মিয়ারে হক: সত্যের মাপকাঠি: কুরআন-হাদীস এবং মওদূদী সাহিত্যের আলোকে: পর্ব-৩

মওদূদী সাহেব দস্তূরে জামাতে ইসলামীতে লিখেন, ‘আল্লাহর রাসূল ছাড়া কাউকে সত্যের মাপকাঠি বানানো যাবে না, কাউকে সমালোচনার উর্ধ্বে মনে করা যাবে না, কারো যেহনী গুলামীতে লিপ্ত হওয়া যাবে না’।
অতএব, এই দফার ভিত্তিতে সাহাবায়ে কিরাম সম্পর্কে মওদূদী আকীদা লক্ষ করুন। কারণ, তাঁরা হলেন উম্মত এবং নবীর মাঝে মাধ্যমস্বরূপ। তাঁদের মাধ্যমে এবং তাঁদেরই উসিলায় উম্মতের নিকট আল্লাহর কিতাব ও সুন্নত পৌঁছেছে। এ কারণে তাঁরা দীনের কেন্দ্রবিন্দু। সুতরাং তাঁরা নির্ভরযোগ্য হলে কুরআন-সুন্নাহ নির্ভরযোগ্য প্রমাণিত হবে। অন্যথায় দীনের এ সুবিশাল প্রাসাদ নিমিষেই ধ্বসে পড়বে। এ কারণেই যিন্দীক ও বাতিল ফিরকাগুলো ইসলামী ইতিহাসের শুরুলগ্ন থেকেই সাহাবিগণের এ পবিত্র জামাআতকে সমালোচনার লক্ষ্য বানিয়েছে এবং তাঁদেরকে অনির্ভরযোগ্য প্রমাণের ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়ে আসছে।
ইমাম আবু যুরআ রাযি রহ. বলেন, ‘যখন তুমি কাউকে রাসূল ﷺ-এর সাহাবীগণের মধ্য থেকে কারো দোষ ধরতে দেখবে, তবে জেনে নিবে সে যিন্দীক। কারণ রাসূল হক, কুরআন হক এবং রাসূল আনীত সবকিছু হক; আর এগুলো সাহাবায়ে কিরামই আমাদের পর্যন্ত পৌঁছিয়েছেন। তাই এসব লোক আমাদের সাক্ষীদেরকে সন্দেহযুক্ত করে দিয়ে কুরআন ও সুন্নাহকে বাতিল করে দিতে চায়। এ কারণে তাদেরকেই ঘায়েল করা অগ্রাধিকারযোগ্য। এসব লোকই যিন্দীক।’ [আল ইসাবাহ ১১]
এ কারণেই হকপন্থীগণ সর্বদাই পূর্ণ তাহকীকের সাথে তাঁদের উপর আরোপিত সকল অভিযোগের তদন্ত-বিশ্লেষণ করেছেন, সত্য-মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করেছেন, ভুল-শুদ্ধ যাচাই করে প্রত্যেকটাকে স্ব-স্থানে রেখেছেন এবং সাহাবায়ে কিরামের পবিত্রতায় একটুও আঁচড় লাগতে দেননি তাঁরা। ঘটনা যেরকম ঘটেছে, সেরকমই গ্রহণ করেছেন, সেটাকেই প্রকাশ করেছেন এবং সেটার উপর উম্মতকে পরিচালিত করেছেন।
হাফিয ইবনে আব্দুল বার রহ. সাহাবায়ে কিরাম সম্পর্কে লিখেছেন, ‘সুতরাং তাঁরা (সাহাবা) হলেন শ্রেষ্ঠ যুগের লোক। মানবজাতির হেদায়েতের জন্য যেসব উম্মতের সৃষ্টি করা হয়েছে, সাহাবায়ে কিরাম হলেন তাদের মধ্যে সর্বোত্তম। আল্লাহ তাআলা কর্তৃক প্রশংসা-সিফাত এবং নবীজী ﷺ-এর প্রশংসার মাধ্যমে তাঁদের ন্যায়পরায়ণতা প্রমাণিত হয়েছে। যাঁদেরকে আল্লাহ তাআলা স্বীয় নবীর সুহবত এবং সাহায্যের জন্য পছন্দ করেছেন, তাঁদের থেকে বেশি ন্যায়পরায়ণ আর কেউ হতে পারে না। কোন শুচি-শুদ্ধতা ও পবিত্রতা তাঁদের থেকে উত্তম নয়। আর আল্লাহ তাআলার বাণী محمد رسول الله والذين معه এর উপরে কোন সাক্ষ্য নেই।’ [ইসতীআব ২]
অতঃপর সপ্তম পৃষ্ঠায় হাফিয ইবনে আব্দুল বার রহ. বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা স্বীয় নবীর সাহাবিদেরকে ন্যায়পরায়ণতা ও আমানতদারিতার সুউচ্চ মর্যাদায় এজন্যই অভিষিক্ত করেছেন যাতে স্বীয় নবী থেকে তাঁরা যেসব ফারাইয (আবশ্যক কর্ম) ও সুন্নতকে বর্ণনা করেছেন, তা সমগ্র উম্মতের জন্য হুজ্জত-প্রমাণ হয়ে যায়। সুতরাং আল্লাহ তাআলা তাঁদের উপর রহমত নাযিল করুন এবং সমস্ত সাহাবীর উপর রাযি হোন। তাঁরা পরবর্তীদের নিকট দীন পৌঁছানোর বেলায় আপনার পক্ষ থেকে সর্বোৎকৃষ্ট এবং অতি উত্তম মুবাল্লিগ ছিলেন।’ [ইসতীআব ৭]
মুহাক্কিক ইবনে হুমাম হানাফী এবং আল্লামা ইবনে আবু শরীফ শাফিয়ী রাহিমাহুমাল্লাহ মুসায়ারা ও তার শরাহ মুসামারার একশো ত্রিশতম পৃষ্ঠায় লিখেন, ‘আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের মতে সকল সাহাবীর পবিত্রতা ঘোষণা ওয়াজিব। তাঁদের সকলের আদালত স্বীকার করা ওয়াজিব। তাঁদের দোষ বর্ণনা ও সমালোচনা থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকা ওয়াজিব। আল্লাহ তাআলা যেরকম করেছেন, ঠিক সেরকমভাবে তাঁদের প্রশংসা ও গুণাবলি বর্ণনা করতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, মানবজাতির কল্যাণের জন্য যত উম্মত সৃষ্টি করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে তোমরাই সর্বশ্রেষ্ঠ। আরো বলেন, আমি তোমাদেরকে মধ্যমপন্থী উম্মত বানিয়েছি যাতে তোমরা মানবজাতির জন্য সাক্ষীস্বরূপ হও।’
হাফিয ইবনে হজর আসকালানী রহ. الاصابه فى تمييز الصحابه কিতাবের প্রথম খন্ডে তৃতীয় অধ্যায়ে সাহাবীগণের অবস্থার বর্ণনায় লিখেছেন, গোটা আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআত একমত যে, সকল সাহাবী আদিল। হাতেগোনা কয়েকজন বিদআতী ছাড়া আর কেউ এ ব্যাপারে দ্বিমত করেন নি। খতীব বাগদাদী কিফায়াতে এ ব্যাপারে একটি চমৎকার অধ্যায়ের অবতারণা করেছেন। তিনি লিখেছেন, সাহাবিদের আদালত (ন্যায়পরায়ণতা) আল্লাহ তাআলা কর্তৃক সাক্ষ্য, পবিত্রতার বর্ণনা ও মনোনয়ন দ্বারা প্রমাণিত। সেসব আয়াতের কয়েকটি হল:-
كنتم خير أمة أخرجت للناس.
وكذلك جعلناكم أمة وسطا.
لقد رضى اللّه عن ألمؤمنين أذ يبايعونك تحت الشجرة فعلم ما في قلوبهم.
والسابقون الاولون من المهاجرين والانصار والذين اتبعوهم بإحسان رضى اللّه عنهم ورضوا عنه.
يا أيها النبى حسبك اللّه ومن اتبعك من المؤمنين.
للفقراء المهاجرين الذين أخرجوا من ديارهم وأموالهم يبتغون فضلا من اللّه ورضوانا وينصرون اللّه ورسوله أولئك هم الصادقون. والذين تبوّؤ الدار والايمان من قبلهم يحبون من هاجر أليهم ولا يجدون في صدورهم حاجة مما اوتوا ويؤثرون على انفسهم ولو كان بهم خصاصة ومن يوق شحّ نفسه فاولئك هم المفلحون والذين جاءو منْ بعدهم يقولون ربنا اغفر لنا ولاخواننا الذين سبقونا بالايمان ولا تجعل في قلوبنا غلا للذين امنوا ربنا انك رءوف الرحيم.
এরূপ বহু আয়াত রয়েছে যেগুলো উল্লেখ করা হলে দীর্ঘ হয়ে যাবে। এছাড়া হাদীসের ভান্ডারে রয়েছে অসংখ্য হাদীস। এই সমস্ত নস তথা আয়াত ও হাদীসের দাবি এই যে, সব সাহাবীর আদালতের আকীদা রাখা এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের তাদীলের (সাক্ষ্য) মোকাবেলায় আর কারো তাদীলের প্রয়োজন মনে না করা। যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে উল্লেখিত কোন আয়াত এবং হাদীস নাও থাকত, তদুপরি তাঁদের হিজরত, জিহাদ, ইসলামের সাহায্য, জান-মালের উৎসর্গ, স্বীয় বাপ-বেটাকে হত্যা, দীনের কল্যাণকামিতা, ঈমান-একীনের শক্তি ইত্যাদি অবস্থা তাঁদের আদিল হওয়ার, তাঁদের পূত-পবিত্রতার উপর ভরসা রাখার এবং তাঁদের পরবর্তী সকল অনাগত ও সমস্ত আদিল থেকে শ্রেষ্ঠ হওয়ার সাক্ষ্য বহন করে। এটাই হল সমস্ত উলামায়ে কিরাম এবং নির্ভরযোগ্য লোকদের অভিমত।
সাহাবায়ে কিরামের (যদিও নবীজী ﷺ-এর সাথে তাঁর সান্নিধ্য খুবই কম হোক না কেন) তাযীম খুলাফায়ে রাশিদীন ও অন্যান্যদের নিকটও স্পষ্ট এবং স্বীকৃত। তন্মধ্যে একটি ঘটনা নিম্নরূপ:
“জনৈক সাহাবী এক আনসারীর নিন্দাবাদ করলে হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেছিলেন যে, ‘যদি তিনি রাসূল ﷺ-এর সুহবতের সেই মর্যাদা লাভ না করতেন যার মাধ্যমে তিনি নাজানি কি কি ফযীলত হাসিল করেছেন, তাহলে তাঁকে শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে আমি তোমাদের পক্ষ থেকে যথেষ্ট ছিলাম। কিন্তু জনাব রাসূল ﷺ-এর সুহবত তাঁর নসীব হয়েছে।’ শুধুমাত্র নবীজী ﷺ-এর সাথে মুলাকাতের কারণে হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু ঐ সাহাবীকে শাস্তি দেয়া তো দূরের কথা, ভর্ৎসনাও করলেন না।”
এই ঘটনা এটারই জ্বলন্ত প্রমাণ যে, খুলাফায়ে রাশিদীন মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন যে, কোন কিছুই সাহাবায়ে কিরামের সমকক্ষ হতে পারে না। যেমন বুখারী ও মুসলিম শরীফে হযরত আবু সায়ীদ খুদরী রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে নবীজী ﷺ-এর এই ইরশাদ বর্ণনা করা হয়েছে, “সেই পবিত্র সত্তার কসম যার কুদরতি হাতে আমার জান, তোমাদের কেউ যদি উহুদ পাহাড় পরিমাণ সোনাও আল্লাহর রাস্তায় দান করে, তবুও সাহাবায়ে কিরামের এক মুদ কিংবা আধ মুদ পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না।”
জনাব রাসূলে কারীম ﷺ থেকে তাওয়াতুরের মাধ্যমে বর্ণিত হয়ে আসছে যে, তিনি বলেছেন: আমার যুগ সর্বোত্তম যুগ। অতঃপর এর সাথে সংশ্লিষ্ট যুগ।
হযরত বাহয ইবনে হাকীম তাঁর পিতার সূত্রে দাদা থেকে বর্ণনা করেছেন যে, নবীজী ﷺ বলেছেন: তোমরা সত্তর উম্মতের পূর্ণতা দানকারী। তোমরা আল্লাহর নিকট সবচেয়ে উত্তম এবং সম্মানিত।
বাযযার স্বীয় মসনদে নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীর সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূল ﷺ বলেছেন: আল্লাহ তাআলা নবী-রাসূলগণ ব্যতীত মানব-দানবের মধ্য থেকে আমার সাহাবাদেরকে নির্বাচন করেছেন। হযরত সুফিয়ান রহ. قل الحمد للّه وسلام على عباده الذين اصطفى এর তাফসীরে বলেছেন যে, তাঁরা হলেন হযরত মুহাম্মদ ﷺ-এর সাহাবায়ে কিরাম। [আল ইসাবাহ ১১-১৫]
এছাড়া বহু রেওয়ায়েত আল ইসাবাতে রয়েছে। সংক্ষেপণের খাতিরে এতটুকুই ভাল এবং তা সন্তোষনকও বটে।
উসদুল গাবাহ ফী মারিফাতিস সাহাবার প্রথম খন্ডের দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় ইমাম ইবনে আসীর জাযারী রহ. বলেন, সাহাবায়ে কিরাম জেরা-তাদীল (তথা নির্ভরযোগ্যতা ও অনির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে বিচার-বিশ্লেষণ) ব্যতীত বাকি সমস্ত বিষয়ে অন্যান্য (হাদীস বর্ণনাকারী) রাবীগণের সাথে সমান অংশীদার। কারণ তাঁরা সব আদিল-নির্ভরযোগ্য। তাঁদের কোন জেরা হতে পারে না। কারণ, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তাঁদের পবিত্রতা ও আদালত বর্ণনা করেছেন। আর এটা সুস্পষ্ট, আলোচনার প্রয়োজন নেই।
মিশকাতের শরাহ মিরকাতের পঞ্চম খন্ডের ৫১৭ পৃষ্ঠায় আছে, প্রত্যেক সাহাবী সম্পূর্ণভাবে আদিল এবং নির্ভরযোগ্য। কুরআন ও হাদীস এবং উম্মতের নির্ভরযোগ্য লোকদের ইজমা এর জ্বলন্ত প্রমাণ। শরহুস সুন্নাহ গ্রন্থে আবু মনসুর বাগদাদী রহ. বলেছেন, আমাদের আকাবীর ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে খিলাফতের তরতীব অনুযায়ী চার খলীফা হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ; অতঃপর আশারায়ে মুবাশশারাহ। তারপর পর্যায়ক্রমে আহলে বদর, আহলে ওহুদ, আহলে বায়আতুর রিযওয়ান, প্রথম ও দ্বিতীয় বায়আতে আকাবায় অংশগ্রহণকারী আনসার সাহাবীগণ এবং উভয় কিবলার দিকে নামাজ আদায়কারী সাবিকীনে আউয়ালীনগণ। হযরত আয়শা ও হযরত খাদীজা রাযিয়াল্লাহু আনহুন্নার মাঝে কে শ্রেষ্ঠ- এতে মতভেদ রয়েছে। এমনিভাবে হযরত আয়শা ও হযরত ফাতেমা রাযিয়াল্লাহু আনহুন্নার মাঝে কে শ্রেষ্ঠ- তাতেও মতানৈক্য পরিলক্ষিত হয়। হযরত মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু আদিল ও শ্রেষ্ঠ সাহাবীগণের মধ্যে একজন। পরস্পরের মধ্যে তাঁদের যেসব লড়াই সংঘটিত হয়েছে, তাতে যুক্তি-প্রমাণের আলোকে প্রত্যেকে নিজেদেরকে হক ও পুণ্যের উপর রাখতেন। আর প্রত্যেকেই স্ব-স্ব লড়াইর ব্যাপারে ইজতেহাদকারী ছিলেন। এ কারণে তাঁদের কেউই আদালত বহির্ভূত হন নি। কারণ তাঁদের প্রত্যেকেই মুজতাহিদ জামাআত ছিলেন। পরস্পরে বিভিন্ন বিষয়ে মতবিরোধ হয়েছে যেমন পরবর্তীতে মুজতাহিদীন বিভিন্ন মাসায়েলে বিরোধ করেছেন। তাই কেউ আদালত বহির্ভূত হবেন না।
মুহাক্কিক ইবনে হুমাম তাহরীরুল উসূল ও তার ভাষ্যগ্রন্থ তাক্বরীরুল উসূল দ্বিতীয় খন্ডের দুইশত ষাট পৃষ্ঠায় মাযহাব ও দলীল বর্ণনার পর লিখেছেন, আল্লামা ইবনে আবদুল বার সাহাবায়ে কিরামের আদিল হওয়ার ব্যাপারে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের ইজমা উল্লেখ করেছেন। এ বর্ণনা ইবনে সালাহর বর্ণনা থেকে উত্তম। তিনি এটাকে সমগ্র উম্মতের ইজমা বলে বর্ণনা করেছেন যে, গোটা উম্মত তামাম সাহাবীর আদিল হওয়ার উপর একমত। তবে ইবনে সালাহর এ কথা, ‘সাহাবায়ে কিরাম থেকে যাঁরা ফিতনায় জড়িয়ে পড়েছেন, তাঁদের আদালতের ব্যাপারে উম্মতের নির্ভরযোগ্য অংশের ইজমা রয়েছে’- বড়ই চমৎকার। ইমাম সুবকী এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত উল্লেখ করেছেন যে, আমরা ফালতু লোকদের অর্থহীন বাক-বিতন্ডা ও বাতিল মতালম্বীদের গুমরাহী কথাবার্তার প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে সাহাবায়ে কিরামের আদালতের ব্যাপারে দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করি। পূর্বে বর্ণিত হয়েছে যে, আমাদের নিকট একজন ব্যক্তির সত্যায়নও যথেষ্ট। সুতরাং আসমান-যমীনের বিন্দু পরিমাণ জিনিসও যাঁর অদৃশ্য নয়, সেই আলীমুল গায়িব সত্তা স্বয়ং যাঁদেরকে পূত ও পবিত্র বলে ঘোষণা দিয়েছেন, সেখানে তাঁদের পূত ও পবিত্র হওয়ার ব্যাপারে কি সন্দেহ থাকতে পারে। এছাড়াও যাঁর সমস্ত আদত-অভ্যাসকে আল্লাহ তাআলা ভুল থেকে নিষ্পাপ রেখেছেন সেই সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব সত্তা হযরত মুহাম্মদ ﷺ অসংখ্য হাদীসে তাঁদেরকে পূত ও পবিত্র আখ্যা দিয়েছেন। তাঁদের পরস্পরে সংঘটিত বিষয়াবলীকে আমরা আল্লাহ তাআলার সোপর্দ করি। যারা সাহাবায়ে কিরামকে গালমন্দ করে আমরা তাদের ব্যাপারে আল্লাহর দরবারে বারাআত প্রকাশ করি। সাহাবায়ে কিরামের নিন্দা-সমালোচনাকারী অতল গুমরাহী ও পরিষ্কার ধ্বংসের মাঝে নিপতিত বলে আমরা বিশ্বাস করি। আমরা আরো বিশ্বাস করি, হযরত উসমান রাযি. ইমামে হক ছিলেন। তিনি মযলুমভাবে শহীদ হয়েছেন। আল্লাহ তাআলা সাহাবায়ে কিরামকে তাঁর হত্যায় অংশ নেওয়া থেকে রক্ষা করেছেন। তাঁর হত্যাকারীরা ছিল অত্যন্ত দুরাত্মা ও শয়তান। সকল সাহাবী এ কাজের তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। অতঃপর হযরত উসমান হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার ব্যাপারটি ছিল ইজতেহাদী। হযরত আলীর মত ছিল বিলম্ব করার মাঝেই কল্যাণ নিহিত। পক্ষান্তরে হযরত আয়েশা মনে করতেন অবিলম্বে বিচার হওয়া উচিত। প্রত্যেকে নিজস্ব ইজতেহাদের উপর আমল করেছেন। ইনশাআল্লাহ তাঁরা আল্লাহর নিকট সওয়ার লাভ করবেন। হযরত যুন-নূরাইন (উসমান) রাযিয়াল্লাহু আনহুর পর ইমামে হক হলেন হযরত আলী রাযি.। হযরত মুআবিয়া রাযি. ও তাঁর জামাআত ছিল তাবীলকারী (ইজতেহাদকারী)। আর তাঁদের মধ্যে এমন লোকও ছিলেন যাঁরা উভয় দল থেকে পৃথক ছিলেন এবং উভয়ের পক্ষালম্বন থেকে বিরত ছিলেন। কারণ বিষয়টির ব্যাপারে তাঁদের অন্তরে বিভিন্ন শক-সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছিল। মোটকথা, সবাই নিজ নিজ ইজতেহাদের উপর আমল করেছেন এবং সবাই আদিল ছিলেন। তাঁরাই হলেন এ দীনের বর্ণনাকারী এবং বুলন্দকারী। তাঁদেরই তরবারীর বদৌলতে এ দীন বিজয়ী আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাঁদেরই যবানে দূর-দূরান্তে প্রচারিত হয়েছে এ দীন। সাহাবায়ে কিরামের ফযীলত সম্পর্কিত আয়াত ও হাদীসগুলো যদি আমরা এখানে বর্ণনা করি তবে আলোচনা অনেক দীর্ঘ হয়ে যাবে। সুতরাং একথা গুলো এমন সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত যে, যে এর খেলাফ আকীদা রাখবে নিশ্চিতভাবে গুমরাহী ও বিদআতের মাঝে নিপতিত হবে। প্রত্যেকেই উল্লেখিত বক্তব্যের নিরিখে আকীদা পোষণ করা উচিত। তাঁদের মাঝে যা সংঘটিত হয়েছে, সে ব্যাপারে মুখ সংযত রাখা উচিত। যে রক্ত থেকে আল্লাহ তাআলা আমাদের হাত পবিত্র রেখেছেন, আমাদের উচিত স্বীয় যবানকে তাতে সম্পৃক্ত করা থেকে রক্ষা করা। মোদ্দা কথা তাঁরা হলেন এ উম্মতের শ্রেষ্ঠ জামাআত। তাঁদের প্রত্যেকেই পরবর্তী সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ, পরবর্তীগণ ইলম আমলে যতই সুউচ্চ মর্যাদার অধিকারী হোন না কেন।
ফাওয়াতিহুর রাহমূত শরহে মুসাল্লামুস সুবূত গ্রন্থের দ্বিতীয় খন্ডে ১৫৬ পৃষ্ঠায় লিপিবদ্ধ আছে, জেনে রাখা ভাল, বদরী ও বায়আতুর রিযওয়ানে অংশগ্রহণকারী সাহাবায়ে কিরামের আদালত অকাট্য। এ ব্যাপারে কোন মুসলমানের সন্দেহ পোষণ করার আদৌ অবকাশ নেই; বরং মক্কা বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণকারী সকল সাহাবীর আদালতও অকাট্য। মুহাজির আনসার সবাই এর অন্তভুর্ক্ত। কেবল মক্কা বিজয়কালীন ইসলাম গ্রহণকারীদের ব্যাপারে কিছুটা দ্বিধা পরিলক্ষিত হয়। কারণ তাঁদের মাঝে মুয়াল্লাফাতুল কুলূবগণও (যাঁদেরকে ঈমানের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত করার মানসে যাকাত ও যুদ্ধলব্ধ সম্পদ থেকে হিসসা প্রদান করা হতো) অন্তর্ভূক্ত ছিল। কিন্তু আমাদের জন্য ওয়াজিব হল তাঁদেরও গুণাবলী ছাড়া অন্য আলোচনা থেকে যবানকে সংযত রাখা।
সারকথা হল, হকপন্থী সমস্ত আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত এ ব্যাপারে একমত যে, তামাম সাহাবায়ে কিরাম রাযিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন আদিল এবং নির্ভরযোগ্য। তাঁদের থেকে বর্ণিত রেওয়ায়েত ও সাক্ষী গ্রহণযোগ্য এবং নির্ভরযোগ্য। তাঁদের ব্যাপারে কোন ধরনের যাচাই-বাছাই এবং সমালোচনার অবকাশ নেই। এ বিষয়ে নকলী-আকলী তথা বর্ণনানির্ভর-যুক্তিনির্ভর প্রভূত দলীল বিদ্যমান রয়েছে। তাঁদেরই উসীলায় পরবর্তীদের নিকট দীন পৌঁছেছে। তাঁরা দীনের কেন্দ্রবিন্দু এবং হকের মাপকাঠি। পরবর্তীদের জন্য তাঁদের অনুসরণ করা অপরিহার্য।
সূরা তাওবায় ইরশাদ হয়েছে,
يايها الذين أمنوا اتقوا الله وكونوا مع الصادقين
সূরা হাশরে মুহাজিরদের সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে,
للفقراء المهاجرين الذين اخرجوا من ديارهـم واموالهـم يبتغون فضلا من الله ورضوانا وينصرون الله ورسولـه اولئك هم الصادقون
সূরা লুকমানে ইরশাদ হয়েছে, واتبع سبيـل من اناب الى
উল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, সমগ্র উম্মতের জন্য তাঁদের অনুসরণ, যিহনী গুলামী ও তাঁদের সাথে থাকা ওয়াজিব। এ বিষয়টি উসূলী (মৌলিক), সাধারণ উসূলী নয়; বরং এরই উপর পুরো দীন, কিতাব ও সুন্নাহর ভিত্তি। এখন এর মুকাবিলায় মওদূদী সাহেব রচিত গঠনতন্ত্রের উক্ত ধারা আবার লক্ষ করুন। তিনি পরিষ্কার লিখেছেন, জনাব রাসূলুল্লাহ ﷺ (রাসূলে খোদা) ব্যতীত আর না কেউ সত্যের মাপকাঠি, না কেউ সমালোচনার উর্ধ্বে, না কেউ অনুসরণাবশ্যকীয় (যিহনী গুলামীর উপযুক্ত) এবং তাকলীদের যোগ্য। একটু চিন্তা করুন, উক্ত ধারাটি কি পরিমাণ হক ও হক্কানিয়ত পরিপন্থী, ফিতনা সৃষ্টিকারী এবং দীন বিধ্বংসী। যদি সাহাবায়ে কিরাম মিয়ারে হক না হন, তবে কুরআনে কারীমের উপর কিভাবে নির্ভর করা যাবে যে, এটা ঐ কালাম যা হযরত মুহাম্মদ ﷺ-এর উপর অবতীর্ণ হয়েছে; আর এতে কোন ধরনের পরিবর্তন-পরিবর্ধন এবং হ্রাস-বৃদ্ধি সংঘটিত হয় নি। কারণ মওদূদী সাহেবের বক্তব্য অনুসারে রাসূলে খোদা ব্যতীত আর কোন মানুষ যখন মিয়ারে হক থাকেন না, তখন এই কুরআন আমাদের নিকট অবশ্যই হক্কানী লোকদের মাধ্যমে পৌঁছে নি। তখন এই নিশ্চয়তা কতটুকু থাকবে যে, এতে কোন হ্রাস-বৃদ্ধি ও বিকৃতি এবং পরিবর্তন সংঘটিত হয়নি। আর এই প্রশ্ন হাদীসের বেলায়ও দেখা দিবে। যখন কোন মানুষ সমালোচনার উর্ধ্বে নয়, তখন এই সুন্নত অবশ্যই দোষযুক্ত বর্ণনাকারীদের মাধ্যমে আমাদের নিকট পৌঁছেছে। আর যখন তাঁদের কেউ দোষমুক্ত নন, তখন এই সুন্নতের কতটুকু গ্রহণযোগ্যতা থাকবে! যখন হযরত মুহাম্মদ ﷺ ব্যতীত আর কোন মানুষ অনুসরণাবশ্যকীয় (যিহনী গুলামীর উপযুক্ত) নয়, তখন অন্য কারো কথা ও কাজ কি করে অনুকরণীয় গণ্য হবে?
যাহোক, আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের উসূল এই যে, সমস্ত সাহাবী আদিল ও নির্ভরযোগ্য। তাঁদের কেউই সন্দেহযুক্ত এবং অনির্ভরযোগ্য নন। আর মওদূদী সাহেবের কথা হল সাহাবী কিংবা তাঁদের পরবর্তী কেউই মিয়ারে হক নন, যাচাই-বাছাই ও সমালোচনার উর্ধ্বে নন, তাঁদের অনুসরণ জরুরি নয়। অনুধাবন করুন, এটা কি পরিমাণ উসূলী প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং এই উসূলের দ্বারা দীনের কি পরিমাণ ক্ষতি সাধন হবে!
মওদূদী সাহেব তাফহীমাত প্রথম খন্ডে লিখেন,
ان سب سے بڑھ کر عجیب بات یہ ہے کہ بسا اوقات صحابہ رضی اللہ عنہم پر بھی بشری کمزوریوں کا غلبہ ہو جاتا تھا اور وہ ایک دوسرے پر چوٹیں کر جاتے تھے۔ ابن عمرؓ نے سنا کہ ابو ہریرہؓ وتر کو ضروری نہیں سمجھتے۔ فرمانے لگے کہ ابو ہریرہؓ جھوٹے ہیں۔ حضرت عائشہ نے ایک موقع پر انس اور ابو سعید خدری رضی اللہ عنہما کے متعلق فرمایا کہ وہ حدیث رسول اللہ کو کیا جانیں، وہ تو اس زمانے میں بچے تھے۔ حضرت حسن بن علی سے ایک مرتبہ شَاھِدٍ وَّ مَشْھُوْدٍ کے معنی پوچھے گئے۔ انھوں نے اس کی تفسیر بیان کی۔ عرض کیا گیا کہ ابن عمرؓ اور ابن زبیرؓ تو ایسا اور ایسا کہتے ہیں۔ فرمایا دونوں جھوٹے ہیں۔ حضرت علی رضی اللہ عنہ نے ایک موقع پر مغیرہ بن شعبہ کو جھوٹا قرار دیا۔ عبادہ بن صامت نے ایک مسئلہ بیان کرتے ہوئے مسعود بن اوس انصاری پر جھوٹ کا الزام لگا دیا، حالانکہ وہ بدری صحابہ میں سے ہیں- ترجمان القرآن۔ صفر ١٣٥٦ھ- مئ ۱۹۳۷ء؛ مولانا سید ابوا لاعلیٰ مودودی: تفہیمات (حصہ اول)؛ مرکزی مکتبہ اسلامی پبلشرز، نئ دہلی؛ اشاعت اول: جون ٢٠٠١ ء؛ صفحہ ٣٥٨
অর্থাৎ “এসব কিছুর চাইতেও বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, بسا اوقات সাহাবায়ে কেরামের ওপরও মানবিক দুর্বলতা প্রভাবশালী হয়ে বসতো এবং তাঁরা একে অপরের ওপর কঠোর আঘাত হানতেন। একবার ইবনে উমর (রা) শুনতে পেলেন যে, আবু হোরায়রা বেতেরকে আবশ্যকীয় মনে করেন না। অমনি বললেনঃ ‘আবু হোরায়রা মিথ্যাবাদী।’ হযরত আয়েশা একবার আনাস (রা) এবং আবু সাাঈদ খুদরী (রা) সম্পর্কে বলেন যে, ‘ওরা হাদীসে রসূলের কী জানে। ওরা তো তখন শিশু ছিলো।’ হযরত হাসানের কাছে একবার شَاهِدٍ وَّ مَشْهُوْدٍ এর অর্থ জিজ্ঞেস করা হয়। তিনি তার অর্থ বিবৃত করলেন। বলা হলো যে, ইবনে উমর (রা) এবং ইবনে জোবায়ের (রা) তো এমন এমন বলেন। তিনি বললেনঃ ‘ওরা উভয়ে মিথ্যাবাদী।’ হযরত আলী (রা) একবার মুগীরাহ বিন শো’বাকে মিথ্যাবাদী আখ্যা দেন। উবাদাহ্ বিন ছামেত একদা একটি মাসয়ালা বর্ণনা প্রসঙ্গে মাসউদ বিন আওস আনসারীকে মিথ্যাবাদী বলে অভিযুক্ত করেন অথচ তিনি ছিলেন বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবীদের অন্যতম।” [নির্বাচিত রচনাবলী ১ম খন্ড/দ্বিতীয় ভাগ, মূল: সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী, অনুবাদ: মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান, ঢাকা: আধুনিক প্রকাশনী, ১ম সংস্করণ: ডিসেম্বর ১৯৯২, পৃষ্ঠা- ১৯০]
এই লেখার উপর চিন্তা করে বলুন, মওদূদী সাহেব সাহাবায়ে কিরামের ব্যাপারে কী আকীদা পোষণ করেন এবং কী শিক্ষা দিচ্ছেন! আর তামাম আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআত আহলে হক কী বলেছেন? উভয়ের মধ্যে কী দুস্তর ব্যবধান!
মওদূদী সাহেব ঘটনাগুলোর সাথে না কোন সনদ উল্লেখ করেছেন আর না কোন নির্ভরযোগ্য কিতাবের হাওয়ালা দিয়েছেন। হ্যাঁ, কুরআন-হাদীস ও আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের ইজমার বিরুদ্ধে গিয়ে সাহাবায়ে কিরামকে অনির্ভরযোগ্য, কবীরা গুনাহগার ও সন্দেহযুক্ত সাব্যস্ত করার ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন! আর এমন লেখা উল্লেখ করেছেন যাতে সাহাবায়ে কিরামের সোনালী যুগ সাধারণ লোকদের দৃষ্টিতে সন্দেহপূর্ণ ও অগ্রহণযোগ্য হয়ে যায়।
(ক) তিনি উক্ত বক্তব্যের কোন সনদ উল্লেখ করেননি। কোন কিতাবের উদ্ধৃতিও দেননি।
(খ) কোন স্তরের সনদ তাও উল্লেখ করেননি যে, এটির মান সহীহ, হাসান বা যয়ীফ ইত্যাদি।
(গ) যেসব ঘটনার প্রতি তিনি ইঙ্গিত করেছেন, তা কস্মিনকালেও সবসময়কার এবং অধিকাংশ সাহাবীর নয়। বরং হঠাৎ সংঘটিত গুটি কয়েকজনের দূর্লভ ও বিরল ঘটনা। অথচ মওদূদী সাহেব বলেছেন, ‘بسا اوقات (অনেক সময়/বারবার) সাহাবায়ে কেরামের ওপরও মানবিক দুর্বলতা প্রভাবশালী হয়ে বসতো’। প্রথমতঃ এ ধরণের ভিত্তিহীন কথা যা ঘটনাক্রমে দু’একবার সংঘটিত হয়েছে, উল্লেখ করাই উচিত ছিল না। বিশেষতঃ যখন তা কুরআন, হাদীস ও গোটা আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। যদি উল্লেখ করতেই হত, তবে হাওয়ালা দান উচিত ছিল এবং উল্লেখ করার সময় অন্ততঃ এটা বলতেন যে, (بعض اوقات অর্থাৎ) মাঝেমধ্যে কোন সাহাবী একে অন্যের উপর আক্রমণাত্মক কথাবার্তা বলতেন। বড়ই পরিতাপের বিষয়, এহেন জঘন্য কথা উল্লেখ করা হয়েছে- তাও এমন শব্দে যাতে সবসময়কার কথা বোঝা যায়। অথচ এটা বিরল সংঘটিত ঘটনা ছিল। উপরন্তু সেসব ঘটনার অর্থও বর্তমান পরিভাষার বিপরীত ছিল যা স্পষ্ট করা হয় নি। পূর্ববর্তীদের পরিভাষায় কিযব শব্দ ‘ভুল’ অর্থেও ব্যবহৃত হত, যেটাকে হাদীসের অনেক ভাষ্যকার দলীল-প্রমাণ সহকারে উল্লেখ করেছেন। ‘মিথ্যা বলা’ অর্থে কিযব ব্যবহৃত হয় না। কারণ তা আদালতের পরিপন্থী হয়ে যায়।
কোন কোন মওদূদীপন্থী তাফহীমাতের উক্ত বক্তব্যের পক্ষে হাফিয ইবনে আবদুল বারের কিতাবুল ইলমের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। কিন্তু কিতাবুল ইলমে উক্ত বক্তব্যের সনদ কোথাও নেই। ইমাম ইবনে আব্দুল বারের পূর্বের কারো কথাও যেখানে সনদ ছাড়া গ্রহণযোগ্য নয়, সেখানে তাঁর কথা কি করে গ্রহণযোগ্য হবে। বিশেষতঃ যখন ইবনে আবদুল বার ও সাহাবায়ে কিরামের মাঝে কয়েক শতকের ব্যবধান বিদ্যমান। কোন সাহাবী দূরের কথা, তাবেয়ীর সাথেও তাঁর সাক্ষাৎ হয় নি। তিনি ৩২৮ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৪৬৩ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। তাছাড়া তাঁর রচিত গ্রন্থ আল ইসতীআবের ন্যায় কিতাবুল ইলম ততখানি প্রসিদ্ধও নয়। আমরা ইসতীআব থেকে এমন বহু বক্তব্য উল্লেখ করেছি যা কিতাবুল ইলমের বক্তব্যের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। সুতরাং এটা মূল কিতাবুল ইলমের বা ইবনে আব্দুল বারের বক্তব্য হতে পারে না বরং কোন খারিজী শিয়া বা বিদআতীর অনুপ্রবেশকৃত হবে বা উক্ত বক্তব্যের এমন অর্থ গ্রহণ করতে হবে যাতে সাহাবায়ে কিরামের আদালতে কোন প্রকার আঁচড় না লাগে। তর্কের খাতিরে যদি মেনেও নেয়া হয় উক্ত বক্তব্য হাফিয ইবনে আবদুল বারের এবং এর অর্থ তাই যা মওদূদী সাহেব বলছেন, তবে নিশ্চিতভাবে তা অগ্রাহ্য হবে। যেমন স্বয়ং ইমাম ইবনে আবদুল বার ইসতীআবে এবং হাদীস, আকায়েদ, উসূল ও ফিকাহর অন্যান্য ইমামগণ স্ব-স্ব নির্ভরযোগ্য কিতাবে তা উল্লেখ করেছেন। কুরআনে করীমের অনেক আয়াত ও বহু সংখ্যক সহীহ হাদীস দ্বারাও তা প্রমাণিত হয়।
যাহোক, এই বিরোধও মৌলিক এবং মওদূদী সাহেব এখানেও মারাত্মক ভুল এবং পরিষ্কার গুমরাহীতে নিপতিত আছেন।
স্মর্তব্য যে, সাহাবায়ে কিরাম মাসূম নন বটে, তবে মাহফূয অবশ্যই। কুরআনে করীমে ইরশাদ হয়েছে,
يثبت الله الذين امنوا بالقول الثابت فى الحياة الدنيا وفى الأخرة
অর্থাৎ যারা শাশ্বত বাণীতে বিশ্বাসী তাঁদেরকে ইহজীবনে ও পরজীবনে আল্লাহ সুপ্রতিষ্ঠিত রাখবেন। [ইব্রাহীম ২৭]
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে,
إن اولياءه الا المتقون
অর্থাৎ শুধু মুত্তাকীগণই তার তত্ত্বাবধায়ক।[আনফাল ৩৪]
এ কারণে আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামগণ ছাড়া যাঁরাই পরিপূর্ণ ঈমানদার হবেন, তাঁরাও আল্লাহ তাআলা কর্তৃক মাহফুয হওয়া প্রমাণিত এবং জরুরি। ইতিহাস গ্রন্থসমূহে সাহাবায়ে কিরামের আদালত পরিপন্থী যেসব কিচ্ছা-কাহিনী বিধৃত হয়েছে, তা মোটেও ভ্রুক্ষেপযোগ্য নয়। সেগুলো না তো তাওয়াতুরের পর্যায়ে পৌঁছে আর না সনদের দিক দিয়ে গ্রহণযোগ্য থাকে। পক্ষান্তরে আয়াতে মুতাওয়াতির এবং মশহুর সহীহ হাদীস সেসব ঐতিহাসিক বর্ণনার বিপরীত। সেসব রিওয়ায়েতের অধিকাংশগুলো শিয়া, খারিজী, মুলহিদদের গড়া এবং তারাই সুকৌশলে তা বিভিন্ন কিতাবে প্রবিষ্ট করেছে। তুহফায়ে ইসনা আশারিয়াহ গ্রন্থ ইত্যাদিতে বিস্তারিতভাবে তা বিবৃত হয়েছে। এ কারণেই মুহাদ্দিসীনে কিরামকে আসমায়ে রিজাল রচনা করতে হয়েছে। মনগড়া হাদীস সংরক্ষণ করতে হয়েছে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সত্য ও সঠিক জিনিস বুঝার তৌফিক দান করুন। আমীন।

মাওলানা মুতিউর রহমান খান সাহেব থেকে সংগৃহিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *