মূলতঃ মওদুদী সাহেব প্রচলিত মাদ্রাসা শিক্ষার চূড়ান্তে পৌছেননি। বরং তিনি টেনে-টুনে এস,এস, সি (দাখিল) পর্যায়ের মাদরাসা শিক্ষা অর্জন করেছিলেন। জামায়াতের সাবেক ভারপ্রাপ্ত আমীর মরহুম আব্বাস আলী খাঁন সাহেবের লিখিত “মাওলানা মওদূদী’ বইতে তিনি উল্লেখ করেছেন:
“শৈশব কাল থেকেই মওদুদী সাহেবের পিতা তাঁর উন্নত চরিত্র গঠনের জন্যে বিশেষভাবে চেষ্টা করেছিলেন যাতে দুষ্ট ও অসৎ সংসর্গে মিশে তাঁর চরিত্র কলুষিত না হয়, তার প্রতি তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতেন।
একবার বালক মওদুদী বাড়ীর চাকরানীর ছোট ছেলেকে মেরেছিলেন। পিতা একথা শুনামাত্রই চাকরানীর পুত্রকে ডেকে এনে আপন পুত্র মওদুদীকে ঠিক সেইরূপ মার দিতে আদেশ করলেন। এ শিক্ষা বালক মওদুদীর কচি হৃদয়ে এমনভাবে জাগরূক হয়ে রইলো যে, পরবর্তী জীবনে তিনি কোন দিন তাঁর অধীন ব্যক্তির উপরে অপরাধ করা সত্ত্বেও হস্ত উত্তোলন করেননি অথবা কোন কটু কথা বলেননি। ন’ বৎসর বয়স পর্যন্ত বাড়ীতে বালক মওদুদীর বিদ্যা চর্চা চলতে থাকে। এ সময়ের মধ্যে তিনি আরবী ব্যাকরণ, সাহিত্য এবং ফেকাহ শাস্ত্রের বিভিন্ন প্রাথমিক পুস্তকাদি শেষ করেন। তারপর তাঁর উস্তাদ মরহুম মৌলভী নাদীমুল্লাহ হুসাইনীর পরামর্শে তাঁকে আওরঙ্গাবাদের ফওকানিয়া (উচ্চ) মাদ্রাসায় রুশদিয়া মানের শেষ বর্ষ শ্রেণীতে (৮ম শ্রেণী) ভর্তি করে দেয়া হয়। ভর্তি হবার ছ’মাস পরেই তিনি রুশদিয়া পরীক্ষা দিয়ে অকৃতকার্য হন।
অবশ্য একমাত্র অংক ব্যতীত অন্যান্য সকল বিষয়েই তিনি ভালভাবে পাস করেন। অংকে পাস না করার কারণ এই যে, মাত্র ছ’ মাস পূর্বে সর্বপ্রথম তাঁর অংকে হাতে খড়ি দেয়া হয়। মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক মোল্লা দাউদ সাহেব তাঁকে উপরের মৌলভী শ্রেনীতে ভর্তি করে নেন।
এবার তিনি বিভিন্ন বিষয়ে নব নব জ্ঞান লাভের সুযোগ পান। শিক্ষার মাধ্যম উর্দু হলেও রসায়ন শাস্ত্র, স্বাস্থ্য বিজ্ঞান, অংক, ইতিহাস ভূগোল প্রভৃতি বিষয়ে তাঁর জ্ঞান লাভের গভীর অনুরাগ জন্মে। তাছাড়া বিভিন্ন শিক্ষকের সাহচর্য ও সংস্পর্শ লাভ করার ফলে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাধারা প্রসারিত হয়। এ যাবত বহির্জগত ও বাইরের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে তাঁর মধ্যে যে বেরসিকতা ও উদাসীনতার সঞ্চার হয়েছিল, সহাধ্যায়ী বন্ধুদের সাহচর্য তা দূর করে দিল।
উল্লেখ্য যে, সে সময়ে আল্লামা শিবলী নোমানী, নওয়াব নিযামুল মুলক বিলগেরামী ও মাওলানা হামীদুদ্দীন ফারাহীর পরিকল্পনা অনুযায়ী হায়দারাবাদ ও আওরঙ্গাবাদে এক নতুন ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা কায়েম করা হয়। শিক্ষার মাধ্যম ছিল উর্দু। ইতিহাস, ভূগোল, অংক ও আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের সাথে আরবী সাহিত্য, ব্যাকরণ, কুরআন-হাদীস ও ফেকাহ, মাকে (তর্কশাস্ত্র) প্রভৃতি পড়ানো হতো। এ মানের মেট্রিকুলেশনকে মৌলভী, ইন্টারমিডিয়েটকে মৌলভী আলেম এবং ডিগ্রী কলেজকে দারুল উলূম বলা হতো।
উনিশ শ’চৌদ্দ খৃস্টাব্দে বালক মওদুদী মৌলভী পরীক্ষা দেন এবং অংকে কাঁচা থাকার কারনে উত্তীর্ণ ছাত্রদের মধ্যে ষষ্ঠ স্থান লাভ করেন। এই সময় পিতার স্বাস্থ্য
একেবারে ভেঙ্গে পড়ে। তিনি ১৯১৬ খৃস্টাব্দে আওরঙ্গাবাদ থেকে হায়দারাবাদ গমন করেন এবং সেখানে দারুল উলুমে উচ্চ শিক্ষার জন্যে পুত্র মওদুদীকে ভর্তি করে দেন। তখন দারুল উলূমের অধ্যক্ষ ছিলেন মাওলানা হামীদুদ্দীন। পুত্রকে হায়দারাবাদ রেখে অসুস্থ পিতা চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য পরিবর্তনের জন্যে ভূপাল চলে যান।
বালক মওদুদী হায়দারাবাদ দারুল উলূমে পাঠ্যাভাস করতে থাকেন। কিন্তু ছ’ মাস অতীত হতে না হতেই ভূপাল থেকে দুঃসংবাদ এলো যে, পিতা মৃত্যু শয্যায় শায়িত। সংবাদ পাওয়া মাত্র বালক মওদুদী মাতাকে নিয়ে ভূপাল চলে যান এবং মুমূর্ষ পিতার সেবা শুশ্রুষায় আত্মনিয়োগ করেন মওদূদী সাহেব।। এ সময় থেকেই বালক মওদুদীকে জীবিকা অন্বেষণের উপায় অবলম্বন করতে হয়।” (মাত্তঃ মাওদূদী পৃঃ ৩০/৩১)
হ্যাঁ এমনিভাবেই ১৯১৪ সালে মৌলভী শ্রেণীতে পরীক্ষা দিয়ে মেট্রিকুলেশন পর্যায়ের শিক্ষা লাভ করেন মওদূদী সাহেব। চূড়ান্ত পর্যায়ের শিক্ষা গ্রহণ করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি যা লাভ করলে তাকে আলেম বা মাওলানা বলা যেতো। সুতরাং হাইস্কুল পর্যায়ের একজন মাদ্রাসা শিক্ষাপ্রাপ্ত ব্যক্তির রচিত কুরআন-হাদীস বিষয়ক লেখনী বিতর্ক মুক্ত হবে না এটাই স্বাভাবিক।