ পৃঃ ৩০৫ )
আল্লামা মওদূদীর খোতবাত থেকে উপরে ৮টি নির্বাচিত অংশ উল্লেখ করা হয়েছে। যা দ্বারা মওদুদী সাহেবের চিন্তা-চেতনা এবং দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কারভাবে প্রকাশ পায়। যার ফলে স্বাভাবিকভাবে এ সিদ্ধান্ত দেয়া কঠিন নয় যে, মওদূদী সাহেব প্রাচীন মু’তাযিলী সম্প্রদায়ের আধুনিক রূপকার।
(ঝ) আল্লানা মওদূদী স্বীয় প্রসিদ্ধ তাফসীর তাফহীমুল কুরআন এর প্রথম খণ্ডে কুফরীর আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন-
কুরআনে কারীমের দৃষ্টিতে কুফরীর বিভিন্ন সূরত হতে পরে পাঁচটি সূরত বর্ণনা করার পর তিনি বলেন- ষষ্ঠ নম্বর এই যে, দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে এসব গুলোকেই মেনে নিতে হবে। কিন্তু যদি কোন ব্যক্তি আমলের ক্ষেত্রে আল্লাহর বিধানাবলী জেনে-শুনে নাফরমানী করে এবং বার-বার সে নাফরমানীতে অটল থাকে তাহলে দুনিয়াবী জীবনে তার দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তি কোন ইবাদতের উপর থাকবে না। বরং নাফরমানীর উপরই থাকবে। (সূত্রঃ তাফহীমুল কুরআন খণ্ড-১ পৃঃ ১২৯, টীকা- ১৬১)
পরিশেষে খোতবাত এর ১০ নং পৃষ্ঠার আরো একটি বিশেষ অংশ লক্ষ্য করুন। যা দ্বারা অনুমান হয়ে যাবে মওদূদী সাহেব মু’তাযিলী সম্প্রদায়ের দো-ভাষী হিসেবে প্রচার প্রসারের ক্ষেত্রে কি কি ভুল দ্বারা। কাজ নিতে চেয়েছেন। লক্ষ্য করুন-
(ঞ) আমলের এ সকল বাহ্যিক নিয়ম-নীতির দৃষ্টান্ত হল এমন-
যেমন একটি শরীর বা দেহ। যদি তার মধ্যে প্রাণ থাকে এবং চলা- ফেরা করে, কাজকর্ম করে, তাহলে নিশ্চই ইহা একটি জীবন্ত মানুষ। কিন্তু যদি তার মধ্যে প্রাণই না থাকে তাহলে ইহা একটি মৃত লাশ। মৃত ব্যক্তির হাত পা, চোখ-নাক, সবকিছুই থাকে। কিন্তু তার মধ্যে প্রাণ থাকে না। এজন্য তোমরা ইহাকে মাটিতে দাফন করে দাও। ঠিক তদ্রূপ যদি নামাযের আরকান পরিপূর্ণ আদায় হয়, অথবা রোযার শর্ত পরিপূর্ণ আদায় করা হয় কিন্তু ঐ মাকছাদ পূর্ণ করা হল না- যার জন্য নামায-রোযা ফরয করা হয়েছে (অর্থাৎ ইকামতে দীন) তাহলে এ ইবাদতগুলো প্রত্যেকটি নিষ্প্রাণ জিনিষ হিসেবে থেকে যাবে। (সূত্রঃ খোতবাত-পৃ-৯০)
উক্ত বক্তব্যের উপর পর্যালোচনা, মন্তব্য ও অভিযোগ
মওদূদীবাদের আয়নায় মু’তাযিলীর ছবি অংকনের জন্য উপরোল্লেখিত ৯টি নির্বাচিত অংশই যথেষ্ট। যাতে তার স্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি বুঝা যায়। সামনের লাইনে অমরা উক্ত ধারাবাহিকতা অনুসারে তার ক্রমিক নং এর ভিত্তিতে প্রত্যেকটি নির্বাচিত অংশের উপর পর্যালোচনা ও মন্তব্য উপস্থাপন করব।
(ক, খ, গ) এর অধীনে মওদূদী সাহেব যা কিছু বর্ণনা করেছেন তা পড়ার পর সামান্য জ্ঞান-বুদ্ধির অধিকারী একজন ব্যক্তিও একথা বুঝে নিবে যে, মওদূদী সাহেব নিজ খোতবায় স্পষ্টভাবে অপ্রাসঙ্গিক কিছু কথা সৃষ্টি করা ও প্রধান আলোচনাকে উল্টিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। তিনি কারো জন্মগত বা বংশগত মুসলমান হওয়াকে সরাসরি অস্বীকার করে বসেছেন। তাছাড়াও তিনি কি দারুণ কৌশলে নিজের সম্বোধিত ব্যক্তির মুখে নিজের সমর্থিত মু’তাযিলী সম্প্রদায়ের কথা ঢেলে দিয়ে জোরপূর্বক তাদের থেকে একথা বের করতে চাচ্ছেন যে, মুসলমানের ঘরে জন্ম নিয়ে মুসলমান হওয়া যায় না, বরং একমাত্র ইসলাম কবুল করার দ্বারাই মুসলমান হওয়া যায়। অন্য ভাষায় তিনি একথা বুঝাতে চাচ্ছেন যে, যেমনিভাবে কোন ভিন্ন ধর্মের মানুষকে শুধু ইসলাম গ্রহণ করার দ্বারাই মুসলমান বলা যায়, ঠিক তেমনিভাবে মুসলমান পিতা-মাতা থেকে জন্ম লাভকারী সন্তান শুধু ইসলাম গ্রহণ করার দ্বারাই মুসলমান হতে পারবে না, ন্মে সূত্রে মুসলমান হতে পারবে না। (মওদূদী সাহেবের এ দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্বাসের সমর্থন ঐ সকল লোকদের আমল দ্বারাও পাওয়া যায়, যা তারা নিজেদের জামাআতে ইসলামী সংগঠন প্রতিষ্ঠার সময় গ্রহণ করেছিলেন- তা এই যে, ঐ সময় মওদূদীর সাথে অবস্থানরত প্রত্যেকটি রুকনই (সদস্য) নতুনভাবে কালিমায়ে শাহাদাত পড়ে জামাআতে ইসলামীতে যোগ দান করে ছিল। (অর্থাৎ নতুনভাবে মুসলমান হয়েছিল।)
এ দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে মওদূদী সাহেব রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম) এর ঐ হাদীসকে প্রত্যাখ্যান করেছেন যার মধ্যে বলা হয়েছে
كل مولود يولد علي الفطرة
অর্থাৎ প্রত্যেকটি বাচ্চাই ফিতরাত তথা ইসলামের উপর জন্ম গ্রহণ করে।
তাছাড়া ফিকাহ শাস্ত্রের ঐ প্রসিদ্ধ কায়িদা বা উসূলকেও প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছেন যার মধ্যে বলা হয়েছে
الولد يتبع خير الابوين دينا
অর্থাৎ পিতা-মাতার মধ্যে যার ধর্ম উত্তম, সন্তানকে তারই অনুসারী
ধরা হয়। এ সূত্র দ্বারাও প্রমাণিত হয় যে, বাচ্চাকে জন্মগতভাবে কোন না কোন ধর্মের সাথে সম্পৃক্ত মানতে হয়।
এই অবস্থায় মুসলমান পিতা-মাতা থেকে জন্ম গ্রহণকারী শিশুর জন্য তার জন্মগত, ঔরসজাত, বংশগত মুসলমান হওয়াকে যথেষ্ট মনে না করে নতুনভাবে ইসলাম গ্রহণ করার কথা বলা এবং এ জাতীয় লোকগুলোকেও হিন্দু, খৃষ্টানদের বরাবর দাড় করিয়ে দেয়া মারাত্মক, জঘন্য পথভ্রষ্টতা। যা মুতাযিলী হওয়ারই নামান্তর। যেগুলোকে তিনি ইকামতে দ্বীনের নামে চালিয়ে দিচ্ছেন।
(ঘ, ঙ, চ, ছ, জ) উক্ত ক্রমিকের অধীনে যে সকল নির্বাচিত অংশ উল্লেখ করা হয়েছে, তার সবগুলিই মু’তাযিলী মতাদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত। অথচ এমন অনেক হাদীস বিদ্যমান রয়েছে, যার দ্বারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মতাদর্শই সত্য প্রমাণিত হয় যে, মুক্তি পাওয়ার জন্য শুধু কালিমায়ে তাইয়্যেবা পড়ে নেয়াই যথেষ্ট। এটা ভিন্ন কথা যে, যদি আল্লাহ তা’আলা তার বেআমলীকে ক্ষমা না করেন, তাহলে প্রথমে তার পাপের শাস্তি ভোগের পর জান্নাতে প্রবেশের সৌভাগ্য অর্জন হবে। কিন্তু কক্ষনো এমন হবে না যে, একজন বে- আমল মুসলমান সদা-সর্বদা জাহান্নামে থাকবে। এ সম্পৰ্কীয় কিছু হাদীস নিম্নে বর্ণনা করা হল :
(১) হযরত আবু যর (রাযিঃ) থেকে এক দীর্ঘ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম) বলেছেন- উম্মতের মধ্যে কোন ব্যক্তি যদি শিরক মুক্ত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে তাহলে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। চাই সে জিনা, চুরি, শরাব পান করে থাকুক। (বুখারী, মুসলিম) (এই একই ধরনের হাদীস হযরত আবু হুরাইরা, হযরত আবু মুসা এবং হযরত মু’আয (রাযিঃ) থেকেও বর্ণিত হয়েছে। যদিও শব্দের মধ্যে সামান্য পার্থক্য আছে।)
(২) হযরত আমর ইবনুল আস (রাযিঃ) থেকে এক দীর্ঘ হাদীসে বর্ণিত রয়েছে যে, কিয়ামতের দিন এক ব্যক্তিকে আল্লাহ তা’আলার দরবারে উপস্থিত করা হবে। যার আমল নামায় ১৯টি দফতর হবে মন্দ আমলের, যা ইনসাফের দাড়িপাল্লার (খাতা) মধ্য থেকে শুধু এক পাল্লায় রাখা হবে। তার নেকীর পাল্লা সম্পূর্ণ খালি থাকবে। অতঃপর কাগজের ১টি ছোট টুকরা বের করে দ্বিতীয় পাল্লায় রেখে দেওয়া হবে। সাথে সাথে দ্বিতীয় পাল্লাটি ঝুঁকে যাবে। (ঐ কাগজের টুকরায় কালিমায়ে শাহাদাত লিখা থাকবে যা সে জীবিতাবস্থায় পাঠ করেছিল। (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ)
(৩) হযরত উসমান গণী (রাযিঃ) থেকে এক দীর্ঘ হাদীসে বর্ণিত রয়েছে যে, তিনি বলেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম) এর মৃত্যুর পর আমার উপর দুঃখ-পেরেশানীর প্রভাব প্রবলভাবে পড়ে ছিল। আমার এই চিন্তা ছিল যে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম) এর মৃত্যু হয়ে গেল কিন্তু আমি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম) থেকে নাজাত পাওয়ার পদ্ধতি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে নিতে পারলাম না – অবশেষে আমি আমার মনের অস্বস্তির কথা হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) এর সম্মুখে আলোচনা করলাম। তখন তিনি বললেন, আমি এ কথা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম)কে জিজ্ঞেস করেছিলাম। উত্তরে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম) বলেছিলেন- নাজাতের মাধ্যম শুধু ঐ কালিমায়ই যা আমি স্বীয় চাচা আবু তালেবকে পড়তে বলছিলাম কিন্তু তিনি আমার কথা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন ও অমান্য করেছিলেন। (সূত্রঃ মুসনাদে আহমদ, জামউল ফাওয়ায়িদ)
ভুল বুঝা ও প্রতারণামূলক ত্রুটি :
শুধু কালিমা পাঠ করার তুলনা আল্লামা মওদূদী এমনই করেছেন যেমনিভাবে কোন ব্যক্তি ঠাণ্ডা বা শীত থেকে বাঁচার জন্য কম্বল-লেপের তাসবীহ পাঠ করে। মওদূদী সাহেবের স্থূল জ্ঞান এর দৃষ্টান্ত দেখে দারুল আশ্চর্য লাগছে। যার উপর মন্তব্য করার মত কোন ভাষা এখন খোজে পাচ্ছি না। পাঠক মহল নিজেরাই সিদ্ধান্ত করে নিবেন যে, মওদূদী সাহেবের দৃষ্টির উপর মু’তাযিলীর চশমায় তাকে কেমন দেখাচ্ছে? মওদূদী সাহেব এটা বুঝতেই পারেন নাই যে, কালিমা হোক বা কুরআনে মাজীদ হোক আল্লাহর জিকির হওয়ার কারণে এগুলো বুঝা ব্যতীত পাঠ করলেও সওয়াব পাওয়া যায়। উদ্দেশ্য পূর্ণ হয় ও প্রিয় জিনিস অর্জন হয় । এটাকে লেপ-কম্বলের জপনের সাথে তুলনা করার মিছাল শুধু স্থুল বুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তিই দিতে পারে। মওদূদী সাহেবের কলম থেকে এ জাতীয় দৃষ্টান্ত বের হওয়া খুবই বিস্ময়কর ব্যাপার। অকল্পনীয় বোকামীর পরিচায়ক।
(ঝ) উক্ত ক্রমিকের অধীনে নির্বাচিত অংশে আল্লামা মওদূদী মারাত্মক ভুল সিদ্ধান্তের সাথে নিজের কথা ব্যক্ত করেছেন। মওদূদী সাহেব মানুষের জন্য শুধু দুটি আকৃতি বা স্তর ধরে নিয়েই আলোচনা করেছেন। অথচ মানুষের তিনটি অবস্থান বা স্তর হতে পারে। মওদূদী সাহেব মাঝখানের একটি স্তর বা অবস্থা বিলোপ করে দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত জবাব হল- যদি মানুষ জীবিত হয় ও চলাফেরা, কাজকর্ম করে তাহলে সে জীবিত এবং সুস্থ মানুষ। কিন্তু যদি সে চলা- ফেরা, কাজকর্ম না করতে পারে তাহলে জরুরী নয় যে, সে মৃত হবে। এবং তাকে মৃত সাব্যস্ত করে মাটিতে দাফন করে দেয়া হবে। যেমনটি মওদূদী সাহেব পরামর্শ নিচ্ছেন। কেননা কখনো এমন হতে পারে যে, মানুষ জীবিত তো আছে কিন্তু দূর্বলতা ও অসুস্থতার কারণে চলতে- ফিরতে, কাজ-কর্ম করতে সক্ষম নয়। এমন মানুষকে জীবিত ও অসুস্থ বলা হবে। তাকে জীবিত মানতে হবে। মৃত ধরা যাবে না। বে-আমল মুসলমানের তুলনা এমন অসুস্থ ব্যক্তির সাথেই হওয়া বাঞ্ছনীয়। তাকে মৃত ঘোষণা দেয়া হাতুড়ে ডাক্তার ও অজ্ঞ হাকীমেরই কাজ হবে। কোন জ্ঞানী ডাক্তার বা হাকীম তাকে কক্ষনো মৃত বলতে পারবে না। এবং কোন স্থুল বুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তিও তাকে মাটিতে সমাধিস্থ করার ফায়সালা করতে পারবে না। যেমনটি মওদূদী সাহেব করেছেন।
মোট কথা মওদুদীবাদ আন্দোলনের পূর্ণ লেটারেচারের মধ্যে এমন কিছু ভুল-ভ্রান্তি ও ভুল বুঝার উৎস ঢুকানো রয়েছে যা এ সংক্ষিপ্ত গ্রন্থে উল্লেখ করা সম্ভব নয়। নমুনা স্বরূপ উপরে কিছু উল্লেখ করা হল যার দ্বারা মওদূদীবাদের আয়নায় মু’তাযিলী হওয়ার স্পষ্ট ছবি প্রকাশ পেয়ে গেছে। আল্লাহ আমাদের সঠিক পথ প্রদর্শন করুন।