‘মিয়ারে হক’ পরিভাষাটি ইদানীং বহুল আলোচিত হলেও ইতিপূর্বে উর্দু বা আরবি সাহিত্যের কোথাও এর ব্যবহার দেখা যায়নি। এ পরিভাষাটি সর্বপ্রথম মওদূদী সাহেবই আবিষ্কার করেছেন এবং তা সাহাবায়ে কেরামের ক্ষেত্রে ব্যবহার করে এক নতুন আকিদার জন্ম দিয়েছেন। তিনি এবং তার অনুসারীদের মতে সাহাবায়ে কেরাম সত্যের মাপকাঠি নন। শব্দটির দ্বারা তারা আসলে কী বুঝাতে চান, সাহাবায়ে কেরামের মর্যাদাকে কোথায় যে নিয়ে যেতে চান, তাও স্পষ্ট ভাষায় বলেন না। এ সম্পর্কিত তাদের বিভিন্ন লিখনী ও বক্তব্য পর্যালোচনা করলে বুঝতে বাকি থাকে না যে, তাদের আসল উদ্দেশ্য হলো— এহেন নব আবিষ্কৃত শব্দের দ্বারা এক ধূম্রজাল সৃষ্টি করে মানুষকে গোলকধাঁধায় ফেলে সাহাবিদের প্রতি তাদের আকিদা-বিশ্বাসকে টলটলায়মান করে দেওয়া ছাড়া অন্য কিছু নয়।
★ মিয়ারে হক (معیار حق) শব্দের তাৎপর্য :
‘মিয়ার’ অর্থ মাপকাঠি-মানদণ্ড, সেই বস্তু যার দ্বারা কোনো কিছুর আসল-নকল যাচাই করা যায় এবং ‘হক’ অর্থ সত্য যা বাতিল নয়; দীন-ঈমান, ইসলাম ইত্যাদি হল হক। معيار حق অর্থ সত্যের মাপকাঠি, ঈমানের মানদণ্ড। অর্থাৎ কে সত্যের উপর এবং কে বাতিলের উপর, কার ঈমান আসল এবং কার ঈমান ভেজাল তা যাচাই হবে সাহাবায়ে কেরামের দ্বারা, তাঁদের ঈমানের দ্বারা। বস্তুত যার মত-পথ, ঈমান-আকিদা সাহাবায়ে কেরামের মত-পথ এবং ঈমান-আকিদার মতো হবে, সে সত্যের উপর বলে সাব্যস্ত হবে, তার ঈমান খাঁটি বলে বিবেচিত হবে। পক্ষান্তরে যার মত-পথ এবং ঈমান-আকিদা সাহাবায়ে কেরামের মত-পথ এবং ঈমান আকিদার পরিপন্থী হবে, সে বাতিলপন্থী এবং তার ঈমান কৃত্রিম বলে সাব্যস্ত হবে।
★ কুরআনের আলোকে সত্যের মাপকাঠি
(১) সাহাবায়ে কেরাম যে সত্যের মাপকাঠি এ কথা বোঝার জন্য দূরে যাবার দরকার নেই। কুরআন শরিফের প্রথম সূরা ফাতেহাতেই এর প্রমাণ রয়েছে। এ সূরায় আল্লাহ পাক আমাদেরকে প্রথমত اهدنا الصراط المستقيم দ্বারা সিরাতে মুস্তাকিম অন্বেষণ করার দুআ শিক্ষা দিয়েছেন। অতঃপর সিরাতে মুস্তাকিম কাকে বলে এর সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন:
صراط الذين انعمت عليهم غير المغضوب عليهم ولا الضالين
অর্থাৎ সিরাতে মুস্তাকিম তাদের পথ যারা আল্লাহ কর্তৃক পুরস্কৃত হয়েছেন ; যারা অভিশপ্ত নয় এবং পথভ্রষ্টও নয়।
তাহলে বোঝা গেল, আল্লাহর পুরস্কৃত বান্দাদের রাস্তাই হলো সিরাতে মুস্তাকিম। আর আল্লাহর পুরস্কৃত বান্দা কারা, তা তিনি অন্য আয়াতে স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন:
أولئك مع الذين أنعم الله عليهم من النبيين والصديقين والشهداء والصالحين.
অর্থাৎ যাঁদেরকে আল্লাহ পাক পুরস্কৃত করেছেন তারা হলেন চার প্রকার:- নবিগণ, সিদ্দিকগণ, শহিদগণ এবং সালেহিন তথা পূণ্যবানগণ। [সূরা নিসা : ৬৯]
এ আয়াতে নবী ব্যতীত বাকি তিনটি বিশেষণ পূর্ণাঙ্গরূপে সাহাবিদের বেলায় প্রযোজ্য— এ কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না। অতএব, প্রমাণিত হলো যে, পুরস্কৃত বান্দাগণ হচ্ছেন নবিগণ এবং সাহাবায়ে কেরাম এবং তাঁদের রাস্তার নামই হলো সিরাতে মুস্তাকিম। আর এটা জানা কথা যে, সিরাতে মুস্তাকিমই একমাত্র সত্য, সরল-সঠিক পথ এবং বাকি সব পথ বাঁকা, ভ্রান্ত, বাতিল।
সুতরাং এ আয়াতদ্বয় দ্বারা দিবালোকের মত পরিষ্কার হচ্ছে যে, আম্বিয়ায়ে কেরাম এবং সাহাবায়ে কেরাম উভয়ই সত্যের মাপকাঠি, ঈমানের মানদণ্ড। যারা আম্বিয়ায়ে কেরামের প্রদর্শিত এবং সাহাবায়ে কেরামের অনুসৃত উক্ত সিরাতের ওপর থাকবেন, তাঁরাই সত্যের ওপর বলে বিবেচিত হবেন এবং একমাত্র তাঁদের ঈমানই হবে গ্রহণযোগ্য। আর যারা বিন্দুমাত্র এর বিরোধিতা করবে, তারা বাতিলের অনুসারী এবং তাদের ঈমান মেকি বলে সাব্যস্ত হবে।
সাহাবায়ে কেরাম সত্যের মাপকাঠি হবার পক্ষে এরচেয়ে স্পষ্ট প্রমাণ আর কী হতে পারে? মওদূদী সাহেব ও তার অনুসারীগণ যদি সাহাবা-বিদ্বেষে অন্ধ না হতেন, তাহলে এতো স্পষ্ট প্রমাণাদি থেকে চোখ বন্ধ করে সাহাবায়ে কেরামের সত্যের মাপকাঠি হওয়াকে অস্বীকার করতেন না।
(২) আল্লাহ পাক অন্য আয়াতে বলেছেন:
واذا قيل لهم امنوا كما امن الناس قالوا أنؤمن كما أمن السفهاء
অর্থাৎ যখন তাদেরকে (মুনাফিকদেরকে) বলা হয়, তোমরা ঈমান আনো, যেভাবে সেই লোকেরা (সাহাবিরা) ঈমান এনেছে। তখন তারা বলে, আমরা কি বোকাদের মতো ঈমান আনব? [সূরা বাকারা : ১৩]
এই আয়াতে الناس দ্বারা সাহাবায়ে কেরামকেই বোঝানো হয়েছে। যেমন তাফসিরে জালালাইনে আছে, “এখানে ‘নাস’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো اصحاب النبي صلى الله عليه وسلم তথা নবীয়ে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবিরা।”
তাফসিরে বায়জাবিতে আছে,
والمراد به الرسول ومن معه
অর্থাৎ الناس দ্বারা রাসুল সা. ও তাঁর সাহাবিগণকেই বোঝানো হয়েছে।’
আয়াতে ‘নাস’ দ্বারা সাহাবায়ে কেরাম উদ্দেশ্য হওয়া হলো সর্বসম্মত কথা। ইবনে আব্বাস রা. বলেন,
وإذا قيل لهم أمنوا كما أمن الناس قال : صدقوا كما صدق أصحاب محمد أنه نبي ورسول وأن ما أنزل عليه حق
অর্থাৎ যখন তাদেরকে বলা হয় তোমরা ঈমান গ্রহণ করো, যেমনভাবে ঈমান এনেছে লোকেরা। অর্থাৎ তোমরা তাঁকে নবী ও রাসুল হিসাবে এবং তাঁর উপর অবতীর্ণ কিতাবকে এমনভাবে সত্যায়ন করো, যেমনভাবে সত্যায়ন করেছেন সাহাবিরা। [দুররে মানসুর, ১/৬৯]
এই আয়াতে আল্লাহ পাক স্পষ্ট ভাষায় সাহাবিদেরকে সত্যের মাপকাঠি, ঈমানের মানদণ্ড বানিয়ে বলছেন যে, সাহাবায়ে কেরাম যেরকম ইখলাস ও আন্তরিকতার সাথে, প্রেম ও ভক্তি সহকারে, অকুণ্ঠচিত্তে, অম্লান বদনে, সন্তুষ্টমনে ঈমান এনেছেন, তোমরাও তদ্রূপ ঈমান আনো। যাতে স্পষ্ট বোঝা যায়, কুরআনের ভাষায় ঈমানের যথার্থতা যাচাই করার মাপকাঠি হচ্ছে সাহাবায়ে কেরামের ঈমান। এ পরীক্ষায় যা সঠিক বলে প্রমাণিত না হবে, তা আল্লাহ ও রাসুলের নিকট ঈমান বলে স্বীকৃত হবে না। এখানে আরেকটি কথা প্রণিধানযোগ্য যে, আদর্শ ও নমুনা তথা সত্যের মাপকাঠি, ঈমানের মানদণ্ড যদি একমাত্র নবি হন, অন্য কেউ, বিশেষ করে সাহাবায়ে কেরাম যদি সত্যের মাপকাঠি না হন, তাহলে মানুষের জন্য ইসলামের উপর একটা অভিযোগ করার অবকাশ রয়ে যাবে। তারা বলবে যে, নবির মতো ঈমান আনা, আমল করা এবং গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
কারণ, নবীর ওপর আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী নাজিল হচ্ছে, তিনি সর্বদা আল্লাহর মুশাহাদায় নিমজ্জিত আছেন অর্থাৎ সবসময় অন্তর্দৃষ্টি দ্বারা আল্লাহকে প্রত্যক্ষ করছেন, তাই নবির ঈমান-আমল তো উচ্চ ধরনের হবেই। আবার নবি মাসূম, শয়তান তাঁর ধারেকাছেও যায় না। তাই তিনি গোনাহ থেকে তো বেঁচে থাকবেনই। আর আমরা হলাম এসব থেকে বঞ্চিত। সুতরাং নবীর মতো ঈমান-আমল করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে কই? খুব সম্ভবত এ কারণেই আল্লাহপাক মানুষকে ঈমানের দিকে আহ্বান করার বেলায় এরকম বলেননি أمنوا كما امن الرسول অর্থাৎ রাসুল যেমন ঈমান এনেছেন, তোমরাও তেমন ঈমান আনো। কেননা, এরকম বললে তারা উপরোক্ত অভিযোগ করতে পারে। তাই তো বলেছেন امنوا كما أمن الناس তথা ‘সেই লোকেরা অর্থাৎ সাহাবায়ে কেরাম যেমন ঈমান এনেছেন, তোমরাও তদ্রূপ ঈমান আনো।’
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! একবার চিন্তা করে দেখুন মওদূদী সাহেবের ধৃষ্টতা। আল্লাহ পাক আসমান থেকে দৃঢ়কণ্ঠে সাহাবায়ে কেরামকে সত্যের মাপকাঠি বলে ঘোষণা দিয়েছেন আর মওদূদী সাহেব জমিন থেকে এর বিরোধিতা করছেন। প্রকারান্তরে এ কথাই বলছেন যে, হে আল্লাহ! তুমি সাহাবায়ে কেরামকে সত্যের মাপকাঠি বলে ঘোষণা দিতে পার, আমি কিন্তু তা মানব না, আমার মতে তাঁরা সত্যের মাপকাঠি নন। এ কথাটা ঠিক তদ্রূপ, যেরূপভাবে আল্লাহ পাক শয়তান ও ফেরেশতাদেরকে বলেছিলেন — أسجدوا لادم “তোমরা আদমকে সিজদা করো’। তখন শয়তান বলল, ‘হে আল্লাহ! তুমি আদমকে সিজদা করার আদেশ দিতে পারো; আমি কিন্তু মানব না। আমি আদমকে সিজদা করতে পারব না। কেননা,
انا خير منه خلقتني من نار و خلقته من طين
অর্থাৎ ”আমি তার চেয়ে উত্তম, আমাকে সৃষ্টি করেছো আগুন দ্বারা এবং তাঁকে সৃষ্টি করেছো মাটি দ্বারা।” হায়! কত বড় দৌরাত্ম্য, কত বড় দুঃসাহস!
(৩) আল্লাহ পাক কুরআন শরিফের অন্যত্র বলেছেন:
فَإِنْ آمَنُوا بِمِثْلِ مَا آمَنتُم بِهِ فَقَدِ اهْتَدوا وَإِن تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا هُمْ فِي شِقَاقٍ
অর্থাৎ তোমরা যেরূপ ঈমান এনেছ, তারাও (তথা ইহুদিগণ) যদি তদ্রূপ ঈমান আনে, তাহলে তারা হবে হেদায়াতপ্রাপ্ত। আর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে তারা রয়ে যাবে খোদাদ্রোহীতার মধ্যে। [সূরা বাকারা: ১৩৭]
এ আয়াতে ‘তোমরা’ বলে সাহাবায়ে কেরামকেই সম্বোধন করা হয়েছে। কেননা, তারাই হলেন কুরআনের প্রথম সম্বোধিত। সুতরাং বোঝা গেল, সাহাবায়ে কেরামের মতো ঈমান আনার নামই হলো হেদায়াত এবং এর বিপরীত হলো গুমরাহি ও খোদাদ্রোহিতা।
এ আয়াতে আল্লাহ তা’আলা স্পষ্ট ভাষায় সাহাবায়ে কেরামকে সত্যের মাপকাঠি, ঈমানের মানদণ্ড বলে ঘোষণা দিয়েছেন যা ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না।
(৪) অন্য আয়াতে আল্লাহ পাক ঘোষণা করেছেন:
وَمَن يُشَاقِقِ الرَّسُولَ مِن بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَى وَيَتَّبِع غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ نوَلِهِ مَا تَوَلَّى وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ
অর্থাৎ হেদায়েতের পথ স্পষ্ট হওয়ার পরও যে ব্যক্তি রাসুলের বিরুদ্ধাচরণ করবে এবং ঈমানদারগণের (সাহাবিগণের) পথ ছাড়া ভিন্নপথ অবলম্বন করবে, সে দুনিয়াতে যে দিকে ফিরে, আমি ফিরতে দিবো এবং পরকালে তাকে জাহান্নামের অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করব। [সূরা নিসা: ১১৫]
এ আয়াতে ‘ঈমানদারগণ’ বিশেষণটির সর্বপ্রথম অধিকারী এবং সর্বপ্রথম পাত্র হলেন সাহাবায়ে কেরাম। কেননা, আয়াত নাজিল হওয়ার সময় ঈমানদার তো তাঁরাই ছিলেন। আয়াতের শানে নুজুলের দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা সহজেই বুঝতে পারি যে, এখানে মুমিনের পথ দ্বারা সাহাবায়ে কেরাম উদ্দেশ্য।
আয়াতটিতে واو অক্ষরটি হলো حرف عطف – সংযোজক অক্ষর। আর এর বিভিন্ন প্রকারের মধ্যে এক প্রকার হলো عطف تفسير – ব্যাখ্যামূলক সংযোজন এবং এ আয়াতে এই প্রকারই অর্থাৎ ‘রাসুলের বিরুদ্ধাচরণ কী?— এর ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে যে, সাহাবায়ে কেরামের বিপরীত পথ অবলম্বনের নামই হলো রাসুলের বিরুদ্ধাচরণ। অতঃপর রাসুলের বিরুদ্ধাচরণ তথা সাহাবিগণের বিপরীত পথ অবলম্বনের উপর দুনিয়াতে গুমরাহি ও পরকালে জাহান্নামের অগ্নিকুণ্ডের ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে।
প্রিয় পাঠক! এখানে প্রণিধানযোগ্য, আয়াতে শুধুমাত্র— ‘যে রাসুলের বিরুদ্ধাচরণ করবে’— বলে দেওয়াই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু তা না করে ويتبع غير سبيل المؤمنين (এবং যে সাহাবিগণের বিপরীত পথ অবলম্বন করবে) বাক্যটি বাড়ানো হয়েছে এ কথাটা বোঝানোর জন্য যে, রাসুল যেমন সত্যের মাপকাঠি, সাহাবিগণও তেমন সত্যের মাপকাঠি। কেননা, সাহাবায়ে কেরামই হচ্ছেন রাসুলের আদর্শের মূর্তপ্রতীক, পূর্ণ নমুনা। তাই সাহাবিদের বিরুদ্ধাচরণের নামই হলো রাসুলের বিরুদ্ধাচরণ এবং তাঁদেরকে মানার নামই হলো রাসুলকে মানা।
(৫) আল্লাহ পাক অন্যত্র বলেছেন:
إنا نحن نزلنا الذكر وإنا له لحافظون
অর্থাৎ আমি এই কুরআন অবতীর্ণ করেছি এবং আমি এর হেফাজতকারী। [সূরা হিজর : ৯]
এ আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ পাক কুরআন তথা দীনে ইসলামের হেফাজতের দায়িত্ব নিজে বহন করে নিয়েছেন এবং হেফাজত করবেন বলে ওয়াদা ও ঘোষণা দিয়েছেন। অবশ্য তিনি হেফাজত করবেন মানুষের দ্বারাই, মানুষের মাধ্যমেই। প্রত্যেক যুগে তিনি এমন একদল রক্ষীবাহিনী সৃষ্টি করবেন যাঁরা তাঁর অদৃশ্য ইঙ্গিতে হেফাজতে দীনকে নিজেদের জীবনের আসল ব্রত ও মূল লক্ষ্য মনে করে এর হেফাজত করবেন। যাতে বোঝা যায় যে, দীনে ইসলাম কিয়ামত পর্যন্ত তার আসল রূপ ও সত্যিকার স্বরূপ নিয়ে বিদ্যমান থাকবে। এ আয়াতের মর্ম পূর্ণাঙ্গরূপে অনুধাবন করার জন্য ইহা জানা দরকার যে, হেফাজত কয় প্রকার ও কি কি?
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! হেফাজত ও সংরক্ষণ দু’প্রকার:
১. ইলমি অর্থাৎ শব্দগত ও অর্থগত সংরক্ষণ।
২. আমলি ও বাস্তব রূপটির সংরক্ষণ।
অন্য কথায়, হেফাজত দু’প্রকার: থিওরিটিক্যাল ও প্র্যাকটিক্যাল। কারণ, ইসলাম শুধু কতিপয় নীতিমালা, থিওরি এবং জ্ঞান ও মতবাদের নাম নয়; বরং ইসলাম মানুষের কর্মবহুল জীবনের প্রত্যেক ক্ষেত্রে সুষ্ঠু, কর্মপন্থার নির্দেশও দিয়ে থাকে। ইসলাম যেখানে মানুষের জীবনের প্রত্যেক স্তরে নীতির দিশারী হয়, সেখানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রত্যেকটি বিষয়ের আমলি সকল কার্যকর পন্থা ও বাস্তব রূপটিও তুলে ধরে এবং সেই বিধান মোতাবেক কিভাবে আমল করতে হয় তা হাতে-কলমে দেখিয়ে দেয়। কাজেই শরিয়তে মুহাম্মদির ইলমি-আমলি উভয় দিকের পূর্ণ হেফাজতের প্রয়োজন। আল্লাহ পাক উক্ত আয়াতে শুধু অর্ধেক হেফাজতের ঘোষণা দেননি; বরং ইলমি-আমলি উভয় দিকের পূর্ণ হেফাজতের ঘোষণা দিয়েছেন।
হজরত রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দীর্ঘ ২৩ বছরে আসমানি ওহির পূর্ণ তত্ত্বাবধানে নিজ হাতে এক জামাতের আদত-আখলাক, ঈমান-আমল ইত্যাদি নিখুঁতভাবে গঠন করে নমুনা রেখে যান এবং সুসংবাদ দেন যে, আল্লাহ পাক এই বাস্তব রূপের সিলসিলাও কিয়ামত পর্যন্ত অক্ষত অবস্থায় কায়েম রাখবেন, তারা শরিয়তের ইলম ও আমল উভয় বস্তুর ধারক-বাহক ও আমানতদার হবেন। এভাবে শরিয়তে মুহাম্মদির ইলমি-আমলি হেফাজত হয়ে আসছে এবং হতে থাকবে। এর কোন একটা বিন্দুবিসর্গও এ যাবৎ রদবদল হয়নি, আর কখনো হবে না। যারা রদবদলের অপচেষ্টা করেছে, তারা তাদের তল্পিতল্পাসহ ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। এখন যদি সাহাবায়ে কেরাম সত্যের মাপকাঠি না হন, তাহলে বোঝা যাবে যে, তাঁরা কুরআনের আদর্শে পূর্ণাঙ্গরূপে আদর্শবান হতে পারেননি, মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমলের পূর্ণ নমুনা হতে পারেননি এবং তাঁরা কুরআন ও হাদিসের ওপর পরিপূর্ণভাবে আমল করতে পারেননি। আর সাহাবায়ে কেরাম মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ছাত্র হয়েও তাঁর তত্ত্বাবধানে থেকেও যদি কুরআন-হাদিসের উপর পূর্ণভাবে আমল করতে না পারেন, তবে পরবর্তীতে তো আর কেউ পারবেই না। ফলশ্রুতিতে প্রমাণিত হবে যে, দীনে ইসলামের আমলি হেফাজত হয়নি। তখন মওদূদী সাহেব ও তার অনুসারীদের কথামতে আল্লাহর উপর্যুক্ত ওয়াদা ও ঘোষণার অর্ধেক মিথ্যা সাব্যস্ত হয়ে যাবে (نعوذ بالله)। হায়! মওদূদী সাহেবের ধৃষ্টতা দেখে বলিহারী যাই।
(৬) আল্লাহ পাক অন্যত্র এরশাদ করছেন:
وَالسَّابِقُونَ الْأَوَّلُونَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُم بِإِحْسَانٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي تَحْتَهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا
অর্থাৎ প্রথম পর্যায়ের মুসলমানগণ (অর্থাৎ মুহাজির ও আনসারগণ) এবং যারা পুণ্যকাজে তাদের অনুসরণ করেছে, আল্লাহ তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তাঁরা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট এবং আল্লাহ তাঁদের জন্য জান্নাত তৈরি করে রেখেছেন, যার আশেপাশে স্রোতস্বিনী প্রবাহিত। তাঁরা সেখানে চিরকাল অবস্থান করবে। [সূরা তাওবা: ১০০]
তাফসিরে রুহুল মাআনিতে আছে,
والمراد بالسابقين جميع الانصار والمهاجرين رضي الله عنهم و معنى كونهم سابقين أنهم أولون بالنسبة إلى سائر المسلمين و كثير من الناس ذهب الى هذا
অর্থাৎ উক্ত আয়াতে السابقين দ্বারা সমস্ত আনসার ও মুহাজির সাহাবাকে বোঝানো হয়েছে। কেননা, অন্যান্য সকল মুসলমানদের তুলনায় তারা সর্বাগ্রে ঈমান এনেছেন। [১১\৭]
আল্লামা ইবনে জারির তাবারি রহ. এ আয়াতের তাফসির করতে গিয়ে বলেন, এ আয়াতে ‘পূর্ববর্তী দল’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, মুহাজিরদের থেকে যারা সবার আগে ঈমান এনেছেন, এরপর পরিবার-পরিজন, গোত্র, বাসস্থান এবং দেশ ছেড়ে হিজরত করেছেন। আর সে সমস্ত আনসার যাঁরা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সাহায্য করেছেন কাফেরদের বিরুদ্ধে। [তাফসিরে ইবনে জারির তাবারি, ১৪/৪৩৪]
এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, সমস্ত সাহাবিদের উপর আল্লাহ সন্তুষ্ট এবং সবাই জান্নাতি। বরং যাঁরা নিষ্ঠার সাথে তাঁদের অনুসরণ করবে, তাঁরাও জান্নাতি হবে এবং আল্লাহ তাঁদের প্রতিও সন্তুষ্ট হবেন।
(৭) অন্যত্র আল্লাহ পাক বলেছেন:
لقد رضي الله عن المؤمنين إذ يبايعونك تحت الشجرة فعلم ما في قلوبهم فأنزل السكينة عليهم
অর্থাৎ আল্লাহ মুমিনদের প্রতি নিশ্চয় প্রসন্ন হলেন, যখন তাঁরা বৃক্ষতলে আপনার নিকট বাইআত গ্রহণ করছিল এবং আল্লাহ তাঁদের অন্তরের সবকিছু অবগত ছিলেন, আল্লাহ তাঁদের উপর শান্তি বর্ষণ করলেন।
আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজিদে সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে বারংবার رضی الله عنهم ورضوا عنه তথা আল্লাহ তাঁদের উপর সন্তুষ্ট এবং তাঁরাও আল্লাহর উপর সন্তুষ্ট বলে সুসংবাদ দিয়েছেন আর বিশ্ববাসীর সম্মুখে এতো অধিক পরিমাণে ঘোষণা দিয়েছেন যে, উক্ত প্রশংসাসূচক বাক্যটি তাঁদের উপাধিতে পরিণত হয়ে গেছে। কোনো নবির নাম উচ্চারণ করলে যেমন عليه السلام বলা কর্তব্য, তেমনি কোনো সাহাবির নাম উচ্চারণ করলে رضى الله عنه বলা একান্ত কর্তব্য। যদি কেউ রাসুলের কোনো সাহাবির নামের সঙ্গে رضى الله عنه বলে না, তাহলে সে শরিয়তের দৃষ্টিতে বেদআতি বলে বিবেচিত হবে।
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! আল্লাহ পাক কুরআন শরিফে যাঁদের প্রতি স্বীয় সন্তুষ্টির ঘোষণা দিলেন, তাঁদের জন্য আর কোন ডিগ্রি বাকি থাকল? আল্লাহ কি তাঁদের শুধু বাহ্যিক অবস্থা দেখে ঘোষণা দিয়ে ফেলেছেন? বরং তাঁদের অন্তর-বাহির, ভূত-ভবিষ্যত সবকিছু দেখে আল্লাহ স্বীয় সর্বজ্ঞানের ভিত্তিতে এ ঘোষণা দিয়েছেন, যার দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মৃত্যু পর্যন্ত সাহাবায়ে কেরাম থেকে আল্লাহর সন্তুষ্টির পরিপন্থী কোনো আচরণ প্রকাশ পাবে না। অতঃপর ورضوا عنہ – তাঁরাও আল্লাহর উপর সন্তুষ্ট বলে তাঁদের মর্যাদাকে আরও বৃদ্ধি করে দিয়েছেন।
আম্বিয়ায়ে কেরামের পর সাহাবিগণ ব্যতীত দুনিয়ার বুকে আর কোনো মানুষ কি এমন পাবেন, যার প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট বলে নিশ্চয়তা দিতে পারেন? হায়! বড়ই আক্ষেপের বিষয়, যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি, আল্লাহর সাদর সম্ভাষণ, আদর-অভিবাদন লাভে ধন্য, পুণ্যবান ও মহিমান্বিত হলেন, তাঁরাই আজ মওদূদী সাহেবের নিকট সত্যের মাপকাঠি নন!
(৮) আল্লাহ পাক অন্যত্র বলছেন:
لَا يَسْتَوِي مِنكُم مَّنْ أَنفَقَ مِن قَبْلِ الْفَتْحِ وَقَاتَلَ أُولَئِكَ أَعْظَمُ دَرَجَةٌ مِنَ الَّذِينَ أَنفَقُوا مِن بَعْدُ وَقَاتَلُوا وَكُلًّا وَعَدَ اللَّهُ الْحُسْنَى
অর্থাৎ যাঁরা মক্কা বিজয়ের পূর্বে দান করেছে ও জিহাদ করেছে, তাঁদের সমকক্ষ এরা হতে পারবে না, যাঁরা মক্কা বিজয়ের পরে দান ও জিহাদ করেছেন। প্রথমোক্তদের মর্যাদা অনেক বেশি। আর প্রত্যেকের সঙ্গে আল্লাহ হুসনার অঙ্গীকার করেছেন। [সূরা হাদীদ : ১০]
এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, সাহাবায়ে কেরামের পরস্পরের মধ্যে মর্যাদার ব্যবধান থাকলেও সব কিন্তু জান্নাতি। হুসনা অর্থ জান্নাত। কেননা, আল্লাহ পাক অন্য আয়াতে পরিষ্কার বলেছেন,
إِنَّ الَّذِينَ سَبَقَتْ لَهُم مِنَّا الْحُسْنَىٰ أُولَئِكَ عَنْهَا مُبْعَدُونَ
অর্থাৎ যারা হুসনার যোগ্য বলে আমি পূর্বেই সিদ্ধান্ত করে নিয়েছি, নিশ্চয় তাঁরা দোজখ থেকে দূরে থাকবে। [সূরা আম্বিয়া : ১০১]
উভয় আয়াত মিলালে হুসনার অর্থ জান্নাত বলে সাব্যস্ত হয়। তাই মুফাসসিরিনে কেরামগণ অকুণ্ঠচিত্তে হুসনার অর্থ ‘জান্নাত’ দ্বারাই করেছেন। দেখুন, আল্লাহ পাক কুরআন শরিফে স্পষ্ট ভাষায় সব সাহাবিকে বেহেশতের সুসংবাদ দান করলেন। তাই কোনো একজন সাহাবিও জাহান্নামে যাবেন না। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো ১০ জন সাহাবিকে এক মজলিসে বেহেশতের সুসংবাদ দান করেছেন যারা عشرة مبشرة উপাধিতে প্রসিদ্ধ। সাধারণভাবে সবাইকে বেহেশতের সুসংবাদ দান করেন। জাবের রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
لا تمس النار مسلما رأنی
অর্থাৎ আমাকে দেখেছেন এমন একজন মুসলমানকেও দোযখের অগ্নি স্পর্শ করবে না। [তিরমিজি ৩৮৫৮; জামিউস সুন্নাহ ৩৮৫৮; ইমাম তিরমিজি রহ. বলেন, হাদিসটি হাসান এবং গারিব]
হায়! আল্লাহ ও রাসুল যাদেরকে বেহেশতের সার্টিফিকেট দিলেন, মওদূদী সাহেব তাঁদেরকে সত্যের মাপকাঠি হবার সার্টিফিকেট দিলেন না?
(৯) দেখুন সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে আল্লাহ পাক আরও বলেছেন:
فالذين هاجروا واخرجوا من ديارهم واوذوا في سبيلي وقاتلوا وقتلوا لاكفون عنهم سيئاتهم ولادخلنهم جنات تجري من تحتها الانهار ثواباً من عند الله والله عنده حسن الثواب
অর্থাৎ যারা হিজরত করেছেন, যাদেরকে ঘরবাড়ি থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে, যারা আমার রাহে কষ্ট ভোগ করেছেন, যুদ্ধ করেছেন এবং নিহত হয়েছেন, আমি নিশ্চয় তাঁদের ভুল-ত্রুটিসমূহ মার্জনা করব এবং তাঁদেরকে বেহেশতে দাখিল করব যার আশেপাশে স্রোতস্বিনী প্রবাহিত। এটা হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিদান, আর আল্লাহর কাছে রয়েছে উত্তম প্রতিদান।
এ আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সাহাবায়ে কেরামের ত্যাগ-তিতিক্ষা, চেষ্টা-সাধনা, দীনের খাতিরে কষ্ট ও নির্যাতন ভোগ, হিজরত, জিহাদ ইত্যাদি সবকিছু সাদরে গ্রহণ করে তাদের মার্জনার ওয়াদা দিচ্ছেন এবং জান্নাতের সুসংবাদ দান করছেন। এরপর সত্যের মাপকাঠি হবার জন্য আর কী বাকি থাকল?
(১০) অন্য আয়াতে আছে-
يَوْمَ لَا يُخْزِي اللَّهُ النَّبِيَّ وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَهُ نُورُهُمْ يَسْعَى بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَبِأَيْمَانِهِمْ الخ
অর্থাৎ আল্লাহ নবিকে এবং তাঁর সাথে ঈমানদার যারা আছে, তাঁদেরকে কিয়ামতের দিন কোনো প্রকার অপমান করবেন না, লজ্জা দিবেন না। তাদের ঈমানের নূর তাদের সম্মুখে ও চারিপার্শ্বে ঝলমল করতে থাকবে। [সূরা তাহরীম : ৮]
যাঁদেরকে আল্লাহ পাক কোনো প্রকার লজ্জা পর্যন্ত দিবেন না বলে ঘোষণা করে দিলেন, হায় তাঁরা বুঝি মওদূদী সাহেবের নিকট সত্যের মাপকাঠি হতে পারছেন না।
পাঠক! উপর্যুক্ত আয়াতসমূহ দ্বারা এ কথা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে যায় যে, সাহাবায়ে কেরাম সত্যের মাপকাঠি।
★ হাদিসের আলোকে সত্যের মাপকাঠি
সাহাবায়ে কেরাম সত্যের মাপকাঠি হওয়ার বিষয়টি যেমনভাবে কুরআনের অসংখ্য আয়াত দ্বারা প্রমাণিত, ঠিক তেমনি এ ব্যাপারে অসংখ্য সহিহ হাদিস বর্ণিত হয়েছে। এখানে পাঠকের প্রশান্তির জন্য কয়েকটি হাদিস উল্লেখ করছি।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
ان بني اسرائيل تفرقت على ثنتين وسبعين ملة وستفترق أمتي على ثلث وسبعين ملة كلهم في النار الا واحدة – قالوا من هم يا رسول الله قال : ما انا عليه واصحابي و في رواية قالوا من هم يا رسول الله قال أهل السنة والجماعة فقيل ومن اهل السنة والجماعة فقال ما انا عليه واصحابي.
অর্থাৎ মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন বনি ইসরাইল ৭২ দলে বিভক্ত হয়েছিল এবং আমার উম্মত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে, তাদের সকলেই হবে জাহান্নামি, কেবলমাত্র একটি দল ছাড়া। প্রশ্ন করা হলো, হে আল্লাহর রাসুল! সেই মুক্তিপ্রাপ্ত দল কোনটি? নবিজি উত্তর দিলেন, আমি এবং আমার সাহাবায়ে কেরাম যে তরিকা ও আদর্শের ওপর আছি এর ওপর যারা থাকবে, তারাই হবে নাজাতপ্রাপ্ত। অন্য বর্ণনামতে, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিলেন, নাজাতপ্রাপ্ত দল হলো আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত। পুনরায় প্রশ্ন করা হলো আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত কারা? নবিজি উত্তরে বললেন, আমার ও আমার সাহাবিদের তরিকা ও আদর্শ যারা মেনে চলবে তারা। [মুসনাদে আহমদ: ২/৩৩২; তিরমিজি: ২৬৪০; আবু দাউদ: ৪৫৯৬; আল মুসতাদরাক: ৪৪১। ইমাম তিরমিজি রহ. বলেন,
حديث أبي هريرة حديث حسن صحيح
অর্থাৎ আবু হুরায়রা রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হাদিসটি হলো হাসান এবং সহিহ]
এ হাদিসটি হক ও বাতিলের মাপকাঠি পরিচয়ের ব্যাপারে এক গুরুত্বপূর্ণ হাদিস।
উক্ত হাদিসে ما انا علیه – যারা আমার আদর্শের উপর থাকবে তারাই নাজাতপ্রাপ্ত বলাই যথেষ্ট ছিল, কিন্তু মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হয়তো আল্লাহর পক্ষ থেকে একথা জানতে পেরেছেন যে, আমার পরে এমন একদল আসবে যারা আমার সাহাবিদেরকে আমা থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করবে, তাঁদেরকে সত্যের মাপকাঠি, ন্যায়ের মানদণ্ড মানবে না, তাই স্পষ্ট ভাষায় واصحابي বলে সাহাবায়ে কেরামকে সত্যের মাপকাঠিস্বরূপ নির্ধারিত করে বাতিলপন্থীদের বিভ্রান্তকরণের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছেন। সুতরাং হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ন্যায় সাহাবিগণও সত্যের মাপকাঠি এবং যারা হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের মতপথ ও আদর্শ মেনে চলবে একমাত্র তারাই হবে নাজাতপ্রাপ্ত আর বাকি সব জাহান্নামি। এ হাদিস দ্বারা একথাও প্রমাণিত হলো যে, নাজাতপ্রাপ্ত দলের অপর নাম ‘আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআত’ যার অর্থই হলো সুন্নত (অর্থাৎ হাদিস) ও সাহাবায়ে কেরামের জামাতের অনুসারী। অতএব, যারা সাহাবায়ে কেরামকে অনুসরণযোগ্য ও সত্যের মাপকাঠি মানে, একমাত্র তারাই এ নামের উপযুক্ত।
শরহে আকায়েদে নাসাফির শরাহ নিবরাসের ৫০ নং পৃষ্ঠায় রয়েছে :
فسموا باهل السنة والجماعة أى أهل الحديث و اتباع اصحابه
অর্থাৎ ‘হাদিসের অনুগামী ও সাহাবায়ে কেরামের অনুসারী হওয়ার কারণেই হকপন্থী দলের নাম রাখা হলো আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত।’
শাহ ওলিউল্লাহ দেহলভি রহ. তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা নামক কিতাবে বলেন,
اقول الفرقة الناجية هم الأخذون في العقيدة والعمل جميعا بما ظهر من الكتاب والسنة و جرى عليه جمهور الصحابة والتابعين
অর্থাৎ আমি বলি যে, নাজাতপ্রাপ্ত দল তারা, যারা আকিদা ও আমল উভয় ব্যাপারে কুরআন ও হাদিস থেকে উদ্ভাসিত বিষয়াদির অনুসরণ করে এবং জমহুর সাহাবা ও তাবেয়িনের অনুসৃত পথ অবলম্বন করে। [১/১৭০]
আজ যারা সাহাবায়ে কেরামকে অনুসরণযোগ্য, সত্যের মাপকাঠি, ঈমানের মানদণ্ড মানতে দ্বিধাবোধ করে, তারা নিজেকে ‘আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআত’ বলে দাবি করতে কি তাদের শরম লাগে না? লজ্জা লাগে না? বোধ হয় তারা ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত’ নামের অর্থই বুঝতে সক্ষম হয়নি।
হজরত উমর রাযি. বর্ণনা করেন, আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন,
سألت ربي عن اختلاف أصحابي من بعدي ، فأوحى إلى : يا محمد! إن أصحابك عندي بمنزلة النجوم في السماء، بعضها أقوى من بعض. ولكل نو ، فمن أخذ بشيء مما هم عليه من اختلافهم فهو عندي على هدى
অর্থাৎ আমার পরে আমার সাহাবিদের মতভেদ সম্পর্কে আমি আল্লাহকে জিজ্ঞাসা করলাম। আমাকে ওহির দ্বারা অবহিত করা হয় যে, হে মুহাম্মদ! আপনার সাহাবিগণ আমার নিকট আকাশের তারকারাজির মতো। তাঁদের কেউ আবার অন্য থেকে অধিক দীপ্তিমান। তবে প্রত্যেকের নিকট হেদায়াতের আলো আছে, সুতরাং তাঁদের মধ্যে পরস্পর বিরোধমূলক যে কোনো বিষয় কেউ গ্রহণ করুক না কেন, সে আমার নিকট হেদায়াতপ্রাপ্ত বলে বিবেচিত হবে। [মিশকাত ৬০০৯, জামে সগির ৪৬০৩]
এ হাদিস নিয়ে মুহাদ্দিসগণ অনেক দীর্ঘ কথা বলেছেন। আমি এখানে হাদিস নিয়ে পর্যালোচনা করছি না। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, এ হাদিসের মর্মকথা কুরআনের অসংখ্য আয়াত এবং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসংখ্য সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। এজন্য এ হাদিস শাস্ত্রীয় মানদন্ডে উত্তীর্ণ না হলেও এর বিষয়বস্তু কিন্তু প্রমাণিত। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে সঠিক পথে পরিচালিত করুন।
من يعش منكم بعدى فسيرى اختلافا كثيرا فعليكم بسنتي وسنت الخلفاء الراشدين المهديين تمسكوا بها وعضوا عليها بالنواجد
অর্থাৎ তোমাদের মধ্যে যে আমার পরে বেঁচে থাকবে, সে বহু ইখতিলাফ ও মতানৈক্য দেখতে পাবে। তখন সত্যের উপর টিকে থাকতে হলে আমার ও খোলাফায়ে রাশিদিনের সুন্নাত ও আদর্শকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরবে। [আবু দাউদ: ৪৬০৭, তিরমিজি: ২৬৬, ইমাম তিরিমিজি বলেন, হাদিসটি হাসান এবং সহিহ]
পাঠকবৃন্দ! সাহাবায়ে কেরাম সত্যের মাপকাঠি হবার প্রমাণ কুরআন হাদিসে দু’একটা নয়, বরং শতাধিক আছে। কিন্তু যে মানে, মানার মতো অন্তর যার আছে, আল্লাহ ও রাসুলের কথার মূল্য যার নিকট আছে, তার জন্য একটি কথাই যথেষ্ট, একটি প্রমাণেই সে সন্তুষ্ট।
পক্ষান্তরে যে মানে না, মানার মতো অন্তর যার নেই, ফেরাউনের মতো কঠিন যার অন্তর, আবু জাহিলের মতো পাষাণ যার হৃদয়, তাকে স্বয়ং আল্লাহ কানে ধরে বোঝালেও বুঝ মানবে না।
হায়! যাঁদের প্রতি স্বয়ং আল্লাহ খুশি এবং যাঁরা আল্লাহর প্রতি খুশি, যাঁদেরকে স্বয়ং আল্লাহ ঈমানপ্রিয়, পুণ্যপ্রেমিক, কুফর ও পাপবিদ্বেষী, সর্বোপরি সত্যনিষ্ঠ বলে ঘোষণা করেছেন, যাঁদেরকে মেনে চলার জন্য স্বয়ং নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশ দিয়েছেন, যাঁদেরকে উম্মতের জন্য হেদায়াতের ধ্রুবতারারূপে স্বয়ং হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশ ঘোষণা করলেন, যাঁরা সুদীর্ঘ ২৩টি বছর স্বয়ং হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পুণ্য-সংসর্গে কুরআন-সুন্নাহর সরাসরি জ্ঞান লাভ করেছেন, দীন-ধর্মকে বুঝেছেন, অদ্যাবধি বিশ্বমুসলিম যাঁদেরকে সত্যের প্রতীক, হেদায়াতের মানদণ্ড বলে বিশ্বাস করে আসছেন, জামাতে ইসলামী ও মওদূদী সাহেবর বিচারে তাঁরা সত্যের মানদণ্ড হতে পারলেন না! অথচ ১৪০০ বছর পরে কোনো মাদরাসায় কিংবা উল্লেখযোগ্য আলেমের কাছে না পড়ে, না পাশ করে, কোনো সনদ লাভ না করেও স্বয়ং মওদূদী সাহেব ও তার দল শুধু সত্যের মানদণ্ডই নন, বরং এর বিচারক পর্যন্ত হয়ে গেলেন, মুসলিম ইতিহাসের বিশ্ববরেণ্য মনীষীদের বিচারকের আসনে বসে গেলেন, এতদপেক্ষা আশ্চর্যের বিষয় আর কী হতে পারে?
একমাত্র হতভাগ্য বিকৃতমস্তিষ্ক ব্যতীত কোনো সাধারণ মুসলমানও এমন অভিশপ্ত উক্তির কল্পনাও করতে পারে না। একেই বলে যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা!
আল্লাহ ও তদীয় রাসুলের ঘোষণায় যাঁরা সত্যের মানদণ্ড, হক ও হেদায়াতের প্রতীক, তাঁরা সত্যের মানদণ্ড নন, এমন স্পর্ধা শুধু মওদূদী সাহেব ও জামাতে ইসলামিই করতে পারে, আমাদের তো এরূপ কল্পনা করতেও কলিজা কাঁপে। আল্লাহ ও রাসুল যাঁদেরকে সনদ ও সার্টিফিকেট দান করেছেন, মওদূদী সাহেব তাঁদের সনদ কেড়ে নিচ্ছেন, এতই তার স্পর্ধা! নিজের কোনো সনদ নাই বলে কি এত বড় দুঃসাহস?
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! ডাক্তার হোন অথবা শিক্ষক, একজন লোক যদি সারাজীবন সাধনা করেও তার একজনও যোগ্য উত্তরাধিকারিত্বের অবর্তমানে তার আদর্শের প্রতীকরূপে গড়ে তুলতে না পারে, তবে তার জীবনসাধনার ব্যর্থতা সম্বন্ধে আফসোসের অন্ত থাকে না। এখন মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুদীর্ঘ তেইশটি বছর সাধনা করেও তাঁর লক্ষাধিক ছাত্রের একজনকেও যদি তাঁর আদর্শের প্রতীক সত্যের মানদণ্ডরূপে তৈরি করতে না পারেন, তাহলে বলতে হবে যে, তাঁর জীবনসাধনা ব্যর্থ হয়েছে, অথবা নবুওতের দায়িত্ব পালনে তিনি ত্রুটি করেছেন (نعوذ بالله)। বস্তুত মওদূদী সাহেব উভয় দাবি করে ফেলেছেন। একদিকে যেমন দাবি করেছেন যে, মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যর্থ হয়েছেন, অন্যদিকে তেমন দাবি করেছেন যে, তিনি নবুওতের দায়িত্ব পালনে ত্রুটি করেছেন। দেখুন,
لیکن وعظ و تلقین میں ناکامی کے بعد داعی اسلام نے ھاتھ میں تلوار لی
অর্থাৎ ওয়াজ-নসিহত এবং শিক্ষা-দীক্ষায় ব্যর্থ হবার পর ইসলামের আহ্বায়ক হাতে তরবারি নিলেন। [আল জিহাদ ফিল ইসলাম উর্দু, পৃষ্ঠা: ১৭৪]
এবং সূরা নসরের তাফসির প্রসঙ্গে মহানবি সা. সম্পর্কে বলেছেন: “আল্লাহর নিকট কাতর কণ্ঠে এই দোয়া কর যে, তােমাকে যে কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তা সম্পন্ন করার ব্যাপারে তােমার দ্বারা যে ভুল-ত্রুটি হয়েছে কিংবা তাতে যে অসম্পূর্ণতা ও দুর্বলতা রয়ে গেছে তা যেন তিনি ক্ষমা করে দেন।” [তাফহীমুল কুরআন ১৯শ খণ্ড, অনুবাদ: মুহাম্মাদ আবদুর রহীম, সূরা নাসর, আয়াত-৩, টীকা-৪, খায়রুন প্রকাশনী]
“সুতরাং এ মহান কার্য সম্পাদনের জন্যে তাঁর প্রশংসা-স্তুতি প্রকাশ কর এবং তাঁর দরবারে আবেদন করঃ প্রভু পরওয়ারদেগার! দীর্ঘ তেইশ বছরের এ খেদমতকালে আমার দ্বারা যে সকল ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়ে গেছে, তা ক্ষমা করে দাও!” [কুরআনের চারটি মৌলিক পরিভাষা : ১১৮]
হায়! মওদূদী সাহেব কোন বুকে, কোন মুখে, কোন সাহসে মহানবি, শেষ নবি, শীর্ষনবি, বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর এত বড় আক্রমণ চালালেন। এখন বলুন তো, যিনি নবুওতের মহামূল্যবান দায়িত্ব আদায়ে ত্রুটি করলেন, তিনি কি সত্যের মাপকাঠি হতে পারেন? তাহলে দেখা যায়, মওদূদী সাহেবের কথামতে সাহাবায়ে কেরাম যেমন সত্যের মাপকাঠি নন, মহানবিও তেমন সত্যের মাপকাঠি নন। আর মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সত্যের মাপকাঠি হতে পারলেন না, তখন পৃথিবীর কিংবা বিশ্বের ইতিহাসে এমন আর কে আছে, যে সত্যের মাপকাঠি হতে পারে? তবে কি মানদণ্ডের অভাবে সত্যানুসন্ধানীরা, সত্যপিপাসুরা চিরবঞ্চিত থাকবে, তাদের কী গতি হবে? না! নিরাশ হবেন না, আর কেউ থাকুক বা না থাকুক মওদূদী সাহেব তো আছেন। তিনি একেবারে আনকনটেস্টে সত্যের মাপকাঠি, দুধে ধোয়া মহামানব।
পাঠকবৃন্দ! মওদূদী সাহেব ও তার অনুসারী উপমহাদেশের অন্যতম বিচক্ষণ আলিম উপাধিধারী ও উস্তাজুল আসাতিজা নামধারীগণ যখন সাহাবায়ে কেরামের সত্যের মাপকাঠি সম্পর্কিত আলোচনায় আসেন তখন বলেন যে, সাহাবিগণ মাসুম বা নিষ্পাপ ছিলেন না, ভুল-ত্রুটির উর্ধ্বে ছিলেন না, নিষ্পাপ এবং ভুল-ত্রুটির উর্ধ্বে ছিলেন একমাত্র আম্বিয়ায়ে কেরাম, তাই একমাত্র আম্বিয়ায়ে কেরাম সত্যের মাপকাঠি, সাহাবিগণ সত্যের মাপকাঠি মন। বড়ই পরিতাপের বিষয়! এই তথাকথিত বিচক্ষণ আলিম ও উস্তাজুল আসাতিজাগণ কুরআন-হাদিসের সমস্ত প্রমাণাদিকে পিছনে ফেলে সাহাবায়ে কেরাম সত্যের মাপকাঠি নন বলে সাব্যস্ত করার জন্য নিষ্পাপ হওয়ার শর্ত আবিষ্কার করলেন। অথচ এর ভিতর দিয়ে আম্বিয়ায়ে কেরামের সত্যের মাপকাঠি হওয়াকে যে অস্বীকার করে ফেলছেন, তা বুঝতে বাকি নেই। কেননা, তারা এবং তাদের গুরুই তো আবার নবিগণের ‘ইসমত’ বা ‘নিষ্পাপতা’ সম্পর্কে আলোচনায় এসে ইসমতের এমন ব্যাখ্যা দিলেন, যাতে ইসমতের আর অস্তিত্বই বাকি থাকে না; বরং ক্ষুণ্ণ এবং ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।
মওদূদী সাহেব বলেন:
الله تعالى بالارادہ ہر نبی سے کسی نہ کسی وقت اپنی حفاظت اٹھا کر ایک دو لغزشیں ہو جانے دی ہیں~ (ابوالاعلی مودودی، تفہیمات، جلد دوم، نئی دہلی: مرکزی مکتبہ اسلامی پبلشرز، طبع اول: مارچ ۱۹۹۹ عیسائی، صفحه ۵۷)
অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা ইচ্ছে করে প্রত্যেক নবী থেকে কোন না কোন সময় স্বীয় হেফাজত (ইসমত) উঠিয়ে নিয়ে দু’একটা পদস্খলন হতে দিয়েছেন। হেফাজতব্যবস্থা ইসমত (নিষ্পাপত্ব) যখন আল্লাহ উঠিয়ে নিলেন, তখন তাঁরা কি আর মাসুম (নিষ্পাপ) থাকলেন? তদ্রূপ নবিগণ থেকে ভুল-ত্রুটি, গুনাহ হয়েছে বলে তাদের বই-পুস্তকে লেখা রয়েছে। অতএব, নবিগণ যখন মাসুম বা নিষ্পাপ থাকলেন না, বরং ভুল-ত্রুটি করেছেন, তখন তারা আর সত্যের মাপকাঠি হতে পারলেন কই?
হায়! ইসলামকে নিয়ে, আম্বিয়ায়ে কেরামকে নিয়ে, সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে এ রকম ছিনিমিনি খেলা না করাই তাদের পক্ষে ভালো ছিল। এসব কি বিচক্ষণ আলিমের ইলমি তাহকিক? না তার জমজম কূপে প্রস্রাব করে প্রসিদ্ধি লাভ করার প্রত্যাশা করছেন?
আরও আশ্চর্যের বিষয় যে, মওদূদী সাহেব সমস্ত আম্বিয়ায়ে কেরামের নিষ্পাপত্বকে খণ্ডন করেছেন এবং নিজের সম্পর্কে যদিও দুশমনের ভয়ে ইসমতের দাবি করেন নাই; তবুও এমন সাফাই পেশ করেছেন, যাতে বোঝা যায় যে, তিনি মনে মনে মাসুম ছিলেন। দেখুন: আল্লাহর মেহেরবানীতে আবেগের বশবর্তী হয়ে আমি কোনো কাজ করিনি এবং কোনো কথা বলিনি। আমার বক্তৃতার প্রতিটি শব্দ আমি মেপেজুকে বলেছি এবং একথা মনে রেখেই বলেছি যে, এজন্যে আল্লাহর কাছেই আমাকে হিসেব দিতে হবে, বান্দাহর কাছে নয়। আমি যে, সত্যের বিপরীত কোনো কথা বলিনি সে বিষয়ে আমি নিশ্চিন্ত। [রাসায়েল ও মাসায়েল ১/১৮২]
১৯৬২ সালের ২৫-২৮ অক্টোবর পর্যন্ত চার দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত সমগ্র পাকিস্তান জামাতে ইসলামীর লাহোর কনফারেন্সে মওদূদী সাহেব বলেন,
میں اپنے سب مخلص بھائیوں کو اطمینان دلاتا ہوں کہ اللّٰہ کے فضل سے مجھے کسی مدافعت کی حاجت نہیں میں کہیں خلا میں سے یکا یک نہیں آ گیا ہوں اس سرزمین میں سالہا سال سے کام کر رہا ہوں میرے کام سے لاکھوں آدمی براہِ راست واقف ہیں میری تحریریں صرف اس ملک میں نہیں، دنیا کے ایک اچھے خاصے حصّے میں پھیلی ہوئی ہیں اور میرے رب کی مجھ پر یہ عنایت ہے کہ اس نے میرے دامن کو داغوں سے محفوظ رکھا ہے ~ روزنامہ مشرق لاہور، ٢٩ اکتوبر ١٩٦٢ء
অর্থাৎ আমি আমার সকল মুখলিস ভাইদের আশ্বস্ত করছি যে, আল্লাহর রহমতে আমার কোনো ওজরখাহীর হাজত নেই। আমি কোনো মহাকাশ থেকে আচানক চলে আসিনি। বহু বছর ধরে এই সরজমিনে কাজ করছি। লক্ষ লক্ষ মানুষ আমার কাজ সম্পর্কে সরাসরি অবগত। আমার লেখাগুলো শুধু এদেশে নয়, দুনিয়ার এক বড় অংশে ছড়িয়ে পড়েছে। আর আমার উপর আমার রবের বড়ই কৃপা যে, তিনি আমার আঁচলকে বেদাগ (পাক-সাফ, কলুষমুক্ত, বেগুনাহ) রেখেছেন। [দৈনিক মাশরিকি লাহোর, 29 অক্টোবর 1962]
বলুন তো যার জীবনে কোন দাগ নেই, চরিত্রে কলুষতা নেই, সে কি মাসুম নয়?
★ মওদূদী সাহেবের মুখে সত্যের মাপকাঠির ব্যাখ্যা :
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! মওদূদী সাহেব যদিও নীতি হিসাবে নির্ধারিত করেছেন যে, সাহাবায়ে কেরাম সত্যের মাপকাঠি নন, কিন্তু তিনি আবার সত্যের মাপকাঠির যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, এর দ্বারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে উদ্ভাসিত হয় যে, সাহাবায়ে কেরাম সত্যের মাপকাঠি। কেননা, সাহাবায়ে কেরাম যে সত্যের মাপকাঠি একথা চিরসত্য, ঐতিহাসিক সত্য, অমোঘ সত্য অবিসংবাদিত সত্য এবং চিরদিনই সত্য। সত্য কোনো দিন মিথ্যার আবরণে ঢাকা পড়ে না। একবার ঢাকা পড়লে পরক্ষণেই আবার উদ্ভাসিত হয়ে উঠে। শাক দিয়ে কোনো দিন মাছ ঢাকা যায় না। কেননা, শাক দিয়ে মাছ ঢাকলে জীবন্ত মাছ শাকের ফাঁক দিয়ে তার মাথা আপনাআপনি বের করে ফেলে। এবার দেখুন মওদূদী সাহেবের ব্যাখ্যা ও ভাষ্যের ফাঁক দিয়ে সাহাবায়ে কেরাম যে সত্যের মাপকাঠি একথা কিরূপে ভেসে উঠছে? তিনি মিয়ারে হক তথা সত্যের মাপকাঠির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন:
ہمارے نزدیک معیار حق سے مراد وہ چیز ہے جس سے مطابقت رکھنا حق ہو اور جس کے خلاف ہونا باطل ہو ۔ اس لحاظ سے معیار حق صرف خدا کی کتاب اور اس کے رسول کی سنت ہے۔ صحابہ کرام معیار حق نہیں بلکہ قرآن وسنت کے معیار پر پورا اترتے ہیں ۔ کتاب و سنت کے معیار پر جانچ کر ہم اس نتیجے پر پہنچے ہیں کہ وہ حق پر ہے
অর্থাৎ আমাদের মতে মিয়ারে হক সেই বস্তু যার সাথে সঙ্গতি রক্ষা করার মধ্যে হক নিহিত ও সীমাবদ্ধ এবং যার বিপরীত হওয়া বাতিল ও অসত্য। এর পরিপ্রেক্ষিতে শুধু আল্লাহর কিতাব ও রাসুলের সুন্নাতই হলো সত্যের মাপকাঠি। সাহাবিগণ সত্যের মাপকাঠি নন, বরং তাঁরা হলেন কিতাব ও সুন্নাতের পূর্ণ অনুসারী। কুরআন ও হাদিসের মাপকাঠিতে যাচাই করে আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে, সাহাবায়ে কেরাম সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। [মওদূদী লিখিত তৎকালীন পাকিস্তান জামাতে ইসলামীর গঠনতন্ত্র, ৩ নং ধারা, ৬ নং উপধারা]
এখন আপনারা মওদূদী সাহেবের এ কথাটির উপর দৃষ্টি রাখুন, “সত্যের মাপকাঠি সেই বস্তু, যার সাথে সঙ্গতি রাখার মধ্যে হক নিহিত এবং যার বিপরীত হওয়া বাতিল।” অতঃপর বর্ণিত কুরআন-হাদিসের উদ্ধৃতিগুলো আবার পড়ুন। দেখবেন যে, কুরআন-হাদিসের মতে একমাত্র সাহাবায়ে কেরামের মত ও পথের সাথে সঙ্গতি রাখা হোক, তাঁদের পথই হলো একমাত্র সিরাতে মুস্তাকিম এবং তাঁদের পথ ও মতের বিপরীত যা কিছু তা সব ভ্রান্ত ও বাতিল। সুতরাং মওদূদী সাহেবের ভাষ্য মতেই সাহাবায়ে কেরাম সত্যের মাপকাঠি বলে প্রমাণিত। এরপর মওদূদী সাহেব তার উপরিউক্ত বক্তব্যে এ কথা স্বীকার করে নিয়েছেন যে, সাহাবায়ে কেরাম হলেন কুরআন-হাদিসের পূর্ণ অনুসারী। তিনি তাঁদেরকে যাচাই করে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, তাঁরা সবাই সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাহলে তাঁদের বিপরীত মত ও পথ কি অসত্য ও নাহক হবে না? অতএব, মওদূদী সাহেবের এ বক্তব্যেই প্রমাণিত হয়ে যায় যে, সাহাবায়ে কেরাম সত্যের মাপকাঠি, অনুসরণযোগ্য। তাঁদের অনুসরণের মাধ্যমেই বাস্তবায়িত হতে পারে কুরআন ও হাদিসের অনুসরণ এবং তাদের বিপরীতই হলো বাতিল।
দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, রেডিও স্টেশনের টাইম নির্ধারক ঘোষণাকে সময়ের মাপকাঠি হিসাবে মেনে নেয়া হয়। এখন যদি কোনো ব্যক্তি এ ঘোষণা শুনেন এবং তার ঘড়িকে ঐ ঘড়ির যে কোনো একটির সাথে মিলিয়ে নেয় যেগুলোকে রেডিওর ঘোষণার সাথে মিলানো হয়েছে, তাহলে কি ভুল হবে? এমতাবস্থায় তার ঘড়ির সময় কি ঠিক হবে না? এবং এর বিপরীত সময় কি ভুল হবে না? ঠিক তেমনি সাহাবায়ে কেরাম যেহেতু মওদূদী সাহেবের মতেই কুরআন-সুন্নাতের পূর্ণ অনুসারী, তাই তাঁদের অনুসরণই হবে সত্যের অনুসরণ এবং তাঁদের বিপরীত পথ অবলম্বনই হবে সত্যের বিরুদ্ধাচরণ।
★ সত্যের মাপকাঠি :: শিরক বির-রাসুল :
যারা সাহাবায়ে কেরামকে সত্যের মাপকাঠি মানেন না, তারা কিছু দিন যাবৎ একটি জঘন্য ও বিভ্রান্তিকর ফতোয়াও জারি করে আসছেন। তারা বলেন, সাহাবায়ে কেরামকে সত্যের মাপকাঠি বললে شرک بالرسل অর্থাৎ রাসুলের সাথে শিরক করা হয়ে যায়। বোধ হয়, তারা ‘শিরক’ শব্দটির অর্থই বুঝতে পারেনি। শিরক হলো توحيد – তাওহিদ এর বিপরীত শব্দ। আর তাওহিদ অর্থ একত্ববাদ, আল্লাহকে সবদিক দিয়ে একক মনে করা। পক্ষান্তরে اشراک হলো আল্লাহর জাত, সিফাত, ইবাদত ইত্যাদিতে অন্যকে তার অংশীদার করা। তাই শিরক একমাত্র আল্লাহর সাথে হয়ে থাকে, রাসুলের সাথে শিরক কোন রকমেই হতে পারে না। শিরকের নানা প্রকারভেদ আছে, কিন্তু শিরক বির-রাসুল নামে শিরকের কোনো প্রকার কুরআন-হাদিস বা ইসলামি সাহিত্যের কোথাও নেই। আয়িম্মায়ে মুজতাহিদিন বা সলফে সালিহিনের মধ্যে কেউ এমন বলেননি। অতএব, এটা তাদের কল্পনাপ্রসূত, তাদেরই আবিষ্কৃত। সাহাবায়ে কেরামকে সত্যের মাপকাঠি মনে করায় যদি রাসুলের সাথে শিরক হয়ে যায় তাহলে আল্লাহর কিতাবের মতো রাসুলের সুন্নতকেও সত্যের মাপকাঠি বিশ্বাস করা কি শিরক-বিল্লাহ হবে না? সুতরাং আপনাদের প্রতিপক্ষ যদি শিরক বির-রাসুল করে থাকেন, তাহলে আপনারা শিরক-বিল্লাহ করে আসছেন, তাই না? এবং আপনারা ইজমায়ে সাহাবা (সাহাবায়ে কেরামের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত)-কে তো সত্যের মাপকাঠি বলে মানেন। এখন প্রশ্ন হলো যে, সাহাবায়ে কেরামের প্রত্যেককে সত্যের মাপকাঠি মানলে যদি শিরক বির-রাসুল হয়ে যায়, তাহলে ইজমায়ে সাহাবা তথা সাহাবিদের ঐকমত্যকে সত্যের মাপকাঠি মানা কি আরও বড় ধরনের শিরক বির-রাসুল হবে না? কেননা, এমতাবস্থায় একসাথে লক্ষাধিক সাহাবাকে রাসুলের সাথে শরিক করা হচ্ছে, তাই না?
অতএব, আসল কথা হলো যে, তাদের এ উক্তি সম্পূর্ণ বাতিল, অলীক ও মূর্খতাপ্রসূত এবং কুরআন-হাদিসের ব্যাপারে অজ্ঞতার পরিচায়ক।
মাওলানা মুতিউর রহমান খান সাহেব থেকে সংগৃহিত
সাহাবারা অনুসরনীয় কিন্তু সত্যের মাফকাঠি একমাত্র রাসুলুল্লাহ সঃ। এটা নিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে বেহুদা কথা বলার কোন সূযোগ নাই। সত্যের মাফকাঠি নবী রাসুলগন, তাঁদের স্বয়ং আল্লাহ সিলেক্ট করেছেন।