1. info@izharehaq.com : MZakir :
রবিবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ১১:২৫ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
মুখোশ উন্মোচন (মওদূদী মতবাদ) আহলে সুন্নতের ফিক্বাহ শাস্ত্রের ইমাম: ইসলামী আমলের ক্ষেত্রে বিদয়াতীদের চক্রান্ত আহলে সুন্নতের আক্বীদামতে মহানবীর মর্যাদা: অতি ভক্তি কিসের লক্ষণ রেজভীদের চক্রান্ত হুবহু ইবনে সাবার চক্রান্তের মত: রাসূলকে আলিমুল গাইব বলা সাবায়ী চক্রান্ত: আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’ত সুবিন্যস্ত হওয়ার ইতিহাস কুরআন ও হাদীসের ভাষায় ছিরাতে মুস্তাক্বীম বা সোজা পথ: নবুওয়াত ও রিসালত: মওদুদীবাদ ইবাদত: মওদুদীবাদ কুরআন মাজীদ ও দ্বীনের সংরক্ষণ: কুরআন সংরক্ষণের অর্থ: কুরআন সংরক্ষণে খোদায়ী ব্যবস্থাপনা: মওদুদীবাদ দ্বীন কী? দ্বীনে নূহ: দ্বীনে ইব্রাহীম: দ্বীনে ইসমাঈল: দ্বীনে ইউসুফ: দ্বীনে মূসা: দ্বীনে ঈসা: মওদূদীবাদ মওদুদী সাহেবের শিক্ষা-দীক্ষার পরিধি গোয়েবলসীয় নীতি : হিটলারের ঐ মুখপাত্রও ”জামাত-শিবিরের মিথ্যাচারের কাছে হার মানায়”: পর্ব ১ ইক্বামাতে দ্বীনের তাৎপর্য এবং বাতিলপন্থীদের বিকৃত ব্যাখ্যা সাহাবাগণ রাঃ সত্যের মাপকাঠি এবং তাদের ইজমা সর্বসিদ্ধান্ত মতে শরীয়তের দলীল সাহাবা রাঃ গণ সত্যের মাপকাঠি খোলাফায়ে রাশেদীনগণের সোনালী আদর্শ সর্বসম্মতিক্রমে শরিয়তের দলীল শায়খ আলিমুদ্দীন দুর্লভপুরী”র ঐতিহাসিক ও তাত্বিক বক্তব্য: “তাঁরাই সত্যের মাপকাঠি” শায়খ আলিমুদ্দীন দুর্লভপুরী”র ঐতিহাসিক ও তাত্বিক বক্তব্য: সাহাবায়ে কেরাম “সত্যের মাপকাঠি: মিয়ারে হক: সত্যের মাপকাঠি: কুরআন-হাদীস এবং মওদূদী সাহিত্যের আলোকে: পর্ব-৬ মিয়ারে হক: সত্যের মাপকাঠি: কুরআন-হাদীস এবং মওদূদী সাহিত্যের আলোকে: পর্ব-৫

আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’ত সুবিন্যস্ত হওয়ার ইতিহাস

মাওলানা নূরুল ইসলাম ওলীপুরী
  • আপডেট সময় : মঙ্গলবার, ২৮ মে, ২০২৪
  • ১০৮ বার পড়া হয়েছে

আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’ত সুবিন্যস্ত হওয়ার ইতিহাস



এ ইতিহাস সংক্ষিপ্তভাবে হলেও অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে “শারহুল আঝাইদিন নাসাফিয়া” নামক কিতাবে। যাকে সংক্ষেপে শরহে আকাইদও বলা হয়। এ কিতাবের বিষয়বস্তু হচ্ছে, আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’তের আন্দ্বীদা-বিশ্বাস।
দীর্ঘদিন থেকে এ কিতাবটি আমাদের দেশের সরকারী এবং কওমী উভয় প্রকার মাদ্‌রাসার পাঠ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এ কিতাবের লিখকের নাম, আল্লামা মাসউদ বিন উমর বিন আব্দুল্লাহ এবং তাঁর উপাধি, সা’দুদ্দীন তাফতাযানী, সংক্ষেপে আল্লামা তাফতাযানী র.। তাঁর জন্ম ৭১২ হিজরী সনে এবং ওফাত ৭৯২ হিজরী সনে (১)
তিনি তাঁর অমর গ্রন্থ শরহে আক্বাইদ এর ভূমিকায় লেখেন ৪-
وقد كانت الأوائل من الصحابة والتابعين – رضوان الله تعالى عليهم اليمن – نصفاء عقائدهم بركة صحبة النبي – صلى الله عليه وسلم – وقرب العهد بزمانه، ولقلة الوقائع والاختلافات، وتمكنهم من المراجعة إلى الثقات مستفدين عن تدوين العلمين، وترتيبهما أبوابا وفصولاً، وتقرير مقاصدهما فروعا وأصولا
অর্থাৎ, সাহাবায়ে কেরাম রা. এবং তাবেঈন র.-এর যুগে(২) তাঁদের আত্মাইদ পরিষ্কার ছিল। কারণ তাঁরা ছিলেন রাসূলের বর্কতময় সংশ্রবে অথবা তাঁর নিকট অতীতকালের পরশে ধন্য। এ ছাড়া তাঁদের যুগে সমস্যাবলি এবং মতভেদ ছিল খুব কম। তদুপরি বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য আলিমগণের কাছ থেকে সরাসরি সমাধান পাওয়ার পর্যাপ্ত সুযোগ ছিল।

(১) সশরুল ফাওয়াইস ১১০।
(২) রাসূলের সান্নিধ্য লাভে ধন্য মুমিনকে এক বহনে সাহাবী আর বহু বচনে সাহাবা এবং সাহাবাগণের সান্নিধ্যলাভে ধন্য মুমিনগণকে এক বচনে তাবিয়ী ও বহুবচনে তাবিয়ীন বলা হয়।

তাই তাঁদের যুগে ইলমে আত্মাইদ বা ইসলামী আক্বীদা বিশ্বাস বিষয়ক জ্ঞান এবং ইলমে ফিক্বাহ বা ইসলামী কার্যকলাপ বিষয়ক জ্ঞানকে সুবিন্যস্ত ভাবে লিপিবদ্ধ করা, বিভিন্ন অধ্যায় ও পরিচ্ছেদে বিভক্ত করা এবং এর মৌলিক ও আনুষঙ্গিক উদ্দেশ্যাবলিকে প্রমাণিত করার তেমন একটা প্রয়োজন ছিল না।
আল্লামা তাফতাযানী অতঃপর লেখেন:-
إلى أن حدثت الفتن بين المسلمين، والبغي على أئمة الدين، وظهر اختلاف الآراء، والميل إلى البدع والأهواء، وكثرت الفتاوى والواقعات، والرجوع إلى العلماء في المهمات، فاشتغلوا بالنظر والاستدلال والاجتهاد والاستنباط، وتمهيد القواعد والأصول، وترتيب الأبواب والفصول، وتكثير المسائل بأدلتها، وإيراد الشبه بأجوبتها، وتعيين الأوضاع والاصطلاحات، وتبيين المذاهب والاختلافات.
অর্থাৎ, শেষ পর্যন্ত যখন মুসলমানদের মধ্যে বিভিন্ন দুর্ঘটনা সংঘটিত হতে লাগল, ধর্মীয় ইমামগণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হল, পরস্পরের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হল, মানুষের মন কুসংস্কার ও কুপ্রবৃত্তির দিকে আকৃষ্ট হতে শুরু করল, সমস্যাসম্বলিত ঘটনাবলি ও সেগুলির সমাধানের আধিক্য এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহের সমাধানের জন্য আলিমগণের সরণাপন্ন হওয়ার আধিক্য দেখা দিল, তখন তাঁরা গভীর চিন্তা-ভাবনার সাথে দলীল প্রমাণ পেশ করা, ইজতিহাদ (বিশেষ গবেষণা) এর মাধ্যমে সমাধান বের করা, মৌলিক নীতিমালা নির্ধারণ করা, বিষয়গুলিকে বিভিন্ন অধ্যায় ও পরিচ্ছেদে বিন্যস্ত করা, সমাধানগুলিকে অধিক পরিমাণে দলীল প্রমাণ দ্বারা সমৃদ্ধ করতঃ বিভিন্ন সন্দেহের উত্থাপন করে সেগুলির জবাব দেয়া, শিরোনাম ও পরিভাষাসমূহ সাব্যস্ত করা এবং বিভিন্ন মাযহাব বা মতাদর্শ এবং সেগুলির পার্থক্য বর্ণনা করার প্রতি মনোনিবেশ করলেন।
আল্লামা তাফতাযানী র. তারপর লেখেন:-
وستموا ما يفيد معرفة الأحكام العملية عن أدلتها التفصيلية بالفقه، و معرفة أحوال الأدلة إجمالا في إفادتها الأحكام بأصول الفقه، ومعرفة العقائد عن أدلتها التفصيلية بالكلام
অর্থাৎ, আর তাঁরা ইসলামী আমল বা কার্যকলাপের বিধিবিধান বিস্তারিত দলীল প্রমাণ দ্বারা জানাকে ইলমে ফিক্বাহ্, এর মূলনীতিকে উসূলে ফিকাহ্ এবং ইসলামী আক্বীদা-বিশ্বাস বিস্তারিত দলীল-প্রমাণ দ্বারা জানাকে ইলমে কালাম নামে নামকরণ করলেন। আকাইদ শাস্ত্রবিদগণের দু’টি স্তর আছে। প্রাথমিক যুগের আক্বাইদ শাস্ত্রবিদ এবং পরবর্তী যুগের আক্বাইদ শাস্ত্রবিদ। এ দু’টি স্তরের কর্মপদ্ধতিগত পার্থক্য হল, প্রাথমিক যুগের আক্বাইদ শাস্ত্রবিদগণের মুকাবেলা হয়েছিল মুসলমানদের মু’তাযিলা, শিয়া, খারিজী ইত্যাদি বাতিল দলসমূহের সাথে, যারা আক্বাইদের বেলায় কুরআন হাদীসকেই দলীল হিসেবে অবলম্বন করত। কিন্তু সুন্নতে রাসূল ও জমা’তে সাহাবার ব্যাখ্যার পরিবর্তে নিজেদের ব্যাখ্যামতে। তাই প্রথম যুগের আক্বাইদ শাস্ত্রবিদগণও সে সব বাতিলপন্থীর মুকাবেলায় পবিত্র কুরআন-সুন্নাহকেই দলীল হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তবে নিজেদের ব্যাখ্যামতে নয়; বরং সুন্নতে রাসূল ও জমা’তে সাহাবার ব্যাখ্যামতে। হযরত ইমাম আবু হানীফা র.-প্রণীত কিতাব “আল-ফিকহুল আকবার” এ দৃষ্টিভঙ্গিতেই লিখিত ।(১)
আর আকাইদ শাস্ত্রবিদদের দ্বিতীয় স্তরের অর্থাৎ, পরবর্তীগণের মুকাবিলা হয়েছিল ওই সব বাতিলপন্থীদের সাথে, যারা দর্শনকে দলীল হিসেবে ব্যবহার করে। মু’তাযিলারাও পরবর্তীতে এ পদ্ধতি অবলম্বন করে। তাই এ স্তরের আকাইদ শাস্ত্রবিদগণও বাতিলপন্থীদের মুকাবিলায় পবিত্র কুরআন সুন্নাহর সাথে সাথে দর্শনকেও দলীল হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
আল্লামা তাফতাযানী র. অতঃপর লেখেন:-
ومعظم خلافياته مع الفرق الإسلامية، خصوصا المعتزلة؛ لأنهم أول فرقة أسسوا قواعد الخلاف لما ورد به ظاهر السنة وجرى عليه جماعة الصحابة . رضوان الله عليهم أجمعين في باب العقائد.
অর্থাৎ, প্রথম স্তরের আক্বাইদ শাস্ত্রবিদদের বিশেষভাবে মুকাবিলা হয়েছে বাতিল মতবাদী মুসলমানদের সাথে। বিশেষত মু’তাযিলাদের সাথে।

(১) নশরুল ফাওয়াইদঃ ১৭

কারণ এরাই বাতিল মতবাদী মুসলমানদের এমন প্রথম দল, যারা আক্বাইদের ব্যাপারে সুন্নতে রাসূল ও জমা’তে সাহাবার পরিপন্থী নীতিমালা প্রণয়ন করেছে।
মু’তাযিলা নামক এ বাতিল দলটির উৎপত্তির বিবরণ দিয়ে আল্লামা তাফতাযানী র. লেখেন:-
وذلك لأن رئيسهم واصل بن عطاء اعتزل عن مجلس الحسن البصري – رحمه الله ويقرر أن من ارتكب الكبيرة ليس بمؤمن ولا كافر ويثبت المنزلة بين المنزلتين، فقال الحسن: قد اعتزل عنا، قسموا المعتزلة.
অর্থাৎ, ওয়াসিল বিন আতা নামক এক ব্যক্তি হযরত ইমাম হাসান বসরী র.-এর দরবার থেকে পৃথক হয়ে গিয়ে প্রচার করতে লাগল, যে ব্যক্তি কোন কবীরা গুনাহ (১) করে সে মুমিনও থাকে না, কাফিরও হয় না। এ ভাবে সে মু’মিন ও কাফিরের মধ্যবর্তী আরেকটা স্তর সৃষ্টি করে আরেকটা ভ্রান্ত মতবাদের উদ্ভাবন করল। তার ব্যাপারে হযরত হাসান বসরী র. বলেন, সে আমাদের থেকে (অর্থাৎ, আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’তের মতাদর্শ থেকে) পৃথক হয়ে গেল। তাই তার দলের নাম হল মু’তাযিলা, অর্থাৎ, পৃথক দল।
এই ওয়াসিল বিন আতা ছিল হযরত ইমাম হাসান বসরীর একজন শিষ্য। এমতাবস্থায় একদা হাসান বসরীর দরবারে বসা অবস্থায় এক ব্যক্তি এসে হযরত ইমাম হাসান বসরীকে প্রশ্ন করল, বর্তমান যুগে এক দল মানুষ কবীরা গুনাহে লিপ্ত ব্যক্তিকে কাফির বলে। আরেক দল বলে, কোন গুনাহর কারণে মুসলমানের কোন সাজাই হবে না। এ ব্যাপারে আপনি কি বলেন?

(১) যেসব গুনাহের কারণে দুনিয়াতে বা আখেরাতে শাস্তির ব্যবস্থা আছে অথবা লা’নতের উল্লেখ আছে সেগুলিকে কবিরা গুনাহ বলা হয়। আর যেসব গুনাহের কারণে শাস্তি বা লা’নতের উল্লেখ নাই সেগুলিকে সগীরা গুনাহ বলা হয়। আবার সগীরা গুনাহ অবজ্ঞার সাথে করলে অথবা বার বার করলে সেটাও কবীরা গুনাহে পরিণত হয়। দ্রঃ তাফসীরে মা’য়ারিফুল কুরআন: ২/৩৮৫।

হযরত ইমাম হাসান বসরী র. প্রশ্নকারীর জবাব দেয়ার আগেই ওয়াসিল বিন আতা বলে উঠল, কবীরা গুনাহগার মুমিনও নয়, কাফিরও নয়। এ কথা বলে সে হাসান বসরীর দরবার ত্যাগ করে মু’তাযিলী মতবাদের সূত্রপাত করে। (১)
এই মুতাযিলা নামক বাতিল দলটির মুকাবিলা করতে গিয়েই আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’তের আকাইদকে দলীল ভিত্তিকভাবে সুবিন্যস্ত করার তীব্র প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল। এর বিবরণ দিয়ে আল্লামা তাফতাযানী র.
লেখেন:-
ثم أنهم توغلوا في الكلام، وتشبئوا بأذيال الفلاسفة في كثير من الأصول والأحكام، وشاع مذهبهم فيما بين الناس.
অর্থাৎ, শেষ পর্যন্ত মু’তাযিলারা আক্বাইদের বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি শুরু করল এবং ইসলামী আক্বীদা ও আমল প্রমাণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দর্শনের চটকদার যুক্তি দ্বারা মানুষকে প্ররোচনা দিতে লাগল। এভাবে মু’তাযিলা মতবাদ সমাজে ছড়িয়ে পড়ল।
আল্লামা তাফতাযানী র. অতঃপর লেখেন:-
إلى أن قال الشيخ أبو الحسن الأشعري لأستاذه أبي علي الجبائي: ما تقول في ثلاثة إخوة: مات أحدهم مطيعا والآخر عاصيا والثالث صغيرا؟
অর্থাৎ, অবশেষে একদা শাইখ আবুল হাসান আশয়ারী তাঁর উস্তাদ আবু আলী জুব্বায়ীকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি সেই তিন ভাইয়ের ব্যাপারে কী বলেন, যাদের এক ভাই বয়স্ক হয়ে সাওয়াবের কাজ করে মৃত্যু বরণ করল, আর দ্বিতীয় ভাই বয়স্ক হয়ে গুনাহর কাজ করে মৃত্যু বরণ করল, এবং তৃতীয় ভাই শিশুকালে মারা গেল? উত্তরে জুব্বায়ী বলেন:-
إن الأول يثاب في الجنة، والثاني يعاقب بالنار، والثالث لا يثاب و لا يعاقب
অর্থাৎ, প্রথম ভাইকে জান্নাতের শাস্তি দেয়া হবে। দ্বিতীয় ভাইকে জাহান্নামের শাস্তি দেয়া হবে। আর তৃতীয় ভাইকে জান্নাতের শান্তিও দেয়া হবে না, জাহান্নামের শাস্তিও দেয়া হবে না।

(১) নিবরাসঃ ১৯।

তখন আশয়ারী র. বললেন:-
فإن قال الثالث: يا رب ا لم أمتني صغيرا، وما أبقيتني إلى أن أكبر، فأومن بك وأطيعك فأدخل الجنة؟ فماذا يقول الرب؟
অর্থাৎ, তখন তৃতীয় ভাই যদি আল্লাহর কাছে জানতে চায়, হে আল্লাহ! আমাকে শিশুকালে মৃত্যু দিয়ে ঈমান-আমলের মাধ্যমে জান্নাত লাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করলেন কেন? তখন আল্লাহ তাকে কী বলবেন?
উত্তরে জুব্বায়ী বলেন:-
يقول الرب إني كنت أعلم منك لوكبرت لعصيت، فدخلت النار، فكان الأصلح لك أن تموت صغيرا.
অর্থাৎ, আল্লাহ বলবেন, আমি তোমার চেয়ে অধিক জ্ঞানী। আমি জানতাম, তোমাকে দীর্ঘজীবন দান করলে, তুমি বড় হয়ে গুনাহ করে জাহান্নামে যাবে। তাই তোমাকে শিশুকালে মৃত্যু দিয়ে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করে অপেক্ষাকৃত অধিক উপকার করেছি।
আশয়ারী বলেন:-
فإن قال الثاني: يا رب ! لم لم تمتني صغيرا لأن لا أعصي لك، فلا أدخل النار؟ فماذا يقول الرب؟
অর্থাৎ, তখন যদি তাদের দ্বিতীয় ভাই আল্লাহর কাছে জানতে চায়, হে আল্লাহ! আমার ছোট ভাইয়ের মত আমাকেও কেন শিশুকালে মৃত্যু দিয়ে জাহান্নাম থেকে বাঁচালেন না? তখন আল্লাহ কী বলবেন?
মু’তাযিলী পণ্ডিত জুব্বায়ী এ প্রশ্নের কোন জবাব দিতে পারলেন না। এর পরবর্তী অবস্থার বিবরণ দিয়ে আল্লামা তাফতাযানী র. লেখেন:-
فبهت الجبائي، وترك الأشعري مذهبه، فاشتغل هو ومن تبعه بإبطال رأي المعتزلة، وإثبات ما ورد به السنة ومضى عليه الجماعة، فسموا أهل السنة والجماعة.
অর্থাৎ, জুব্বায়ী যখন আর কোন উত্তর দিতে পারলেন না, তখন হযরত আবুল হাসান আশয়ারী র. ও তাঁর অনুসারীগণ জুব্বায়ীর মতবাদ বর্জন করতঃ তা খণ্ডনে এবং সুন্নতে রাসূল ও জমা’তে সাহাবার মতাদর্শ প্রমাণে ব্রতী হলেন। তাই এ মতাদর্শে বিশ্বাসীগণ আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’ত নামে অভিহিত হলেন (১)
উপরোক্ত ঘটনার মূল কেন্দ্রবিন্দুটা অনুধাবন করার জন্য আহলে সুন্নত ও মু’তাযিলাদের মধ্যকার আক্বীদাগত বিশেষ দু’টি পার্থক্য স্মরণ থাকা দরকার। এর একটা হল, আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’তের আক্বীদা মতে হাশরের বিচারে আল্লাহ পুণ্যবানকে জাহান্নামে দিলে, অথবা পাপীকে ক্ষমা করে জান্নাতে দিলে, আর নাবালককে জান্নাত জাহান্নামের যে কোনটায় দিলে আল্লাহর বিচারে কোন বে-ইনসাফী হবে না। (এর দলীল ভিত্তিক আলোচনা পরে করা হবে।)
কিন্তু মু’তাযিলাদের আক্বীদামতে পুণ্যবানকে জান্নাতে, পাপীকে জাহান্নামে এবং নাবালককে “আ’রাফে” দিলেই শুধু আল্লাহর বিচারে ইনসাফ হবে। আর এর ব্যতিক্রম করলেই হবে বে-ইনসাফী।
আর দ্বিতীয় পার্থক্যটা হল, আহলে সুন্নতের আক্বীদামতে দুনিয়ার জীবনে বান্দাকে যেভাবে পরিচালনা করলে তার উপকার হবে, সেভাবে পরিচালনা করা আল্লাহর জন্য ওয়াজিব নয়; বরং শুধু উপকারের পথ প্রদর্শনই আল্লাহর জন্য যথেষ্ট। কারণ এখানে তিনি বান্দাকে পরীক্ষার জন্য পাঠিয়েছেন। তাই পরীক্ষায় পাশ করার পথে চলতে বাধ্য করে দিলে এটা আর পরীক্ষাই থাকে না।
পক্ষান্তরে মু’তাযিলাদের আক্বীদামতে বান্দাকে শুধু মঙ্গলের পথ প্রদর্শন করলেই আল্লাহর দায়িত্ব শেষ হয় না; বরং তাকে মঙ্গলের পথে পরিচালনা করা আল্লাহর উপর ওয়াজিব।
এ ব্যাপারে উস্তাদ আবু আলী জুব্বায়ীর সাথে ছাত্র আবুল হাসান আশয়ারীর মতানৈক্য চলছিল পূর্ব থেকেই। ইতোমধ্যে দু’টি ঘটনা ঘটে গেল। একটা বাহ্যিক, আরেকটা আধ্যাত্মিক। বাহ্যিক ঘটনাটা হল, উপরোক্ত আশয়ারী-জুব্বায়ীর বিতর্কের ঘটনা। যাতে ছাত্র আশয়ারীর কাছে উস্তাদ জুব্বায়ী শোচনীয়ভাবে হেরে গেলেন। আর জুব্বায়ী হেরে গেলেন মানেই আশয়ারীর কাছে মু’তাযিলী আক্বীদা প্রমাণিত না হয়ে, আহলে সুন্নতের আক্বীদাই উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

(১) শরহে আক্বাইদে নাসাফী: ৬।

তাই উক্ত বিতর্কের ঘটনা তাঁর জীবন সাধনায় আমূল পরিবর্তন এনে দিল। এ পরিবর্তন ঘটার পিছনে আরেকটা আধ্যাত্মিক ঘটনা ক্রিয়াশীল ছিল। আর তা হল, মহা সৌভাগ্যের পরিচায়ক এক স্বপ্নের ঘটনা। যে স্বপ্নযোগে স্বয়ং রাসূলে করীম সা. তাঁকে আহলে সুন্নত ওয়াল জমাজের সন্ধান দিয়েছিলেন। সেই স্বপ্নের ঘটনাটা নিম্নে তাঁর সাংক্ষিপ্ত জীবনীসহ আলোচনা করা হচ্ছে।



আহলে সুন্নতের আক্বাইদের ইমামদ্বয়ের পরিচয়


উপরোক্ত ঘটনার নায়ক হযরত আবুল হাসান আয়ারী এবং তাঁর সাথে হযরত আবু মনসূর মাতুরিদীকে মুসলিম বিশ্ব আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’তের আক্বীদা বা ইলমে আক্বাইদের ইমাম হিসেবে বরণ করে নিয়েছে। তন্মধ্যে আশয়ারীর পূর্বোক্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করেই ইলমে কালামের সুবিন্যাসের কাজ শুরু হয় এবং ইমাম মাতুরিদীও এ কাজে বিশেষ ভূমিকা রাখেন।
ইমাম আশয়ারীর নাম আলী বিন ইসমাঈল। উপনাম আবুল হাসান। বংশগত পরিচয় আশয়ারী। যেহেতু তিনি বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবু মুসা আশ্বারী রা.-এর বংশে জন্মগ্রহণ করেছেন, তাই তাঁর বংশগত পরিচয় আশয়ারী। তিনি ২৭০ হিজরী সনে বসরায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ষাট বৎসর বয়সে ৩৩০ হিজরী সনে বাগদাদে ইনতিকাল করেন।
তিনি প্রথম জীবনে আবু আলী আব্দুল ওয়াহহাব জুব্বায়ী মু’তাযিলীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করতঃ মু’তাযিলী মতবাদের পৃষ্ঠপোষকতায় দীর্ঘ চল্লিশ বৎসর অতিবাহিত করে মু’তাযিলীদের ইমাম গণ্য হতে যাচ্ছিলেন। এদিকে আল্লাহ পাকের ইচ্ছা ছিল তিনি আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’তের ইমাম হবেন। এমতাবস্থায় একদিন স্বপ্নে দেখেন, হযরত রাসূলে করীম সা. তাঁকে বলছেন :-
انصر المذاهب المروية عني؛ فإنها الحق.
অর্থাৎ, যে সব মতাদর্শ আমার থেকে বর্ণিত সেগুলির সহযোগিতা কর; কারণ এগুলিই সাঠিক। তিনি একাধারে তিনদিন একই স্বপ্ন দেখেন। ফলে একদিন তিনি বসরার মসজিদে গিয়ে মু’তাযিলী মতবাদ বর্জনের ঘোষণা দিয়ে তার খণ্ডন এবং আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’ত প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করেন। আক্বাইদের বেলায় তিনি নিজে ইমাম হলেও ফিক্বাহর বেলায় তিনি ইমাম শাফেয়ী র.-এর অনুসারী ছিলেন ।(১)
ইমাম মাতুরিদীর নাম মুহাম্মদ বিন মুহাম্মদ বিন মাহমুদ। তিনি সমরকন্দের অন্তর্গত মাতুরীদ নামক এক জনপদের বাসিন্দা ছিলেন। সুতরাং মাতুরিদী শব্দটা তাঁর বাসস্থানের পরিচায়ক। তিনি যথাক্রমে দু’জন উস্তাদের মাধ্যমে ইমাম আবু ইউসুফ এবং ইমাম মুহাম্মদ র.-এর ছাত্র। তিনি ৩৩৩ হিজরী সনে ইনতিকাল করেন। কিতাবুত তাওহীদ, কিতাবুল মাকালাত, তাবীলাতুল কুরআন, কিতাবুল জাদাল ইত্যাদি তাঁর অমরগ্রন্থ। (২)
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, হযরত ইমাম আবু হানীফা র. আক্বাইদের কিতাব লেখা সত্ত্বেও ফিক্বাহ শাস্ত্রে তাঁর অবদান বেশি হওয়ায় ফিক্বাহর ইমাম হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন। আর ইমাম আশয়ারী এবং ইমাম মাতুরিদী র. ফিকাহর ক্ষেত্রে যথাক্রমে ইমাম শাফেয়ী র. এবং ইমাম আবু হানীফা র.-এর অনুসারী হওয়া সত্ত্বেও আকাইদের ক্ষেত্রে তাঁদের অবদান বেশি হওয়ায় আক্বাইদের ইমাম গণ্য হয়েছেন।
প্রকাশ থাকা আবশ্যক যে, জনৈক রেজভী তার “হেদায়েত ও গুমরাহী” নামক পুস্তিকার ৫০ পৃষ্ঠায় রেজা খাঁনকে সারা দুনিয়ার আহলে সুন্নত ওয়াল জমাতের ইমাম বলে আখ্যায়িত করেছে। এটা জ্বলন্ত মিথ্যা এবং রেজভীদের ধোঁকা বৈ আর কিছু নয়।
উপরোক্ত বিবরণে এ কথা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, সারা দুনিয়ার আহলে সুন্নত ওয়াল জমাতের আক্বাইদের ইমাম হচ্ছেন, ইমাম আবুল হাসান আশয়ারী র. এবং ইমাম আবু মনসূর মাতুরিদী র.।

(১) নশরুল ফাওয়াইদ: ৯।
(২) নশরুল ফাওয়াইদ: ১০।



আহলে সুন্নতের আক্বাইদের কিতাব



হযরত ইমাম আবু হানীফা র. (১) আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’তের আমল সংক্রান্ত বিষয়সমূহ বা ফিক্বাহর বড় ইমাম (ইমামে আযম) হিসেবে সুখ্যাত হওয়া সত্ত্বেও আহলে সুন্নতের আক্বীদা সংক্রান্ত বিষয়েও তাঁর লিখিত বহু কিতাব রয়েছে। তন্মধ্যে “আল ফিক্বহুল আকবার” একটি। আর সারা বিশ্বে হানাফী মাযহাবের প্রসিদ্ধ ভাষ্যকার আল্লামা মুল্লা আলী আল-ক্বারী র. লিখিত উক্ত কিতাবের ব্যাখ্যা গ্রন্থের নাম, “শারহুল ফিকহিল আকবার”।
পরবর্তীতে ইমাম আশয়ারী র. ও ইমাম মাতুরিদী র.-এর অনুসরণে আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’তের আক্বীদা বিষয়ে আরও অনেক কিতাবাদি লেখার সূত্র চালু হয়ে আসছে। যদিও খাইরুল কুরুন অর্থাৎ, ইসলামের অনুসরণীয় তিন যুগ থেকেই এর সূত্রপাত হয়েছে। (২)
আহলে সুন্নতের সেই সব প্রামাণ্য কিতাবের একটা, ইমাম আবু হানীফা র. প্রণীত ফিক্বহে আকবর। আরেকটা, তার ব্যাখ্যাগ্রন্থ পূর্বোক্ত শরহে ফিক্বহে আকবর। আহলে সুন্নতের আক্বাইদের উপর হযরত ইমাম আবু হানীফা র. আরও কিতাবদি লিখেছেন। যেমন, ১। ফিক্বহে আবসাত, ২। কিতাবুল আলিম ওয়াল মুতায়া’ল্লিম, ৩। কিতাবুল ওসীয়ত, ৪। রিসালা ফিল ইস্তিতাআ’ত ইত্যাদি।
ইমাম তাহাবী র. হানাফী মাযহাবের ইমামগণের মধ্যে পৃথিবী বিখ্যাত একজন ইমাম। (৩) তাঁর লিখিত আহলে সুন্নতের আক্বীদার কিতাব এবং এর বিভিন্ন ব্যাখ্যাগ্রন্থ বর্তমান বিশ্বে আহলে সুন্নতের সকল মুসলমানের কাছে প্রামাণ্য ও সমাদৃত। এছাড়া বাংলাদেশের সকল কওমী মাদ্রাসা এবং আলিয়া মাদ্রাসায় আহলে সুন্নতের আক্বীদা বিষয়ক যে কিতাবটি দীর্ঘদিন থেকে পাঠ্যতালিকার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, তার নাম শরহে আক্বাইদে নাসাফী। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, এ দেশের রেজভীরা বৃটিশ আমল থেকেই নানারকম বিদয়াতী কর্মকাণ্ডে এমনকি শিরকি আক্বীদায় লিপ্ত হয়েও নিজেদেরকে আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’ত বলে প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছে।

(১) জন্মঃ ৮০ হিজরী, ওফাত: ১৫০ হিজরী।
(২) সাহাবাহ, তাবিয়ীন ও তাবে তাবিয়ীনের যুগকে খাইরুল কুরুন বলা হয়।
৩) জন্মঃ প্রসিদ্ধ মতে ২২৯ হি.. ওফাত: ৩২১ হি.। 

এরা আহলে সুন্নতের প্রামাণ্য কিতাবাদিতে যেসব কথার নাম গন্ধও নেই শুধু যে এমনসব কথাই মনগড়াভাবে উদ্ভাবন করতঃ আহলে সুন্নতের আক্বীদা বলে চালিয়ে যাচ্ছে তাই নয়; বরং যেসব আক্বীদা বিশ্বাসকে আহলে সুন্নতের আক্বীদার কিতাবে শিরক ও কুফ্র বলা হয়েছে, সেগুলিকেই আহলে সুন্নতের আক্বীদা বলে পাল্টা প্রচার করতঃ সরল মুসলমান সমাজের সাথে প্রতারণা করে বেড়াচ্ছে। নিম্নে এর একটা উদাহরণ পেশ করছি।


আহলে সুন্নতের আক্বীদায় গাইব জানেন কে?


ইমাম আবু হানিফা র. লিখিত “ফিক্বহে আকবর” এর ব্যাখ্যাগ্রন্থ “শরহে ফিক্বহে আকবর “(১) এ উল্লেখ আছে:-
وذكر الحنفية تصريحا بالتكفير باعتقاد أن النبي عليه الصلوة والسلام يعلم الغيب المعارضة قوله تعالى: قُلْ لا يَعْلَمُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ الْغَيْبَ إلا الله.
অর্থাৎ, হানাফী মাযহাবের ইমামগণ এ কথা পরিষ্কার ভাবে উল্লেখ করেছেন যে, মহানবী সা. গাইব জানেন বলে বিশ্বাস করা কুফ্রি আক্বীদা। কারণ এ আক্বীদা পবিত্র কুরআনের সেই আয়াতের প্রকাশ্য বিরোধী যাতে আল্লাহ মহানবীকে বলেন যে, আপনি বলে দিন, আসমান জমিনের (নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের) কোন বাসিন্দাই গাইব জানে না, একমাত্র আল্লাহ ছাড়া (২)

(১) পূর্ণ নাম- শারহু কিতাবিল ফিত্বহিল আকবার, পৃঃ ২২৫।
(২) সূরায়ে নামাল: ৬৫।


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ ক্যাটাগরির আরো
© All rights reserved © 2019 www.izharehaq.com
Theme Customized BY Md Maruf Zakir