কুরআন মাজীদ ও দ্বীনের সংরক্ষণ
(কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে)
কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে দ্বীন-এর পরিচিতিমূলক বিস্তারিত আলোচনার পর আমরা এখন কুরআন মাজীদের হিফাযত বা সংরক্ষণ ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনায় প্রবৃত্ত হচ্ছি।
দ্বীন তথা কুরআন মাজীদের হিফাযত ব্যবস্থা বিষয়ে অবহিতি লাভ করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্যই জরুরী। কেননা, আল্লাহ প্রদত্ত এবং আল্লাহ তা’য়ালা কর্তৃক প্রেরিত দ্বীন অবিকল, অবিকৃত ও নিখুঁত অবস্থায় আমরা যদি লাভ করতে না পারি অথবা যে কোন ভাবে যদি আসমানী এই কিতাবের মাঝে কোন প্রকার রদ বদল কিংবা তার শব্দ ও অর্থের মাঝে কোন রকম ভুল ও বাতিল ঢুকিয়ে দিয়ে আমাদের কাছে এ দ্বীন উপস্থাপন করা হয় তাহলে এমন দ্বীন পালন করে নিশ্চয়ই আমরা প্রতারিত হবো। তদুপরি আল্লাহ তা’য়ালা যে সকল নবী, রাসুল, সাহাবী, তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ী সহ হাক্কানী উলামায়ে কিরামের এক জামায়াতকে কুরআনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও হিফাযতের জন্য বিশেষ ভাবে নির্বাচিত ও গ্রহণযোগ্য করেছেন। (যা বাস্তবতার নিরিখে প্রমাণিত) তাঁদের ব্যক্তিত্ব, তাঁদের সততা, তাদের দ্বীনী জ্ঞানের গভীরতা, তাঁদের আমল-আখলাকের উজ্জ্বলতা, তাকওয়া পরহেযগারী ও আল্লাহর রাহে কুরবানীর সুউচ্চ দৃষ্টান্ত, সত্যের বিকাশ ঘটাতে তাঁদের আপোষহীনতা, ব্যক্তি স্বার্থ ও লোভ-লালসা থেকে তাদের পরিচ্ছন্নতা এবং সকল রক্ত চক্ষুর সামনে তাঁদের পাহাড়সম অটলতা সর্বোপরি সত্য দ্বীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় যথাযথ বর্ণনা ও বাস্তবায়নে যাঁরা দ্বীন ইসলামের তারকা তুল্য সেই সব আস্থাভাজন বিশ্বস্থ ও আপাদমস্তক দ্বীনী ব্যক্তিত্ব তথা দ্বীনের অতন্দ্র প্রহরীদের সম্পর্কে মিথ্যা অপবাদ, প্রোপাগাণ্ডা কিংবা কোন প্রকার সংশয় সন্দেহের উদ্রেক করে কেউ যেন দ্বীনের মূল অস্তিত্ব ও বুনিয়াদের মাঝে কোন প্রকার দ্বিধা সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালাতে না পারে সেজন্যও দ্বীনের হিফাযত ও সংরক্ষণ ব্যবস্থা বিষয়ে আমাদের সম্যক অবহিতি থাকা অপরিহার্য।
বলা বাহুল্য, ইতিপূর্বে নাযিলকৃত আসমানী কিতাব সমূহের মাঝে এরূপ বিকৃতি তথা পাত্রী ও ধর্মজাযকদের সুবিধাবাদী রদ-বদল, পরিবর্তন-পরিবর্ধন, সংযোজন- বিয়োজনের ফলে ঐসব কিতাব অবিকৃত থাকেনি, থাকেনি আল্লাহ প্রদত্ত দ্বীনের আদি আসল অবয়ব। অবশ্য আল্লাহ তা’য়ালার পক্ষ থেকেও ঐসব কিতাবের স্থায়ী হিফাযতের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়নি, বরং ঐসব উম্মতের উপর নিজেদের দ্বীন ও কিতাবের হিফাযতের দায়িত্ব অর্পন করা হয়েছিল।
আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেনঃ
إِنَّا اَنْزَلْنَا التَّوْرَةَ فِيهَا هُدًى وَنُورٌ يَحْكُمُ بِهَا النَّبِيُّونَ الَّذِينَ اسْلَمُوا لِلَّذِينَ هَادُوا وَالرَّبَّانِيُّونَ وَالْأَحْبَارُ بِمَا اسْتُحْفِظُوا مِنْ كِتَابِ اللَّهِ وَكَانُوا عَلَيْهِ شُهَدَاءَ
‘নিশ্চয় আমি তাওরাত নাযিল করেছি, যার মাঝে ছিল হিদায়াত ও আলো’। আল্লাহর অনুগত নবী, রাসূল, পাদ্রী ও দরবেশগণ এ তাওরাতের নির্দেশনা অনুযায়ী ইহুদীদেরকে বিধান প্রদান করতেন। কেননা তাদেরকে আল্লাহর এই (তাওরাত) কিতাবের সংরক্ষক নির্ধারণ করা হয়েছিল এবং স্বয়ং তারা এ বিষয়ে সাক্ষী ছিল। (সূরা মায়িদা, আয়াত: ৪৪)
কেননা, আল্লাহ তা’য়ালা ঐসব কিতাব ও দ্বীন নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে এবং নির্দিষ্ট যুগের জন্যই কেবল অবতীর্ণ করেছিলেন। তাই তো শেষ আসমানী কিতাব কুরআনুল কারীম ভিত্তিক যে পূর্ণাঙ্গ ও চূড়ান্ত দ্বীন (দ্বীনে ইসলাম) আমাদের প্রতি নাযিল করা হয়েছে তার মাধ্যমে ইতিপূর্বের সকল আসমানী কিতাব ওnদ্বীন রহিত হয়ে গেছে।
পক্ষান্তরে এই কুরআনুল কারীম কখনো রহিত হবার নয়। কেননা, এই কিতাবের পরে আর কোন কিতাব অবতীর্ণ হবে না, এই কিতাব সার্বজনীন-সর্বকালীন-চিরন্তন। আগের যুগের সুবিধাবাদী গোমরাহ ধর্মজাযকদের মত কেউ এই কিতাবের মাঝে বিকৃতি সাধনের অপচেষ্টা চালিয়ে সফলকাম হতে পারবে না। মহান রাব্বুল আলামীন স্বয়ং এই কিতাব ও দ্বীনের হিফাযতের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন।
পূর্ণাঙ্গ এবং চূড়ান্ত আসমানী কিতাব কুরআনুল কারীম এর যথাযথ সংরক্ষণ ও হিফাযত সম্পর্কে আল্লাহ তা’য়ালা স্পষ্ট ঘোষণা করেছেনঃ
أَنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ .
‘আমিই কুরআনুল কারীম নাযিল করেছি এবং স্বয়ং আমিই এর সংরক্ষক।’ (সূরা হিজর, আয়াতঃ ৯)
সর্বশেষ আসমানী কিতাব কুরআনুল কারীম ভিত্তিক দ্বীনে ইসলামের মাঝে বিকৃতি সাধনের অবকাশ যাতে কেউ না পায়, তার যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। সুতরাং এই দ্বীন ও কিতাবে বিকৃতি সাধন করার চেষ্টা করে কেউ সফলকাম হবে না, বরং অপচেষ্টাকারীরা ইসলামের দুশমন বলে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
কুরআনুল কারীমের শব্দ সংরক্ষণ এবং এর অর্থগত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বিষয়ে আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেছেনঃ
لَا تُحَرِّكْ بِهِ لِسَانَكَ لِتَعْجَلَ بِهِ إِنَّ عَلَيْنَا جَمْعَهُ وَ قُرْآنَهُ فَإِذَا قَرَأْنَاهُ فَاتَّبِعُ قُرْآنَهُ ثُمَّ إِنَّ عَلَيْنَا بَيَانَهُ .
“হে নবী! কুরআনুল কারীমের শব্দসমূহ তাড়াতাড়ি আয়ত্ত্ব করার জন্য আপনি অধিকহারে জিহ্বা সঞ্চালন করবেন না। কেননা কুরআনের শব্দ সমূহের সংরক্ষণ এবং তা পাঠ করানোর দায়িত্ব আমারই, আপনি কেবল আমার পাঠের অনুসরণ করুন যখন আমি তা পাঠ করি। এ ছাড়া কুরআনে কারীমের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের দায়িত্বও আমার। (সুরা জ্বিয়ামাহ, আয়াতঃ ১৬-১৯)
যেহেতু কুরআনুল কারীমের পরে আর কোন কিতাব নাযিল হবে না, বরং এই কিতাব ও দ্বীনকে সর্বকালের (অপরিবর্তনশীল) স্থায়ী দ্বীন হিসাবে পূর্ণাঙ্গতা প্রদান করে নাযিল করা হয়েছে, সুতরাং ক্বিয়ামত পর্যন্তই এর অবিকৃত অবস্থার নিশ্চয়তা জরুরী। এই সার্বজনীনতা ও সর্বকালীন স্থায়ীত্বশীলতার কথা ঘোষণা করে আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেছেনঃ
إِنْ هُوَ إِلَّا ذِكْرٌ لِلْعَالَمِينَ .
এই কুরআনুল কারীম (যা দ্বীনে ইসলামের মূল ভিত্তি) বিশ্ববাসী সকল সদস্যের জন্য দিক নির্দেশক। (সূরা তাকভীর, আয়াত : ২৭)
অন্যত্র মুহাম্মাদ (সা.) কে সম্বোধন করে ইরশাদ হয়েছেঃ
وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا كَافَّةً لِلنَّاسِ بَشِيرًا وَ نَذِيرًا وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ –
“আর আপনাকে আমি (কিয়ামত পর্যন্তের) সকল মানুষের জন্য সুসংবাদ দাতা ও সতর্ককারী রূপে প্রেরণ করেছি। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না, বুঝে না।” (সূরা সাবা, আয়াত: ২৮)
সূরা আ’রাফে ইরশাদ হয়েছে-
قُلْ يَأَيُّهَا النَّاسُ إِنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكُمْ جَمِيعًا الَّذِي لَهُ مُلْكُ السَّمَواتِ وَالْأَرْضِ
(হে রাসূল)! আপনি বলুন, হে (সর্বযুগের) মানব সকল! আমি তোমাদের জন্য সেই আল্লাহর পক্ষ থেকে রাসূল হিসেবে প্রেরিত হয়েছি যিনি আকাশ মণ্ডলী এবং পৃথিবীর সার্বভৌমত্ব ও কর্তৃত্বের অধিকারী।” (সূরা আ’রাফ, আয়াতঃ১৫৮)
সূরা ফুরক্বানে আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেছেনঃ
تَبَارَكَ الَّذِي نَزَّلَ الْفُرْقَانَ عَلَى عَبْدِهِ لِيَكُونَ لِلْعَالَمِينَ نَذِيرًا –
“কতই না মহান তিনি যিনি তাঁর বান্দা (মুহাম্মাদ)-এর প্রতি সত্য ও অসত্য নির্ণয়কারী কুরআন নাযিল করেছেন, যাতে তিনি সকল জগতের জন্য সতর্ককারী হন।” (সূরা ফুরক্বান, আয়াতঃ ১)
সূরা আম্বিয়ায়ে ইরশাদ হয়েছেঃ
وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً إِلَّا رَحْمَةً لِلْعَالَمِينَ . .
“আর আপনাকে তো আমি সকল জগতের (মানুষের) জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি।” (সূরা আম্বিয়া, আয়াতঃ ১০৭)
রাসূলে কারীম (সা.) ইরশাদ করেন:
بعِثْتُ إِلَى الْأَسْوَدِ وَالْأَحْمَرِ
“আমি লাল, কালো সকল বর্ণের মানুষের প্রতি প্রেরিত হয়েছি।”
তিনি আরো ইরশাদ করেছেনঃ
كَانَ النَّبِيُّ يُبْعَثُ إِلَى قَوْمِهِ خَاصَّةً وَبُعِثْتُ إِلَى النَّاسِ عَامَّةً (بخاري ومسلم)
“আগের যুগের নবীগণ কোন বিশেষ জনপদের উদ্দেশ্যে নবী হিসেবে প্রেরিত হতেন। কিন্তু আমি (সকল যুগের) সকল মানুষের প্রতি নবী হিসেবে প্রেরিত হয়েছি…..।
উপরে উল্লেখিত আয়াতসমূহ এবং হাদীসদ্বয় দ্বারা প্রতিভাত হলো যে, দ্বীনে ইসলাম সকল যুগের, সকল দেশের, সকল অঞ্চলের, সকল বর্ণের, সকল বংশের মানুষের জন্য এক ব্যাপক দ্বীন। এই দ্বীন গ্রহণে, পালনে, বাস্তবায়নে সকলের অধিকার সমান। আর সার্বজনীন, সর্বকালীন আল্লাহর আহবান হিসেবে কুরআনে কারীম একক মর্যাদার অধিকারী। তাওরাত, যবুর ও ইঞ্জিল (বাইবেল) এবং ইহুদী ও খৃষ্ট ধর্ম নির্দিষ্ট গোত্রের নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্রযোজ্য ছিল, সে কারণে ঐ সব কিতাবের সংরক্ষণের দায়িত্ব আল্লাহ তা’য়ালা নিজে নেননি। তাই বর্তমানে পৃথিবীতে কুরআনে কারীম ব্যতীত কোন অবিকৃত আসমানী কিতাব নেই। কিন্তু কুরআনে কারীম অন্যান্য আসমানী কিতাবের তুলনায় সকল দিক থেকেই স্বতন্ত্র ও অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। এই কুরআনে কারীমের স্থায়ী হিফাযতের দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ তা’য়ালা নিয়েছেন। এই কুরআনে কারীমের শব্দ, অর্থ ও আমলের বাস্তব নমুনা প্রদান ও সবকিছুর সংরক্ষণের যিম্মাদারী তিনি নিজে গ্রহণ করেছেন এবং ইরশাদ করেছেনঃ আমি (আল্লাহই) এই নসীহতপূর্ণ কুরআন নাযিল করেছি এবং নিশ্চয়ই আমি নিজেই এর সংরক্ষক। (সূরা হিজর)
কুরআন সংরক্ষণের অর্থ
আল্লাহ তা’য়ালা নিজেকে কুরআনে কারীমের হাফেয (সংরক্ষক) বলে যে ঘোষণা দিয়েছেন তাতে হিফাযতের তিনটি বিভাগের সমন্বয় কার্যকর রয়েছে। যথাঃ (১) কুরআনে কারীমের শব্দসমূহের হিফাযত, (২) কুরআনে কারীমের শব্দসমূহের অর্থগত হিফাযত, (৩) কুরআনে বর্ণিত আ’মালের (বাস্তব রূপের) হিফাযত। তাই ক্বিয়ামত পর্যন্ত এই চিরন্তন কুরআনের শব্দের মাঝে কেউ কোন পরিবর্তন করতে সক্ষম হবে না এবং এর অর্থের মাঝেও কোন প্রকার রদ-বদল বা বিকৃতি সাধন করতে পারবে না, আর কুরআনে কারীমে বর্ণিত আ’মালসমূহের যে বাস্তব নমুনা তাতেও কেউ মনগড়া বা স্বেচ্ছাচারী পরিবর্তন সাধন করে পার পেতে পারবে না।
যেমনঃ কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছেঃ أَقِيمُوا الصلوة (আকিমুস সালাতা) এর অর্থ হল বাহ্যিক এবং বাতেনী শর্তসমূহ পালন করে সর্বদা আল্লাহর নির্দেশিত পন্থায় যথাযথভাবে নামায আদায় করো। এই নামাযের বাস্তব রূপ কি? বাস্তব রূপ তা-ই যা রাসূল (সা.) নিজের মোবারক জীবনে বাস্তবায়ন করে দেখিয়ে গেছেন এবং সাহাবায়ে কিরামকে বলে গেছেন-
صَلُّوا كَمَا رَأَيْتُمُونِي أَصَلِّي
‘আমাকে যেভাবে নামায আদায় করতে দেখ তোমরা সেভাবে নামায আদায় কর’। লক্ষাধিক সাহাবায়ে কিরাম নিজেদের জীবনে এই নামায আদায় করে লক্ষ লক্ষ তাবেয়ীগণকে নামায শিখিয়েছেন। এই ভাবে নামাযের বাস্তব নমুনা আমাদের পর্যন্ত পৌঁছেছে। অর্থাৎ, সমগ্র বিশ্বের মুমিন নর-নারী যে পদ্ধতিতে নামায আদায় করে আসছেন সেটাই ইক্বামাতে সালাত বা নামায কায়েম করার বাস্তবরূপ।
উল্লেখ্য যে, ‘হিফাযত’ শব্দটি বিশাল এবং ব্যাপক অর্থ বহন করে। সে কারণেই এই ‘ইক্বামতে সালাত’ বাক্যটিরও রয়েছে সার্বিক হিফাযতের প্রশ্ন। এখন এই “আক্বীমুস সালাত (নামায কায়েম কর) বাক্যটির আসল অর্থ যা, তা যদি সংরক্ষিত না থাকে বরং বিকৃত হয়ে যায়, তাহলে ‘আক্বীমুসালাতা’ এই আদেশটি অকার্যকর হয়ে পড়বে। নামায আদায় নিরর্থক হবে বা আদেশটি সম্পূর্ন লংঘিত হবে। কিংবা অসাধ্য বিষয়ে
পরিণত হবে। কুরআনের শব্দ, অর্থ ও বাস্তবরূপ অথবা এর যে কোন একটি পরিবর্তিত হলে সর্বক্ষেত্রেই এরূপ জটিলতা এবং বিকৃতি ও অপারগতা বা স্বেচ্ছাচারিতার উদ্ভব ঘটতে পারে। সে জন্যই কুরআনে কারীমের সার্বিক হিফাযতের দায়িত্ব আল্লাহ নিজে নিয়েছেন। আর কুরআনে কারীমকে অনাগত সর্বকালের জন্য প্রযোজ্য ও উপযোগী করেই নাযিল করেছেন। সে কারণেই এর সার্বক্ষণিক এবং পরিপূর্ণ হিফাযত অপরিহার্য।
কুরআন সংরক্ষণে খোদায়ী ব্যবস্থাপনা
এখানে কুরআনী জ্ঞান-বিদ্যার বৈশিষ্ট্য এবং কিভাবে দ্বীনে-ইসলামের হিফাযত করে চলেছেন আল্লাহ তা’য়ালা, সে বিষয়ে আলোকপাত করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য যে, সকল জ্ঞানের উৎস, সকল জ্ঞান-বিজ্ঞানের উদ্ভাবক সর্বোচ্চ ক্ষমতাবান আল্লাহ তা’য়ালা যেমন সকল সৃষ্টির চেয়ে সত্ত্বাগত ভাবে অনন্য, অতুলনীয় এবং প্রশ্নের উর্ধ্বে। তেমনি তাঁর নাযিল করা কুরআনী শিক্ষাও তুলনাহীন, সাদৃশ্যহীন, একক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। সে কারণেই কুরআনী শিক্ষার অবতরণ’ এর প্রশিক্ষণ, প্রচার সংরক্ষণ এবং বাস্তবরূপ প্রদর্শনের পদ্ধতি অন্যান্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের মত নয়।
যেমন আমরা লক্ষ্য করলে দেখতে পাব যে, বর্তমান পৃথিবীতে মানব রচিত বা মানব উদ্ভাবিত জ্ঞান-বিজ্ঞানের যত শাখা-প্রশাখা রয়েছে যথাঃ চিকিৎসা বিদ্যা, প্রকৌশল বিদ্যা, কৃষি বিজ্ঞান, উদ্ভিদ বিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান, সমরাস্ত্র বিদ্যা, পশু বিজ্ঞান, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, সৌর বিজ্ঞান, জলজ বিজ্ঞান, রাষ্ট্র বিজ্ঞান, বাণিজ্য বিদ্যা, কম্পিউটার বিজ্ঞান, অংক শাস্ত্র, ভূতত্ত্ব বিদ্যা, খনিজ বিজ্ঞান ও আধুনিক প্রযুক্তি বিদ্যা প্রভৃতি জ্ঞান-বিজ্ঞানের যারা রচয়িতা তাদের চারিত্রিক অবস্থা, ব্যক্তি জীবনে তাদের নৈতিকতা, সাধুতা, সংযমশীলতা, খোদাভীতি ও সততা ইত্যাদি বিষয়ে তাঁরা কোন উল্লেখযোগ্য মর্যাদার অধিকারী ছিলেন না।
উল্লেখিত বিষয়সমূহের অগণিত রচয়িতা ও উদ্ভাবক ইয়াহুদী, খৃস্টান, ধর্মহীন ও নাস্তিক হলেও তাদের রচিত ও উদ্ভাবিত জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তির
শিক্ষা লাভ করে পৃথিবীবাসী উপকৃত হচ্ছে। জীবিকা ও বৈষয়িক প্রয়োজন পূরণ করে চলেছে।
পক্ষান্তরে কুরআনী জ্ঞান বা ইসলাম প্রদত্ত ঐশী জ্ঞান-বিদ্যা এমনটি নয়। কুরআনে কারীম হলো আল্লাহ প্রদত্ত এক পূর্ণাঙ্গ আসমানী কিতাব। এই পূর্ণাঙ্গ কিতাবের মাধ্যমেই দ্বীনে ইসলাম পূর্ণাঙ্গতা লাভ করেছে।
কুরআনে কারীম এমন এক মহান সত্ত্বার বাণী, যিনি সকল সৃষ্টির স্রষ্টা, অনাদী-অনন্ত, যাঁর সত্ত্বা ও গুণাবলীর মাঝে অসত্য, কলুষতা, পরীশ্রকাতরতা, সংকীর্ণতা, বিদ্বেষ, অপরিণামদর্শিতা, স্বেচ্ছাচারিতা তথা কোন প্রকার ত্রুটি বা অসুন্দরের লেশমাত্র নেই। তাই এই কুরআনী জ্ঞান কুরআনে কারীমের ব্যাখ্যা, হাদীস, ফিকাহ ও তাফসীর ইত্যাদি শাস্ত্রের লক্ষাধিক কিতাবাদির রচয়িতা ও সংকলক সকল যুগের নির্ভরশীল, সুচরিত্রের অধিকারী পাক-পবিত্র উলামায়ে কিরামের জামায়াত। তাইতো এই বিদ্যার মাঝে আস্থাহীনতা ও স্ববিরোধিতারও উদ্ভব হয় না। যেমনটি হয় মানব রচিত জ্ঞান-বিজ্ঞানের মাঝে।
যুগে যুগে এই কুরআনী জ্ঞান-বিদ্যার ধারক-বাহক হলেন আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত ও নির্বাচিত এমন এক মহান দল যাঁরা বিশ্বাসযোগ্যতা, আমানতদারী, ন্যায়পরায়ণতা, সত্যনিষ্ঠতা, চারিত্রিক উৎকর্ষ, জ্ঞানগত সাধনা, ত্যাগ ও কুরবানী, উন্নত স্মরণ শক্তি, মেধা, মননশীলতা সর্বোপরি ইলমের যথাযথ এবং হুবহু ধারণ ও বহনের ক্ষেত্রে সকল প্রশ্নের উর্ধ্বে।
আল্লাহ তা’য়ালা তার এই সব মনোনীত মহান ব্যক্তিবর্গের মাধ্যমে যেমনিভাবে কুরআনে কারীমের শাব্দিক হিফাযত করেছেন, ঠিক তেমনি অর্থ ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ তথা মূল এবং শাখা-প্রশাখা উভয়ের হিফাযতের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। কুরআনী ইল্ম তথা ঐশী জ্ঞানের এই সংরক্ষণ কর্মকাণ্ডে যাঁরা নিরলস ও ঐকান্তিক ভূমিকা পালন করে ইসলামের আকাশে নক্ষত্র হয়ে রয়েছেন, তাঁরা হলেন আল্লাহর নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিত্য সহচর সাহাবায়ে কিরাম, পরবর্তী পর্যায়ে তাবেঈন, তাবে-তাবেঈন, মুজাহিদীন, ফুক্বাহা ও মুহাদ্দিসীন তথা কুরআন-হাদীসের বিদগ্ধ জ্ঞানী উলামায়ে কিরামের পূত:-পবিত্র জামায়াত। এই নির্বাচিত
দলটির চরিত্র, নির্ভরযোগ্যতা, সত্যবাদিতা, জ্ঞানগত উৎকর্ষের মান যাতে কোন ভাবেই প্রশ্নের সম্মুখীন না হয়, কোন দুষ্ট চক্র যাতে তাঁদের চরিত্র ও সততায় কোন প্রকার কালিমা লেপনের সুযোগ না পায়; সেজন্য পাঁচ লক্ষাধিক কুরআনী ইলমের ধারক ও বাহকগণের জীবনী সংরক্ষিত হয়েছে গ্রন্থাকারে। বিষয়টি এই দ্বীনে ইসলামের অনন্য বৈশিষ্ট্য।
উল্লেখ্য যে, উপরোক্ত কুরআনী জ্ঞান-বিজ্ঞানের ধারক-বাহক মহামনীষীগণ কিতাবুল্লাহর জ্ঞান লাভের ও কিয়ামত পর্যন্ত তার সঠিক অর্থ ও মর্ম সংরক্ষণের জন্যে প্রায় চৌদ্দটি শাস্ত্রের আবিস্কার করেছেন। কুরআনী জ্ঞান বিদ্যার বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার উদ্ভাবক ঐ সকল মুফাস্সির, মুহাদ্দিস, মুজতাহিদ, মুক্তী, আইনবেত্তা ইমামগণ আজ আমাদের মাঝে জীবিত না থাকলেও তাঁদের রচিত উলূমে দ্বীনের মাধ্যমে (যা কাগজের পৃষ্ঠায় উজ্জ্বল হয়ে আছে) আজও পৃথিবীবাসী বিশুদ্ধ ইসলামের সঠিক দিক-নির্দেশনা লাভ করছে। কিয়ামত পর্যন্ত কুরআনুল কারীম তার অর্থ ও আমালের (বাস্তবরূপের) নমুনা সহ সংরক্ষিত হয়ে থাকবে।
আমরা ইতিপূর্বে এ প্রসঙ্গে কুরআনে কারমীমের আয়াত উল্লেখ করে এসেছি যে, মহান আল্লাহ তা’য়ালা স্বয়ং কুরআনে কারীমের সার্বিক হিফাযতের দায়িত্ব নিয়েছেন। হ্যাঁ, এই দায়িত্ব নেওয়ার কারণেই শব্দগত, অর্থগত কিংবা বাস্তব রূপগত কোন প্রকার বাতিলের অনুপ্রবেশ কুরআনে কারীমের মাঝে ঘটা সম্ভব নয়। তাছাড়া কুরআনে কারীমকে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ এবং পূর্ণাঙ্গ ও চূড়ান্ত আসমানী কিতাবরূপে নাযিল করেছেন তিনিই। সুতরাং এই কুরআনে কারীমে পরিবর্তন ও পরিবর্ধনেরও কোন অবকাশ নেই। তাইতো কুরআনে কারীমের সর্বপ্রকার বিকৃতি এবং পরিবর্তনমুক্ত হওয়ার গ্যারান্টি দিয়ে আল্লাহ তা’য়ালা ঘোষণা করেছেনঃ
وَإِنَّهُ لَكِتَابٌ عَزِيزٌ لَا يَأْتِيْهِ الْبَاطِلُ مِنْ بَيْنِ يَدَيْهِ وَلَا مِنْ خَلْفِهِ تَنْزِيلٌ مِّنْ حَكِيمٍ حَمِيدٍ –
“নিশ্চয়ই এই কুরআনে কারীম এক মহিমান্বিত (চিরন্তন) কিতাব। সম্মুখ কিংবা পশ্চাত দিক থেকে কোন বাতিল (বিকৃতি-মিথ্যা) এই কিতাবে,
অনুপ্রবেশ করতে পারবে না। বরং মহা প্রতাপশালী প্রশংসিত আল্লাহর পক্ষ থেকে (চিরন্তন সত্য গ্রন্থ) নাযিল হয়েছে এই কিতাব। (সূরা হা-মীম সিজদা, আয়াতঃ৪১-৪২)
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছেঃ
اتْلُ مَا أُوحِيَ إِلَيْكَ مِنْ كِتَابِ رَبِّكَ لَا مُبَدِّلَ لِكَلِمَتِهِ وَ لَنْ تَجِدَ مِنْ دُونِهِ مُلْتَحَدًا –
“হে নবী! আপনি আপনার প্রতি নাযিলকৃত আপনার প্রতিপালকের কিতাব পড়ে শুনাতে থাকুন, তাঁর বাণীসমূহ পরিবর্তনকারী কেউ নেই। আর আপনি তাকে ছাড়া আর কোন আশ্রয়স্থল পাবেন না।” (সূরা কাহাফ, আয়াতঃ ২৭)
কুরআনও দ্বীন সংরক্ষণের নিরবচ্ছিন্ন ধারা
দ্বীনে ইসলামের মূল ভিত্তি ‘কুরআনে কারীমের’ হিফাযতের দায়িত্ব যেহেতু স্বয়ং আল্লাহ তা’য়ালা গ্রহণ করেছেন সেহেতু তার যথাযথ পদ্ধতি ও উপকরণেরও যোগান দিয়েছেন তিনিই। আল্লাহ তা’য়ালা কর্তৃক গৃহীত পদ্ধতিসমূহ সত্যিই অনন্য এবং যথাযথ। যেমনঃ কুরআনে কারীমের শব্দ সমূহকে বিকৃতিহীন সংরক্ষণ করতে যুগে যুগে লক্ষ কোটি হাফেযে কুরআন সৃষ্টি করেছেন। যারা না দেখেই পূর্ণাঙ্গ কুরআনে কারীমের শব্দ, বানান-রীতি, দাঁড়ি, কমা, যতিচিহ্ন ইত্যাদি নিশ্চিতরূপে বলে দিতে পারে।
অন্যদিকে কুরআনে কারীমের অর্থ, ব্যাখ্যা, মর্মকথা ইত্যাদির যথাযথ হিফাযতের জন্য আল্লাহ তা’য়ালা যোগ্য, বিচক্ষণ ও মানব জাতির মধ্যে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য (কুরআনী জ্ঞান বিশেষজ্ঞ) উলামায়ে কেরামের এক জামায়াত সৃষ্টি করেছেন, যাঁরা কুরআনে কারীমের শাব্দিক অর্থ, মূলনীতিগত বিধান, ইঙ্গিতবহ বিধান, প্রকাশ্য অর্থ, মর্মগত অর্থ. পারিভাষিক অর্থ, শব্দ বা বাক্যের বাহ্যিক বা প্রচ্ছন্ন চাহিদাগত অর্থ ইত্যাদির যথাযথ বর্ণনা প্রদানের মাধ্যমে কুরআনে কারীমের অর্থগত হিফাযতের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। শুধু তাই নয়; ঐ সমস্ত বিচক্ষণ
ও বিদগ্ধ মুফাস্সিরে কুরআনগণ ঐ সংরক্ষিত বর্ণনার বহুল প্রচারও করে চলেছেন।
এ প্রসঙ্গে বিদগ্ধ মুফাস্স্সিরে কুরআন আল্লামা আলাউদ্দীন বাগদাদী তাঁর কৃত তাফসীরে খাযিনে লিখেছেনঃ
بَلْ أَعْجَزَ اللهُ الخَلقَ عن إبطاله وإفساده بوجه من الوجوه فَقَيَّضَ الله العلماء الراسخين يَحفَظُونَ ويذبون عنه الى اخر الدهر لأن دواعي جماعة من الملاحدة و اليهود متوفرة على ابطاله وافساده فلم يَقْدِرُوا عَلَى ذَالِكَ بِحَمْدِ اللَّهِ تَعَالَى
“এই চিরন্তন কুরআনের মাঝে কোন সৃষ্টি কোন প্রকার বিশৃঙ্খলা ধ্বংসলীলা কিংবা বিকৃতি সাধন করবে সে শক্তি আল্লাহ তা’য়ালা খর্ব (রহিত) করে দিয়েছেন এবং ইসলামের প্রতি যুগে এই চূড়ান্ত কুরআনে কারীমের যথাযথ হিফাযতের জন্য অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য বিচক্ষণ ও বিদগ্ধ উলামায়ে কিরামের জামায়াতকে অতন্দ্র প্রহরী রূপে নিযুক্ত রেখেছেন। তারা কিয়ামত পর্যন্ত কুরআনের সংরক্ষণও বাতিলের আক্রমণ থেকে তার প্রতিরোধের দায়িত্ব পালন করে থাকবেন। সে কারণেই কুটিল ইয়াহুদী, খৃষ্টান এবং বে-দ্বীন ধূর্ত গোষ্ঠী শত অপচেষ্টা ও শত অপতৎপরতা চালিয়েও কুরআনে কারীমে কোন প্রকার বিকৃতি বা অনিষ্ট সাধনে সক্ষম হয়নি আলহামদুলিল্লাহ। (তাফসীরে খাযিন, সূরা হিজর)
কুরআনে কারীমের শব্দ ও অর্থের হিফাযতকারী ও কুরআনে কারীমের জ্ঞানে বুৎপত্তি অর্জনকারী প্রথম কাফেলায় যারা ছিলেন তাঁরা হলেন হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রত্যক্ষ শাগরেদ এবং কুরআনে কারীমের অবতরণ প্রত্যক্ষকারী মহান সাহাবায়ে কিরাম।
কুরআনে কারীমের সংরক্ষণ কর্মে সাহাবায়ে কিরাম ছিলেন সর্বদা সচেতন, যত্নশীল ও তৎপর। কুরআনে কারীমের কোন শব্দ রাসূলে কারীম
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখ থেকে প্রকাশ পেয়ে তাদের কর্ণগোচর হওয়া মাত্রই তা আত্মস্থ করতে তাঁরা পিপাসায় পানি পান করার মত ব্যস্ত হয়ে যেতেন। কুরআনে কারীমের আয়াতের (শব্দের) যথাযথ সংরক্ষণের জন্য শব্দসমূহের উচ্চারণ এবং তার অর্থ অন্তরে অংকিত করে নেয়ার জন্য নিরলস সাধনা চালিয়ে যেতেন, যাতে করে কুরআনে কারীমের শব্দের বা তার অর্থের কোন বিকৃতি ঘটতে না পারে। তদুপরি কুরআনে কারীমের কোন আয়াত বা শব্দের অর্থ বা ব্যাখ্যা অনুধাবনে কিংবা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোন ভুল-ত্রুটি হয়ে গেলে (বা ধরা পড়লে) সাথে সাথেই শরীয়তদাতা (শারে’) কুরআনে কারীমের প্রথম বিশ্লেষক মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে তা সংশোধন করে নিতেন। কোন কোন ক্ষেত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে আয়াতের অর্থ বলে দিতেন ও আমল করে কুরআনী বিধানের বাস্তবরূপ দেখিয়ে দিতেন।
মোদ্দাকথা
উল্লেখিত আলোচনা দ্বারা দুটি বিষয়কে পরিস্কার করে বুঝাতে চেয়েছি। (১) কুরআনে কারীমের শব্দ ও অর্থ তদুপরি কুরআনে কারীমে বর্ণিত আমলের বাস্তব (প্রাকটিক্যাল) রূপ ও আকৃতি-প্রকৃতি আজ পর্যন্ত পৃথিবীর কাছে হুবহু সেভাবেই অবিকৃত রূপে বিদ্যমান রয়েছে, যেভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে বিদ্যমান ছিল এবং কিয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত এভাবে অবিকৃতরূপে সংরক্ষিত থাকবে।
(২) দ্বিতীয়তঃ হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগ থেকে শুরু করে সব যুগেই কুরআনে কারীমের বিশুদ্ধ জ্ঞানের অধিকারী এবং দ্বীনের হিফাযতকারী একটি পূতঃ-পবিত্র পূণ্যবান দল প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং আজও রয়েছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। এই বিশ্বাসের কোন বিকল্প নেই।
এই বিশ্বাসে কেউ যদি বিশ্বাসী হতে না চায় অথবা এই বিশ্বাস বিরোধী মন্তব্য করে তাহলে সে কুরআনের আয়াত অস্বীকারকারী হবে। কেননা, আল্লাহ তা’য়ালা ওয়াদা করেছেন, ‘নিশ্চয়ই আমি এই কুরআন নাযিল করেছি এবং সর্বদা, সর্বযুগে অবশ্য অবশ্যই আমি এই কুরআনকে হিফাযত করতে থাকবো। (সূরা হিজর, আয়াতঃ ৯)
তাই ইসলামের এই আক্বীদা “কুরআন মাজীদের আয়াত (বাক্য) ও তার বিশুদ্ধ অর্থ এবং কুরআনে বর্ণিত আমলের বাস্তব নমুনা সংরক্ষিত ও অবিকৃত” এর বিরোধিতা ইয়াহুদী, খৃস্টান অনেক দিন থেকেই করছে, কিন্তু সফলকাম হতে পারছে না।
মওদুদীবাদ
মওদুদী সাহেব তার লেখনীতে হিফাযতে দ্বীনের আল্লাহ প্রদত্ত গ্যারান্টি বাতিল করে দিতে আদাজল খেয়ে লেগেছিলেন। না; তিনিও সফল হননি। আল্লাহর কালাম ও ইসলামী কিতাবাদির ভাণ্ডার সম্পর্কে মন্তব্য করে তিনি লিখেছেনঃ
ক) ‘এটা সুস্পষ্ট যে, কুরআনের শিক্ষা অনুধাবন করার জন্যে পরিভাষা চতুষ্ঠয়ের (ইলাহ, রব, দ্বীন, ইবাদত) সঠিক ও পরিপূর্ণ তাৎপর্য অনুধাবন করা একান্ত অপরিহার্য। “ইলাহ” শব্দের অর্থ কি? “ইবাদতের” সংজ্ঞা কি, “দ্বীন” কাকে বলে? কোন ব্যক্তি যদি তা না জানে তবে তার কাছে সম্পূর্ণ কুরআনই অর্থহীন হয়ে পড়বে। (কুরআন কী চার বুনিয়াদী ইন্তেলাহে পৃঃ ৭. কুরআনের চারটি মৌলিক পরিভাষা ১১)
খ) “আরবে যখন কুরআন পেশ করা হয়, তখন প্রত্যেকেই জানতো ‘ইলাহ’ অর্থ কি, ‘রব’ কাকে বলা হয়-অনুরূপভাবে ‘ইবাদত’ ও ‘দ্বীন’ শব্দও তাদের ভাষায় প্রচলিত ছিল পূর্ব থেকে। কিন্তু কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার সময় এ শব্দগুলোর যে মৌল অর্থ প্রচলিত ছিলো পরবর্তী শতকে ধীরে ধীরে তা পরিবর্তিত হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত এক একটি শব্দ তার সম্পূর্ণ ব্যাপকতা হারিয়ে একান্ত সীমিত বরং অস্পষ্ট অর্থের জন্য নির্দিষ্ট হয়ে পড়ে”। (কুরআন কী চার বুনিয়াদী ইস্তেলাহে পৃঃ ৮. কুআনের চারটি মৌলিক পরিভাষা ১১)
“ফল দাঁড়ালো এই যে, কুরআনের মূল উদ্দেশ্য অনুধাবন করাই লোকের পক্ষে কষ্টসাধ্য হয়ে পড়লো।” তিনি আরো বলেনঃ “এটা সত্য যে, কেবল এ চারটি মৌলিক পরিভাষার তাৎপর্যে আবরণ পড়ে যাওয়ার কারণে কুরআনের তিন চতুর্থাংশের চেয়েও বেশী শিক্ষা বরং তার সত্যিকার স্প্রীটই দৃষ্টি থেকে প্রচ্ছন্ন হয়ে যায়।” (কুরআনের চারটি মৌলিক পরিভাষা, পৃঃ ১২-১৩, কুরআন কী চার বুনিয়াদী ইস্তিলাহেঁ, পৃঃ ৯-১০)
গ) পরবর্তী (প্রথম শতাব্দীর পরের) যুগের (আরবী) অভিধান ও তাফসীর গ্রন্থ সমূহে কুরআনের প্রায় শব্দের ব্যাখ্যা আসল আভিধানিক অর্থের স্থলে ঐসব অর্থ দ্বারা করা হয়েছে যা এ যুগের লোক বুঝে। (কুরআন কী চার বুনিয়াদী ইত্তিলাহে পৃঃ৯)
ঘ) কুরআন ও সুন্নাতে রাসূলের শিক্ষা অগ্রগণ্য কিন্তু তাফসীর ও হাদীসের পুরাতন ভাণ্ডারের মাধ্যমে নয়। (তানকীহাত, পৃঃ ১৭৫)
ঙ) ইসলামী আইনের শিক্ষা অপরিহার্য। কিন্তু এক্ষেত্রেও পুরানো কিতাব কোন কাজে আসবে না। (তানকীহতা পৃঃ ১৭৫)
চ) কুরআনের ব্যখ্যার জন্য কোন তাফসীরের প্রয়োজন নেই বরং উচু পর্যায়ের একজন অধ্যাপকই যথেষ্ট। (তানকীহতা পৃঃ ২৯১)
প্রচলিত ইসলামী ফিক্বাহসহ অন্যান্য দ্বীনী কিতাবসমূহের বিশুদ্ধতাকে প্রত্যাখ্যান করে মাওদুদী সাহেব বলেন,
ছ) “কিয়ামতের দিন এসব গোনাহগারদের সাথে তাদের ধর্মীয় নেতারাও গ্রেফতার হয়ে আল্লাহর আদালতে হাযির হবেন। তখন আল্লাহ তা’য়ালা তাদের জিজ্ঞাসা করবেন-‘আমি তোমাদেরকে কুরআন ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য করার হুকুম দিয়েছিলাম। এ দু’কে অতিক্রম করে নিজেদের পূর্ববর্তীদের অনুসরণ করা তোমাদের উপর কে ফরয করেছিল? আমি প্রতিটি সমস্যার সমাধান এ কুরআনে রেখে দিয়েছিলাম, এটাকে স্পর্শ করতে তোমাদের কে নিষেধ করেছে? মানুষের লেখা কিতাবগুলোকে নিজেদের জন্য যথেষ্ট মনে করার নির্দেশই বা তোমাদের কে দিয়েছে’? এ জিজ্ঞাসার জবাবে কোন আলেমেরই কানযুদ দাক্বাইকু, হেদায়া ও আলমগীরীর রচয়িতাদের কোলে আশ্রয় পাওয়ার আশা নেই। (হুকুকোযযাওজাইন পৃঃ ৯৫-৯৬, স্বামী-স্ত্রীর অধিকার পৃঃ ৮১)
জ) ‘অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, উলামারা (দু একজন ছাড়া) ইসলামের মূল স্ট্রীট থেকে বঞ্চিত, তাঁদের মধ্যে সংস্কার এবং আমলের শক্তি নেই। নেই সরাসরি কুরআন ও রাসূলের হিদায়াত থেকে ইসলামী মূলনীতি সংগ্রহের যোগ্যতা। তাদের মাথায় আস্সাফের (পূর্বসুরীদের) অনুসরণের রোগ ঢুকেছে’। (তানকীহাত পৃঃ ৪১)
গ) পরবর্তী (প্রথম শতাব্দীর পরের) যুগের (আরবী) অভিধান ও তাফসীর গ্রন্থ সমূহে কুরআনের প্রায় শব্দের ব্যাখ্যা আসল আভিধানিক অর্থের স্থলে ঐসব অর্থ দ্বারা করা হয়েছে যা এ যুগের লোক বুঝে। (কুরআন কী চার বুনিয়াদী ইত্তিলাহে পৃঃ৯)
ঘ) কুরআন ও সুন্নাতে রাসূলের শিক্ষা অগ্রগণ্য কিন্তু তাফসীর ও হাদীসের পুরাতন ভাণ্ডারের মাধ্যমে নয়। (তানকীহাত, পৃঃ ১৭৫)
ঙ) ইসলামী আইনের শিক্ষা অপরিহার্য। কিন্তু এক্ষেত্রেও পুরানো কিতাব কোন কাজে আসবে না। (তানকীহতা পৃঃ ১৭৫)
চ) কুরআনের ব্যখ্যার জন্য কোন তাফসীরের প্রয়োজন নেই বরং উচু পর্যায়ের একজন অধ্যাপকই যথেষ্ট। (তানকীহতা পৃঃ ২৯১)
প্রচলিত ইসলামী ফিক্বাহসহ অন্যান্য দ্বীনী কিতাবসমূহের বিশুদ্ধতাকে প্রত্যাখ্যান করে মাওদুদী সাহেব বলেন,
ছ) “কিয়ামতের দিন এসব গোনাহগারদের সাথে তাদের ধর্মীয় নেতারাও গ্রেফতার হয়ে আল্লাহর আদালতে হাযির হবেন। তখন আল্লাহ তা’য়ালা তাদের জিজ্ঞাসা করবেন-‘আমি তোমাদেরকে কুরআন ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য করার হুকুম দিয়েছিলাম। এ দু’কে অতিক্রম করে নিজেদের পূর্ববর্তীদের অনুসরণ করা তোমাদের উপর কে ফরয করেছিল? আমি প্রতিটি সমস্যার সমাধান এ কুরআনে রেখে দিয়েছিলাম, এটাকে স্পর্শ করতে তোমাদের কে নিষেধ করেছে? মানুষের লেখা কিতাবগুলোকে নিজেদের জন্য যথেষ্ট মনে করার নির্দেশই বা তোমাদের কে দিয়েছে’? এ জিজ্ঞাসার জবাবে কোন আলেমেরই কানযুদ দাক্বাইকু, হেদায়া ও আলমগীরীর রচয়িতাদের কোলে আশ্রয় পাওয়ার আশা নেই। (হুকুকোযযাওজাইন পৃঃ ৯৫-৯৬, স্বামী-স্ত্রীর অধিকার পৃঃ ৮১)
জ) ‘অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, উলামারা (দু একজন ছাড়া) ইসলামের মূল স্ট্রীট থেকে বঞ্চিত, তাঁদের মধ্যে সংস্কার এবং আমলের শক্তি নেই। নেই সরাসরি কুরআন ও রাসূলের হিদায়াত থেকে ইসলামী মূলনীতি সংগ্রহের যোগ্যতা। তাদের মাথায় আস্সাফের (পূর্বসুরীদের) অনুসরণের রোগ ঢুকেছে’। (তানকীহাত পৃঃ ৪১)
ঋ) বর্তমানে মুসলমানদের সবচাইতে বড় বরং আসল বিপদ এই যে, তাদের মধ্যে দ্বীন সম্পর্কে বুৎপত্তি এবং কুরআন ও সুন্নাহ সম্পর্কে কোন অনুধাবন নেই। এই অভাব ও শুন্যতাই তাদের গোটা ধর্মবিশ্বাসকে অন্তঃসার শূন্য ও তাদের ইবাদত-বন্দেগীকে প্রাণহীন করে দিয়েছে।
কারণ ইসলাম ও অনৈসলামের পার্থক্যের বিষয়টা প্রকৃত জ্ঞান ও বোধ শক্তির উপর নির্ভরশীল। আর এখানে রয়েছে তারই অভাব। আর পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত বিরাট মুসলিম সমাজে একটি নগণ্য দল ছাড়া এই অজ্ঞতার পরিচয় আমরা সর্বত্র দেখতে পাই। তাদের অশিক্ষিত জনগণ, সনদ প্রাপ্ত আলেম সমাজ, জুব্বাধারী পীর-মাশায়েখ এবং কলেজ ও ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষাপ্রাপ্ত লোকের ধ্যান-ধারণা ও রীতিনীতিতে প্রচুর ব্যবধান ও ভিন্নতা রয়েছে বটে কিন্তু ইসলামের তাৎপর্য ও তার প্রাণ বস্তু সম্পর্কে অনভিজ্ঞতার ব্যাপারে তারা সবাই সমান। (তাফহীমাত ১ম খণ্ড পূঃ ৪৪-৪৫; নির্বাচিত রচনাবলী ১ম খণ্ড, ১ম ভাগ পৃঃ ৪০-৪১)
ঞ) খোদ মুসলমানদের শতকরা ৯৯ ভাগেরও বেশী লোক নিজেকে ‘মুসলমান’ বলে পরিচয় দেয় এবং নিজের ধর্মমত প্রকাশ করতে ইসলাম শব্দটির আশ্রয় নেয়, কিন্তু মুসলিম হওয়ার মানে কি এবং ইসলাম শব্দের প্রকৃত অর্থ কি এটা তারা জানে না। (তানকীহাত ২২৪, ইসলাম ও পাশ্চাত্য সভ্যতার ১৭১)/
ট) আজকের মুসলমানদের মধ্যে যেমন ইসলামী স্বভাব, প্রকৃতি ও নৈতিক চরিত্রের বালাই নেই, তেমনি নেই ইসলামী চিন্তাধারা ও কর্মপ্রেরণা। মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকাহ কোথাও সত্যিকারের ইসলামী প্রাণ-চেতনা নেই। (ইসলাম ও পাশ্চাত্য সভ্যতার দ্বন্দ্ব পৃঃ ২৮; তানকীহাত পৃঃ ৪০)
ঠ) তাঁদের (উলামায়ে কেরামের) মধ্যে পূর্ব পুরুষদের অন্ধ ও অনড় তাক্বলীদের ব্যাধি পুরোপুরি সংক্রমিত হয়েছিল। এর ফলে প্রতিটি জিনিসই তারা এমন কিতাবাদিতে খোঁজ করতেন, যা কোন কালোত্তীর্ণ খোদায়ী কিতাব ছিল না। (ইসলাম ও পাশ্চাত্য সভ্যতার দ্বন্দ্ব, পৃঃ ২৯; তানকীহাত পৃঃ ৪১)
মওদুদী সাহেব আদালতের বিচারক ও উলামায়ে কেরামকে মুসলমানদের কোন সমস্যার সমাধানের যোগ্য মনে করতেন না। কোন বিশুদ্ধ ফতোয়া দেয়ার যোগ্যতাও তাদের আছে বলে স্বীকার করতেন না। তাই তিনি লিখেছেনঃ
৬) আদালতের বিচারকদের সম্পর্কে যতদূর বলা যায় তাদের অক্ষমতা তো সুস্পষ্ট। বাকী থাকলেন আলেম সমাজ। তাদের মধ্যে এক দলের অবস্থা এই যে, পুরাতন ফেক্কার গ্রন্থগুলোতে আনুষাঙ্গিক নির্দেশগুলো যেভাবে লিখিত আছে সেগুলোকে অবিকল পেশ করার চেয়ে অধিক যোগ্যতা তাদের নেই। আর কতিপয় আলেমকে যদিও আল্লাহ তা’য়ালা দৃষ্টির প্রশস্ততা এবং দ্বীনের গভীর জ্ঞান দান করেছেন কিন্তু এককভাবে তাদের কারো মধ্যে এতটুকু দুঃসাহস নেই যে, কোন মাআলার ক্ষেত্রে বুদ্ধি-বিবেক খাঁটিয়ে কোন পুরাতন আনুষাঙ্গিক নির্দেশ থেকে বিন্দু পরিমাণ বিচ্যুত হন। কেননা এক দিকে তাঁরা ভুলে নিমজ্জিত হওয়ার ভয়ে এ দুঃসাহসিক পথে পা বাড়ান না, অপরদিকে তাদের ভয় হচ্ছে অপরাপর আলেমগণ তাদেরকে মাযহাবের অন্ধ অনুকরণ থেকে বিচ্যুত হওয়ার অপবাদ দিবেন। (হুকুকুষ যাওজাইন পূঃ ৯২; স্বামী-স্ত্রীর অধিকার পৃঃ ৭৮)
ঢ) যতদিন আলেম সমাজ এই উৎস ও ভিত্তিমূল থেকে জ্ঞান আহরণ করেছিলেন এবং নির্ভুল চিন্তা শক্তি ও বিচার-বুদ্ধি দ্বারা ইজতিহাদ করে আদর্শিক ও বাস্তব সমস্যাবলীর সমাধান করেছিলেন, ততদিন ইসলাম যুগের গতির সাথে তাল মিলিয়ে চলছিল। কিন্তু যেদিন থেকে কুরআন সম্পর্কে চিন্তা গবেষণা পরিহার করা হল, হাদীসের সত্যানুসন্ধান ও বিচার-বিশ্লেষণ বন্ধ হয়ে গেল, নির্বিচারে পূর্ববর্তী তাফসীরকার ও মুহাদ্দিসগণের অন্ধ অনুকরণ শুরু হল, অতীতের ফিক্বাহ শাস্ত্রকার ও কালাম শাস্ত্রবিদদের ইজতিহাদকেই অটল ও চিরস্থায়ী বিধানে পরিণত করা হলো এবং কুরআন ও সুন্নাহর নীতিকে পরিত্যাগ করে বুযুর্গদের উদ্ভাবিত খুঁটিনাটিকেই মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হলো- সেদিন থেকেই ইসলামের অগ্রগতি রুদ্ধ হয়ে গেল। তার সম্মুখ গতির পরিবর্তে পশ্চাদপসারণ শুরু হল। (তানকীহাত পৃঃ ১৮৩; ইসলাম ও পাশ্চাত্য সভ্যতার দ্বন্দ্ব পৃঃ ১৩৫)
ণ) দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, আমাদের আলেম সমাজ আজ পর্যন্ত তাঁদের ভ্রান্তি উপলব্ধি করতে পারেননি। যে নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গির কারণে প্রথম দিকে আলেম সমাজ ব্যর্থতার গ্লানি বরণ করে নিয়েছিলেন, আজও প্রায় প্রতিটি মুসলিম দেশেই তাঁরা সেই একই দৃষ্টিভঙ্গির উপরই অবিচল রয়েছেন। (তানকীহাত পৃঃ ৪২; ইসলাম ও পাশ্চাত্য সভ্যতার দ্বন্দু পৃঃ ৩০)
ত) যারা নিজেদের আকল-বুদ্ধি ও জ্ঞান কাজে লাগায় না’ আসল নকল পরখ করে না বরং অন্যের অন্ধ তাক্বলীদ (অনুসরণ) করে বেড়ায় কুরআনে তাদেরকে অন্ধ, বোবা, বধির এবং নির্বোধ বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়; এদেরকে কুরআন জানোয়ারের সাথে তুলনা করে, বরং তাদের থেকেও নীচ প্রাণী এরা। কেননা জানোয়ারের তো (মানুষের মত) বিবেক-বুদ্ধি নেই কিন্তু উপরোক্ত মানুষেরা তো বিবেক-বুদ্ধি থাকা সত্ত্বেও তা কাজে লাগায় না। (তানকীহাত, পৃঃ ২৩৩)
খ) সত্য এই যে, কোন বিষয় সহী অথবা হক্ক হওয়ার জন্য এটা দলীল হতে পারে না যে বিষয়টি পূর্বের বুযুর্গ ব্যক্তিদের যুগ থেকে (ঐ নির্দিষ্ট পন্থায়) পালিত হয়ে আসছে। (তানকীহাত পৃঃ ২২৯)
দ) ‘তোমরা মধ্য যুগের ধর্মীয় উন্মাদদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে যে বিদ্বেষ লাভ করেছ এবং সেই অন্ধকার যুগের তামাম জিনিসের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করার পরও যাকে তোমরা আজ পর্যন্ত আঁকড়ে ধরে রয়েছো তাকে পরিহার কর এবং উদার মনে কুরআন ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহান শিক্ষা সম্পর্কে অবহিত হও, তাকে গ্রহণ কর’। (তান্কীহাত পৃঃ ৩৭; ইসলাম ও পাশ্চাত্য সভ্যতার দ্বন্দ্ব, পৃঃ ২৬)
(উল্লিখিত মন্তব্য গুলো জামায়াত শিবিরের সিলেবাস ভূক্ত বই পুস্তক থেকে নেয়া হয়েছে।)
সার সংক্ষেপ
১. প্রথম শতাব্দীর পর ইলাহ, রব, দ্বীন, ইবাদত সহ কুরআন মাজীদের প্রায় শব্দের অর্থে আবরণ পড়ে যায় এবং আসল অর্থ বিকৃত হয়ে যায়। তাই কুরআন শরীফের তিন চতুর্থাংশের চেয়েও বেশী শিক্ষা থেকে গত ১৩ শত বৎসরের মুসলমানগণ অবহিতি লাভ করতে পারেননি।
২. হাদীস, তাফসীর ও আরবী অভিধানে কুরআন শরীফের বেশীর ভাগ
শব্দের আসল অর্থের স্থলে ভুল অর্থ বর্ণিত রয়েছে।
৩. সাল্ল্ফ-সালেহীন ও বুযুর্গানে দ্বীনের রচিত হাদীস ও তাফসীরের কিতাবাদীর মাধ্যমে সঠিক দ্বীন পাওয়া যাবে না।
৪. হাদীস, তাফসীর ও চার মাযহাব ও আহলে হাদীসের যত ফেক্কার কিতাব বিদ্যমান আছে এগুলো গ্রহণযোগ্য নয়।
৫. ফেক্কার কিতাবাদীর অনুসরণ করলে জাহান্নামে পতিত হওয়ার আশংকা রয়েছে।
৬. উলামা, পীর, মাশায়েখ, শিক্ষিত সমাজ ও পাবলিকসহ সব মুসলমান ইসলাম না জানার ক্ষেত্রে সমান।
৭. সল্ফে সালেহীন ও বুযুর্গানে দ্বীনের অনুসরণ শিরক সমতুল্য।
৮. কুরআন মাজীদ পড়ে নিজেই তা বুঝার চেষ্টা করা উচিত। কোন তাফসীরের আশ্রয় নেয়া ঠিক নয়।
পর্যালোচনা
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! আমরা ইতিপূর্বে বর্ণনা করেছি যে, অত্যন্ত তাকীদ ও গুরুত্বের সাথে আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর সর্বশেষ নাযিলকৃত আসমানী কিতাব ‘কুরআন শরীফের’ সার্বিক সংরক্ষণের ওয়াদা করেছেন। এমনকি এও বলেছেন যে, কুরআনে কারীমের মাঝে কোন প্রকারের বাতিল বা বানাওয়াটি কিছু ঢুকতে পারবে না। এর বিপরীতে তাঁর নাযিলকৃত অন্যান্য আসমানী কিতাবের ব্যাপারে তিনি এরূপ কোন ঘোষণা বা গ্যারান্টি দেননি।
১। সুতরাং আমরা যদি মওদুদী সাহেবের ঐ থিউরী বিশ্বাস করি যে, “প্রথম শতাব্দীর পরে কুরআনে কারীমের অর্থ তিন চতুর্থাংশ বিকৃত হয়ে গিয়েছিল” তাহলে কুরআনে কারীমের আয়াতের উপর আমল ও তার অনুসরণ যেমন অসার হয়ে পড়বে, তেমনি আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত ওয়াদা খেলাপের অভিযোগও প্রকাশ পাবে। (নাউযুবিল্লাহ)
তদুপরি আল্লাহ তা’য়ালা ওয়াদা পালনে অক্ষম হয়েছেন এমন প্রশ্নও উত্থাপিত হবে, যা পরিস্কার কুফুরী।
২। কুরআনে কারীমের অন্যান্য কিতাবের উপর অন্যতম শ্রেষ্ঠত্ব এই যে, অন্যান্য আসমানী কিতাব বিকৃত বা রহিত হলেও কুরআনে কারীম চিরস্থায়ী, অবিকৃত এবং সার্বজনীন ও সর্বকালের জন্য প্রযোজ্য থাকবে। কিন্তু মওদুদী সাহেবের মতে কুরআনে কারীম প্রথম শতাব্দীর পর বিকৃত
হয়ে গিয়েছিল। মওদুদী সাহেবের এ দর্শনে বিশ্বাসী হলে সকল আসমানী কিতাবের উপরে কুরআনে কারীমের শ্রেষ্ঠত্ব রহিত হয়ে যায়।
৩। সচেতন মুসলমানদের জিজ্ঞাসা, তাফহীমুল কুরআনে মওদুদী গাহেব কুরআনে কারীমের শব্দগুলোর যে অর্থ ও ব্যাখ্যা করেছেন তা যে আসল ও বিশুদ্ধ অর্থ তার প্রমাণ কি? তের শত বৎসরের রচিত তাফসীর ও অভিধানের মধ্যে যে শব্দগুলোর অর্থ (তাঁর মতে) বিকৃত ছিলো হঠাৎ করে কোন গায়েবী খাজানা ও অদৃশ্য গুদাম থেকে আসল অর্থ বেরিয়ে এলো?
৪। বলা বাহুল্য, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুদৃঢ় ভাষায় বর্ণনা করেছেনঃ
لَا تَزَالُ طَائِفَةٌ مِّن امتى على الحق ظاهرين لا يَضُرُّهُم مَنْ خَالَفَهم حتى يَأْتِيَ امر الله (ابوداود، ترمذی)
‘আমার উম্মতের একটি দল সর্বদাই ক্বিয়ামত পর্যন্ত হজ্বের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে’। তাঁদের বিরুদ্ধাচারণকারী তাদের কোন ক্ষতি সাধন করতে পারবেনা (আবু দাউদ, তিরমিযী)। অপর হাদীসে তিনি আরও পরিষ্কার করে বর্ণনা করেছেনঃ
يَحْمِلُ هُذَا العلمَ مِن كُلِّ خَلَفٍ عدوله يَنْفُونَ عنه تحريف الغالين وانتحال المبطلين وتأويل الجاهلين
(رواه البيهقي في المدخل مشكوة) (٣٦)
‘প্রতি যুগে আগমনকারী আমার উম্মতের মধ্যে যারা ন্যায়পরায়ণ, বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য হবে তারা ইলমে ওহীর ধারক ও বাহক হবে’। (মিশকাত)
এই হাদীসদ্বয়ে বর্ণিত সুস্পষ্ট ভবিষ্যত বাণীতে প্রতি যুগে হক্কের উপর অটল, যে দলের কথা বলা হয়েছে, ঐ দলটিই খাটি বুযুর্গ ও ইসলাম বিশেষজ্ঞ দল। তাঁদের লিখিত কিতাবাদীতে যদি সঠিক দ্বীন ও শরীয়ত না
থাকে, তবে সঠিক দ্বীনী জ্ঞান আর কোথায় পাওয়া যাবে? সুতরাং মওদুদী সাহেব কি করে বলেন যে, বুযুর্গদের কাছে দ্বীন এর বিশুদ্ধ জ্ঞান নেই, তাই তাদের অনুসরণ করা যাবে না। বুযুর্গদের কাছ থেকে সহীহ দ্বীন শিখতে মওদুদী সাহেবের কেন এত অনীহা। তিনি সহীহ দ্বীন ওয়ালা হলে আমাদের তার কাছ থেকে দ্বীন শিখতে দ্বিধা ছিল না। কিন্তু তিনি তো বিশুদ্ধ দ্বীন ওয়ালা নিজেকে প্রমাণ করতে পারেননি।
৫। মওদুদী সাহেবের এই মন্তব্য যে, “দ্বিতীয় শতাব্দীর পর থেকে এ পর্যন্ত আরবী অভিধান ও তাফসীর গ্রন্থ সমূহে কুরআন মাজীদের প্রায় শব্দের ব্যাখ্যা আসল অর্থের দ্বারা হয়নি” সত্যিই উদ্ভট এবং মূর্খতায় ভরা। কেননা বিদগ্ধ আলেম বুযুর্গগণই যদি দ্বীনের বাহক না হবেন এবং তাঁদের রচিত কিতাবাদীতে যদি ইসলামী শিক্ষা না পাওয়া যাবে, তাহলে সংযম অশিক্ষিত, অর্ধ-শিক্ষিত অথবা সন্ত্রাসী ও রগ কর্তনকারীরাই কি বিশুদ্ধ দ্বীনের বাহক হয়ে যাবেন? আর তাদের বই-পুস্তকে সহীহ দ্বীনের জ্ঞান পাওয়া যাবে? তেতুল গাছ থেকে কি মিষ্টি আমের আশা করা যায়?
৬। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমার উম্মতের “একটি দল (সর্বদাই) কিয়ামত পর্যন্ত হকের (বিশুদ্ধ ইসলামের) উপরে প্রতিষ্ঠিত থাকবে”। হাদীসের এই বাক্য দ্বারা কিয়ামত পর্যন্ত আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াত তথা সহীহ দ্বীনের ধারক-বাহক একটি দলের প্রতিষ্ঠিত থাকা সুষ্পষ্টভাবে প্রমাণিত। কিন্তু মওদুদী সাহেবের মতে সাহাবায়ে কেরামের যুগের পর আর সহীহ কুরআন ও সহীহ দ্বীনের ধারক-বাহক অবশিষ্ট থাকেনি। এ বক্তব্যে মওদুদী সাহেব প্রত্যক্ষভাবে উল্লেখিত হাদীস অস্বীকার করেছেন। আর হাদীস অস্বীকার কারী আর যা-ই হোক জান্নাতী হতে পারে না।
৭। কুরআনে কারীমে আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেছেনঃ
الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَنْزَلَ عَلَى عَبْدِهِ الْكِتَابَ وَلَمْ يَجْعَلْ له عِوَجًا –
“সকল প্রশংসা ঐ আল্লাহর জন্য যিনি তাঁর বান্দা মুহাম্মাদ (স.)–এর প্রতি কিতাব নাযিল করেছেন এবং যাতে রাখেননি কোন প্রকার বক্রতা, অবোধগম্যতা”। (সূরা কাহাফ, আয়াতঃ ১)
অন্যত্র ইরশাদ করেছেনঃ
وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْآنَ لِلذِّكْرِ
“আমি কুরআনে কারীমকে নসীহত গ্রহণের জন্য খুব সহজ করে রেখেছি”। (সূরা কামার)
এ ধরনের বহু আয়াতের প্রেক্ষিতে দৃঢ়তার সাথেই বলা যায় যে, এই বক্রতাহীন জটিলতা মুক্ত কুরআনুল কারীম নসীহত ও উপদেশ (হিদায়াত) গ্রহণের জন্য অতি সহজ। কিন্তু মওদুদী সাহেবের মতে এই সর্বশ্রেষ্ঠ কিতাব থেকে এক শতাব্দী খুব সহজতার সাথে নসীহত গ্রহণ করা গেলেও পরবর্তী ১৩ শত বছর পর্যন্ত আর কারো জন্য এই কিতাব দ্বারা উপদেশ লাভ করা সহজ থাকেনি। তাহলে এই কুরআন বক্রতামুক্ত এবং উপদেশ গ্রহণের জন্য সহজ কি করে হলো? এ প্রশ্ন কি খোদ কুরআন নাযিলকারী আল্লাহ তা’য়ালার উপর আরোপিত হয় না? (নাউযুবিল্লাহ)।
৮। মওদুদীপন্থীদের মতে ফেক্কার পুরানো কিতাব যেমন মাবসুত হিদায়াহ, শরহে বেকায়া, শরহে নিক্বায়া, বাদাইউস্ সানায়ে, বাহরুর রায়েকু, ক্বাযী খান, শামী, আলমগীরী, শরহে মুহায্যাব, (লিন্নবাবী) শরহে মুগনী (লি ইবনে কুদামা) ইত্যাদি কিতাব নির্ভরযোগ্য নয় এবং কুরআনী ব্যাখ্যা হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয় বলে এসব থেকে ইসলামী শিক্ষা গ্রহণ করাও উচিত নয়।
এখন প্রশ্ন হলো পূর্বের ইসলাম বিশেষজ্ঞ মহামনীষীগণের পরিপূর্ণ দ্বীনের ব্যাখ্যা সম্বলিত ঐসব কিতাবের বাইরে আরো কোন গ্রহণযোগ্য কিতাব আছে কি? যে উপরোক্ত কিতাব পরিত্যাগ করে যার অনুসরণ আমরা নির্দ্বিধায় করতে পারি? নাকি কেবলমাত্র মওদুদী সাহেবের রচিত বই-পুস্তকই সহীহ ইসলাম বুঝানোর একচেটিয়া ঠিকাদারী পেয়েছে? কিংবা তার কি তেমন পূর্ণাঙ্গ কোন রচনাবলী আছে?
৯। উপরোল্লেখিত কিতাবাদী যদি গ্রহণযোগ্য না হয় তবে জামায়াত শিবিরের পিতা-মাতাসহ অন্যান্য পূর্ব-পুরুষদের অবস্থা কবরে, আখেরাতে কী হবে? যারা মওদুদী সাহেবের প্রলয়ংকর যোগ্যতার বিবরণ ও তাঁর রচনাবলী মার্কেটে আসার পূর্বে মারা গিয়েছেন এবং যাঁরা মওদুদীর ব্যাখ্যা অনুযায়ী জীবন যাপন করতে পারেননি? বরং চার মাযহাবের মধ্য থেকে কোন এক মাযহাবের তথা মধ্যযুগের উলামাদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী আমল করে তারা মৃত্যুবরণ করেছেন? তারা কি মওদুদী সাহেবের মতে মধ্যযুগের ধর্মীয় উন্মাদদের অনুসরণের কারণে জাহান্নামে পতিত হবেন?
১০। মওদুদী সাহেব ও তার একক অনুসারী দল, যারা পূর্ব যুগের কিতাবের ধার ধারেন না, ঐসব কিতাব থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে সঠিক ইসলাম বুঝা যায় বা ঐ কিতাব সমূহের ব্যখ্যা অনুযায়ী আমল করে আখেরাতে নাজাত পাওয়া যাবে বলে বিশ্বাস করেন না, তাদেরকে সংগত কারণেই প্রশ্ন করা যায় যে, তাদের পিতা-মাতার বিবাহ কি বিশুদ্ধ শরীয়ত মতে হয়েছে? কেননা তাদের পিতা-মাতার বিবাহ তো হয়েছে হিদায়া, আলমগীরী, কানযুদ্দাকাইকু, শামী ইত্যাদি পুরনো ফিকার কিতাবের বিবরণ অনুযায়ী!
এখন পিতা-মাতার বিবাহই যদি বিশুদ্ধ শরীয়ত মতে (হালাল) না হয়ে থাকে তাহলে মওদুদী সহেব ও তার শিষ্যগণের জন্মের অবস্থা কি হবে? যাদের নিজস্ব থিউরী মতেই তাদের জন্ম হালাল হারামের দ্বিধা-দ্বন্দুে দোদুল্যমান তাদেরকে সমাজের কোন স্তরে স্থান দেয়া হবে?
১১। পাঠকবৃন্দ। যে ব্যক্তি দাবী করে যে, আমি ইসলাম মানি না, আর যে ব্যক্তি বলে যে, আমি ইসলাম মানি কিন্তু হাদীস, তাফসীর এবং ফিক্বার কিতাবসমূহে যা কিছু লেখা রয়েছে তা মানিনা, এই দুইজনের মধ্যে কোন পার্থক্য আছে কি? যেমন নাস্তিক, খৃস্টানরা বলে আমরা ইসলাম মানিনা, আর জামায়াত শিবির বলে ইসলাম মানি, তবে হাদীস, তাফসীর ও ফিকার পুরনো কিতাবাদীর আলোকে নয়। এরা উভয়ই ইসলামী জ্ঞান ভাণ্ডার অস্বীকার করার ব্যাপারে সমান নয় কি?
১২। সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বশেষ নবী সাইয়্যেদুল মুরসালিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে ইসলাম পূর্ণাঙ্গতায় পৌঁছেছে। তাঁর পরে আর কোন নবী আসবেন না। কেননা এই দ্বীনে এখন আর কোন অসম্পূর্ণতা বা অস্পষ্টতা নেই, তাই অন্য কোন নবীর আগমনের অবকাশ নেই। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবী হিসেবে, রাসূল হিসেবে বৈশিষ্ট্য এখানেই।
কিয়ামত পর্যন্ত এ পৃথিবীতে যত মানুষ আগমন করবে, তাদের যত জিজ্ঞাসা বা নতুন কৌতুহল জাগ্রত হবে মানসপটে দ্বীন সম্পর্কে, বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসবের দূরদর্শী দিক-নির্দেশনা, সুষ্ঠু সমাধান প্রদান করে গিয়েছেন। এবং বিশিষ্ট উলামায়ে কেরাম চলমান আধুনিক যুগ জিজ্ঞাসার যৌক্তিক জবাব ও সমাধান কুরআন-হাদীসের আলোকে গ্রন্থিত আকারে পেশ করেছেন। আর একেবারেই অভিনব দু একটি জিজ্ঞাসার জবাব যা সেখানে আপাততঃ বর্তমান নেই তারও সমাধানকল্পে এমন মূলনীতি নির্ধারণ করে দিয়েছেন যা দ্বারা খুব সহজেই ঐ নতুন জিজ্ঞাসার জবাব মিলে যাবে। কিন্তু যারা ঐসব মূলনীতি সম্বলিত কিতাবাদী কিংবা ইসলাম বিশেষজ্ঞদের আধুনিক যুগ জিজ্ঞাসার জবাব সমৃদ্ধ কিতাবসমূহের পৃষ্ঠা ছুঁয়েও দেখেননি, (কারণ এসব কিতাবাদী পড়ার বা বুঝার তাঁদের কোন যোগ্যতা নেই, যেমন জামায়াত শিবিরের সদস্যরা) তাদের ইসলামী জ্ঞান ভাণ্ডার সম্পর্কে কথা বলার কোন অধিকার নেই?
১৩। এইসব গুটি কতক ব্যক্তি যারা কিছু বাংলা বই পড়ে ইসলামী চিন্তাবিদ সেজেছেন, অথবা যারা হাদীস, তাফসীর ও ফিক্বাহ শাস্ত্রে জ্ঞান না থাকা সত্বেও জোর গলায় এ মর্মে শ্লোগান আওড়ান যে, পৃথিবী আজ অনেক দূর এগিয়ে গেছে, এই কম্পিউটারের যুগে পিছনে ফিরে তাকানোর কোনই অবকাশ নেই, এখন চাই সব নতুন জ্ঞান-বিজ্ঞান, নতুন তাফসীরের কিতাব, লেটেষ্ট হাদীস বিশ্লেষণের আধুনিক কিতাব, পুরনো কোন কুরআনী জ্ঞান ভান্ডার আর এখন চলার মত নয়। এদের সম্পর্কে বলা যাবে এসব কোন ভালো মস্তিষ্কের লোকের কথা হতে পারে না। কেননা এই দ্বীন এক অত্যাধুনিক দ্বীন। হাজার বৎসর পূর্বে এই দ্বীনের উপর টিকে থাকার জন্য যে পরিশ্রম দিতে হয়েছে এখন তার এক দশমাংশেরও প্রয়োজন পড়ে না। ইসলামী শিক্ষা অর্জন, নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত আদায় করা পূর্বের চেয়ে অনেক সহজ হয়ে গেছে। ইসলামে এমন কোন আইন নেই যা এখন প্রযোজ্য নয়। সুতরাং ইসলামী কিতাবাদী পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই। হ্যাঁ মাওদুদী ও তাঁর অনুসারীদের মস্তিষ্কের পরিবর্তন প্রয়োজন। যাতে করে তাদের মস্তিষ্কে অবিকৃত ইসলামের উপর চলার মানসিকতা সৃষ্টি হয়।
১৪। মওদুদী সাহেব এবং চিহ্নিত ঐ সব কলামিষ্ট বুদ্ধিজীবী ভদ্র মহোদয়গণের উল্লেখিত শ্লোগান বা বুলি খুবই চমকপ্রদ! তাদের এই
চমকপ্রদ অথচ অবুঝ মাতামাতির প্রবণতা নিম্নে বর্ণিত হাসির ঘটনাটির সাথে তুলনাযোগ্য।
বলা বাহুল্য, একদা সরকারী মাদ্রাসা বোর্ডের সিলেবাস কমিটির মিটিং চলছিল। কোন কোন বই ও কিতাব সিলেবাসের আওতায় রাখা হবে আর কোন বই কিতাব রাখা হবে না, এসব বিষয়ে আলোচনা হচ্ছিল। “ফুসূলে আকবরী” নামক একটি কিতাব সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব যখন উঠলো তখন এক সদস্য দাড়িয়ে গিয়ে প্রচণ্ড জোরের সাথে প্রতিবাদ জানিয়ে বললেনঃ না, না, ‘ফুসূলে আকবরী’ কিতাব সিলেবাসে রাখা যাবে না। কেননা আকবর একজন বেদ্বীন এবং নষ্ট চরিত্রের লোক, তার প্রদত্ত ফায়সালা সম্বলিত কোন কিতাব পড়ানোর দরকার নেই। তবে বাদশাহ আলমগীরের কোন ফায়সালার কিতাব ‘ফুসূলে আলমগীরী’ সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
উল্লেখ্য যে, মূলতঃ “ফুসূলে আকবরী” বাদশাহ আকবরের ফায়সালার কোন কিতাব নয় বরং এটি আরবী শব্দ প্রকরণ শাস্ত্রের কিতাব। কিন্তু কিতাবের নামে আকবরী শব্দার্থ দেখে এ কিতাবটিকে উল্লেখিত অজ্ঞ ব্যক্তি বাদশাহ আকবরের ফায়সালা সম্বলিত কিতাব মনে করে বসেছেন।
উপরোল্লিখিত বোর্ডের সদস্যের মত মওদুদী সাহেব ও তার অনুসারীগণ হাদীস, তাফসীর ও ফিক্বাহ ইত্যাদি ইসলামী কিতাবাদীর রিডিং পড়ারও যোগ্যতা রাখেন না, অর্থ বুঝাতো দূরের কথা, তারা কি করে বলতে পারেন যে, এই যুগে পূর্বেকার কিতাব চলতে পারে না?
১৫। পাঠকবৃন্দ! লক্ষ্য করুন এবং চিন্তা করুন বর্তমানে আমাদের সামনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাযির নেই, নেই কোন সাহাবী। ঠিক তেমনি যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রত্যক্ষ শাগরিদগণের কাছ থেকে কুরআনে কারীমের তাফসীর শিখেছেন অথবা তাঁদের তাফসীর পড়ে যারা বুৎপত্তি অর্জন করেছেন তারাও আমাদের সামনে জীবিত নেই। এমন কি যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস যাচাই বাছাই করে হাজার হাজার হাদীস সংকলন করেছেন এবং যারা আরবী ভাষাজ্ঞানে সুপণ্ডিত এবং দ্বীনদার ছিলেন আরবী অভিধানের নির্ভরযোগ্য সংকলন করে গেছেন তারাও আমাদের সামনে নেই। কিন্তু তাদের অবর্তমানে তাদের কৃত দ্বীনী কিতাবাদী অদৃশ্য হয়ে যায়নি, তাদেরকে জীবদ্দশায় না পাওয়ার কারণে আমাদেরকে এখন তাদের কৃত কিতাবের শরণাপন্ন হয়ে দ্বীনী শিক্ষা অর্জন করতে হবে। কেননা তারা ছিলেন দ্বীনী জ্ঞান বিশেষজ্ঞ পূর্বসুরী।
তাই ঐ সকল মহামনীষীদের কৃত কিতাব যেমন হাদীস শাস্ত্রে বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ, মুয়াত্তা মালেক, মুয়াত্তা মুহাম্মদ, কিতাবুল আছার, মুসনাদে আহমাদ, তাহাবী, সহীহ ইবনে খুযাইমা, বায়হাকী, মুসতাদরাকে হাকীম, মুহান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, মুসনাদে ইমাম শাফেয়ী, মুছান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহ প্রভৃতি। ঠিক তদ্রূপ তাফসীরুল কুরআনের ক্ষেত্রে তাফসীরে ইবনে জারীর তাবারী, তাফসীরে কুরতুবী, তাফসীরে খাযেন, মাদারিকুত তানযীল, তাফসীরে কাবীর, তাফসীরে রুহুল মা’আনী, ইবনে কাসীর, তাফসীরে মাযহারী প্রভৃতি এবং আরবী অভিধানের প্রসিদ্ধ কিতাবসমূহের মধ্যে ইবনে আছীরের “নেহায়া” ইবনে মানজুর আফরীকীর “লিছানুল আরব”, আল্লামা মাজদুদ্দীন ফিরোজাবাদীর, “আল-কামুহু”, যুবাইদীকৃত “তাজুলউরুছ”, রাগিব ইস্পাহানীকৃত “আল-মুফরাদাত” ইত্যাদি। উল্লেখিত হাদীস, তাফসীর ও অভিধানের কিতাব সমূহ যদি (মওদুদী সাহেবের মতে) নির্ভরযোগ্য না হয় এবং ঐ সমস্ত দ্বীনী কিতাবের মাঝে যদি কুরআনে কারীমের তিন চতুর্থাংশ শব্দের অর্থ (তাঁর মতে) পরিবর্তিত ও বিকৃত এবং অশুদ্ধভাবে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে, তাহলে আপনারাই বলুন এখন কুরআন-হাদীসের জ্ঞান অর্জনের জন্য ঐ সকল সহীহ কিতাবাদী অধ্যয়ন ছাড়া আর কোন পদ্ধতি বিদ্যমান আছে কী? না সেটা কেবল স্বঘোষিত ইসলাম বিশেষজ্ঞ জামায়াতে ইসলামীর ফাউন্ডার মওদূদী সাহেবের রচিত বই পুস্তকই? (যা জামায়াত, শিবিরের সিলেবাস ভুক্ত।) -বাহ কেমন শ্রীপুরের বড়ী। টাকায় ১০টা, সাথে সাথে সব রোগের শেফা।
১৬। ইসলামী জ্ঞান ভাণ্ডারকে অস্বীকার করে প্রাচ্যবিদদের মন-মানসিকতা ও প্লান প্রোগ্রামে মাওদুদী সাহেবের যে ইসলামী আন্দোলন বিদ্যমান আছে তাতে হিদায়েত এর আলো ও শান্তি আসবে, নাকি তাগুতের অন্ধকার ও অশান্তির আগুন ছড়াবে?
১৭। মেডিকেল কলেজের কোন ছাত্র চাই সে যতই মেধাবী হোক না কেন, আপন মেধা, বিবেক-বুদ্ধি খাঁটিয়ে একাকী যতই চিন্তা-ভাবনা করুক না কেন ডাক্তার সে হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে পারদর্শী ডাক্তারদের অনুসরণ না করবে। অনুরূপভাবে ইঞ্জিনিয়ার, পাইলট, ড্রাইভার, কবি, সাহিত্যিক, কলামিষ্ট কেউ-ই কেবল আপন মেধা এবং চিন্তা-ভাবনার দ্বারা ইঞ্জিনিয়ার, পাইলট, ড্রাইভার ইত্যাদি হতে পারে না। বরং প্রত্যেক বিভাগের ছাত্রকেই ঐ বিভাগের বা ঐ শাস্ত্রের পূর্ব যুগের অভিজ্ঞ শাস্ত্রবিদদের রচিত পুস্তকাদি অধ্যয়ন করে তাদের বাঙ্গানো থিউরী অনুসরণ করতে হয়। শুধু এরূপ অধ্যয়নই নয় বরং পূর্ব যুগের শাস্ত্রবিদদের থিউরী আত্মস্থ করার পর ঐ বিষয়ের বর্তমান অভিজ্ঞজনের শরণাপন্ন হয়ে তাদের প্রত্যক্ষ সংস্বর্গ লাভ করলেই কেবল নির্দিষ্ট শাস্ত্রে একজন শিক্ষার্থী, অভিজ্ঞতা ও বিচক্ষণতা অর্জন করতে পারে।
উল্লেখিত বিষয়টির উদাহরণ হিসেবে খোদ মওদুদী সাহেবকেই তুলে ধরা যেতে পারে। যেমনঃ মওদুদী সাহেব মায়ের পেট থেকে জন্ম নিয়েই লেখক, কলামিষ্ট হয়ে যাননি। বরং নির্ধারিত বয়সে পৌঁছে বিভিন্ন উস্তাদদের খেদমতে কয়েক বৎসর অতিবাহিত করে ম্যাট্রিক সমমানের ক্লাস পর্যন্ত পড়ার পর বিশিষ্ট দুই উর্দু সাহিত্যিক নিয়াজ ফতেহপুরী ও জুশ মালীহাবাদীর সংসর্গ লাভ করে লেখক হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন।
অভিজ্ঞ প্রশিক্ষক তথা শাস্ত্রবিদ ছাড়া যেমন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পাইলট, ড্রাইভার, কবি, সাহিত্যিক, কলামিষ্ট কেউ হতে পারে না, ঠিক তেমনি পূর্ব মহামনীষীদের অনুসরণ ও তাদের রচিত দিক নির্দেশনা মূলক কিতাবাদী অধ্যয়ন ও প্রশিক্ষণ ছাড়া কেউই আলেম, ফক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির, মুফতী, ইসলামী চিন্তাবিদ হতে পারে না। এমনকি মওদুদী সাহেবের রচিত পুস্তকাদী ও তাঁর ব্যাখ্যা ও মতবাদের অন্ধ তাকলীদ বা অনুসরণ না করে কেউ জামায়াতে ইসলামীর অথবা শিবিরের রুকন ও সদস্য হতে পারে না। এই বাস্তবতা কি জামায়াতীরা অস্বীকার করতে পারবেন? সুতরাং বিজ্ঞ উলামায়ে কেরাম যারা তাবেয়ীনগণের মাধ্যমে, সাহাবায়ে কেরাম থেকে কুরআন ও সুন্নাতে রাসূলের সঠিক শিক্ষা লাভ করেছেন তাঁদের রচিত কিতাবাদী ছাড়া কুরআন সুন্নাহর শিক্ষা অর্জন করা কখনও সম্ভব হতে পারে না। কিন্তু মাওদুদী সাহেব বলেছেন, “কুরআন ও সুন্নাতে রাসূলের শিক্ষা অগ্রগণ্য কিন্তু তাফসীর ও হাদেিসর পূরাতন ভান্ডারের মাধ্যমে নয়।” (তানক্বীহাত)
১৮। আমরা বর্তমানে এমন এক সময় অতিক্রম করছি যখন চতুর্দিকে ফিতনার সয়লাব আর নৈতিকতার অবক্ষয়। নতুন নতুন বিভ্রান্তি এবং আধুনিকতার জয়কীর্তন করতে গিয়ে বিকৃতি-ই যেন এ যুগের চিন্তাবিদদের ধ্যানে, অস্থি-মজ্জায় চেপে বসেছে। আসল এবং অকৃত্রিমকে ধরে রাখার প্রোগ্রাম যেন ক্রমশঃ গৌণ হয়ে যাচ্ছে। এহেন মুহূর্তে অকৃত্রিম ইসলামকে মানুষের সামনে তুলে ধরার জন্য, হিদায়াত ও সংশোধনের প্রসারের জন্য দ্রুত প্রভাবশীল পদ্ধতি হলো পূর্ব যুগের বুযুর্গ ওলী-আল্লাহগণের তথা আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের উলামায়ে কেরামের দ্বীনী রচনাবলী ও তাঁদের শিক্ষামূলক জীবনী সর্বসাধারণের সামনে তুলে ধরা, তাদের ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদা বর্ণনা করা। এ সব প্রোগ্রামের মাধ্যমে সাধারণ মুসলমানের মনে ঐ সকল ওলী-আল্লাহ ও বুযুর্গানে দ্বীনের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা সৃষ্টি হবে। এর দ্বারা মানুষ ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হবে, ইবাদত ও আমলের দিকে মনোযোগী হবে।
কিন্তু এর বিপরীত কর্ম (যা মওদুদী ফর্মূলা) অর্থাৎ ওলী আল্লাহদেরকে মধ্যযুগের উন্মাদ আখ্যা দিয়ে তাদের কৃত হাদীস, তাফসীর ও ফেকার কিতাবাদীকে ভুল, অচল, অগ্রহণযোগ্য ইত্যাদি অপপ্রচার করে ইসলামের কী লাভ হবে? হ্যাঁ লাভ এতটুকু হতে পারে যে, কিছু সংখ্যক লোক ওলী আল্লাহদের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে বিশুদ্ধ দ্বীন ছেড়ে দিয়ে মুনাফিক হয়ে মাওদূদীর কার্টুন ইসলামের দিকে ধাবিত হবে। এর দ্বারাই কি মওদুদী অনুসারী জামায়াত শিবিরের সব স্বার্থ হাসিল হয়ে যাবে?
১৯। এইসব বুযুর্গানে দ্বীন তথা ইসলামী বিশেষজ্ঞজনের নিন্দা করে অথবা যারা ১৩ শত বৎসর পর্যন্ত ইসলামের প্রচার এবং ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন তাদেরকে অবজ্ঞা করে কিংবা গোমরাহ আখ্যা দিয়ে কী ধরনের ইসলামী হুকুমত কায়েম করা হবে? কোন স্বার্থে, কী প্রয়োজনে মাওদুদী সাহেবের এই অপপ্রচার?
তাঁর এরূপ জঘন্য বক্তব্য তো ঐ সব বে-দ্বীনদের ভাষ্যেরই প্রতিধ্বনি। যাদের সম্পর্কে আল্লাহ তা’য়ালা ঘোষণা করেছেন।-
سَيَعْلَمُ الَّذِينَ ظَلَمُوا أَيَّ مُنْقَلِبٍ يَنْقَلِبُونَ
“খুব শীঘ্রই জেনে নিবে জালেমরা (তাদের অবস্থার কথা) যে তারা কোন ঘুর্ণায়মানতায় ঘুরপাক খাচ্ছে।”
২০। মহান আল্লাহ তা’য়ালা কুরআনে কারীমের হিফাযতের ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠভাবে পরিচালনার জন্য প্রতি যুগে আস্থাভাজন ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিবর্গ উলামায়ে কেরামকে নির্বাচন করে আসছেন। তারা কুরআনে কারীমের শব্দ, অর্থ, এমনকি আমলের বাস্তবরূপও সঠিকভাবে সংরক্ষণ করে চলেছেন। তদুপরি কুরআনে কারীমের বহু আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা “مبين” )প্রকাশ্য( يَسْرُنَا )সহজবোধ্য( وَاصْحَات )পরিস্কার) এ ধরনের বিশেষণের দ্বারা কুরআন শরীফের পরিচিতি বর্ণনা করেছেন। সেখানে কুরআনে কারীমকে অথবা তার কিছু অংশকে ‘অবোধগম্য’ হয়ে পড়েছে কিংবা ‘পর্দাবৃত’ হয়ে গেছে অথবা ‘অর্থহীন’ হয়ে পড়েছে। এরূপ বলার দ্বারা খোদ কুরআনে কারীমেরই বিরোধিতা এবং কুরআনকে অস্বীকার করা হয়েছে। কুরআনকে এভাবে অমান্য ও অস্বীকার করে মওদুদী সাহেব ও তার খাছ শীষ্যগণ কোন্ ইসলাম কায়েম করতে চান?
২১। আসলে মওদুদী সাহেব তাঁর ভ্রান্ত মতবাদকে প্রমাণিত করার জন্য
এক ব্যতিক্রমধর্মী তাফসীরের প্রয়োজন মনে করেছিলেন। তাই পূর্বেকার তাফসীরগুলোকে ভুল আখ্যা দিয়ে এক বিশেষ তাফসীরের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। পরে বাইবেল ও অরিয়েন্টালিস্টদের বস্তাপচা মন্তব্য ধার করে এনে চটকদার ও আকর্ষণীয় উর্দু শব্দ লাগিয়ে তাফসীর বানিয়ে ফেলেন। এ হলো তার যোগ্যতার আয়তন।
২২। কোন ব্যক্তির আক্বীদা বিশ্বাসে যদি কেবলমাত্র এতটুকুই বিভ্রান্তি থাকে যে, সে বিশ্বাস করে “কুরআন শরীফের ব্যাখ্যা ও অর্থ সাহাবায়ে কেরামের যুগ পর্যন্ত সহীহ ছিল তারপর থেকে আজ পর্যন্ত কুরআনে কারীমের তিন চতুর্থাংশ বিকৃত, অর্থহীন ও পরিবর্তিত অবস্থায় বিদ্যমান (সঠিক ও আসল অবস্থায় নেই।) তাই উম্মত কুরআনে কারীমের মূল আবেদন সম্পর্কে সেই যুগ থেকে আজ পর্যন্ত অজ্ঞ এবং বেখবর, তাহলে এই ধরনের আকীদা পোষণকারী ব্যক্তির গোমরাহ হওয়ার জন্য এবং অন্যকে গোমরাহ করার জন্য আর জাহান্নামে পতিত হওয়ার জন্য এতটুকু অপরাধই যথেষ্ট।
২৩। বড়ই পরিতাপের বিষয় যে, বেশ কিছু সংখ্যক লোক ইসলামী জ্ঞান না থাকায় মওদুদী সাহেবের দর্শনে প্রভাবিত হয়ে এরূপ বিশ্বাস রাখেন যে, মওদুদী সাহেব যেরূপ গভীরভাবে কুরআন অধ্যয়ন করেছেন এবং আধুনিক যুগ জিজ্ঞাসার আলোকে যথাযথ ভাবে তা উপস্থাপন করেছেন তেমনটি আজ পর্যন্ত অন্য কেউ করতে পারেননি। বলুন, এরূপ বিশ্বাস ও গোঁড়ামী আর অন্ধভক্তি কোন মুসলমানের জন্য কি বাঞ্ছনীয়? এসব ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা ও মূর্খতার প্রতিফল ছাড়া আর কি হতে পারে।
চা বাগানের কুলি স্থানীয় প্রাইমারী স্কুলের মাস্টারের বক্তৃতা শুনে বললো বাহ্ এত বড় শিক্ষিত আর কেউ নেই। জামা শিবিরে মওদূদী সাহেব সম্পর্কে মন্তব্য তদ্রুপ।
মওদুদী সাহেবের আক্বীদা পোষণকারী লোক পরিষ্কার বে-দ্বীন এর চেয়েও অধিক ভয়ংকর। কেননা পরিস্কার নাস্তিকতা বা কুফুরীর দিকে আহবান করা হলে কোন মুসলমানই তা গ্রহণ করবে না। যারা গ্রহণ করবে তারা তা বুঝে শুনেই করবে। পক্ষান্তরে (মওদুদী মতবাদ কায়েম করার উদ্দেশ্যে) যদি ইসলামী হুকুমতের দিকে কাউকে আহ্বান করা হয় তখন নিরীহ সরলপ্রাণ মুসলমানগণ ইসলামের প্রতি ভালবাসার কারণে ঐ আহবানের দিকে ঝুকে পড়বে নিমিষেই। তখন তাঁরা হেদায়েতের স্থলে গোমরাহীতে পতিত হবে। তাই ইসলামী আন্দোলনের মাধ্যমে হিদায়েতের শরবত পান করছেন না তাগুতের ফেন্সিডিল? যাচাই করে নেন জামাআত শিবিরের ভাইয়েরা।
২৪। ইতিপূর্বের বিশদ আলোচনায় আমরা পরিস্কার এবং প্রত্যক্ষ দলীলের মাধ্যমে প্রমাণ করেছি যে, মওদুদী সাহেবের আবিষ্কৃত মতবাদে কুরআনের বিরোধিতা রয়েছে, রয়েছে কুরআন অমান্য করার প্রবণতা। সে কারণেই ইসলামী হুকুমত কায়েম করার শ্লোগানসর্বস্ব আহবানে সাড়া দিয়ে মওদুদী প্রবর্তিত এই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তি বিভ্রান্ত হবে, হবে পথভ্রষ্ট। কুফুরীতে লিপ্ত হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। কেননা ঐ ব্যক্তি তখন মওদুদী দর্শন অনুযায়ী বিশ্বাস করবে যে সাহাবায়ে কেরামের যুগের পর কুরআনে কারীম বিকৃত হয়ে গেছে, অর্থহীন হয়ে পড়েছে। কুরআনে কারীমের মূল প্রাণের তিরোধান ঘটেছে। তদুপরি পূর্ব যুগের বুযুর্গানে দ্বীন, ওলী-আল্লাহগণ ভুল এবং বিকৃত ইসলাম প্রচার করেছেন। কেবলমাত্র মওদুদী সাহেবই এককভাবে সহীহ-শুদ্ধ ভাবে কুরআন বুঝেছেন। এ ধরনের আক্বীদা তাদেরকে সহীহ ইসলাম থেকে বিচ্যুত করে ছাড়বে। তাই ইসলামের মুখোশধারী এ ধরনের বে-দ্বীনী আন্দোলন থেকে বেঁচে থাকা প্রত্যেকের জন্যে অপরিহার্য।
২৫। মহান আল্লাহ তা’য়ালা কেয়ামত পর্যন্তের জন্য কুরআনে কারীমের সংরক্ষণের দায়িত্ব নিজে গ্রহণ করেছেন। কুরআনে কারীমকে শাব্দিক ও আর্থিকভাবে হিফাযত করবেন তাও পরিস্কার করে বলেছেন। এখন এরূপ হিফাযতের দায়িত্ব নেওয়া স্বত্বেও (মওদুদীপন্থীদের আক্বীদা অনুযায়ী) সেই কুরআন যদি সাহাবায়ে কেরামের যুগের পর সংরক্ষিত না থেকে থাকে তাহলে আল্লাহ্র প্রতি অক্ষমতা ও ব্যর্থতার অভিযোগ আরোপিত হয় না?
যা প্রকাশ্য কুফর
وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَى عَلَى اللهِ كَذِبًا |
২৬। যদি মওদুদী সাহেবের উপরোক্ত উদ্ভট দাবী-ই সত্য বলে ধরে নেয়া হয়, তাহলে তো আমাদেরকে বলতে হবে যে, দ্বীন, ইলাহ, রব ইবাদত ইত্যাদি পরিভাষার আসল অর্থ সেই ১৩ শত বছর কালের মুসলমানরা না জানার কারণে তারা কুরআন শরীফে বর্ণিত হালাল, হারাম, বৈধ-অবৈধ, ফরয, ওয়াজিব এবং ইবাদতের বর্ণনা ইত্যাদি সম্পর্কে আদৌ জানতে পারেননি। এবং তারা দ্বীনদারী, বে-দ্বীনী, ভাল-মন্দ, করণীয়-বর্জনীয় ইত্যাদির কোন মাপকাঠি বা দিক-নির্দেশনা লাভ করতে সক্ষম হননি। সুতরাং তারা জান্নাতী হবে না জাহান্নামী? তাদের তো জান্নাতে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না, কারণ তারা দ্বীন বুঝেননি, করেননি। আর যদি তাদের জন্য জাহান্নামের ফায়সালা হয় তখন তারা যদি আল্লাহ তায়ালার কাছে ক্বিয়ামতের দিনে এই মর্মে অভিযোগ করেন যে, হে আল্লাহ! আপনি ১৩শত বছর কাল পর্যন্ত কুরআন শরীফের যথাযথ সংরক্ষণ করতে পারেননি। সুতরাং আমরা আপনার কিতাব থেকে দ্বীন শিখে আমল করতে পারি নাই। তখন আল্লাহ তা’য়ালা তাদেরকে কি করবেন? -জামায়াত শিবিরের ভায়েরা উত্তর দিবেন কি?
২৭। মওদুদী সাহেব সুষ্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে, কুরআনে কারীমের তিন চতুর্থাংশ পরবর্তীতে প্রচ্ছন্ন ও বিকৃত হয়ে গেছে এবং ইসলামী শিক্ষার মূল সঞ্জিবনী শক্তি হারিয়ে গেছে। এ মন্তব্যের দ্বারা মওদুদী সাহেব কি বুঝাতে চেয়েছেন যে গত ১৩ শত বছর কুরআনে কারীম অকার্যকর ছিল এখন তিনি কুরআনকে কার্যকর বানাচ্ছেন?
২৮। মাওদূদী সাহেব বলেছেন “কুরআন ও সুন্নাতে রাসূলের শিক্ষা অগ্রগণ্য কিন্তু তাফসীর ও হাদীসের পূরাতন ভান্ডারের মাধ্যমে নয়।” (তানক্বীহাত)
জামায়াত শিবিরের ভাইদের কাছে আমার প্রশ্ন এই যে হাদীস ও তাঙ্গীরের কিতাবাদী ব্যতিরেকে এমন কি পন্থা আপনাদের কাছে আছে যার মাধ্যমে কুরআন শরীফের বিশুদ্ধ তাফসীর যা রাসূল (সা.) থেকে বর্ণিত তা সংগ্রহ করা যাবে? এবং হাদীস ছাড়া রাসূল (সা.) এর সুন্নাত জানার উপায় কী?
* এ প্রশ্নের উত্তর যদি এই হয় যে আল্লাহ তা’আলা মওদুদী সাহেবকে ওহীর মাধ্যমে কুরআন মাজীদের আসল তাফসীর শিখিয়েছেন, আর আল্লাহ নিজেই মওদূদী সাহেব কে সুন্নাতে রাসূল থেকে অবগত করেছেন। তাহলে কি আপনারা মাওদুদীকে নবীর মর্যাদা দিতে চান?
* আর যদি তা না হয় তবে তার অর্থ মওদুদী ও তাঁর অনুসারীরা কুরআন ও সুন্নাতে রাসূলের শিক্ষাকে অস্বীকার করতে চান, কারণ কুরআনের মূল বিশুদ্ধ শিক্ষা যা রাসূল (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম থেকে বর্ণিত তা তাফসীরও হাদীসের কিতাবেই রয়েছে। ঠিক তদরূপ সুন্নাতে রাসূলের শিক্ষা হাদীসের কিতাবেই বিদ্যমান। তাই ঐ সমস্ত কিতাবের মাধ্যম ছেড়ে ইসলামের নামে যে রাষ্ট্র হবে তা হবে তাগুতী রাষ্ট্র।
২৯। তাঙ্গীর, হাদীসের কিতাবের পূরাতন ভান্ডার কে যদি মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ না করা হয় তাহলে কুরআন ও সুন্নাতে রাসূলের শিক্ষার বিন্দু মাত্র সংগ্রহের কোন উপায় নেই। তাই তাফসীর ও হাদীছের কিতাব ছাড়া কুরআন ও সুন্নাতের শিক্ষা লাভ করা তাগুত ও শয়তানের দিকে আহ্বানের নামান্তর।
৩০। পিতাকে, দাদাকে অস্বীকার করে বংশের দাবিদার যেভাবে মিথ্যুক ও প্রতারক বা জারজ বলে আখ্যায়িত হবে, তাঙ্গীর, হাদীসের পুরাতন ভান্ডারকে অস্বীকার করে কুরআন ও সুন্নাতে রাসূলের শিক্ষার দাবিদার সেভাবে মিথ্যুক, প্রতারক ও ইসলামী শিক্ষার ময়দানে জারজ বলে গণ্য হবে।
৩১। কুরআনের শিক্ষা হলো নামায নিদৃষ্ট পাঁচ ওয়াক্তে পাঁচ বার ফরয এবং ফজরের ফরয দুই রাকাত, যুহরের ফরয চার, আছরের চার, মাগরিবের তিন, ও এশার ফরয চার রাকআত। কুরআনের এই শিক্ষা আমরা তাফসীর ও হাদীসের পুরাতন ভান্ডারে পেয়েছি। কিন্তু জামায়াত শিবিরের মূলনীতি “তাফসীর হাদীসের পুরাতন ভান্ডারের মাধ্যমে কুরআনী শিক্ষা লাভ করা যায় না।” তাই নামাযের রাকআত সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য ব্যাখ্যা তাঁরা কোথায় পাবে।
৩২। সুন্নাতে রাসূলের শিক্ষার মধ্যে রয়েছে ফজর, যুহর, মাগরিব, ইশার সুন্নাত নামাযসমূহ। কিন্তু যেহেতু সুন্নাতের এই বর্নণা আমাদের কাছে পৌঁছেছে হাদীসের পুরাতন কিতাবের মাধ্যমে তাই জামায়াত শিবির সুন্নাত নামাযের অপরিহার্যতা কে অস্বীকার করে থাকে, এবং শতকরা ৯০% জন জামায়াত শিবির কর্মী সুন্নাত নামায পড়ে না। কারণ, হাদীছের পুরাতন কিতাব তাদের কাছে অনির্ভরযোগ্য।
৩৩। সুন্নাতে রাসূলের শিক্ষা লম্বা দাড়ি রাখা, মাথায় পাগড়ী পরা, লম্বা জামা পরা, টাখনু গিরার উপর কাপড় পরা, মিছওয়াক করা। কিন্তু যেহেতু এসব সুন্নাত হাদীসের পুরাতন কিতাবের মাধ্যমে আমাদের কাছে পৌঁছেছে তাই জামায়াত, শিবিরের ভাইদের ঐ সব সুন্নাতের আমল করাতো দুরের কথা বরং তারা ঐ সব সুন্নাত কে নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রূপ করেন। মওদুদী সাহেব তাঁর কিতাবাদীতে ঐ সব সুন্নাতের উপহাস, ঠাট্টা ও অবহেলামূলক মন্তব্য অনেক করেছেন।
৩৪। তাঙ্ক্ষীর, হাদীসের কিতাবাদীতে বিশুদ্ধ হাদীস দ্বারা কুরআন শরীফের যে শিক্ষা উম্মতের কাছে সংরক্ষিত আছে এবং বুখারী, মুসলিম সহ অন্যান্য কিতাবাদীতে বিশুদ্ধ হাদীসের মাধ্যমে ১৩ শত বছরের মুসলমানগণ সুন্নাতে রাসূলের যে শিক্ষা লাভ করেছেন, তা যদি কুরআন ও সুন্নাতে রাসূলের সঠিক শিক্ষা না হয়, তাহলে কি মওদুদী সাহেবের ভয়ংকর যোগ্যতার পূর্বে বিশ্ব মুসলিম কুরআন ও সুন্নাতে রাসূলের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত ছিলেন?
৩৫। আমাদের দেশের হাইকোর্টের বিচারপতী মুর্তাদ গোলাম রাব্বানী কর্তৃক “সর্ব প্রকার ফতোয়া নিষিদ্ধ” রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় উঠছিল। কিন্তু মওদুদী সাহেব তাঁর বিভিন্ন বই (যেমন তানক্বীহাত, কুরআন কী চার বুনিয়াদী ইস্তেলাহে, হুকুকুযযাওযাইন) এ হাদীস, তাফসীর ও ফতোয়ার কিতাবাদী সম্পর্কে যা লিখেছেন তার সার সংক্ষেপ হলো এই যে, “ঐ সব কিতাবাদীতে বিশুদ্ধ দ্বীন নেই যা আছে তা বিকৃত, ঐ সব কিতাবাদীর উপর আমল করলে আখেরাতে নাজাতের কোন সম্ভাবনা নেই”।
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ। বলুন গোলাম রব্বানীর রায় ‘সর্বপ্রকার ফতোয়া নিষিদ্ধ’ এবং মওদুদীর রায় “সর্বপ্রকার ফতোয়ার উপর আমল করলে জাহান্নামে পতিত হওয়ার আশংকা” উভয়ের মধ্যে ব্যবধান কি? বরং আমার মতে মুর্তাদ গোলাম রাব্বানীর চেয়ে মওদূদীর মন্তব্য মারাত্মক। কারণ গোলাম রব্বানী শুধু বাংলাদেশের মুসলমানদের কে ঐ সব ফতোয়ার উপর আমল নিষিদ্ধ করেছে। ভারত, পাকিস্তানসহ পৃথিবী জুড়ে অন্যান্য মুসলমানের উপর এ নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য নয় এবং সে আখেরাত সম্পর্কেও কোন মন্তব্য করেনি। কিন্তু মওদুদী সাহেব সমস্ত পৃথিবীর মুসলমানগণ কে ঐ সব ফতোয়া থেকে বিরত থাকার রায় দিয়েছেন আর সাথে সাথে তা বলে দিয়েছেন যে এই সব কিতাবের ফতোয়া মতে চললে শুধু মাত্র দুনিয়ার জীবনের ক্ষতি নয় বরং পরকালের অনন্ত অসীম জীবনের নাজাতের কোন সম্ভাবনা নেই। তাগুতের স্টেডিয়ামে মর্তাদ গোলাম রব্বানী মওদুদী সাহেবের কাছে হার মানিয়েছে।
৩৬। ইসলামের সর্বোচ্চ ফেক্কার কিতাব যথা হেদায়া, ফাতহুল কাদীর, শামী, আলমগীরী, ক্বাযীখান, বাহরুররায়িক ও বাদায়িউসানায়ে প্রভৃতি কিতাবাদীর ফতোয়া মতে আমল করলে আখেরাতে নাজাত পাওয়া যাবে না। আর মওদুদী সাহেবের ফতোয়া মতে আমল করলে আখেরাতে নাজাত পাওয়া যাবে বলে কুরআন শরীফে কোন বর্ণনা আছে কী? যদি না থাকে তা হলে মওদুদী সাহেবের মন্তব্য কোন দ্বীনদারের দ্বীনী মন্তব্য? না কোন বে-দ্বীনের বেদ্বীনী মন্তব্য।
৩৭। হাদীস শরীফে যেভাবে দাজ্জালের বর্ণনা রয়েছে সেভাবে এমন কোন মুজাদ্দিদের বর্ননা আছে কি, “যে এই দ্বীন এক শত বছর পর বিকৃত হয়ে যাবে এবং তেরো শত বছর এভাবে বিকৃত থাকার পর আমার উম্মতে সূট, কোট, টাই পরিহিত, ধুমপানে অব্যস্ত, যার চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত নিটিন ক্লিন চেহারা থাকবে সে অল্প শিক্ষিত হলেও আল্লাহ তা’আলা তাকে ইসলামের মূল স্ত্রীট দান করবেন তোমরা তার অনুসরণ করবে”। দাজ্জালের মত মওদুদী সাহেব সম্পর্কে রাসূল সা. এর এ ধরনের কোন বাণী আছে কী? থাকলে আমাদের কে জানাবেন।
৩৮। মওদূদী সাহেব “তানক্বীহাত” বইতে লিখেছেন কুরআনের ব্যাখ্যার জন্যে কোন তাফসীরের প্রয়োজন নেই বরং উচ্চ পর্যায়ের একজন অধ্যাপকই যথেষ্ট।
প্রকাশ থাকে যে, কুরআন শরীফের আসল তাফসীর যা তাফসীরের কিতাবাদীতে সংরক্ষিত, তা যদি প্রত্যাখ্যান করা হয়, তাহলে কুরআন শরীফের মূল স্ত্রীট থেকে উম্মাত বঞ্চিত থেকে যাবে। ঐ সব তাফসীর ছাড়া কুরআন বুঝার চেষ্টা করাকে তাফসীর বলা হয় না বরং তাহলো প্রত্যেকের নিজস্ব উপলব্দী, (তাঙ্গীর বিররায়) যা শরীয়ত সম্মত নয়।
৩৯। হাদীসে আছে যারা নিজস্ব উপলব্ধি দ্বারা কুরআন মাজীদের ব্যাখ্যা (তাফসীর বিররায়) করে সে জাহান্নামী। উল্লেখ্য যে মওদুদী সাহেব তার তাফহীমূল কুরআনের প্রারম্ভে লিখেছেন যে “আমি কুরআন পড়ে যে অর্থ বুঝেছি এবং আমার মনে যা উপলব্ধি হয়েছে আমার ভাষায় তাহা লিপিবদ্ধ করলাম।” তাই তাফহীমূল কুরআন লিখে মওদুদী সাহেব যে অপরাধ করেছেন, এবং জামায়াত, শিবিরের ভায়েরা তাফহীমুল কুরআনের মাধ্যমে তাফসীরের যে প্রথা চালু করেছেন, উপরে উল্লেখিত হাদীসের আলোকে জাহান্নামে যাওয়ার জন্য তাহাই যথেষ্ট, অন্য কোন পরিশ্রমের প্রয়োজন মনে হয় পড়বে না।
৪০। গোলাম আহমদ কাদিয়ানী, স্যার সৈয়দ সহ অনেক হিন্দু, খৃষ্টান ও ইহুদী কুরআন শরীফ পড়ে নিজস্ব উপলব্ধিতে তার ব্যাখ্যা করেছে, মওদুদী সাহেব ও কুরআন শরীফ পড়ে নিজস্ব উপলব্ধিতে ব্যাখ্যা করেছেন। এসব কোনটিই কালামুল্লাহর ব্যাখ্যা নয়।
কালামুল্লার ব্যাখ্যা উহাকে বলে যাহা রাসূল সা. ও ছাহাবায়ে কেরাম থেকে বর্নিত তাই নিজস্ব উপলব্ধি-কে তাফসীরে কুরআন আখ্যা দেয়। উম্মতের সাথে প্রতারণা মূলক আচরণ।
কোন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অধ্যাপক, অধ্যক্ষ আইনজীবী, ব্যবসায়ী, রাজমিস্ত্রী, কাটমিস্ত্রী গং যেন তাঙ্গীরুল কুরআনের খাহিস না করে, এবং তাফসীরের আহাদীস না জেনে নিজের খেয়াল খুশি মতে যেন কেহ তাঙ্গীর না করে। সে জন্যে রাসুলুল্লাহ সা. এর পক্ষ থেকে তার নিষেধ আসছে এবং জাহান্নামের ভয় দেখান হয়েছে।
৪১। কেহ যদি কুরআন বুঝার জন্যে পূর্বেকার মুফাস্সিরগণের কৃত তাঙ্গীর ও পুরাতন হাদীসের কিতাবাদীর শরণাপন্ন না হয়ে জামায়াত শিবিরের মত তাফহীমুল কুরআন থেকে অথবা কোন প্রফেসার, ডাক্তার বা রোড মুফাসসির থেকে কুরআন বুঝার চেষ্টা করে তবে সে এলাহ, রব, দ্বীন, ইবাদত, তাওহীদ, রিসালাত, আখেরাতের হাকীকত কিছুই বুঝতে পারবেনা। যিলালুল কুরআন ও তাফহীমুল কুরআনের মাধ্যমে কুরআন শরীফের আসল স্প্রীট উপলব্ধি করা আদৌ সম্ভব নয়। এসব মাধ্যমে কুরআন শিখে কেহ যদি মনে করে যে সে ইসলামের ও কুরআনের আসল মর্ম পেয়ে গেছে তবে সে প্রতারিত হবে, সে মনে করবে যে সে ইসলামী আন্দোলনের একজন সৈনিক কিন্তু আসলে যে সে তাগুতী আন্দোলনে জীবন নষ্ট করছে তা সে বুঝতে পারছেনা। তাফহীমুল কুরআনে আস্থাশীল কোন ভাই কে যদি বলা হয় যে ভাই আপনি যে বস্তুকে ইসলাম মনে করে নিজের মেধা, সময় ও অর্থ ব্যয় করছেন তা আসল দ্বীন নয়, এ তো এক মুখরোচক স্লোগান মাত্র, এর জন্যে যে কুরবানী আপনি দিচ্ছেন, তার কোন প্রতিদান আল্লাহ থেকে পাওয়ার আশা করা যায়না। তখন সে রাগে ক্রোধে মারমুখী হয়ে যাবে কিন্তু হায়! সে যে তার অতি মূল্যবান জীবন কে এক কাল্পনিক নিরর্থক প্রোগ্রামে অযথা নষ্ট করছে তা সে উপলব্ধি করতে পারছেনা।
৪২। খুবই আফসোসের বিষয় যে, যদি কোন ইয়াহুদী, খৃস্টান কিংবা বিধর্মী ইসলাম এবং মুসলমানদের উপর অভিযোগ করে যে, হে মুসলিম জাতি। তোমরা দাবী কর যে তোমাদের কুরআন সর্বকালীন, সার্বজনীন। স্থায়ীভাবে আল্লাহ তা’য়ালা তার সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, এই কিতাব কিয়ামত পর্যন্ত বিকৃত হবে না। -না, তোমাদের এই কথা সঠিক নয়। কেননা তোমাদের একজন প্রসিদ্ধ ইসলামী চিন্তাবিদ ও পণ্ডিত মওদুদী সাহেবের লিখিত কিতাব “কুরআন কী চার বুনিয়াদী ইসতেলাহেঁ” (কুরআনের চারটি মৌলিক পরিভাষা) পড়ে আমরা জানতে পেরেছি যে, সাহাবায়ে কেরামের যুগের পর তের শত বছর যাবৎ কুরআনের আসল রূপ ও অবয়বের উপর আবরণ পড়ে যাওয়ার কারণে কুরআনে কারীমের মূল প্রাণ মানুষের চোখের অন্তরাল হয়ে গিয়েছে, বিকৃত হয়ে গিয়েছে। এমনকি অর্থহীন হয়ে পড়েছে তোমাদের গর্বের কিতাব। তাই ১৩ শত বৎসর হিদায়েতের আহবান করতে পারেনি এই কিতাব। সুতরাং যে কিতাব একশত বছর কার্যকর থাকলেও ১৩ শত বছর অকার্যকর ছিল তা নিয়ে কিসের গৌরব তোমাদের?
পাঠকবৃন্দ! আপনারাই বলুন, বিজাতীয়রা এরূপ প্রশ্ন করলে আক্ষেপ করে নিজের দাঁত দিয়ে নিজের আঙ্গুল কাটা ছাড়া আমাদের আর কিছু করার থাকবে কি?
সুতরাং আমাদেরকে গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে আমরা কুরআনের আয়াত তথা আল্লাহর বাতলানো বাস্তবতায় বিশ্বাস করে শ্রেষ্ঠ ও চির অবিকৃত কুরআনে বিশ্বাসী ও আমলকারী হয়ে শ্রেষ্ঠজাতি হিসেবে নিজেদেরকে গড়ে তুলবো, নাকি ভ্রান্তির চোরাবালিতে নিমজ্জিত মওদুদী ও মওদুদীবাদীদের ভ্রান্ত দর্শনে প্রতারিত হয়ে ধ্বংসের পথে পরিচালিত হবো? এবং সেই সাথে বিকৃত ও রহিত আসমানী কিতাবের অনুসারী দাবী করে বিজাতীয়দের কাছে নিজেদেরকে মিথ্যাবাদী, হেয় এবং বিভ্রান্ত বলে পরিচিত করবো? কোন পথ আমরা গ্রহণ করবো?
৪৩। বড়ই পরিতাপের বিষয় যে, এ পৃথিবীতে হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বী জাতি (ধর্ম পালন না করলেও) তাদের ধর্মীয় গ্রন্থসমূহকে সঠিক ও সত্য বলে বিশ্বাস করতঃ সম্মান করে। তাদের ধর্মযাজকদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভক্তি প্রদর্শন করে। কিন্তু মুসলিম জাতির মধ্যে কেবল মওদূদী ও মওদূদী মতবাদে বিশ্বাসী জামাআত ও শিবীর সম্প্রদায় আপন ধর্মীয় কিতাবাদীকে ভুল এবং ইসলাম বিশেষজ্ঞ ইমাম, ফকীহ, মুহাদ্দিস ও মুফাসসিরগণকে ভ্রান্ত এবং উন্মাদ বলে আখ্যা দিয়ে স্বস্তি বোধ করে। তাহলে তারা কোন্ ধর্মে বিশ্বাসী?
৪৪। কিয়ামত দিবসে আল্লাহ তায়ালা যখন মওদূদী এবং মওদূদী আবিষ্কৃত মতবাদে প্রতিষ্ঠিত গোষ্ঠীকে গ্রেফতার করবেন এবং রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞেস করবেন যে, আমি (আল্লাহ তায়ালা) কুরআনুল কারীম ও আমার রাসূলের সুন্নাহকে তোমাদের সর্বাংগীন হিদায়াতের জন্য প্রদান করেছিলাম, যা নবী (সাঃ)-এর যুগ থেকে সর্বদা হাদীস, তাফসীর ও ফিকাহর কিতাবে বিশ্লেষিত ও সংরক্ষিত ছিল, যে নির্দেশনা মেনে চলে সমগ্র মুসলিম জাতি ছহীহ ইসলামের উপরে সুদৃঢ় ছিল। সেসব ছহীহ নির্দেশনা সমূহকে পরিত্যাগ করে বিকৃত ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করার অধিকার তোমাদেরকে কে দিয়েছে? যে বিকৃতির দ্বারা শুধু তোমরাই বিভ্রান্ত হওনি বরং অন্যদেরকেও বিভ্রান্ত করেছ। কেন এই অপকর্মে লিপ্ত হয়েছিলে? মহান আল্লাহর এই প্রশ্নের জবাব দিয়ে নাজাত পাওয়ার কোন আশা করতে পারেন, মওদূদীবাদীরা?
Leave a Reply