সিরিজ – ০১.
মওদূদী সাহেব ও জামায়াতে ইসলামীর সাথে আলেম সমাজের বিরোধিতার প্রকৃত কারণ:
সম্প্রতি মওদূদীবাদ ও মওদূদী সাহেবের ভূল ভ্রান্তি সংক্রান্ত বিষয়ে
‘বেফাকের প্রশ্নমালা’ নিয়ে মওদূদী চিন্তা ধারার অনুসারী জামায়াতে ইসলামীর ভাইয়েরা তুমুল হৈচৈ আরম্ভ করেছেন। সোসাল মিডিয়ায় নানা রকম চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে মারছেন। সাথে সাথে কিছু কিছু উদারপন্থী “কওমীয়ানরাও তাদের নানা বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দ্বারা সংশয়ের মধ্যে পড়ে গেছেন। তারা বলছেন- “মওদূদীবাদ বলতে আলাদা কিছু নেই। মওদূদী সাহেবের আকিদা বিশ্বাস আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকিদার অনুরূপ।
তিনি হানাফী মাযহাবের অনুসারী”।
এতে তারা জামায়াতের ভাইয়েরা অতীতের মতো নানা মিথ্যাচার ও ছল চাতুরীর আশ্রয় নিচ্ছেন।
তারা জামায়াতে ইসলামী ও মওদূদী সাহেবের বিরোধিতার কারণ, মওদূদী বিরোধিতার ইতিহাস, জামায়াতে ইসলামীর বিরোধিতার অন্তরালে ইত্যাদি নামে যেসব কারণ বা ইতিহাস বর্ণনা করে থাকেন, তা সবই মিথ্যাচার, অপপ্রচার ও ভিত্তিহীন। এগুলোর কোনোটাই মওদূদী বিরোধিতার প্রকৃত কারণ নয়। বরং মওদূদী সাহেবের বিরোধিতার প্রকৃত কারণ হলো- তার চিন্তাধারার ভ্রান্তি ও ভ্রষ্টতা; যেগুলো সম্পর্কে বিভিন্ন ভাষায় অনেক বই-পুস্তক রচনা করা হয়েছে। এগুলোর কোনো কোনোটার জবাব যদিও মওদূদীপন্থীরা দেয়ার চেষ্টা করেছেন এবং খন্ডনে কিছু বই পুস্তক লিখেছেন। কিন্তু এগুলো মোটেও সন্তুষজনক ও গ্রহণযোগ্য নয়। এজন্য আলেম সমাজের কাছে এগুলো গৃহীত হয়নি। যদিও এগুলো দ্বারা নিজের দলের সরলমনা কর্মীদেরকে শান্তনা দেয়া যায়, কিন্তু এগুলো প্রকৃত জবাব নয়।
মওদুদী সাহেবের সাথে উলামায়ে কেরামের বিরোধিতার মূল ও প্রকৃত কারণটা কী ? এবং যেসব কারণে একসময় মওদুদী সাহেবের সঙ্গে থাকা ভারত উপমহাদেশের গণ্যমান্য আলেমগণ তার থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। পরবর্তীতে মওদুদী সাহেবের বিভ্রান্তি নিরসনে বই- পুস্তক লিখেছেন- যথাক্রমে- মাওলানা আবুল হাসান আলী নদবী রাহ. লিখেছেন-
عصر حاضر میں دین کی تشریح و توضیح۔
মাওলানা মঞ্জুর নোমানী রাহ. লিখেছেন-
مولانا مودودی کے ساتھ میری رفاقت کی سرگزشت آور اب میرا موقف,
মাওলানা ওয়াহিদ উদ্দিন খান রাহ. লিখেছেন-
تعبیر کی غلطی.
এমনকি যারা একসময় মওদুদী সাহেবের দলীয় চিন্তাধারাকে সমর্থন করেছেন- কিংবা নীরব থেকেছেন- তারাও পরবর্তীতে তার কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, প্রতিবাদ করেছেন, বই-পুস্তক লিখেছেন। যথাক্রমে- কারী তায়্যিব রাহ. লিখেছেন –
مودودی دستور مقدمہ.
পাকিস্তানের মুফতিয়ে আজম মাওলানা মুফতি মোহাম্মদ শফী ওসমানী রাহ. লিখেছেন-
فتویٰ متعلقہ جماعت اسلامی,
পাকিস্তান আন্দোলনের অগ্রদূত মাওলানা যাফর আহমদ থানবী রাহ. লিখেছেন- براءت عثمان,
বাংলাদেশশের মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী রাহ. লিখেছেন-
“ভুল সংশোধন”।
কেন এবং কি কি কারণে এইসব ওলামায়ে কেরাম মওদুদী সাহেবের বিরোধিতা করলেন? বই- পুস্তক লিখলেন? এবং আজ অবধি পাক-ভারত উপমহাদেশসহ পৃথিবীর হক্কানী ওলামায়ে কেরাম বিরোধিতা করে যাচ্ছেন। আজকের আলোচনায় এই উত্তরটা দেওয়ার চেষ্টা করবো।
উত্তর-
মওদুদী সাহেবের সাথে ওলামায়ে হক্কানীর বিরোধিতার প্রকৃত কারণ হলো- তিনি ইসলাম ধর্মের কতিপয় মৌলিক বিষয় সম্পর্কে মনগড়া এমন কিছু ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন; যা ইসলাম নামক গাছের শিকড়ের (মূল) মাটি খুঁড়ে পানির বদলে পেট্রোল ঢালার মত। যখন থেকে তার প্রবন্ধাবলী ও লিখনিতে তার মনগড়া ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ প্রকাশ পেতে থাকে। তার সঙ্গে থাকা উলামায়ে কেরামগণ তখনই তাকে এইসব থেকে ফিরে আসার আহ্বান করা সত্ত্বেও তিনি ফিরে আসেননি এবং তাদের বিরোধিতার কোন মূল্যায়ন করেননি।
নিচে জামায়াতে ইসলামী ও মওদূদী সাহেবের সাথে আলেম সমাজের বিরোধিতার মূল ও প্রকৃত কতিপয় কারণ উল্লেখ করছি।
০১. اله. رب. دين. عبادت (ইলাহ, রব, দ্বীন, ইবাদত,) শব্দ চতুষ্টয়ের মর্ম বিকৃতি:
পবিত্র কুরআন, হাদীস, ফেকাহ ও ফতোয়ার কিতাবাদীতে বহুল আলোচিত এই চারটি শব্দের আলোচনা করতে গিয়ে মওদূদী সাহেব বলেন-
لیکن بعد کے صدیوں میں رفتہ رفتہ ان سب الفاظ کے وہ اصلی معنی جو نزول قران کے وقت سمجھے جاتے تھے، بدلتے چلے گئے، یہاں تک کہ ھر ایک اپنی پوری وسعتوں سے ہٹ کر نہایت محدود بلکہ مبہم مفہومات کے لیے خاص ہو گیا۔(قرآن کی چار بنیادی اصطلاحیں۔ صفحہ۷)
অর্থাৎ- কিন্তু কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার সময় এই শব্দগুলোর যে মূল অর্থ প্রচলিত ছিল, পরবর্তী শতকে তা পরিবর্তিত হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত একেকটি শব্দ তার ব্যাপকতা হারিয়ে একান্ত সীমিত বরং অস্পষ্ট অর্থের জন্য নির্দিষ্ট হয়ে পড়ে।
(সূত্র – কুরআনের চারটি মৌলিক পরিভাষা, পৃষ্ঠা, ১৪ মাওলানা মওদূদী)
তিনি আরো বলেন-
بس یہ حقیقت ہے کہ محض ان چار بنیادی اصطلاحوں کے مفہوم پر پردہ پڑ جانے کی بدولت قرآن کی تین چوتھائی سے زیادہ تعلیم بلکہ اس کی حقیقی روح نگاہوں سے مستور ہو گئی۔——– نتیجہ یہ ہوا کہ قران کے اصل مدعا ہی سمجھنا لوگوں کے لیے مشکل ہو گیا۔ (قرآن کی چار بنیادی اصطلاحیں۔ صفحہ۔۱۲.۱۳)
অর্থাৎ- এটা সত্য যে কেবল এ চারটি মৌলিক পরিভাষার তাৎপর্যে আবরণ পড়ে যাওয়ার কারণে কুরআনের তিন চতুর্থাংশের চেয়েও বেশি শিক্ষা এবং তার সত্যিকারের স্পিরিটই দৃষ্টি থেকে প্রচ্ছন্ন হয়ে যায়। (সূত্র -কুরআনের চারটি মৌলিক পরিভাষা, পৃষ্ঠা, ১৫.)
সম্মানিত পাঠক মওদুদী সাহেবের উপরোক্ত বক্তব্য উনার নিজস্ব থিওরি থেকে আবিস্কৃত। চৌদ্দশত বছরের মধ্যে আর কোন ইসলামী চিন্তাবিদ এরকম ভয়ংকর, অবাস্তব, উদ্ভট দাবি করেননি। যদি তার এই ভয়ঙ্কর দাবি মেনে নেয়া যায়, তাহলে কি ফল দাঁড়াবে শুনুন।
ক.
পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহর বাণী ও ঘোষণা-
إنا نحن نزلنا الذكر وإنا له لحافظون.
অর্থাৎ ‘কুরআন আমি অবতীর্ণ করেছি এবং এর সংরক্ষণ আমিই করতে থাকবো’। এই ঘোষণার কোনো যথার্থতা থাকবেনা। কারণ কুরআন অবতীর্ণ হওয়াকালীন এই শব্দগুলোর মূল অর্থ যদি পরবর্তী শতকে হারিয়ে যায় এবং কুরআনের অধিক শিক্ষাই যদি অদৃশ্য হয়ে যায় তাইলে পবিত্র কুরআনের এই শব্দাবলি এবং কুরআনের তালিমের প্রকৃত সংরক্ষণ হলো কীভাবে?
অথচ কুরআনের সংরক্ষণ খোদ আল্লাহ তাআলা জিম্মা নিয়েছেন।
খ.
পবিত্র কুরআনের অন্যান্য আসমানি কিতাবের উপর শ্রেষ্ঠত্ব হলো- অন্যান্য আসমানী কিতাব বিকৃত হলেও কুরআনে করিম কেয়ামত তক চিরস্থায়ী, অবিকৃত থাকবে। কিন্তু মওদুদী সাহেবের উপরোক্ত মতামত ও দর্শন অনুযায়ী পরবর্তী শতকে কুরআনের এই চারটি শব্দের অর্থ হারিয়ে অন্যান্য আসমানী কিতাবের উপর শ্রেষ্ঠত্ব হারিয়েছে। ফলে কুরআনুল কারিম অবিকৃত অবস্থায় আছে- এই দাবি
হাস্যকর হয়ে যাবে। নাউজুবিল্লাহ।
০২. ইক্বামাতে দ্বীনের মর্মবিকৃতি:
মওদুদী সাহেব ও তদীয় অনুসারীরা পবিত্র কুরআনের আয়াত أقيمو الدين এর অর্থ উদঘাটনে মনগড়া ব্যাখ্যা করেছেন।
মওদূদী সাহেব বলেন- دین سے مراد حکومت ہے۔ অর্থাৎ- দ্বীন দ্বারা উদ্দেশ্য হলো রাষ্ট্র পরিচালনা। (খুতবাত, মাওলানা মওদূদী)
তিনি আরো বলেন-
دنیا کی کسی زبان میں کوئی ایسا جامع لفظ نہیں، جو اس پورے مفہوم پر حاوی ہو۔ موجودہ زمانے کا لفظ اسٹیٹ کسی حد تک اس کے قریب پہنچ گیا ہے۔ لیکن ابھی اسے”دین” کے پورے معنوی حدود پر حاوی ہونے کے لۓ مزید وسعت درکار ہے ۔ (قران کی چار بنیادی اصطلاحیں۔ صفحہ۔۱۰۱)
অর্থাৎ- দুনিয়ার কোনো ভাষায় এত ব্যাপক শব্দ নেই; যা (دین) এর সম্পূর্ণ অর্থ জ্ঞাপন করতে পারে। আধুনিক কালে “স্টেট” শব্দটি অনেকটা এর কাছাকাছি পৌঁছেছে। কিন্তু দ্বীন শব্দের সম্পূর্ণ অর্থ জ্ঞাপন করার জন্য এখনো এর অনেক স¤প্রসারণ প্রয়োজন। (কুরআনের চারটি মৌলিক পরিভাষা পৃষ্ঠা, ১১৫)
সম্মানিত পাঠক- এই পুস্তকে “একামতে দ্বীনের তাৎপর্য” শিরোনামে أقيمو الدين এর শাব্দিক অর্থ এবং নির্ভরযোগ্য মুফাসসিরীনে কেরামের তাফসীর সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু কোনো মুফাসসিরই এর এই ব্যাখ্যা করেন নি; যা মওদূদী সাহেব চৌদ্দ শত বছর পর করলেন।
০৩. ইক্বামাতে সালাতের মর্ম বিকৃতি:
ইক্বাামাতে সালাতের মর্ম উদঘাটন করতে গিয়ে মওদূদী সাহেব বলেন-
اقامت صلاۃ ایک جامع اصطلاح ہے، اس کے معنی صرف یہی نہیں ہے کہ آدمی پابندی کے ساتھ نماز ادا کرے، بلکہ اس کا مطلب یہ ہے کہ اجتماعی طور پر نماز کا نظام باقاعدہ قائم کیا جائے۔ اگر کسی بستی میں ایک شخص انفرادی طور پر نماز کا پابند ہو، لیکن جماعت کے ساتھ اس فرض کے ادا کرنے کا نظم نہ ہو، تو یہ نہیں کہا جا سکتا کہ وہاں نماز قائم کی جا رہی ہے۔ (تفہیم القرآن، جلد۔۱. سورہ بقرہ، آیت۔۳. حاشیہ، ۵, صفحہ،۵۰)
অর্থাৎ- ইক্বামাতে সালাত এক ব্যাপক পরিভাষা। এর অর্থ এই নয় যে, মানুষ নিয়মিতভাবে নামাজ আদায় করবে, বরং এর মর্ম হলো- সমষ্টিগতভাবে নামাজের নিজাম (রীতি-নীতি) নিয়মিতভাবে প্রতিষ্ঠ করা। কোনো মহল্লায় যদি জামায়াতের সাথে নামাজ আদায় করার ব্যবস্থা না থাকে এমতাবস্থায় কোনো ব্যক্তি একলা নামাজ পড়ার অভ্যস্ত হয়, তাইলে এটা বলা যাবেনা যে, সেখানে নামাজ কায়েম করা হচ্ছে। (তাফহিমুল কুরআন, উর্দূ, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা, ৫০)
এই হলো মওদূদী সাহেবের ইক্বামতে সালাতের মর্ম বিকৃতির নমুনা। কোনো মহল্লায় সম্মলিতভাবে জামায়াতের সাথে আদায়ের নিজাম (রীতি-রীতি) না থাকলে ইক্বামতে সালাত হয় না, একথা সম্পূর্ণ তার মস্তিষ্কপ্রসূত। পূর্ববর্তী মুফাসসিরিনে কেরামের কেউ এমন আজগবি কথা বলেননি, বরং সবার মতে ইক্বামতে সালাতের মানে হলো নামাজ সময় মতো এবং নিয়মিত আদায় করা। যেমন তাফসীরে জালালাইনে আছে-
یقیمون الصلٰوۃ ای یأتون بھا بحقوقھا অর্থ: قائم رکھتے ہیں نمازکو
এবং তাফসীরে বয়ানুল কুরআনে থানভী রাহ. বলেন- قائم رکھنا یہ ہیں کہ اس کو پابندی کے ساتھ اس کے وقت میں پورے شرائط و ارکان کے ساتھ اداکریں۔
এবং শায়খু হিন্দ রাহ. বলেন-
اقامت صلوٰۃ یہ ہے کہ ہمیشہ رعایت حقوق کے ساتھ وقت پر ادا کرتے ہیں۔
০৪. عصمت (ইসমত) নিষ্পাপতাকে নবী-রাসূলদের অবিচ্ছেদ্য গুণ বলে অস্বীকার করা:
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের উলামা মাশায়েখ ও গবেষকদের মতামত ‘ইসমত’ হলো নবী- রাসূলদের এক এক অবিচ্ছেদ্য গুণ; যা তাঁদের থেকে ক্ষণিকের জন্য কখনো বিচ্যুত হয়নি।
অথচ মওদূদী সাহেব বলেন-
یہ لطیف نکتہ ہے کہ اللہ تعالی نے بالارادہ ہر نبی سے کسی نہ کسی وقت اپنی حفاظت اٹھا کر ایک دو لغزشیں سرزد ہو جانے دی ہے، تاکہ لوگ انبیاء کو خدا نہ سمجھ لیں، اور جان لے کہ یہ بشر ہیں، خدا نہیں۔(تفہیمات۔ جلد ۲. صفحہ۔۷۵)
অর্থাৎ- এটা একটা সূক্ষ বিষয় যে, আল্লাহ তায়ালা স্বেচ্ছায় প্রত্যেক নবী থেকে কোনো না কোনো সময় তাঁর হেফাজত উঠিয়ে নির্য়ে এক- দুই লগজিস (ভুল) হতে দিয়েছেন; যাতে মানুষ নবীদেরকে খোদা মনে না করে এবং বিশ্বাস করে যে, তারাও মানুষ খোদা নন। (তাফহিমাত, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা ৭৫.)
সম্মানিত পাঠক- অথচ নবী- রাসূলগণ খোদা নন, বরং মানুষ এটা বুঝার জন্য তাদের মধ্যে মানবিক গুণাবলী যেমন- খাওয়া-দাওয়া, মলমূত্র ত্যাগ করা, নিদ্রা যাওয়া, মানুষের ঘরে জন্ম নেয়া, ছেলে মেয়ের পিতা হওয়া ইত্যাদিই যথেষ্ট। তারা মানুষ; খোদা নন এ কথা বুঝানোর উদ্দেশ্যে কিছু সময়ের জন্য ইসমত উঠিয়ে নেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।
খ্রিষ্টানরা হযরত ঈসা মসীহ ও তাঁর মাতা হযরত মারইয়াম আ. কে খোদা মনে করে, এর খন্ডনে আল্লাহ পাক সূরা মায়েদায় বলেছেন-
ما المسيح إبن مريم إلا رسول. قد خلت من قبله الرسل. وأمه صديقة كانا يأكلان الطعام. أنظر كيف نبين لهم الآيات ثم أنظر أنى يؤفكون. (مائده. ٧٥)
অর্থাৎ- মরিয়ম তনয় মসীহ রাসূল ছাড়া আর কিছু নন, তাঁর পূর্বে অনেক রাসূল অতিক্রান্ত হয়েছেন,আর তাঁর জননী একজন পরম সত্যবাদিনী, তাঁরা উভয়ই খাদ্য আহার করতেন। দেখুন- আমি তাদের জন্য কিরূপ যুক্তি প্রমাণ বর্ণনা করি, আবার দেখুন- তারা উল্টো কোন্ দিকে যাচ্ছে। (সূরা মায়েদা, ৭৫)
এ আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা খ্রিস্টানদের ভ্রান্ত বিশ্বাসের খন্ডনে এ কথা বলেন নি যে, তাঁদের থেকে লগজিস (ভুল) সংঘটিত হয়েছে, বরং বলেছেন, كانا يأكلان الطعام (তাঁরাও মানুষের মতো খাওয়া দাওয়া করে।) তাই এই আয়াতের আলোকে পরিষ্কার হয়ে গেলো যে, নবী- রাসূলদেরকে খোদা মনে না করে মানুষ মনে করার জন্য তাঁদের মধ্যে খাওয়া দাওয়াসহ মানবিক গুণাবলী বিদ্যমান থাকাই যথেষ্ট।
০৫. হযরত ইউনুস আ. নবুওয়াতের দায়িত্ব পালনে ত্রুটি করেছেন বলে মওদূদী সাহেবের ভয়ংকর উক্তি:
তিনি তাফহিমুল কুরআনে লিখেছেন-
قران کے اشارات اور صحیفہ یونس کی تفصیلات پر غور کرنے سے اتنی بات صاف معلوم ہو جاتی ہے کہ “حضرت یونس علیہ السلام سے فریضہ رسالت ادا کرنے میں کچھ کتاہیاں ہو گئی تھی”اور غالبا انہوں نے بے صبر ہو کر قبل از وقت اپنا مستقر چھوڑ دیا تھا اس لیے جب آثار عذاب دیکھ کر آشوریوں نے توبہ و استغفار کی تو اللہ تعالی نے انہیں معاف کر دیا ۔ قرآن میں خدائی دستورکےجو اصول وکلیات بیان کیےگئےہیں ان میں ایک مستقل دفعہ یہ بھی ہے کہ اللہ تعالیٰ کسی قوم کو اس وقت تک تو عذاب نہیں دیتا جب تک اس پر اپنی احجت پوری نہیں کردیتا۔ پس جب نبی اداے رسالت میں کوتاہی کرگیا اور اللہ کے مقرر کردہ وقت سے پہلے خود ہی اپنی جگہ سے ہٹ گیا تو اللہ تعالیٰ کے انصاف نے اس قوم کو عذاب دینا گوارانہ کیا۔(تفہیم القران جلد ۲, صفحات ۳۱۲. طبع۔ ۱۹۶۴عیسوی)
অর্থাৎ- কুরআনের ইঙ্গিত এবং হযরত ইউনূসের গ্রন্থের বিস্তারিত বিশ্লেষণের প্রতি লক্ষ্য করলে বিষয়টি পরিষ্কার জানা যায় যে, ইউনুস আ.’র দ্বারা রিসালাতের দায়িত্ব পালনে যৎসামান্য ত্রুটি হয়ে গিয়েছিল এবং হয়তো তিনি অধৈর্য হয়ে নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই নিজের অবস্থান ছেড়ে দিয়েছিলেন। এজন্য আযাবের লক্ষণাদি দেখেই তার সঙ্গী সাথীগণ তওবা ইস্তেগফার করে দেয়, তখন আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে ক্ষমা করে দেন। কুরআনে আল্লাহ তা’য়ালার যে সব রীতি-মূলনীতির কথা বলা হয়েছে, তাতে একটি নির্দিষ্ট ধারা এও রয়েছে যে, আল্লাহ কোনো জাতি সম্প্রদায়কে ততক্ষণ পর্যন্ত আজাবে লিপ্ত করেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তাদের উপর স্বীয় প্রমাণাদি পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত করে দেন। সুতরাং নবীর দ্বারা যখন রেসালাতের দায়িত্ব পালনে ত্রুটি হয়ে যায় এবং আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সময়ের পূর্বে তিনি নিজেই যখন স্থান ত্যাগ করেন, তখন আল্লাহর ন্যায়নীতি তার সম্প্রদায়কে সেজন্য আজাব দান করতে সম্মতি হয়নি। (তাফহিমুল কুরআন, খন্ড ২, পৃষ্ঠা, ৩১২, মুদ্রন, ১৯৬৪ ঈ.)
সম্মানিত পাঠক- মওদূদী সাহেবের উপরোক্ত বক্তব্যের বিরুদ্ধে ওলামায়ে কেরাম প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠলে তাফহিমুল কুরআনের পরবর্তী মুদ্রণে এ বক্তব্যটি কোনোরকম ভুল স্বীকার না করেই কিছুটা পরিবর্তন করা হয়।
কিন্তু পুনরায় এর সমর্থনেই সূরা সাফফাতের (১৩৯) নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যায় পূর্বের কথাগুলো বহাল রাখা হয়; যাতে পাঠকরা মনে করে যে, তার পরিবর্তিত এই বক্তব্যের উপরও আলেমরা অযথা আপত্তি উত্থাপন করেন।
এসম্পর্কে মুফতী মুহাম্মদ শফী রাহ.’র মা’আরিফুল কুরআনে লেখা হয়েছে-
تفہیم القرآن کے بعد کے ایڈیشنوں میں اس عبارت سے کسی رجوع کے اعلان کے بغیریہاں عبارت میں معمولی تبدیلی کی گئی ہے یعنی” فريضہ رسالت کی ادائیگیٍ میں کوتاہی “کے الفاظ نئی عبارت میں موجود نہیں ہے، لیکن یہ بات اب بھی عبارت میں باقی ہے کہ جب نبی نے اس قوم کی مہلت کے آخری لمحے تک نصیحت کا سلسلہ جاری نہ رکھا اور اللہ کے مقرر کردہ وقت سے پہلے بطور خودہی وہ ہجرت کرگیا تو اللہ تعالیٰ کے انصاف نے اس کی قوم کو عذاب دینا گوارانہ کیا کیونکہ اس پراتمام حجت کی قانونی شرائط پوری نہیں ہوئی تھی، “لھذا تفہیم القرآن” کی عبارت میں تبدیلی کے باوجود “معارف القرآن”کا تبصرہ علی حالہ برقرار ہے۔ (معارف القرآن۔ اردو، حاشیہ نمر۱، جلد ۴، صفحہ ۵۷۰)
অর্থাৎ: (মওদূদী সাহেবের তাফহীমুল কুরআনের প্রথম এডিশনের আপত্তিকর) উপরোক্ত বাক্যসমূহের বিষয়ে তাফহীমুল কুরআনের পরবর্তী মুদ্রনসমূহে কোনো রকম (ভুল স্বীকার করা) প্রত্যাহারের ঘোষণা ব্যতীত সামান্য কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়েছে। অর্থাৎ “ইউনূস আ. রেসালতের দায়িত্ব পালনে ত্রুটি করেছেন” এই বাক্যটি পরবর্তী মুদ্রনের নতুন বাক্যে নেই। কিন্তু একথাটি এখনো বিদ্যমান আছে যে, “যখন ইউনূস আ. তার স্বজাতিকে আল্লাহর পক্ষ থেকে দেয়া নির্ধারিত সময়ের শেষ পর্যন্ত নসিহত অব্যাহত রাখলেন না, বরং নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই তিনি নিজের সিদ্ধান্তেই হিজরত করে ফেললেন, (তার মানে ইউনূস আ. রেসালতের দায়িত্ব পালনে ত্রুটি করেছেন) তখন আল্লাহর ন্যায়ে নীতি তার কওমকে আযাব দিতে সম্মত হলোনা। কেননা এতে স্বীয় প্রমাণাদির নীতিগত শর্তাবলী পরিপূর্ণ হয়নি” (তার মানে ইউনূস আ. রেসালতের দায়িত্ব পালনে ত্রুটি করেছেন, আর তাঁর এই ত্রুটির কারণেই তার কাফের কাওম আল্লাহর আযাব থেকে রেহাই পেলো।) তাই এই কারণে ‘তাফহিমুল কুরআনে’র বাক্যে পরিবর্তন আসার পরও ‘মা’আরিফুল কুরআনে’র বিশ্লেষণ যথাস্থানে বহাল রইলো। (মা’আরিফুল কুরআন, উর্দূ, টিকা নম্বর ০১, খন্ড ০৪, পৃ. ৫৭০)
উল্লেখ্য যে, মুফতি মুহাম্মদ শফী রাহ. তাঁর বিখ্যাত মা’আরেফুল কুরআন (উর্দূ) গ্রন্থের ৪র্থ খন্ডের ৫৭০-৫৭৭ পৃষ্ঠা জুড়ে সূরা ইউনুসের এই আয়াতের তাফসীরে মওদূদী সাহেবের আপত্তিকর বক্তব্যের বিস্তারিত খন্ডন করেছেন। কিন্তু তার অন্ধ ভক্ত অনুসারীরা আজও এটাকে সঠিক বলে মনে করেন। হযরত ইউনুস আ. নবুওয়াতের দায়িত্ব পালনে ত্রুটি করেছেন বলে তারা বিশ্বাস করেন এবং প্রচার করে থাকেন।
সম্মানিত পাঠক- প্রকৃতপক্ষে মওদূদী সাহেবের উলূমে আরাবিয়ার শাস্ত্রবিজ্ঞানে গভীরতার অনুপস্থিতির কারণে তার মেধা ও মননে এইসব ভ্রান্ত চিন্তা- দর্শন জায়গা করে নিয়েছে। আমরা আমাদের এই ক্ষুদ্র পরিসরে মওদূদী সাহেবের ভয়ংকর এই পাঁচটা ভ্রান্ত চিন্তা দর্শনের কথা তুলে ধরলাম।
মূলত এইসবই মওদূদী সাহেবের সাথে আলেম সমাজের বিরোধিতার আসল ও প্রকৃত কারণ; যেকারণে ১৯৪১ সালে মওদূদী সাহেব কর্তৃক জামায়াতে ইসলামী গঠিত হোয়ার পর থেকে আজ অবধি আপামর উলামায়ে কেরাম মওদূদী সাহেব ও জামায়াতে ইসলামীর বিরোধিতা করে যাচ্ছেন এবং তার এইসব ভ্রান্ত চিন্তাধারার খন্ডন করে অগণিত বই পুস্তক লিখেছেন।
জামায়াতীরা মূলত তাদের গুরু মওদূদী সাহেবের জঘন্যতম ভুল ভ্রান্তি, বিভ্রান্তিকর আকিদা বিশ্বাস ও ভয়ংকর চিন্তা- দর্শনের অনুকরণ ও আহবানের মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহকে এক ভয়াবহ ফিতনার দিকে ঠেলে দিতে চাচ্ছেন।
তাই আমরা এখানে তাদের ভয়াবহ বিভ্রান্তি ও উলামায়ে ইসলামের বিরোধিতার মূল ও প্রকৃত কারণ গুলো সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি মাত্র। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সহিহ বুঝার তাওফিক দান করুন আমিন।
সিরিজ- ২
হক্কানী উলামায়ে কিরামের মওদুদীবাদী জামায়াতের সঙ্গে ধর্মীয় বিরোধিতাকে জামায়াতপন্থীদের “রাজনৈতিক বিরোধিতা” আখ্যা দান সংক্রান্ত মিথ্যাচার।
জামায়াত নেতৃবৃন্দ উলামায়ে কিরামের বিরুদ্ধে যেসব মিথ্যাচার করে থাকেন। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশী জঘন্য মিথ্যাচার হল এই যে, তারা উলামায়ে কিরামের মওদূদী বিরোধিতাকে একটি রাজনৈতিক বিরোধের জের আখ্যা দিয়ে থাকেন। উলামায়ে কিরামের এ বিরোধিতাকে বিগত শতাব্দির চল্লিশের দশকে সংঘটিত ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের ‘একজাতিতত্তের ভিত্তিতে অখন্ড ভারত পরিকল্পনা’ বনাম মুসলিম লীগের ‘দ্বিজাতিতত্তের ভিত্তিতে পাকিস্তান দাবি’র সাথে সম্পৃক্ত করে বলে থাকেন যে, ১৯৩৮ সালে হযরত মাওলানা মাদানী রাহ. একজাতিতত্তকে ইসলাম বিরোধী নয় বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করে ‘মুত্তাহিদা কাওমিয়াত আওর ইসলাম’ (একজাতিতত্ত ও ইসলাম) নামে একটি পুস্তিকা লিখেছিলেন। ১৯৩৯ সালে এর খন্ডনে মাওলানা মওদুদী ‘মাসআলায়ে কাওমিয়াত’ (ইসলাম ও জাতীয়তাবাদ) নামক বইটি প্রকাশ করার পর তার বিরোধিতার সূত্রপাত হয়েছে। তাই আলেমসমাজের জামায়াত-বিরোধিতা কোনো ধর্মীয় কারণে নয় বরং তা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক।
যেমন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর তাত্তিক নেতা ও সাবেক নায়েবে আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম তার বিখ্যাত ‘ইক্বামাতে দ্বীন’ নামক বইয়ে লিখেন-
“মাওলানা মাদানী রাহ. এর একজাতিতত্তের বিরুদ্ধে মাওলানা মওদূদীর বইটি প্রকাশিত হবার পর দেওবন্দ থেকে ক্রমাগত মাওলানা মওদূদীর বিরুদ্ধে ফতোয়া বের হতে থাকে। কংগ্রেসকে সমর্থন করা মুসলমানদের কিছুতেই উচিত নয় বলে মাওলানা মওদূদী যত জোরালোভাবে লিখতে থাকলেন ততই ফতোয়ার সংখ্যাও বাড়তে থাকে। এভাবেই মাওলানা মওদূদী কংগ্রেস সমর্থক উলামায়ে কিরামের ফতোয়ার শিকারে পরিণত হলেন”। (ইক্বামাতে দ্বীন-পৃ. ৬৩)
প্রায় অনুরূপ কথা লিখেছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক ভারপ্রাপ্ত আমীর মরহুম ‘আব্বাস আলী খান’ মাওলানা মওদূদীর জীবনীগ্রন্থে। জামায়াতের নায়েবে আমীর মাওলানা আবুল কালাম মুহাম্মদ ইউসুফ ‘জামায়াতে ইসলামীর বিরোধিতার অন্তরালে’ বইয়ে ‘মাওলানা মওদুদীর বিরোধিতার ইতিহাস’ শীর্ষক অনুচ্ছেদ (পৃ. ৮-১০) এ কথারই পুনরাবৃত্তি করেছেন। আর তাদেরই শিখানো বুলি আওড়িয়েছেন ‘সত্যের আলো’ লেখক মাওলানা বশীরুজ্জামান। তিনি তার বইয়ে ‘মাওলানা মওদূদী (রাহ.) এর বিরোধিতার কারণ’ শীর্ষক আলোচনায় লিখেন-
“অতঃপর গান্ধীর,,,,,,, (এক জাতিতত্ত) এর পক্ষে মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী রাহ. ‘মুত্তাহিদা কাওমিয়াত’
(একজাতিতত্ব) নামে একটি বই লিখে কায়েদে আজমের ,,,,,,,,,,, দ্বিজাতিতত্তকে ভুল প্রমাণ করতে চেষ্টা করেন। মাওলানা মওদুদী রাহ. মাসআলায়ে কাওমিয়াত বা ‘জাতীয়তার মাসআলা’ নামে একটি বই লিখে কুরআন ও হাদীসের বলিষ্ঠ যুক্তির মাধ্যমে মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী রাহ. এর মতকে ভুল প্রমাণিত করেন। ফলে মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানীসহ অন্যান্য কংগ্রেসী উলমায়ে কিরাম; যারা ইতোপূর্বে মাওলানা মওদূদী (রাহ.) এর প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন, যারা তাকে মুফাক্কিরে আযম বা শ্রেষ্ঠ ইসলামী চিন্তাবিদ উপাধী দিয়েছিলেন, তারাই মাওলানাকে পুনরায় পথভ্রষ্ট, ইসলামের দুশমন, এমন কি কাফির উপাধিতে (?) ভূষিত করতে লাগলেন।” (সত্যের আলো – পৃ. ১৭১-১৭২)
উত্তর- খন্ডন:
আমরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ও দীপ্ত কন্ঠে ঘোষণা করছি যে, মওদূদীপন্থীদের এ প্রচারণা জঘন্য মিথ্যাচার ও সম্পূর্ণ বানোয়াট। এটা উলামায়ে কিরামের উপর জঘন্য মিথ্যা অপবাদ বৈ কিছু নয়। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, একজাতিতত্তের বিরুদ্ধে মওদূদী সাহেবের বইটি প্রকাশিত হবার পর পরই দেওবন্দ থেকে তার বিরুদ্ধে ক্রমাগত ফতোয়া বের হয়নি। বরং এর বহু বছর পর পর্যন্তও উলামায়ে কিরাম তার অনুকূলে কথা বলেছেন। একজাতিতত্তের বিরুদ্ধে মওদূদী সাহেব তার বইটি রচনা করেন ১৯৩৮ সালে। এর প্রায় তিন বছর পর ১৯৪১ সালের আগষ্টে তিনি যখন জামায়াতে ইসলামী গঠন করেন তখন উলামায়ে কিরাম জনসাধারণকে তাতে অংশগ্রহণ করে কাজ করার অনুমতিও দিয়েছিলেন। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, মাও. মওদূদী ও জামায়াতের ব্যাপারে উলামায়ে কিরামের বিশেষত হযরত মাদানী রাহ.’র দৃষ্টিভঙ্গির মোট তিনটি পর্যায় রয়েছে।
(ক) প্রথম পর্যায়ে তাঁরা জামায়াতকে সত্যিকার ইসলামী আন্দোলন মনে করে এতে যোগদান করার অনুমতি দিয়েছিলেন।
(খ) দ্বিতীয় পর্যায়ে তাঁদেরকে জামায়াতের রচনাবলী পাঠ করে এ সম্পর্কে তাঁদের মতামত জানানোর অনুরোধ করলে তারা এর পক্ষে-বিপক্ষে কোনো প্রকার মতামত ব্যক্ত করা থেকে বিরত থাকেন।
(গ) তৃতীয় পর্যায়ে তাঁরা জামায়াতের রচনাবলী গভীরভাবে অধ্যয়ন করে এর বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করতে বাধ্য হন।
এ তিনটি পর্যায় সম্পর্কীয় পর্যাপ্ত তথ্য স্বয়ং মওদূদী সাহেব ও তার সমর্থকদের রচনাবলীতেই বিদ্যমান রয়েছে। যেসব তথ্য দ্বারা এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, মওদূদীপন্থীদের উপরোক্ত প্রচারণা সম্পূর্ণ মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। নিচে এসব তথ্য ধারাবাহিকভাবে উল্লেখ করা হচ্ছে।
(১)
মওদূদী সাহেবের প্রখ্যাত সাফাই উকিল পাকিস্তানের মুফতি মুহাম্মদ ইঊসুফ সাহেব তার রচিত مولانا مودودی پر اعتراضات کا علمی جائزہ ‘মাওলানা মওদূদী সাহেবের উপর আরোপিত অভিযোগমালার তাত্তিক আলোচনা’ নামক বইয়ের ভূমিকায় ‘জামায়াতে ইসলামীর সাথে আমার পরিচিতি’ শীর্ষক আলোচনায় উল্লেখ করেন, “দারুল উলূম দেওবন্দে শিক্ষাপ্রাপ্ত ও শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী রাহ.’র বিশিষ্ট শাগরিদ মরহুম মাওলানা সাইয়িদ গুল বাদশাহ আমাকে হযরত শায়খুল ইসলাম রাহ.’র স্বহস্তে লিখিত একখানা পত্র দেখালেন। মাওলানা গুল বাদশাহ সাহেব হযরত মাদানী রাহ.কে পত্র মারফত জিজ্ঞাসা করেছিলেন-
“আমি কি জামায়াতে ইসলামীর সংগঠনে অংশ গ্রহণ করে কাজ করতে পারি?” এর জবাবে মাওলানা মাদানী রাহ. তাকে অনুমতি প্রদান করে লিখেন, “আপনি জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করে দ্বীনের খিদমাত করতে পারেন। শরীয়তের দৃষ্টিতে এতে কোন অসুবিধা নেই।” (ইলমী জাইযা, পৃ. ২১)
১৯৪৫ সনের প্রথম দিকে লায়েলপুর জেলার অন্তর্গত রেওয়াজ আবাদের ‘আনজুমানে ইসলাহুল ক্বোরা’ এর পক্ষ থেকে সুপ্রসিদ্ধ আরেক দেওবন্দী কংগ্রেসসমর্থক আলিম হযরত মাওলনা মুফতী কিফায়াতুল্লাহ দেহলভী রাহ.’র খিদমতে মওদূদী সাহেব সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি উত্তরে লিখেন-
“মওদূদী সাহেবের লেখাসমূহ অধিকাংশই সঠিক। তার আন্দোলনে বাহ্যত কোন ভুল বা পথভ্রষ্টতা নেই। শুধু এ কথা ভাববার বিষয় যে, বর্তমান যুগে এ আন্দোলন উপকারী ও ফলপ্রসু হওয়ার ক্ষেত্রসমূহ অনুকূলে আছে কি নেই এবং এ আন্দোলনকারী লোকটি বাস্তববাদী নাকি শুধুই কথার ফুলঝুরি ছড়ান।” (বাংলা রাসায়েল ও মাসায়েল ২য় খন্ড, পৃ. ৪৭৬)
এ সময়েই ‘বারা বাংকী জিলার’ অধিবাসী এক ব্যক্তি তাকে জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি নিম্নোক্ত জবাব প্রদান করেন-
“মাওলানা আবুল আ‘লা মওদূদীর দৃষ্টিভঙ্গি নীতিগতভাবে তো সঠিক, কিন্তু আজকের দিনে বাস্তবধর্মী নয়। যেমন কেউ বললো: শরীয়তের শাস্তিবিধান জারি হওয়া উচিত। একথা নীতিগতভাবে তো ঠিক। কিন্তু এ যুগে চোরের হাত কাটা, ব্যাভিচারীকে পাথর নিক্ষেপে হত্যা করার আদেশ কার্যত অসম্ভব। কারণ অনৈসলামিক শাসনব্যবস্থা এর প্রতিবন্ধক। এতদসত্তেও যদি কেউ তাঁর জামায়াতে শামিল হয়ে সাধ্যানুযায়ী ইসলামী খেদমত আনজাম দেয়, তাহলে সেটা কোন ক্ষতিকর নয়।” (প্রাগুক্ত)
মুফতী ইউসুফ সাহেবের ‘ইলমী জাইযা’ এবং স্বয়ং মওদূদী সাহেবের রাসাইল ও মাসাইল থেকে সংগৃহীত উদ্ধৃতিত্রয় দ্বারা সন্দেহাতীতভাবে কি প্রমাণিত হয় না? ১৯৪৫ সালের প্রথম দিক পর্যন্ত তথা একজাতিতত্তের বিরুদ্ধে মওদূদী সাহেবের বই প্রকাশিত হবার দীর্ঘ সাত বছর পর পর্যন্ত হযরত মাদানী রাহ. ও হযরত মুফতী কিফায়াতুল্লাহ রাহ. তার পক্ষে কথা বলেছেন; এমন কি তার প্রতিষ্ঠিত জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করার অনুমতি কেউ চাইলে তাকে অনুমতিও দিয়েছেন। এই হলো জামায়াত ও মওদূদী সাহেব সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির প্রথম পর্যায়।
(২)
১৯৪৫ সালের শেষ দিকে হযরত মাদানী রাহ. কে ‘জামায়াতে ইসলামীর দাওয়াত’ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি এভাবে জবাব দেন-
“মাওলানা মওদূদীর চিন্তাধারা অনেক লেখাও পত্রপত্রিকা ইত্যাদিতে প্রকাশিত হচ্ছে। এগুলো মনযোগ সহকারে দেখার মতো সময় আমার হাতে নেই। তার লিখিত যেসব প্রবন্ধ আমার নযরে পড়েছে। সেগুলোর বাস্তবায়ন বর্তমান অবস্থায় অসম্ভব। আল্লাহই ভালো জানেন। বর্তমান যুগে এবং পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে ঐ সব বিষয়ের উপর যে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে, তদনুযায়ী আমাদের ওপর শরয়ী হুকুম আরোপ হবে কি হবেনা তা আমি বুঝতে পারছিনা।” (বাংলা রাসায়েল ও মাসায়েল, ২য় খন্ড পৃ. ৪৭৭)
এই সময়ে আরেকজন লোক, যিনি ফিরোজপুর ঝরকার সহকারী তাহসীলদার ছিলেন, তিনি জামায়াতে ইসলামীর সমস্ত বইপত্র হযরত মাদানী রাহ.’র কাছে পাঠিয়ে আবেদন করেন যে, তিনি যেন এ সব প্রকাশনা অধ্যয়ন করে বলে দেন যে, ‘জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের নীতি’ এবং ‘জামায়াতে ইসলামীর দাওয়াত’ এ দু’টির কোনটি সত্য ও সঠিক।
এর জবাবে হযরত মাদানী রাহ. মুজাফ্ফরনগর জেলার হোসাইন আবাদ থেকে (৩০ শে যিলহজ্জ, ১৩৬৪ হি./১৯৪৫ ঈ. তারিখে) লিখেন-
‘মুহতারাম! আমি এতো ব্যস্ত ও অবসরহীন যে, প্রতিদিন চিঠিপত্র দেখা সম্ভব নয়, কিতাব দেখা ও জবাব লেখা তো দূরের কথা! মওদূদী সাহেব অবসর আছেন, যা ইচ্ছা করেন লেখেন, যখন ছাপাতে চান ছাপিয়ে দেন। ‘জামিয়তুল উলামা’ রাজনীতিতে যে পদ্ধতি গ্রহণ করেছে তা সাধ্যানুযায়ী ‘দুটি মুসীবতের মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম মুসীবতটি’র ওপর ভিত্তি করে। বর্তমান পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে যে শক্তি ও সামর্থ বর্তমান আছে, তার উপরই জমিয়তের কর্মতৎপরতা নির্ভরশীল। মওদূদী সাহেব যে দর্শন উপস্থাপন করেছেন, তা দেখা এবং এর উপর সমালোচনা ও পর্যালোচনা করা অথবা এর জবাবে লেখার প্রয়োজনীয়তা আমরা বুঝিনা। আর বুঝলেও অবসর নেই। মওদূদী সাহেব ও তার সমর্থকগণ নিজেদের কর্মসূচী নিয়ে তৎপর হোন। আমরা তাদের মোকাবেলা করবোনা এবং তাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রোপাগান্ডা করবোনা। তার কর্মপদ্ধতি শরীয়তসম্মত এবং ইসলাম ও মুসলমানদের জন্যে উপকারী একথা যদি আমাদের মনে এসে যায়, তাহলে আমরাও তার অনুসারী হয়ে যাবো। অন্যথায় কুরআনের ভাষ্য ‘আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত কোন কাজের ভার দেন না’ অনুযায়ী আমরা অক্ষম হবো।’
স্বয়ং মওদূদী সাহেব রচিত, আব্দুল মান্নান তালিব ও আব্দুল আযীয অনূদিত এবং আধুনিক প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত রাসায়েল ও মাসায়েল প্রথম প্রকাশ থেকে সংগৃহীত হযরত মাদানী রাহ.’র উপরোক্ত উদ্ধৃতিদ্বয় দ্বারা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয় যে, একজাতিতত্তের বিরুদ্ধে মওদূদী সাহেবের বইটি প্রকাশিত হবার দীর্ঘ সাত বছর পরও তথা ১৯৪৫ সালের শেষ নাগাদ পর্যন্ত তিনি মওদূদী সাহেবের বিরুদ্ধে কোন মতামত ব্যক্ত করেননি এবং মওদূদী সাহেবের রচনাবলী পড়ে দেখা ও তার চিন্তাধারা সম্পর্কে তার মতামত জানানোর অনুরোধ করলেও নিজের ব্যস্ততা ও সীমাহীন অবসরহীনতা হেতু তিনি এতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
বস্তুত তখন ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়। তিনি এতে ব্যস্ত থাকার দরুন অন্য কিছু ভাববার কোন অবকাশই তার ছিলোনা। তাই তিনি এ সম্পর্কে কোন প্রকার মন্তব্য করা থেকে অপারগতা প্রকাশ করেছেন বরং বলেছেন, ‘মওদূদী সাহেবের কর্মপদ্ধতি শরীয়তসম্মত এবং ইসলাম ও মুসলমানদের জন্যে উপকারী মনে হলে আমরাও তার অনুসারী হয়ে যাব। এত সতর্কতার পরও যদি বলা হয় যে, “একজাতিতত্তের বিরুদ্ধে মওদুদী সাহেবের বইটি প্রকাশিত হবার পর দেওবন্দ থেকে ক্রমাগত তার বিরুদ্ধে ফতোয়া বের হতে থাকে” অথবা বলা হয়, “উক্ত বইটি লেখার ফলে হযরত মাদানী রাহ. ও অন্যান্য কংগ্রেসী আলেমগণ তাকে পথভ্রষ্ট, বিপথগামী ইত্যাদি ফতোয়া দিতে শুরু করেন” তা হলে এর চেয়ে জঘন্য মিথ্যাচার ও ভিত্তিহীন অপবাদ আর কী হতে পারে?
এই ছিলো জামায়াতে ইসলামী ও মওদূদী সাহেবের ব্যপারে হযরত মাদানীর মনোভাবের দ্বিতীয় পর্যায়।
(৩)
উপমহাদেশের স্বাধীনতা লাভ এবং দেশ বিভাগের ফলে সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা বন্ধ হবার পর যখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে এবং জামায়াতে ইসলামী তার কার্যক্রম পুনরায় শুরু করে। তখন জামায়াতের দাওয়াত ও চিন্তাধারা সম্পর্কে আপামর দ্বীনদার মহলের মনে নানা সন্দেহ সংশয়ের সৃষ্টি হয়। হযরত মাদানী রাহ. ও অন্যান্য নির্ভরযোগ্য উলামায়ে কিরামের কাছে মওদূদী সাহেবের চিন্তাধারা সম্পর্কে তাদের মতামত জানতে চেয়ে চিঠিপত্র আসা অব্যাহত থাকে। এমনকি কোনো কোনো ব্যক্তি মওদূদী সাহেবের নানা আপত্তিকর উক্তি উদ্ধৃত করে জানতে চান যে এ ব্যাপারে করণীয় কী? তখন তিনি মাদানী রাহ. জামায়াতের রচনাবলী পড়ে দেখার তীব্র প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। দেশ স্বাধীন হয়ে যাবার দরুন রাজনীতি থেকে কিছুটা অবসর ছিলেন, তাই মওদূদী সাহেবের রচনাবলী অধ্যয়নে মনোনিবেশ করেন। যতই পড়তে থাকেন, ততই মওদূদী সাহেবের চিন্তাধারার ভ্রান্তি, গোমরাহী ও ভয়াবহতা তাঁর সামনে উদ্ভাসিত হতে থাকে এবং তিনি সন্দেহাতীতভাবে উপলব্ধি করতে সমর্থ হন যে, মওদূদী সাহেবের মতবাদ মুসলমানদের জন্যে ক্ষতিকর এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের পরিপন্থী। তখন তিনি জামায়াতে ইসলামী ও মওদূদী সাহেবের বিরুদ্ধে মনোভাব ব্যক্ত করতে বাধ্য হন।
এটা হলো এ সম্পর্কে তাঁর মনোভাবের তৃতীয় পর্যায়।
তখন ছিল ১৩৬৯ হিজরী মোতাঃ ১৯৫০ সাল, অর্থাৎ একজাতিতত্তের বিরুদ্ধে মওদূদী সাহেবের বইটি প্রকাশিত হবার দীর্ঘ বার বছর পর।
১৯৫০ সালে এবং এর পরে বিভিন্ন সময়ে জামায়াতের বিরুদ্ধে তাঁর অভিমত প্রকাশিত হয়েছে। তবে এগুলোর অধিকাংশই ছিল পত্রাকৃতির। এ ধরণের একটি পত্রের একাংশ যিলহজ্জ, ১৩৬৯ হি./অক্টোবর ১৯৫০ ঈ. তারিখে ‘হযরত মাওলানা মাদানীর হুঁশিয়ারী’ নামে প্রকাশিত হয়েছিল। এর পর্যালোচনা করে মওদূদী সাহেব তার সম্পাদিত মাসিক তরজুমানুল কুরআন, শাবান ১৩৭০ হি. জুন ১৯৫১ ঈ. সংখ্যায় এক দীর্ঘ প্রতিবেদন লিখেন। এর এক পর্যায়ে তিনি বলেন-
“একটি কথা, যা আমাদের জন্যে এ থেকে কিছুমাত্র কম বিস্ময়কর নয়। কথাটি হলো আমাদের ব্যাপারে কতিপয় বুযুর্গের বিগত কয়েক বছরব্যাপী দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। অথচ আমাদের খেয়াল ও ধ্যান-ধারণা বছরের পর বছরব্যাপী আগে যেমন ছিল আজও তেমনই আছে। আমাদের লেখাসমূহ যেগুলোকে কেন্দ্র করে আজ আমরা পথভ্রষ্ট, বিপথগামী এবং বদবখ্ত ও খবীস পর্যন্ত হয়ে গেছি, সেগুলো এ সময় থেকে অনেক আগেই প্রকাশিত হয়। তখন আমরা ঐসব বুযুর্গের দৃষ্টিতে অন্তত পথভ্রষ্ট ও পথভ্রষ্টকারী ছিলামনা। (বাংলা রাসায়েল ও মাসায়েল-২য় খন্ড, পৃ. ৪৭৬)
অতঃপর তিনি মওদূদী সাহেব ইতোপূর্বে উল্লিখিত হযরত মাদানী রাহ. ও মুফতী কিফায়েতুল্লাহ রাহ. অভিমতগুলো উল্লেখ করেন, যেগুলোতে তারা জামায়াতে যোগদানের অনুমতি প্রদান করেছেন অথবা এর বিপক্ষে মন্তব্য করা থেকে বিরত রয়েছেন।
এর পর তিনি লিখেন-
“ঠিক পাঁচ বছর পর, ১৩৬৯ হিজরীর যিলহজ্জ মাসের আজকের দিনে সেই মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী সাহেব আমাদের সম্পর্কে ঐ মত প্রকাশ করেছেন, যা এ প্রবন্ধের সূচনায় উল্লেখ করা হয়েছে। প্রশ্ন হলো মতামতের ক্ষেত্রেও বিপ্লবের এবং চিন্তা-ভাবনার এই পরিবর্তনের কারণ কী? সে সময় থেকে অদ্যাবধি যদি আমাদের পক্ষ থেকে কোনো নতুন গোমরাহী প্রকাশ পেয়ে থাকে, যা থেকে সে সময় পর্যন্ত আমরা দূরে ছিলাম, তাহলে দয়া করে সে গোমরাহী সম্পর্কে আমাদের অবশ্যই অবহিত করবেন। অথবা যদি ঐ হযরতগণ সে সময়ে যে সমস্ত কিতাব পড়ার সময় পাননি, এখন সেগুলো পাঠ করার অবকাশ পেয়ে থাকেন এবং এগুলো অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে পাঠ করার পর আমাদের গোমরাহী সম্পর্কে জ্ঞাত হয়েছেন, তা হলে অন্তত এ কথাটি সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করে দিন। আর যদি ব্যাপার ভিন্নতর হয় বরং এসব ফতওয়া ও লেখালেখির যা বর্তমানে এ কারণে নিক্ষেপণ শুরু হয়েছে যে, জামায়াতে ইসলামীর অগ্রগামী আন্দোলনে তাদের নিজেদের প্রভাবিত ইউনিট থেকে লোকদের বিচ্ছিন্ন হওয়ার আশংকা এ বুযুর্গদের পেরেশান করে ফেলেছে এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদেরকে ঠেকানোই তাদের বর্তমানের সামগ্রিক চিন্তা। বস্তুত এ চিন্তাই সোশ্যালিষ্ট, মুসলিম লীগার, বেরেলভী, কাদিয়ানী, আহলে হাদীস, হাদীস অস্বীকারকারীদেরকে আমাদের বিরোধিতায় উদ্বুদ্ধ করে রেখেছে, তাহলে বেআদবী মাফ করবেন। এ ধরণের চিন্তাভাবনা আহলে হকের জন্য শোভনীয় নয় এবং এরূপ চাতুর্য কী মর্যাদার অবমাননা নয়? (ঐ-পৃ. ৪৭৯)
জামায়াত ও মওদূদী সাহেবের বিপক্ষে হযরত মাদানী রাহ.’র অভিমতের পর্যালোচনা করতে যেয়ে মওদূদী সাহেব যে দীর্ঘ প্রবন্ধ পত্রস্থ করেছেন এবং যা রাসায়েল ও মাসায়েল ২য় খন্ডে সন্নিবেশিত হয়ে আছে, এত্থেকে উপরে উল্লিখিত দু’টি উদ্ধৃতাংশ থেকে যে কয়েকটি কথা বুঝা গেল তা হলো এই-
০১. হযরত মাদানী রাহ.’র একজাতিতত্তের বিরুদ্ধে মওদূদী সাহেবের বইটি প্রকাশিত হবার দীর্ঘদিন পর পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে দেওবন্দ থেকে ফতোয়া বের হয়নি, বরং বের হয়েছে এর বহুকাল পর তথা এক যুগ পর যিলহজ্জ ১৩৬৯ হি./ ১৯৫০ ঈ. তারিখে।
০২. হযরত মাদানী রাহ. ও দেওবন্দের কংগ্রেসী আলিমরাই তার প্রথম বিরোধিতাকারী নন, বরং তাঁদের আগেও তার বিরোধিতা করেছেন অনেকেই। যাদের মধ্যে কায়েদে আজমের ‘দ্বিজাতিতত্তের পতাকাবাহী মুসলিম লীগাররা অন্যতম এবং ফিরকায়ে আহলে হাদীসও তার বিরোধিতা থেকে পিছিয়ে নেই।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, মওদূদীপন্থীরা কংগ্রেসী আলেমদেরকে মওদূদী সাহেবের প্রথম বিরোধিতাকারী বরং একমাত্র বিরোধিতাকারী বলে বুঝানোর অপচেষ্টা করেন।
০৩. মওদূদী সাহেবের মতে, হযরত মাদানী রাহ. প্রমুখ কর্তৃক তার বিরোধিতার কারণ এই যে, জামায়াতে ইসলামী অগ্রগামী আন্দোলনে তাদের প্রভাব বলয় থেকে লোকজন বিচ্ছিন্ন হবার আশংকায় তারা পেরেশান হয়ে গেছেন এবং লোকদেরকে ঠেকানোই তাদের সামগ্রিক চিন্তা । তাই এ বিরোধিতা।
লক্ষ্য করুন, মওদূদী সাহেব উলামায়ে কিরাম কর্তৃক তার বিরোধিতার কারণ কী আখ্যা দিচ্ছেন, যদিও তা তার বদগোমানী বৈ কিছুই নয়; কিন্তু আমাদের বাংলাদেশের জামায়াত-নেতৃবৃন্দ ও সমর্থকদের মত হযরত মাদানী রাহ.’র একজাতিতত্তের বিরোধিতাকে এর কারণ নির্ণয় করেছেননা।
তাই তো প্রথমেই বলেছি, জামায়াত নেতৃবৃন্দ ও সাফাই উকিলদের এ প্রচারণা মিথ্যা প্রমাণ করার জন্যে আমাদের বুযুর্গদের রচনাবলীর আশ্রয় নিতে হবেনা, বরং তাদের আদর্শিক গুরু স্বয়ং মওদূদী সাহেব ও তার ভক্তদের রচনাবলীতেই তাদের মিথ্যাচারের প্রমাণাদি বিদ্যমান রয়েছে, যা উপরে সবিস্তারে উল্লেখ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, হযরত মাদানী রাহ. বিভিন্ন সময়ে প্রশ্নকারীদের জবাবে যে সব অভিমত ব্যক্ত করেছেন তা ছোট ছোট পুস্তক আকারে ভিন্ন ভিন্ন নামে প্রকাশিত হয়েছে, এগুলো আজও পাওয়া যায়। যেমন ‘ঈমান ও আমল’, ‘দাড়ী কা ফলসফা’ ও ‘মওদূদী দস্তুর আওর আকাইদ কি হাকীকত’।
শেষোক্ত বইখানার উপর দারুল উলূম দেওবন্দের তৎকালীন মহাপরিচালক হাকীমুল ইসলাম ক্বারী মুহাম্মদ তায়্যিব রাহ. একটি সারগর্ভ ও তথ্যসমৃদ্ধ ভূমিকা রচনা করেছেন। সম্প্রতি উক্ত ভূমিকা ও মূল পুস্তিকাখানা বাংলায় অনূদিত হয়ে “জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্র ও আকীদার স্বরূপ” নামে প্রকাশিত হয়েছে।
তবে এ সম্পর্কে তাঁর সংক্ষিপ্ত অথচ সর্বাধিক তথ্যপূর্ণ হচ্ছে ঐ পত্রখানা; যা তিনি ১৯৫১ সালে তৎকালীন ভারতীয় জামায়াতে ইসলামীর আমীর মাওলানা আবুল লাইস ইসলাহীর পত্রের জবাবে লিখেছিলেন। এ পত্রখানায় তিনি জামায়াতের গোমরাহী ও ভ্রান্তিগুলো চিহ্নিত করেছেন। তার উক্ত জবাবী পত্রখানা ‘মাকতূবে হিদায়াত’ নামে প্রকাশ লাভ করে।
হযরত মাদানী রাহ. ছাড়াও আরো বহু উলামায়ে কিরাম ১৯৫০ এবং এর পরবর্তী সময়ে প্রশ্নকারীদের জবাব দেয়ার প্রয়োজনে মওদূদী সাহেবের রচনাবলী অধ্যয়নে মনোনিবেশ করেন এবং তার চিন্তাধারার ভ্রান্তি অনুধাবন করে তার বিরুদ্ধে অভিমত ব্যক্ত করেন। তন্মধ্যে অবিভক্ত ভারতের প্রধান মুফতী মাওলানা কিফায়াতুল্লাহ রাহ., দারুল ঊলূম দেওবন্দের শায়খুল আদব মাওলানা ই’যায আলী রাহ., দারুল ঊলূম দেওবন্দের মুফতী মাওলানা মাহদী হাসান রাহ., মাওলানা ফখরুল হাসান রাহ. এবং মাযাহিরুল ঊলূম সাহারানপুর মাদ্রাসার মাওলানা মুফতী সঈদ আহমদ রাহ. সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
তন্মধ্য থেকে মুফতী মাহদী হাসান সাহেবের অভিমতটি ‘আয়েনায়ে তাহরীকে মাওদূদীয়্যত’ বা ‘মওদূদী আন্দোলনের দর্পন’ এবং মুফতী সঈদ আহমদ সাহেবের অভিমতটি ‘কাশফে হাক্বীক্বত’ বা ‘সত্য উদঘাটন’ নামে প্রকাশিত হয়। ঐ সময় সাহারানপুর মাদ্রাসার জনৈক উস্তাদ মওদূদী সাহেবের চিন্তাধারায় আকৃষ্ট হয়ে গিয়েছিলেন, তাকে এই চিন্তাধারার ভ্রান্তি ও ভয়াবহতা বুঝানোর লক্ষ্যে উক্ত মাদ্রাসার শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা যাকারিয়া রাহ. তার নামে একখানা দীর্ঘ পত্র লিখেছিলেন। এই মূল্যবান পত্রখানা দীর্ঘদিন পর্যন্ত অপ্রকাশিত থেকে লিপিবদ্ধ হবার পঁচিশ বছর পর ১৯৭৫ সালে ‘ফিতনায়ে মওদূদিয়্যত’ নামে প্রকাশিত হয়েছে।
তাছাড়াও মওদূদী সাহেবের ভ্রান্তি সম্পর্কে জনসাধারণকে সতর্ক করে দৈনিক আল-জমিয়ত ৩রা আগষ্ট, ১৯৫১ ঈ. সংখ্যায় উপমহাদেশের শীর্ষস্থানীয় সর্বদলীয় উলামায়ে কিরামের এক যুক্তবিবৃতি প্রকাশিত হয়। বিবৃতিটি ছিল নিম্নরূপ:
“মওদূদী সাহেব ও তার জামায়াতের বই পুস্তকের দ্বারা জনসাধারণের উপর যে প্রভাব বিস্তার হয়, এর ফলে জনসাধারণ হিদায়াতের ইমামদের অনুসরণ থেকে বিরত ও সম্পর্কহীন হয়ে পড়ে। আর এটা জনসাধারণের জন্যে অত্যন্ত মারাত্মক ও গোমরাহীর কারণ। দ্বীনের সংগে সঠিক সম্পর্ক রক্ষা করার জন্যে সাহাবায়ে কিরাম ও বুযুর্গানে দ্বীনের সাথে যে ধরণের ভক্তির সম্পর্ক থাকা আবশ্যক, তাতে ভাটা পড়ে। তদুপরি মওদূদী সাহেবের ভুল গবেষণার প্রভাবে জনসাধারণ প্রভাবান্বিত হয়ে পড়ে। ফলে এক নতুন ধর্ম বরং দ্বীনের নতুন রং সৃষ্টি হতে চলেছে। আমরা মনে করি এ অবস্থা মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত মারাত্মক। এ দলের সাথে আমাদের সম্পর্কহীনতার কথা স্পষ্ট ঘোষণা করছি।”
এতে উপমহাদেশের নিম্নোক্ত শ্রেষ্ঠ মনীষীগণ স্বাক্ষর করেন-
১. মুফতিয়ে আযম হযরত মাওলানা কিফায়াতুল্লাহ রাহ.।
২. শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা সায়্যিদ হোসাইন আহমদ মাদানী রাহ.।
৩. হাকীমুল ইসলাম হযরত মাওলানা ক্বারী মুহাম্মদ তায়্যিব রাহ. মহাপরিচালক, দারুল ঊলূম, দেওবন্দ।
৪. হযরত মাওলানা আব্দুল লতীফ রাহ., মহাপরিচালক, মাযাহিরুল ঊলূম সাহারানপুর মাদরাসা।
৫. শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা যাকারিয়া রাহ.।
৬. হযরত মাওলানা আহমদ সঈদ দেহলভী রাহ.।
৭. হযরত মাওলানা সঈদ আহমদ রাহ., মুফতী, সাহারানপুর মাযাহিরুল ঊলূম মাদরাসা।
৮. শায়খুল আদব হযরত মাওলানা ই’যায আলী রাহ., দারুল ঊলূম দেওবন্দ।
৯. হযরত মাওলানা হাবীবুর রহমান লুধিয়ানবী রাহ.।
১০. হযরত মাওলানা সাইয়িদ মুহাম্মদ মিয়া রাহ.।
দারুল ঊলূম দেওবন্দের মুখপত্র মাসিক ‘দারুল উলুম’ যিলকদ ১৩৭০ হি./১৯৫১ ঈ. সংখ্যায়ও এ বিবৃতিটি প্রকাশিত হয়েছিলো।
লক্ষণীয়, উক্ত বিবৃতিতে শুধু কংগ্রেস সমর্থক উলামায়ে কিরামই স্বাক্ষর করেননি। বরং মুসলিম লীগসমর্থক উলামায়ে কিরামের মধ্য থেকে হযরত থানভী রাহ.’র বিশিষ্ট খলীফা হাকীমুল ইসলাম হযরত মাওলানা ক্বারী মুহাম্মদ তায়্যিব রাহ.ও এতে স্বাক্ষর করেন। এছাড়াও এতে স্বাক্ষর করেন রাজনীতির অঙ্গন থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থানকারী শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা যাকারিয়া রাহ. প্রমুখ।
এদ্বারা প্রমাণিত হয় যে, সকল শ্রেণীর উলামায়ে কিরামই মওদূদী সাহেবের চিন্তাধারাকে ভ্রান্ত মনে করেন। সুতরাং শুধু কংগ্রেস সমর্থক উলামায়ে কিরামকে মওদূদী বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করা ভাঁওতাবাজী ও সত্যের অপলাপ বৈ কী হতে পারে!
এই হলো উলামায়ে কিরাম কর্তৃক মওদূদী সাহেব ও জামায়াতে ইসলামীর বিরোধিতার প্রকৃত ইতিহাস। অবিকৃত ইতিহাস। নির্ঘাত সত্য ও সঠিক ইতিহাস। এ ইতিহাসে নেই মিথ্যার কোনো ছোঁয়া। নেই কোনো কপটতার সংমিশ্রণ।
পক্ষান্তরে জামায়াতপন্থীরা এর যে ইতিহাস বয়ান করে থাকেন, তা আগাগোড়া সম্পূর্ণ মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও বানোয়াট। যে আদর্শিক গুরুর স্বপক্ষে তারা এ মিথ্যাচার করছেন, তারই রেখে যাওয়া অন্যতম জ্ঞানসম্ভার রাসায়েল ও মাসায়েল এ বিদ্যমান তথ্যাবলীর আলোকেই তাদের মিথ্যাচার প্রমাণিত।
এই সত্য সঠিক ইতিহাস দ্বারা সুপ্রমাণিত হয় যে, হযরত মাদানী রাহ.’র একজাতিতত্তের বিরুদ্ধে ১৯৩৯ সালে মওদূদী সাহেবের বইটি প্রকাশিত হবার পর দেওবন্দ থেকে তার বিরুদ্ধে ক্রমাগত ফতোয়া বের হয়নি। বরং তার বিরুদ্ধে ফতোয়া বের হয়েছে এর এক যুগ পর ১৯৫০/৫১ সালে এবং এর পরবর্তী সালগুলোতে। তখন একজাতিত্ব বনাম দ্বিজাতিত্ব সংঘাত বিরাজমান ছিলনা। বরং এর তিন চার বছর আগে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির মাধ্যমে এ বিতর্কের অবসান হয়ে গিয়েছিলো। এ সময় মওদূদী সাহেব একজাতিতত্তের বিরুদ্ধে জোরালোভাবে লিখতে থাকেননি বা লিখার প্রয়োজনও ছিলোনা। সুতরাং এ কারণে তার বিরুদ্ধে ফতোয়ার সংখ্যা বাড়তে থাকার কোনো প্রশ্নই আসেনা।
বরং তার বিরুদ্ধে মূলত ফতোয়া দেয়া হয়েছে তার রচনাবলী ও চিন্তাধারার ভ্রান্তির কারণে এবং ভ্রান্তি যত জোরালো হয়েছে, তার বিরুদ্ধে ফতোয়ার সংখ্যাও তত বৃদ্ধি পেয়েছে।
অতএব দ্বিপ্রহর সূর্যের ন্যায় আলোকিত হয়ে গেল যে, জামায়াত-নেতৃত্বের এ প্রচারণা-
“মাওলানা মাদানী রাহ.’র একজাতিতত্তের বিরুদ্ধে মাওলানা মওদূদীর বইটি প্রকাশিত হবার পর দেওবন্দ থেকে তার বিরুদ্ধে ক্রমাগত ফতোয়া বের হতে থাকে। কংগ্রেসকে সমর্থন করা মুসলমানদের কিছুতেই উচিত নয় বলে মাওলানা যত জোরালো ভাবে লিখতে থাকলেন ততই ফতোয়ার সংখ্যা বাড়তে থাকে”- (ইক্বামতে দ্বীন, অধ্যাপক গোলাম আযম, পৃ. ৬৩, প্রকাশকাল- ১৯৮১) এ দাবিটা সম্পূর্ণ মিথ্যা, কল্পিত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এটা আলেমদের উপর জঘন্য মিথ্যা অপবাদ। উলামায়ে কিরামকে হেয় প্রতিপন্ন করা, তাদের প্রতি ঘৃণা জন্মানো, তাদের অপ্রতিরোধ্য প্রভাব প্রতিপত্তিকে খর্ব করা, সর্বোপরি নিজেদের দলের সত্যান্বেষী ও নিষ্ঠাবান কর্মীরা যেন তাদের জামায়াত বিরোধী তৎপরতায় প্রভাবান্বিত না হয় এবং এদিকে কর্ণপাত না করে, সেই হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার মানসেই জামায়াত-নেতারা সম্মিলিত ও সুপরিকল্পিতভাবে এ মিথ্যা প্রচারণার অপকৌশল গ্রহণ করেছেন।
একজাতিতত্ত বনাম দ্বিজাতিতত্ত সংঘাত শেষ হয়ে যাবার দীর্ঘ কয়েক যুগ পর ইতিহাসের এই নাজুক ও স্পর্শকাতর বিষয়টি বার বার আওড়িয়ে তারা দলীয় ফায়েদা লুটারই অপচেষ্টা করছেন এবং মিথ্যা ধুম্রজাল সৃষ্টি করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের ফন্দি আঁটছেন। কিন্তু তাদের জানা দরকার যে, মিথ্যার বেসাতি দিয়ে কখনো সত্যকে চাপিয়ে রাখা যায়না। সকল অপপ্রচার ও মিথ্যাচারের বেড়াজাল ছিন্ন করে এবং সকল অসত্য ও ভাঁওতাবাজীর যবনিকাপাত করে সত্য বেরিয়ে আসেই। এটাই আমোঘ বিধান, আবধারিত নিয়ম।
তথাকথিত ‘ইক্বামাতে দ্বীন’ ও ‘আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা’র অজুহাতে তাদের জন্য আলিম সমাজের বিরুদ্ধে অপপ্রচার এবং তাদের উপর এ জঘন্য অপবাদ দেয়া কি জামায়াত-নেতাদের জন্য জায়েয ও নেকীর কাজ হয়ে গেল? মিথ্যাচার ও জঘন্য মিথ্যা অপবাদ-আরোপই যে ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম হাতিয়ার খোদা পাকই ভাল জানেন, এ আন্দোলনের পরিণতি যে কত ভয়াবহ ও কদর্য হবে। নাউযুবিল্লাহি মিনহু।
আল্লাহ আমাদেরকে এ থেকে রক্ষা করুন। পরিশেষে জামায়াত-নেতৃবৃন্দ ও সাফাই-উকিলদের উদ্দেশ্যে ক্বোরআনে পাকের নিম্মোক্ত আয়াতটি আবৃতি করতে চাই।
سبحٰنک ھذا بھتٰن عظیم۔ یعظکم اللہ ان تعودوا لمثلہ أبدا إن کنتم مؤمنین۔
“আল্লাহতো পবিত্র, মহান! এটা তো গুরুতর অপবাদ। আল্লাহ তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছেন, তোমরা যদি ঈমানদার হও, তবে কখনো পুনরায় এ ধরণের আচরণের পুনরাবৃত্তি করো না।”
(সূরা আন্-নূর ১৬-১৭)
তাদের মিথ্যাচারের আরেক প্রমাণ:
এখানে আরেকটি বিষয় সবিশেষ প্রণিধানযোগ্য, যদ্বারা তাদের এ প্রচারণা অলীক ও উদ্ভট বলে আরো প্রকটভাবে ধরা পড়ে। তাহলো এই যে, হযরত মাদানী রাহ.’র ‘মুত্তাহিদা কাওমিয়াত আওর ইসলাম’ পুস্তিকাটির আসল প্রতিপক্ষ মওদূদী সাহেব ছিলেননা, ছিলেন ডক্টর ইকবাল ও মুসলিমলীগ-নেতৃবৃন্দ।
হযরত মাদানী রাহ.’র একটি বক্তৃতাকে কেন্দ্র করে ডক্টর সাহেব যে ব্যঙ্গাত্মক কবিতা ও প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন, এরই জবাবে এই পুস্তিকাখানা রচিত হয়েছে। এ জন্যেই তো পুস্তিকাখানার বিভিন্ন স্থানে ডক্টর সাহেবের বক্তব্য উদ্ধৃত করে সেটার জবাব দিতে দেখা যায়।
একজাতিতত্তের বিরোধিতাই যদি মওদূদী বিরোধী ফতোয়ার কারণ হয়ে থাকতো তাহলে ডক্টর ইকবাল ও মুসলিমলীগ-নেতৃবৃন্দ বরং আল্লামা শাব্বির আহমদ উসমানী রাহ.সহ স্বয়ং দেওবন্দী আলিমদের একাংশই সর্বপ্রথম ফতোয়ার শিকারে পরিণত হতেন।
কারণ, তারা তো ‘একজাতিতত্ত’ ও ‘অখন্ড ভারত পরিকল্পনা’ উভয় ব্যাপারেই হযরত মাদানী রাহ. ও অন্যান্য আলেমদের বিরোধী ছিলেন।
পক্ষান্তরে মওদূদী সাহেব একজাতিতত্তের ব্যাপারে তাদের বিরোধী হলেও তিনি মুসলিম লীগের দ্বিজাতিতত্তের সমর্থক ছিলেননা এবং পাকিস্তান দাবীর ব্যাপারে সোচ্চারও ছিলেন না; বরং তিনি লীগ-নেতৃবৃন্দের সমলোচনায়ই তৎপর ছিলেন।
তাই রাজনৈতিক মতবিরোধই যদি ফতোয়ার কারণ হয়ে থাকত, তাহলে মওদূদী সাহেবের বিরুদ্ধে নয় বরং প্রধান প্রতিপক্ষ ডক্টর ইকবাল, লীগ-নেতৃবৃন্দ এবং লীগ-সমর্থক আলিমদের বিরুদ্ধেই ফতোয়া প্রয়োগ করা হতো। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, তাদের না হয়ে হলো নাকি শুধু মওদূদী সাহেবের বিরুদ্ধে! কী অযৌক্তিক ও কান্ডজ্ঞনহীন অভিযোগ! হাস্যকর ও মিথ্যা অপবাদ! তাদের এ মিথ্যাচার হিটলারের মুখপাত্র গোয়েবলসের মিথ্যাচারকেও হার মানায়। মনে হয় উলামায়ে কিরামের প্রতিরোধের মুখে দিশেহারা ও হিতাহিত জ্ঞানশূণ্য হয়ে গিয়ে তারা এ ধরনের প্রলাপ বকতে শুরু করেছেন।
তাই বলি-
সুধীজন, ভাব কিছুক্ষণ।
এমন মিথ্যাচার আর নয়,
এই কর পণ।
মুখলিসুর রাহমান রাজাগঞ্জী সিলেট। ২৫-০২-২৪
————————————
তাহকিক ও সম্পাদনা –
হাফিজ আল্লামা মাহমুদ হোসাইন সিলেটি, সাবেক শায়খুল হাদীস জামেয়া মাদানিয়া আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর ও বর্তমান শায়খুল হাদীস জামেয়া ইসলামিয়া বার্মিংহাম ইউকে।
Leave a Reply