প্রশ্ন: সাহাবায়ে কিরামের পরিচিতি ও মর্যাদা বর্ণনা কর।
উত্তর: সাহাবায়ে কিরামের পরিচিতি। সাহাবী শব্দের অর্থ সঙ্গী, সাথী।
পরিভাষায় :-
هو من لقى النبي صلى الله عليه وسلم مؤمنابه ومات على الايمان
যারা ঈমানের অবস্থায় নবী করীম (সাঃ) এর সাক্ষাৎ লাভ করেছেন এবং এ অবস্থায়ই মৃত্যু বরণ করেছেন তাদেরকেই সাহাবী বলা হয়।
সাহাবীদের সংখ্যা লক্ষাধিক। নবী-রাসূলগণের পরেই তাঁদের মর্যাদা। কুরআন ও হাদীসে তাদের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে। তারা আল্লাহ তা’আলার মনোনীত জামা’আত। আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-
ثم اورثنا الكتب الذين اصطفينا من عبادنا
-“তারপর আমি কিতাবের অধিকারী করলাম আমার বান্দাদের মধ্যে তাদেরকে যাদেরকে আমি মনোনীত করলাম। (সূরা ফাতির : ৩২)।
এক হাদীসে আছে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেন, আল্লাহ তা’আলা নবী রাসূলগণের পর সমস্ত বিশ্বভূমন্ডলে আমার সাহাবীগণকে মনোনীত করেছেন। (মুম্দে বাযযার)।
কুরআনের আলোকে সাহাবায়ে কিরামের মর্যাদা
সাহাবায়ে কিরামের মাদ্রাসা বায়তুল্লাহ্ সিলেবাস কিতাবুল্লাহ, পরীক্ষক আল্লাহ এবং উস্তাদ হলেন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সাঃ)। তিনি তা’লীম ও তরবিয়ত, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, ইসলাহ্ ও সংশোধনের মাধ্যমে তাদেরকে যোগ্য করে গড়ে তোলে ছিলেন। স্বয়ং আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন তাদের সত্যবাদিতা, নির্ভরযোগ্যতা, আন্তরিকতা ও লিল্লাহিয়্যাতের প্রশংসা করেছেন। এমন কি আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর রিসালত ও নবুওয়তের সাক্ষী রূপে সমস্ত পৃথিবীর সামনে তুলে ধরেছেন। ইরশাদ হয়েছে,
محمد رسول الله والذين معه اشداء على الكفر رحماء بينهم تراهم ركعا سجدا يبتغون فضلا من الله ورضوانا سيماهم في وجوههم من أثرالسجود
“মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল তাঁর সহচরগন কাফিরদের প্রতি কঠোর এবং নিজেদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল। আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনায় তুমি তাদেরকে রুকু ও সিজদায় অবনত দেখবে। তাদের মুখমুন্ডলে সিজদার চিহ্ন থাকবে” (৪৮ সূরা ফাতহঃ ২৯ নং আয়াত)।
ইমাম কুরতুবী সহ সকল মুফাস্সির والذين معه অংশটিকে عام বা ব্যাপক অর্থ বোধক বলে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। এতে প্রমাণিত হয় যে, সমস্ত সাহাবাই এ আয়াতের মর্মার্থের অন্তর্ভুক্ত।
আল্লাহ তা’আলা আল কুরআনে সাহাবায়ে কিরামের ঈমান আকীদাকে সত্য ও ঈমানের মাপকাঠি বলে ঘোষণা করেছেন এবং তাদেরকে যারা মাপকাঠি রূপে গ্রহণ করবে না তাদের নির্বোধ ও অজ্ঞ বলে আখ্যায়িত করেছেন। ইরশাদ হয়েছে,
واذا قيل لهم امنوا كما امن الناس قالوا انؤمن كما امن السفهاء الا انهم هم السفهاء ولكن لا يعلمون
“যখন তাদেরকে বলা হয়, যে সকল লোক ঈমান এনেছে তোমরা ও তাদের মত ঈমান আনয়ন কর, তখন তারা বলে নির্বোধগন যে রূপ ঈমান এনেছে আমরা ও কি সে রূপ ঈমান আনব?” (সূরা বাকারা: ১৩)।
এ আয়াতে الناس শব্দের الف ولام অক্ষরটি হল عهد خارجی এর দ্বারা সাহাবায়ে কিরামকে বুঝানো হয়েছে। এতে এ কথা প্রতিভাত হচ্ছে যে, সাহাবায়ে কিরামের ঈমান ঈমানের মাপকাঠি। সুতরাং অন্যান্য ক্ষেত্রে ও তারা মাপকাঠি হতে পারবেন।
সাহাবায়ে কিরামের অনুসৃত পথ সঠিক ও নির্ভুল পথ। এ কারণেই তাদের বিরোধিতা করাকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর বিরোধিতার নামান্তর বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে এবং এ জাতীয় লোকদেরকে কঠিন শাস্তির ভয় দেখানো হয়েছে। আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,
ومن يشاقق الرسول من بعد ما تبين له الهدى ويتبع غير سبيل المؤمنين نوله ما تولى ونصله جهنم وساءت مصيرا
“কারো নিকট সৎ পথ প্রকাশ হওয়ার পর সে যদি রাসূলের বিরুদ্ধাচারণ করে এবং মুমিনদের পথ ব্যতীত অন্য পথ অনুসরণ করে তবে যে দিকে সে ফিরে যায় সে দিকেই তাকে ফিরিয়ে দিব এবং জাহান্নামে তাকে দগ্ধ করব, আর তা কত মন্দ আবাস।” (৪ সূরা নিসাঃ ১১৫ নং আয়াত)।
এ আয়াতটিতে মুমিন বলতে সাহাবায়ে কিরাম এর দিকেই ইংগিত করা হয়েছে। কেননা তারাই মুমিনদের সর্বপ্রথম এবং সর্বশ্রেষ্ঠ জামা’আত। এর দ্বারা আরো স্পষ্ট হয়ে যায় যে, সাহাবায়ে কিরামের জীবন, তাদের আমল-আখলাক, চরিত্র ও কার্যধারার মধ্যেই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সঠিক অনুসরণ সীমাবদ্ধ। আর সাহাবায়ে কিরামের জীবন ও চরিত্রকে সত্যের মাপকাঠি রূপে স্বীকার করে নিলে-ই তা সম্ভব হতে পারে। আল কুরআনে আল্লাহ্ নিজে তাদের ঈমানের এবং পাপা চার থেকে তাদের বেঁচে থাকার আগ্রহের সাক্ষ্য দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে,
ولكن الله حبب اليكم الايمان وزينه في قلوبكم وكره اليكم الكفر والفسوق والعصيان اولئك هم الراشدون فضلا من الله ونعمة والله عليم حکیم
“কিন্তু আল্লাহ্ তোমাদের নিকট ঈমানকে প্রিয় করেছেন এবং একে তোমাদের হৃদয় গ্রাহী করেছেন, আর কুফ্রী, পাপাচার ও অবাধ্যতাকে করেছেন তোমাদের নিকট অপ্রিয়। তারাই সৎ পথ অবলম্বনকারী।” (৪৯ সূরা হুজুরাত : ৭ নং আয়াত)।
আল কুরআনের বহু আয়াতে সাহাবায়ে কিরাম সম্বন্ধে আল্লাহ তা’আলা এ কথা দ্ব্যর্থহীন ভাবে ঘোষণা করেছেন যে, আল্লাহ্ তাদের উপর সন্তুষ্ট এবং তারা ও আল্লাহর উপর সন্তুষ্ট। ইরশাদ হয়েছে, رضى الله عنهم ورضوا عنه আল্লাহ তাদের প্রতি প্রসন্ন এবং তারা ও তার প্রতি সন্তুষ্ট। (৮৯ সূরা বায়্যিনা : ৮ নং আয়াত)।
ইবনে আবদুল বার (রঃ) বলেন,
من رضى الله عنهم لم يسخط عليه ابدا ان شاء الله
আল্লাহ্ যাদের প্রতি একবার সন্তুষ্ট হয়েছেন ইন্শাআল্লাহ্ তাদের প্রতি তিনি কখনো অসন্তুষ্ট হবেন না। কেননা আল্লাহ্ তা’আলা সাহাবায়ে কিরামের বাহ্যিক আমল ও বর্তমান অবস্থার প্রতি লক্ষ্য করেই “আমি তাদের উপর সন্তুষ্ট” এ খোশখবরী ঘোষণা করেছেন, তা হতে পারে না। বরং তিনি তাদের ভিতর ও বাহির, বর্তমান ও ভবিষ্যত সব কিছু সামনে রেখেই এ ঘোষণা দিয়েছেন। আল্লাহর এ ঘোষণা মূলতঃ এ কথারই যামানত যে, মৃত্যু পর্যন্ত আল্লাহর সন্তুষ্টির বাইরে কোন কাজ তাদের থেকে হবেনা এবং শুভ অবস্থার উপরই তাদের শেষ খাতিমা হবে। এ কারণেই رضى الله عنه শব্দটি তাদের নামের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে আজ পর্যন্ত উচ্চারিত হয়ে আসছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত হতে থাকবে।
উল্লেখ্য যে, যাদের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্টির ঘোষণা দিয়েছেন তাদের প্রতি আমাদের ও সন্তুষ্টি থাকা একান্ত কর্তব্য। পক্ষান্তরে যাদের অন্তরে তাদের প্রতি অসন্তুষ্টি বা ক্ষোভ রয়েছে তাদের সম্বন্ধে আল্লামা ইবন কাসীর (রঃ) বলেন,
فاين هؤلاء
يا ويل من ابغضهم اوسبهم اوسب بعضهم
من الايمان بالقران اليسبون من رضى الله عنهم
ধ্বংস! চরম ধ্বংস সেই নরাধমদের জন্য যারা সকল সাহাবায়ে কিরামের প্রতি অথবা তাদের কোন একজনের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে কিংবা তাদেরকে মন্দ বলে। আল্লাহ যাদের প্রতি সন্তুষ্ট তাদের যারা মন্দ বলে কোথায় থাকলো তাদের কুরআনের উপর ঈমান?
এ ছাড়া ও আরো বহু আয়াতে সাহাবায়ে কিরামের ফযীলত ও মর্যাদা সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে।
হাদীসের আলোকে সাহাবায়ে কিরামের মর্যাদা:
অসংখ্য হাদীসে সাহাবায়ে কিরামের মর্যাদার কথা বিবৃত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,
ان الله عز وجل اختارني و اختارلی اصحابی فجعل لى منهم وزراء واختانا واصهارا فمن سبهم فعليه لعنة الله والملكة والناس اجمعين ولا يقبل الله منه يوم القيامة صرفا ولا عدلا –
“রিসালতের জন্য আল্লাহ্ আমাকে নির্বাচন করেছেন এবং আমার সাহ চর্যের জন্য আমার সাহাবাদেরকে নির্বাচন করেছেন, তাদের মধ্যে কতিপয়কে আমার উজীর, কতিপয়কে আমার জামাতা ও শশুর নির্বাচন করেছেন। যারা তাদেরকে মন্দ বলবে তাদের উপর আল্লাহ্, ফিরিশতা ও মানব কুলের অভিশাপ নেমে আসবে। তাদের ফরয-নফল কোন আমলই কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা’আলা কবুল করবেন না।” (আন্জামি’লি আহকামিল কুরআন: ৮ম খন্ড)।
হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবন মাসউদ (রাঃ) সাহাবায়ে কিরামের মর্যাদার কথা উল্লেখ পূর্বক বলেন,
من كان مستنا فليستن بمن قدمات فان الحى لا تؤمن عليه الفتنة اولئك اصحب محمد صلى الله عليه وسلم كانوا افضل هذه الامة و ابرها قلوبا واعمقها علما واقلها تكلفا اختارهم الله لصحبة نبيه ولاقامة دينه فاعرفوا لهم فضلهم واتبعوهم على اثرهم وتمسكوا بما استطعتم من اخلاقهم وسير هم فانهم كانوا على الهدى المستقيم
কেউ যদি কারো আদর্শ অনুসরণ করতে চায় তাহলে তাঁর জন্য উচিত যারা ইন্তিকাল করেছেন (সাহাবী) তাদের আদর্শের অনুসরণ করা।
কেননা জীবিত ব্যক্তি ফিতনার সম্ভাবনা মুক্ত নয়। আর তারা হলেন মুহাম্মদ (সাঃ) কেননা জীবিত ব্যক্তি ফিনার সম্ভাবনা মুক্ত নয়। আর তারা হলেন মুহাম্মদ (সাঃ) এর সাহাবী। হৃদয়ের পবিত্রতায়, ইল্মের গভীরতায় এবং আড়ম্বর হীনতায় তারা ছিলেন এই উম্মতের শ্রেষ্ঠতম জামা’আত। আল্লাহ তাদেরকে আপন নবীর সংগ লাভ এবং দীন প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে মনোনীত করেছেন। সুতরাং তোমরা তাদের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নাও, তাদের পথ- পন্থা অনুসরণ কর এবং তাদের আখলাক ও আদর্শ দৃঢ় ভাবে ধারণ করা! কেননা তারা ছিলেন সরল ও সঠিক পথের পথিক। (মিশকাত শরীফ ১ম খন্ড)।
উম্মতের শ্রেষ্ঠতম কোন ব্যক্তির বড় থেকে বড় কোন নেক আমল ও সর্বনিম্ন সাহাবীর ছোট হতে ছোট কোন আমলের বরাবর হতে পারে না। সুতরাং তাদের সমালোচনায় জবান দরাজী করার অধিকার করো নেই। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,
لا تسبوا اصحابي فان احدكم لو انفق مثل احد ذهبا ما بلغ مدا من احدهم ولا نصيفه
তোমরা আমার সাহাবাদের মন্দ বলোনা। কেননা আল্লাহর পথে তোমাদের কারো অহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ দান করাও কোন সাহাবীর এক মুদ বা তার অর্ধেকের সমতুল্য হবে না। (বুখারী ও মুসলিম শরীফ)।
হাদীসে বর্ণিত لا تسبوا শব্দটির অর্থ সাধারণত: “গালি দিওনা” করা হয়। এটা ভুল অনুবাদ। কেননা আমাদের ভাষায় গালি শব্দটি অকথ্য কথনের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। অথচ আরবী ভাষায় কষ্ট দায়ক ও অবমাননাকার যে কোন কথাকেই سب বলা হয়। আর গালির সমার্থক শব্দ হল, لشتم। এ কারণেই হাদীসের তরজমায় আমরা মন্দ বলোনা লেখেছি। সাহাবীকে ভালবাসার অর্থ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে ভাল বাসা। তাদের সম্বন্ধে সামান্যতম জবান দরাজীও মারাত্মক ধৃষ্ঠতা ও ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।
তিনি ইরশাদ করেন,
الله الله في اصحابي لا تتخذوهم عرضا من بعدى فمن احبهم فيحبى احبهم ومن ابغضهم فيغضى ابغضهم ومن أذاهم فقد أذاني ومن أذاني فقد اذى الله ومن اذى الله فيوشك ان ياخذه
আল্লাহকে ভয় কর। আমার সাহাবীদের ব্যাপারে তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। আমার পর তোমরা তাদেরকে আক্রমণ ও সমালোচনার লক্ষ স্থল কেননা জীবিত ব্যক্তি ফিতনার সম্ভাবনা মুক্ত নয়। আর তারা হলেন মুহাম্মদ (সাঃ) কেননা জীবিত ব্যক্তি ফিনার সম্ভাবনা মুক্ত নয়। আর তারা হলেন মুহাম্মদ (সাঃ) এর সাহাবী। হৃদয়ের পবিত্রতায়, ইল্মের গভীরতায় এবং আড়ম্বর হীনতায় তারা ছিলেন এই উম্মতের শ্রেষ্ঠতম জামা’আত। আল্লাহ তাদেরকে আপন নবীর সংগ লাভ এবং দীন প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে মনোনীত করেছেন। সুতরাং তোমরা তাদের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নাও, তাদের পথ- পন্থা অনুসরণ কর এবং তাদের আখলাক ও আদর্শ দৃঢ় ভাবে ধারণ করা! কেননা তারা ছিলেন সরল ও সঠিক পথের পথিক। (মিশকাত শরীফ ১ম খন্ড)।
উম্মতের শ্রেষ্ঠতম কোন ব্যক্তির বড় থেকে বড় কোন নেক আমল ও সর্বনিম্ন সাহাবীর ছোট হতে ছোট কোন আমলের বরাবর হতে পারে না। সুতরাং তাদের সমালোচনায় জবান দরাজী করার অধিকার করো নেই। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,
لا تسبوا اصحابي فان احدكم لو انفق مثل احد ذهبا ما بلغ مدا من احدهم ولا نصيفه
তোমরা আমার সাহাবাদের মন্দ বলোনা। কেননা আল্লাহর পথে তোমাদের কারো অহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ দান করাও কোন সাহাবীর এক মুদ বা তার অর্ধেকের সমতুল্য হবে না। (বুখারী ও মুসলিম শরীফ)।
হাদীসে বর্ণিত لا تسبوا শব্দটির অর্থ সাধারণত: “গালি দিওনা” করা হয়। এটা ভুল অনুবাদ। কেননা আমাদের ভাষায় গালি শব্দটি অকথ্য কথনের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। অথচ আরবী ভাষায় কষ্ট দায়ক ও অবমাননাকার যে কোন কথাকেই سب বলা হয়। আর গালির সমার্থক শব্দ হল, لشتم। এ কারণেই হাদীসের তরজমায় আমরা মন্দ বলোনা লেখেছি। সাহাবীকে ভালবাসার অর্থ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে ভাল বাসা। তাদের সম্বন্ধে সামান্যতম জবান দরাজীও মারাত্মক ধৃষ্ঠতা ও ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।
তিনি ইরশাদ করেন,
الله الله في اصحابي لا تتخذوهم عرضا من بعدى فمن احبهم فيحبى احبهم ومن ابغضهم فيغضى ابغضهم ومن أذاهم فقد أذاني ومن أذاني فقد اذى الله ومن اذى الله فيوشك ان ياخذه
আল্লাহকে ভয় কর। আমার সাহাবীদের ব্যাপারে তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। আমার পর তোমরা তাদেরকে আক্রমণ ও সমালোচনার লক্ষ স্থল বানিও না। তাদের প্রতি ভালবাসা আমারই প্রতি ভালবাসার প্রমাণ এবং তাদের প্রতি বিদ্বেষ আমারই প্রতি বিদ্বেষের প্রমাণ। তাদেরকে যে কষ্ট দিল। সে আমাকেই কষ্ট দিল। আর যে আমাকে কষ্ট দিল সে আল্লাহকেই কষ্ট দিল। আর যে আল্লাহকে কষ্ট দিল অতি সত্বর তিনি তাকে পাকড়া ও করবেন। (তিরমিযী শরীফ)।
যারা সাহাবীদের দোষ খুজে বেড়ায় এবং তাদের সমালোচনা করে তারা মালউন-অভিশপ্ত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেন,
ادار أيتم الذين يسبون اصحابي فقو لوا لعنة الله على شركم
যদি কাউকে আমার সাহাবীদের মন্দ বলতে দেখ তবে বলে দিও তোমাদের মধ্যে যারা (সাহাবাদের বদনামকারী) নিকৃষ্টতর তাদের প্রতি আল্লাহর অভিশাপ। (মিশকাত শরীফ)।
সাহাবাদের সমালোচনা হতে থাকলে এবং তাদেরকে গাল-মন্দ করলে এর জওয়াব দেওয়া এবং নিজের ইলমকে প্রকাশ করা ওয়াজিব। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেন-
اذا احدث في امتى البدع وشتم اصحابي فليظهر العالم علمه فمن لم يفعل فعليه لعنة الله والملئكة والناس اجمعين
যখন আমার উম্মতের মধ্যে বিদ’আতের উদ্ভব ঘটবে এবং যখন লোকেরা আমার সাহাবীদের মন্দ বলতে আরম্ভ করবে তখন আলিমের জন্য উচিত হবে নিজের ইলমকে প্রকাশ করে দেওয়া। যদি সে তা না করে তবে তার প্রতি আল্লাহ্ ফিরিশতা এবং সমস্ত মানুষের লা’নত। (আল্ ই’তিসাম)।
উপরোক্ত আয়াত এবং হাদীসের মধ্যে সাহাবায়ে কিরামের প্রশংসা, ফযীলত এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাত প্রাপ্তির সুসংবাদের পাশাপাশি উম্মতকে তাদের অনুসৃত পথে চলার জোর তাকীদ প্রদান করা হয়েছে। সেই সাথে হুশিয়ার করে দেওয়া হয়েছে কোন সাহাবীর সমালোচনা করার কঠিন পরিণতি সম্পর্কে ও। সর্বোপরি সাহাবায়ে কিরামের প্রতি ভালবাসাকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর ভালবাসার এবং তাদের প্রতি বিদ্বেষকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর প্রতি বিদ্বেষের পরিচায়ক বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
মণীষীদের দৃষ্টিতে সাহাবায়ে কিরামের মর্যাদা
কুরআন-সুন্নাহর আলোকে সাহাবায়ে কিরামের নির্ধারিত এই মর্যাদা সম্পর্কে সর্ব যুগের উম্মতে মুহাম্মদী ঐকমত্য পোষণ করে এসেছে।
শ্রেষ্ঠতম তাবিঈ’ হযরত উমর ইবন আব্দুল আযীয (রঃ) সাহাবায়ে কিরামের মর্যাদা সম্পর্কে ব্যাখ্যা করে বলেন, সাহাবায়ে কিরামের অনুসৃত পথ গ্রহণ করাই তোমাদের জন্য কর্তব্য। কেননা তারা জ্ঞান ও ইলমের ভিত্তিতে কোন কিছু থেকে বিরত রয়েছে এবং সুতীক্ষ্ম অন্তদৃষ্টির কারণেই কাউকে কোন কাজে বাধাদান করেছেন, জটিল ও সুক্ষ্ম বিষয়ের সমাধানে তারা ছিলেন সক্ষম এবং দীনের ক্ষেত্রে তারাই হলেন শ্রেষ্ঠত্বের অধিক হকদার। দীনের পথে তারাই হলেন অগ্রবর্তী এবং সকল ক্ষেত্রে রয়েছে তাদের পর্যাপ্ত দিক নির্দেশনা। তাদের দেওয়া ব্যবস্থা পত্র থেকেই সকল ব্যধির উপশম লাভ সম্ভব। সুতরাং তাদের অনুসৃত পথ ও পন্থায় সংযোজন বা বিয়োজন কোনটাই সম্ভব নয়। একদল তাতে সংযোজন করতে গিয়ে বাড়াবাড়িতে লিপ্ত হয়েছে। আরেক দল বিয়োজন করতে গিয়ে মূল উদ্দেশ্য থেকে দূরে সরে পড়েছে। বস্তুত: সাহাবায়ে কিরাম ছিলেন উভয় প্রান্তি কতার মধ্যবর্তী সহজ-সরল পথের অনুসারী। (আবু দাউদ শরীফ)।
আল্লামা ইব্ন সালাহ (রঃ) “উলূমুল হাদীস গ্রন্থে” লিখেছেন, সাহাবায়ে কিরামের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য এই যে, তাদের কারোই আদালত ও ন্যায় পরায়নতা সম্পর্কে তথ্য অনুসন্ধানের কোন অবকাশ নেই। কেননা তা কুরআন, সুন্নাহ ও উম্মতের ইজমার দ্বারা সুপ্রমাণিত। আল্লাহ তা’য়ালা তাদের সম্বন্ধে ইরশাদ করেছেন, “তোমরা মানুষের কল্যাণের উদ্দেশ্যে প্রেরিত শ্রেষ্ঠ উম্মত” আল্লামা ইবন আব্দুল বার (রঃ) “আল ইসতি ‘আব’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, সাহাবায়ে কিরাম হলেন, সর্বযুগের শ্রেষ্ঠ এবং মানব জাতির জন্য প্রেরিত সর্বোত্তম উম্মত। আল্লাহ ও রাসূলের বিভিন্ন প্রশংসাবাণী দ্বারা তাদের আদালত ও ন্যায় পরায়ণতা সুপ্রমাণিত। সর্বোপরি নবী করীম (সাঃ) এর সাহচর্য ও সাহায্যের জন্য নির্বাচিত যারা তাদের তুলনায় অধিক ন্যায়পরায়ণ কে আর হতে পারে? কারো ন্যায় পরায়ণতা ও নির্ভর যোগ্যতার স্বপক্ষে এর চেয়ে বড় সনদ আর কি হতে পারে?
ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রঃ) ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল (রঃ) থেকে উদ্ধৃত করেন যে, তাদের মন্দ আলোচনা করা, দোষারোপ করা, বা খুত খুজে বের করা কারো জন্যই বৈধ নয়। বরং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। হযরত মায়মূনী (রঃ) বলেন, ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল (রঃ) কে আমি আক্ষেপ করে বলতে শুনেছি যে, মানুষের কি হল যে, তারা হযরত মু’আবিয়া (রাঃ) এর সমালোচনায় মেতে উঠেছে। এ ভয়াবহ বিপদ থেকে আল্লাহ্ আমাদের নিরাপদ রাখুন। (বর্ণনাকারী বলেন) তারপর তিনি আমাকে বললেন, হে আবু হাসান! কাউকে যদি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) -এর সাহাবাদের সমালোচনা করতে দেখ তবে তার ঈমানকে সন্দেহের চোখে দেখবে।
আল্লামা সুয়ূতী (রঃ) বলেন, সাহাবায়ে কিরাম সমালোচনার উর্ধে। তাদের আদালত ও ন্যায়পরায়ণতা প্রশ্নাতীত। এ বিশ্বাসের কারণ এই যে, রাসূল ও তাঁর উম্মতের মধ্যে সাহাবায়ে কিরামই হলেন একমাত্র যোগসূত্র। দ্বীন ও শরী’আতের তারাই হলেন প্রথম ধারক ও বাহক। তাদের আদালত ও ন্যায় পরায়ণতা প্রশ্নের সম্মুখীন হলে দীন ও শরী’আতের অস্তিত্ব ও প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে পড়বে।
• আল্লামা কামাল ইব্ন হুমাম (রঃ) “আল মুসায়িরা” গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, আহলুস্ সুন্নাহ ওয়াল জামা’আতের আকীদা মতে সকল সাহাবার সাধুতা ও ন্যায় পরায়ণতায় বিশ্বাস করা, তাদের সমালোচনা সর্বোতভাবে পরিহার করা এবং আল্লাহ্ ও রাসূলের অনুরূপ তাদের প্রশংসা করা অবশ্য কর্তব্য।
আল্লামা সাফারিনী (রঃ)-এর প্রণীত আকীদা গ্রন্থে আহলুস্ সুন্নাহ ওয়াল জামা’আতের সর্ব সম্মত সিদ্ধান্ত এই যে, সকল সাহাবাকে পাপ ও দোষ মুক্ত মনে করা, তাদের আদালত ও ন্যায়পরায়ণতা স্বীকার করা এবং আন্তরিক ভাবে তাদের প্রশংসা করা সকল মুসলমানের কর্তব্য। কেননা আল কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা তাদের প্রশংসা করেছেন। সর্বোপরি যদি তাদের শানে আল্লাহ ও রাসূলের কোন প্রশংসা বাণী উচ্চারিত নাও হত তবুও তাদের হিজরত, নুসরত, জিহাদ ও আল্লাহর পথে জান-মাল এবং পিতা ও পুত্রদের কুরবাণী, তাদের ঈমানী শক্তি ইত্যাদি গুণাবলীর কারণে উম্মতের শ্রেষ্ঠতম জামা’আত বলে বিশ্বাস রাখা অপরিহার্য হত। সর্বজন মান্য ইমামদের সর্ব সম্মত সিদ্ধান্তের আলোকে এটাই হল উম্মতের সর্বজনীন আকীদা ও বিশ্বাস। ইমাম মুসলিম (রঃ)-এর বিশিষ্ট উস্তাদ ইমাম আবুযুর আ (রঃ) বলেন, কাউকে যদি তুমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর কোন সাহাবীর অবমাননা করতে দেখ তাহলে মনে করবে যে, লোকটি যিন্দীক (ধর্মহীন)। কেননা কুরআন সত্য, রাসূল সত্য এবং তার আনীত শিক্ষা ও আদর্শ সত্য। এগুলো সাহাবায়ে কিরামের মাধ্যমেই আমাদের নিকট পৌছেছে। (তাই তারা ও সত্য, আদিল, ন্যায় পরায়ণ)। তাদের চরিত্রে কলংকলেপন করা কুরআন-সুন্নাহকে মুছে ফেলার অপচেষ্টা ছাড়া কিছু নয়।
আকায়িদ শাস্ত্রের সুপ্রসিদ্ধ কিতাব “আল আকায়িদুল নাসাফিয়্যাতে” ইমাম নাসাফী (রঃ) লিখেছেন যে, মুসলিম উম্মাহর আকীদা এই যে, সাহাবায়ে কিরাম সম্বন্ধে শুধু উত্তম আলোচনা করা উচিত। ইমাম আবু হানীফা (রঃ) শরহে ফিকহে আকবর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, আমরা সাহাবায়ে কিরামের গুণচর্চা ব্যতিরেকে কখনো দোষচর্চা করবনা। ইমাম তাহাভী (রঃ) “আকীদাতুত তাহাভী গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, যারা সাহাবায়ে কিরামের প্রতি শত্রুতা পোষণ করে অথবা তাদের কুৎসা রটায় আমরাও তাদেরকে শত্রু বলে মনে করি। আমরা কেবল সাহাবায়ে কিরামের গুণচর্চা করি, দোষচর্চা করি না। ইমাম মালিক (রঃ) বলেন, সাহাবীগণকে যারা হেয় প্রতিপন্ন করতে চায়-তাদের আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে রাসূল (সাঃ) কে হেয় প্রতিপন্ন করা। কিন্তু প্রকাশ্য ভাবে এতটুকু ধৃষ্ঠতার সাহস না থাকায় তারা সাহাবীগণকে আক্রমণের লক্ষ্যরূপে নিরুপন করে নিয়েছে। যাতে মানুষ বুঝে যে, স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সাঃ)ই মন্দ লোক ছিলেন। (মা’আযাল্লাহ) কারণ তিনি যদি ভাল লোক হতেন তাহলে তার সঙ্গ প্রাপ্ত এই লোকগুলো ভাল হত। ফলেই তো বৃক্ষের পরিচয়। (আস্সারিমুল মালূল)।
সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে যে যুদ্ধ বিগ্রহ সংঘটিত হয়েছে এ সম্বন্ধে মুসলিম উম্মাহর সার্বজনীন সিদ্ধান্ত এই যে, তাদের এ সব কর্মকান্ড ইজতিহাদের ভিত্তিতে সংগটিত হয়েছে। তবে এ কথা অবশ্যই সত্য যে, হযরত আলী (রাঃ) ও তাঁর অনুসারীদের ইতিহাদ ছিল সঠিক আর যারা তাদের বিপক্ষে ছিলেন তাদের ইজতিহাদ সঠিক ছিলনা। আর এ কথা সর্বজন স্বীকৃত যে, শরী’আতের দৃষ্টিতে ভুল ইজতিহাদ কোন অপরাধ নয়। বরং সঠিক সিদ্ধান্ত লাভের শুভ উদ্দেশ্যে নির্ধারিত মূলনীতি অনুসারে ইজতিহাদ প্রয়োগের পর ও ভুল সিদ্ধান্তের শিকার হলে এতে ও একগুণ সাওয়াব পাওয়া যাবে। আর সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারলে এতে দ্বিগুণ সওয়াব হবে। এ কারণেই ইমাম ও বড় বড় আলিমগণ সাহাবায়ে কিরামের বিরোধ সম্বন্ধে এমন সব মন্তব্য করা হতে বিরত থেকেছেন-যার দ্বারা তাদের সম্মান ও মান ক্ষুন্ন হয়। সাহাবায়ে কিরামের পারস্পরিক বিবাদের ফলে যে রক্ত প্রবাহিত হয়েছিল সে সম্পর্কে জনৈক শ্রদ্ধেয় আলিমের মতামত চাওয়া হলে তিনি শুধু এ আয়াতটি পড়ে শোনালেন,
تلك امة قدخلت لها ما كسبت ولكم ما كسبتم ولا تسئلون عما كانوا يعملون
“সে উম্মত অতিক্রান্ত হয়ে গিয়েছে, তারা যা অর্জন করেছে তা তাদের আর তোমরা যা অর্জন কর তা তোমাদের। তারা যা করত সে সম্বন্ধে তোমাদেরকে কোন প্রশ্ন করা হবে না”। (২ সূরা বাকারা: ১৩ নং আয়াত)। এর তাৎপর্য এই যে, ব্যাপারে মন্তব্য করা হতে বিরত থাকা কর্তব্য।
একই প্রশ্নের জওয়াবে অপর এক আলিম বলেছেন, তাদের রক্তে আল্লাহ তা’আলা আমাদের হাত রঞ্জিত করেন নি। সুতরাং আমার জিহবাকে সে রক্তে আর রঞ্জিত করতে চাই না। এ সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জওয়াবে হযরত হাসান বসরী (রঃ) বলেন, এ সব যুদ্ধে সাহাবীগণ উপস্থিত ছিলেন এবং আমরা ছিলাম অনুপস্থিত। তারা সম্পূর্ণ অবস্থা জানতেন কিন্তু আমরা জানিনা। সুতরাং যে বিষয়ে সাহাবাগণ একমত আমরা তা অনুসরণ করব। আর যে বিষয়ে তারা দ্বিধাবিভক্ত আমরা তাতে নিরবতা অবলম্বন করব।
হযরত মুহাসিবী (রঃ) বলেন, তারা সবাই ইজতিহাদের মাধ্যমে যা ভাল মনে করেছেন, তাই করেছেন। এতে তারা সর্বদাই আল্লাহ্ তা’আলার সন্তুষ্টি কামনা করেছিলেন। আমাদের তরফ হতে নতুন কোন পথ আবিষ্কার করা অনুচিত। ধর্মীয় ব্যাপারে তারা সকলেই ছিলেন সন্দেহ ও সংশয়ের উর্ধ্বে। পরবর্তী ইতিহাস গুলোতে নানা বিকৃতিপূর্ণ ও অতিরঞ্জিত তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে। ইমাম শাফিঈ (রঃ) সহ বহু বরেণ্য আলিম বলেছেন যে, এ রক্ত দ্বারা আল্লাহ তা’আলা আমাদের হাত রঞ্জিত করেননি। সুতরাং এ সম্বন্ধে কথা বলে আমরা আমাদের জিহবাকে রঞ্জিত করতে চাইনা।
মুদ্দাকথা হচ্ছে সাহাবায়ে কিরামের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা এবং তাদের প্রতি কটূক্তি হতে বিরত থাকা ওয়াজিব। এমনি ভাবে পরবর্তী কালে তাদের মধ্যে যে যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে তা সম্বন্ধে জবান সংযত রাখা ও আবশ্যক। পক্ষান্তরে যারা সাহাবায়ে কিরামের কুৎসা রটনা করবে, তাদের সমালোচনা করবে এবং তাদের দোষ গেয়ে গেয়ে বেড়াবে তারা যিন্দীক, বদদীন ও ধর্ম ত্যাগী। তাদের কথা ও সংশ্রব থেকে বেচে থাকা আবশ্যক (ইসলামী আকীদা)।
প্রশ্ন: সাহাবীগণ মি’য়ারে হক’ ছিলেন-কুরআন হাদীসের আলোকে প্রমাণ কর।
উত্তর: সাহাবীগণ মি’য়ারে’ হক বা সত্যের মাপকাঠি ছিলেন। কুরআনের আলোক প্রমাণ (১) সূরায়ে ফাতেহায় আল্লাহপাক মানব জাতিকে দ্বীনের আদর্শ বা সত্যের মাপকাঠি সাহাবীদের পথ প্রদর্শনের দোয়া শিক্ষা দিয়ে ইরশাদ করেন,
اهدنا الصراط المستقيم – صراطا الذين انعمت عليهم غير المغضوب عليهم ولا الضالين
অর্থাৎ হে আল্লাহ আপনি আমাদেরকে সরল পথ প্রদর্শন করেন ঐ সব লোকের পথ যাদেরকে আপনি পুরষ্কার দান করেছেন, এদের পথ নয় যাদের উপর আপনি (গজব বর্ষণ করেছেন) অসন্তুষ্ট, এবং এদের পথ ও নয় যারা পথ ভ্রষ্ট হয়ে গেছে। উপরোক্ত আয়াত সমূহে আল্লাহ পাক ছিরাতে মুসতাকিমের ব্যাখ্যা (ছিরাতুল্লাহ) আল্লাহর পথ (ছিরাতুল রাসূল) রাসূলের পথ। ছিরাতুল কুরআন কুরআনের পথ প্রভৃতি দ্বারা করেন নাই। বরং তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন আল্লাহর পুরষ্কার প্রাপ্ত বান্দাদের পথদ্বারা, আর পবিত্র কুরআনের সুরায়ে নিসায় আপন পুরষ্কার প্রাপ্ত বান্দাদের পরিচয় দিয়ে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেনঃ
اولئك الذين انعم الله عليهم من النبيين والصديقين والشهداء والصالحين
অর্থাৎ এসব লোক যাদেরকে আল্লাহপাক পুরষ্কার প্রদান করেছেন, তারা হলেন নবীগণ, ছিদ্দীকগণ, শহীদগণ এবং নেককার, পূণ্যবানগণ। অতএব পরিষ্কার ভাবে বুঝা গেল যে উক্ত চার প্রকার বান্দাদের পথই হল সিরাতুল মুসতাকিম। আর সাহাবায়ে কিরাম হলেন শেষোক্ত তিন প্রকার লোকদের অন্যতম, যেমন হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) ও মা আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) প্রমুখ হলেন সিদ্দীকদের অন্তর্ভূক্ত। আর যে সব সাহাবী নানা ভাবে শাহাদৎ বরণ করেছেন তারা হলেন শহীদ গণের অন্তর্ভূক্ত এবং অবশিষ্ট সকল সাহাবীগণ হলেন সালিহীনদের অন্তরভূক্ত, তাই পরিষ্কার হয়ে গেল যে সমস্ত সাহাবায়ে কিরাম খোদার পুরষ্কার প্রাপ্ত। যেমন আল্লাহপাক ইরশাদ করেছেনঃ
وكلا وعد الله الحسنى আল্লাহ পাক বিশ্ব নবী (সাঃ) এর সমস্ত সাহাবীদেরকে বেহেস্তের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। (সূরা আল হাদিদ) সুতরাং সাহাবায়ে কিরাম হলেন বিশ্ব মানবের জন্য আদর্শ বা সত্যের মাপকাটি এবং তাদের মতামত ও প্রদর্শিত পথই হল সিরাতে মুসতাকিম বা সত্য পথ।
২য় প্রমাণ : সমস্ত সাহাবায়ে কিরাম মিয়ারে হক বা সত্যের মাপকাটি ইরশাদ হচ্ছে واذا قيل لهم أمنوا كما أمن الناس আর যখন তাদেরকে বলা হয় তোমরা ঈমান আন যে ভাবে লোকেরা ঈমান এনেছে। (সূরা বাকারা-১৩) উক্ত আয়াতে الناس শব্দের الف ولام টি হল عهد خارجی এর দ্বারা সাহাবায়ে কিরাম কে বুঝানো হয়েছে। এত এ কথা প্রতি ভাত হচ্ছে যে সাহাবায়ে কিরামের ঈমান, ঈমানের মাপকাটি। উক্ত আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে মুফাসসীরগণ বলেন ঈমান যাচাই করার মাপকাটি হল সাহাবাদের ঈমান। যার ঈমান সাহাবাদের ঈমানের নিরিখে সঠিক প্রমাণিত হবে না তার ঈমান আল্লাহর কাছে স্বীকৃতি পাবে না। আল্লাহ পাক সাহাবাগণের ঈমানকে ঈমানের মাপকাঠি রূপে সাব্যস্তকরে যখন মুনাফিকদেরকে বললেন 2) أمنو كما أمن الناس( মুনাফিকরা) তোমরা সাহাবাদের ঈমানের মত ঈমান আন, কিন্তু মুনাফিকগণ তাদেরকে ঈমান তথা সত্যের মাপকাঠি হিসাবে গ্রহণ না করে তাদের সমালোচনা করে বললো قالوا انوس كما امن السفهاء তারা বলল আমরা কি বোকা ও নির্বোধের মত ঈমান আনবো? আল্লাহ পাক মুনাফিকদের প্রতি উত্তরে ইরশাদ করেন * الا الهم هم السفاء ولكن لا يعلمون
অর্থাৎ জেনে রেখো তারাই (মুনাফিকরা( হল প্রকৃত বোকা ও নিবোধ। কিন্তু তারা জানেনা ও উপলব্ধি করতে পারছেনা। (সূরা বাকারা-১৩) উপরোক্ত আয়াত দ্বারা সুস্পষ্ট প্রমাণিত হল যে সাহাবাদের ঈমান ঈমানের মাপকাঠি মুনাফিকগণ সাহাবায়ে কিরামের মত ঈমান না আনার কারণে আল্লাহর কাছে তাদের ঈমান গ্রহণ যোগ্য হয় নাই। এবং ইহাও প্রমাণিত হল যে সাহাবীদের সমালোচনাকারীদের জবাব দেওয়া প্রত্যেক মুমিনের জন্য কর্তব্য। যেমন অত্র আয়াতে আল্লাহপাক তাদের জবাব দিয়েছেন আরো প্রমাণিত হল যারা সাহাবিদের সমালোচনা করবে মাপকাঠি রূপে গ্রহণ করবেনা তাদের উপর চির কালের জন্য মোনাফিকী ও নির্বোদ্ধিতার মোহর আল্লাহ তাআলা মেরে দিয়েছেন। অন্যত্র আল্লাহপাক সাহাবীদের ঈমান ও আকিদাকে বিশ্ব মানবের জন্য সত্য ও ঈমানের মাপকাঠি সাব্যস্ত করে ইরশাদ করেন:
فان أمنوا بمثل ما أمنتم به فقد اهتدوا وان تولوا فانما هم في شقاق فسيكفيكهم الله وهو السميع العليم
অর্থাৎ যদি তারা (ইহুদী তথা বিশ্ব অমুসলিমগণ) এরূপ ঈমান নিয়ে আসে যে রূপ ঈমান তোমরা এনেছ তখন তারা হেদায়েত পাবে। আর যদি তারা এরূপ ঈমান গ্রহণ করা থেকে বিমুখ হয়ে যায় তবে তারা নিশ্চয় (সত্য ও খোদা) বিরোধিতায় রয়েছে। তবে শীঘ্রই আল্লাহ পাক তাদের পূর্ণ ব্যবস্থা করে নিবে। আর তিনি অত্যাধিক শুনেন ও জানেন। (সূরা বাকারা- ১৩৭)।
উক্ত আয়াতে بمثل ما امنتم به তোমরা যে রূপ ঈমান এনেছ) দ্বারা বিশ্ব নবী (সাঃ) এর সাহাবীদেরকেই সম্বোধন করা হচ্ছে। অতএব অত্র আয়াতে সাহাবীদের ঈমানকে অন্যান্য লোকদের ঈমানের মাপকাঠি ও আদর্শ সাব্যস্ত করে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে আল্লাহর কাছে একমাত্র গ্রহণ যোগ্য ও স্বীকৃত ঈমান এটাই, যে ঈমান সাহাবীগণ অবলম্বন করেছেন। সুতরাং যে ঈমান ও আকিদা সাহাবীদের ঈমান ও বিশ্বাস থেকে চুল পরিমাণ ভিন্ন হবে তা আল্লাহর কাছে গ্রহণ যোগ্য নয়। (মারিফুল কুরআন ১/৩৫৫) মুফাসসিরনে কিরাম বলেন, উক্ত আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, হিদায়াত প্রাপ্তির মাপকাঠি হচ্ছে সাহাবায়ে কিরামের ঈমান। এখন চিন্তা করার প্রয়োজন যে, যারা সাহাবায়ে কিরামকে আদর্শ ও সত্যের মাপকাঠি হিসাবে বিশ্বাস করে না বা মানে না তাদের ঈমানের অবস্থা কি হবে। তারা কাকে ঈমানের আদর্শ ও মাপকাঠি বিশ্বাস করে ও কাকে অনুসরণীয় মনে করে?
উল্লেখ্য মুসলমানদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দৌলত হল ঈমান আর হিদায়াত। যখন ঈমান যাচাই করা এবং হিদায়াত লাভ করার জন্য সাহাবায়ে কিরামদের ঈমানকে মাপকাটি সাব্যস্ত করা হয়েছে, তখন দ্বীনের অন্যান্য ব্যাপারে নিঃসন্দেহে তাঁরা মাপকাঠি।
৩য় প্রমাণঃ সাহাবীদের অনুসৃত পথ নির্ভুল ও সঠিক পথ : আল্লাহপাক পবিত্র কুরআনের সূরায়ে নিসায় সুস্পষ্ট ভাষায় সাহাবীগণের মত ও পথকে নির্ভুল ও সঠিক বলে বর্ণনা করেছেন এবং তাঁদের বিরোধিতা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর বিরোধীতার নামান্তর বলে ঘোষণা করেছেন। আর এ ধরণের ব্যক্তিদের সম্পর্কে কঠিন ও ভয়ানক আযাবের সংবাদ দিয়ে ইরশাদ করেছেনঃ
ومن يشاقق الرسول من بعد ماتبين له الهدى ويتبع غير سبيل المؤمنين نوله ما تولی و نصله جهنم وسأت مصيرا
অর্থাৎ হেদায়াতের পথ স্পষ্ট হওয়ার পর যে ব্যক্তি রাসূল (সাঃ) এর বিরোধিতা করবে এবং মুমিনদের পথ পরিত্যাগ করে অন্য পথ ধরবে সে যে দিকে ফিরে, তাকে সে দিকেই ফিরিয়ে দেব এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব। জাহান্নাম একটি নিকৃষ্ট অবস্থানাগার (সূরা নিসা-১১৫) উক্ত আয়াতটিতে মুমিন বলতে সাহাবায়ে কেরামদেরকে বুঝানো হয়েছে। কেননা এরাই পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার সময়ের মুমিন এবং অরাই- মুমিনদের সর্বপ্রথম এবং সর্ব শ্রেষ্ট জামাত এর দ্বারা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, সাহাবীগণের জীবন তাদের চরিত্র ও কর্মধারার অনুসরনের মধ্যেই রাসূল (সাঃ) এর অনুসরণ সঠিক ভাবে সীমাবদ্ধ। আর সাহাবায়ে কিরামের জীবন ও চরিত্রকে সত্যের অন্যতম বিশিষ্ট আদর্শ ও মাপকাঠি রূপে স্বীকার করে নিলেই নবী করীম (সাঃ) এর যথাযথ অনুসরণ সম্ভব হয়ে উঠতে পারে।
হাদীসের আলোকে ১ম প্রমাণ
عن عبد الله بن عمرو رض الله عنه قال قال رسو الله صلى الله عليه وسلم ان بني اسرائيل تفرقت على ثنتين وسبعين ملة ستفترق امتى على ثلاث وسبعين ملة كلهم فى النار الا ملة واحدة قالوا من هي يارسول الله قال ما انا عليه واصحابي (مشكواة)
অর্থাৎ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে অমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, বনি ইসরাঈল বাহাত্তর দলে বিভক্ত হয়েছিল আর অতি সত্তর আমার উম্মত তেহাত্তর দলে বিভক্ত হবে। সব দলই হবে দোযখী মাত্র একটি দল হবে বেহেস্তী। সাহাবীগণ আবদার করে বললেন হুজুর ওরা কোন দল? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিলেন যারা আমি এবং আমার সাহাবীগণের আদর্শ ও নীতিমালার উপর অটল থাকবে। (মিশকাত, তিরমিযী) উপরোক্ত হাদীসে সুস্পষ্ট প্রমাণ দিচ্ছে যে, সাহাবীগণ সত্য ও দ্বীনের আদর্শ কারণ যদি একমাত্র নবী (সাঃ) সত্য ও দ্বীনের মাপকাঠি হতেন তাহলে নবী (সাঃ) বলতেন ما انا عليه (আমি যে আদর্শ ও নীতির উপর আছি) বলে কথা সমাপ্ত করতেন। কিন্তু নবী (সাঃ( واصحابی )আর আমার সাহাবীদের আদর্শ-নীতি) বলে স্পষ্ট করে দিলেন যে, বেহেস্তী ও নাজাত প্রাপ্ত দলের অন্তর্ভুক্ত হতে হলে আমার সাহাবীদেরকে আদর্শ মনে করে তাদের অনুসরণ করতে হবে।
২য় প্রমাণ: হযরত আনাস (রাঃ) বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেছেন:
مثل اصحابي في امتى كالملح فى الطعام لا يصلح الطعام الا بالملح (مشكوة)
অর্থাৎ আমার উম্মতের মধ্যে আমার সাহাবীদের মর্যাদা এমন, যেমন খানার মধ্যে লবণের মর্যাদা। লবন ছাড়া খানা বিশুদ্ধ হয় না। ঠিক তেমনি ভাবে সাহাবা ছাড়া উম্মতের বিশুদ্ধতা ও সংশোধন হতে পারে না। (মিশকাত) এ হাদীস বর্ণনা করার পর হাসান বসরী (রহঃ) আক্ষেপ করে বলেছিলেন।
ذهب ملحنا فكيف تصلع হায় আমাদের লবন (সাহাবীগণ) চলে গেলেন, আমরা কিভাবে বিশুদ্ধতা লাভ করবো? বিখ্যাত হাদীস বিশারদ মোল্লা আলী ক্বারী (রহঃ) প্রতি উত্তর স্বরূপ বললেন:
قلت تصلح بكلامهم وروايتهم ومعرفة مقاماتهم وحالاتهم والاقتداء باخلاقهم وصفاتهم (مرقاة)
অর্থাৎ আমি বলি সাহাবীদের বাণী, তাদের বর্ণনা বলি, তাদের মর্যাদা উপলব্ধি এবং তাদের চরিত্র ও গুণাবলী অনুকরণের মাধ্যমে আমরা বিশুদ্ধতা ও সংশোধনী অর্জন করবো। (মিরকাত) এখন লক্ষণীয় কথা হল এই যে, উপরোক্ত হাদীসে নবী করীম (সাঃ) সাহাবীদেরকে লবণের সাথে তুলনা করে স্পষ্ট করে দিয়েছেন, যে লবণ ছাড়া যেমন খানা বিশুদ্ধ ও সুস্বাদু হয় না, ঠিক তেমনি ভাবে উম্মতের বিশুদ্ধতা ও হেদায়েত সাহাবীদের অনুসরণ ছাড়া সম্ভব নয়।
৩য় প্রমাণ: প্রত্যেক সাহাবীই অনুসরণ যোগ্য এবং তাতে হেদায়েত নিহিত রয়েছে। হযরত ওমর (রঃ) বলেন যে, আমি শুনেছি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেছেনঃ
سئلت ربي عن اختلاف اصحابى من بعدى فأوحى إلى يا محمد ان اصحابك عندى بمنزلة النجوم فى السماء بعضها اقوى من بعض ولكل نور فمن اخذ بشتى مماهم عليه من اختلافهم فهو على هدى
অর্থাৎ আমি আল্লাহ পাকের নিকট আমার সাহাবীদের ইখতিলাফ ও মত পার্থক্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম যা আমার পরে ঘটবে, তখন আল্লাহ পাক ওহীর মাধ্যমে আমাকে জানালেন হে মুহাম্মদ (সাঃ) আপনার সাহাবীগণ আমার নিকট আকাশের নক্ষত্র তুল্য। এক জন অপর জন থেকে দীপ্তিময় এবং প্রত্যেকেই জ্যোতির্ময়। সুতরাং যে ব্যক্তি সাহাবীদের মত পার্থক্যের মধ্যে যার মত ও পথ গ্রহণ করবে, সে আমার নিকট হিদায়ত ও সত্য পথের উপর গণ্য হবে। (মিশকাত শরীফ) অন্য রেওয়ায়েতে বর্ণিত আছেঃ
اصحابی کالنجوم بايهم اقتديتم اهتديتم
আমার সাহাবাগণ নক্ষত্র সমতুল্য তোমরা যারই অনুসরণ করবে হিদায়ত পাবে। (মিশকাত) উপরোক্ত হাদীস দ্বারা সুস্পষ্ট ভাবে প্রমাণিত হচ্ছে যে, সাহাবীদের প্রত্যেকেই অনুসরণীয় এবং প্রত্যেক সাহাবীর অনুসরণের মধ্যে হিদায়াত নিহিত রয়েছে। আর যদি কোন বিষয়ে দুই সাহাবীর দ্বিমত পরিলক্ষিত হয় তাহলে যে কোন সাহাবীর অনুসরণ করলেই
হিদায়ত বা মুক্তির পথ পাওয়া যাবে। তাই অন্য সাহাবীর মত ও কথাকে ভুল বা গোমরাহী বলা কারো জন্য জায়েয হবে না।
জ্ঞাতব্য কুরআনের কোন জায়গায় নবীজীকে মিয়ারে হক বলেননি এবং বানাননি। আর কাউকে বানানোর নির্দেশ ও দেননি। বরং নবী করীম (সাঃ) কে উসওয়ায়ে হাছানা বলেছেন। যার শাব্দিক অর্থ হল নমুনা বা আদর্শ।
لقد كان لكم في رسول الله اسوة حسنة :
নিশ্চয়ই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর মধ্যে তোমাদের জন্য উত্তম এক আদর্শ, নমুনা, বিদ্যমান রয়েছে।” (সূরা আহযাব)।
প্রশ্ন: আল্লাহর নবী (সাঃ) কে মু’মিনদের উত্তম চরিত্রের অধিকারী বানানোর পর সাহাবীগণের ঈমান ও পথ কে বিশ্বের মানব জাতীর জন্য আদর্শ ও সত্যের মাপকাঠি রূপে পেশ করলেন কেন?
উত্তর: তার সংক্ষিপ্ত জবাব হল এই যে নবী করীম (সাঃ) এর ঈমানের মত ঈমান আনা কোন মুমিনের পক্ষে সম্ভব নয়। এমন কি নবী (সাঃ) এর সাহাবীদের পক্ষেও তা সম্ভব নয়। কারণ আল্লাহর নবী বেহেস্ত দোযখ আরশে এলাহী ছিদরাতুল মুনতাহা এমনকি মালায়ে আলা উর্ধ্ব জগৎ ভ্রমণ করে রাব্বুল আলামীনের সাথে কথোপকথন করে যে স্তরের ঈমান অর্জন করে ছিলেন এ স্তরের ঈমান অন্য কোন নবী রাসূলও অর্জন করতে পারেন নাই। নবী করীম (সাঃ) এর সব আমল পরিপূর্ণ ভাবে অনুসরণ করা উম্মতের জন্য সম্ভব নয়। কারণ অনেক আমল রয়েছে যে গুলো নবীর জন্য জায়িয ও বৈধ। কিন্তু উম্মতের জন্য তা নাযায়েয ও অবৈধ যেমন এক সাথে চারের অধিক স্ত্রী নিজ অধীনে রাখা নবীর জন্য জায়িয ও বৈধ ছিল। তাই নবীজী (সাঃ) নয় জন স্ত্রী রেখে ইহ জগত ত্যাগ করেছেন। কিন্তু উম্মতের জন্য এক সাথে চারের অধিক স্ত্রী নিজ অধীনে রাখা হারাম ও অবৈধ। মোহরানা ব্যতীত নবীর জন্য বিবাহ জায়িয ছিল কিন্তু মোহরানা ব্যতীত উম্মতের জন্য বিবাহ নাজায়েয নবীর জন্য ওয়াছাল রোযা (অর্থাৎ ধারাবাহিক ২/৩ দিন রোযা রাখা) এর মধ্যে ইফতার ও সেহরী না খাওয়া জায়িয ও বৈধ কিন্তু তা উম্মতের ক্ষমতার বাইরে। এ ধরণের আরো অনেক বিশেষত্যু নবীর জন্য রয়েছে। অতএব নবী করীম (সাঃ) এর ঈমানের মত ঈমান অর্জন করা এবং নবী করীম (সাঃ) এর আমলের পরিপূর্ণ অনুসরণ করা উম্মতের জন্য সম্ভব নয় যেহেতু আল্লাহপাক অতি অনুগ্রহ করে বিশ্বনবী (সাঃ) এর জন্য আদর্শ ও মাপকাঠি বানিয়েছেন।
প্রশ্ন: সাহাবায়ে কিরাম সমালোচনার উর্ধ্বে প্রমাণ পেশ কর?
উত্তরঃ সাহাবায়ে কিরাম সমালোচনার উর্ধ্বে। আল্লাহ তা আলা ইরশাদ করেন:
يايها الذين أمنوا اجتنبوا كثير امن الظن ان بعض الظن اثم ولا تجسرا ولا يغتب بعضكم بعضا
অর্থাৎ হে মুমীনগণ তোমরা অনেক ধারণা ও সন্দেহ থেকে বিরত থাক, কেননা কোন কোন ধারণা এবং সন্দেহ পাপ জনক হয়ে থাকে, এবং কারো দোষ অনুসন্ধান করোনা। আর একে অন্যের অগোচরে দুর্নাম করো না। (সূরা হুজরাত-১২) হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে অর্থাৎ হযরত আবু সাঈদ এবং হযরত জাবীর (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে তারা বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেছেন যে গীবত করা ব্যভিচার (কুকর্ম) এর চেয়েও শক্ত পাপ। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন গীবত ব্যভিচার তথা কুকর্মের চেয়ে শক্ত পাপ কিভাবে?
নবীজী (সাঃ) বললেন, কোন লোক ব্যভিচার করারপর সত্য মনে তওবা করলে আল্লাহ পাক তাকে ক্ষমা করেদেন আর গীবত কারীকে ক্ষমা করা হবে না, যতক্ষণ ঐ ব্যক্তি তাকে ক্ষমা না করবে যার গীবত করেছে। (মিশকাত) অন্য হাদীসে বর্ণিত আছে:
عن ابى هريرة رض الله عنه ان رسول الله صلى الله عليه وسلم قال اتدرون ما الغيبة قالوا الله ورسوله اعلم قال ذكرك اخاك بما يكره قيل ان كان فى اخى ما اقول قال ان كان فيه ما تقول فقد اغتبته وان لم فقد بهته (رواه مسلم) يكن فيه ما تقول
অর্থাৎ হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করলেন, তোমরা কি জান, গীবত বা পরনিন্দা কি ও সাহাবায়ে কিরাম বললেন, আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলই ভাল জানেন। নবী (সাঃ) বললেন, গীবত বা পর নিন্দা হল, তোমার ভাই সম্বন্ধে তোমার এমন কথা বলা বা আলোচনা করা যা শুনলে যে দুঃখিত হবে। কেহ বললেন ইয়া রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমি যা বলছি তা যদি আমার ভাই এর মধ্যে বিদ্যমান থাকে তিনি বললেন, তুমি যা বললে তা যদি তার মধ্যে থাকে তবে তো তুমি গীবত করলে, আর যদি তা তার মধ্যে না থাকে তবে তো তুমি তার সম্বন্ধে মিথ্যা তহমত অপবাদ করলে। পবিত্র কোরআনুল করীম এ ধরণের গীবত করাকে ঘৃণিত কার্যরূপে বর্ণনা করে গীবতে লিপ্ত বা পরনিন্দা কারী সম্বন্ধে বলেছেন যে, সে যেন স্বীয় ভ্রাতার মৃত দেহের গোশত ভক্ষণ করল। আল্লাহপাক ইরশাদ করেছন:
ايحب احدكم ان يأكل لحم اخيه ميتا فكر هتموه
অর্থাৎ তোমাদের কেহ কি তার মৃত্যু ভ্রাতার গোশত ভক্ষণ করতে চাইবে। বস্তুত তোমরা একে ঘৃণা করো”। (সূরা হুজরত-১২) অতএব বুঝা গেল যে, গীবত বা পর নিন্দা সে সকল নিকৃষ্ট স্বভাবের অন্তর্গত যা মানুষের মধ্যকার সুসম্পর্ক বিনষ্ট করে দেয়। এবং অন্যের অনুপস্থিতিতে তার নিন্দা করা যা তার অন্তরে আঘাত করে এবং সম্মানহানী ঘটায় তা লোকের মধ্যে শত্রুতার উদ্রেক করে এবং মুসলমানদের মধ্যকার বন্ধুত্ব ও ভালবাসাকে দূর করে দেয়। এ কারণেই নবীজী ইরশাদ করেন যে,
حسب امرء من الشر ان يحقر اخاه المسلم وكل مسلم على المسلم حرام دمه وماله وعرضه رواة مسلم
অর্থাৎ মানুষ নিকৃষ্ট হওয়ার জন্য যথেষ্ট হলঃ মুসলমানদের কে হেয় প্রতিপন্ন করা। মূলতঃ প্রত্যেক মুসলমানদের ও ইজ্জত মাল জান (নষ্ট করা) মুসলমানদের জন্য হারাম। (মুসলীম শরীফ)।
হুজুর (সাঃ) এর সাথে সাহাবায়ে কিরামের যেহেতু সরাসরি সম্পর্ক ছিল তাই তাঁদের প্রতি ভালবাসা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর প্রতি ভালবাসারই নামান্তর। সুতরাং তাদের সম্পর্কে সামান্যতম কটূক্তি করা ও মারাত্মক ধৃষ্টতাও এক মহা অপরাধ। তাই নবী করীম (সাঃ) স্বীয় উম্মতকে সতর্কতা হিসাবে ইরশাদ করেছেন:
الله الله في اصحابي لا تتخذو اهم غرضا من بعدى فمن احبهم فيحيى احبهم ومن ابغضهم فببغضى ابغضهم ومن اذاهم فقد اذاني ومن اذاني فقد اذا الله ومن اذا الله يوشك ان يأخذهم
অর্থাৎ তোমরা আমার সাহাবীগণের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো। আমার পর তোমরা তাদেরকে আক্রমণ ও সমালোচনার লক্ষ বস্তু বানাবে না। যে ব্যক্তি তাদেরকে মহব্বত করে সে ব্যক্তি আমাকে মহব্বত করে বলেই তা করে। আর যে ব্যক্তি তাদেরকে হিংসা করে সে আমার প্রতি হিংসা পোষণ করে বলেই তা করে। যে ব্যক্তি তাদেরকে কষ্ট দিল সে যেন আমাকেই কষ্ট দিল। আর যে আমাকে কষ্ট দিচ্ছে সে যেন আল্লাহকে কষ্ট দিচ্ছে। যে ব্যক্তি আল্লাহকে কষ্ট দেয় অতিসত্ত্বর তিনি তাকে অপদস্ত ও পাকড়াও করবেন। (তিরমিযী ২/২২৬) কারণ বিশ্বনবীর সাহাবীগণ আল্লাহর প্রিয় বান্দা ছিলেন দুনিয়াতেই তারা বেহেসতের সুসংবাদ পেয়েছিলেন এবং তাদের সমকক্ষ কেহ হতে পারবে না। তাই নবী (সাঃ) ইরশাদ করেছেনঃ
لا تسبوا اصحابي فلو ان احدكم انفق مثل أحد ذهبا ما بلغ مد احدهم ولا نصيفه
অর্থাৎ তোমরা আমার সাহাবীগণকে গালমন্দ (তাদের শানে এমন বাক্য আরোপ) করোনা, যা তাদের মান মর্যাদায় আঘাত করে। তোমাদের কেউ যদি আল্লাহর পথে উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ রৌপ্য দান করে তবে তাদের একসের বা আধাসের (যব) দানের ও সমান হতে পারেনা। (বুখারী ও মুসলিম)।
উপরোক্ত হাদীসে (সাব্বুন) শব্দটি শুধু গালি গালাজ করার অর্থে স্বাভাবিক ব্যবহার হয়ে থাকে। কিন্তু আরবের পরিভাষায় (সাব্বুন) শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহার হয়ে থাকে। অর্থাৎ কারো সম্পর্কে এমন শব্দ ও ভাষা ব্যবহার করা যাতে তার সম্মান হয় এবং তাকে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়। আর শুধু গালি বুঝনোর জন্য (শাতমুন) শব্দ ব্যবহার হয়। উক্ত হাদীস সুস্পষ্ট প্রমাণ দিচ্ছে যে সাহাবীদের সামান্যতম আমলের সমান বাকী উম্মতের কোন আমল হতে পারবে না। সুতরাং তাদের প্রতি কটূক্তি করা বা তাদের সমালোচনা করার কারো কোন অধিকার নেই এবং কারো জন্যে তা বৈধ ও নয়। সাহাবীদের সমালোচনাকারীরা লানৎ ও অভিশাপের যোগ্য। সাহাবীগণের স্তর, পদ ও মর্যাদার জটিলতার প্রতি লক্ষ্য করেই বলা হয়েছে যারা তাদের দোষ খুঁজে সমালোচনা করে এদেরকে শুধু দুর্ভাগা, মালউন ও অভিশপ্ত মনে করেই ক্ষান্ত হওয়া উচিত নয় বরং তা প্রকাশ্যে ঘোষণা করা কর্তব্য। যেমন নবী করীম (সাঃ) ইরশাদ করেছেন:
اذا رأيتم الذين يسبون اصحابي فقولوا لعنة الله على شركم
অর্থাৎ যখন তোমরা আমার সাহাবীগণের বদনামকারীদেরকে দেখবে তখন তোমরা (তাদেরকে লক্ষ্য করে) বল তোমাদের দুষ্টামির উপর আল্লাহর লানত ও অভিশাপ হোক”। (তিরমিযী ২য় খন্ড, ২২৭ পৃষ্ঠা)।
নবী করীম (সাঃ) এদের উপর লানতের নির্দেশ দেওয়ার কারণে এসব লোক আল্লাহপাক এবং তার সমস্ত ফিরিস্তা এবং সমস্ত লোকের লা’-নত ও অভিশাপের যোগ্য হয়ে থাকে। আর তাদের কোন উপাসনা আল্লাহর কাছে গ্রহণ যোগ্য হয় না। যেমন নবী করীম (সাঃ) ইরশাদ করেছেনঃ
ان الله تعالى اختاري و اختارلی اصحابی فجعل منهم وزراء وانصارا واصهارا فمن سبهم فعليه لعنة الله والملائكة والناس اجمعين لا يقبل الله منه يوم القيامة
অর্থাৎ আল্লাহপাক আমাকে শেষ নবী হিসাবে মনোনীত করেছেন এবং আমার জন্য সাহাবী (সঙ্গী সাথী) মনোনীত করেছেন। অতঃপর তাদের থেকে উজীর ও মন্ত্রীগণ আনসার এবং নিকট আত্মীয় বানিয়েছেন। অতএব যে তাদের প্রতি কটূক্তি করবে ও সমালোচনা করবে তার উপর আল্লাহ ও ফিরিস্তা আর সমস্ত মানুষের লা-নত ও অভিশাপ হোক। আর আল্লাহপাক তাদের কোন প্রকার উপাসনা ও ছদকা গ্রহণ করবেন না। (তিবরাণী ও হাকিম)।
উপরোল্লিখিত আয়াতে কুরআন ও হাদীসে নববী দ্বারা স্পষ্ট প্রমাণিত হচ্ছে যে, সাধারণ মুসলমানেরও সমালোচনা, দোষ অন্বেষণ ও দোষ চর্চা করা হারাম এবং কবীরা গোনাহ। সুতরাং আল্লাহর মাসুম নিষ্পাপ নবীদের ও আল্লাহর নবীর মাহফুজ সাহাবাদের সমালোচনা ও দোষ চর্চা করা এবং তাদের উপর অলিক অভিযোগ উত্থাপন করা কত বড় মহাপাপ হবে আল্লাহ পাকই ভাল জানেন। উল্লেখিত আলোচনা দ্বারা আরো প্রমাণিত হল, যারা সাহাবাদের সমালোচনা করে তাদের কোন ইবাদত বা আমল কবুল হয় না। আরো প্রমাণিত হল যে, সাহাবায়ে কিরাম সমালোচনার উর্ধ্বে। সুতরাং সাহাবীদের সমালোচনা করা মানে কুরআন ও হাদীস অস্বীকার করার নামান্তর।
প্রশ্ন: আদালতে সাহাবা বলতে কি বুঝায়, আদালতের জন্য নিষ্পাপ হওয়া কি শর্ত? সাহাবায়ে কিরামের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব কলহ কি আদালতের পরিপন্থী হবে?
উত্তর: সাহাবাগণ সকলই বিশ্বস্ত মুসলিম মিল্লাতের সর্ব সম্মত সিদ্ধান্ত হল যে সাহাবা ছিক্কাহ তথা নির্ভর যোগ্য। তাঁরা প্রত্যেকই বিশ্বস্ততা ও ন্যায় পরায়ণতার উচ্চ শিখরে সমাসীন। তাঁদের প্রতিটি খবর ও সাক্ষ্য গ্রহণ যোগ্য। পবিত্র কুরআন নিজেই তাঁদের বিশ্বস্ততা ও পবিত্রতার সাক্ষ্য প্রদান করেছে। হাদীস শরীফ ও তাঁদের বিশ্বস্ততা ও পবিত্রতার সাক্ষ্য প্রদান করেছে। যেমন হাদীসে বর্ণিত আছে الصحابة كلهم عدول সমস্ত সাহাবায়ে কিরাম আদিল বা বিশ্বস্ত”।
উপরন্তু এ কথা পূর্বেই বিধৃত হয়েছে যে, সাহাবায়ে কিরাম আল্লাহ তাআলার মনোনীত ও নির্বাচিত জামাআত, আর এ কথা বলাই বাহুল্য যে, কারো বিশ্বস্ততা ও পবিত্রতার জন্যে আল্লাহর মনোনয়ন যথেষ্ট। যেহেতু আল্লাহ তাআলা সর্বত্ত্ব ও সর্বদর্শী যদি সাহাবাগণ বিশ্বস্ত ও ন্যায় পরায়ণ না হন তবে আল্লাহ তাআলা কুরআন সুন্নাহর ধারক বাহক হিসেবে কেমন করে তাঁদেরকে মনোনীত করলেন? তবে কি আল্লাহ মনোনয়নই সঠিক হয়নি, তিনি কি সর্ব বিষয়ে পরিত্ত্বাত নন? (নাউযুবিল্লাহ)। আল্লাহর সর্বত্ত্বানের উপর বিশ্বাস রাখতে হলে সাহাবাদের আদালত তথা বিশ্বস্ততার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন ছাড়া কোন উপায় নেই।
(খ) আদালতের জন্য নিষ্পাপ হওয়া শর্ত নয়। তবে আদালতের জন্য জরুরী হল সর্ব প্রকার খারাপ ও পাপাচার মূলক কার্যকলাপ থেকে বেঁচে থাকা। গোনাহ হেতু আদালত বাতিল হয় সত্য কিন্তু চিরজীবনের জন্যে নয়। তাওবার মাধ্যমে তা পুনরায় ফিরে আসে। আর এমন কোন সাহাবী নেই যিনি হঠাৎ কোন গোনাহ করে ফেললে তাৎক্ষনাৎই তাওবা করে পবিত্র হননি। যদি সাহাবাগণ তাওবার মাধ্যমে পবিত্র ও ক্ষমাপ্রাপ্ত না হন তবে আল্লাহর সন্তুষ্টি প্রাপ্ত হলেন কি করে? বলা বাহুল্য কুরআন শরীফ সাহাবাদের সম্পর্কে সন্তুষ্টি ঘোষণা করেছে। আর গোনাহ মাপ না করে কি সন্তুষ্টি হয়? পূর্বেই সাহাবাদের গুণাবলী বর্ণিত হয়েছে। এ সব গুণাবলীর মোকাবেলায় তাঁদের জীবনের এক আধটা গোনাহ কর্তব্য নয়, বরং আল্লাহর ওয়াদা অনুযায়ী তাঁদের গুণাবলী গোনাহ সমূহের কাফ্ফারা হয়ে যায়। ইরশাদ হচ্ছে নিঃসন্দেহে পূণ্য কার্য পাপকে দূর করে দেয়।” (সূরা হুদ-১১৪) সাহাবাদের পূণ্য কাজ মন্দ কাজের কাফ্ফারা না হলে আর কার হবে?
(গ) সাহাবায়ে কিরামের পারস্পরিক দ্বন্ধ কলহ গোনাহ বা পাপ নয়, যে তাঁদের আদালতের পরিপন্থী হবে। কারণ তাঁরা যা কিছু করেছেন সবই ইজতিহাদের মাধ্যমে করেছেন। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্যে করেছেন। আর যারা নিরপেক্ষ ছিলেন তাঁরাও ইজতিহাদের মাধ্যমে নিরপেক্ষ পথ অবলম্বন করেছেন। এ হিসাবে তাঁদের কাউকে ও ভ্রান্ত বলা যায় না। তাদের প্রত্যেকেরই কর্ম পন্থা ছিল সঠিক এবং নির্ভুল। সুতরাং এ কারণে তাঁদেরকে তিরষ্কার করা তাঁদের ফযিলত ও মর্যাদা অস্বীকার করা কিছুতেই ঠিক নয়। তাঁরা রাসুল (সাঃ) এর ছোহবত লাভের সৌভাগ্য প্রাপ্ত হয়েছেন। আমাদের কর্তব্য হল আমরা যেন তাঁদের বিরোধ সম্পর্কে মন্তব্য বা সমালোচনা না করে সর্বদা উত্তম পন্থায় তাদের সম্পর্কে আলোচনা করি”। মা আরিফুল কুরআন) সাহাবাদের পরস্পরের মধ্যে মর্যাদা গত তারতম্য রয়েছে বটে, কিন্তু সাহাবাদের প্রত্যেকই জান্নাতী। যার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত প্রস্রবন সমূহ। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। (সূরা তাওবা- ১০০) তাছাড়া আরো অনেক আয়াত ও হাদীস দ্বারা প্রমাণীত যে সাহাবায়ে কেরাম বিশ্বস্ত ও জান্নাতী।
প্রিয় পাঠক মন্ডলী, আসুন আমরা সাহাবাদের কে ভালবাসি, তাদেরকে মহব্বত করি, তাদের অনুকরণে চলি, তাদের সমালোচনা না করি।