ঠিক তেমনি ইতিপূর্বে আমরা যে কুরআনে কারীমের বহু সংখ্যক আয়াত উল্লেখ করেছি তাতেও দ্বীনের মৌলিক সংজ্ঞা ও দ্বীন কায়েমের অর্থ বিধৃত হয়েছে। ঐ সকল আয়াত সমূহ এবং হাদীসে জিব্রাঈল দ্বারা চূড়ান্তভাবেই প্রমাণিত হলো যে, ঈমান, ইবাদত ও আখলাক এই তিন বিষয় প্রতিপালনের নাম দ্বীন কায়েম করা। সূরা শুরার ১৩ নম্বর আয়াতে “আন্ আক্বীমুদ দ্বীন” এবং সূরা রুম এর ৩০ নম্বর আয়াতে “ফাআক্কিম ওয়াজহাকা লিদ্দ্বীনিল কায়্যিম” বাক্য দ্বারা মূলতঃ ঈমান, ইবাদত ও আখলাক প্রতিপালনের মাধ্যমে দ্বীন কায়েম করতে বলা হয়েছে। কুরআন-হাদীসের কোন স্থানে ইক্বামতে দ্বীন দ্বারা রাষ্ট্র গঠন বুঝানো হয়নি। তবে এর এই অর্থ নয়, যে ইসলামে রাজনীতি নেই বরং প্রথিবীর সবচেয়ে সফল রাজনীতি ইসলামেই বিদ্যমান।
ইতিপূর্বে আমরা সরাসরি কুরআন ও হাদীসের দলীলের ভিত্তিতে ‘দ্বীন’ এবং দ্বীন কায়েমের ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যাখ্যা বর্ণনা করেছি। কিন্তু স্বেচ্ছাচারী বিদ্যায় ভয়ংকর জ্ঞানী মওদুদী সাহেব ও তার অন্ধভক্ত জামায়াতে ইসলামী, ছাত্র শিবির ইত্যাদি দল ও গোষ্ঠী আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত দ্বীন কায়েম করতে রাজী নন। বরং তারা তাদের স্বার্থ ও সুবিধামত মনগড়া এক দ্বীন কায়েম করতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু ইসলাম বাদ দিয়ে সম্রাট আকবরের উদ্ভাবিত ‘দ্বীনে এলাহী’র মত কোন সম্পূর্ণ নতুন ধর্ম যেহেতু তারা বানাতে সাহসী নন তাই আল্লাহর নাযিল করা দ্বীনে ইসলামের মাঝে সুবিধামত মনগড়া বিকৃত সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা জুড়ে দিয়ে তারা স্বেচ্ছাচারী দ্বীন কায়েম করতে চান। (নাউজুবিল্লাহ)
আমাদের এ কথা ভিত্তিহীন অথবা কোন ব্যক্তি ও দলের প্রতি বিদ্বেষী হয়ে অপবাদ চাপানো নয়। বরং বাস্তব এবং জাজ্বল্যমান এক মহাসত্য। ইসলামকে অভ্রান্ত এবং সন্দেহাতীতরূপে মুসলমানদের মাঝে প্রতিষ্ঠিত রাখার মহান স্বার্থেই আমরা মওদুদী সাহেবের ‘মনগড়া দ্বীন’কে রেফারেন্সসহ এখানে তুলে ধরছি।
‘দ্বীন’-এর তাগুতী ব্যাখ্যা
মওদুদী সাহেব তার রচিত পুস্তকে লিখেছেন-
(ক) সম্ভবত দুনিয়ার কোন ভাষায় এত ব্যাপক অর্থবোধক কোন শব্দ নেই যা ‘দ্বীন’ এর পূর্ণ অর্থ প্রকাশ করতে পারে। তবে বর্তমান যুগের ইংরেজী শব্দ “ষ্টেট” শব্দটি দ্বীন এর কাছাকাছি ভাব আদায় করে। (কুরআন কী চার বুনিয়াদী ইস্তেলাহে পৃ. ১০৯; কুরআনের চারটি মৌলিক পরিভাষা পৃ.১১০)
(খ) কিন্তু প্রকৃত পক্ষে ইসলাম কোন ধর্ম এবং মুসলমান কোন জাতির নাম নয়। ইসলাম হচ্ছে মূলতঃ এক বিপ্লবী মতবাদ ও মতাদর্শের নাম। (তাফহীমাত ১ম খণ্ড, পৃ.৭৭; নির্বাচিত রচনাবলী প্রথম ভাগ, পৃ. ৭৫)
(গ) যে ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের ভিত্তিতে (প্রভাবে) মানুষ কোন রীতি-নীতি বা বিধি-বিধান মেনে চলে তা যদি আল্লাহর কর্তৃত্ব সম্বলিত হয়, তাহলে বলা যাবে মানুষ আল্লাহর দ্বীনের উপর আছে। আর ঐ ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব যদি বাদশাহর হয়, তাহলে বলা যাবে যে, মানুষ বাদশাহর দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত। আর যদি ঐ ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব কোন পুরোহিত বা পণ্ডিতের হয়, তবে বলা হবে যে, মানুষ ঐ পন্ডিত বা পুরোহিতের দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত। (কুরআন কী চার বুনিয়াদী ইসতেলাহেঁ পৃ. ১০৮, কুরআনের চারটি মৌলিক পরিভাষা, পৃ. ১০৯)
(ঘ) দ্বীন মূলতঃ রাষ্ট্র সরকারকেই বলা হয়। শরীয়ত হচ্ছে এর আইন এবং এ আইন ও নিয়ম প্রথা যথারীতি মেনে চলাকে বলা হয় ইবাদত। আপনি যাকেই শাসক ও নিরঙ্কুশ রাষ্ট্র কর্তারূপে মেনে তার অধীনতা স্বীকার করবেন, আপনি মূলতঃ তারই দ্বীন এর অন্তর্ভুক্ত হবেন। আপনার এ শাসক ও রাষ্ট্রকর্তা যদি আল্লাহ হন, তবে আপনি তার দ্বীন-এর অধীন হলেন। তিনি যদি কোন রাজা-বাদশাহ হন, তবে বাদশাহর দ্বীনকেই আপনার কবুল করা হবে। বিশেষ কোন জাতিকে এ মর্যাদা দিলে সেই জাতিরই দ্বীন গ্রহণ করা হবে, আর যদি এ শাসক গণতান্ত্রিক হয় তবে আপনি সেই দ্বীনের অন্তর্গত গণ্য হবেন। (খুতবাত পৃ. ৩২০, ইসলামের বুনিয়াদী শিক্ষা পৃ. ২৫৮)
(ঙ) অন্যান্য দ্বীনের ন্যায় দ্বীন ইসলামও এ দাবী করে যে, ক্ষমতা ও প্রভৃত্ব নিরংকুশভাবে কেবলমাত্র আমারই হবে এবং অন্যান্য প্রত্যেকটি দ্বীনই আমার সামনে অবনত ও পরাজিত থাকবে। অন্যথায় আমার
অনুসরণ কি করে সম্ভব হতে পারে? আমার দ্বীন ‘গণদ্বীন’ হবে না। শাহীদ্বীন হবে না, কমিউনিস্ট দ্বীন হবে না অপর কোন দ্বীনেরই অস্তিত্ব থাকবে না। পক্ষান্তরে অন্য কোন দ্বীনের অস্তিত্ব থাকলে আমি থাকবো না। তখন আমাকে শুধু মুখেই সত্য বলে স্বীকার করলে কোন বাস্তব ফল পাওয়া যাবে না। (খুতবার পৃ. ৩২৪, ইসলামী বুনিয়াদী শিক্ষা, পৃ. ২৬২)
চ) ‘দ্বীন’ যা-ই এবং যে ধরনেরই হোকনা কেন রাষ্ট্র ও সরকারী কর্তৃত্ব ছাড়া তার কোন মূল্য নেই। গণ-দ্বীন, কমিউনিষ্ট-দ্বীন কিংবা আল্লাহর দ্বীন যা-ই হোক না কেন, একটি দ্বীনের প্রতিষ্ঠা রাষ্ট্র শক্তি ছাড়া আদৌ সম্ভব নয়। প্রাসাদের শুধু কাল্পনিক চিত্র যার বাস্তব কোন অস্তিত্বই নেই যেমন অর্থহীন, অনুরূপভাবে রাষ্ট্র সরকার ছাড়া একটি দ্বীন সম্পূর্ণরূপে নিরর্থক। (ইসলামের বুনিয়াদী শিক্ষা পূঃ ২৬০, খুতবাত পৃঃ ৩২২)
ছ) বাস্তব ক্ষেত্রে আপনি যারই আইন পালন করে চলবেন মূলতঃ তারই দ্বীন আপনার পালন করা হবে। (খুতবাত পূঃ ৩২১; ইসলামের বুনিয়াদী শিক্ষা, পৃঃ ২৫৯)
জ) রাষ্ট্র ক্ষমতা ছাড়া কোন বিধান ও মতবাদ পেশ করা অথবা তার ভক্ত হওয়া নিতান্তই অর্থহীন। (ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন পূঃ ২৫)
ঝ) কারণ অন্য কোন দ্বীনের (সরকারের) অধীন থেকে আল্লাহর দ্বীনের আনুগত্য ও অনুসরণ অসম্ভব। অতএব, আল্লাহর এ দ্বীনকে যদি বাস্তবিকই সত্য দ্বীন বলে বিশ্বাস করেন, তবে তাকে বাস্তব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে প্রাণপণ সাধনা ও সংগ্রাম করা ভিন্ন অন্য কোন উপায় থাকতে পারে না। (খুতবাত পৃঃ ৩২৬; ইসলামী বুনিয়াদী শিক্ষা, পৃঃ ২৬৪)
ঞ) কিন্তু আল্লাহর দ্বীন ভিন্ন অপর কোন দ্বীনের (প্রশাসনের) অধীন জীবন যাপন করায় আপনার যদি তৃপ্তি লাভ হয় এবং সে অবস্থায় আপনার মন সন্তুষ্ট ও আশ্বস্ত হয়ে থাকে, তবে আপনি আদৌ ঈমানদার নন। আপনি মনোযোগ দিয়ে যতই নামায পড়েন, দীর্ঘ সময় ধরে ‘মুরাকাবা’ করেন আর যতই কুরআন-হাদীসের ব্যাখ্যা করেন ও ইসলামের দর্শন প্রচার করেন না কেন, কিন্তু আপনার ঈমানদার না হওয়া সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই। দ্বীন ইসলাম বিশ্বাস করে অন্য কোন দ্বীনের (প্রশাসনের) প্রতি যে সন্তুষ্ট থাকবে, তার সম্পর্কে এটাই চূড়ান্ত কথা। (খুতবাত পূঃ ৩২৭; ইসলামী বুনিয়াদী
শিক্ষা, পৃঃ ২৬৪)
ত) আমি তোমাদেরকে বলতে চাই যে, যার অন্তরে জেহাদের নিয়ত নেই, আর যার উদ্দেশ্য জেহাদ হবে না তার জীবনের সম্পূর্ণ ইবাদত-বন্দেগী নিষ্ফল, কোন লাভ নেই। (খুতবাত পৃ.৩১৮, বুনিয়াদী শিক্ষা পৃ. ২৫৭)
খ) একথা নিশ্চিত যে, সকল নবী-রাসূলগণের (আল্লাহ প্রদত্ত্ব) মিশনের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য ছিল (হুকুমতে ইলাহিয়্যাহ) আল্লাহর সরকার কায়েম করা। (তাজদীদ ও এহয়ায়ে দ্বীন, পৃঃ ২১, ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন পৃঃ ২৬)
দ) কোন ফরযই দ্বীনে বাতিলের (বাতিল সরকারের) অধীনে ফরযের মর্যাদা পায় না-সুতরাং ইক্বামতে দ্বীনের (ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার) দায়িত্বটিই সব ফরযের বড় ফরয-দ্বীনকে কায়েম বা বিজয়ী করার চেষ্টা করা ফরযে আইন। (অধ্যাপক গোলাম আযম, ইক্বামতে দ্বীন পৃঃ ২৭)
সার সংক্ষেপ
১. দ্বীন অর্থ ষ্টেট।
২. ইসলাম কোন ধর্ম এবং মুসলমান কোন জাতির নাম নয় বরং
ইসলাম এক বিপ্লবী আন্দোলন।
৩. ইলাহী রাষ্ট্র গঠন করা ব্যতীত পৃথিবীর কোন সরকারের অধীনে থেকে কোন ধর্মীয় কাজ কবুল হবে না।
৪. আপনি যে সরকারের আইন মেনে চলবেন আপনি তার দ্বীনের অনুসারী বলে গণ্য হবেন। আপনাকে মুসলমান, দ্বীনদার বলা যাবে না।
৫. দ্বীন ‘রাষ্ট্র সরকার’কে বলা হয়, আর সরকারের আইন মেনে চলাকে ‘ইবাদত’ বলা হয়
৬. বিদ্যমান সরকার উৎখাত করে ইসলামী সরকার গঠন সকল ফরযের বড় ফরয অর্থাৎ ফরযে আইন।
৭. প্রচলিত সরকার উৎখাত করে ইসলামী সরকার গঠন না করলে ঈমান, নামায, রোযা, যিকির ইত্যাদি কোন কাজে আসবেনা।
৮. ইসলামী সরকার গঠন আম্বিয়ায়ে কেরামের মিশনের মূল উদ্দেশ্য।
পর্যালোচনা
সুধী পাঠক/পাঠিকা। ইতিপূর্বে আমরা কুরআনে কারীমের সুস্পষ্ট বহু আয়াত এবং হাদীসে জিবরাঈল এর দ্বারা আল্লাহর মনোনীত ‘দ্বীনে ইসলাম’ এবং দ্বীনে ইসলাম কায়েমের ব্যাখ্যা বর্ণনা করে এসেছি। অতঃপর ‘দ্বীন এর তাগুতী ব্যাখ্যা’ শিরোনামে মওদুদী সাহেবের নিজস্ব ব্যাখ্যা তাঁর মূল উর্দু ও বাংলায় অনুদিত পুস্তক পুস্তিকা থেকে তুলে ধরেছি। এই দুই ব্যাখ্যার কোনটি আমরা গ্রহণ করবো? ইসলাম নাযিল হওয়ার ১৪ শত বছর পরে জন্মগ্রহণ করে মওদুদী সাহেব যে নতুন ও অভূতপূর্ব ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং তার অনুসারী গোলাম আযম সাহেব, আব্বাস আলী সাহেব, নিজামী সাহেব, সাঈদী সাহেবসহ জামায়াত শিবিরের ভায়েরা যে ব্যাখ্যাকে একমাত্র সত্য ও সঠিক ব্যাখ্যা বলে বিশ্বাস করেছেন সে মর্তবাদ বা ব্যাখ্যাকে আমরা কি বিনা বাক্য ব্যয়ে লুফে নেব? নাকি একটু যাচাই বাছাই করে তলিয়ে দেখার চেষ্টা করবো। মওদুদী সাহেবকৃত এবং তার অনুসারীদের অনুসৃত ব্যাখ্যাকেই বা কেন আমরা তাগুতী ব্যাখ্যা বলে আখ্যায়িত করতে গেলাম? এসব বিষয়ের নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ এবং কৈফিয়াতের জন্যই এই পর্যালোচনা শিরোনামের অবতারণা।
প্রথমেই ‘তাগুতী ব্যাখ্যা’ শিরোনাম প্রদানের কৈফিয়তঃ উল্লেখ্য যে, বিশ্বাস ও কার্যগতভাবে আল্লাহ তা’য়ালার মৌলিক দ্বীন ও শরীয়তের (কুরআন-সুন্নাহর) বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করাকেই তাগুতী বা শয়তানী অবস্থান বলা হয়। বলা বাহুল্য, যেখানে আল্লাহ তা’য়ালা দ্বীনে ইসলাম নাযিলের মূল উদ্দেশ্য ও মানুষ সৃষ্টির মূল লক্ষ্য বলেছেন ইবাদত, এবং দ্বীন কায়েমের প্রধান কর্মসূচী রূপে বর্ণনা করেছেন ঈমান, ইবাদত ও আফ্লাক। সেখানে মওদুদী সাহেব ও তার অনুসারীরা এর বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করে বলেছেনঃ মানুষ সৃষ্টি এবং ইসলাম অবতরণের মূল উদ্দেশ্য ঈমান ও ইবাদত নয়। আম্বিয়ায়ে কেরামও এসব বাস্তবায়নের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রেরিত হননি বরং রাষ্ট্র কায়েম করার উদ্দেশ্যে তাঁদের পাঠানো হয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া দ্বীন পালন করা আদৌ সম্ভব নয়, গণতান্ত্রিক বা অন্য কোন রাষ্ট্রীয় আইন মেনে চললে দ্বীনে ইসলাম এর সেখানে কোন স্থান নেই, থাকতে পারে না। হ্যাঁ, বিশ্বাস ও কার্যগতভাবে মওদুদী ও তার অনুসারীরা দ্বীন ও শরীয়তের উপরোক্ত বিরোধী অবস্থানে থাকার কারণেই তারা তাগুত এবং তাদের ব্যাখ্যা ইসলামী ব্যাখ্যা নয়, বরং তাগুতী ব্যাখ্যা
(বাতিল ব্যাখ্যা)। এবং সে কারণেই আমরা ঐসব ব্যাখ্যাকে ‘তাগুতী ব্যাখ্যা’ শিরোনামে তুলে ধরতে বাধ্য হয়েছি।
যারা কুরআন এবং রাসূলের ব্যাখ্যা ও ফায়সালা উপেক্ষা করে কুরআন সুন্নাহর বিরোধী ফায়সালা গ্রহণ করতে উৎসুক তাদের উদ্দেশ্যে আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেছেনঃ
أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ يَزْعُمُونَ أَنَّهُمْ آمَنُوا بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ يُرِيدُونَ أَنْ يَتَحَاكَمُوا إِلَى الطَّاغُوتِ وَقَدْ أَمِرُوا أَنْ يَكْفُرُوا بِهِ. دابه
‘হে নবী! আপনি কি তাদের প্রতি লক্ষ্য করেছেন, যারা দাবী করে যে, তারা বিশ্বাসী ঐ কিতাবের প্রতি-যা আপনার প্রতি নাযিল করা হয়েছে এবং সেই কিতাবের প্রতিও যা আপনার পূর্বে নাযিল করা হয়েছে, অথচ তারা ফায়সালার বিষয়কে তাগুত এর কাছে (শয়তানের কাছে) উপস্থাপন করে তাগুত এর ফায়সালা গ্রহণ করতে চায়, যদিও তাদেরকে আদেশ করা হয়েছে শয়তানকে প্রত্যাখ্যান করতে। (সূরা নিসা, আয়াতঃ ৬০)
এবার সেসব বিষয়ের পর্যালোচনায় আসা যাক-মওদুদী সাহেব ও তার
অনুসারীদের ব্যাখ্যা মেনে নিলে যেসব অনিবার্য প্রশ্ন, ভ্রান্তি এবং বিকৃতির মুখোমুখি হয়ে বিধ্বস্ত হয় দ্বীন ইসলাম এবং কুরআনুল কারীম। প্রশ্নের সম্মুখীন হন নিষ্পাপ ও সম্পূর্ণ সফল, কৃতকার্য ও ধন্য নবী-রাসূলগণ।
মওদুদী সাহেব ও তার আদর্শের মানস সন্তানদের প্রদত্ত দ্বীন ও ইক্বামতে দ্বীনের ব্যাখ্যা বিনা বাক্য ব্যয়ে কেন মেনে নেয়া যায় না? কেন তাদের নিজস্ব ব্যাখ্যাকে ভ্রান্ত বলতে হয়? তাদের ব্যাখ্যা মানতে গেলে কেন সমাধানহীন অনেক সমস্যা ও প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়?
১। কেননা একমাত্র মওদুদী সাহেবই সর্বপ্রথম ‘দ্বীন’ এর একক অর্থ ‘ষ্টেট’ বলে বর্ণনা করেছেন। হকপন্থী তথা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের কোন ব্যক্তি ‘দ্বীনে ইসলাম’ এর এমন অর্থ করেননি। কুরআন-হাদীসেও এমন সংকীর্ণ ব্যাখ্যা কোথাও উল্লেখ নেই। যদি এই তাগুতী ব্যাখ্যা মেনে নেয়া যায় তবে গোটা ইসলামই বিকৃত হয়ে যাবে।
ইকামাতে দ্বীন অর্থ হুকুমত বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এরূপ সীমাবদ্ধ মতলবী ব্যাখ্যা মওদুদী সাহেব ও মওদুদীবাদী ছাড়া আর কেউ করেননি, কুরআন-হাদীসও এ ব্যাখ্যা অনুমোদন করে না।
২ বরঞ্চ মুসলিম অমুসলিম নির্বিশেষে পৃথিবীর সকল মানুষ সাধারণভাবে হুকুমত, সরকার, স্টেট, রাজ্য ও রাষ্ট্র বলতে ঐ কর্তৃত্ব বা সুসংহত শক্তি ও ক্ষমতাকেই বোঝেন যার আওতায় নির্দিষ্ট ভূখন্ড করায়ত্ত থাকে, থাকে স্বতন্ত্র রাজধানী ও নির্দিষ্ট মন্ত্রণালয়, থাকে নির্ধারিত বাজেট এবং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও। এই রাষ্ট্র বা সরকার কিংবা রাজ্যকে কেউ-ই দ্বীন বা ধর্ম বলে মনে করে না। যেমন সৌদী হুকুমত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত সরকার, ইউরোপিয়ান স্টেট, দক্ষিণ এশিয়ান রাষ্ট্র সমূহ ইত্যাদি। রাষ্ট্র, সরকার বা ‘ষ্টেট’ কে কেউই দ্বীন বলে না। পক্ষান্তরে দ্বীন, ধর্ম, মাযহাব, মিল্লাত ও শরীয়ত বলতে রাষ্ট্র নয় বরং আকীদা-বিশ্বাস, ইবাদত ও ধর্মীয় রীতি-নীতি বুঝায়। হ্যাঁ ইসলামী রাষ্ট্র বা সরকার ইসলামের একটি অঙ্গ ও প্রশাসনিক দিক বটে, কিন্তু তাই বলে ঈমান-ইসলাম, নামায-রোযা, হজ্জ-যাকাতকে বাইরে রেখে বা গৌণ বিষয় মনে করে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করাকেই দ্বীন বা ইক্বামতে দ্বীন বলা ইসলাম নয়; বরং তা তাগুতী প্রোপাগাণ্ডা।
৩। দ্বীনের অর্থ যে ‘ষ্টেট’ তা মওদুদী সাহেব কি করে জানলেন? তিনি নিজেই কি চিন্তা করে দ্বীনের এ অর্থ আবিষ্কার করেছেন? না কোন জ্বীন-ভূতের কাছ থেকে তা সংগ্রহ করেছেন? কেননা তাঁর মতে এই শব্দের আসল অর্থ প্রথম শতাব্দীর পর বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
৪। দ্বীনে ইসলাম নাযিল, মানুষ সৃষ্টি এবং নবী-রাসূল প্রেরণের একমাত্র উদ্দেশ্য ‘ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠা’ এরূপ দাবীও মওদুদীবাদী ছাড়া আর কেউ করেননি। কোন ব্যক্তির ব্যক্তিগত ব্যাখ্যা বা বর্ণনা ইসলাম হতে পারেনা-তা খুব বেশী বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখেনা
৫। পৃথিবীর প্রায় ১৫০ কোটি মুসলমান যারা দ্বীন অর্থ ষ্টেট মনে করেন না তারা কি দ্বীনদার নন?
৬। মওদুদী সাহেব বলেছেনঃ “যে ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের ভিত্তিতে মানুষ কোন রীতি-নীতি বা বিধি-বিধান মেনে চলে তা যদি আল্লাহ তা’য়ালার কর্তৃত্ব সম্বলিত হয়, তাহলে বলা যাবে মানুষ আল্লাহর দ্বীনের উপর আছে।
আর ঐ ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব যদি বাদশাহর হয়, তাহলে বলা হবে যে, মানুষ বাদশাহর দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত”।
মওদুদীবাদের এই দর্শন অনুযায়ী বর্তমানে যেহেতু জামায়াত শিবির বিএনপি সরকারের রীতি-নীতি ও গণতান্ত্রিক বিধি-বিধান শুধু মেনে চলেননি বরং তা প্রতিষ্ঠা করার জন্যে রীতিমত দুটি মন্ত্রণালয়ও নিয়েছেন সেহেতু তাঁদেরকে আল্লাহর দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত বলা যায় না; বরং তাঁরা গণতান্ত্রিক দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকে বাতিল দ্বীনে জীবন অতিবাহিত করছেন। তাই তাঁদেরকে তাঁদের ঈমান মতে বেদ্বীন ভ্রান্ত বলা হবে।
৭। যেহেতু মওদুদীবাদীদের মতে দ্বীন মানে ‘স্টেট’। নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত আদায় করলে দ্বীন কায়েম হয় না, অথচ তারা এখনও কোথাও রাষ্ট্র বা সরকার কায়েম করতে পারেননি, তাহলে তারা তো কেউই দ্বীনদার নন!
৮। খোদ মওদুদী সাহেব দ্বীন কায়েম (রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা) করে যেতে পারেননি। বরং তিনি পাকিস্তানের (সামরিক/বেসামরিক) সরকারের নিয়ম-কানুন ও সংবিধান মেনে চলতেন, পাকিস্তানী সংবিধানের খেলাফ কিছু করতেন না। ঐ সরকারকেই ইনকাম ট্যাক্স প্রদান করতেন, পাকিস্তানী পৌরসভার আইন মেনে চলতেন। তিনি নিজের ভিসার আবেদনপত্রে নিজেকে হুকুমতে পাকিস্তানের অধীনস্ত নাগরিক বলে স্বীকৃতি দিতেন, বিদেশী দুতাবাসগুলোও তাকে পাকিস্তান সরকারের অধীনস্ত নাগরিক গণ্য করেই ভিসা প্রদান করত। অথচ আবার তিনি নিজেই বলেছেন ইসলামী সরকার ব্যতীত অন্য কোন সরকারের নিয়ম-কানুন মেনে চললে সেখানে দ্বীনের কোন স্থান নেই। তাহলে মওদুদী সাহেব নিজ জীবনের কোন মূহূর্তে ইসলামের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন না তা-ই কি প্রমাণিত হয় না?
৯। শুধু কি তাই? বাস্তবতা সাক্ষী যে, এই মওদুদী সাহেব বৃটিশ ইংরেজদের (ভারত উপমহাদেশ) শাসনামলে ইংরেজ কর্তৃক প্রবর্তিত রাষ্ট্রীয় আইন-কানুন মেনে চলতেন (বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধিতা করেছেন)। যখন পাকিস্তান হল তখন যথাক্রমে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, লিয়াকত আলী খান, সোহরাওয়ারদী, নাজিমুদ্দীন, ইস্কান্দার মীর্যা, আইয়ুব খাঁন, ইয়াহইয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রমূখ ব্যক্তির কৃত ও পরিচালিত আইন-কানুন মেনে চলেছেন। তারা কেউই হুকুমতে
ইলাহিয়্যাহ কায়েম করেননি। আর মওদুদী সাহেবের মতে, যে ক্ষমতা বা কর্তৃত্বের ভিত্তিতে বা প্রভাবে মানুষ কোন নিয়ম-কানুন মেনে চলে সে ঐ ব্যক্তি বা কর্তৃত্বের দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে। মওদুদী সাহেবের এই দর্শন অনুযায়ী তিনি ইংরেজ আমলে ইংরেজদের দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। পরবর্তীতে অন্যান্য ব্যক্তিবর্গের (রাষ্ট্রনায়কদের) দ্বীনে জীবন-যাপন করেন। এক মুহূর্তের জন্যও তিনি দ্বীনে ইসলামের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন না। কেননা, দ্বীনে ইলাহিয়্যাহ তিনি কায়েম করতে পারেননি স্বল্পকালের জন্যও। এই আত্মঘাতি দর্শনের কোপানল থেকে কি করে বেরিয়ে আসবেন মওদুদী সাহেব? এবং তাঁর অনুসারীরা?
১০। বর্তমান জামায়াতে ইসলামী এবং ছাত্রশিবিরের যারা দ্বীন অর্থ ষ্টেট এবং ইক্বামতে দ্বীন অর্থ রাষ্ট্র ক্ষমতা লাভ বা সরকার প্রতিষ্ঠা মনে করেন এবং অন্য কোন রাষ্ট্রীয় আইন মেনে চললে ইসলাম তথা ঈমান, ইবাদত, আখলাক এর উপর চলার অবকাশ থাকবে না বলে বিশ্বাস করেন তাদেরকে তো আমরা সবাই দেখেছি যে, তারা কখনো আওয়ামীলীগ কখনো জাতীয় পার্টি ও কখনো বিএনপির কর্তৃত্ব ও প্রশাসন মেনে চলছেন। সুতরাং এখনও তাঁরা আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করার সুযোগ করতে পারেননি।
১১। বিশেষ করে মওদুদী সাহেবের অনুসারীরা যখন গণতান্ত্রিক
আন্দোলনে বিশ্বাসী হয়ে নিজ দলীয় কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন, তখন তারা গণতান্ত্রিক দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকার চেষ্টা করছেন। আর মওদুদী সাহেব স্বতন্ত্রভাবে গণতন্ত্রের কথা উল্লেখ করে বলেছেনঃ “তুমি যদি গণতান্ত্রী বিধি-বিধান মেনে চলো, তাহলে ইসলামের সেখানে কোন স্থান নেই।” সুতরাং মওদুদীবাদীদের একথা স্বীকার করতেই হবে যে, তাঁরা দ্বীনে ইসলামের উপরে প্রতিষ্ঠিত নন। বরং তাগুত ও শিরকের উপর প্রতিষ্ঠিত। কেননা, তাদের ভাষ্য অনুযায়ী অন্য কোন রাষ্ট্র বা সরকারের নিয়ম-কানুন মেনে চললে সেক্ষেত্রে ইসলাম মানার কোন সুযোগ নেই।
১২। মওদুদী সাহেব এবং তার অনুসারীরা যেহেতু মনে করেন ‘দ্বীন অর্থ স্টেট’ আর ইক্বামতে দ্বীন অর্থ আল্লাহর সরকার কায়েম করা সুতরাং সেই আল্লাহর সরকার কায়েম না করে অন্য মতবাদের বা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নিয়ম-কানুনের অনুগত থেকে যে সকল জামায়াত বা শিবির সদস্য
মৃত্যুবরণ করেছেন তারা কবরের মাঝে তোমার দ্বীন কি? ফিরিশতাদের এই প্রশ্নের উত্তরে যখন “ইসলাম” বলতে পারবেন না তখন তারা কি বলবেন আমার দ্বীন ‘গণতন্ত্র’ অথবা ‘বাংলাদেশ’? আর মওদুদী সাহেব বলবেন আমার দ্বীন ‘বৃটিশ’ ও ‘পাকিস্তান’ তাই কি? এরূপ জবাব দিলে জান্নাত মিলবে না জাহান্নামে পতিত হবে। (কেননা তারা রাষ্ট্র গঠন ছাড়া দ্বীনের অস্তিত্বই স্বীকার করেন না।
১৩। মওদুদীবাদীদের মতে যেহেতু আল্লাহর সরকার গঠন করা ছাড়া অন্য কোন রাষ্ট্র বা কর্তৃত্বের নিয়ম-কানুন মেনে চলার কারণে ইসলামে প্রবেশ করা যায় না, সুতরাং যতক্ষণ পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামী ও তাঁদের আদর্শে বিশ্বাসীরা হুকুমতে ইলাহিয়্যাহ কায়েম না করছেন ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁদেরকে মুসলমান বলা যায় কি?
১৪। জামায়াতে ইসলামী ও শিবির সদস্যগণ যেহেতু (হুকুমতে ইলাহিয়্যাহ) আল্লাহর সরকার কায়েম করতে না পারায় তারা নিজেরাই ইসলামে প্রবেশ করতে পারেননি। সুতরাং তাঁদের বে-দ্বীনী দাওয়াত মানুষ কেন গ্রহণ করবে? তাদেরই বা কি অধিকার আছে মানুষকে বে-দ্বীনির দিকে ডাকার?
১৫। যদি জামায়াতীগণ দাবী করেন যে, আমরা হুকুমতে ইলাহিয়্যাহ কায়েমের চেষ্টা তো করছি! তা হলে শুধু এই দাবী দ্বারা-ই তারা মুসলমান হয়ে যাবেন না। কেননা, কোন অমুসলিম ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করার চেষ্টা করলেই তাকে মুসলমান বলা যায় না। কারণ শুধুমাত্র চেষ্টার নাম ইসলাম নয়। যেভাবে রাত্র এবং দিন একটি অপরটির মধ্যে প্রবেশ করতে পারে না সেভাবে তাঁদের মতে অন্য কোন প্রশাসনের উপস্থিতিতে দ্বীনে ইসলাম অস্তিত্ব লাভ করতে পারে না। তাই দ্বীনে ইলাহিয়্যাহ কায়েমের চেষ্টা করলেই মওদুদীপন্থীদেরকে দ্বীনদার বলা যাবে না। বাস্তবে দ্বীন আছে কিনা তা দেখতে হবে।
১৬। ইসলামী হুকুমত বা ইসলামী সরকার না থাকা অবস্থায় উপমহাদেশে ইংরেজ শাসন আমলে এবং ইংরেজ কর্তৃত্ব অবসানের পর এখন পর্যন্ত এই দেশে যেসব ওলী আল্লাহ, মুক্তী, মুহাদ্দিস, মুফাস্সির, মুজাদ্দিদ, পীর, দরবেশগণ ইন্তেকাল করেছেন তাঁদের সম্পর্কে মওদুদীবাদীদের রায় কি? আল্লাহর সরকার কায়েম না থাকা অবস্থায় তাঁদের মৃত্যু হয়েছে বলে তারা কি বে-দ্বীন হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন?
১৭। মওদুদী সাহেবের অনুসারী জামায়াত শিবিরের মতে ঈমান, নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত, যিকির ও তেলাওয়াত সহ সম্পূর্ণ জীবনের ইবাদতে কোনই সওয়াব হবে না বা তা দুনিয়া ও আখেরাতের কোন কাজে আসবে না, যদি ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠিত না থাকে। কারণ মওদুদী সাহেব বলেছেন, ‘প্রাসাদের শুধু কাল্পনিক চিত্র-যার বাস্তব কোন অস্তিত্ব নেই তা যেমন অর্থহীন, অনুরূপভাবে রাষ্ট্র সরকার ছাড়া একটি দ্বীন সম্পূর্ণরূপে নিরর্থক।” আল্লাহ তা’য়ালা দ্বীন নিরর্থক ও অগ্রহণীয় হওয়ার ব্যাপারে এ ধরনের কোন কথা কুরআন শরীফে বলেননি। এটা নির্দোষ পূত: পবিত্র আল্লাহর উপর তাঁর মূর্খ বান্দা আবুল আলার মিথ্যা অপবাদ।
افْتَرَى عَلَى اللهِ كَذِبًا
১৮। মওদুদী সাহেবের মতে হযরত মুয়াবিয়া (রাযি.)-এর যুগ থেকে হুকুমতের ভিত্তি ইসলামের স্থলে জাহিলিয়্যাতের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এ দীর্ঘকাল ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠিত ছিল না বলে তাঁর মতে ঐ সময়ের মুসলমানদের ঈমান, ইবাদত নিরর্থক। বাহ। কি জঘন্য মুফতী মওদূদী সাহেব।
১৯। আল্লাহ তা’য়ালা কোন নবী রাসূলকে মুখ্যত: হুকুমতে ইলাহিয়্যাহ কায়েম করার উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেননি। এর কোন প্রমাণও কুরআন-হাদীসে বর্ণিত নেই। বরং হযরত নূহ (আ.), হযরত সালেহ (আ.), হযরত ইবরাহীম (আ.), হযরত লূত (আ.), হযরত ইসমাঈল (আ.), হযরত ইসহাক (আ.), হযরত ইয়াকুব (আ.), হযরত ইলিয়াস (আ.), হযরত ইউনুস (আ.) এবং হযরত ঈসা (আ.) সহ লক্ষাধিক নবী-রাসূলগণ রাষ্ট্র কায়েম করে যাননি এবং তার জন্যে তাঁরা কোন চেষ্টাও করেননি। কারণ, এ কাজের জন্য তারা আদিষ্ট হননি বা এ কাজের যিম্মাদারী দিয়ে তাঁদেরকে পাঠানো হয়নি। কিন্তু মওদুদী সাহেব বলেছেন আম্বিয়াগণের মিশনের মূল উদ্দেশ্য হুকুমতে এলাহিয়া কায়েম করা। এটা মওদুদী সাহেবের এমন এক তাগুতী দর্শন যা আজ পর্যন্ত কোন তাগুতও পেশ করতে পারেনি।
বাস্তবতা এই যে, নবী-রাসূলগণ তাঁদের নিজেদের উপর আরোপিত দায়িত্বকে পুরোপুরি পালন করেছেন। নবী মিশনের এমন কোন কাজ বাকী থাকেনি যা তাঁরা পূর্ণ করতে পারেননি। কিন্তু মওদুদী সাহেব হুকুমতে ইলাহিয়্যা নামে এক ভুয়া উদ্দেশ্য সৃষ্টি করে এবং একে নববী মিশনের
চূড়ান্ত লক্ষ্য বলে নিজের ভ্রান্ত মতবাদকে বাজারে চালু করার সাথে সাথে নবী, রাসূলগণকে নবুওয়াত ও রিসালাতের দায়িত্বে ব্যর্থ সাব্যস্ত করার জন্য এক জঘন্য চক্রান্তে মেতেছেন। তাই মাওদুদী সাহেব ও তাঁর অনুসারীদের ঈমানের প্রতি জাতি সন্দিহান।
২০। যেহেতু মওদুদী সাহেব বলেছেন, ‘আপনি যাকেই শাসক ও নিরঙ্কুশ রাষ্ট্রকর্তারূপে মেনে তার অধীনতা স্বীকার করবেন আপনি মূলতঃ তারই দ্বীন এর অন্তর্ভুক্ত হবেন-যদি এ শাসক গণতান্ত্রিক হয়, তবে আপনি সেই দ্বীনের অন্তর্গত গণ্য হবেন? সুতরাং মওদুদী সাহেবের এই ফতোয়া মতে যদি জামায়াত শিবির বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সরকারের অধীনে থেকে এদেশের নির্বাচনে অংশ নেয়, তবে তাঁরা মওদুদী সাহেবের মতাদর্শ অনুসারে মুসলমান থাকতে পারবে কি?
জেনে রাখা দরকার যে, ইসলাম এক পরিপূর্ণ দ্বীন। মানব জীবনের এমন কোন দিক নেই, সমস্যা নেই, যার সমাধান ইসলামে নেই। ব্যক্তি জীবন থেকে নিয়ে পারিবারিক, রাষ্ট্রীয় ও আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে সর্বক্ষেত্রে ইসলামী সমাধান রয়েছে। তবে ইসলামী আহকামাত এর শ্রেনী বিন্যাস রয়েছে। মূল দ্বীন ঈমান, ইবাদত ও আখলাক। অর্থাৎ কালিমা, নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত এই ইবাদতসমূহের যে মর্যাদা এবং অপরিহার্যতা, অন্যান্য শাখা-প্রশাখা সেরূপ নয়। যেমন ভাবে হার্ট, মাথা, পেট, পিঠ, চুল, দাড়ি সবই মানুষের অঙ্গ। তাই বলে কেউ চুল, দাড়িকে আসল মানুষ আখ্যা দিয়ে হার্ট, মাথা ও মুখমণ্ডলকে গৌণ অঙ্গ মনে করে না, কেউই পাসপোর্টে মুখমণ্ডলের স্থলে চুল দাড়ির ফটো ব্যবহার করে না। ঠিক তেমনি রাষ্ট্র সরকার বা প্রশাসনিক দিকটিকে মূল দ্বীন আখ্যা দিয়ে ঈমান, নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাতকে গৌণ বিষয় বা ট্রেনিং কোর্স বলে প্রচার করা ইসলাম সম্পর্কে মূর্খতারই বহিঃপ্রকাশ।
কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, মওদূদী সাহেবের এরূপ মুর্খতাকেই অনেকে তার বিচক্ষণতা বা দূরদর্শিতা মনে করে বসে আছেন। আমি তাদের মুক্ত মনে ইসলাম অধ্যয়ন করতে অনুরোধ করছি। ১৪শত বছরের পাক- পবিত্র উলামায়ে কেরামের জামায়াতকে প্রত্যাখ্যান করে বিংশ শতাব্দীর এক উম্মাদের অন্ধ অনুসরণ করা ভাল মস্তিষ্কের মানুষের কাজ নয়।