মওদূদী সাহেব ‘দস্তূরে জামাতে ইসলামী’তে লিখেন, ‘আল্লাহর রাসূল ছাড়া কাউকে সত্যের মাপকাঠি বানানো যাবে না, কাউকে সমালোচনার উর্ধ্বে মনে করা যাবে না, কারো যেহনী গুলামীতে লিপ্ত হওয়া যাবে না’।
লক্ষ করুন, এই দফাগুলো কী পরিমাণ কুরআন বিরোধী!!! সূরা হুজরাতে ইরশাদ হয়েছে,
واعلموا ان فيكم رسول الله لو يطيعكم في كثير من الامر لعنتم ولكن الله حبب اليكم الايمان وزينه في قلوبكم وكره اليكم الكفر والفسوق والعصيان اولئك هم الراشدون فضلا من الله ونعمة والله عليم حكيم
অর্থাৎ তোমরা জেনে রাখ, তোমাদের মধ্যে আল্লাহর রাসূল রয়েছেন। তিনি যদি অনেক বিষয়ে তোমাদের আবদার মেনে নেন, তবে তোমরাই কষ্ট পাবে। কিন্তু আল্লাহ তোমাদের অন্তরে ঈমানের মহব্বত সৃষ্টি করে দিয়েছেন এবং তা হৃদয়গ্রাহী করে দিয়েছেন। পক্ষান্তরে কুফর, পাপাচার ও নাফরমানীর প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করে দিয়েছেন। তাঁরাই সৎপথ অবলম্বনকারী। এটা আল্লাহর পক্ষ হতে দান ও অনুগ্রহস্বরূপ। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। [আয়াত ৭-৮]
চিন্তা করুন, সাহাবায়ে কিরাম যাঁদের হৃদয়ে আল্লাহ তাআলা ঈমানকে সুপ্রিয় ও সুশোভিত করে দিয়েছেন এবং কুফর, পাপাচার ও নাফরমানীর প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করে দিয়েছেন আর যাঁদের হেদায়েতপ্রাপ্ত হওয়ার ব্যাপারে কুরআনে করীম অকুন্ঠচিত্তে ঘোষণা দেয়, তাঁরা কি মিয়ারে হক হবেন না? সমালোচনার উর্ধ্বে হবেন না? তাঁদের তাকলীদে কি কোন ধরনের শঙ্কা থাকবে? উক্ত আয়াত সমস্ত সাহাবীর পরিপূর্ণ সত্যায়ন করেছে। যদি সাহাবায়ে কিরাম থেকে কদাচিৎ স্বেচ্ছায় কোন গুনাহ হয়েও থাকে, তবে তা উল্লিখিত আয়াত ও বর্ণিত মাহফূয হওয়ার পরিপন্থী হবে না। কারণ আদালত সেই অনন্যসাধারণ প্রতিভা এবং শাশ্বত শক্তির নাম যা কবীরা গুনাহ পরিত্যাগ, সগীরা গুনাহ বিমুখ এবং অশালীন কথা বর্জন করতে উদ্বুদ্ধ করে। ঘটনাক্রমে কখনো কোন গুনাহ বা অন্যায় হয়ে যাওয়া, অতঃপর অনুতপ্ত হয়ে তার উপর অটল থাকা আদালতের মধ্যে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না এবং এটা তাঁদের হেফাযতেরও পরিপন্থী নয়। কিন্তু মওদূদী সাহেব কোন সাহাবীকে, কোন মানুষকে মিয়ারে হক মানেন না। তাঁদেরকে না সমালোচনা ও যাচাই-বাছাইয়ের উর্ধ্বে মনে করেন আর না অনুসরণযোগ্য বলেন। দেখুন কত দুস্তর ব্যবধান উভয়ের মাঝে! বলুন এ বিরোধ কি শাখাগত না মৌলিক?
সূরা ফাতহের মধ্যে ইরশাদ হয়েছে,
محمد رسول الله والذين معه أشداء على الكفار رحماء بينهـم تراهم ركعا سجدا يبتغون فضلا من الله ورضوانا سيماهم في وجوههم من اثر السجود ذلك مثلهم في التوراة ومثلهم في الانجيل كزرع اخرج شطأه فازره فاستغلظ فاستوی على سوقه يعجب الزراع ليغيظ بهم الكفار
অর্থাৎ মুহাম্মদ ﷺ আল্লাহর রসূল এবং তাঁর সহচরগণ কাফেরদের প্রতি কঠোর, নিজেদের মধ্যে পরস্পর সহানুভূতিশীল। আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনায় আপনি তাঁদেরকে রুকু ও সেজদারত দেখবেন। তাঁদের মুখমন্ডলে রয়েছে সেজদার চিহ্ন । তওরাতে তাঁদের অবস্থা এরূপ এবং ইঞ্জিলে তাঁদের অবস্থা যেমন একটি চারা গাছ যা থেকে নির্গত হয় কিশলয়, অতঃপর তা শক্ত ও মজবুত হয় এবং কান্ডের উপর দাঁড়ায় দৃঢ়ভাবে- চাষীকে আনন্দে অভিভূত করে- যাতে আল্লাহ তাঁদের দ্বারা কাফিরদের অন্তর্জ্বালা সৃষ্টি করেন। [আয়াত ২৯]
এ আয়াত দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণ করে যে, হযরত মুহাম্মদ ﷺ-এর সাহাবায়ে কিরামের ঈমান আনুগত্য ও একীনের সোপান অতিক্রম করে মহব্বত ও প্রেমের সর্বোচ্চ স্তরে গিয়ে পৌঁছেছিল। এর ফলশ্রুতিতে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি তাঁদের মহব্বত এতই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে এর প্রভাব তাঁদেরকে মান্যকারী এবং তাঁদের উপর ঈমান আনয়নকারীগণ পর্যন্তও পূর্ণ মাত্রায় বিকশিত হয়েছিল। এমনকি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে শত্রুতা পোষণকারী তাঁদের দৃষ্টিতে চূড়ান্ত পর্যায়ের ঘৃণিত হয়ে গিয়েছিল। তাঁরা তাদের সাথে কেবল সম্পর্কচ্ছেদই করেন নি বরং আপসহীনতা এবং কঠোরতাও প্রদর্শন করেছেন। এমনিভাবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের মহব্বত তাঁদের ভিতরে এত পরিমাণে অনুপ্রবেশ করেছিল যে, তাঁদেরকে মান্যকারী এবং তাঁদের উপর ঈমান আনয়নকারীগণও সর্বোচ্চ স্তরের প্রেমিক হয়ে গিয়েছিল। এমনকি (সাহাবীগণ) তাঁদের উপর করুণা ও দয়া প্রদর্শনকারী হয়ে গিয়েছিলেন। এমনিভাবে আল্লাহর দাসত্বের গুণ সাহাবাদের অস্তিত্বে এত পূর্ণমাত্রায় প্রতিফলিত হয়েছিল যে, কেবল আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লার নির্ধারিত ইবাদত-বন্দেগী সম্পাদন করেই ক্ষান্ত থাকতেন না বরং সদা-সর্বদা তাঁদেরকে ইবাদত-বন্দেগীতে লিপ্ত মনে হত। আর এই নির্ধারিত ইবাদত-বন্দেগী অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পর্যন্তই সীমিত ছিল না বরং তাঁদের হৃদয় এবং আত্মাও সে রঙ্গে রঙিন হয়ে গিয়েছিল। এমনকি তাঁদের এই অন্তঃকরণ ইহ-পারলৌকিক সকল স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে একমাত্র মাবুদে হাকীকীর রেযা ও সন্তুষ্টি অন্বেষী হয়ে গিয়েছিল। তাঁদের অভীষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল কেবল রেযায়ে ইলাহী এবং তাঁরই ফযল-করম। এমনকি খোদার এই বন্দেগী ও তাবেদারী সাময়িক কিংবা অল্পকালস্থায়ী ছিল না বরং তা সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যে চিরস্থায়ী অবস্থা ও স্থিতির কারণে পুরো শরীরে অনুপ্রবেশ করেছিল। চেহারায় এবং অঙ্গ-প্রতঙ্গে কাকুতিমিনতি, বিনয় ও নম্রতার নিদর্শন كل اناء يتر شح بما فيه প্রবাদের মত পরিস্ফুট হয়েছিল।
এমনকি তাঁদের এসব গুণ ও চরিত্র সাময়িক কিংবা নতুন নয় বরং আলীমুল গায়িবের কাছে অনন্তকাল ধরে প্রকাশিত এবং প্রস্ফুটিত হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ তাওরাত ও ইঞ্জিলে তাঁদের এ সুউচ্চ মর্যাদার কথা বর্ণিত হয়েছ। লক্ষ করুন, সাহাবায়ে কিরামের স্তুতি বর্ণনা করতে আল্লাহ তাআলা والذين معه অর্থাৎ ‘যাঁরা তাঁর সাথী’ শব্দ উল্লেখ করেছেন যেটা উসূলে ফিকহের কায়দা অনুযায়ী ইসতিগরাক বোঝায় এবং উসূলে মাআনীর কায়দা অনুযায়ী সকল সাহাবী এর অন্তর্ভুক্ত। যার মর্মার্থ হল রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর সকল সাথী উক্ত গুণসমূহের পরিপূরক। আর এ অর্থ বুঝেছেন তামাম আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআত। তাই তাঁরা সকল সাহাবীর পবিত্রতা ও নির্ভরযোগ্যতা বর্ণনা করেন, তাঁদের কারো সমালোচনা ও জেরা বৈধ মনে করেন না এবং এর জন্য তাঁদের পূত-পবিত্র জীবন ও আল্লাহ তাআলা কর্তৃক প্রশংসা-গুণাবলীকে জ্বলন্ত সাক্ষী মনে করেন। পক্ষান্তরে মওদূদী সাহেব কোন সাহাবীকে চাই তিনি খলীফা-ই-রাশিদ হোন বা না হোন, আশারা-ই-মুবাশ্শারা (দুনিয়াতে জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত দশজন সাহাবী) হোন বা না হোন, বদরী সাহাবী হোন বা না হোন, আসহাবে বায়আতুর রিযওয়ান হোন বা না হোন- কাউকে হকের মাপকাঠি বিশ্বাস করেন না; সমালোচনার উর্ধ্বে মনে করেন না; কাউকে অনুকরণীয় মনে করেন না। এটা কি কুরআন হাদীসের সম্পূর্ণ পরিপন্থী নয়? এটা কি উসূলী মাসআলা নয়?
সূরা তাওবায় ইরশাদ হয়েছে,
والسابقون الاولون من المهاجرين والانصار والـذين اتبعوهم باحسان رضی الله عنهم ورضوا عنه واعـة لهم جنات تجرى تحتها الانهار خالدين فيها ابدا ذلك الفوز العظيم
অর্থাৎ মুহাজির ও আনসার যাঁরা প্রথম অগ্রগামী এবং যাঁরা নিষ্ঠার সাথে তাঁদের অনুসরণ করে, আল্লাহ তাঁদের প্রতি প্রসন্ন এবং তাঁরাও তাতে সন্তুষ্ট এবং তিনি তাঁদের জন্য প্রস্তুত করেছেন জান্নাত যার নিম্ন দেশে নদী প্রবাহিত, যেখানে তাঁরা চিরস্থায়ী হবে। এটা মহা সাফল্য। [আয়াত ১০০]
আল্লাহ তাআলা তাঁর চিরন্তন এবং শাশ্বত কালামে সাবিকীনে আওয়ালীন মুহাজির-আনসার ও তাঁদের নিষ্ঠাবান অনুসারীদেরকে এমন রেযা ও সন্তুষ্টির সুসংবাদ দিয়েছেন যাতে তাঁরা খুশী হবেন, পরিতৃপ্ত হবেন। আরো সুসংবাদ দিচ্ছেন, আমি তাঁদের জন্য এমন জান্নাত তৈরী করে রেখেছি যেখানে তাঁরা চিরকাল অবস্থান করবেন। এটাই তাঁদের মহা সাফল্য। এখন প্রশ্ন হল যাঁরা মিয়ারে হক নন, যাদের কথা-কৰ্ম হক্কানী নয়, যাদের মাঝে খাদ আছে, যাদের সমালোচনা বৈধ, যাদের তাকলীদ নাজায়িয- আল্লাহ তাআলা তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হতে পারেন কি? এই আয়াতের সুসংবাদ তো এটাই যে, সমস্ত সাবিকীনে আওয়ালীন (সকল আনসার ও মুহাজির পরবর্তীদের তুলনায় প্রথম ও অগ্রগামী) মুহাজির ও আনসার এবং তাঁদের নিষ্ঠাবান অনুসারী সবাই আল্লাহ তাআলার রেযা ও সন্তুষ্টি এবং চিরস্থায়ী জান্নাত অর্জনকারী। পক্ষান্তরে মওদূদী সাহেব একে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে গিয়ে বলেছেন, রাসূল ﷺ ব্যতীত না কোন সাহাবী মিয়ারে হক, সমালোচনার উর্ধ্বে ও অনুসরণযোগ্য আর না কোন তাবেয়ী এবং তাদের পরবর্তী কেউ? তাহলে যারা মিয়ারে হক নন এবং খাদযুক্ত তাদেরই কি এই অমরত্ব এবং রেযা হাসিল হবে!
সূরা ফাতহে ইরশাদ হয়েছে,
لقد رضي الله عن المؤمنين اذ يبايعونك تحت الشجرة فعلم ما في قلوبهـم فانزل السكينة عليهم واثابهـم فتحـا قريبا ومغانم كثيرة يأخذونها وكان الله عزيزا حكيما
অর্থাৎ তখন আল্লাহ তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট হলেন, তাঁদের অন্তরে যা ছিল তা তিনি অবগত ছিলেন, তাঁদেরকে তিনি দান করলেন প্রশান্তি এবং তাঁদেরকে পুরষ্কার দিলেন আসন্ন বিজয় ও বিপুল পরিমাণ যুদ্ধলব্ধ সম্পদ যা তাঁরা হস্তগত করবে। আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। [আয়াত ১৮]
অনুধাবন করুন, উক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা হুদায়বিয়ার সময় বায়আতুর রিযওয়ানে অংশগ্রহণকারী পনের শত সাহাবায়ে কিরাম সম্পর্কে কত বলিষ্ঠ ভাষায় স্বীয় রেযা ঘোষণা করেছেন। কিন্তু মওদূদী সাহেব বলেছেন যে, তাঁদের মধ্যে এরকম কেউ নেই যার কথা ও কাজকে হক চেনার হাতিয়ার এবং মিয়ার আখ্যা দেয়া যেতে পারে। এরকমভাবে পরিপূর্ণ আদালত ও তাকওয়াসম্পন্ন কেউ নেই যিনি সমালোচনার উর্ধ্বে; আর না কেউ এমন যার তাকলীদ ও যিহনী গুলামী জায়িয আছে। এই মতবিরোধ কি শাখাগত? এরকম কথা কি বিপথগামিতা এবং পথভ্রষ্টতা নয়?
সূরা তাহরীমে ইরশাদ হয়েছে,
يوم لا يخزى الله النبي والذين أمنوا معه نورهم يسعى بين ايديهم وبإيمانهم يقولون ربنا اتمم لنا نورنا واغفرلنا انك على كل شيء قدير
অর্থাৎ সেদিন, যেদিন আল্লাহ নবী ও সাহাবীদেরকে লজ্জিত করবেন না; তাঁদের জ্যোতি তাঁদের সম্মুখে ও ডানপাশে ধাবিত হবে। তাঁরা বলবে- হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদের জ্যোতিকে পূর্ণতা দান কর এবং আমাদেরকে ক্ষমা কর। নিশ্চয়ই আপনি সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান। [আয়াত ৮]
এই আয়াতের উপর চিন্তা করুন, আল্লাহ তাআলা উক্ত আয়াতে হযরত মুহাম্মদ ﷺ ও তাঁর সাহাবীদের ব্যাপারে ওয়াদা করেছেন যে, তিনি তাঁদেরকে লজ্জিত করবেন না; অপদস্থ করবেন না। তাদেঁরকে এমন নূর ও আলো দান করবেন যা তাঁদের সামনে ও ডানে ধাবিত হবে এবং তাঁদের সে নূরকে পূর্ণতা দান করবেন। তাঁদের মাগফিরাত করবেন। উত্তম পরিণামের এহেন গ্যারান্টি লাভের পরও কি সাহাবায়ে কিরাম সম্পর্কে বলা যাবে যে, তাঁরা মিয়ারে হক নন, তাঁদেরকে জেরা-সমালোচনা করা যাবে এবং তাঁদের অনুসরণ থেকে মুখ ফিরানো জায়িয আছে। মওদূদী সাহেবের উক্ত দফা সম্পূর্ণ কুরআন বিরোধী নয় কি এবং তার সাথে এই মতবিরোধ কি শাখাগত না আকীদাগত?
কুরআন তো রাসূল ﷺ-এর সমস্ত মুমিন সঙ্গী-সাথী তথা সাহাবীকে জান্নাতের সুসংবাদ দিচ্ছে। পক্ষান্তরে মওদূদী সাহেব তাঁদের কাউকে মিয়ারে হক মানতে দিতে চান না, আদৌ তানকীদের উর্ধ্বে মনে করেন না।
সূরা হাদীদে ইরশাদ হয়েছে,
لا يستوى منكم من انفق من قبل الفتح وقتل أولئك اعظم درجة من الذين انفقوا من بعد وقاتلوا وكلا وعد اللـه الحسني والله بما تعملون خبير
অর্থাৎ তোমাদের মধ্যে যাঁরা মক্কা বিজয়ের পূর্বে (আল্লাহর রাস্তায়) ব্যয় করেছে ও জিহাদ করেছে, তাঁরা (মর্যাদায় পরবর্তীদের) সমান নয়। মর্যাদা তাঁরা সেই সকল লোক অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, যাঁরা (মক্কা বিজয়ের) পরে ব্যয় করেছে ও জিহাদ করেছে। তবে আল্লাহ তাআলা সকলকেই হুসনার (জান্নাতের) প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তোমরা যা কর, সে সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা পরিপূর্ণ অবগত। [আয়াত ১০]
চিন্তা করুন, উক্ত আয়াতে মক্কা বিজয়ের পূর্বে জিহাদ ও ব্যয়কারী সাহাবার মর্যাদা বর্ণনা করার পরে আল্লাহ তাআলা সমস্ত সাহাবীর জন্য স্বীয় সর্বোচ্চ ও সর্বোৎকৃষ্ট ওয়াদার কথা উল্লেখ করেছেন। এর ফলে কি সকল সাহাবীকে আল্লাহ তাআলা কর্তৃক পুরস্কৃত করা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় না? আর এমন উত্তম প্রতিশ্রুতি ‘হুসনা’র পরও কি এসব মানুষকে সমালোচনা ও যাচাই-বাছাইর সুযোগ থাকে এবং তাঁরা হক্কানী থাকেন না! মওদূদী সাহেবের উক্ত ধারা কি এই আয়াতের বিরোধী নয়? আর এটা কি উসূলী তথা মৌলিক বিরোধ নয়?
সূরা আলে ইমরানে ইরশাদ হয়েছে,
كنتم خير امة اخرجت للناس تأمرون بالمعروف وتنهون عن المنكر وتؤمنون بالله
অর্থাৎ তোমরাই সব উম্মত থেকে শ্রেষ্ঠ। মানবজাতির জন্য তোমাদের পাঠানো হয়েছে। তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দান কর, অসৎকাজে নিষেধ কর এবং আল্লাহতে বিশ্বাস কর। [আয়াত ১১০]
চিন্তা করুন, উক্ত আয়াতের প্রথম সম্বোধিত জামাআত হলেন সাহাবায়ে কিরাম। তাঁদেরকে সকল পূর্ববর্তী উম্মত থেকে শ্রেষ্ঠ উম্মত বলা হয়েছে। যাদের মধ্যে সমালোচনা ও জেরা করার স্থান বিদ্যমান, যারা হক্কানিয়তের মাপকাঠি নয়, যাদের অনুসরণ যথার্থ নয়- তাঁরা কি এ আযীমুশ্বান প্রশংসা ও অভিধায় সম্বোধিত প্রথম শ্রেণী হওয়ার যোগ্যতা রাখেন? এই মর্যাদায় তো সমস্ত সাহাবী শামিল। কিন্তু মওদূদী সাহেব বলেন, সাহাবায়ে কিরাম রাযিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন এবং পরবর্তীদের মধ্যে এমন কেউ নেই যার কথা ও কাজকে মিয়ারে হক আখ্যা দেয়া যেতে পারে, তানকীদ ও জেরা থেকে মুক্ত হওয়ার উপযুক্ত হতে পারে এবং যার তাকলীদ ও যিহনী গুলামী বৈধ হতে পারে। দেখুন, উভয়ের মাঝে কত ব্যবধান! এটা কি ফুরূয়ী খেলাফ না উসূলী?
সূরা বাকারার ১৪৩ নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে,
وكذلك جعلنكم امة وسطا لتكونوا شهـداء على الناس ويكون الرسول عليكم شهيـدا
অর্থাৎ এভাবে আমি তোমাদেরকে এক মধ্যপন্থী জাতিরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছি, যাতে তোমরা মানবজাতির জন্য সাক্ষীস্বরূপ ও রাসূল তোমাদের জন্য সাক্ষীস্বরূপ হবে।
উক্ত আয়াতের প্রথম সম্বোধিত জামাআত হিসেবে সাহাবায়ে কিরামকে উগ্রতা ও শিথিলতা মুক্ত মধ্যপন্থী, শ্রেষ্ঠ ও সরলপথে প্রতিষ্ঠিত জামাআত বলে উল্লেখ করা হয়েছে, যাতে তাঁরা পূর্ববর্তী নবীগণের জন্য গ্রহণযোগ্য সাক্ষী হতে পারেন এবং রাসূল ﷺ (যিনি সাহাবায়ে কিরাম সম্পর্কে ভাল করে জানেন) তাঁদের সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও আদালতের সাক্ষী দিতে পারেন। এটা সুস্পষ্ট যে, উক্ত আয়াতের মাধ্যমে উম্মতে মুহাম্মদিয়া (যারা নিজেদের উক্ত মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখেছে) বিশেষতঃ সাহাবায়ে কিরামের কতই না সুউচ্চ আদালত ও মর্যাদা প্রমাণিত হয়। কিন্তু মওদূদী সাহেব সাহাবা কিংবা উম্মতের কাউকে না হক্কানিয়তের মিয়ার মানেন, না সমালোচনা ও যাচাই-বাছাইর উর্ধ্বে মানেন আর না তাঁদের কাউকে অনুসরণীয় মনে করেন, বরং এই সবকিছুকে অস্বীকার করেন। উভয় রাস্তার মাঝে কত ফারাক! এই মতবিরোধ কি ফুরূয়ী না উসূলী?
সূরা আ’রাফে ইরশাদ হয়েছে,
ورحمتى وسعت كل شئ فساكتبها للذين يتقون ويؤتون الزكوة والذين هم باياتنا يومنون الذين يتبعون الرسول النب الامي الذي يجدونه مكتوبا عندهم في التورة والانجيل يأمرهم بالمعروف وينهاهم عن المنكر ويحل لهم الطيبات ويحرم عليهم الخبائث ويضع عنهم اصرهم والاغلال التي كانت عليهم فالذين أمنوا به وعزروه ونصروه واتبعوا النور الذي انزل معه أولئك ھم المفلحون
অর্থাৎ আমার দয়া তো প্রত্যেক বস্তুতে ব্যাপ্ত। সুতরাং আমি দয়া তাদের জন্য নির্ধারিত করব যারা তাকওয়া অবলম্বন করে, যাকাত দেয় ও আমার নিদর্শনে বিশ্বাস করে। যারা অনুসরণ করে বার্তাবাহক উম্মী নবীর যার উল্লেখ তাওরাত, ইঞ্জিল ও যা তাদের নিকট আছে তাতে লিপিবদ্ধ পায়। যে তাদেরকে সৎকাজে নির্দেশ দেয় ও অসৎ কাজে বাধা দেয়, যে তাদের জন্য পবিত্র বস্তু হালাল করে ও অপবিত্র বস্তু হারাম করে এবং যে মুক্ত করে তাদেরকে তাদের গুরুভার হতে ও শৃংখল হতে- যা তাদের উপর ছিল। সুতরাং যারা তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, তাকে সাহায্য করে এবং যে নূর তাঁর সাথে অবতীর্ণ হয়েছে তার অনুসরণ করে, তারাই সফলকাম। [আয়াত ১৫৬-১৫৭]
চিন্তা করুন, উক্ত আয়াতে (হযরত মূসা আলাইহিস সালাম এবং তাঁর উম্মতের জন্য) উম্মতে মুহাম্মাদীর যেসব সুউচ্চ গুণাবলী, মর্যাদা ও তাঁদের প্রতি স্বীয় বিশেষ রহমত বর্ষিত হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সাহাবায়ে কিরাম হলেন সেসবের প্রথম ও পরিপূর্ণ অধিকারী। আর সমস্ত সাহাবী এসব ফাযায়েল ও গুণে গুণান্বিত ছিলেন। কিন্তু মওদূদী সাহেব এত বিশাল ও ব্যাপক মর্যাদার পরও তাঁদের কোন একজনকেও না মিয়ারে হক মানেন, আর না সমালোচনা ও যাচাই-বাছাই থেকে পবিত্র এবং অনুসরণাবশ্যকীয় মানেন। এটা কি এই আয়াতের খেলাফ নয়? উসূল এবং কুরআনে কারীমের খেলাফ নয়?
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সাহাবায়ে কেরামের পথের পথিক হওয়ার তৌফিক দান করুন। আমীন।
মাওলানা মুতিউর রহমান খান সাহেব থেকে সংগৃহিত
Leave a Reply