ইক্বামাতে দ্বীনের তাৎপর্য এবং বাতিলপন্থীদের বিকৃত ব্যাখ্যা

‘ইক্বামাতে দ্বীন’ জামাতে ইসলামীর অতি পরিচিত একটি শ্লোগান।

তারা অবলীলাক্রমে অহরহ এ শ্লোগানটি ব্যবহার করে আসছেন এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে এর অপব্যাখ্যাও জনসমক্ষে পেশ করে চলছেন।
তাদের ধারণামতে ইক্বামাতে দ্বীনের তাৎপর্য হল ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সকল পর্যায়ে সমগ্র দ্বীনকে প্রতিষ্ঠা ও বাস্তবায়িত করা।
তারা মনে করেন, বর্তমানে আমাদের দেশের সকল বিভাগে যেহেতু দ্বীনের যাবতীয় বিধি-বিধান বাস্তবায়িত ও প্রতিষ্ঠিত নয়, বরং দেশটি এখনো মানবরচিত আইনানুযায়ী পরিচালিত হয়ে আসছে, তাই দেশে দ্বীন প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে জিহাদ করা ‘ফরযে আইন’ অর্থাৎ প্রত্যেক মুসলিমের অপরিহার্য দায়িত্ব। যারা এ জিহাদ বা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করছেন না এবং খানকা, মাদরাসা, মসজিদ, তাবলীগ ইত্যাদি নিয়ে বসে আছেন, তারা এ ফরযের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে চরম অপরাধ করে আসছেন। মওদূদীবাদীদের এ ধারণা কতটুকু গ্রহণযোগ্য— সে সম্পর্কে বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে কিঞ্চিত আলোকপাত করার প্রয়াস পাচ্ছি।

★ কুরআন পাকে ইক্বামাতে দ্বীনের নির্দেশ:
পবিত্র কুরআনের যে আয়াতটিতে ইক্বামাতে দ্বীনের আলোচনা ও নির্দেশ করা হয়েছে তা হল এই-
شرع لكم من الدين ما وصى به نوحا والذي أوحينا اليك وما وصينا به ابراهیم و موسیٰ و عیسیٰ ان اقيموا الدين ولا تتفرقوا فيه (الشوری – ۱۳)
অর্থ: আল্লাহ পাক তোমাদের জন্য দ্বীনের সে বিষয়ই নির্ধারিত করেছেন, যার আদেশ নূহকে করেছেন এবং যা আপনার নিকট ওহী করেছেন এবং যে নির্দেশ ইব্রাহীম, মূসা এবং ঈসাকে করেছেন, তা হল এই যে, তোমরা দ্বীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকো এবং দ্বীনের ব্যাপারে দ্বিধা-বিভক্ত হয়ো না। (সূরা শূরা-১৩)
এ আয়াতের পরিপ্রেক্ষিতে উপরোক্ত মহল মনে করেন যে, আয়াতে ‘দ্বীন’ মানে মানুষের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে সামাজিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের যাবতীয় নির্দেশাবলি, যা শরীয়তে বিদ্যমান রয়েছে। আর ইকামাতে দ্বীনের মর্ম হল, উল্লিখিত যাবতীয় আহকাম কায়েম বা প্রতিষ্ঠা করা। সুতরাং এ আয়াতে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী জীবন বিধানকে মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা ও বিজয়ী করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং তা একমাত্র ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমের মাধ্যমেই সম্ভব। শুধু ব্যক্তিগত জীবনে ইসলামী অনুশাসন মেনে চললেই উক্ত আদেশ পালন করা হবে না। তাই ইসলামী হুকুমত কায়েম করার উদ্দেশ্যে আন্দোলন ও জিহাদ করতে হবে, প্রয়োজনে জানও দিতে হবে, এ উদ্দেশ্য সাধনের অন্তরায় সকল পরিবেশ ও প্রতিবন্ধকতার মোকাবেলা করে তা দূর করতে হবে। তবেই দেশে বাস্তবায়িত হবে ইসলামী বিপ্লব এবং রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত হবে দ্বীন।
কিন্তু এটা আয়াতের এমন এক অভিনব ব্যাখ্যা বা তাফসীর; যা উক্ত আয়াতের বর্ণনাভঙ্গি মোটেই সমর্থন করেবনা এবং আমাদের জানামতে ইসলামের চৌদ্দশত বছরের ইতিহাসে কোনো নির্ভরযোগ্য তাফসীরবিদও এমন তাফসীর করেননি। এ আয়াত সম্পর্কে মুফাসসিরীনে কেরামের মতামত কী? তা উপস্থাপন করার আগে ‘ইক্বামাত’ ও ‘দ্বীন’ শব্দদ্বয়ের মর্ম উদঘাটন করা অতিশয় প্রয়োজনীয় মনে করি। কারণ তা মুফাসসিরীনে কেরামের ব্যাখ্যা অনুধাবনে যথেষ্ট সহায়ক হবে।

★ ইক্বামাত শব্দের মর্ম:
আয়াতে উল্লিখিত ‘আক্বীমূ’ পদটি ‘ইক্বামাত’ ধাতু হতে নির্গত। ইক্বামাত শব্দের অর্থ হল- কোনো কাজকে যথাযথভাবে পালন করা, সঠিকভাবে আঞ্জাম দেয়া। প্রখ্যাত আভিধানিক ও তাফসীরবিদ আল্লামা রাগিব ইসফাহানী রাহ. লিখেন,
إقامة الشيء : توفية حقه
সুতরাং কোনো কাজ নামেমাত্র করে নিলেই তার ইক্বামত হয় না; বরং ইক্বামাত তখনই হয়, যখন কাজটিকে সঠিক পদ্ধতিতে যথাযথ ও নিখুঁতভাবে পালন করা হয়। যেমন আল্লাহ পাক কুরআন শরীফে أقيموا الصلوة কথাটি বহুবার ব্যবহার করে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে ইকামাতে সালাতের নির্দেশ দিয়েছেন। এর অর্থ শুধু নামাজ পড়াই নয়; বরং এর মর্ম হল নামাযকে নিয়মিত, সময়মত সঠিক পদ্ধতিতে আদায় করা।

★ ‘দ্বীন’ শব্দের ব্যাখ্যা:
আরবী ভাষায় ‘দ্বীন’ শব্দটির বিভিন্ন অর্থ রয়েছে। যেমন প্রতিদান, আনুগত্য ইত্যাদি। কুরআনে পাকে ‘দ্বীন’ শব্দটি চারটি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যথা-
১. جَزَاء – প্রতিদান, প্রতিফল। যেমন- مالك يوم الدين অর্থাৎ প্রতিদান দিবসের মালিক। এ আয়াতে দ্বীন বলে আমলের প্রতিদান বুঝানো হয়েছে। আরবী ভাষা ও সাহিত্যে এ অর্থে শব্দটির ব্যবহার ব্যাপকভাবে পাওয়া যায়।
যেমন প্রবাদ আছে- كَمَا تَدِينُ تُدَانُ অর্থাৎ যেমন কর্ম তেমন ফল।
২. طاعَة – আনুগত্য। যেমন- الا لله الدين الخالص অর্থাৎ জেনে রেখো, একচ্ছত্র আনুগত্য কেবল আল্লাহ পাকেরই প্রাপ্য। (যুমার-৩)
৩. أصول الشرائع – শরীয়তের বুনিয়াদি বিষয়াবলি, যা সমস্ত নবীদের শরীয়তে এক ও অভিন্ন রয়েছে। অর্থাৎ মৌলিক বিশ্বাস, যথা তাওহীদ, রিসালত ও পরকালে বিশ্বাস এবং মৌলিক ইবাদত যেমন নামায, রোযা, যাকাত ও হজ্জের বিধান। এ ছাড়া চুরি, ডাকাতি, ব্যভিচার, মিথ্যা, প্রতারণা, অপরকে অন্যায়ভাবে নিপীড়ন করা, প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করার মতো অনাচারসমূহের নিষিদ্ধতা। নিম্নোক্ত আয়াতে এ ধরণের মৌলিক বিষয়াবলিকে দ্বীন বলা হয়েছে-
وما أمروا إلا ليعبدوا الله مخلصين له الدين حنفاء ويقيموا الصلوة ويؤتوا الزكوة وذالك دين القيمة
অর্থ: তাদেরকে (ইহুদি ও খ্রিস্টানদেরকে) এ কথারই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, তারা যেন আল্লাহ তা’আলার জন্যই একনিষ্ঠ আনুগত্যের মাধ্যমে তাঁর ইবাদত করে, সালাত কায়েম করে এবং যাকাত প্রদান করে। এটা সঠিক দ্বীন। (সূরা বায়্যিনাহ-৫)
লক্ষ করুন, এ আয়াতে ইখলাসের সাথে ইবাদত, সালাত ও যাকাতকেই দ্বীন আখ্যা দেয়া হয়েছে।
৪. ملة ، شريعة – জীবনবিধান। এ অর্থে দ্বীনের পরিধি খুবই ব্যাপক। মানবজীবনের সর্বক্ষেত্রে রয়েছে তার বিস্তৃতি। ব্যক্তিজীবন থেকে আরম্ভ করে পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, আন্তর্জাতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সকল বিষয় সংক্রান্ত যাবতীয় ও পূর্ণাঙ্গ বিধি-নিষেধ দ্বীনের অর্ন্তভুক্ত এবং এগুলোর সমষ্টির নামই হল দ্বীন। এ হিসেবে দ্বীন দু’ভাগে বিভক্ত। যথা-
(ক) দ্বীনে হক্ক বা আল্লাহর দেয়া পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান ও বিস্তারিত বিধি-নিষেধ, যা আল্লাহ পাক প্রত্যেক নবীর উম্মতকে যুগের চাহিদা অনুযায়ী দান করেছেন।
(খ) দ্বীনে বাতিল, বা মানবরচিত এমন বিধান, যা খোদায়ী বিধানের পরিপন্থী ও সাংঘর্ষিক।
কুরআন শরীফে উভয় প্রকারের বিধান ও আইন সম্পর্কে ‘দ্বীন’ শব্দের ব্যবহার পাওয়া যায়।
দ্বীনে হক অর্থে: যেমন-
ان الدين عند الله الاسلام
অর্থ: নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট দ্বীন হলো একমাত্র ইসলাম। (আলে ইমরান- ১৯)
اليوم اكملت لكم دينكم واتممت عليكم نعمتي ورضيت لكم الاسلام دينا
অর্থ: আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পরিপূর্ণ করে দিলাম। তোমাদের উপর আমার নিয়ামত পূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেব ইসলামের ওপর সন্তুষ্ট হয়ে গেলাম। (মায়িদা-৩)
و من يبتغ غير الاسلام دينا فلن يقبل منه
অর্থ: যে ব্যক্তি ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো দ্বীন অনুসন্ধান করবে, তার পক্ষ থেকে তা গৃহীত হবে না। (আলে ইমরান-৮৫)
দ্বীনে বাতিল অর্থে: যেমন-
وقال فرعون ذروني اقتل موسى وليدع ربه اني اخاف ان يبدل دينكم او ان يظهر في الارض الفساد
অর্থ: ফিরআউন বলল, আমাকে ছাড়ো, আমি মূসাকে হত্যা করবো। সে তার রব্বকে ডাকুক। আমি আশংকা করছি, সে তোমাদের দ্বীন বদলিয়ে দেবে অথবা দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে। (মু’মিন-২৬)
ما كان ليأخذ اخاه في دين الملك
অর্থ: হযরত ইউসুফ আ. মিশরের বাদশাহর দ্বীন অনুযায়ী তাঁর ভাইকে রাখতে পারতেন না। (ইউসুফ-৭৬)
উপরোক্ত আয়াত পঞ্চয়ের প্রথম তিনটিতে ‘দ্বীন’ বলে দ্বীনে হক তথা পূর্ণ ইসলামী শরীয়তকে বুঝানো হয়েছে, যা কিয়ামত অবধি অনাগত সকল লোকের, সকল দেশের ও সকল যুগের উপযোগী করে মহানবী সা.-কে দান করা হয়েছে এবং শেষোক্ত আয়াতদ্বয়ে ‘দ্বীন’ বলে দ্বীনে বাতিল অর্থাৎ মানবরচিত বিধান ও আইন যেমন ফিরআউন ও মিশরের বাদশাহর আইন বুঝানো হয়েছে।

★ আলোচ্য আয়াতে ‘দ্বীন’ শব্দের অর্থ: আলোচ্য আয়াতে اقيموا الدين বাক্যের মধ্যে উল্লিখিত দ্বীন শব্দের অর্থ কী, তা নির্ণয় করতে হলে একটি কথা অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে তা হল এই- কোনো শব্দের একাধিক অর্থ থাকলে সবগুলো অর্থ প্রত্যেক স্থানেই অথবা এক সাথে একই স্থানে গ্রহণ করা চলে না। কোন্ স্থানে কী অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে তা পূর্ণ বাক্য থেকেই বুঝা যায়। যে বাক্যে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে তা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ঐ শব্দের সঠিক অর্থ বুঝার উপায় নেই।
এ কথার আলোকেই মুসলিম উম্মাহর সকল তাফসীরবিদদের অভিন্ন ও সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হল, এখানে দ্বীন শব্দটি তার তৃতীয় অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে অর্থাৎ এখানে দ্বীন বলে শরীয়তের বুনিয়াদি শিক্ষা ও মৌলিক বিষয়াদি বুঝানো হয়েছে।
এখানে দ্বীন শব্দটি তার ব্যাপক অর্থে অর্থাৎ চতুর্থ অর্থে ব্যবহার করা হয়নি। পূর্ণ আয়াত থেকেই তা প্রতীয়মান হয়। কারণ আয়াতে এমন দ্বীন কায়েমের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যা হযরত নূহ আ. থেকে শুরু করে শেষ নবী সা. পর্যন্ত ছিল এক ও অভিন্ন। আর তা হচ্ছে ‘দ্বীনের মৌলিক বিষয়াদি’। শরীয়তের যাবতীয় বিধি-নিষেধ এর অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না। কারণ এ ব্যাপারে নবীদের শরীয়তের বিভিন্নতা রয়েছে। আল্লাহ পাক বলেন-
لكل جعلنا منكم شرعة ومنهاجا
অর্থ: তোমাদের মধ্য থেকে প্রত্যেকের জন্য পৃথক শরীয়ত ও স্বতন্ত্র পদ্ধতি নির্ধারণ করেছি। (মায়িদা-৪৮)
সুতরাং আলোচ্য আয়াতে ‘দ্বীন’ শব্দ দ্বারা শরীয়তের যাবতীয় মৌলিক ও অমৌলিক বিধি-বিধান বুঝে নিলে তা হবে আয়াতের বাচনভঙ্গির সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এজন্যই اقيموا الدین কথাটির অর্থ ‘ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করো’ বললে তা গ্রহণযোগ্য হবে না, হতে পারে না। এর সঠিক অর্থ হলো, ‘শরীয়তের মৌলিক বিষয়াদি যথাযথভাবে পালন করো’। অতএব, ইক্বামাতে দ্বীনের মর্ম হল— দ্বীনের বুনিয়াদি শিক্ষা ও মৌলিক বিষয়াদি যথাযথভাবে পালন করা, পরিবর্তন ও বর্জন না করা। এটাই সকল তাফসীরবিদদের সর্বসম্মত অভিমত। এ অভিমতের বিশুদ্ধতা আয়াতে উল্লিখিত নবীদের জীবনী পর্যালোচনা করলেও অতি সহজেই প্রতীয়মান হয়। কারণ এতে উল্লিখিত পাঁচজন নবীদের মধ্য থেকে হযরত নূহ, হযরত ইবরাহীম ও হযরত ঈসা আ. কোনো প্রকার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না, অথচ তাঁদেরকেও ইক্বামাতে দ্বীনের ওসিয়ত ও নির্দেশ করা হয়েছিল। তাই ইক্বামাতে দ্বীনের অর্থ ‘ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা’ এ কথা হজম করে নিলে বলতে হবে, তাঁরা এ আদেশ পালনে ব্যর্থ হয়েছেন এবং তাঁদের নুবুওয়াতের দায়িত্ব পালনে বিরাট ত্রুটি রয়ে গেছে (নাউযুবিল্লাহ)। পক্ষান্তরে মুফাসসিরীনে কেরামের অভিমত, যা আয়াতের বর্ণনাভঙ্গি খেকে স্পষ্টত প্রতিভাত হচ্ছে, তা হলো সম্পূর্ণ সংশয়মুক্ত। কারণ, নবীদের সবই দ্বীনের উপর যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠিত এবং শরীয়তের বিধিবিধানের সংরক্ষক ও পালনকারী ছিলেন, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।

★ কতিপয় শীর্ষস্থানীয় মুফাসসির ও নির্ভরযোগ্য তাফসীর গ্রন্থের উদ্ধৃতি:
এ সম্পর্কে মুসলিম উম্মাহর কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় মুফাসসির ও নির্ভরযোগ্য তাফসীর গ্রন্থের উদ্ধৃতি পেশ করা হল-
১. প্রথম শ্রেণীর তাবেয়ী হযরত মুজাহিদ রহ. বলেন-
لم يبعث نبي إلا أمر بإقامة الصلاة وإيتاء الزكاة والإقرار بالله تعالى وطاعته سبحانه و ذلك إقامة الدين . (روح المعاني)
অর্থ: প্রত্যেক নবীকেই সালাত কায়েম, যাকাত প্রদান, আল্লাহর অস্তিত্বের স্বীকারোক্তি ও তাঁর আনুগত্যের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এটাই হলো ইক্বামাতে দ্বীনের মর্মকথা। (রুহুল মাআনী)
২. প্রখ্যাত তাবেয়ী হযরত আবুল আলিয়া রহ. বলেন –
الإخلاص لله وعبادته
অর্থ: ইক্বামাতে দ্বীনের মর্ম হলো একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ পাকের ইবাদত করা।
৩. প্রখ্যাত অভিধানবিদ ও তাফসীরবিদ আল্লামা রাগিব ইসফাহানী রহ. লিখেন-
وقوله : شرع لكم من الدين فأشارة الى الاصول التي تتساوى فيها الملل فلا يصح عليها النسخ كمعرفة الله تعالى ونحو ذلك – المفردات
অর্থ: এ আয়াতে সেসব মৌলিক নীতিমালা বুঝানো হয়েছে, যা সকল শরীয়তে সমান ও অপরিবর্তিত ছিল। যেমন- আল্লাহ পাককে জানা ইত্যাদি। (আল মুফরাদাত)
৪. তাফসীরে বাহরুল মুহীত্বঃ
هو ما شرع لهم من العقائد المتفق عليها من توحيد الله وطاعته و الإيمان برسله و بكتبه و باليوم الآخر والجزاء فيه.
অর্থ: এখানে দ্বীন মানে সেসব বিশ্বাস ও ধর্মমত, যা আল্লাহ পাক সবার জন্য ধার্য করেছেন। যথা আল্লাহ তা’আলাকে এক জানা, তাঁর আনুগত্য করা, আল্লাহর প্রেরিত রাসূলগণ ও নাযিলকৃত কিতাবাদির প্রতি এবং পরকালের স্বীয় কৃতকর্মের প্রতিদান পাওয়ার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা।
৫. তাফসীরে কুরতুবী:
هو توحيد الله وطاعته و الإيمان برسله وكتبه و بيوم الجزاء و بسائر ما يكون الرجل بإقامته مسلماً، ولم يرد الشرائع التي هي مصالح الأمم على حسب أحوالها، فإنها مختلفة متفاوتة.
অর্থ: এখানে ‘দ্বীন’ মানে আল্লাহ তা’আলার একত্ববাদে বিশ্বাসী হওয়া, তাঁর আনুগত্য করা, তাঁর রাসূল ও কিতাবাদির প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা, যেগুলো যথাযথভাবে পালন করলে মানুষ মুসলিম হিসেবে পরিগণিত হয়। এখানে শরীয়তের যাবতীয় বিধিবিধান বুঝানো হয়নি। কারণ উম্মতদের অবস্থাভেদে তাতে বিভিন্নতা ও তারতম্য রয়েছে।
৬. তাফসীরে ইবনে কাসীর:
أي: القدر المشترك بينهم هو عبادة الله وحده لا شريك له و إن اختلف شرائعهم ومناهجهم.
অর্থ: এখানে ‘দ্বীন’ অর্থ সকল নবীদের মধ্যকার অভিন্ন বিষয়াদি। অর্থাৎ এক ও লা-শরীক আল্লাহর ইবাদত করা ; যদিও তাঁদের পন্থা ও পদ্ধতি ছিল ভিন্ন ভিন্ন।
৭. তাফসীরে খাযিন:
المراد بأقامة الدين هو توحيد الله والايمان به وبكتبه ورسله واليوم الآخر وطاعة الله فى اوامره ونواهيه وسائر ما يكون الرجل به مسلماً ولم يرد الشرائع التي هي مصالح الأمم على حسب حوالها فأنه مختلفة متفاوتة، قال الله تعالى: لكل جعلنا منكم شرعة ومنهاجا
অর্থ: ইক্বামাতে দ্বীনের মর্ম হল আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস করা, তাঁর নাযিলকৃত কিতাবাদি, প্রেরিত রাসূল ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা, আল্লাহর বিধি-নিষেধসমূহে তাঁর আনুগত্য করা ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়াদি, যা দ্বারা কোনো ব্যক্তি মুসলিম হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এখানে শরীয়তের যাবতীয় বিধিবিধান বুঝানো হয়নি। কারণ উম্মতদের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তাতে বিভিন্নতা ও পার্থক্য বিদ্যমান ছিল। আল্লাহ পাক ঘোষণা করেছেন, তোমাদের মধ্য থেকে প্রত্যেকের জন্য পৃথক বিধান ও স্বতন্ত্র পদ্ধতি নির্ধারণ করেছি।
৮. তাফসীরে মাদারিক:
المراد إقامة دين الإسلام هو توحيد الله وطاعته والإيمان برسله وكتبه و بيوم الجزاء و سائر ما يكون المرء بإقامته مسلما، و لم يرد به الشرائع؛ فإنها مختلفة.
অর্থ: দ্বীনে ইসলাম কায়েমের তাৎপর্য হল— এক আল্লাহতে বিশ্বাস করা, তাঁর আনুগত্য করা এবং তাঁর রাসূল, কিতাবাদি, প্রতিদান দিবস প্রভৃতির প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা, যা যথাযথভাবে পালন করলে কোন ব্যক্তি মুসলিম হয়ে যায় এবং ‘দ্বীন’ বলে যাবতীয় বিধিবিধান বুঝানো হয়নি। কারণ তাতে বিভিন্নতা বিরাজমান ছিল।
৯. তাফসীরে রুহুল মাআনী:
أي دين الإسلام الذي هو توحيد الله تعالى و طاعته و الإيمان بكتبه ورسله وبيوم الجزاء و سائر ما يكون العبد به مؤمناً ، والمراد بإقامته : تعديل أركانه وحفظه من أن يقع فيه زيغ ، والمواظبة عليه.
অর্থ: আলোচ্য আয়াতে দ্বীন মানে দ্বীনে ইসলাম। অর্থাৎ এক আল্লাহকে বিশ্বাস করা, তাঁর আনুগত্য করা এবং তাঁর কিতাবাদি ও রাসূলবৃন্দ ও প্রতিদান দিবস প্রভৃতি বিষয়ের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা, যা দ্বারা কোনো বান্দা মুমিন হিসেবে পরিগণিত হয়। আর ইকামাতে দ্বীনের অর্থ হল দ্বীনের স্তম্ভগুলোকে সঠিকভাবে পালন করা, সর্বপ্রকার পরিবর্তন ও বক্রতা থেকে হিফাযতে রাখা এবং দ্বীনের উপর সুদৃঢ় থাকা।
১০. তাফসীরে বয়ানুল কুরআন:
مراد اس دین سے اصول دین ہیں جو مشترک ہیں تمام شرائع بمثل توحید ورسالت و نحوه، اور اقامت رکھنا یہ کہ اس کو تبدیل مت کرنا، اس کو ترک مت کرنا
অর্থ: এখানে দ্বীন বলে সকল শরীয়তের অভিন্ন মূলনীতি বুঝানো হয়েছে। যেমন তাওহীদ, রিসালাত, পুনরুত্থান ইত্যাদি এবং (কায়েম রাখা) প্রতিষ্ঠিত রাখার অর্থ পরিবর্তন ও তরক না করা।
তাফসীর শাস্ত্রের অন্যান্য গ্রন্থরাজিতে আলোচ্য আয়াতের তাফসীরে অনুরূপ তথ্য বিদ্যমান রয়েছে। নমুনাস্বরূপ উপরোক্ত দশটি উদ্ধৃতিই পেশ করলাম।
১১. তাফসীরে মা’আরিফুল কুরআন:
جمہور مفسرین کے نزدیک ان اقیمو الدین میں حرف ان تفسیر کے لئے ہے، تو دین کے معنی متعین ہو گئے کہ مراد وہی دین ہے جو سب انبیاء علیہم السلام میں مشترک چلا رہا ہے، اور یہ بھی ظاہر ہے کہ وہ دین مشترک بین الانبیاء اصول عقائد یعنی توحید رسالت آخرت پر ایمان اور اصول عبادات نماز ، روزہ ، حج ، زکوۃ کی پابندی ہے۔ نیز چوری، ڈاکہ ، زنا، جھوٹ ، فریب ، دوسروں کو بلا وجہ شرعی ایذاء دینے وغیرہ اور عهد شکنی کی حرمت ہے ، جو سب ادیان سماویہ میں مشترک اور متفق علیہ چلے آئے ہیں
অর্থ: জমহুর মুফাসসিরীনের দৃষ্টিতে أقيمو الدين এর মধ্যে ان হরফটি তাফসিরের অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অতএব, দ্বীনের অর্থ নির্ধারিত হয়ে গেলো যে, ধর্ম বলে সকল পয়গম্বরপর অভিন্ন ধর্মকে বুঝানো হয়েছে অর্থাৎ মৌলিক বিশ্বাস যেমন তাওহীদ, রিসালত, পরকালে বিশ্বাস এবং মৌলিক এবাদত যেমন নামাজ, রোজা, হজ্ব ও জাকাতের বিধান মেনে চলা। এছাড়া চুরি, ডাকাতি, ব্যভিচার, মিথ্যা, প্রতারণা, অপরকে বিনা কারণে নিপীড়ন করা, প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করার মতো অনাচারসমূহের নিষিদ্ধতা; যা সমস্ত ঐশী ধর্মেরই অভিন্ন ও সর্বসম্মত বিষয়। [মাআরিফুল কুরআন]
এগুলো দ্বারা স্পষ্টত প্রমাণিত হয়ে গেল, আল্লাহ পাক আলোচ্য আয়াতে সকল নবী-রাসূল ও মুসলিমদের জন্য যে ইক্বামাতে দ্বীনের বিধান ধার্য করেছেন, তার তাৎপর্য হল, দ্বীনের বুনিয়াদি শিক্ষা ও মৌলিক বিষয়াদি যথাযথভাবে পালন করা, এককথায় ইসলামী বিধিবিধান মেনে চলা। এটাই প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরযে আইন, যা সকল মুসলমানের ওপর সর্বাবস্থায় অপরিহার্য। এটাই হলো-
(ক) মুসলিম উম্মাহর সমস্ত মুফাসসিরীনে কেরামের অবিসংবাদিত অভিমত।
(খ) আয়াতের বিশেষ বর্ণনাভঙ্গি থেকে স্পষ্টত প্রতিভাত।
(গ) আয়াতে উল্লিখিত নবীদের জীবনী দ্বারা প্রমাণিত।
সুতরাং আলোচ্য আয়াতে ‘দ্বীন’ শব্দ দ্বারা শরীয়তের যাবতীয় বিধিবিধান বুঝে নেয়া এবং ইক্বামাতে দ্বীনের আদেশ দ্বারা ‘ইসলামী হুকুমত ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা’র নির্দেশ বুঝে ফেলা আদৌ বিশুদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য হতে পারেনা, বরং তা হলো আয়াতের تحریف معنوی বা অপব্যাখ্যা।

★ আক্বীমুদ্দীন (اقيموا الدين) বাক্যটির নিখুঁত তরজমা:
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা আবশ্যক যে, اقيموا الدين কথাটির অনুবাদ উর্দুতে دین قائم کرو এবং বাংলায় ‘দ্বীন প্রতিষ্ঠা করো’ বলে করা যদিও শব্দগতভাবে অশুদ্ধ নয়, তথাপি যেহেতু এ দ্বারা বিভ্রান্তি সৃষ্টির অবকাশ রয়েছে বরং বিভ্রান্তি ঘটেও চলছে, সেহেতু এর অনুবাদ উর্দুতে دین پر قائم رہو এবং বাংলায় ‘দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকো’ বলে করাই হবে উত্তম, নিখুঁত ও বিভ্রান্তিমুক্ত। এজন্যই দেখা যায়, কুরআন শরীফের উর্দুভাষী মুফাসসির ও অনুবাদকদের কেউই دین قائم کرو বলে বাক্যটির অনুবাদ করেননি। নীচে উপমহাদেশের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় উলামার অনুবাদ উদ্ধৃত করা হলো-
১. শাহ আব্দুল কাদির দেহলভী : قائم رکھو دین (দ্বীন প্রতিষ্ঠিত রাখো)
২. শাহ রফীউদ্দীন দেহলভী : قائم رکھو دین کو (দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত রাখো)
৩. মাওলানা আব্দুল হক হক্কানী : اسی دین پر قائم رہنا (ঐ দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা)
৪. ডিপুটি নযীর আহমদ : اسی دین کو قائم رکھنا (ঐ দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত রাখা)
৫. শায়খুল হিন্দ মাহমূদ হাসান : قائم رکھو دین کو (দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত রাখো)
৬. মাওলানা আশরাফ আলী থানভী : اس دین کو قائم رکھنا (ঐ দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত রাখা)

★ ইক্বামাতে দ্বীনের কাজে মাদরাসা শিক্ষার ভূমিকা:
উপরের নাতিদীর্ঘ আলোচনা দ্বারা দিবালোকের মত উজ্জ্বল হয়ে গেল যে, ইক্বামাতে দ্বীনের তাৎপর্য ও মৌলকথা হলো, দ্বীনের মৌলিক শিক্ষা ও বুনিয়াদি বিষয়াদি পূর্ণভাবে পালন করা তথা প্রত্যেক মুসলিম তার ব্যক্তিগত জীবনে ইসলামী অনুশাসন ও ধর্মীয় বিধিবিধান মেনে চলা। এটাই হচ্ছে প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরযে আইন। অথচ নিজামী-গোলাম আজমরা ক্ষমতা দখলের জন্য আক্বীমু্দ্দীনের সর্বসম্মত এ মর্মকে বিকৃত করে হুকুমত প্রতিষ্ঠা করাকে ফরজে আইন বলে আয়াতটির মনগড়া তাফসীর প্রচার করে উম্মতকে বিভ্রান্তির দিকে নিয়ে চলেছেন। আমাদের দ্বীনী মাদরাসাগুলো ইসলামী শিক্ষাদান ও চরিত্র গঠনের মাধ্যমে, খানকাগুলো ওয়ায ও যিকিরের মাধ্যমে এবং তাবলীগ জামাআত মুসলিম সমাজের ঘরে ঘরে পুরো ইসলামী যিন্দেগীর উপর চলার দাওয়াত পৌঁছানোর মাধ্যমে ইসলামী অনুশাসনের অনুগামী একটি বিরাট দল তৈরী করে আসছে এবং সকল মুসলমানকে এর প্রতি উদ্বুদ্ধ করছে। এভাবে এঁরা সবাই স্ব স্ব পরিমন্ডলে অবস্থান করে নিঃসন্দেহে ইক্বামাতে দ্বীনের কাজে নিয়োজিত ও সক্রিয় আছেন, নিষ্ক্রিয় নন। ‘মাদরাসা, খানকা ও তাবলীগ জামাআতের মাধ্যমে শুধু খেদমতে দ্বীন হচ্ছে’, ‘উলামায়ে কেরাম ইক্বামাতে দ্বীনের কাজে সক্রিয় নন’, ‘উপমহাদেশের বড় বড় আলিমগণ ইক্বামাতে দ্বীনের কোনো কর্মসূচী রেখে যাননি’ ইত্যাদি কথাবার্তা যেমন অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেব তার ইক্বামতে দ্বীন বইয়ে বলেছেন, সম্পূর্ণ সত্যের অপলাপ ও অসৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত ; যা ইক্বামাতে দ্বীনের তাৎপর্য অনুধাবনে ব্যর্থতা এবং অপব্যাখ্যা করারই ভয়াবহ পরিণাম।

★ ইসলামী হুকুমত বা খিলাফত কায়েমের সঠিক পদ্ধতি:
উপসংহারে বলতে চাই, বাংলাদেশের প্রতিটি মুসলিম নাগরিক তার জীবনে ইক্বামাতে দ্বীন অর্থাৎ ইসলামী অনুশাসন মেনে চলার আবেগ ও মন-মানসিকতা সৃষ্টি করতে পারলেই দেশে ইসলামী পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে যাবে এবং পরিণতিতে দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে আমাদের অতি কাঙ্ক্ষিত ইসলামী হুকুমত বা খিলাফত। এটা আল্লাহ পাকের ওয়াদা। পবিত্র কুরআনের ভাষা-
وعد الله الذين أمنوا منكم وعملوا الصلحت ليستخلفنهم في الأرض كما استخلف الذين من قبلهم وليمكنن لهم دينهم الذي ارتضى لهم وليبدلنهم من بعد خوفهم امنا
অর্থ: তোমাদের মধ্য থেকে যারা ঈমান আনবে এবং সৎকর্ম করবে, আল্লাহ পাক তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন যে, তাদেরকে পৃথিবীর শাসনকর্তৃত্ব দান করবেন, যেমন তাদের পূর্ববর্তীদের দান করেছিলেন এবং তিনি তাদের জন্য যে দ্বীনকে পছন্দ করেছেন (অর্থাৎ দ্বীনে ইসলাম), তাদের জন্য তা সুদৃঢ় করে দেবেন আর তাদের ভয়ভীতিকে শান্তিতে পরিণত করে দেবেন। (সূরা নূর- ৫৫)
এ আয়াত দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করছে যে, খিলাফত ও হুকুমত হলো আল্লাহ পাকের একটি প্রতিশ্রুত ব্যাপার ; যা ঈমান ও আমলে সালেহের ফলশ্রুতি। এ দুটো গুণ মুসলমানদের মধ্যে অর্জিত হলে আল্লাহ পাক পুরস্কারস্বরূপ দুনিয়ার খিলাফত ও বিশ্বের নেতৃত দান করবেন। খেলাফত ও রাষ্ট্রক্ষমতা লাভই মুমিনের চরম লক্ষ্য নয়, বরং চরম ও আসল উদ্দেশ্য হলো ঈমান ও আমলে সালেহ। তা অর্জিত হলে অবশ্যই খিলাফত ও নেতৃত্ব অর্জিত হবে। এটাই আল্লাহ তা’আলার ওয়াদা। খিলাফত লাভের জন্য কোনো আন্দোলন বা তথাকথিত জিহাদ করতে হবে না, অযথা রক্ত ঝরাতে হবে না। তাইতো দেখা যায়, মহানবী সা. অতি স্বল্পসংখ্যক সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে অতি সহজেই বিনা রক্তপাতে মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কারণ তাঁরা সবাই ছিলেন ঈমানের বলে বলীয়ান এবং আমলে সালেহের অস্ত্রে সুসজ্জিত। তাই মহানবী সা.-কে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে রক্ত ঝরাতে হয়নি বা যুদ্ধ-বিগ্রহ করতে হয়নি ; বরং তখন তো যুদ্ধের অনুমতিই ছিল না এবং কাফেরদের সাথে সংঘর্ষ এড়িয়ে চলার নির্দেশ ছিল। মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার পর ইসলামী রাষ্ট্রকে রক্ষা করার জন্য হিজরতের পর যুদ্ধ-বিগ্রহের অনুমতি ও জিহাদ সংক্রান্ত নির্দেশাবলি নাযিল হয়েছে।
অতএব, কাঙ্খিত খিলাফত লাভ করতে হলে তার পূর্বশর্ত অর্থাৎ ঈমান ও আমলে সালেহের অধিকারী হতে হবে এবং তা অর্জনে মুসলিম সমাজকে উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে মাদরাসা, খানকা ও তাবলীগ জামাআতের ভূমিকা সর্বাধিক ও অপরিসীম। কাজেই খিলাফত ও বিশ্বের নেতৃত্ব লাভ করতে হলে—
১. মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করে ইসলামী শিক্ষাকে প্রত্যেক মুসলিমের দোরগোড়ায় পৌঁছিয়ে দিতে হবে এবং মাদরাসাসমূহের প্রতি বৈরীভাব পরিত্যাগ করতঃ এগুলোর উন্নতি-অগ্রগতির জন্য সাহায্য-সহযোগিতার হাত আরো সম্প্রসারিত করতে হবে।
২. খাঁটি পীর ও বুযুর্গানে দ্বীনের তত্ত্বাবধানে স্থানে স্থানে খানকা গড়ে তুলে আত্মশুদ্ধির কাজে মনোনিবেশ করতে হবে। মওদূদী সাহেবের মত একে ‘বিষ’ আখ্যায়িত করে তা থেকে বিরত থাকার নসিহত খয়রাত করার মন-মানসিকতা পরিত্যাগ করতে হবে।
৩. তাবলীগ জামাআতে সকল শ্রেণীর লোক আরো বেশীভাবে জড়িত হয়ে দাওয়াতের কর্মসূচিকে সার্বজনীন করতে হবে এবং জনসাধারণকে ইসলামের বুনিয়াদি শিক্ষা অর্জনে ব্রতী হবে হবে।
ইক্বামাতে দ্বীনের ব্যাপারে মাদরাসা, খানকা ও তাবলীগ জামাআতের অবদানকে অস্বীকার করতঃ মওদূদীবাদীদের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে এগুলোকে ‘খেদমতে দ্বীন’ বলে বিদ্রূপ করতে থাকলে ইসলামী হুকুমতের পরিবেশ সৃষ্টির ধারণা হবে আকাশকুসুম কল্পনামাত্র। শুধু মজবুত, সুশৃঙ্খল ও ক্যাডারভিত্তিক সংগঠনের মাধ্যমে রাজপথকে শ্লোগানে মুখরিত ও শিক্ষাঙ্গনকে রণাঙ্গনে পরিণত করে নিলেই ইসলামী হুকুমত কায়েম হবে না, হতে পারে না ; নতুবা মওদূদী চিন্তাধারার জন্মভূমি ভারতে এবং লালনভূমি ও মওদূদীর বত্রিশ বছরের কর্মভূমি পাকিস্তানে অনেক আগেই ইসলামী বিপ্লব বাস্তবায়িত হয়ে যেত। কিন্তু, কই! অদ্যাবধি এর ক্ষীণতম আশাও কী করা যাচ্ছে? তাই মওদূদী চিন্তাধারার চারণভূমি আমাদের বাংলাদেশেও তা বাস্তবায়িত হওয়া সুদূর পরাহত। স্বরণ রাখতে হবে, ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠা করতে হলে ইসলামের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রদর্শিত পথেই এগুতো হবে ; তবেই সাফল্য অর্জন হবে নিশ্চিত, সফলতা হবে অবশ্যম্ভাবী।

মাওলানা মুতিউর রহমান খান সাহেব থেকে সংগৃহিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *