উপরোক্ত ঘটনার মূল কেন্দ্রবিন্দুটা অনুধাবন করার জন্য আহলে সুন্নত ও মু’তাযিলাদের মধ্যকার আক্বীদাগত বিশেষ দু’টি পার্থক্য স্মরণ থাকা দরকার। এর একটা হল, আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’তের আক্বীদা মতে হাশরের বিচারে আল্লাহ পুণ্যবানকে জাহান্নামে দিলে, অথবা পাপীকে ক্ষমা করে জান্নাতে দিলে, আর নাবালককে জান্নাত জাহান্নামের যে কোনটায় দিলে আল্লাহর বিচারে কোন বে-ইনসাফী হবে না। (এর দলীল ভিত্তিক আলোচনা পরে করা হবে।)
কিন্তু মু’তাযিলাদের আক্বীদামতে পুণ্যবানকে জান্নাতে, পাপীকে জাহান্নামে এবং নাবালককে “আ’রাফে” দিলেই শুধু আল্লাহর বিচারে ইনসাফ হবে। আর এর ব্যতিক্রম করলেই হবে বে-ইনসাফী।
আর দ্বিতীয় পার্থক্যটা হল, আহলে সুন্নতের আক্বীদামতে দুনিয়ার জীবনে বান্দাকে যেভাবে পরিচালনা করলে তার উপকার হবে, সেভাবে পরিচালনা করা আল্লাহর জন্য ওয়াজিব নয়; বরং শুধু উপকারের পথ প্রদর্শনই আল্লাহর জন্য যথেষ্ট। কারণ এখানে তিনি বান্দাকে পরীক্ষার জন্য পাঠিয়েছেন। তাই পরীক্ষায় পাশ করার পথে চলতে বাধ্য করে দিলে এটা আর পরীক্ষাই থাকে না।
পক্ষান্তরে মু’তাযিলাদের আক্বীদামতে বান্দাকে শুধু মঙ্গলের পথ প্রদর্শন করলেই আল্লাহর দায়িত্ব শেষ হয় না; বরং তাকে মঙ্গলের পথে পরিচালনা করা আল্লাহর উপর ওয়াজিব।
এ ব্যাপারে উস্তাদ আবু আলী জুব্বায়ীর সাথে ছাত্র আবুল হাসান আশয়ারীর মতানৈক্য চলছিল পূর্ব থেকেই। ইতোমধ্যে দু’টি ঘটনা ঘটে গেল। একটা বাহ্যিক, আরেকটা আধ্যাত্মিক। বাহ্যিক ঘটনাটা হল, উপরোক্ত আশয়ারী-জুব্বায়ীর বিতর্কের ঘটনা। যাতে ছাত্র আশয়ারীর কাছে উস্তাদ জুব্বায়ী শোচনীয়ভাবে হেরে গেলেন। আর জুব্বায়ী হেরে গেলেন মানেই আশয়ারীর কাছে মু’তাযিলী আক্বীদা প্রমাণিত না হয়ে, আহলে সুন্নতের আক্বীদাই উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
(১) শরহে আক্বাইদে নাসাফী: ৬।
তাই উক্ত বিতর্কের ঘটনা তাঁর জীবন সাধনায় আমূল পরিবর্তন এনে দিল। এ পরিবর্তন ঘটার পিছনে আরেকটা আধ্যাত্মিক ঘটনা ক্রিয়াশীল ছিল। আর তা হল, মহা সৌভাগ্যের পরিচায়ক এক স্বপ্নের ঘটনা। যে স্বপ্নযোগে স্বয়ং রাসূলে করীম সা. তাঁকে আহলে সুন্নত ওয়াল জমাজের সন্ধান দিয়েছিলেন। সেই স্বপ্নের ঘটনাটা নিম্নে তাঁর সাংক্ষিপ্ত জীবনীসহ আলোচনা করা হচ্ছে।
আহলে সুন্নতের আক্বাইদের ইমামদ্বয়ের পরিচয়
উপরোক্ত ঘটনার নায়ক হযরত আবুল হাসান আয়ারী এবং তাঁর সাথে হযরত আবু মনসূর মাতুরিদীকে মুসলিম বিশ্ব আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’তের আক্বীদা বা ইলমে আক্বাইদের ইমাম হিসেবে বরণ করে নিয়েছে। তন্মধ্যে আশয়ারীর পূর্বোক্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করেই ইলমে কালামের সুবিন্যাসের কাজ শুরু হয় এবং ইমাম মাতুরিদীও এ কাজে বিশেষ ভূমিকা রাখেন।
ইমাম আশয়ারীর নাম আলী বিন ইসমাঈল। উপনাম আবুল হাসান। বংশগত পরিচয় আশয়ারী। যেহেতু তিনি বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবু মুসা আশ্বারী রা.-এর বংশে জন্মগ্রহণ করেছেন, তাই তাঁর বংশগত পরিচয় আশয়ারী। তিনি ২৭০ হিজরী সনে বসরায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ষাট বৎসর বয়সে ৩৩০ হিজরী সনে বাগদাদে ইনতিকাল করেন।
তিনি প্রথম জীবনে আবু আলী আব্দুল ওয়াহহাব জুব্বায়ী মু’তাযিলীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করতঃ মু’তাযিলী মতবাদের পৃষ্ঠপোষকতায় দীর্ঘ চল্লিশ বৎসর অতিবাহিত করে মু’তাযিলীদের ইমাম গণ্য হতে যাচ্ছিলেন। এদিকে আল্লাহ পাকের ইচ্ছা ছিল তিনি আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’তের ইমাম হবেন। এমতাবস্থায় একদিন স্বপ্নে দেখেন, হযরত রাসূলে করীম সা. তাঁকে বলছেন :-
انصر المذاهب المروية عني؛ فإنها الحق.
অর্থাৎ, যে সব মতাদর্শ আমার থেকে বর্ণিত সেগুলির সহযোগিতা কর; কারণ এগুলিই সাঠিক। তিনি একাধারে তিনদিন একই স্বপ্ন দেখেন। ফলে একদিন তিনি বসরার মসজিদে গিয়ে মু’তাযিলী মতবাদ বর্জনের ঘোষণা দিয়ে তার খণ্ডন এবং আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’ত প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করেন। আক্বাইদের বেলায় তিনি নিজে ইমাম হলেও ফিক্বাহর বেলায় তিনি ইমাম শাফেয়ী র.-এর অনুসারী ছিলেন ।(১)
ইমাম মাতুরিদীর নাম মুহাম্মদ বিন মুহাম্মদ বিন মাহমুদ। তিনি সমরকন্দের অন্তর্গত মাতুরীদ নামক এক জনপদের বাসিন্দা ছিলেন। সুতরাং মাতুরিদী শব্দটা তাঁর বাসস্থানের পরিচায়ক। তিনি যথাক্রমে দু’জন উস্তাদের মাধ্যমে ইমাম আবু ইউসুফ এবং ইমাম মুহাম্মদ র.-এর ছাত্র। তিনি ৩৩৩ হিজরী সনে ইনতিকাল করেন। কিতাবুত তাওহীদ, কিতাবুল মাকালাত, তাবীলাতুল কুরআন, কিতাবুল জাদাল ইত্যাদি তাঁর অমরগ্রন্থ। (২)
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, হযরত ইমাম আবু হানীফা র. আক্বাইদের কিতাব লেখা সত্ত্বেও ফিক্বাহ শাস্ত্রে তাঁর অবদান বেশি হওয়ায় ফিক্বাহর ইমাম হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন। আর ইমাম আশয়ারী এবং ইমাম মাতুরিদী র. ফিকাহর ক্ষেত্রে যথাক্রমে ইমাম শাফেয়ী র. এবং ইমাম আবু হানীফা র.-এর অনুসারী হওয়া সত্ত্বেও আকাইদের ক্ষেত্রে তাঁদের অবদান বেশি হওয়ায় আক্বাইদের ইমাম গণ্য হয়েছেন।
প্রকাশ থাকা আবশ্যক যে, জনৈক রেজভী তার “হেদায়েত ও গুমরাহী” নামক পুস্তিকার ৫০ পৃষ্ঠায় রেজা খাঁনকে সারা দুনিয়ার আহলে সুন্নত ওয়াল জমাতের ইমাম বলে আখ্যায়িত করেছে। এটা জ্বলন্ত মিথ্যা এবং রেজভীদের ধোঁকা বৈ আর কিছু নয়।
উপরোক্ত বিবরণে এ কথা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, সারা দুনিয়ার আহলে সুন্নত ওয়াল জমাতের আক্বাইদের ইমাম হচ্ছেন, ইমাম আবুল হাসান আশয়ারী র. এবং ইমাম আবু মনসূর মাতুরিদী র.।