১২. রিক্সা চালকের ত্রুটিতে দুই আরোহীসহ রিক্সা এক্সিডেন্ট হয়, বাসের ড্রাইভারের ত্রুটিতে ৪০-৫০ জন আরোহী সহ বাস এক্সিডেন্ট হয়, ট্রেনের চালকের ত্রুটিতে ছয় সাত শত আরোহী সহ ট্রেন এক্সিডেন্ট হয়, বিমানের পাইলটের ত্রুটিতে আরোহী সহ বিমান চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়, একটি লাশও খুজে পাওয়া যায় না। আর বিশ্ব মানবের পরিচালক একজন রাসূলের দায়িত্ব আদায়ে ত্রুটি হলে বিশ্ব মানবতা লণ্ড-ভণ্ড হয়ে অগ্নিকুন্ডে পরিণত হবে। মওদুদী সাহেব রাসূল (সাঃ)-কে এতবড় অপরাধির কাঠ গড়ায় হাজির করলেন?
১৩. রাসূল (সাঃ)-এর আনন্দ আবেগের কার্য কলাপ যেভাবে দ্বীনের অংশ বিশেষ, তাঁর রাগান্বিত ও অবস্থার আচার-আচরণ ও শরীয়তের অংশে পরিগণিত বরং তাঁর স্বপ্ন ও শরীয়ত হিসেবে বিবেচিত, তিনি আবার কি করে দায়িত্ব আদায়ে ত্রুটি বিচ্ছুতি করতে পারেন?
১৪. রাসূল (সাঃ)-এর জীবনে কোন কাজ নেই। কাজ শুধু তাঁর একটাই তাহলো মানুষের হেদায়েতের মেহনত অর্থাৎ দাওয়াত, তা’লীম ও তাযকিয়া। প্রতিদিন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত মানুষের ময়দানে মেহনত করাই তাঁর কাজ। মানুষ যদি দাওয়াত কবুল না করত তখন রাসূল (সাঃ) এত চিন্তিত অস্থির ও পেরেশান হয়ে পড়তেন যে তাঁকে শান্ত্বনা দেয়ার জন্যে কুরআন শরীফের আয়াত নাযিল হত যেমন –
لَعَلَّكَ بَاخِعٌ نَفْسَكَ عَلَى أَثَارِهِمْ إِنْ لَّمْ يُؤْمِنُوا بِهَذَا الْحَدِيثِ أَسَفًا
অতঃপর হয়তো আপনি ইহাদের পিছনে আপনার জীবন বিসর্জন করে দিবেন। যদি তারা এই বিষয়গুলোর প্রতি ঈমান না আনে আক্ষেপ করতে করতে।
لَسْتَ عَلَيْهِمْ بِمُصَيْطِرٍ
আপনি তাদের উপর দায়গ্রস্ত অধিকারী (নিযুক্ত) নহেন।
يَشَاءُ أَنَّكَ لَا تَهْدِي مَنْ أَحْبَبْتَ وَلَكِنَّ اللَّهَ يَهْدِي مَنْ
আপনি যাকে চান হেদায়েত করতে পারবেন না, বরং আল্লাহ যাকে চান তাকে হেদায়েত করেন।
নবুওয়াতের পরিপূর্ণ দায়িত্ব আদায় করে মানুষের হেদায়েতের জন্যে অতিরিক্ত চিন্তা, ব্যথা ও অস্থিরতা থাকা সত্বেও রাসূল (সাঃ) কে নবুওয়াতের দায়িত্ব আদায় না করার অপবাদ দেয়া কত বড় কুফুরী ও তাগুতী মানসিকতার কাজ।
لَعْنَةُ اللَّهُ عَلَى شَرِهِمُ
ইসলামের উপর মওদুদীবাদের বিষাক্ত ছোবল
১. তাফহীমুল কুরআনে মওদুদী সাহেব কুরআন শরীফের বিশুদ্ধ কোন তাফসীর করেননি। বরং তাঁর ভ্রান্ত উপলব্ধি দ্বারা কুরআন শরীফের ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেনঃ “আমি কুরআন শরীফের শব্দগুলোকে উর্দু ভাষায় অনুবাদের স্থলে এ চেষ্টা করেছি যে, কুরআনের একটি আয়াত তেলাওয়াত করে যে অর্থ আমার বুঝে এসেছে এবং যে প্রভাব আমার অন্তরে পড়েছে যথাসম্ভব বিশুদ্ধতার সাথে তা আমি আমার নিজের ভাষায় প্রকাশ করব।” (তাফহীমুল কুরআন- উর্দু দীবাছা, পৃঃ ১০)
২. হযরত দাউদ (আঃ) এর সম্পর্কে তাফহীমাতে বাইবেলের উদ্ধৃতি দিয়ে মওদুদী সাহেব লিখেছেনঃ “একদিন অপরাহ্নে দাউদ নিজ প্রাসাদের ছাদে পায়চারী করছিলেন। এই সময় স্নানরত এক পরমা সুন্দরী রমনীর ওপর তার দৃষ্টি পড়লো। দাউদ খোঁজ নিলেন মহিলাটি কে? জানা গেল, সে এলিয়ামের কন্যা ও উরিয়াহিত্তার স্ত্রী বাতসাবা। দাউদ বাতসাবাকে ডেকে
পাঠালেন এবং রাতে নিজের কাছে রাখলেন। সেই রাতেই সে গর্ভবতী হয়ে গেল। পরে সে দাউদকে নিজের গর্ভবতী হওয়ার কথা জানিয়ে দিল।”
এরপর দাউদ উরিয়াকে উয়াবের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। উয়াব তখন বনী আমুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়েছিল এবং রাব্বা নগরীকে অবরোধ করে সেখানে অবস্থান করছিল। দাউদ উয়াবকে লিখলেন যে, রণাঙ্গনের সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধ স্পেনে চলছে, সেখানে তাকে নিয়োগ কর এবং তারপর তাকে একাকী রেখে সরে যাও, যাতে সে নিহত হয়। উয়াব নির্দেশ মোতাবেক কাজ করলো এবং উরিয়া নিহত হলো।”
এভাবে উরিয়াকে খতম করার পর দাউদ ঐ মহিলাকে বিয়ে করলেন এবং তার পেট থেকেই হযরত সোলায়মান জন্ম গ্রহণ করেন। (নির্বাচিত রচনাবলী ২য় খণ্ড, পৃঃ ৬০)
মওদুদী সাহেবের মতে হযরত দাউদ (আঃ) এর উপর এই অপবাদকে নিশ্চিতভাবে অস্বীকার করা যায় না। তিনি বলেনঃ “এ ধরনের ঘটনায় সব সময় দু’টো সম্ভাবনা থাকে এবং দু’টোই সমান শক্তিশালী। এমনও হতে পারে যে, একজন মানুষ তার ভালোলাগা মহিলাকে পাওয়ার কোনো চেষ্টাই করেনি। কিন্তু সে বিধবা হওয়ার পর কোনো নৈতিক ও আইনগত বাধা না থাকায় তাকে বিয়ে করেছে। আবার এমনও হতে পারে যে, সে তাকে পাওয়ার জন্য অন্যায় চেষ্টা-তদবিরে লিপ্ত ছিল। এই দুটো সম্ভাবনার একটিকে অপরটির ওপর নিশ্চিতভাবে অগ্রগন্য মনে করা সাক্ষ্য প্রমাণ ছাড়া সম্ভব বা সমীচীন নয়। (নির্বাচিত রচনাবলী, ২য় খণ্ড, পৃঃ ৬৪-৬৫)
৩. মওদুদী সাহেব বুখারী, মুসলিম শরীফসহ হাদীস গ্রন্থের নির্ভরযোগ্য
হাদীসকে হাদীস বলে স্বীকার করেন না। তিনি বলেনঃ “আপনাদের মতে
সনদের দিক দিয়ে মুহাদ্দিসরা নির্ভুল আখ্যা দিয়েছেন-এমন প্রতিটি
রেওয়াতকে হাদীসে রাসূল বলে বিশ্বাস করা আবশ্যক। কিন্তু আমরা
সনদের যথার্থকে হাদীসের যথার্থতার জন্যে অপরিহার্য প্রমাণ মনে করি
না।” (নির্বাচিত রচনাবলী, ১ম খণ্ড ২য় ভাগ পৃঃ ২০০) ইত্যাদি
শেষ কথা
অনেক সময় একটি মিথ্যা কথা বার বার বলার দ্বারা শ্রোতার কাছে তা সত্যবলে মনে হয়। এর উদাহরণ জামায়াত শিবির। তাঁরা পত্র পত্রিকা, বই-পুস্তক, পোষ্টার, লিফ্লেট ও মিটিং মিছিলের মাধ্যমে এত প্রচুর পরিমাণে তাগুতের বিরুদ্ধে ও ইসলামের পক্ষে কথা বলেছেন যে ইসলামী শিক্ষায় অনভিজ্ঞ ব্যক্তি অনেকে মনে করে বসেছেন যে জামায়াত শিবির আসলে ইসলামী দল। কিন্তু তাঁরা জানেন না যে জামায়াত শিবিরের ছহীহ দ্বীনের সাথে কোন সম্পর্ক নেই। কেননা যে আন্দোলনের ভিত্তি ও মূল স্ট্রীট হলো এই যে,
(১) নবী রাসূলগণ পাপী ছিলেন (নাউযুবিল্লাহ)।
(২) অনেক নবী রাসূল তাঁদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হননি।
(৩) সাইয়িদুল মুরসালীন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা. ও তাঁর নবুওয়াতী দায়িত্ব পালনে ভুল-ত্রুটি করেছেন।
(৪) প্রথম শতাব্দীর পরে কুরআন মাজীদের অর্থ বিকৃত হয়ে গেছে।
(৫) গত ১৩ শত বছরের কেউ কুরআন ও দ্বীনে ইসলামের হাকীকত বোঝেননি।
(৬) ‘কুরআনী শিক্ষা’ হাদীছ, তাফছীর ও ফিক্কার কিতাবাদীতে পাওয়া যায় না।
(৭) গত ১৩ শত বৎসরের রচিত কিতাবাদীর আলোকে জীবন যাপন করে যারা মারা গেছে তাদের নাজাতের সম্ভাবনা নেই।
(৮) নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত মূল ইবাদত নয়, এগুলো হলো রাষ্ট্র গঠনের জন্যে ট্রেনিং কোর্স।
(৯) ইসলামী হুকুমত বিদ্যমান না থাকা অবস্থায় পৃথিবীর মুসলমানদের যত নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত, ইত্যাদি ইবাদত পালিত হয়েছে, তা সম্পূর্ণ নিরর্থক।
(১০) ইসলামী রাষ্ট্র ব্যতিত ঈমানও নিস্ফল ইত্যাদি ইত্যাদি।
জামায়াত শিবিরের এসব মূল দর্শন যা তাদের সিলেবাস ভূক্ত বইতে বিদ্যমান আছে (এই বই এর শেষের পৃষ্ঠায় ঐ সব বইয়ের তালিকা রয়েছে)।
সম্মানিত পাঠক! ইসলামী আন্দোলনের জন্যে উল্লেখিত ইসলাম বিরোধী নীতি নির্ধারণের কি প্রয়োজন ছিল? কুরআন শরীফ কে বিকৃত ঘোষণা দিয়ে এবং ইসলামী জ্ঞান ভান্ডারকে অস্বীকার করে এবং মুহাদ্দিসীন, মুফাসসিরীন, ফুকাহা ও আওলিয়ায়ে কেরামকে ভ্রান্ত ও উন্মাদ ফতোয়া দিয়ে ইসলামী রাষ্ট্র গঠনে জামায়াত শিবিরভিত্তিক যে আন্দোলন চলছে আসলে তা কিসের আন্দোলন? প্রত্যেক সচেতন মুসলমানের এ ব্যাপারে শান্ত মনে চিন্তা করা দরকার।
বিশুদ্ধ ইসলাম হলো- যা ১৪শত বৎসর ধরে নির্ভরযোগ্য সূত্রে নিরবচ্ছিন্ন ধারায় আমাদের কাছে পৌঁছেছে এবং যা হাদীস, ছহীহ্ তাফসীর ও ফিক্কার কিতাবাদীতে সংরক্ষিত রয়েছে। তাই মওদুদী দর্শনের উপর পরিচালিত জামায়াত শিবিরের ধর্মীয় মূলনীতি হাদীস, তাফসীর ও ফিক্বার কিতাবাদীর সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ায় তাঁদের মতবাদ ও আন্দোলনকে হকু বলে স্বীকৃতি দেয়া যায় না। একজন আল্লাহ ও রাসূল প্রেমিকের জন্যে এটা কি করে সম্ভব হতে পারে যে, সে কুরআন, হাদীস বিরোধী আন্দোলনের সাথে জড়িত থাকবে। আমাদের সত্য বক্তব্যে জামায়াত শিবিরের ভাইদের মনে কষ্ট লাগতে পারে। কিন্তু আমরা কি করে আমাদের আল্লাহর কালাম ও আমাদের রাসূলের হাদীসকে প্রত্যাখ্যান করে তাঁদের সাথে জড়িত হতে পারি? যদিও মনে চায় যে দেশে একটা ইসলামী বিপ্লব সংঘটিত হোক, কিন্তু এই আবেগ থাকা স্বত্বেও তাঁদের সাথে যোগ দিতে পারছিনা, কেননা ইসলামী আন্দোলনের উদ্দেশ্য হলো সর্ব প্রথম মুসলমানদের অন্তরে বিশুদ্ধ ঈমান জাগ্রত করা এবং দেশের মুসলমানের আমল ও চরিত্র ছাহাবায়ে কেরামের মডেলে গড়ে তোলা। যাতে মানুষের মনে আল্লাহর ভয় ও প্রেম ভালবাসা জন্মে এবং রাসূল সা. এর সুন্নাতের অনুসরণের পরিবেশ গড়ে উঠে।
কিন্তু বর্তমান জামায়াত শিবিরের সব চাইতে বড় বরং আসল বিপদ এই যে তাদের মধ্যে দ্বীন সম্পর্কে ব্যুৎপত্তি ও কুরআন হাদীস সম্পর্কে কোন
অনুধ্যান এবং সুন্নাতে রাসূল ও ইবাদতের প্রতি কোন আগ্রহ নেই। যা তাদের লেখনীর দ্বারা প্রকাশিত। এই অভাব ও শূন্যতাই তাঁদের ঈমান বিশ্বাসকে অন্তঃসারশূন্য ও তাঁদের আন্দোলনকে প্রাণহীন করে দিয়েছে। তাঁদের মধ্যে ইসলামের ভক্ত ও ইসলামী রাষ্ট্র গঠনের আন্দোলনকারী অনেক রয়েছে। কিন্তু কুরআন ও মুহাম্মদ সা. এর পেশকৃত দ্বীনের প্রাণ বস্তু এবং তার মূলনীতির অনুধাবনকারী একজনও নেই। তাঁরা দ্বীন প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত কিন্তু তাঁদের ব্যক্তি জীবনে কোন দ্বীনদারী ও সুন্নাতে রাসূলের অনুসরণ দেখা যায় না। তাঁরা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় খুব আগ্রহী কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্রের মূলনীতি ও বিধি-বিধান যা হাদীস ও ফিক্বার কিতাবাদীতে সংরক্ষিত তা পরিস্কারভাবে অস্বীকার করে। সর্বদা তাঁরা ইসলামী আন্দোলনে ব্যস্ত কিন্তু ব্যক্তি জীবনে অথবা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কোন স্বার্থ পেয়ে গেলে ইসলাম ছেড়ে যে কোন বে-দ্বীনী শক্তির সামনে মাথানত করতে দ্বিধা নেই তাঁদের। এসব প্রতারণা ও নীতিহীনতার কারণে তাঁরা জাতির আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। তাইতো কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর যাবৎ এত ঢাক-ঢোল পিটিয়ে দেশের কোন এক মহল্লায়ও তাঁরা ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা চালু করতে পারেননি, আর কখনও পারবেন না নিশ্চয়ই।
অতএব ইসলামী আন্দোলনের আবেগ ও জ্যাকে মওদুদী মতবাদের পেছনে অযথা নষ্ট না করে, ইসলামের ১৪শত বছরের নিরবচ্ছিন্ন নূরানী ধারা ‘আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের’ পতাকা তলে সমবেত হয়ে পূতঃ পবিত্র উলামায়ে কেরামের নেতৃত্বে আয়িম্মায়ে মুজতাহিদীন ও বুযুর্গানে দ্বীনের লিখিত কিতাবাদীর আলোকে দেশে আইনে শরীয়ত প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে এগিয়ে আসার জন্যে সবাইকে উদাত্ব আহ্বান জানাচ্ছি। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সর্বপ্রকার বাতিল থেকে হেফাজত করুন ও দেশে শরীয়তের আইন প্রতিষ্ঠা করার তাওফীক দান করুন। আমীন
اللَّهُمَّ أَرِنَا الْحَقَّ حَقًّا وَ ارْزُقْنَا اتَّبَاعَهُ وَارِنَا الْبَاطِلَ بَاطِلًا وَارْزُقْنَا اجْتِنَابَهُ
وما علينا الا البلاغ المبين