এদের কুচক্রান্তসমূহের একটা হল, সম্মান করার বাহানায় “মহানবী আলিমুল গাইব” বলাকে সুন্নী আক্বীদা নাম দিয়ে শিরকি ও কুফরি আক্বীদার প্রচলন করা। কারণ আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে আলিমূল গাইব হওয়াকে একমাত্র তাঁর বৈশিষ্ট্যপূর্ণ গুণ বলে আখ্যায়িত করেছেন, ভাই রাসূলকে আলিমুল গাইব বলা যে সুন্নী আক্বীদা নয়; বরং কুফ্রি ও শিরকি আক্বীদা, তা বলাই বাহুল্য।
এতদ সত্ত্বেও আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’তের ইমাম ও মনীষীগণ আহলে সুন্নতের কিতাবাদিতে পবিত্র কুরআনের আয়াত ও রাসূলের সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণ করেছেন যে, গাইব জানা একমাত্র আল্লাহপাকের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ গুণ, বিধায় রাসূল সা. বা অন্য কাউকে আলিমুল গাইব বিশ্বাস করা কুরি। যা শরহে ফিক্বহে আকবর কিতাবের বরাতে পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে।
সাথে সাথে যেসব বিষয়কে কেন্দ্র করে বাতিলপন্থীরা রাসূল বা অন্য কাউকে আলিমুল গাইব প্রমাণ করার অপচেষ্টা করতে পারে সেগুলির পরিষ্কার জবাবও উল্লেখ করেছেন। যেমন, শরহে আক্বাইদ নামক কিতাবে উল্লেখ আছে:-
وبالجملة، العلم بالغيب أمر تفرد به الله – تعالى – لاسبيل إليه للعباد إلا با علام منه، أو إلهام بطريق المعجزة والكرامة، وإرشاد إلى الاستدلال بالأمارات فيما يمكن فيه ذلك، ولهذا ذكر في الفتاوى، أن قول القاتل عند رؤية هالة القمر : يكون مطر، مدعيا علم الغيب لا بعلامته كفر.
অর্থাৎ, সারকথা হচ্ছে, ইলমে গাইব (গাইব জানা) এমন এক বিষয় যা একমাত্র আল্লাহ পাকের বৈশিষ্টা, যার অধিকারী হওয়ার কোন অবকাশ বান্দার নেই। অবশ্য আল্লাহ ওবণী অথবা এলহ্যামের মাধ্যমে নবীগণকে মু’জিনা হিসেবে এবং এলবামের মাধ্যমে ওলীগণকে কারামাত হিসেবে যা কিছু অগাজ করেন, অথবা বাজনাসমূহ দ্বারা প্রমাণ করার মত বিষয়সমূহকে প্রমান করার যে পথ প্রদর্শন করেন সেগুলির কথা ভিন্ন।
এ জনই ফতোয়ার কিতাবাদিতে উল্লেখ আছে, চন্দ্রের চতুর্দিকে চক্রাকারে মেষ দেখে যদি কেউ এটাকে বৃষ্টি হওয়ার লাক্ষণ না বলে গাইব জানার দাবি করে বলে যে, বৃষ্টি হবে, তাহলে এটা তার কুরি কথা হবে (১)
এখানে ওহী, এলহাম, লক্ষন ইত্যাদির মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর বান্দাকে যা কিছু অবগগত করেন সেগুলিকে ব্যাডিলাপন্থীদের পক্ষে ইলমে গাইবের অন্তর্ভুক্ত করার কোন সুযোগ নেই। কারণ এগুলি সম্পর্কে শরহে আত্মাইদের ব্যাখ্যাগ্রাহ ‘নিবরাস” এ উল্লেখ আছে:-
والتحقيق، أن الغيب ما غاب عن الحواس والعلم الضروري والعلم الاستدلالي، وقد نطق القرآن بقي علمه عمن سواه تعالى، فمن ادعى الله يعلمه كفر، ومن صدق المدعي كفر، وأما ما علم بحاسة أو ضرورة أو دليل فليس بغيب، ولا كفر في دعواه
অর্থাৎ, গাইব এর তত্ত্বপূর্ণ সংজ্ঞা হল, যা কিছু ইন্দ্রিয় শক্তি, স্বভাবগত মেধাশক্তি এবং দলীল প্রমাণ দ্বারা জানা যায় না, তা-ই গাইব। আর পবিত্র কুরআন এ কথা পরিষ্কার ভাষায় ঘোষণা দিয়েছে, একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কেউই গাইব জানে না। সুতরাং একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ গাইব জানার দাবি করলে সেতো কাফির হবেই, যারা তাকে বিশ্বাস করবে, তারাও কাফির হবে।
আর যা কিছু ইন্দ্রিয় শক্তি, স্বভাবগত মেধাশক্তি অথবা দলীল প্রমাণ দ্বারা জানা যায়, তা গাইব নয়। সুতরাং তা জানার দাবি করা কুফরি নয় (২)
(১) শরহে আত্মাইীদ: ১২২।
(২) নিররাস: ৩৪৩।
অতঃপর উক্ত কিতাবের একই পৃষ্ঠায় আরো উল্লেখ আছে :-
بهذا التحقيق الدفع الإشكال في الأمور التي يزعم أنها من الغيب وليست منه لكونها مدركة بالسمع أو البصر أو الضرورة أو الدليل، فأحدها أخبار الأنبياء؛ لأنها مستفادة من الوحي.
অর্থাৎ, উপরোক্ত তাত্ত্বিক আলোচনার দ্বারা এমন প্রশ্নেরও নিরসন হয়ে গেল, যা ওই সব বিষয়ে জাগতে পারে যেগুলিকে গাইব মনে করা হয়, অথচ সেগুলি আসলে গাইব নয়। কারণ এগুলি হয়ত ইন্দ্রিয় শক্তির মাধ্যমে অথবা মেধাশক্তির মাধ্যমে অথবা দলীলের মাধ্যমে জানা যায়। এগুলোর ১ম প্রকার হল, নবীগণের প্রদত্ত সংবাদ। এগুলি যেহেতু ওহীর মাধ্যমে জানা যায়, তাই এগুলি গাইব নয়।
সারমর্ম হল, আল্লাহ তাঁর বান্দাকে কোন কিছুর মাধ্যমে যা জানতে দেন, যেমন সাধারণ মানুষ ইন্দ্রিয় শক্তির মাধ্যমে, বুদ্ধিমান মেধাশক্তির মাধ্যমে, সাধারণ মুসলমান আলিমগণের মাধ্যমে, আলিমগণ শরীয়তের দলীলের মাধ্যমে বা নবীর মাধ্যমে, ওলীগণ কাল্ফ ও এলহামের মাধ্যমে এবং নবীগণ ওহীর মাধ্যমে যা জানেন তা গাইব নয়।
সুতরাং এসব বিষয় জানাকে গাইব জানা বলা ভুল। এর মধ্যে সর্বোচ্চ মাধ্যম হল ওহী। ওহীর মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর নবীগণকে যা জানান, তার নাম গাইব জানা নয়। অথচ কবর, হাশর, পুলসিরাত, জান্নাত, জাহান্নাম ইত্যাদি যেহেতু নবীগণকে ওহীর মাধ্যমে জানানো হয়, তাই নবীকে গাইব জাননে ওয়ালা বলা যাবে না।
এখানে এসে যদি নিতান্ত চাপাবাজি করেই কেউ নবীকে আলিমুল গাইব বলে, তাহলে এসব বিষয় তো নবীর মাধ্যমে উম্মতও জানে। তাই এবার উম্মতকে কী বলা যাবে? যদি বলা হয়, এসব বিষয় জানার কারণে উম্মতও আলিমুল গাইব হবে, এমতাবস্থায় নবীকে আলিমুল গাইব বলে তো তাঁকে আলাদা কোন মর্যাদা দেয়া হল না; বরং উম্মতের সমান সাব্যস্ত করা হল।
আর যদি বলা হয়, এগুলি নবীর মাধ্যমে জানার কারণে উম্মত আলিমুল গাইব হয়নি, তাহলে নবীও তো এগুলি ওহীর মাধ্যমেই জানতে পেরেছেন। তাই তিনি আলিমুল গাইব হলেন কিভাবে?
এসব কূটতর্কের অবসান ঘটিয়ে আক্বাইদের কিতাবাদিতে পরিষ্কার ভাবেই বলা হয়েছে, এগুলি জানাকে গাইব জানা বলে না; বরং কোন কিছুর মাধ্যম ছাড়া যিনি এসব জানেন কেবল তিনিই আলিমুল গাইব। যা একমাত্র আল্লাহ পাকের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ গুণ।
তাই শরহে ফিক্বহে আকবর নামক আক্বাইদের কিতাবে বলা হয়েছে, যারা বিশ্বাস করবে নবীয়ে করীম সা. গাইব জানেন, তারা কাফির। যা উদ্ধৃতি সহ পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। আরও লক্ষ্যণীয় ব্যাপার যে, এ কথাটা হযরত ইমাম আবু হানীফা র.-এর নিজস্ব ইজতেহাদ বা ব্যক্তিগত গবেষণাজনিত কথা নয়; বরং এটা পবিত্র কুরআনের সূরায়ে নামাল এর ৬৫নং আয়াতের সুস্পষ্ট ঘোষণা।
আল্লাহ বলেনঃ-
قُلْ لا يَعْلَمُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ الْغَيْبَ إِلَّا اللَّهُ.
অর্থাৎ, হে রাসূল, আপনি বলে দিন, আসমান জমিনের কোন বাসিন্দাই গাইব জানে না, একমাত্র আল্লাহ ছাড়া।
সুতরাং এরপরও নবীর প্রতি অতিভক্তি দেখাতে গিয়ে নবী গাইব জানেন বলার মানেই হল সাবায়ী যুক্তির মাধ্যমে পবিত্র কুরআনের এ আয়াত অবিশ্বাস করা।
এতো পরিষ্কার কথা আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’তের আক্বাইদের কিতাবে উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও এর বিরুদ্ধে জেরা করে আবার নিজেকে সুন্নী বলে দাবি করা জঘন্যতম চাপাবাজি এবং সাবায়ী চক্রান্ত ছাড়া আর কী হতে পারে?