1. info@izharehaq.com : MZakir :
সোমবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭:৪৮ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :
আহলে সুন্নতের ফিক্বাহ শাস্ত্রের ইমাম: ইসলামী আমলের ক্ষেত্রে বিদয়াতীদের চক্রান্ত আহলে সুন্নতের আক্বীদামতে মহানবীর মর্যাদা: অতি ভক্তি কিসের লক্ষণ রেজভীদের চক্রান্ত হুবহু ইবনে সাবার চক্রান্তের মত: রাসূলকে আলিমুল গাইব বলা সাবায়ী চক্রান্ত: আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’ত সুবিন্যস্ত হওয়ার ইতিহাস কুরআন ও হাদীসের ভাষায় ছিরাতে মুস্তাক্বীম বা সোজা পথ: নবুওয়াত ও রিসালত: মওদুদীবাদ ইবাদত: মওদুদীবাদ কুরআন মাজীদ ও দ্বীনের সংরক্ষণ: কুরআন সংরক্ষণের অর্থ: কুরআন সংরক্ষণে খোদায়ী ব্যবস্থাপনা: মওদুদীবাদ দ্বীন কী? দ্বীনে নূহ: দ্বীনে ইব্রাহীম: দ্বীনে ইসমাঈল: দ্বীনে ইউসুফ: দ্বীনে মূসা: দ্বীনে ঈসা: মওদূদীবাদ মওদুদী সাহেবের শিক্ষা-দীক্ষার পরিধি গোয়েবলসীয় নীতি : হিটলারের ঐ মুখপাত্রও ”জামাত-শিবিরের মিথ্যাচারের কাছে হার মানায়”: পর্ব ১ ইক্বামাতে দ্বীনের তাৎপর্য এবং বাতিলপন্থীদের বিকৃত ব্যাখ্যা সাহাবাগণ রাঃ সত্যের মাপকাঠি এবং তাদের ইজমা সর্বসিদ্ধান্ত মতে শরীয়তের দলীল সাহাবা রাঃ গণ সত্যের মাপকাঠি খোলাফায়ে রাশেদীনগণের সোনালী আদর্শ সর্বসম্মতিক্রমে শরিয়তের দলীল শায়খ আলিমুদ্দীন দুর্লভপুরী”র ঐতিহাসিক ও তাত্বিক বক্তব্য: “তাঁরাই সত্যের মাপকাঠি” শায়খ আলিমুদ্দীন দুর্লভপুরী”র ঐতিহাসিক ও তাত্বিক বক্তব্য: সাহাবায়ে কেরাম “সত্যের মাপকাঠি: মিয়ারে হক: সত্যের মাপকাঠি: কুরআন-হাদীস এবং মওদূদী সাহিত্যের আলোকে: পর্ব-৬ মিয়ারে হক: সত্যের মাপকাঠি: কুরআন-হাদীস এবং মওদূদী সাহিত্যের আলোকে: পর্ব-৫ মিয়ারে হক: সত্যের মাপকাঠি: কুরআন-হাদীস এবং মওদূদী সাহিত্যের আলোকে: পর্ব-৪

মিয়ারে হক: সত্যের মাপকাঠি: কুরআন-হাদীস এবং মওদূদী সাহিত্যের আলোকে: পর্ব-৬

নাম:
  • আপডেট সময় : শনিবার, ৯ মার্চ, ২০২৪
  • ২৩২ বার পড়া হয়েছে

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর নবী জীবনের তেইশ বছরে আসমানী ওহীর পূর্ণ তত্ত্বাবধানে মানবজাতির জন্য সর্বোত্তম আদর্শরূপে যে মোবারক জামাআত গড়ে তুলেছিলেন, তাঁরাই হলেন সাহাবায়ে কেরাম রাযিয়াল্লাহু তাআলা আনহুম আজমাঈন। মধ্যযুগীয় বর্বরতার যুগে যখন ছিলো সমগ্র পৃথিবী শিরক ও কুফরীর ভয়ঙ্কর অন্ধকারে নিমজ্জিত, সবদিকে ছিলো অধর্ম ও পাশবিকতার জয়ধ্বনি, মানবতার সেই চরম দুর্দিনে ঈমান ও তাওহীদের যে ক্ষুদ্র কাফেলাটি দাঁড়িয়েছিলো পৃথিবীর সকল ইবলীসী শক্তির বিরুদ্ধে, বাতেল ও অসত্যের মোকাবেলায় নির্ভীক ও নিঃশঙ্ক কণ্ঠে সেদিন যাঁরা উচ্চারিত করেছিলেন কালেমায়ে তাইয়্যেবার বিপ্লবী ঘোষণা, যাঁদের বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে রচিত হয়েছে ইসলামের বিজয় ইতিহাস, তাঁরাই হলেন ‘সাহাবায়ে কেরাম’।
সাহাবায়ে কেরাম ছিলেন আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্যের মূর্ত প্রতীক, নফস ও প্রবৃত্তির সব রকম মলিনতা থেকে তাঁরা ছিলেন চির পবিত্র। হৃদয় ও আত্মার স্বভাবগত পবিত্রতার কারণে আল্লাহ পাক তাঁদের প্রতি সাধারণ সন্তুষ্টির ঘোষণা করে পবিত্র কালা
رضي الله عنهم ورضوا عنه
“আল্লাহ তাঁদের উপর সন্তুষ্ট এবং তাঁরাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট”। (সূরা তাওবা-১০০)
অন্যত্র তাঁদের সম্পর্কে বলেন:
وكلا وعدالله الحسنى
“আল্লাহ পাক সকল সাহাবীকে বেহেশতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।” (সূরা হাদীদ-১০)

সাহাবায়ে কেরামের মহান ত্যাগ ও কুরবানীর বদৌলতেই আমরা দ্বীন পেয়েছি, পেয়েছি ঈমান ও তাওহীদের আলো। তাই কিয়ামত পর্যন্ত আগত উম্মতের প্রতি তাঁদের দান অপরিসীম, অপ্রতিশোধ্য তাঁদের ঋণ। হেদায়েত ও সরল পথের সন্ধান পেতে হলে তাঁদেরকেই আমাদের অনুসরণ করতে হবে জীবন পথের প্রতিটি বাঁকে-বাঁকে। কেননা, তাঁরা হলেন রাসূলের মহান আদর্শ ও মহোত্তম চরিত্রের বাস্তব নমুনা। এ মোবারক জামাআতকে আল্লাহ তা’আলা কুরআন শরীফের বিভিন্ন আয়াতে ঈমান ও সত্যের মাপকাঠি ঘোষণা করেছেন এবং রাসূলে করীম সা. অনেক হাদীসে তাঁদেরকে অনুসরণ করার স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন। তাই তাঁরা হলেন সত্যের মাপকাঠি এবং অনুসরণীয়। এটা মুসলিম উম্মাহর সর্বসম্মত আকীদা ও মৌল বিশ্বাস।

কিন্তু অত্যন্ত লজ্জা ও পরিতাপের বিষয় যে, সর্বযুগের বাতিল সম্প্রদায় সাহাবায়ে কেরামকে সত্যের মাপকাঠি ও অনুসরণীয় মেনে নিতে নারাজ। তারা এ সত্যকে কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করে। তাদের মতে এটা হচ্ছে একটা প্রমাণহীন কথা, যার পেছনে কুরআন ও হাদীস থেকে কোন নির্ভরযোগ্য প্রমাণ নেই, বরং এ বিশ্বাসকে তারা শিরক বির-রাসূল (রাসূলে সাথে শিরক) আখ্যা দেওয়ার মত অদ্ভূত ও বিভ্রান্তিকর উক্তি করতেও কুণ্ঠাবোধ করে না।
এ সত্যকে কুরআন ও হাদীসের আলোকে প্রমাণিত করার চেষ্টাই হচ্ছে আমার আসল লক্ষ্য। তবে এর সাথে সাথে এ সম্পর্কে স্বয়ং সাহাবায়ে কেরামের দৃষ্টিভঙ্গি এবং মুসলিম উম্মাহর অনুসরণীয় চারি ইমাম ও নির্ভরযোগ্য উলামায়ে কেরামের মতামতও উপস্থাপিত করেছি। অতঃপর বাতিলপন্থীদের বিভিন্ন বক্তব্যের মূল্যায়ন, যুক্তির খণ্ডন এবং বিভিন্ন অপলাপের প্রতি আলোকপাত করেছি।

★ মিয়ারে হক বা সত্যের মাপকাঠির তাৎপর্য এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা:
সত্যের মাপকাঠি শব্দটি যদিও সাম্প্রতিক বিভিন্ন মহলে পরিচিত এবং সর্বমুখে উচ্চারিত। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটা হচ্ছে সম্পূর্ণ নব-আবিষ্কৃত। ইসলামের চৌদ্দশত বছরের ইতিহাসে এর অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। পবিত্র কুরআন ও হাদীসে এর চিহ্নও মিলে না। সাহাবায়ে কেরাম, আইম্মায়ে মুজতাহিদীন ও পূর্বসূরী আলেমদের কেউই এ পরিভাষা ব্যবহার করেন নি। এ পরিভাষাটি সর্বপ্রথম যিনি ব্যবহার করেছেন আমাদের জানা মতে তিনি হলেন জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা জনাব সায়্যিদ আবুল আলা মওদূদী সাহেব। তাঁর মূল উর্দু শব্দটি হলো معیار حق (মিয়ারে হক)। ১৯৪১ সালে রচিত জামাআতে ইসলামীর গঠনতন্ত্রে তিনি এ শব্দটি প্রয়োগ করেন। বলেন-
رسول خدا کے علاوہ کسی انسان کو معیار حق نہ بنائے
“আল্লাহর রাসূল ব্যতীত কোন মানুষকে মিয়ারে হক বানাবে না”। (পাকিস্তান জামাআতে ইসলামীর গঠনতন্ত্র, ধারা-৩ উপধারা-৬)
এ ‘মিয়ারে হক’ শব্দেরই বাংলা রূপ হচ্ছে সত্যের মাপকাঠি। উপরোক্ত বক্তব্যে যখন মওদূদী সাহেব ঘোষণা দিলেন যে, রাসূল সা. ব্যতীত কেউ সত্যের মাপকাঠি নয়, সাহাবায়ে কেরামও নন; তখন উপমহাদেশের বিভিন্ন মহলে এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বয়ে চললো। তখন থেকেই এ শব্দটি হয়ে গেল বহুল আলোচিত। এভাবে এটা সর্বমহলে পরিচিতি লাভ করলো।

যখন মওদূদী সাহেবকে ‘মিয়ারে হক’ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তখন তিনি জবাবে বলেছিলেন:
ہمارے نزدیک معیار حق سے مراد وہ چیز ہے جس سے مطابقت رکھنا حق ہو اور جس کے خلاف ہونا باطل ہو ~ ترجمان القرآن، جلد ۵۲ عدد ۵
অর্থাৎ ‘আমরা সত্যের মাপকাঠি বলতে ঐ বস্তুকে বুঝাই, যার সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করা সত্য (হক) এবং যার পরিপন্থী হওয়া মিথ্যা (বাতিল) বলে সাব্যস্ত হয়। [রাসায়েল ও মাসায়েল ৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা : ৩১]
উল্লেখ্য, যার সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করা হক এবং যার পরিপন্থী হওয়া বাতিল, তার সাথে অবশ্যই সঙ্গতি রক্ষা করে চলতে হবে, তার অনুসরণ করতে হবে। তাই সে বস্তু বা ব্যক্তি হবে অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় এবং তার কথা ও কাজ হবে হুজ্জত অর্থাৎ শরীয়তের প্রামাণ্য দলীল। অতএব, সত্যের মাপকাঠির অর্থ দাঁড়ালো এই যে, যার কথা ও কাজ হুজ্জত, তিনিই মিয়ারে হক। যেমন মওদূদী সাহেব নিম্নোক্ত বক্তব্যে হুজ্জত শব্দটি ব্যবহার করেছেন।
ان کے اجماع کو ہم اس بنا پر حجت مانتے ہیں کہ ………. ~ ترجمان القرآن، جلد ۵۲ عدد ٥
“সাহাবায়ে কেরামের ইজমাকে (ঐক্যমতকে) আমরা এজন্য হুজ্জত মানি যে”…. [তরজমানুল কুরআন, খণ্ড ৫২, ৫ম সংখ্যা]
উপরোক্ত উক্তিতে মওদূদী সাহেব معيار حق এর পরিবর্তে হুজ্জত শব্দটি উল্লেখ করেছেন। তাই বুঝা গেল যে, তিনি হুজ্জত অর্থেই ‘মিয়ারে হক’ পরিভাষাটি আবিষ্কার করেছেন।

অতএব, সাহাবায়ে কেরাম সত্যের মাপকাঠি কি না, তা জানতে হলে দেখতে হবে যে, কুরআন ও হাদীসে তাঁদের অনুসরণ-অনুকরণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে কি না? আইম্মায়ে কেরাম তাঁদের অনুসরণকে জরুরী মনে করেন কি না? আর তাঁদের ফয়সালাকে হুজ্জত আখ্যা দেন কি না? এ লেখায় এটা প্রমাণ করা হয়েছে যে, আল্লাহ পাক সাহাবায়ে কেরামের ঈমানের মত ঈমান আনার, তাঁদেরকে অনুসরণ করার এবং তাঁদের ভিন্ন পথ অনুসরণ না করার নির্দেশ দিয়েছেন। অনুরূপ, নবী পাক সা. বিভিন্ন হাদীসে তাঁদের অনুসরণ-অনুকরণের স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন। আইম্মায়ে কেরাম তাঁদের অনুসরণকে ওয়াজিব এবং তাঁদের কথা ও ফয়সালাকে হুজ্জত আখ্যা দিয়েছেন। তাই বুঝা গেল যে, সাহাবায়ে কেরাম সত্যের মাপকাঠি ও অনুসরণীয় এবং তাঁদের কথা ও কাজ হুজ্জত। তবে এখানে একটি কথা স্মরণ রাখতে হবে যে, ‘সাহাবায়ে কেরাম সত্যের মাপকাঠি এবং অনুসরণীয়’— এ কথার অর্থ এই নয় যে, তাঁরা আল্লাহ ও রাসূলের সমমর্যাদার অধিকারী, বরং এর অর্থ হল, “সাহাবায়ে কেরাম দ্বীনের যে নমুনা রেখে গেছেন, তা হল দ্বীনের বাস্তব নমুনা এবং তাঁরা কুরআন ও হাদীসের যে ব্যাখ্যা পেশ করেছেন, তা হলো প্রকৃত ব্যাখ্যা। এমনকি কোন বিষয়ে কুরআন ও হাদীসের ফয়সালা না পওয়া গেলে সে বিষয়ে সাহাবায়ে কেরামই হলেন অনুসরণীয় ও অনুকরণীয়”। এ কথাগুলো স্মরণ রাখলে বহু সংশয়ের নিরসন হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
মুফতী মাও. আব্দুর রহীম লাজপুরী রাহ. তদীয় ফাতাওয়ায়ে রাহিমিয়া গ্রন্থে এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন:
صحابہ کرام معیار حق ہیں۔ اس کا معنی مطلب یہ ہے کہ ان کے اقوال وافعال حق و باطل کی کسوٹی ہیں، ان حضرات نے جو فرمایا، یا جو دینی کام کیا، وہ ہمارے لئے مشعل راہ، حجت اور ذریعہ فلاح ہیں
‘সাহাবায়ে কেরাম সত্যের মাপকাঠি’— এর মানে হলো তাঁদের কথা ও কাজ হক ও বাতিলের কষ্টিপাথর। তাঁরা যা বলেছেন এবং যেসব দ্বীনী কাজ করেছেন, এগুলো আমাদের জন্য হেদায়েতের আলো, প্রামাণ্য দলীল এবং সফলতার মাধ্যম। (ফাতাওয়া রাহিমিয়া ৩য় খণ্ড, পৃ. ৯৭, করাচী, পাকিস্তান)

★ কুরআনের আলোকে সত্যের মাপকাঠি
১. পবিত্র কুরআনের নির্যাস হল সূরায়ে ফাতেহা। এই সূরাতে আল্লাহ পাক মানবজাতিকে একমাত্র যে দোয়াটি শিক্ষা দিয়েছেন, তা হলো—
اهدنا الصراط المستقيم صراط الذين انعمت عليهم غير المغضوب عليهم ولا الضالين
“(হে আল্লাহ!) আমাদেরকে পরিচালিত কর সিরাতে মুসতাক্বিম তথা ঐ সকল লোকের পথে যাঁদেরকে তুমি পুরস্কৃত করেছ এবং যাঁরা অভিশপ্ত ও পথভ্রষ্ট নন”। (সূরায়ে ফাতিহা)
উপরোক্ত আয়াতসমূহে মহান আল্লাহ সুরাতে মুসতাকিমের ব্যাখ্যা (صراط الله) আল্লাহর পথ, (صراط الرسول) রাসূলের পথ বা (صراط القرآن) কুরআনের পথ প্রভৃতি দ্বারা করেন নি বরং তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে, খোদার পুরস্কারপ্রাপ্ত বান্দারা যে পথে চলেন, সেটা হলো সিরাতে মুসতাক্বিম বা সহজ-সরল পথ, সত্য পথ তথা মুক্তির ও বেহেশতের পথ। পুরষ্কৃত বান্দা কারা? তাও অন্যত্র বলে দিয়েছেন:
الذين انعم الله عليهم من النبيين والصديقين والشهداء والصالحين.
“যাঁদেরকে আল্লাহ পাক পুরস্কৃত করেছেন তাঁরা হলেন (চার প্রকার) নবীগণ, সিদ্দীকগণ, শহীদগণ এবং নেক বান্দাগণ”। (সূরা নিসা-৬৯)
বুঝা গেল যে, উক্ত চারি প্রকার বন্দাদের পথই হলো সিরাতে মুস্তাকিম। এখন দেখা যাক যে, সাহাবায়ে কেরাম এ চারি প্রকারের আন্তর্ভুক্ত কি না? হ্যাঁ! আমরা দেখতে পাই যে, তাঁরা শেষোক্ত তিন প্রকারের অন্যতম। যেমন হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. এবং আম্মাজান হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা. প্রমুখ হলেন সিদ্দীকীনদের অন্তর্ভুক্ত, আর যে সকল সাহাবী নানাভাবে শাহাদত বরণ করেছেন তাঁরা হলেন শহীদগণের অন্যতম এবং অবশিষ্ট সকল সাহাবী হচ্ছেন সালেহীনের অন্তর্ভুক্ত।
অর্থাৎ সাহাবায়ে কেরাম সবাই খোদার পুরস্কৃত বান্দা। কুরআন শরীফের বিভিন্ন আয়াতে আল্লাহ তা’আলা তাদের পুরস্কারের কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন এক আয়াতে এরশাদ করেছেন:
وكلا وعد الله الحسنى
“সকল সাহাবিকে আল্লাহ তা’আলা বেহেশতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন”। (সূরা হাদীদ-১০)
অতএব, সাহাবায়ে কেরামের মত এবং তাঁদের প্রদর্শিত পথই হলো সিরাতে মুস্তাকিম বা সত্য পথ এবং তাঁরা হলেন সত্যের মাপকাঠি।

২. মুনাফিকদের সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেন:
وإذا قيل لهم أمنوا كما أمن الناس قالوا انؤمن كما أمن السفهاء الا انهم هم السفهاء ولكن لا يعلمون
“যখন তাদেরকে (মুনাফিকদেরকে) বলা হয় যে, তোমরা ঈমান আনয়ন কর যেভাবে ঈমান এনেছে অন্যান্য লোকজন (সাহাবীগণ), তখন তারা বলে- আমরা কি বোকাদের মত ঈমান আনবো? (আল্লাহ পাক বলেন) জেনে রেখ, ওরাই (মুনাফিকরাই) হলো প্রকৃত বোকা। কিন্তু তারা তা উপলব্ধি করতে পারে না। (সূরা বাকারা, আয়াত-১৩)
এ আয়াতে الناس ‘অন্যান্য লোকজন’ মানে সাহাবায়ে কেরাম, যেমন তাফসীরে জালালাইনে আছে-
اصحاب النبي صلى الله عليه وسلم
তাই বুঝা গেল যে, সাহাবিদের ঈমানই হচ্ছে গ্রহণযোগ্য ঈমান। যেহেতু মুনাফিকদের ঈমান সাহাবিদের ঈমানের মত হয় নি, এজন্যে তাদের ঈমান খোদার দরবারে গৃহীত হয়নি।

৩. ইহুদিদের সমালোচনা প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা সাহাবায়ে কেরামকে সম্বোধন করে বলেন:
فأن أمنوا بمثل ما أمنتم به فقد اهتدوا وان تولوا فأنما هم في شقاق.
“যদি তারা (ইহুদিরা) ঈমান আনে যেভাবে তোমরা ঈমান এনেছ, তাহলে তারা হেদায়ত পাবে। আর যদি তারা এ থেকে বিমুখ হয়ে যায়, তবে তারা রয়ে যাবে খোদাদ্রোহিতার মধ্যে।” (সূরা বাক্বারা-১৩৭)
এ আয়াত দ্বারাও প্রমাণিত হয় যে, সাহাবীগণ ঈমান তথা সত্যের মাপকাঠি। যে ব্যক্তি তাঁদের মত খাঁটি ও ভেজালমুক্ত ঈমান আনবে, সেই হেদায়েত লাভ করতে পারবে নতুবা তার ঈমান হবে গুমরাহী ও প্রত্যাখ্যাত। আর অনেক ইহুদি যেহেতু সাহাবিদের মত ঈমান আনেনি, তাই তাদের ভাগ্যে হেদায়েত জুটেনি।

৪. অন্যত্র আল্লাহ পাক ঘোষণা করেছেন:
ومن يشاقق الرسول من بعد ما تبين له الهدى ويتبع غير سبيل المؤمنين نوله ما تولى ونصله جهنم و ساءت مصيرا
“যে ব্যক্তি হেদায়েতের পথ স্পষ্ট হওয়ার পরও রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং মুমিনদের ভিন্ন পথ অনুসরণ করে, তার দায়িত্ব তার উপর চাপিয়ে দেব এবং তাকে দোযখে নিক্ষেপ করবো এবং দোযখ একটি নিকৃষ্ট অবস্থানাগার”। [সূরা নিসা, আয়াত: ১১৫]
এ আয়াতে مؤمنين (মুমিনীন) মানে সাহাবায়ে কেরাম। কেননা, কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার যুগে তাঁরাই ছিলেন মুমিন।
লক্ষ করুন! যদি রাসূলে খোদাই একমাত্র মাপকাঠি বা মিয়ার হতেন, তাহলে উপরোক্ত আয়াতে من يشاقق الرسول (যে ব্যক্তি রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে) বলাই যথেষ্ট ছিল, কিন্তু আল্লাহ তা’আলা এর পর ويتبع غير سبيل المؤمنین (এবং মুমিনদের ভিন্ন পথ অনুসরণ করে) বলে স্পষ্ট করে দিলেন যে, সাহাবিদের ভিন্ন পথ অবলম্বন করাই হলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধাচরণ এবং একমাত্র সাহাবিদের অনুসরণের মাধ্যমেই বাস্তবায়িত হয় রসূলের আনুগত্য, ভিন্ন পথে নয়। অতএব, এ আয়াত দ্বারাও বুঝা গেল যে, সাহাবায়ে কেরাম সত্যের মাপকাঠি এবং তাঁদের অনুসরণ করা জরুরী।

৫. সূরায়ে তাওবায় মহান আল্লাহ এরশাদ করেন:
والسابقون الأولون من المهاجرين والانصار والذين اتبعوهم بأحسان رضي الله عنهم ورضوا عنه
“প্রথম পর্যায়ের মুসলমানগণ অর্থাৎ মুহাজির ও আনসার এবং যাঁরা সুন্দরভাবে তাদের অনুসরণ করেছে, আল্লাহ তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তাঁরাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট।” (সূরা তাওবা-১০০)
এ আয়াতে السابقون الاولون “প্রথম পর্যায়ের মুসলমান” দ্বারা সমস্ত আনসার ও মুহাজির এবং الذين اتبعوهم باحسان ‘যারা সুন্দরভাবে তাঁদের অনুসরণ করেছে’ দ্বারা ঐ সকল লোকদের বুঝানো হয়েছে, যারা কেয়ামত পর্যন্ত ঈমান ও আনুগত্যের মাধমে সাহাবিদের অনুসরণ করবে। এটা অধিকাংশ মুফাসসিরীনে কেরামের অভিমত।
তাই বুঝা গেল যে, সমস্ত মুহাজির ও আনসারদের উপর আল্লাহ পাক সন্তুষ্ট এবং যারা তাঁদের অনুসরণ করবে, তাঁদের উপরও তিনি সন্তুষ্ট। অতএব, প্রমাণিত হল যে, তাঁরা সবাই অনুসরণীয় এবং তাঁদের অনুসরণের মাধ্যমেই আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা সম্ভব।

★ হাদীসের আলোকে সত্যের মাপকাঠি
বিভিন্ন হাদীসে নবী করীম সা. সাহাবায়ে কেরামকে সত্যের মাপকাঠি নির্ধারিত করেছেন এবং তাঁদের অনুসরণ করার স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন। এর কয়েকটি নিম্নরূপ:
১. হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমর রা. বলেন যে, রাসূলুল্লাহ সা. এরশাদ করেছেন, বনী ইসরাঈল বিভক্ত হয়েছিল বাহাত্তর দলে, আর আমার উম্মত বিভক্ত হবে তেহাত্তর দলে। তন্মধ্যে সব দলই হবে দোযখী, আর মাত্র একটি হবে বেহেশতী। সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, হুজুর! সেটি কোন দল? রাসূল সা. উত্তর দিলেন- ما انا عليه واصحابي ‘যারা আমার এবং আমার সাহাবিদের নীতিমালার উপর থাকবে (তারাই হলো বেহেশতী)।
এ হাদীস দ্বারা স্পষ্টত বুঝা গেল যে, সাহাবায়ে কেরামও সত্যের মানদণ্ড। কেননা, যদি নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই একমাত্র মানদণ্ড হতেন, তাহলে শুধু ما انا عليه বলাই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু রাসূল সা. واصحابي বলে পরিষ্কার করে দিলেন যে, বেহেশতী ও নাজাতপ্রাপ্ত দলের অন্তর্ভুক্ত হতে হলে আমার সাহাবিদেরও অনুসরণ করতে হবে।

২. হযরত আনাস রা. বলেন যে, রাসুল সা. এরশাদ করেছেন,
مثل اصحابى فى امتى كالملح فى الطعام لا يصلح الطعام إلا بالملح – مشكوة
“উম্মতের মধ্যে আমার সাহাবিদের তুলনা এমন, যেমন খাদ্যের মধ্যে লবণ। খাদ্য লবণ ব্যতীত বিশুদ্ধ হয় না। (ঠিক তেমনি উম্মতের বিশুদ্ধতা ও সংশোধন সাহাবা ব্যতীত হতে পারেনা।)” [মিশকাত শরীফ]
হযরত হাসান বসরী রাহ. এ হাদীস বর্ণনা করার পর আক্ষেপ করে বলেন, হায়! আমাদের লবণ (লবণতুল্য সাহাবায়ে কেরাম) চলে গেলেন, এখন আমরা কিভাবে বিশুদ্ধতা ও হেদায়েত লাভ করবো?
মোল্লা আলী ক্বারী রাহ. বলেন,
قلت نصلح بكلامهم ورواياتهم ومعرفة مقاماتهم وحالاتهم والاقتداء بأخلاقهم وصفاتهم (مرقاة)
“সাহাবায়ে কেরামের বাণী, তাঁদের বর্ণনাবলী, তাঁদের ফযীলত ও মর্যাদা উপলব্ধি এবং তাঁদের চরিত্র ও গুণাবলীর অনুকরণের মাধ্যমে আমরা হেদায়েত লাভ করবো।” [মিরকাত]
শ্রদ্ধেয় পাঠক! লক্ষ করুন, উপরের হাদীসে সাহাবায়ে কেরামকে লবণের সাথে তুলনা করে রাসূলে করীম সা. পরিষ্কার করে দিলেন যে, খাদ্য লবণ ব্যতীত যেমন বিশুদ্ধ ও সুস্বাদু হয় না, ঠিক তেমনি আমার উম্মতের বিশুদ্ধতা ও হেদায়েত সাহাবিদের অনুসরণ ব্যতীত সম্ভব নয়। তাই বুঝা গেল যে, সাহাবীগণও সত্যের মাপকাঠি এবং তাঁদের অনুসরণ জরুরী।

৩. হযরত উমর রা. বলেন যে, আমি শুনেছি যে, রাসূল সা. এরশাদ করেছেন-
سألت ربي عن اختلاف اصحابي من بعدي فأوحى الى يا محمد ان اصحابك عندی بمنزلة النجوم في السماء بعضها اقوى من بعض ولكل نور فمن أخذ بشيئ مما هم عليه من اختلافهم فهو عندى على هدى (مشكوة كتاب المناقب)
“আল্লাহ পাকের দরবারে আমার পরে আমার সাহাবিদের এখতেলাফ ও মতপার্থক্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। আল্লাহ পাক ওহীর মাধ্যমে আমাকে জানালেন, হে মুহাম্মদ! (আপনি বিচলিত হবেন না। কেননা) আপনার সাহাবীগণ আমার নিকট আকাশের নক্ষত্রতুল্য। একজন অপরজন থেকে তেজ ও দীপ্তিময় এবং প্রত্যেকই জ্যোতির্ময়। অতএব, যে ব্যক্তি সাহাবিদের অভিমতসমূহের যে কোনটি গ্রহণ করবে, সে আমার নিকট হেদায়েতের উপর বলে গণ্য হবে।” (মিশকাত শরীফ)
এ হাদীসও স্পষ্ট প্রমাণ যে, সাহাবিদের প্রত্যেকই অনুসরণীয় এবং যে কোন সাহাবীর অনুকরণের মধ্যে আছে হেদায়েত নিহিত। যদি কোন বিষয়ে দুই সাহাবীর দ্বিমত পাওয়া যায়, তাহলে যে কোন সাহাবীর অনুকরণ করলেই হেদায়েত, মুক্তি ও নাজাত পাওয়া যাবে। তবে অন্য সাহাবীর কথা ভুল বা গোমরাহী বলা যাবে না।

৪. হযরত হুযায়ফা রা. বলেন যে, নবী করীম সা. এরশাদ করেছেন:
اقتدوا بالذين من بعدی ابی بکر و عمر (رواه الترمذی وقال هذا حديث حسن)
“আমার পর আবু বকর ও উমরের অনুসরণ করবে।” (তিরমিযী শরীফ, হাদীস নং ৩৬৬৩)

৫. হযরত ইরবাজ ইবনে সারিয়া রা. থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে রাসূল সা. বলেছেন,
فأنه من يعش منكم من بعدى فسيرى اختلافا كثيرا فعليكم بسنتى وسنة الخلفاء الراشدين المهديين تمسكوا بها وعضوا عليها بالنواجذ
“তোমাদের মধ্য থেকে যারা আমার পর জীবিত থাকবে, তারা অল্প দিনের মধ্যেই বহু মতভেদ পরিলক্ষিত করবে, তখন তোমরা আমার সুন্নতকে এবং সৎপথপ্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নতকে আঁকড়িয়ে ধরবে এবং উহাকে আঁকড়িয়ে ধরে থাকবে।” (আহমদ, আবু দাউদ, তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ)

৬. হযরত জাবির বিন আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-
رأيت رسول الله صلى الله عليه وسلم في حجته يوم عرفة وهو على ناقته القصواء يخطب سمعته يقول: يا أيها الناس إنى تركت فيكم ما ان أخذتم به لن تضلوا كتاب الله وعترتي أهل بیتی – رواه الترمذي
“বিদায় হজ্জে আরাফাতের ময়দানে আমি রাসূলে করীম সা.-কে তাঁর কাছওয়া নামীয় উষ্ট্রীর উপর থেকে ভাষণ দিতে দেখেছি। সে ভাষণে তিনি পরিষ্কার ঘোষণা করেছেন যে, হে মানবজাতি! আমি তোমাদের মধ্যে এমন দু’টি বস্তু ছেড়ে যাচ্ছি, যার অনুসরণ করলে তোমরা কখনো গোমরাহ হবে না। ১. আল্লাহর কিতাব, ২. আমার ইতরত বা পরিবারবর্গ। (তিরমিযী)
লক্ষণীয় যে, মানবতার মুক্তিসনদ বিদায় হজ্জের অবিস্মরণীয় ভাষণের গুরুত্ব কে না জানে? এ ভাষণে তিনি আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর পরিবারভুক্ত সাহাবীদেরকে রক্ষাকবচ নির্ধারিত করেছেন এবং বলেছেন যে, তাঁদের অনুসরণ করলে কেউ কখনো গোমরাহ হবে না।
উপরের হাদীসসমূহ দ্বারা স্পষ্ট প্রমাণিত হয়ে গেল যে, শুধু ইজমায়ে সাহাবা বা সাহাবায়ে কেরামের ঐকমত্যই অনুসরণীয় নয়, বরং পৃথকভাবে প্রত্যেক সাহাবীও অনুসরণযোগ্য। এজন্যই তো নাম ধরে হযরত আবু বকর রা., হযরত উমর রা., খোলাফায়ে রাশেদীন এবং নিজের আহলে বায়ত সাহাবিদের অনুসরণের আদেশ দিয়েছেন। যারা শুধু সাহাবায়ে কেরামের ইজমাকে হুজ্জত ও অনুসরণীয় মনে করেন, তারা মূলত সাহাবিদের মর্যাদা উপলব্ধি করতে সক্ষম হননি। কেননা, প্রত্যেক যুগের আলেমদের ইজমাই (সর্বসম্মত সিদ্ধান্তই) তো হচ্ছে হুজ্জত। সুতরাং এক্ষেত্রে সাহাবী ও অন্যদের মধ্যে পার্থক্য রইলো কোথায়?

৭. প্রসিদ্ধ হাদীসে আছে যে, হুযূর সা. ঘোষণা করেছেন,
قال رسول الله صلى الله عليه وسلم أصحابي كالنجوم بأيهم اقتديتم اهتديتم – (رواه الدار قطنی)
“আমার সাহাবীগণ তারকাসদৃশ। তোমরা তাঁদের মধ্য থেকে যাঁকেই অনুসরণ করবে, হেদায়েত পাবে।” (দারা কুতনী)
এ হাদীস দ্বারাও সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, প্রত্যেক সাহাবীই অনুসরণযোগ্য এবং যে কোন একজন সাহাবীর অনুসরণের মধ্যে আছে হেদায়েত নিহিত।
উপরের আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয়ে গেল যে, সাহাবায়ে কেরামকে অনুসরণীয় ও সত্যের মাপকাঠি দাবী করা কোন প্রমাণহীন কথা নয়, বরং এ দাবীর পেছনে রয়েছে কুরআন ও হাদীস থেকে ভুরী ভুরী প্রমাণ।

★ একটি ভ্রান্তি ও এর মূলোৎপাটন
যারা সাহাবায়ে কেরামকে অনুসরণযোগ্য ও সত্যের মাপকাঠি মানেন না, তারা দীর্ঘদিন যাবৎ একটি অপপ্রচার করে আসছেন। এখানে এর ভ্রান্তি উদঘাটন করা অতি প্রয়োজনীয়।
মওদূদীবাদী গ্রুপের উকিল জনাব বশীরুজ্জামান সাহাবায়ে কেরাম সত্যের মাপকাঠি নন প্রমাণ করতে গিয়ে উল্লিখিত ৭নং হাদীস সম্পর্কে বলেন, “এ হাদিসটি আসলে একটি জয়ীফ বা দুর্বল হাদিস। আর জয়ীফ হাদিস কখনও দলিল হিসেবে গ্রহণ করা যায় না এটা সর্বসম্মত কথা।” (সত্যের আলো-৩৯)
আরেক মওদূদীবাদী আসলাম হুসাইন সাহেব তার এক ফেসবুক পোস্টে হাদীসটাকে জাল, বানোয়াট, মনগড়া বলেছেন।
এছাড়া মওদূদী সাহেবের অনুসারীরা অহরহ অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন যে, আলোচ্য হাদীসটি দুর্বল, দলীল হওয়ার অযোগ্য।
তাদের বক্তব্য দ্বারা বোঝা যায় যে, সাহাবায়ে কেরামকে সত্যের মাপকাঠি দাবীদাররা শুধু এ হাদীস দ্বারাই প্রমাণ করে থাকেন এবং তাদের কাছে এ হাদীস ছাড়া অন্য কোন প্রমাণ নেই এবং এটা হচ্ছে জয়ীফ হাদীস, যা দলীল হিসেবে গৃহীত হতে পারেনা। অথচ উপরে আমাদের দীর্ঘ আলোচনা থেকে দিবালোকের মত উজ্জ্বল হয়ে গেছে যে, সাহাবায়ে কেরাম অনুসরণীয় ও সত্যের মাপকাঠি প্রমাণিত হওয়া এ হাদীসের উপরই নির্ভর করেনা; বরং কুরআন শরীফের বিভিন্ন আয়াত এবং অনেক সহীহ হাদীস দ্বারা তা প্রমাণিত।
সহৃদয় পাঠক! আসুন, এখন আমরা এ হাদীস সম্পর্কেও একটু আলোচনা করে দেখি যে, সত্যিই কি এটা এমন দুর্বল যে, দলীল হিসেবে গ্রহণ করার উপযুক্ত নয়? হাদীসটি সম্পর্কে মুহাদ্দিসীনে কেরামের অভিমত নিম্নরূপ:

★ হাদীস أصحابي كالنجوم এর সঠিক মূল্যায়ন
উক্ত হাদীস সম্পর্কে প্রখ্যাত মুহাদ্দিস মোল্লা আলী কারী রাহ. নিম্নোক্ত তথ্য পেশ করেছেন: “হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. তাখরীজে আহাদীসে রাফেয়ী নামক কিতাবের ‘আদাবুল কাযা’ শীর্ষক অধ্যায়ে উক্ত হাদীসের উপর দীর্ঘ আলোচনা করে বলেন যে, এ হাদীসটি অত্যন্ত দুর্বল, বরং ইবনে হাজম তো এটাকে জাল ও বাতিল আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু ইমাম বায়হাক্বী রাহ. বলেন যে, মুসলিম শরীফের একটি সহীহ হাদীসে অর্থগতভাবে এর সমর্থন পাওয়া যায়। পূর্ণ হাদীসটি নিম্নরূপ:
النجوم امنة للسماء، فأذا ذهبت النجوم إتى السماء ما توعد وانا امنة لا صحابي، فأذا ذهبت اتى اصحابي ما يوعدون، واصحابي امنة لامتي، فأذا ذبت اصحابي اتى امتی ما یوعدون (صحیح مسلم ج ٢ ص ٣۰۸ باب بيان ان بقاء النبي صلى الله عليه وسلم امان لا صحابه وبقاء اصحابه امان للامة)
কেননা, আলোচ্য হাদীসের মত এ হাদীসেও সাহাবায়ে কেরামকে তারকার সাথে তুলনা করা হয়েছে। হাফিয ইবনে হাজার রাহ. বলেন যে, ইমাম বায়হাক্বী ঠিকই বলেছেন। বাস্তবিকই মুসলিম শরীফের সহীহ হাদীসটি সাহাবাকে তারকাতুল্য আখ্যায়িত করার বিষয়কে বিশুদ্ধ ও শক্তিশালী করে দেয়। তবে সাহাবিদের অনুসরণের ব্যাপারটি এ হাদীস দ্বারা পরিষ্কার বুঝা যায়না। হ্যাঁ! তারকার মাধ্যমে যেহেতু সঠিক পথ লাভ করা যায়, তাই তারকার সাথে তুলনা করা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, তাঁদের মাধ্যমেও হেদায়েত ও সত্যপথ পাওয়া যাবে। মোল্লা আলী কারী রাহ. বলেন যে, অনুসরণের ব্যাপারটিও এ হাদীস থেকে স্পষ্টভাবে বুঝা যায়। কেননা, হেদায়েতপ্রাপ্তি হচ্ছে অনুসরণেরই ফলশ্রুতি।” [মিরকাত ১১\২৮০]
আলোচ্য হাদীস সম্পর্কে আল্লামা আব্দুল হাই লাখনভী রাহ. বলেন: “উক্ত হাদীসকে ইমাম দারা কুতনী তাঁর ‘আল মুতালাফ’ এবং ‘গারায়েবে মালিক’ নামক কিতাবদ্বয়ে, আল্লামা কুযায়ী ‘মুসনাদে শিহাব’ নামক কিতাবে, মুহাদ্দিস আবদ বিন হুমায়েদ, ইমাম বায়হাক্বী আল-মদখল নামক কিতাবে, ইমাম ইবনে আদী ‘আল-কামিল’ এর মধ্যে, ইমাম দারিমী, আল্লামা ইবনে আব্দুল বার, আল্লামা ইবনে আসাকির, আল্লামা আবু আব্দুল্লাহ আল-হাকিম প্রমুখ মনীষীগণ বিভিন্ন সনদে রেওয়ায়েত করেছেন। তাঁদের রেওয়ায়েতসমূহের মধ্যে শাব্দিক ভিন্নতা থাকলেও অর্থগতভাবে সবগুলি সমার্থক। তবে হাদীসটির যাবতীয় সনদই দুর্বল বা জয়ীফ। যেমন হাফেজ ইবনে হাজার রাহ. الكاف الشاف في تخريج احاديث الكشاف নামক কিতাবে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
কিন্তু কাসরাতে তুরুক বা সনদের বহুলতার কারণে হাদীসটি ‘হাসান’ (প্রমাণযোগ্য হাদীসের প্রকারবিশেষ) এর সীমানায় পৌঁছে গেছে। এজন্যেই ইমাম সাগানী রাহ. উক্ত হাদীসকে ‘হাসান’ আখ্যায়িত করেছেন। যেমন আল্লামা সায়্যিদ জুরজানী রাহ. মিশকাত শরীফের টিকায় তা উল্লেখ করেছেন। তিনি فضل العالم على العابد এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেছেন যে, অন্য এক হাদীস أصحابي كالنجوم এর মধ্যে সাহাবীদিগকে তারকার সাথে তুলনা করা হয়েছে। এ হাদীসকে ইমাম সাগানী রাহ. ‘হাসান’ ও প্রমাণের যোগ্য আখ্যা দিয়েছেন। (ইকামাতুল হুজ্জাহ, পৃ. ৪৮)
মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী রাহ. বলেন, أصحابي كالنجوم হাদীসটি মিশকাত শরীফে রাযীন রাহিমাহুল্লাহর বর্ণনায় বিদ্যমান আছে। তবে সিহাহ সিত্তার মধ্যে এ হাদীসটি নেই। মিশকাত শরীফ প্রণেতা এর উপর কোন আলোচনা করেননি। হাফেজ ইবনে হাজার রাহ. প্রমুখ এটাকে দুর্বল আখ্যা দিয়েছেন। তবে এই হাদীসের সমর্থনে হাদীস আরোও আছে। যেমন ‘আমার সাহাবীদের মতপার্থক্য রহমত’, ‘আমার উম্মতের মতবিরোধ রহমতস্বরূপ’। এসব মিলে হাদীসটি হাসান লিগায়রিহ্ বা দলীল হিসেবে গ্রহণ করার যোগ্য হয়ে গেছে। (সাবীলুর রাশাদ, পৃ. ৪)
প্রখ্যাত তাপস ও আরেফ বিল্লাহ ইমাম আব্দুল ওয়াহ্হাব শা’রানী রাহ. এ হাদীস সম্পর্কে বলেন-
هذا الحديث وان كان فيه مقال عند المحدثين فهو صحيح عند أهل الكشف ~ میزان الکبری
“এ হাদীস সম্পর্কে যদিও মুহাদ্দিসীনে কেরামের কথাবার্তা আছে, কিন্তু কাশফসম্পন্ন বুযুর্গদের মতে এটা সহীহ ও প্রথম শ্রেণীর প্রমাণযোগ্য হাদীস।” (মিজানুল কুবরা ১ম খন্ড, পৃ. ২৮)
যারা সাহাবায়ে কেরামকে সত্যের মানদণ্ড স্বীকার করেন না, তারা যেহেতু তাসাউফকেও অস্বীকার করেন, তাই তারা কাশফের মত দৌলত হতে বঞ্চিত। এ জন্যই তারা এ হাদীসের বিশুদ্ধতা উপলব্ধি করতে সক্ষম হননি।

আলোচ্য হাদীস সম্পর্কে উল্লিখিত আলোচনা থেকে যে কথাগুলো স্পষ্টভাবে বুঝা গেল, সেগুলো হচ্ছে এই:
১. প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইবনে হাযম উক্ত হাদীসকে জাল ও বাতিল আখ্যা দিয়েছেন। তবে মুহাদ্দিসীনে কেরামের কেউই এ ব্যাপারে তার সাথে একমত হননি।
২. হাফিজ ইবনে হাজার প্রমুখ মুহাদ্দিসীন এটাকে অত্যন্ত দুর্বল আখ্যায়িত করেছেন।
৩. ইমাম বায়হাক্বী, হাফিজ ইবনে হাজার ও মোল্লা আলী কারী বলেন যে, এ হাদীসটি দুর্বল হলেও অর্থগতভাবে মুসলিম শরীফের একটি সহীহ হাদীস দ্বারা সমর্থিত।
৪. ইমাম সাগানী, আল্লামা সাইয়্যিদ জুরজানী, আল্লামা আব্দুল হাই লাখনভী, মাও. রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী প্রমুখ এ হাদীসকে হাসান বা গ্রহণযোগ্য বলে অভিহিত করেছেন।
৫. কাশফ ও অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন বুজুর্গানে দ্বীনের মতে এটা একটি সহীহ বা বিশুদ্ধ এবং প্রথম শ্রেণীর প্রমাণযোগ্য হাদীস।

মোটকথা, আলোচ্য হাদীসটি ‘জয়ীফ’ হলেও সহীহ হাদীস দ্বারা সমর্থিত, বহু সনদে বর্ণিত, অনেক মুহাদ্দিসীনে কেরামের সিদ্ধান্তনুযায়ী ‘হাসান’ এবং অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন আউলিয়াদের মতে ‘সহীহ’। এখন সম্মানিত পাঠকই বিচার করুন যে, এ হাদীসটি কি সত্যিই প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করার অযোগ্য, না এটা বিরুদ্ধবাদীদের প্রোপাগাণ্ডা মাত্র? সত্যের আলো লেখক বশীরুজ্জামান সাহেব একতরফাভাবে শুধু সে সমস্ত মুহাদ্দিসীনে কেরামের অভিমত উল্লেখ করেছেন, যাঁরা এটাকে জয়ীফ আখ্যায়িত করেছেন আর যাঁরা এটাকে গ্রহণযোগ্য ও হাসান বলে অভিহিত করেছেন, তাঁদের কথা উল্লেখ করেননি। এটা কি হকপন্থীদের তরীকা? না এটাই ইকামাতে দ্বীনের পদ্ধতি?

★ মওদূদী সাহেব ও أصحابي كالنجوم হাদীস : মওদূদীপন্থীদের কাছে প্রশ্ন?
সাহাবায়ে কেরামকে সত্যের মাপকাঠি মান্যকারী আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআত সচরাচর নবীজীর নিম্নোক্ত হাদীস উল্লেখ করেন:
اصحابی کالنجوم بأیھم اقتدیتم اھتدیتم
অর্থাৎ আমার সাহাবীগণ তারকাসদৃশ। তোমরা তাঁদের মধ্য থেকে যাঁকেই অনুসরণ করবে, হেদায়েত পেয়ে যাবে। [দারা কুতনী, মিরকাত, ইকামাতুল হুজ্জাহ, সাবীলুর রাশাদ]
আর মওদূদীবাদী গ্রুপের উকিল জনাব বশীরুজ্জামান সাহাবায়ে কেরাম সত্যের মাপকাঠি নন প্রমাণ করতে গিয়ে এই হাদীস সম্পর্কে বলেন, “এ হাদিসটি আসলে একটি জয়ীফ বা দুর্বল হাদিস। আর জয়ীফ হাদিস কখনও দলিল হিসেবে গ্রহণ করা যায় না এটা সর্বসম্মত কথা।” (সত্যের আলো-৩৯)
আর আসলাম হুসাইন সাহেব তার এক ফেসবুক পোস্টে হাদীসটাকে জাল, বানোয়াট, মনগড়া বলেছেন।
এছাড়া মওদূদী সাহেবের অনুসারীরা অহরহ অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন যে, আলোচ্য হাদীসটি দুর্বল, দলীল হওয়ার অযোগ্য। কিন্তু তারা হয়তো জেনেও গোপন রাখছেন অথবা জানেন না ; না জেনে থাকলে তাদের অবগতির জন্য বলছি যে, তারা নিজেদের যে মহান গুরু মওদূদী সাহেবের পক্ষে এতসব করছেন, সেই মওদূদী সাহেব কিন্তু হাদীসটিকে দলীল হিসেবে গণ্য করেন এবং এটাকে অন্যের বিরুদ্ধে দলীল হিসাবে পেশ করেছেন। তিনি শিয়া সম্প্রদায় সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে লিখেন,
تیسرے یہ کہ حضو ر صلی اللہ علیہ وسلم نے صرف یہی نہیں فرمایا ہے کہ ترکت فیکم الثقلین…بلکہ یہ بھی فرمایا ہے کہ علیکم بسنتی وسنۃ الخلفاء الراشدین المھدیین‘‘ (میری سنت اور ہدایت یافتہ خلفائے راشدین کی سنت پر چلو)، او ریہ بھی فرمایا ہے کہ: ’’اصحابی کالنجوم بایھم اقتدیتم اھتدیتم‘‘ (میرے اصحاب ستاروں کی مانند ہیں،ان میں سے جس کسی کی پیروی کرو گے ہدایت پائو گے)۔ پھر آخر کیا وجہ ہے کہ حضور صلی اللہ علیہ وسلم کے ایک ارشاد کو تولیا جائے اور دوسرے ارشادات کو چھوڑ دیا جائے؟ کیوں نہ اہل بیت سے بھی علم حاصل کیا جائے اور ان کے ساتھ خلفائے راشدین اور اصحاب نبی (رضی اللہ عنہم) سے بھی؟
অর্থাৎ তৃতীয়ত, রসূলুল্লাহ (স) কেবল “তোমাদের মাঝে দুটি ভারী জিনিস রেখে গেলামই” বলেননি, তিনি এ কথাও বলেছেনঃ
عَلَيْكُمْ بِسُنَتي وَسُنَّة الْخُلَفَاء الراشدين الْمَهْدِيِّينَ .
“তোমরা আমার সূন্নাত এবং হিদায়াতপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতের উপর চলো।” তিনি এও বলেছেনঃ
“আমার সাহাবারা নক্ষত্রমন্ডলীর মতো তাদের মধ্যে থেকে তোমরা যাকে অনুসরণ করবে, হিদায়াত লাভ করবে।” তাহলে রসূলের একটি বাণী গ্রহণ করা হবে আর অন্য সবগুলো বাদ দেয়া হবে এর কারণ কি? কেনোই বা আহলে বায়াতের সাথে সাথে খুলাফায়ে রাশেদীন এবং নবীর অন্যান্য সমস্ত সাহাবা থেকে ইলম হাসিল করা হবেনা? [রাসায়েল ও মাসায়েল ২য় খণ্ড : সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী, অনুবাদ : আবদুল মান্নান তালিব ও আবদুল আযীয, প্রকাশক : শতাব্দী প্রকাশনী ঢাকা, ৬ষ্ঠ মুদ্রণ : জুন ২০০৯, পৃষ্ঠা : ২৩৩]

দেখলেন! মওদূদী সাহেব হাদীসটাকে দলীল হিসাবে পেশ করেছেন। এখন মওদূদীর সাফাই উকিলদের কাছে প্রশ্ন যে, আলোচ্য হাদীসটি দুর্বল হয়ে থাকলে আপনাদের গুরু এটাকে দলীল হিসাবে কেন পেশ করলেন? তাহলে কি হাদীসটি শিয়াদের বিরুদ্ধে সবল এবং আপনাদের বিরুদ্ধে দুর্বল? নাকি যখন মওদূদী সাহেব এটাকে দলীল হিসাবে পেশ করেন, তখন সবল হয়ে যায় আর আমরা যখন এর দ্বারা দলীল দেই, তখন দুর্বল, জাল, বানোয়াট ও মনগড়া হয়ে যায়? আশা করি ভেবেচিন্তে এর জবাব দিবেন।
সত্যের আলো লেখকের কতিপয় জঘণ্য ভুল : আলোচ্য হাদীস সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে সত্যের আলো প্রণেতা বশীরুজ্জামান সাহেব লিখেছেন যে, “ইমাম বুখারী এ হাদিসের একজন বর্ণনাকারী সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন:
انه منكر الحديث
অর্থাৎ নিশ্চয়ই তিনি হাদিস শাস্ত্রে অপরিচিত ব্যক্তি।”
তিনি উপরোক্ত বক্তব্যে منكر الحديث (মুনকারুল হাদীস) শব্দকে মুনকিরুল হাদীস পড়ে এর অর্থ করেছেন হাদীস শাস্ত্রে অপরিচিত ব্যক্তি— যা সম্পূর্ণ ভুল। এ ধরনের জঘন্য ভুল হাদীস শাস্ত্রের প্রাথমিক ছাত্রও করে না। এতে বুঝা যায় যে, ইলমে হাদীস ও তার পরিভাষা সম্পর্কে তার ন্যূনতম জ্ঞানও নেই। انه منكر الحديث কথাটির সঠিক অর্থ হলো— নিশ্চয়ই এ বর্ণনাকারীর হাদীস মুনকার (দুর্বল হাদীসের প্রকারবিশেষ)।
তাছাড়া এ পৃষ্ঠায়ই তিনি দু’বার লিখেছেন ‘ইবনে মুঈন’। এটাও ভুল এবং শুদ্ধ হলো ইবনে মাঈন। দেখুন নিম্নোক্ত কিতাবাদি:
(١) عون المعبود شرح أبى داود ج ١ صفحه ٧٩
(٢) هامش بذل المجهود ج ١ صفحه ١٢٨
(٣) امعان النظر شرح نخبة الفكر
এছাড়াও তিনি এ পৃষ্ঠায় লিখেছেন ‘ইবনে কাইয়ুম’। এটাও ভুল এবং শুদ্ধ হলো ‘ইবনে কায়্যিম’, বিভিন্ন কিতাবে হরকত লাগিয়ে তা বুঝানো হয়েছে। এ ধরনের আরও অগণিত ভুল তার বইটিতে রয়েছে।
যে ব্যক্তি হাদীস শাস্ত্রের দু’জন জাগদ্বিখ্যাত ইমামের নামও শুদ্ধ করে লিখতে পারে না এবং ইলমে হাদীসের একটি গরিভাষিক শব্দকে শুদ্ধ করে পড়তে ও তার সঠিক অর্থ লিখতে পারে না, তার জ্ঞানের পরিধি যে কতটুকু তা সহজেই অনুমেয়। এ ধরনের ব্যক্তি যে কিভাবে হাদীস পর্যালোচনায় কলম ধরলেন তা ভাবতেও যে লজ্জা হয়। প্রবাদ আছে, অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্কর।

এ ধরনের নামধারী মাওলানা যদি মওদূদী সাহেবের ভুলকে শুদ্ধ, গোমরাহীকে হেদায়ত এবং ধংসাত্মক কাজকে সংস্কারমূলক কাজে পরিণত করার অপচেষ্টা না করেন, তাহলে দীনের এ মহান(!) খেদমত কে আঞ্জাম দেবে? হ্যাঁ এদের সম্পর্কেই তো আল্লাহর রাসুল সা. ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে,
حتى اذا لم يبق عالما اتخذالناس رؤوسا جاهلا فسئلوا فافتوا بغير علم فضلوا واضلوا ~ متفق عليه صحيح البخاري – رقم ١٠٠
অর্থাৎ অবশেষে যখন আল্লাহ পাক (দুনিয়ায়) কোনো আলেমকেই বাকী রাখবেন না, তখন লোকেরা অজ্ঞ জাহিলদেরকে নেতারূপে গ্রহণ করবে। অতঃপর তাদের নিকট (মাসআলা-মাসায়েল) জিজ্ঞাসা করা হবে আর তারা বিনা ইলমেই ফতোয়া দিবে। ফলে নিজেরাও গুমরাহ হবে এবং অপরকেও গুমরাহ করবে। (বুখারী-১০০, মুসলিম)
আসলাম হুসাইন সাহেবের বক্তব্য হল— “মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী রহ.-এর মতো একজন জগৎ বিখ্যাত মুহাদ্দিস সাহাবায়ে কেরামদেরকে সত্যের মাপকাঠি বানানোর জন্য যখন জাল হাদিসের আশ্রয় নেন তখন আফসোস করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না।
সাহাবায়ে কেরামদেরকে সত্যের মাপকাঠি বানানোর জন্য যারা মরিয়া তাদের পুঁজিই হলো এই বানোয়াট হাদিস। এখন পুঁজি বা ভিত্তিই যদি হয় মনগড়া হাদিস, তাহলে দাবি আর কতটুকু সত্য হতে পারে তা এখান থেকে খুব সহজেই অনুমান করা যায়।”
জবাবে আপনার গুরু মওদূদী সাহেবের বক্তব্য লক্ষ করুন। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি কুরআন অধ্যয়ন করে ইসলামের মূলনীতিকে খুব উত্তমরূপে বুঝে নিয়েছে এবং অধিকাংশ হাদীসের গভীরতর অধ্যয়নের দ্বারা হাদীস বিচারের দূরদৃষ্টি অর্জন করেছে কেবল সেই ব্যক্তিই দেরায়েতের মূলনীতি অনুসারে হাদীসের বক্তব্য বিচার করতে পারে। প্রচুর অধ্যয়ন ও গবেষণার ফলে মানুষের মধ্যে এমন এক শক্তির সৃষ্টি হয়, যদ্বারা সে রসূলে করীম (স)-এর মেজাজ প্রকৃতি অনুধাবন করতে পারে, তার মন ও মস্তিষ্কে ইসলামের সঠিক ভাবধারা দৃঢ়মূল হয়ে যায়। অতঃপর সে একটি হাদীস দেখে রসূলে করীম এরূপ বলতে পারতেন কিনা, কিংবা তাঁর আমল এরূপ হতে পারতো কিনা তা প্রথম দৃষ্টিতেই বুঝতে পারে। [তাফহীমাত ১ম খণ্ড (উর্দু), নির্বাচিত রচনাবলী ১ম খণ্ড\২য় ভাগ: ১৭১-১৭২]
আল্লাহ্ তায়ালা যাকে تفقه বা অনুধ্যান শক্তি দান করেছেন, কুরআন ও নবী-চরিতের গভীরতর অধ্যয়নের ফলে তার ভেতর এক বিশেষ মেজাজ বা বিচার শক্তির (Taste) সৃষ্টি হয়-ঠিক যেমন, কোনো প্রবীণ মণিকারের য়মধ্যে মণিমুক্তার সুক্ষ্মতম বৈশিষ্ট্যটি পর্যন্ত যাচাই করার মতো এক অন্তর্দৃষ্টি সৃষ্টি হয়। তার দৃষ্টি সামগ্রিকভাবে শরীয়াতের গোটা পদ্ধতির ওপর প্রসারিত এবং সে এ পদ্ধতির মূল প্রকৃতিকে চিনে নেয়। এরপর যখন তার সামনে খুঁটিনাটি বিষয় আসে তখন কোন্ জিনিসটি ইসলামের মেজাজ ও প্রকৃতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ আর কোনটি সঙ্গতিপূর্ণ নয়, তার বিচারশক্তিই তাকে বাতলে দেয়। সে যখন রেওয়ায়েতের প্রতি দৃষ্টিপাত করে, তখন সে ক্ষেত্রেও এ মাপকাঠিই গ্রহণ ও বর্জনের মানদণ্ডে পরিণত হয়। ইসলামের মেজাজ হচ্ছে-ঠিক নবী করীমের মেজাজ। যে ব্যক্তি ইসলামের মেজাজকে বোঝে এবং ব্যাপকভাবে কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতে রসুলের গভীরতর অধ্যয়ন করে থাকে, সে নবী করীমের মেজাজের সঙ্গে অত্যন্ত নিবিড়ভাবে পরিচিত হয়ে যায়। হাদীস সংক্রান্ত রেওয়ায়েত দেখার পর তার ভেতর কোন্ উক্তি বা কাজটি মহানবীর হতে পারে আর কোন্ জিনিসটি সুন্নাতে নববীর নিকটবর্তী, তা স্বভাবতই তার অন্তর্দৃষ্টি তাকে বাতলে দেয়। [তাফহীমাত ১ম খণ্ড (উর্দু) : ২৯৬-২৯৭ ; নির্বাচিত রচনাবলী ১ম খণ্ড\২য় ভাগ : ১৯৩]

এখন আপনার গুরু মওদূদীর উপরোক্ত মিয়ার তথা মাপকাঠির আলোকে হযরত শাইখুল ইসলাম রাহমাতুল্লাহি আলাইহি কি হাদীসটি গ্রহণ করতে পারেন না? অথচ আপনি নিজেই তাঁর ব্যাপারে লিখলেন জগৎবিখ্যাত মুহাদ্দিস। নাকি এ মাপকাঠি একমাত্র মওদূদীর জন্য নির্ধারিত ও সীমাবদ্ধ?

হে রাহমানুর রাহীম! আমাদের সবাইকে এদের গোমরাহী থেকে হেফাজত কর। আমীন ছুম্মা আমীন।

মাওলানা মুতিউর রহমান খান সাহেব থেকে সংগৃহিত

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ ক্যাটাগরির আরো
© All rights reserved © 2019 www.izharehaq.com
Theme Customized BY Md Maruf Zakir