প্রকৃত আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’ত পরিচিতি
-: প্রথম কথা:-
পৃথিবীর সমস্ত মানুষ এক আদমের সন্তান। তাই হযরত আদম আ. গোটা জগতের সকল মানুষের আদিপিতা। আর তাঁর স্ত্রী হাওয়া আ. সকল মানুষের আদিমাতা। সেই আদম-হাওয়াকে সৃষ্টি করে আল্লাহ তাআ’লা প্রথমে জান্নাতে বসবাস করতে দেন। পরবর্তীতে শয়তানের প্রতারণায় নিষিদ্ধ গাছের ফল খাওয়াকে কেন্দ্র করে তাঁদের উভয়কে জান্নাত থেকে বের করে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেন। পাঠাবার সময় সরাসরি তাঁদের দু’জনকে আর তাঁদের মাধ্যমে তাঁদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বলে দেন:-
قُلْنَا اهْبِطُوا مِنْهَا جَمِيعًا فَإِمَّا يَأْتِيَنَّكُمْ مِنِّي هُدًى فَمَنْ تَبِعَ هُدَايَ فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ. وَالَّذِينَ كَفَرُوا وَكَذَّبُوا بِآيَاتِنَا أُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ.
অর্থাৎ, তোমরা এখান থেকে (পৃথিবীতে) নেমে যাও। অতঃপর আমার পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে (পুনরায় জান্নাতে পৌঁছার) পথ প্রদর্শক আসবে। তখন যারা আমার পথের অনুসরণ করবে, তাদের জন্য (ভবিষ্যতেরও) কোন ভয় নেই এবং (অতীতেরও) কোন চিন্তা থাকবে না। আর যারা অমান্য করবে এবং আমার বাণীসমূহকে অবিশ্বাস করবে, তারা চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবে। (১)
আল্লাহ তাআ’লা সেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পৃথিবীর মানুষকে আবার জান্নাতে ফিরে যাওয়ার পথ প্রদর্শনের জন্য লক্ষাধিক নবী-রাসূল ও শতাধিক আসমানী কিতাব (ঐশীগ্রন্থ) নাযিল (অবতীর্ণ) করেন। সে সকল নবী রাসূলের মধ্যে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল হলেন আমাদের মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সা.। আর তাঁর কাছে নাযিল করেন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানী কিতাব মহাগ্রন্থ আল-কুরআন।’
(১) সূরাতুল বাক্বারাহঃ ৩৮-৩৯।
পবিত্র কুরআনের ভাষায় আল্লাহর প্রতিশ্রুত সেই পথ প্রদর্শনকে বলা হয়েছে হেদায়ত বা পথ দেখানো, আর তাঁর প্রদর্শিত সেই পথকে বলা হয়েছে ছিরাতে মুস্তাকীম। এর বাংলা অর্থ, সোজা পথ। কাদের জন্য সোজা পথ? পৃথিবীর মানুষের জন্য। কোথায় যাওয়ার সোজা পথ? জান্নাতে যাওয়ার সোজা পথ।
এবার প্রশ্ন আসে, সেই সোজা পথের ব্যাখ্যা কী? মুফাস্স্সিরীনে কেরাম (পবিত্র কুরআনের সম্মানিত ব্যাখ্যাকারগণ) ছিরাতে মুস্তাক্বীম বা সোজা পথের বিভিন্ন ব্যাখ্যা পেশ করেছেন। যেমন:-
১। ইসলামের পথ।
২। কুরআনের পথ।
৩। নবীগণের পথ।
৪। সিদ্দীকগণের পথ।
৫। শহীদগণের পথ।
৬। সালেহগণের পথ।
৭। আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’তের পথ। (১)
এ ব্যাখ্যাসমূহের প্রতিটারই তফসিলী বিবরণ আছে। যা সবিস্তারে উল্লেখ করার অবকাশ এ পুস্তকে নেই। তাই এখানে শুধু ছিরাতে মুস্তাকীমের সপ্তম ব্যাখ্যা অর্থাৎ, আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’তের পথ বলতে কোন মতাদর্শ বুঝায়, তার সামান্য বিশ্লেষণ পেশ করা হচ্ছে। কারণ আমাদের সমাজের কিছু লোক আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’তের নামে তাদের কতিপয় মনগড়া মতবাদ প্রচার করে বেড়াচ্ছে।
যার ফলে অনেক সরলপ্রাণ মুসলমান তাদের মনগড়া মতবাদকেই আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’তের মতাদর্শ মনে করে প্রতারিত হচ্ছে। এ প্রতারণা থেকে সতর্ক করে তাদেরকে প্রকৃত আহলে সুন্নত ওয়াল জমাতের সন্ধান দেয়ার উদ্দেশ্যেই এ পুস্তক লেখার প্রয়াস। যা ভূমিকাতেই উল্লেখ করা হয়েছে।
(১) তাফসীরে ইবনে কাসীরঃ ১/৪২-৪৩
কুরআনের ভাষায় ছিরাতে মুস্তাক্বীম বা সোজা পথ
পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে ছিরাতে মুস্তাক্বীম এর উল্লেখ রয়েছে। তন্মধ্যে এক আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে:-
وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيلِهِ ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ.
অর্থাৎ, আর নিশ্চয়ই ‘এটি আমার ছিরাতে মুস্তাকীম (বা প্রদর্শিত সোজা পথ), তাই তোমরা এ পথে চল, এ ছাড়া অন্যান্য পথে চলো না। অন্যথায় সেগুলি তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্যুত করে দিবে। তিনি (অর্থাৎ, আল্লাহ) অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে তোমাদের এ উপদেশ দিচ্ছেন, যাতে তোমরা (ভ্রান্ত পথ থেকে) বাঁচতে পার। (১)
এ আয়াতে ছিরাতে মুস্তাক্বীম বা সোজা পথ কথার অর্থ ইসলাম বা কুরআনের পথও হতে পারে, আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’তের পথও হতে পারে। যদি ইসলাম বা কুরআনের পথ গণ্য করা হয়, তাহলে “অন্যান্য পথ” বলতে অন্যান্য ধর্মের পথ বুঝতে হবে। আর যদি এখানে সোজা পথ বলতে আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’তের পথ গণ্য করা হয়, তাহলে “অন্যান্য” পথ বলতে ইসলামের মনগড়া অপব্যাখ্যাকারী বাহাত্তর দলের ভ্রান্ত মতবাদ বুঝতে হবে। (২)
(১) সূরায়ে আন’য়াম: ১৫৩।
(২) তাফসীরে কামালাইন শরীফ: ১/৩৫।
রাসূলের হাদীসে ছিরাতে মুস্তাক্বীম বা সোজা পথের ব্যাখ্যা
হযরত রাসূলে করীম সা.-এর হাদীসে উক্ত আয়াতের যে কয়েকটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায়, তন্মধ্যে নিম্নোক্ত দু’টি ব্যাখ্যা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি এক হাদীসে মৌখিক বিবরণের মাধ্যমে, আরেক হৃদীসে রেখা অংকনের মাধ্যমে এ আয়াতের ব্যাখ্যা করেছেন।
উভয় হাদীসের মর্ম একই। আর তা হল, মুসলমানগণ তেয়াত্তর দলে বিভক্ত হয়ে বাহাত্তর দল জাহান্নামী, আর একটি মাত্র দল জান্নাতী হবে। জান্নাতী দলটির পরিচয় জিজ্ঞাসিত হয়ে রাসূল সা. বলেন, যে দল আমার সুন্নত এবং আমার সাহাবার জমা’তের মতাদর্শে অটল থাকবে। এ হাদীসের ভিত্তিতেই মুসলমানদের একটিমাত্র জান্নাতী দল আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’ত নামে অভিহিত হয়। এর অর্থই হল, রাসূলের সুন্নত ও সাহাবাগণের জমা’তের আদর্শে বিশ্বাসী।
এখানে এসেই সুন্নতে রাসূল সা. ও জমা’তে সাহাবা রা.-এর আদর্শ বলতে কোন মতাদর্শ বুঝায় তার পরিষ্কার বিবরণের দরকার, যা পরে আলোচনা করা হবে। এর আগে উক্ত হাদীস দু’টির যে অংশ আলোচ্য বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত তার পূর্ণ বিবরণ এবং কিছু আনুষঙ্গিক কথা আলোচনা হওয়া দরকার। যার আলোকে আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’তের পরিচয় বুঝা সহজ হয়।
হাদীস দু’টির পূর্ণ বিবরণ
মৌখিক বিবরণ সম্বলিত হাদীসের এক পর্যায়ে রাসূল সা. বলেন:-
وإن بني إسرائيل تفرقت على ثنتين وسبعين ملة، وتتفرق أمتي على ثلث و سبعين ملة كلهم في النار إلا واحدة، قالوا: من هي يا رسول الله قال: ما أنا عليه وأصحابي. رواه الترمذي. وفي رواية أحمد وأبي داؤد عن معاوية وهي الجماعة، وإنه رضى الله عنه ثنتان وسبعون في النار و واحدة في الجنة سيخرج في أمتي أقوام تتجارى بهم تلك الأهواء، كما يتجارى الكلب بصاحبه حتى لا يبقى منه عرق ولا مفصل إلا دخله.
অর্থাৎ, বনী ইসরাঈল (হযরত ইয়াকূব আ.-এর পরবর্তী বংশধর) বাহাত্তর দলে বিভক্ত হয়েছিল এবং আমার উম্মত তেয়াত্তর দলে বিভক্ত হবে। তন্মধ্যে একটা দল ছাড়া সবাই হবে জাহান্নামী। উপস্থিত সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এ দলটির পরিচয় কী? উত্তরে রাসূল সা. বলেন, যারা আমার (সুন্নত) এবং আমার সাহাবাগণ (এর জমা’ত) এর মতাদর্শে অটল থাকবে। এটা তিরমিযী শরীফের বিবরণ। ইমাম আহমদ এবং আবু দাউদের বিবরণে আছে, আমার উম্মতের মধ্যে এমন কতগুলি দল বের হবে, যাদের প্রতিটি ধমনী ও জোড়ায় জোড়ায় বনী ইসরাঈলের কুপ্রবৃত্তিসমূহ প্রবাহিত হবে। যেভাবে জলাতঙ্ক রোগীর মধ্যে তার জীবাণু প্রবাহিত হয়। (১)
আর রেখা অংকন সম্বলিত হাদীসে উল্লেখ আছে:-
وعن عبدالله بن مسعود عنه، قال: خط لنا رسول الله صلى الله عليه وسلم – خطا، ثم قال: هذا سبيل الله، ثم خط خطوطا عن يمينه وعن شماله وقال: هذه سبل على كل سبيل منها شيطان يدعو إليه و قرأ وَأَنَّ هَذَا صرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ الآية.
অর্থাৎ, হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা. বলেন, হযরত রাসূলে করীম সা. আমাদের বুঝাবার জন্য একটা সরল রেখা টনে বলেন, এটা আল্লাহর পথ (এর উদাহরণ)। তারপর উক্ত সরল রেখার ডানে-বামে আরও (ছয়টা বাঁকা) রেখা টেনে বললেন, এগুলো ভিন্ন পথসমূহ (এর উদাহরণ), যার প্রতিটি পথের দিকে শয়তান ডাকছে। এ কথা বলে রাসূল সা. সেই আয়াত তিলাওয়াত করেন, যে আয়াতে আল্লাহ বলেন, এটাই আমার ছিরাতে মুস্তাক্বীম। (২) অর্থাৎ, এভাবে রেখা টেনে রাসূল উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা করলেন।
এতদোভয় হাদীসের মর্ম একই। আর তা হল, মুসলমান উম্মতের বাহাত্তরটি দল কুপ্রবৃত্তির শিকারে পরিণত হয়ে শয়তানের ডাকে ইসলামের নামে ভ্রান্ত আক্বীদা পোষণ করার দরুন জাহান্নামে যাবে। আর একটি মাত্র দল ছিরাতে মুস্তাক্বীম বা সোজা পথে চলে অর্থাৎ, ইসলামের বিশুদ্ধ আক্বীদা বিশ্বাসে অটল থেকে জান্নাতে যাবে। সেই বিশুদ্ধ আক্বীদার ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে কোথায়? পাওয়া যাবে রাসূলের সুন্নত আর সাহাবাগণের জমা’তে সুতরাং মুসলমানের এ একটিমাত্র দল ইসলামী আক্বীদা বিশ্বাসের ক্ষেত্রে নিজেদের মনগড়া ব্যাখ্যার আশ্রয়ে না গিয়ে, সুন্নতে রাসূল এবং জমা’তে সাহাবার আদর্শকে মাপকাঠি হিসেবে অবলম্বন করায় জান্নাতী হবে। তাই দলটি আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’ত নামে অভিহিত হয়েছে। এর অর্থ হল, রাসূল সা.-এর সুন্নত এবং সাহাবাগণ রা.-এর জমা’তের মতাদর্শে বিশ্বাসী।
(১) মিশকাত শরীফ ১/৩০।
(২) মিশকাত শরীফঃ ১/৩০।
আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’ত নামের উৎস
যে হাদীসে মুসলমানদের তেয়াত্তর দলে বিভক্ত হওয়ার কথা বর্ণিত হয়েছে, সে হাদীসকে “হাদীসে ইফতেরাকে উম্মত” বলা হয়। এর অর্থ, উম্মতের দলাদলির বিবরণ সম্বলিত হাদীস। হাদীসটি তিরমিযী শরীফ, আবু দাউদ শরীফ ও মিশকাত শরীফসহ হাদীসের বিভিন্ন কিতাবে বহু সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। এ হাদীসের মূল বক্তব্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে শব্দগতভাবে সামান্য ব্যবধান থাকলেও সেগুলির মর্মে কোন ব্যবধান নেই। তাই অর্থগত দিক থেকে হাদীসটা মুতাওয়াতির বা সন্দেহাতীতভাবে গৃহীত।
এ হাদীসের এক বর্ণনায় জান্নাতী দলটির পরিচয়ে রাসূল সা. বলেছেন- ما أنا عليه وأصحابي যার অর্থ, যে তরিকায় আমি আছি, আর আমার সাহাবাগণ আছেন। আর রাসূলের তরিকা বা তাঁর অনুসৃত পদ্ধতিকে তাঁর সুন্নত, আর তাঁর সাহাবাগণের সমষ্টিকে সাহাবাগণের জমা’ত বলা হয়। তাই আলোচ্য হাদীসের এ অংশটির মর্মার্থ হল, রাসূলের সুন্নত এবং তাঁর সাহাবাগণের জমা’ত এর আদর্শে প্রতিষ্ঠিত দল। আর এ মর্মেই এ হাদীসকে আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’ত নামের উৎস হিসেবে অবলম্বন করা হয়েছে।
এ ছাড়া দারুল উলূম দেওবন্দের সাবেক মুহতামিম হাকীমুল ইসলাম আল্লামা ক্বারী তৈয়ব সাহেব র. “আক্বীদাতুত তাহাবী”-এর ব্যাখ্যায় লেখেন:
وفي رواية أحمد وأبي داؤد، وهي الجماعة، وفي رواية، من كان على السنة والجماعة، ففيه إشارة إلى أن لقب أهل الحق بأهل السنة والجماعة مأخوذ من قول النبي – صلى الله عليه وسلم.
অর্থাৎ, মসনদে আহমদ ও আবু দাউদ শরীফের বর্ণনায় উক্ত হাদীসের শেষাংশে উল্লেখ আছে, জান্নাতী দলটিই হচ্ছে জমা’ত। আরেক বিবরণে উল্লেখ আছে, যারা সুন্নত এবং জমা’তের উপর প্রতিষ্ঠিত তাঁরাই জান্নাতী দল। এ বিবরণমতে রাসূলের হাদীসের মর্মই শুধু আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’ত নামের উৎস নয়; বরং হাদীসের সরাসরি শব্দ থেকেই হকপন্থী মুসলমান দলের নামটি গৃহীত হয়েছে। (১)
অতঃপর তিনি লেখেন:-
وهذا اللقب مركب من جزئين منهاج السنة المراد من ما، والذوات القدسية المراد من الجماعة، فمعيار الحق السنة وأهلها، لا أحدهما فقط فالسنة وأهلها متلازمان
অর্থাৎ, আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’ত নামের দু’টি অংশ রয়েছে। প্রথম অংশ, সুন্নত তরিকা, যা আলোচ্য হাদীসে ৩ শব্দটির মর্ম। আর দ্বিতীয় অংশ, সাহাবাগণের পবিত্র আত্মাসমূহ, যা جماعة। শব্দটির মর্ম।
সুতরাং এ হাদীস দ্বারা মি’য়ারে হজ্ব বা সত্যের মাপকাঠি অর্থাৎ, মুসলমানদের বাহাত্তরটি বাতিল দল থেকে একমাত্র হক বা সত্যপন্থী দলটি পরখ করার মানদণ্ড একটি নয়; দু’টি সাব্যস্ত হল। যার একটি হচ্ছে, রাসূলের সুন্নত, আর অপরটি, এর অনুসারী দল সাহাবাগণের জমা’ত। সুতরাং সুন্নত এবং জমা’ত একটা অপরটা থেকে অবিচ্ছেদ্য। (২) কারণ সুন্নতের উপরই জমা’ত প্রতিষ্ঠিত, আর জমা’তের দ্বারাই সুন্নত অনুসৃত।
এ বিবরণ দ্বারা এ কথা দিবালোকের মত পরিষ্কার হয়ে গেল যে, রাসূলের একটা প্রসিদ্ধ হাদীসের ভিত্তিতেই আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’তের নামকরণ করা হয়েছে এবং সুন্নতে রাসূল সা. এবং জমা’তে সাহাবা সত্যের মাপকাঠি হওয়াই এ নামকরণের কারণ।
(১) আক্বীদাতুত্ তাহাবী মা’য়াল হাওয়াশী: ৯।
(২) আক্বীদাতুত্ তাহাবী মা’য়াল হাওয়াশী: ৯।
মহানবী সা.-এর উম্মত কারা
আলোচ্য হাদীসে রাসূল সা. বলেন, আমার উম্মত তেয়াত্তর দলে বিভক্ত হবে, এখানে রাসূলের উম্মত বলতে কাদেরকে বুঝানো হয়েছে? এ প্রশ্নের জবাব বুঝার জন্য জানা থাকা দরকার যে, মহানবীর উম্মত দু’ প্রকার। প্রথম প্রকার উম্মতের নাম “উম্মতে দাওয়াত”। আর দ্বিতীয় প্রকার উম্মতের নাম “উম্মতে ইজাবত”।
আল্লাহ আমাদের মহানবীকে সারা বিশ্বের সকল মানুষের প্রতি ইসলামের দাওয়াত দিতে পাঠিয়েছেন। এ হিসেবে মুসলমান-অমুসলমান নির্বিশেষে সারা বিশ্বের সকল মানুষই মহানবীর উম্মতে দাওয়াত। আর এ দাওয়াত যারা ইজাবত বা গ্রহণ করেন তাদেরকে অর্থাৎ, শুধুমাত্র মুসলমানগণকে বলা হয় উম্মতে ইজাবত।
প্রসিদ্ধ মতানুসারে আলোচ্য হাদীসে রাসূলের উম্মত বলতে তাঁর উম্মতে ইজাবত বা মুসলমান বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ, মুসলমানেরা তেয়াত্তর দলে বিভক্ত হয়ে বাহাত্তর দল জাহান্নামী আর একদল জান্নাতী হবে (১)
এখানে আরও কয়েকটা আনুষঙ্গিক প্রশ্নের মীমাংসা হওয়া দরকার। তন্মধ্যে প্রথম প্রশ্ন হল, এক হাদীসে রাসূল সা. বলেন:-
من كان في قلبه مثقال حبة من خردل من إيمان دخل الجنة.
অর্থাৎ, যার অন্তরে সরিষার দানা পরিমাণও ঈমান থাকবে সেও জান্নাতে যাবে। (২)
সুতরাং ৭২ দল মুসলমান জাহান্নামে যাওয়ার মর্ম কী? আর দ্বিতীয় প্রশ্ন হল, সমস্ত মুসলমান তো একই আল্লাহ, একই রাসূল, একই কুরআন, একই কালেমা এবং একই কিবলায় বিশ্বাসী। সুতরাং মুসলমানদের মধ্যে তেয়াত্তরটা দল হবে কেন?
(১) মাযাহিরে হজ্বঃ ১/২৩১-৩২, মিরকাত শরহে মিশকাত: ১/৩৮০।
(২) সহীহ বোখারী শরীফ: ২/৯৭০।
কোন মুসলমান জাহান্নামী হওয়ার ব্যাখ্যা
প্রথম প্রশ্নের জবাব হল, জাহান্নামী প্রধানতঃ দু’ প্রকার। প্রথম প্রকার: চিরস্থায়ী জাহান্নামী এবং তারা হচ্ছে, বেঈমান কাফিরগণ, যারা ইসলামে অবিশ্বাসী। আর আলোচ্য হাদীসে বাহাত্তর দল মুসলমানকে এমন জাহান্নামী বলা হয়নি। দ্বিতীয় প্রকার: ক্ষণস্থায়ী জাহান্নামী, যারা স্বীয় পাপের শাস্তি ভোগ করার জন্য প্রথমে জাহান্নামে যাবে। এরা একটা মেয়াদ অতিক্রম করার পর মুক্তি পেয়ে জান্নাতে চলে যাবে। এরা হচ্ছে, পাপাচারী মুসলমানগণ (১)
সুতরাং কোন মুসলমানই কাফিরদের মত চিরকাল জাহান্নামে থাকবে না; বরং এক সময় মুক্তি পেয়ে জান্নাতে যাবে। এদের বেলায় প্রশ্নে উত্থাপিত হাদীস প্রযোজ্য হতে পারে। কিন্তু তাই বলে উক্ত হাদীসের এ অর্থ নয় যে, কোন মুসলমানই কোন পাপের কারণে জাহান্নামে যাবে না। মোট কথা, যে সমস্ত মুসলমান আক্বীদাগত ভ্রান্তির পাপের কারণে জাহান্নামে যাবে, তাদের বেলায় হাদীসে ইফতেরাকে উম্মত প্রযোজ্য। কিন্তু সব মুসলমানই শেষ পর্যন্ত জান্নাতে যাবে। এ মর্মে প্রশ্নে উত্থাপিত হাদীস প্রযোজ্য। সুতরাং উভয় হাদীসে আর কোন বিরোধ রইল না।
(১) মিরক্কাত শরহে মিশকাতঃ ১/১৭৫-৭৬
আহলে সুন্নতের আক্বীদাই ইসলামের বিশুদ্ধ আক্বীদা
দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাব হল, হাদীসে ইফতেরাকে উম্মত এ যেহেতু বলা হয়েছে, উম্মতে ইজাবত বা মুসলমানগণ তেয়াত্তর দলে বিভক্ত হবে, তাই এদের সকল দলই এক আল্লাহ, এক কুরআন, এক কিবলা ইত্যাদিতে বিশ্বাসী হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ এগুলি বিশ্বাস না করলেত মুসলমানই থাকবে না। হ্যাঁ, আসল প্রশ্ন হচ্ছে, মুসলমানদের কোন্ মতভেদটার কারণে এরা কাফিরও হয় না, আবার জাহান্নামীও হয়। আর এমন মতভেদটা করবেই বা কেন?
এ সম্পর্কে প্রথম কথা হল, কিছু আক্বীদা বা বিশ্বাস এমন আছে, যেগুলি ছাড়া কোন মানুষ মুসলমান হতে পারে না। যেমন আল্লাহকে লা- শরীক বা অংশীদারমুক্ত বিশ্বাস করা, হযরত মুহাম্মদ সা.-কে সর্বশেষ নবী বিশ্বাস করা, পবিত্র কুরআনকে আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাব বিশ্বাস করা ইত্যাদি।
আর কিছু আক্বীদা বিশ্বাস আছে এমন, যেগুলি পোষণ না করলে কোন মুসলমান আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’ত হতে পারে না। যেমন সমস্ত নবী রাসূলকে মাসূম (নিষ্পাপ) এবং মহানবীর সমস্ত সাহাবাকে মাগফুর (ক্ষমাপ্রাপ্ত) বলে বিশ্বাস করা। অনুরূপভাবে সাহাবাগণের মধ্যে হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা., হযরত উমর ফারুক রা., হযরত উসমান রা. এবং হযরত আলী রা.-কে যথাক্রমে অন্যান্য সাহাবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ বিশ্বাস করা।
এ সমস্ত আক্বীদা বিশ্বাস যদি কেউ পোষণ করে না, তাহলে সে কাফির না হয়ে মুসলমান থাকবে বটে, কিন্তু আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’তের অন্তর্ভুক্ত থাকবে না। কারণ তার আক্বীদা কুফ্রি না হলেও সুন্নতে রাসূল এবং জমা’তে সাহাবার মতাদর্শের পরিপন্থী।
এ ধরনের ভ্রান্ত আক্বীদাসমূহের কারণে আলোচ্য হাদীস (হাদীসে ইফতেরাকে উম্মত) এ বাহাত্তর দল মুসলমানকে জাহান্নামী বলা হয়েছে। এদের ভ্রান্ত আক্বীদাগুলি যতক্ষণ পর্যন্ত অকাট্য কুফর এর পর্যায়ে না পৌছুবে ততক্ষণ পর্যন্ত কাফির গণ্য হবে না। কিন্তু সুন্নতে রাসূল আর জমা’তে সাহাবার পরিপন্থী আক্বীদা পোষণের কারণে গুমরাহ অর্থাৎ, পথভ্রষ্ট ও ভ্রান্তপন্থী মুসলমান গণ্য হয়ে জাহান্নামী সাব্যস্ত হবে।
সুতরাং আলোচ্য হাদীসে মুসলমানদের আক্বীদাগত মতভেদের কথা বলা হয়েছে ।(১) যার মধ্যে একমাত্র আহলে সুন্নতের আক্বীদাই হল ইসলামের বিশুদ্ধ আক্বীদা।
(১) তাফসীরে কামালাইন শরীফঃ ১/৩৫-৩৬
মুসলমানদের বাহাত্তর দলে বিভক্ত হওয়ার কারণ
বাকি রইল এ প্রশ্ন যে, বাহাত্তর দল মুসলমান এমন ভ্রান্ত আক্বীদা পোষণ করতে যাবে কেন, যার ফলে জাহান্নামী হতে হয়? এর কারণও রাসূলে করীম সা. আলোচ্য হাদীসের শেষাংশে বলে দিয়েছেন। তিনি একটা চমৎকার উপমা দিয়ে কারণটা বর্ণনা করেছেন। উপমাটা বুঝার জন্য জানা থাকতে হবে, জলাতংক রোগে আক্রান্ত কুকুর যখন কোন মানুষকে কামড় দেয়, তখন কামড় খাওয়া মানুষটির রক্তে সে কামড়ের মাধ্যমে জলাতংক রোগের জীবাণু মিশে যায় এবং তার প্রতিটি ধমনী ও শিরা উপশিরায় বিদ্যমান সব রক্তই আক্রান্ত হয়ে মানুষটাও জলাতংক রোগে আক্রান্ত হয়ে যায়।
এমন জলাতংকগ্রস্ত রোগীর উদাহরণ দিয়ে রাসূল সা. বলেন, এ রোগীর প্রতিটি শিরা উপশিরায় যেভাবে কুকুরের কামড়ের বিষ মিশে যায়, তেমনিভাবে বাহাত্তর দল মুসলমানের রক্তের প্রতিটি কণায় কণায় দুনিয়ার লোভ অর্থাৎ, পার্থিব অবৈধ লালসা মিশে যাবে। এ লালসার তাড়নায় তারা সুন্নতে রাসূল ও জমা’তে সাহাবার আদর্শ ছেড়ে পবিত্র কুরআন হাদীসের মনগড়া ব্যাখ্যার আশ্রয়ে ভ্রান্ত আক্বীদা পোষণ করবে। আর এ অপরাধের কারণেই তারা জাহান্নামী সাব্যস্ত হবে।
মুসলমান আমলগত অপরাধেও জাহান্নামী হতে পারে
প্রকাশ থাকা আবশ্যক যে, আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’তের আক্বীদা পোষণ করার পরও যদি কেউ আমলের দ্বারা গুনাহ করে, তবে সেও জাহান্নামের শাস্তির যোগ্য হয়। যেমন দৈনিক পাঁচ বেলার নামাযকে ফরয বিশ্বাস করা সত্ত্বেও যদি কোন মুসলমান অলসতাবসত কোন এক বেলার নামাযও যথাসময়ে না পড়ে পরবর্তীতে ক্বাজা পড়ে, তবে তাকে এক বেলার নামায সময়মত না পড়ার কারণে দীর্ঘদিনের জন্য জাহান্নামে যেতে হবে বলে বর্ণিত আছে। (১)
সুতরাং আলোচ্য হাদীসের যে অংশে একটি মাত্র দলের মুসলমানকে জান্নাতী বলা হয়েছে, এর মর্ম হল, তাদের আক্বীদাগত কোন ত্রুটির কারণে জাহান্নামে যেতে হবে না। কিন্তু শুধু আমলের ত্রুটির কারণে যারা জাহান্নামে যাবে বলে অন্যান্য হাদীসে এবং বিভিন্ন আয়াতে উল্লেখ আছে, তাদের কথা আলোচ্য হাদীসের এ অংশে উল্লেখই করা হয়নি। বরং এখানে শুধু আক্বীদাগত ত্রুটির কারণে কারা জাহান্নামে যাবে, আর কারা যাবে না এর আলোচনাই করা হয়েছে।
সুতরাং আমল সংক্রান্ত বিবরণের সাথে এ বিবরণের কোন সম্পর্ক নেই। এ ছাড়া আমাদের আলোচ্য হাদীসের প্রথমাংশটাও আমলের সাথে সম্পর্কিত। যে কারণে সেই অংশটা এখানে উল্লেখই করা হয়নি। সেই অংশেও জাহান্নামে যাওয়ার মত আমলের কথা বর্ণিত হয়েছে।
আরও প্রকাশ থাকা আবশ্যক যে, আমলগত ত্রুটির অপরাধের চেয়ে আক্বীদাগত ত্রুটির অপরাধ গুরুতর। এ ছাড়া বাতিলপন্থীদের আক্বাইদ ভ্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে আমলেও ভ্রান্তি রয়েছে। পক্ষান্তরে আক্বাইদ যাদের বিশুদ্ধ তাদের ভ্রান্তি শুধুমাত্র আমলেই হতে পারে। তাই আমলের ত্রুটির কারণে যাদের শাস্তি হবে, তাদের চেয়ে আক্বীদায় যাদের ভ্রান্তি আছে তাদের শাস্তি অধিকতর কঠিন হবে। এ মর্মে আক্বীদাতুত তাহাবী কিতাবের ব্যাখ্যা গ্রন্থে উল্লেখ আছে:-
والمراد بالاختلاف بين الفرق اختلاف الأصول، لا اختلاف الفروع، وإلا لازداد عدد الفرق على ثلاث وسبعين والمراد من قوله صلى الله عليه وسلم: “كلهم في النار” أنهم يعذبون عذابا شديدا لفساد اعتقاداتهم وسوء أعمالهم، بخلاف الفساق من أهل السنة والجماعة، فإنهم يعذبون لسوء أعمالهم.
অর্থাৎ, আলোচ্য হাদীসে মুসলমানদের দলাদলি বলতে আক্বীদাগত দলাদলি বুঝানো হয়েছে। কারণ আমলের মতভেদ গণ্য করলে দলসমূহের সংখ্যা তেয়াত্তরের বহু ঊর্ধ্বে চলে যাবে। আর এদের মধ্যে বাহাত্তর দল জাহান্নামী হওয়ার মর্ম হল, এদের শাস্তি শুধুমাত্র আমলগত ত্রুটি সম্পন্নদের তুলনায় অনেক কঠিন হবে। কারণ এদের একদিকে রয়েছে আক্বীদায়
ভ্রান্তি যা আমলের ভ্রান্তির চেয়ে মারাত্মক, অপরদিকে এদের আমলেও ভ্রান্তি। পক্ষান্তরে আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’তের কেউ শাস্তির যোগ্য হলে শুধুমাত্র আমলের ত্রুটির কারণেই হবে, আক্বীদার কারণে নয়। (২)
(১) মাজালিসুল আবরার: ৩০১।
(২) আক্বীদাতুত্ তাহাবী মা’য়াল হাওয়াশী: ৯।
চার মাযহাবের সকলই আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’ত
এখানে কারো মনে এ প্রশ্নও আসতে পারে যে, ইসলামী আক্বীদা বিশ্বাস নিয়ে মতভেদ করে তেয়াত্তর দলে বিভক্ত মুসলমানদের বাহাত্তর দলই যেহেতু ভ্রান্ত হওয়ার কারণে জাহান্নামে যাবে, তাহলে কি ইসলামী আমলের বেলায় মুসলমানগণ চার মাযহাবে বিভক্ত হওয়ার কারণেও কোন একটা মাত্র মাযহাবের অনুসারীগণ জান্নাতী আর বাকিরা জাহান্নামী হবে?
এ সম্পর্কে হাদীস ব্যাখ্যাতাগণ লেখেন:-
قال الشيخ في البذل المراد من هذا التفرق التفرق المذموم الواقع في أصول الدين، وأما اختلاف الأمة في الفروع فليس بمذموم، بل هو من رحمة الله سبحانه فإنك ترى أن الفرق المختلفة في الفروع كلها متحدة في الأصول ولا يضل بعضهم بعضا. وأما المتفرقون في الأصول فيكفر بعضهم بعضا.
অর্থাৎ, শায়খ খলীল আহমদ সাহারানপুরী র. আবু দাউদ শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ বজলুল মজহুদে লেখেন, আলোচ্য হাদীসে মুসলমানদের দলাদলি বলতে ইসলামী আক্বীদা-বিশ্বাস সংক্রান্ত দলাদলি বুঝানো হয়েছে। পক্ষান্তরে মাযহাবের ইমামগণ যে ইসলামী আমলের ব্যাপারে মতভেদ করেছেন, সেটা নিন্দনীয় নয়; বরং আল্লাহ পাকের বিশেষ রহমত। তাই আপনি দেখবেন, আমল সংক্রান্ত ব্যাপারে যারা মতভেদ করেছেন তাদের সকলেই আক্বীদার ব্যাপারে একমত হওয়ায় তাঁদের এক মাযহাবের অনুসারীরা অন্য মাযহাবের অনুসারীগণকে পথভ্রষ্ট বলেন না। অথচ আক্বীদার ব্যাপারে মতভেদকারী বাহাত্তর দলের একদল আরেক দলকে কাফির বলে। (১)
এখানে মাযহাবের ইমামগণের মতভেদকে আল্লাহর রহমত বলা হয়েছে। কারণ রাসূল সা. সহীহ হাদীসে এ পর্যায়ের মতভেদের উভয় পক্ষেই সাওয়াব আছে বলে উল্লেখ করেছেন (২) এবং সাহাবাগণের এমন মতভেদকে সমর্থন দিয়েছেন। (৩) বিশেষতঃ চার মাযহাব সম্পর্কে তাফসীরে আহমাদিয়ায় উল্লেখ আছে:-
قد وقع الإجتماع على أن الاتباع إنما يجوز للأربع، لا يجوز الاتباع لمن حدث مجتهدا مخالفا لهم …. والإنصاف أن انحصار المذاهب في الأربعة واتباعهم فضل إلهي وقبولية من عند الله تعالى، لا مجال فيه للتوجيهات والأدلة.
অর্থাৎ, এ কথার উপর উম্মতের ইজমা (ঐকমত্য) অনুষ্ঠিত হয়েছে যে, অনুসরণ শুধুমাত্র চার মাযহাবেরই করা যাবে। এ ছাড়া নতুন কোন মুজতাহিদ যদি চার মাযহাবের পরিপন্থী কিছু বলেন, তবে তার অনুসরণ করা বৈধ হবে না। …
আর ইনসাফভিত্তিক কথা হল, মাযহাব চারটিতে সীমাবদ্ধ হওয়া এবং এগুলির অনুসরণ আল্লাহপাকের বিশেষ অনুগ্রহ এবং তাঁর কাছে কবুল হওয়ার ব্যবস্থা। এ ব্যাপারে কোন প্রমাণ পেশ করা বা ব্যাখ্যা প্রদানেরও প্রয়োজনীয়তা বাকি নেই। (৪)
এর কারণ, চার মাযহাবের ইমামগণ ছাড়া আর যত মুজতাহিদ ছিলেন, তাঁদের কারো মাযহাব পূর্ণাঙ্গতা লাভ করেনি। অর্থাৎ, সব বিষয়ের সমাধান তাঁদের মাযহাবে স্থান পায়নি বলে তাঁদের মাযহাবগুলি সুবিন্যস্ত হয়নি। বরং এমনটা হয়েছে শুধু চার মাযহাবের বেলায়। (৫)
সুতরাং চার মাযহাবের ইজতিহাদগত মতভেদের কারণে এগুলির কোন অনুসারীর গুনাহগার হয়ে জাহান্নামী হওয়ার প্রশ্নই আসে না। বরং মাযহাব চতুষ্টয়ের অনুসারীরাই সাওয়াবের অধিকারী হয়ে জান্নাতী হবে।
মোট কথা, চার মাযহাবের সবাই যেহেতু আক্বাইদের বেলায় ইসলামের বিশুদ্ধ আক্বীদা বিশ্বাসে ঐক্যবদ্ধ এবং আমলের বেলায় তাদের মতভেদটাও সুন্নতে রাসূল এবং জমা’তে সাহাবার দ্বারা সমর্থিত, তাই চার মাযহাবের সবাই আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’তের অন্তর্ভুক্ত। হ্যাঁ, রেজভীরা যেহেতু সুন্নী দাবি করেও আহলে সুন্নতের পরিপন্থী আক্বীদা পোষণ করে এবং হানাফী দাবি করেও ইমাম আবু হানীফা র.-এর কিতাব মানে না, তাই এরা হানাফীও নয় এবং আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’তও নয়; বরং এ দু’টি নামের মুখোশধারী।
যাই হোক, চার মাযহাবের এখতেলাফটা হাদীসে ইফতেরাকে উম্মত এর আওতাভুক্ত নয়। প্রকাশ থাকা আবশ্যক যে, কেউ যদি ফিক্বাহর বেলায় চার মাযহাবের কোন একটার অনুসারী হয়েও আক্বীদার বেলায় আহলে সুন্নতের অনুসারী না হয়, তাহলে সে প্রকৃত অর্থে মাযহাব চতুষ্টয়ের কোন একটার অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে না। কারণ মুসলমান হওয়ার আগে যেমন কোন মানুষ আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’ত হতে পারে না, তেমনিভাবে আহলে সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত না হয়ে কেউ চার মাযহাবের কোন একটার অনুসারী হতে পারে না।
(১) আল কাউকাবুদ্দুররি: ২/১২৮।
(২) সহীহ বোখারী শরীফঃ ২/১০৯২।
(৩) প্রাগুক্ত।
(৪) তাফসীরে আহমদী কৃতঃ আল্লামা মুল্লা জীওনঃ ৩৪৬।
(৫) তাক্বলীদ কী শরয়ী হাইসিয়াত: ৭৮-৮৫।
দলাদলির মূল কারণ দুনিয়ার লোভ
এবার আসা যাক মূল আলোচনায়। আলোচ্য হাদীসে মুসলমানদের তেয়াত্তর দলে বিভক্ত হওয়ার সুস্পষ্ট কারণ বর্ণিত হয়েছে। আর তা হল দুনিয়ার লোভ। অর্থাৎ, পার্থিব অবৈধ স্বার্থের লোভে পড়ে বাহাত্তর দল মুসলমান ভ্রান্ত পথে চলে যাবে। আর একটি মাত্র দল ছিরাতে মুস্তাকীমের উপর অটল থাকবে।
আর দুনিয়ার লোভ প্রধানতঃ তিন প্রকার। যথাঃ ১। মানের লোভ, ২। ধনের লোভ, ৩। নারী-পুরুষের অবাধ মেলামিশার লোভ। এ তিন প্রকার লোভই চরিতার্থ করার সর্বাপেক্ষা সহজ ব্যবস্থা হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় শক্তির অধিকারী হওয়া। সোজা কথায়, অসৎ উদ্দেশ্যে দেশের গদি দখল করা। তাইতো ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আলোচ্য হাদীসে বর্ণিত বাহাত্তরটি বাতিল দলের প্রায় সব কটি দলেরই উদ্ভব হয়েছে রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে। অর্থাৎ, রাষ্ট্রীয় গদি দখলের জন্য চলেছে আন্দোলন, আর সে আন্দোলনকে সফল করার জন্য ইসলামী আক্বীদার অপব্যাখ্যার মাধ্যমে ইসলামের নামকে ব্যবহার করা হয়েছে।
যেমন সময়ের দিক থেকে সর্বপ্রথম বাতিল দল শিয়া। এদের আন্দোলনের সূত্রপাতই হয়েছে এ দাবির ভিত্তিতে যে, রাসূল সা.-এর পরই তাঁর খেলাফত বা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন হযরত আলী রা.। তাঁর এ অধিকার থেকে তাঁকে বঞ্চিত করে হযরত আবু বকর রা.-কে খলীফা মনোনীত করে অন্যায় করা হয়েছে।
তেমনিভাবে স্থল দৃষ্টিতে চটকদার যুক্তি পেশ করার দিক থেকে প্রথম দল মু’তাযিলা। এরাই তাদের ভ্রান্ত মতবাদ গ্রহণ না করায় রাষ্ট্রীয় শক্তির দাপটে হযরত ইমাম আহমদ বিন হাম্বল র.-কে কারাবন্দী করে কঠিন বেত্রাঘাতসহ নানাভাবে লোমহর্ষক নির্যাতন করেছিল।
অনুরূপভাবে অন্যান্য অনেক দলেরই উত্থান হয়েছে রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে। যদিও তাদের বেশিরভাগ দলই গদি দখলের সুযোগ পায়নি, তবুও উপরোক্ত তিন প্রকার লোভের কোন না কোনটা চরিতার্থ করার অসৎ উদ্দেশ্যেই ইসলামের নামে মনগড়া আক্বীদা বিশ্বাসের উদ্ভাবন করেছে। মুরজিয়া ফিরকার লোকেরা যে নারীদেরে ফুলের সাথে তুলনা করে বিয়ে ছাড়া তাদের উপভোগের মতবাদ উদ্ভাবন করেছে, এটাই তো তাদের অবাধ যৌনাচারের কুপ্রবৃত্তির শিকার হওয়ার জ্বলন্ত প্রমাণ বহন করে।
যে সব ফিরকা বা দল ইসলামের রাজনীতিকে তাদের কুপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করার হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে, তাদের এ অপকীর্তির কারণে অনেকে ইসলামের বিশুদ্ধ রাজনীতি সম্পর্কেও সন্দীহান হয়ে ধর্মহীন রাজনীতিতে বিশ্বাসী হয়ে পড়েছে। অথচ রাজনৈতিক হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য অপব্যাখ্যার মাধ্যমে ইসলামের নাম ব্যবহার করা যেমন অসৎ পথ, তেমনিভাবে ইসলামে যে রাজনীতিও আছে, যা মহানবী সা. তাঁর পবিত্র জীবনের শেষ দশটি বৎসর এবং তাঁর পরবর্তী খলীফাগণ করে গেছেন, তা অস্বীকার করাও সৎ পথ নয়। ব্যবধান শুধু এতটুকু যে, এক পক্ষ শুধু নিজেদের কুপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করার জন্য রাজনীতি করে এবং ইসলামকে তার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। এহেন অসৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত রাজনীতির যেখানেই বিশুদ্ধ ইসলাম বাধা হয়ে দাঁড়ায়, সেখানেই ইসলামের নামে ভ্রান্ত মতবাদ উদ্ভাবন করে।
আরেক পক্ষ সকল প্রকার কুপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করার পথে একমাত্র ইসলামই বাধা হওয়ার কারণে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ইসলামকে সমূলে অস্বীকার করে। এতদোভয় মতবাদেই তিন প্রকার লোভ-লালসার কোন একটা ক্রিয়াশীল। অর্থাৎ, মানের লোভ, ধনের লোভ ও অবাধ যৌনাচারের লোভ। মোট কথা, পার্থিব হীন স্বার্থ ছাড়া মুসলমানদের তেয়াত্তর দলে বিভক্ত হওয়ার আর কোন কারণ নেই। শুধুমাত্র একটি দল এসব লোভ- লালসা মুক্ত হওয়ায় এরাই হবে জান্নাতী। আর বাহাত্তর দল মুসলমান এ সমস্ত লোভের বশবর্তী হয়ে মনগড়াভাবে ভ্রান্ত মতবাদ উদ্ভাবন করার কারণে হবে জাহান্নামী।
এ পর্যন্ত বলার পর অর্থাৎ, আলোচ্য হাদীসে রাসূল যখন দুনিয়ার লোভের কারণে বাহাত্তর দল মুসলমানকে জাহান্নামী, আর এ লোভ মুক্ত হওয়ায় একদল মুসলমানকে জান্নাতী বলে আখ্যায়িত করলেন, তখনই রাসূলের দরবারে উপস্থিত সাহাবাগণ বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ!” সেই জান্নাতী মুসলমান দলটার পরিচয় কী? এর উত্তরে রাসূল সা. কী বলেছিলেন সেটাই হবে আমাদের মুখ্য আলোচ্য বিষয়, যার মাধ্যমে আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’তের পরিচয় জানা যাবে। কিন্তু এর আগে এখানে কিছু আনুষঙ্গিক কথা উল্লেখ করা দরকার।
নারায়ে রিসালাত ইয়া রাসূলাল্লাহ্ বলবে কোন আক্বীদায়?
প্রথম কথা হল, সাহাবায়ে কেরাম রা. যেহেতু হযরত রাসূলে করীম সা.-কে “ইয়া রাসূলাল্লাহ” বলে সম্বোধন করেছেন, তাই আমরা “নারায়ে রেসালাত ইয়া রাসূলাল্লাহ” বলে শ্লোগান দিলে দোষ কী? এ প্রশ্নের জবাব বুঝার জন্য পূর্ব থেকেই স্মরণ রাখতে হবে, আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’ত কোন শ্লোগানের দ্বারা হয় না। হয় সুন্নতে রাসূল ও জমা’তে সাহাবার আদর্শমতে ইসলামী-আক্বীদা বিশ্বাসের দ্বারা। আর সাহাবায়ে কেরাম, রাসূলকে হাযির নাযির বা সর্বত্র বিরাজমান ও সর্বদর্শী বিশ্বাস করে ইয়া রাসূলাল্লাহ বলেননি। অর্থাৎ, তাঁদের যে যখন যেখানেই আছেন, তাঁর সাথে তখন সেখানেই রাসূল হাযির আছেন বলে নয়; বরং রাসূল যেখানে আছেন সেখানে নিজেরা হাযির হয়ে ইয়া রাসূলাল্লাহ বলেছেন। আর আমাদের সমাজে যারা নারায়ে রেসালাত ইয়া রাসূলাল্লাহ বলে শ্লোগান দেয়, তারা রাসূলকে সর্বত্র হাযির নাযির বলে প্রচার করার জন্যই এ শ্লোগান দেয়।
সুতরাং এদের আক্বীদার সাথে সাহাবায়ে কেরামের ইয়া রাসূলাল্লাহ বলার আদৌ কোন সম্পর্ক নেই। রাসূলকে হাযির নাযির বিশ্বাস করা আহলে সুন্নতের আক্বীদা তো নয়ই, বরং এটা শিরকি আক্বীদা। কারণ এটা আল্লাহ পাকের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ গুণ। আর আল্লাহ পাকের সত্তায় বা তাঁর বৈশিষ্ট্যপূর্ণ গুণে অন্য কাউকে গুণান্বিত করার নামই শিরক। যেমন, আল্লাহ বলেন:-
وَهُوَ مَعَكُمْ أَيْنَ مَا كُنتُمْ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ
অর্থাৎ, তোমরা যেখানেই থাক না কেন আল্লাহ তোমাদের সাথে থাকেন এবং তোমরা যাই কর না কেন আল্লাহ তা দেখেন। (১)
অন্য আয়াতে বলেন:-
مَا يَكُونُ مِنْ نَجْوَى ثَلَالَةٍ إِلَّا هُوَ رَابِعُهُمْ وَلَا خَمْسَةٍ إِلَّا هُوَ سَادِسُهُمْ وَلَا أدنى من ذلك وَلا أَكْثَرَ إِلَّا هُوَ مَعَهُمْ أَيْنَ مَا كَانُوا.
অর্থাৎ, কোন তিন ব্যক্তি যদি চুপেচুপে কথা বলে, তখন আল্লাহ তাদের চতুর্থজন হিসেবে, আর কোন পাঁচ ব্যক্তি যদি চুপিসারে কথা বলে, তখন তিনি ষষ্ঠজন হিসেবে থাকেন। এর চেয়ে কম বা বেশি হলেও বান্দারা যেখানেই থাকে তিনি তাদের সাথে সেখানেই থাকেন। (২)
অন্যত্র বলেন:-
وَإِذا سألك عبادي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ
অর্থাৎ, হে রাসূলে করীম! যখন আমার বান্দারা আপনাকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে (আমি তাদের কাছে থাকি, না দূরে থাকি, তখন তাদেরকে আপনি বলে দিন,) আমি অবশ্যই (তাদের) কাছে থাকি। যখন কেউ আমাকে ডাকে, তখনই আমি তার ডাকে সারা দেই। (৩)
অন্য আয়াতে বলেন:-
وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْ حَبْلِ الْوَرِيدِ –
অর্থাৎ, আমি তার রক্ত সঞ্চালনকারী ধমনীর চেয়েও অধিক নিকটবর্তী (৪)
এ সমস্ত আয়াতসহ পবিত্র কুরআনের বহু আয়াতে আল্লাহ পাকের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ গুণ বর্ণনা করে বলা হয়েছে, বান্দাদের যে যখন যেখানেই থাকে, আল্লাহ তখন তার সাথে সেখানেই থাকেন। তিনি সর্বদা বান্দার কার্যকলাপ দেখেন এবং তার কথাবার্তা যত আস্তেই বলুক তা শুনেন, আর তার সকল অবস্থা দেখেন। সুতরাং সর্বদা সর্বত্র বিরাজমান থাকা বা হাযির নাযির হওয়া একমাত্র আল্লাহ পাকের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ গুণ। তাই এ গুণ রাসূলের বেলায় আরোপ করা আহলে সুন্নতের আক্বীদা তো নয়ই; বরং শিরকি আক্বীদা। সুতরাং এ আক্বীদার সাথে আলোচ্য হাদীসে সাহাবাগণের ইয়া রাসূলুল্লাহ বলার আদৌ কোন সম্পর্ক নেই। কারণ তাঁরা রাসূলের কাছে উপস্থিত হয়ে ইয়া রাসূলাল্লাহ বলতেন।
(১) হাদীদঃ ৪।
(২) সূরায়ে মুজাদালাহঃ ৭।
(৩) সূরায়ে বাক্বারাহঃ ১৮৬।
(৪) সূরায়ে ক্বাফ: ১৬।
বাহাত্তর দলের পরিচয়
দ্বিতীয় কথা হল, আলোচ্য হাদীসে সাহাবাগণ রাসূলের কাছে মুসলমানদের বাহাত্তরটি ভ্রান্ত ও জাহান্নামী দলের পরিচয় জিজ্ঞেস না করে, একটি মাত্র সঠিক জান্নাতী দলের পরিচয় জানতে চাইলেন কেন? এর প্রথম জবাব হল, যে সব পথে চলার দরকার নেই, সে সব পথের অনুসন্ধান করারও দরকার নেই। বরং শুধুমাত্র যে পথে চলার দরকার, সে পথটিই চিনার দরকার। দ্বিতীয় জবাব হল, জান্নাতে যাওয়ার একটামাত্র পথ চিনে ফেললেই তো পরিষ্কার হয়ে যাবে যে, এ ছাড়া বাকি সবগুলিই জাহান্নামের পথ।
এখানে লক্ষ্যণীয় ব্যাপার যে, সাহাবাগণ জান্নাতী যে দলটির পরিচয় জানতে চাইলেন, রাসূল সা.-ও সে দলটির পরিচয়ই পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছেন যে, যারা রাসূলের সুন্নত ও সাহাবাগণের জমা’তের আদর্শে অটল থাকবে। যে কারণে দলটি আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’ত নামে পরিচিত হয়েছে।
সুতরাং জান্নাতী দলটির সুস্পষ্ট আদর্শ বর্ণিত হওয়ায় দলটিকে পরিষ্কারভাবে চেনার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু ভ্রান্ত মতবাদী বাকি বাহাত্তরটি দলের পরিচয় সাহাবাগণ জিজ্ঞেসও করেননি এবং রাসূলও সে সব দলের বিস্তারিত বিবরণ দেননি। তাই তো দেখা যায়, হাদীসে ইফতেরাকে উম্মত নামক হাদীসটির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মুহাদ্দিসীন ও মুফাসসিরীনে কেরাম আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’তকে তো সুস্পষ্টরূপে এবং সন্দেহাতীতভাবে সকলের ঐকমত্যে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু বাকি বাহাত্তর দল ভ্রান্ত পন্থীদের বেলায় এমনটা হয়নি; বরং তাঁদের বিভিন্ন জন ৭২ দলের তফশীল বিভিন্নভাবে পেশ করেছেন।
যেমন তাফসীরে কামালাইন শরীফে আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যায় উল্লেখ আছে, বাহাত্তরটি ভ্রান্ত দলের মূল দল হল ছয়টি। আর প্রতিটি মূল দলের উপদল রয়েছে বারটি করে। এভাবে তারা বাহাত্তর দলে বিভক্ত হয়েছে। নিম্নে এর বিস্তারিত বিবরণ পেশ করা হচ্ছে:-
১। রাফিযী দল:- এদের কতিপয় বিশেষ মৌলিক আক্বীদা হলঃ-
এরা (ক) নামাযের জমা’তের জন্য ইক্বামতকে সুন্নত মনে করে না।
(খ) নামাযের জমা’তকেও সুন্নত মনে করে না।
(গ) চামড়ার মোজার উপর মাছেহ করা জায়েয মনে করে না।
(ঘ) তারাবীহের নামাযকে সুন্নত মনে করে না।
(ঙ) নামাযে দাঁড়ানো অবস্থায় ডানহাত বামহাতের উপর রাখাকে সুন্নত মনে করে না।
(চ) রোযার ইফতারকে সুন্নত মনে করে না।
(ছ) মাগরিবের নামাযের সময় হলে পরে তা অবিলম্বে পড়া সুন্নত মনে করে না।
(জ) হযরত ফাতেমা রা.-কে হযরত আয়শা রা.-এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করে।
(ঝ) শুধুমাত্র হযরত আলী রা. ছাড়া সমস্ত সাহাবা বিশেষতঃ হযরত আবু বকর রা., হযরত উমর রা., হযরত তালহা রা. এবং হযরত যুবায়ের রা.-এর প্রতি লা’নত বর্ষণ করে।
(ঞ) একত্রে তিন তালাকের প্রয়োগ বিশ্বাস করে না।
(ট) আল্লাহর রহমতের আশা করে না।
এই রাফিযীরাই আবার পরস্পরে বিভেদ করে বারটি উপদলে বিভক্ত হয়েছে, যথাঃ (১) উলুভিয়া, (২) আইদিয়া, (৩) শিয়া, (৪) ইসহাকিয়া, (৫) যায়দিয়া, (৬) আব্বাসিয়া, (৭) ইমামিয়া, (৮) তানাসুখিয়া, (৯) নাদিসিয়া, (১০) লাগিয়া, (১১) ওয়াজিইয়্যা ও (১২) ওয়াবিছিয়া।
২। খারিজী দল :- এদের কতিপয় মৌলিক আক্বীদা হল:- এরা মনে করে
(ক) নামাযের জমা’ত সুন্নত নয়।
(খ) মুসলমান কোন প্রকারের কবীরা গুনাহ করলেই কাফির হয়ে যায়।
(গ) বিনা শর্তেই অত্যাচারী সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা বৈধ।
সর্বোপরি এরা-
(ঘ) হযরত আলী রা.-এর প্রতি লা’নত বর্ষণ করে।
খারিজীদের বারটি উপদল হলঃ (১) আযারিয়া (২) আবাখানিয়া, (৩) তাগলিবিয়া, (৪) হারিসিয়া, (৫) খালাফিয়া, (৬) কুযিয়া, (৭) মু’তাযিলা, (৮) মায়মুনিয়া, (৯) কানযিয়া, (১০) মাহকামিয়া, (১১) উখতিয়া, (১২) শারাফিয়া।
৩। জাবরিয়া দল :- এদের কতিপয় মৌলিক আক্বীদা হলঃ-
(ক) বান্দা পাথরের মত সম্পূর্ণ অক্ষম। তাই সে কোন পাপ-পুণ্য নিজের ক্ষমতায় করে না।
(খ) ধন সম্পদ আল্লাহর প্রিয়বস্তু।
(গ) বান্দা কোন কাজের ইচ্ছা করার পর আল্লাহ তাকে সামর্থ্য দান করেন।
এদের উপদলগুলো হল: (১) মুযতাররিয়া, (২) আফআলিয়া, (৩) মায়িয়া, (৪) মাগরুয়িয়া, (৫) মাজাযিয়া, (৬) মুতমাইন্নিয়া, (৭) কাসালিয়া, (৮) সাবেকিয়া, (৯) হাবীবিয়া, (১০) খাওফিয়া, (১১) ফিকরিয়া, (১২) হারীসিয়া।
৪। কাদরিয়া দল:- এদের মৌলিক আক্বীদা হল :-
(ক) বান্দাই তার সকল কাজে পূর্ণ ক্ষমতার অধিকারী।
(খ) কোন কাজ বান্দার কাছে ঈমান এবং আল্লাহর কাছে কুফর হতে পারে।
(গ) জানাযার নামায পড়া জরুরি নয়।
(ঘ) আহদে মীসাক (অর্থাৎ, আল্লাহর সাথে বান্দার আনুগত্যের ওয়াদার ঘটনা) অবাস্তব।
(ঙ) বান্দার কাজের আগে আল্লাহ তাকে সামর্থ্য দান করেন।
(চ) রাসূলের মে’রাজ শুধু স্বপ্নযোগে হয়েছিল, সশরীরে নয়।
এদের বারটি উপদল হল: (১) আহমদিয়া, (২) সানবীয়া, (৩) কাসানিয়া, (৪) শয়তানিয়া (৫) শরীকিয়া (৬) ওয়াহমিয়া, (৭) রুওয়াইদিয়া, (৮) নাকিশিয়া, (৯) মুতাবাররিয়া, (১০) ফাসেতিয়া, (১১) নেযামিয়া, (১২) মনযিলিয়া।
৫। জাহমিয়া দল:- এদের মৌলিক আক্বীদা হলঃ-
(ক) ঈমানের সম্পর্ক শুধুমাত্র অন্তরের সাথে, মুখের সাথে মোটেও নয়।
(খ) হযরত মূসা আ. কলীমুল্লাহ (অর্থাৎ, আল্লাহর সাথে কথোপকথনকারী) নন।
(গ) কবরের আযাব বলতে কিছু নেই।
(ঘ) কবরে প্রশ্নকারী মুনকার নাকীর ফিরিশতা বলতে কেউ নেই।
(ঙ) মহানবীর হাউযে কাউসার বলতে কিছু নেই।
(চ) মালাকুল মাউত বা আজরাঈল ফিরিশতা বলতে কেউ নেই; বরং এসবই হচ্ছে কল্পনা-জল্পনা মাত্র।
(ছ) প্রাণীর আত্মা সরাসরি আল্লাহই কবয বা বধ করেন।
এদের বারটি উপদল হল: (১) মা’খলুকিয়া, (২) গায়রিয়া, (৩) ওয়াকিফিয়া, (৪) খবরিয়া, (৫) যানাদিকিয়া, (৬) নাফতিয়া, (৭) মুরাবিইয়া, (৮) মুতারাক্বিবিয়া, (৯) ওয়ারিদিয়া, (১০) ফানিয়া, (১১) হারক্বিয়া, (১২) মুয়াত্তালিয়া।
৬। মুরজিয়া দল:- এদের মৌলিক আক্বীদা হলঃ-
(ক) হযরত আদম আ.-কে আল্লাহ নিজের আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন।
(খ) আল্লাহর শরীর আছে সুতরাং-
(গ) আল্লাহর শরীরের অবস্থানের জন্য স্থানের দরকার।
(ঘ) ঈমান ছাড়া যেমন নেক আমল কোন উপকারে আসবে না, তেমনি ভাবে গুনাহের কারণে ঈমানদারদের কোন শাস্তি হবে না। সুতরাং বান্দার জন্য শুধু ঈমান গ্রহণ করা ফরয, কোন আমল করা ফরয নয়।
(ঙ) নারীদের উদাহরণ বাগানের ফুলের মত, যার ইচ্ছা হয় সেই ব্যবহার করবে। সুতরাং নারীদেরকে উপভোগ করার জন্য বিয়ের দরকার নেই।
এদের বারটি উপদল হচ্ছেঃ (১) তারেকিয়া, (২) শানিয়া, (৩) রাজিয়া, (৪) শাকিয়া, (৫) বাহমিয়া, (৬) আমলিয়া, (৭) মানকুসিয়া, (৮) ছাতশানিয়া, (৯) আশারিয়া, (১০) বিদ্ইয়া, (১১) হাশওয়ায়িয়া, (১২) মুশতাবিহিয়া।
উপরোল্লিখিত ছয়টি মূল দল আপন আপন উপদলগুলি নিয়ে বাহাত্তর দলে বিভক্ত হয়ে নিজেদের যুগে বাতিল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। যদিও আজকাল সেগুলির অধিকাংশের নামও অনেকের জানা নেই। (১)
বাহাত্তরটি বাতিল দলের বিভক্তির যে তফশীল উপরে দেয়া হল, তা তাফসীরে কামালাইন শরীফের বিবরণ অনুযায়ী। আবার সেই কামালাইন শরীফেই উক্ত বিবরণের পর উল্লেখ আছে, শরহে বেকায়া নামক কিতাবে মুয়াত্তালাকে মূল দল এবং জাহমিয়াকে তার উপদল গণ্য করা হয়েছে।
তেমনিভাবে উক্ত কিতাবে মুশাববিহাকে মূল দল এবং মুরজিয়াকে তার উপদল গণ্য করা হয়েছে। আবার কেউ কেউ মূল দলের সংখ্যা ছয়টির স্থলে বারটি বলেছেন, এবং প্রতিটি মূল দলের ছয়টি করে উপদল বলেছেন। আবার মাওয়াক্বিফ নামক গ্রন্থের লেখক সে কিতাবে বাহাত্তর দলের বিভক্তির বিবরণটা সম্পূর্ন ভিন্নভাবে দিয়েছেন। সেই বিবরণমতে মূল দলের সংখ্যা আটটা। যথা:-
১। মু’তাযিলা, এর উপদল ২০টা
২। শিয়া, এর উপদল ২২টা
৩। খারিজী, এর উপদল ২০টা
৪। মুরজিয়া, এর উপদল ৫টা
৫। নাজ্জারিয়া, এর উপদল ৩টা
৬। বাবরিয়া, (এর কোন উপদল নেই) ১টা
৭। মুশাববিহা, (এর কোন উপদল নেই) ১টা
৮। নাজিয়া, (এর কোন উপদল নেই) ১টা
মোট ৭৩টা
তন্মধ্যে শেষোক্তটা অর্থাৎ, নাজিয়া দলটাই আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’ত নামে পরিচিত। নাজিয়া অর্থ জাহান্নাম থেকে মুক্ত দল। শুধু এরাই সুন্নতে রাসূল ও জমা’তে সাহাবাকে আদর্শ মাপকাঠি মানার কারণে নাজিয়া বা জান্নাতী হিসেবে চিহ্নিত এবং আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’ত নামে পরিচিত।
(১) তাফসীরে কামালাইন শরীফ : ৩৬
৭২ দলের আরেক ব্যাখ্যা
মিশকাত শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ মিরকাত শরীফে (১) মাওয়াক্বিফ নামক কিতাবের বরাতে উল্লেখ আছে, বাতিল পন্থীদের মূল দল আটটা:-
১। মু’তাযিলা :- এদের কতিপয় আক্বীদা হল:-
(ক) বান্দা নিজেই তার কাজের স্রষ্টা।
(খ) আল্লাহকে কখনও দেখা যাবে না।
(গ) পুণ্যবান বান্দাকে পুরস্কার প্রদান অর্থাৎ, পরকালে জান্নাতে দেয়া, পাপী বান্দাকে জাহান্নামে দেয়া, আর যার পাপ-পুণ্য কিছুই নেই, (যেমন শৈশবে মৃত্যু বরণকারী, পাগল গং) তাকে জান্নাত, জাহান্নামের কোথায়ও না দেয়া ওয়াজিব। এ নিয়মের ব্যতিক্রম করলে আল্লাহর বিচারে বে- ইনসাফ হবে। এরা মোট বিশটা উপদলে বিভক্ত।
২। শিয়াঃ- এরা হযরত আলী রা.-এর ভালবাসায় সীমা লংঘনকারী। (এদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত সবচেয়ে কম ভ্রান্তিপূর্ণ উপদলের নাম যায়দিয়া। তাদের আক্বীদা হল, হযরত আলী রা. রাসূলের প্রথম খলীফা হওয়ার যোগ্য ছিলেন। কিন্তু তাঁকে সে পদে নিযুক্ত না করে তাঁর উপর অবিচার করা হয়েছে।) এরা মোট বাইশটি উপদলে বিভক্ত।
৩। খারিজী :-
(ক) এরা হযরত আলী রা.-এর শত্রুতায় সীমা লংঘন করে তাঁকে কাফির বলে।
(খ) এমনকি যে কোন মুসলমান কবীরা গুনাহ করলেই তাকে কাফির বলে। এদের উপদল বিশটা।
৪। মুরজিয়া :- এদের আক্বীদা হল, কাফিরগণ যেমন নেক আমলের দ্বারা জান্নাতে যেতে পারবে না, তেমনিভাবে মুমিনদেরও কোন গুনাহের কারণে জাহান্নামে যেতে হবে না। এদের উপদল পাঁচটা।
৫। নাজ্জারিয়া ৪- এরা সকল কাজের স্রষ্টা আল্লাহকে বিশ্বাস করার মাধ্যমে আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’তের সাথে একমত। কিন্তু-
(ক) আল্লাহ পাকের অনাদি-অনন্ত গুণাবলি অবিশ্বাস করা এবং
(খ) পবিত্র কুরআনকে নবরচিত বিশ্বাস করার কারণে মু’তাযিলাদের সাথে একমত। এদের উপদল তিনটি।
৬। জাবরিয়া :- এদের আন্দ্বীদা হল, বান্দার কোন কাজ করার ইচ্ছা শক্তিটুকু পর্যন্ত নেই। এদের কোন উপদল নেই।
৭। মুশাবিহা :- এদের আত্ত্বীদা হল,
(ক) আল্লাহ বান্দার মতই শরীর বিশিষ্ট এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিশিষ্ট।
(খ) সৃষ্টি যেমনভাবে কোন কিছুর মধ্যে প্রবেশ করতে বা কোন কিছুর মধ্যে মিশে যেতে পারে, তেমনটা আল্লাহর বেলায়ও হতে পারে। এদেরও কোন উপদল নেই।
উপরোক্ত সাতটি মূল দল বিভিন্ন উপদলসহ বাহাত্তর দল। এদের সবাই (আপন আপন আক্বীদা বিশ্বাসের বেলায় সুন্নতে রাসূল ও জমা’তে সাহাবাকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ না করায়) জাহান্নামী।
৮। নাজিয়া :- এদের সমস্ত আক্বীদা বিশ্বাস সুন্নতে রাসূল ও জমা’তে সাহাবার আদর্শমতে গৃহীত হওয়ায় আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’ত নামে পরিচিত (২)
আর নাজিয়াদের আক্বীদা সম্পর্কে তাফসীরে কামালাইনের বিবরণ হচ্ছে, হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা.-এর বর্ণনামতে নিম্নোক্ত আক্বীদাগুলি আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’তের আক্বাইদের অন্তর্ভুক্ত। যথাঃ-
১। হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. এবং হযরত উমর ফারুক রা.-কে মহানবীর উম্মতের মধ্যে যথাক্রমে সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদার অধিকারী বলে বিশ্বাস করা। তাঁদের পরে:-
২। হযরত উসমান রা. এবং হযরত আলী রা.-কে যথাক্রমে শ্রেষ্ঠ মর্যাদার অধিকারী বলে বিশ্বাস করা।
৩। বাইতুল হারাম (কাবা শরীফ) স্থায়ী কিবলা এবং বাইতুল মুকাদ্দাস বা মসজিদে আকসাকে অস্থায়ী কিবলা হিসেবে সম্মানিত বিশ্বাস করা।
৪। নেককার-বদকার নির্বিশেষে সকল মুসলমানের জানাযার নামাযকে জরুরি মনে করা।
৫। (সুযোগ থাকলে) নেককারের ইমামতিতে, আর (সুযোগ না থাকলে) ফাসিকের ইমামতিতেই জমা’তের সাথে নামায পড়াকে জরুরি মনে করা।
৬। ইনসাফগার শাসকের বিরুদ্ধে যেভাবে বিদ্রোহ করা নিষিদ্ধ, তেমনিভাবে (একটা নির্ধারিত অবস্থা পর্যন্ত) জালিম শাসকের বিরুদ্ধেও বিদ্রোহ করাকে নিষিদ্ধ মনে করা।
৭। ওযু করার সময় নির্দিষ্ট বিধানমতে চামড়ার মোজার উপর মাসেহ করাকে বৈধ মনে করা।
৮। ভাল-মন্দ তত্ত্বদীরের প্রতি বিশ্বাস রাখা।
৯। যে সব লোকের জান্নাতী বা জাহান্নামী হওয়ার কথা সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্টভাবে কুরআন সুন্নাহতে উল্লেখ নেই, এমন কাউকে নিশ্চিতভাবে জান্নাতী অথবা জাহান্নামী মনে না করা।
১০। নামায কায়েম করা এবং যাকাত আদায় করা। অর্থাৎ, এগুলিকে ফরয বলে বিশ্বাস করা।
প্রকাশ থাকা আবশ্যক যে, উপরোক্ত বিবরণে তেয়াত্তর দলের যে সমস্ত আক্বীদা বিশ্বাসের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলি শুধু উদাহরণ স্বরূপই উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ, এর অর্থ এ নয় যে, এগুলি ছাড়া এ সমস্ত দলের আর কোন আক্বীদা নেই; বরং এ ছাড়াও তাদের আরও ভিন্ন ভিন্ন অনেক আক্বীদা আছে। যেগুলি সবিস্তারে উল্লেখ করার সুযোগ এ পুস্তকে নেই।
আরও উল্লেখ্য যে, বাহাত্তরটি বাতিল দলের কোন কোন দলের কোন কোন আক্বীদা আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’তের আক্বীদার সাথে মিলে যায়। যেমন মুরজিয়াদের একটা আক্বীদা হল, কাফির কোন নেক আমলের দ্বারা কখনও জান্নাতে যেতে পারবে না। হুবহু এ আক্বীদাটাই আহলে সুন্নত ওয়াল জমাতেরও। এ ক্ষেত্রে কারো মনে হয়তো প্রশ্ন জাগতে পারে তাহলে তাদের মধ্যে আর আহলে সুন্নতের মধ্যে পার্থক্য রইল কোথায়?
এ প্রশ্নের জবাব হল, বাহাত্তর দলের কোন কোন আক্বীদা আহলে সুন্নতের অনুরূপ হলেও অন্যান্য আক্বীদার বেলায় পার্থক্য থাকার কারণে তাদের মধ্যে আর আহলে সুন্নতের মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান। যেমন, কাফিরগণ কোন নেক আমলের দ্বারা জান্নাতে যেতে পারবে না, এ আক্বীদায় মুরজিয়ারা আহলে সুন্নতের সাথে একমত হলেও, মুমিন কোন কবীরা গুনাহের কারণেই জাহান্নামে যাবে না, এ ভ্রান্ত আক্বীদার কারণে তারা আহলে সুন্নত থেকে আলাদা হয়ে গেছে।
এ ব্যাপারে আহলে সুন্নতের আক্বীদা হল, মুমিনও কবীরা গুনাহের কারণে অস্থায়ীভাবে জাহান্নামের শাস্তিযোগ্য হয়। আলোচ্য হাদীসই (হাদীসে ইফতেরাকে উন্মত) এর জ্বলন্ত প্রমাণ। বাকি রইল এ প্রশ্ন যে, পরবর্তীতে উদ্ভূত বিভিন্ন দলগুলি পূর্বোল্লিখিত দল সমূহের অন্তর্ভুক্ত না বহির্ভূত? এর জবাব পুস্তকের শেষের দিকে উল্লেখ করা হবে।
(১) মিরক্বাত শরহে মিশকাতঃ ১/৩৮১।
(২) এ পর্যন্ত মিরকাতের বিবরণ শেষ।
আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’তের পরিচয়
এবার আসা যাক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। আলোচ্য হাদীসে সাহাবাগণ রাসূলের কাছে বাহাত্তর দলের পরিচয় জিজ্ঞেস না করে শুধু একটিমাত্র জান্নাতী দলের পরিচয় জিজ্ঞেস করার কারণ পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁদের এ জিজ্ঞাসার জবাবে রাসূল বলেন:-
ما أنا عليه وأصحابي.
অর্থাৎ, যে মতাদর্শে আমি আছি, আর আমার সাহাবাগণ আছেন, সেই মতাদর্শে যারা অটল থাকবে। এর মর্ম হল, আমার সুন্নত এবং আমার সাহাবাগণের জমা’তের দ্বারা ইসলামের যেসব আক্বীদা বিশ্বাস প্রমাণিত, তাতে যারা অটল থাকবে, তারাই হবে জান্নাতী দল। আর এ কারণেই দলটা আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’ত নামে অভিহিত হয়েছে। যা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে।
এ মর্মে শরহে আক্বাইদে নাসাফী নামক কিতাবে উল্লেখ আছে:-
ما ورد به السنة ومضى عليه الجماعة، قسموا أهل السنة والجماعة.
অর্থাৎ, রাসূলের সুন্নত এবং সাহাবায়ে কেরামের জমা’ত দ্বারা প্রমাণিত আক্বীদায় বিশ্বাসী হওয়ার কারণেই দলটি আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’ত নামে অভিহিত হয়েছে। আর বাকি বাহাত্তর দলের মুসলমানরা বিভিন্ন আক্বীদা-বিশ্বাসে সুন্নতে রাসূল ও জমা’তে সাহাবার আদর্শ বর্জন করার কারণে পথভ্রষ্ট জাহান্নামী সাব্যস্ত হয়েছে।
এবার প্রশ্ন দাঁড়ায়, এখানে রাসূলের সুন্নত তরিকা এবং সাহাবায়ে কেরামের জমা’তের আদর্শ বলতে সুনির্দিষ্টভাবে কোন্ পদ্ধতিটা বুঝানো হয়েছে, যাকে ইসলামী আক্বীদা বিশ্বাসের বেলায় আদর্শরূপে গণ্য করায় আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’ত জান্নাতী সাব্যস্ত হল এবং বর্জন করায় বাকি বাহাত্তর দলের মুসলমান জাহান্নামী সাব্যস্ত হল?
এ প্রশ্নের মীমাংসা এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, এটা পরিষ্কার না হলে একদিকে বাতিলপন্থীরাও নিজেদের আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’ত বলে দাবি করার সুযোগ পাবে এবং অন্যদিকে খাঁটি আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’তের অনুসারীরাও নিজেদের হকপন্থী বলে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করতে পারবে না। কারণ সমস্ত বাতিলপন্থী মুসলমানই নিজেদের বাতিল মতবাদের পক্ষে পবিত্র কুরআন হাদীস দ্বারা দলীল পেশ করে থাকে।
এ পর্যায়ে দেখতে হবে, এদের পেশকৃত দলীলগুলোর যে ব্যাখ্যা তারা দিচ্ছে সেই ব্যাখ্যা সুন্নতে রাসূল এবং জমা’তে সাহাবার দ্বারা সমর্থিত কি না। যাদের পেশকৃত দলীলের ব্যাখ্যা সুন্নতে রাসূল ও জমা’তে সাহাবার দ্বারা সমর্থিত হবে, তাদের দলীলই বিশুদ্ধ বলে গণ্য হবে। আর যাদের দলীলের ব্যাখ্যা এ দু’টি আদর্শ মাপকাঠি দ্বারা সমর্থিত হবে না, তাদের দলীলই ভ্রান্ত সাব্যস্ত হবে।
সুতরাং এ ভ্রান্তির কবল থেকে আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’তকে সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করার জন্য রাসূলের সুন্নত তরিকা এবং জমা’তে সাহাবার আদর্শ বলতে কোন পদ্ধতিটা বুঝানো হয়েছে তা খুব পরিষ্কারভাবে চিহ্নিত হওয়ার গুরুত্ব অপরিসীম।
এ মর্মে শরহে আক্বাইদে নাসাফী নামক কিতাবে উল্লেখ আছে:-
والنصوص من الكتاب والسنة تحمل على ظواهرها مالم يصرف عنها دليل قطعي.
অর্থাৎ, পবিত্র কুরআন-হাদীসের ভাষ্যকে ততক্ষণ পর্যন্ত তার বাহ্যিক অর্থেই ব্যবহার করতে হবে, যতক্ষণ না ভিন্ন কোন ব্যাখ্যাস্বাপেক্ষ অর্থে ব্যবহারের পক্ষে অকাট্য কোন দলীল পাওয়া যাবে । (১)
কোন বিষয়ে কুরআন-হাদীস দ্বারা দলীল পেশ করার ক্ষেত্রে এটাই রাসূলের সুন্নত তরিকা এবং জমা’তে সাহাবার আদর্শ।
প্রকাশ থাকা আবশ্যক যে, উপরোক্ত নীতি কেবল সে ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যে ক্ষেত্রে পবিত্র কুরআনের কোন সুস্পষ্ট বিবরণ সম্বলিত আয়াত অথবা রাসূলের সুস্পষ্ট বিবরণ সম্বলিত সহীহ হাদীস (২) দ্বারা দলীল পেশ করা হবে।
পক্ষান্তরে যদি আয়াতের বিবরণ অস্পষ্ট বা ব্যাখ্যা সাপেক্ষ হয়, তাহলে আয়াতের ব্যাখ্যায় রাসূলের সুন্নাহ বা এমন সহীহ হাদীস পেশ করতে হবে, যা ব্যাখ্যাহীন বা সুস্পষ্ট অর্থবোধক। আর যদি সহীহ্ হাদীসও অস্পষ্ট অর্থবোধক বা ব্যাখ্যাসাপেক্ষ হয়, তাহলে সে ক্ষেত্রে হাদীসের ব্যাখ্যায় জমা’তে সাহাবার সমর্থন পেশ করতে হবে।
অনুরূপভাবে কুরআন বা হাদীসে যে বিষয়ের সুস্পষ্ট সমাধান পাওয়া যায় না, সে বিষয়ের সমাধানও জমা’তে সাহাবার দ্বারা হলে তা ইসলামের বিশুদ্ধ আক্বীদা হিসেবে গণ্য হতে পারে ।(১) এটাই আক্বীদা বিশ্বাসের বেলায় কোন মুসলমানের আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’তের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার দলীলভিত্তিক নিয়ম।
এক কথায়, যে বিষয় পবিত্র কুরআনে অনুল্লেখিত বা অস্পষ্টভাবে বর্ণিত, তা রাসূলের সুন্নাহ বা সহীহ হাদীসের বিবরণ বা বিশ্লেষণে, আর যে বিষয় সহীহ হাদীসে অনুল্লেখিত বা অস্পষ্টভাবে বর্ণিত, তা জমা’তে সাহাবা দ্বারা ব্যক্ত বা বিশ্লেষিত হলে তা বিশ্বাস করাই হবে আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’তের পরিচয়। এভাবে কুরআনের ব্যাখ্যা সুন্নাহ দ্বারা, আর সুন্নাহর ব্যাখ্যা জমা’তে সাহাবা দ্বারা গ্রহণকারী দলই হবে আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’ত।
আর যে বিষয় পবিত্র কুরআন অথবা রাসূলের সুন্নাহতে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখিত, সে বিষয়কে দলীল হিসেবে গ্রহণের বেলায় আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’তের মূলনীতি হল, যতক্ষণ পর্যন্ত এর ভিন্ন কোন ব্যাখ্যা অকাট্য দলীল দ্বারা প্রমাণিত হবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত এর বাহ্যিক অর্থই গৃহীত হবে।
উল্লেখ্য যে, যে মুত্তাসিল হাদীসের সনদের প্রত্যেক বর্ণনাকারীই পূর্ণ “আদালত” ও “ঘবত” গুণ সম্পন্ন এবং হাদীসটি “শুযুষ” ও “ইল্লত” দোষ মুক্ত, হাদীস শাস্ত্রের পরিভাষায় সে হাদীসকে সহীহ হাদীস বলে। দ্রঃ হাদীসের তত্ত্ব ও ইতিহাসঃ ৭।
(১) যেমন রাসূল সা.-এর পর তাঁর প্রথম খলীফা কে হবেন তা কুরআন-সুন্নাহতে পরিষ্কার ভাবে উল্লেখ না থাকায় জমা’তে সাহাবা কর্তৃক সমর্থিত হওয়ায় হযরত আনু বকর সিদ্দীকু রা.-কে রাসূলের প্রথম খলীফা হওয়ার যোগ্য বলে বিশ্বাস করা আহলে সুন্নতের আক্বীদা সাব্যস্ত হয়েছে।
কিন্তু যে ক্ষেত্রে অকাট্য দলীল দ্বারা এর ভিন্ন কোন ব্যাখ্যা প্রমাণিত হবে, সে ক্ষেত্রে কুরআন সুন্নাহর বাহ্যিক অর্থের পরিবর্তে প্রমাণিত ব্যাখ্যা গ্রহণ করাই হবে আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’তের পরিচায়ক। কারণ এটাই সুন্নতে রাসূল এবং জমা’তে সাহাবার অনুসৃত নীতি।
যেমন রাফিযীদের একটা উপদলের নাম বাতিনিয়া। এরা জান্নাতের বিবরণ সম্বলিত আয়াত ও হাদীস সমূহকে এর বাহ্যিক অর্থে গ্রহণ না করে বলে যে, পার্থিব জীবনে শরীয়তের বিধান পালনের কষ্ট থেকে মুক্তি লাভের নাম জান্নাত। অর্থাৎ, জান্নাত শব্দটাকে কুরআন সুন্নায় বর্ণিত বাহ্যিক অর্থে গ্রহণ না করে উপরোক্ত ভ্রান্ত ব্যাখ্যা মতে গ্রহণ করে। এভাবে তারা জাহান্নাম, ওষু, গোসল ইত্যাদি শব্দকে কুরআন সুন্নাহতে বর্ণিত বাহ্যিক অর্থে গ্রহণ না করে বিভিন্ন ভ্রান্ত ব্যাখ্যায় গ্রহণ করে। এদের দলের আরও বিভিন্ন নাম আছে। যেমন ইসমাঈলিয়া, কারামাতিয়া ইত্যাদি । (৩)
অথচ এসব শব্দকে শরীয়তের বাহ্যিক অর্থে ব্যবহার না করে ভিন্ন কোন ব্যাখ্যায় গ্রহণ করা সুন্নতে রাসূল এবং জমা’তে সাহাবার দ্বারা প্রমাণিত নয়। উপরন্তু এ সমস্ত ভ্রান্ত ব্যাখ্যা মুজতাহিদগণের ইজমার পরিপন্থী হওয়ায় কুফ্রিও বটে।
তেমনিভাবে মুরজিয়া দল ও তাদের অনুরূপ কিছু লোকের ভ্রান্ত আক্বীদা হচ্ছে, বান্দার অন্তরে যখন আল্লাহর চূড়ান্ত মহব্বত লাভ হয়ে যায়, তার অন্তর পরিষ্কার হয়ে যায় এবং কুফ্র এর পরিবর্তে খাঁটিভাবে অন্তরে ঈমান রাখে, তখন তাদের উপর থেকে শরীয়তের বিধি নিষেধ রহিত হয়ে যায়। তখন তাদের এবাদত বলতে বাহ্যিক নামায রোযা ইত্যাদি বুঝায় না; বরং আল্লাহর ধ্যানমগ্নতাই বুঝাবে। এমতাবস্থায় মদ পান করলে এমনকি যিনা ব্যভিচার করলেও কোন গুনাহ হবে না। (৪)
এ জন্যই মুরজিয়াদের মতে বিয়ে ছাড়াই নারীদেরে উপভোগ করাতে কোন পাপ নেই। এরাও পবিত্র কুরআন হাদীসের দ্বারাই দলীল পেশ করে থাকে। যেমন পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন:-
وَاعْبُدْ رَبَّكَ حَتَّى يَأْتِيَكَ الْيَقِينُ
অর্থাৎ, ইয়াক্বীন বা দৃঢ় বিশ্বাস অর্জন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এবাদত কর (৫)
এখানে তারা খাঁটি অন্তরে ঈমান আনয়নকেই ইয়াক্বীন বা দৃঢ় বিশ্বাস বলে থাকে। অথচ সমস্ত মুফাসসিরই এখানে “ইয়াক্বীন” এর ব্যাখ্যা করেছেন মৃত্যু। অর্থাৎ, মৃত্যু পর্যন্ত আল্লাহর এবাদতে অটল থাক। এভাবে তারা একটা হাদীস দ্বারা দলীল পেশ করে, যে হাদীসে রাসূল বলেছেনঃ-
إذا أحب الله تعالى عبدا لم يضره ذنب.
অর্থাৎ, আল্লাহ যখন কোন বান্দাকে ভাল বাসেন, তখন কোন গুনাহ তার ক্ষতি করতে পারে না। এ ব্যাপারে প্রথম কথা হল, হাদীসটা সহীহ সনদ দ্বারা প্রমাণিত নয়। (৬)
দ্বিতীয় কথা হল, একটু সময়ের জন্য প্রমাণিত ধরে নিলেও “কোন গুনাহ তার কোন ক্ষতি করতে পারবে না” কথার মর্ম হল, আল্লাহ তাকে গুনাহ থেকে বাঁচিয়ে রাখবেন, অর্থাৎ, সে আর কোন গুনাহর কাজই করবে না। যার ফলে সে গুনাহর ক্ষতি থেকে নিরাপদ থাকবে।(৭)
আবার কোন কোন হাদীস এবং আয়াতের বাহ্যিক অর্থ দাঁড়ায়, আল্লাহ আসমানে আছেন, কোন আয়াতের বাহ্যিক অর্থ হয়, আল্লাহ আরশের উপর আরোহণ করেছেন, কোন আয়াতের বাহ্যিক অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর হাত আছে, আর কোন আয়াতের বাহ্যিক অর্থ হয়, আল্লাহ হাশরের মাঠে আসবেন।
কিন্তু অন্যান্য অকাট্য দলীল দ্বারা (৮) প্রমাণিত যে, আল্লাহর দেহ, অঙ্গ- প্রত্যঙ্গ, আকার-আকৃতি এবং আসা-যাওয়া নেই। সুতরাং এ ধরনের আয়াত ও হাদীস বাহ্যিক অর্থে ব্যবহৃত না হয়ে বিশেষ ব্যাখ্যা স্বাপেক্ষে ব্যবহৃত হবে। এটাই আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’তের নীতি।
কিন্তু বাতিলপন্থীরা এ নীতি লংঘন করে পবিত্র কুরআন হাদীসের বাহ্যিক বরাতে দলীল পেশ করে থাকে। যার ফলে ওই সমস্ত মুসলমানের মধ্যে মারাত্মক বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়, যারা রাসূলের সুন্নত তরিকা ও সাহাবাগণের জমা’তের আদর্শ বলতে কোন্ নীতি বুঝানো হয়েছে তা জানে না। তাই এ সমস্ত সরলপ্রাণ সাধারণ মুসলমান কুরআন-হাদীসের উদ্ধৃতি দেখলেই (তা কোন বাতিল দলের পক্ষ থেকেই হোক না কেন) মনে করে, তাদের পক্ষেও কুরআন-হাদীসের দলীল আছে।
এভাবে জনসাধারণকে ধোঁকা দেয়ার অপকৌশলটা প্রায় সময়ই কাজে লাগিয়ে থাকে আমাদের সমাজের সুন্নী নামধারী রেজভীরা। তাই এদের খপ্পর থেকে ঈমান বাঁচাবার জন্যই রাসূলের সুন্নত তরিকা এবং সাহাবাগণের জমা’তের আদর্শ বলতে কোন নীতিটা বুঝানো হয়েছে, তা পরিষ্কারভাবে জেনে রাখা দরকার। আর যারা এ নীতি লঙ্ঘন করে কুরআন হাদীসের দলীলের নামে জনগণকে ধোঁকা দিয়ে থাকে শেষ বিচারের দিন আল্লাহর দরবারে তাদের রেহাই হবে না। কারণ এরা শুধু নিজেরাই পথভ্রষ্ট নয়; বরং আন্যদেরও পথভ্রষ্টকারী। আর অপকে পথভ্রষ্ট করার মানেই হল বান্দার হজ্ব নষ্ট করা। যা আল্লাহ মাফ করেন না।
(১) শরহে আক্বাইদে নাসাফী: ১১৯।
(২) কারণ হাদীস শাস্ত্রের পরিভাষায় যেসব হাদীস সহীহ্ নয় সেসব হাদীস দ্বারা
আহলে সুন্নাত ওয়াল জমা’তের আক্বীদা প্রমাণিত হয় না। =
(৩) জাওয়াহিরুল ফারাইদ: ৬৪৮।
(৪) নিবরাস: ৩৩৬।
(৫) সূরায়ে হিজর : ৯৯।
(৬) নিবরাস: ৩৩৬।
(৭) শরহে আকাইদ: ১১৯।
(৮) যেমনঃ ليس كمثله شيء অর্থাৎ, আল্লাহর সাথে সৃষ্ট জগতের কোন কিছু তুলনীয় নয়। সূরায়ে শুরাঃ ১১।
Leave a Reply