এ পুস্তকের মূল আলোচ্য বিষয়, আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’তের আক্বাইদ। আহলে সুন্নতের আকাইদ শাস্ত্রের দু’ইমাম যথাক্রমে ইমাম আবুল হাসান আশয়ারী এবং ইমাম আবু মনসূর মাতুরিদী র.-এর নাম ও তাঁদের সংক্ষিপ্ত জীবনী পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে।
আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’তের আরেকটা আলোচ্য বিষয় হচ্ছে, আমল সংক্রান্ত। যাকে পারিভাষিক অর্থে ফিক্বাহ শাস্ত্র (ইলমুল ফিক্বহ) বলা হয়। ফিক্বাহ শাস্ত্রের কোন বিষয় প্রমাণিত হওয়ার দলীল চারটি। যথাক্রমেঃ-
৪। ক্বিয়াসুল মুজতাহিদীন বা মুজতাহিদ ইমামগণের ক্বিয়াস (অর্থাৎ, বিশেষ গবেষণালব্ধ অনুমান)।
এই ফিক্বাহ শাস্ত্র বা এর দলীলসমূহ যেহেতু এ পুস্তকের মূল আলোচ্য বিষয় নয়, তাই সেগুলির ব্যাপারে সবিস্তারে আলোচনা করার সুযোগ এখানে নেই। এখানে শুধু এতটুকু উল্লেখ করতে চাই যে, আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’তের আক্বাইদের পূর্বোল্লেখিত দুই ইমামের নাম জানার পর কারো মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে, চার মাযহাবের চার ইমাম কোন্ বিষয়ের ইমাম? এর জবাব হল, তাঁরা ইলমুল ফিক্বহ বা ফিক্বাহ শাস্ত্রের ইমাম। তাঁরা হচ্ছেন যথাক্রমে:-
১। হযরত ইমাম আবু হানীফা র. জন্ম- ৮০ হি. ওফাত- ১৫০ হি.।
২। হযরত ইমাম শাফেয়ী র. জন্ম- ১৫০ হি. ওফাত- ২০৪ হি.।
৩। হযরত ইমাম মালিক র. জন্ম- ৯৩ হি. ওফাত- ১৭৯ হি.।
৪। হযরত ইমাম আহমদ র. জন্ম- ১৬৪ হি. ওফাত-২৪১হি.।
তাঁদের চার জনের নামেই চারটি মাযহাব যথাক্রমে হানাফী, শাফেয়ী, মালিকী ও হাম্বলী প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এ চারটি মাযহাবই হজ্ব। যা পূর্বেও উল্লেখ করা হয়েছে।
কারণ সহীহ বোখারী শরীফে উল্লেখ আছে :-
إذا اجتهد الحاكم فأصاب فله أجران، وإذا اجتهد فأخطأ فله أجر واحد.
অর্থাৎ, বিচারক “ইজতিহাদ” করে রায় দিতে গিয়ে যদি সঠিক রায় দিতে সক্ষম হন, তাহলে দু’টি সাওয়াব পাবেন। আর যদি ভুল করেন তবুও একটি সাওয়াব পাবেন (১) অনুরূপ বর্ণনা আবু দাউদ এবং তিরমিযী শরীফেও আছে। এ মর্মে শরহে আক্বাইদে উল্লেখ আছে, মুজতাহিদ যদি তাঁর সমস্ত শর্তাবলি(২) পালনের মাধ্যমে ইজতিহাদ করেন তাহলে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে না পারলেও সওয়াব পাবেন।
এ মর্মে হাদীস শরীফে আছে:-
قال عليه السلام: إن أصبت فلك عشر حسنات، وإن أخطأت فلك حسنة واحدة. وفي حديث آخر، جعل للمصيب أجرين وللمخطي أجرا واحدا.
অর্থাৎ, রাসূলে করীম সা. বলেন, যদি তুমি সঠিক সিদ্ধান্তে পৌছুতে পার, তাহলে দশটি সাওয়াব পাবে। আর যদি ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হও, তবুও একটি সাওয়াব পাবে। অন্য হাদীসে রাসূল সা. বলেন, সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত মুজতাহিদের জন্য দু’টি সাওয়াব, আর বেঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত মুজতাহিদের জন্য একটি সাওয়াব রয়েছে । (৩)
সুতরাং ইজতিহাদগত মত পার্থক্যের কারণে চার মাযহাবের যে কোন মাযহাব পালনেই সাওয়াব আছে। কাজেই কোন মাযহাবই বাতিল বা জাহান্নামী নয়। কারণ এ ধরনের ইজতিহাদগত মত পার্থক্য সাহাবায়ে কেরামের জমা’তেও হয়েছে এবং স্বয়ং রাসূল সা. তাঁদের ভিন্ন ভিন্ন মতকেই সমর্থন দিয়েছেন বলে বিভিন্ন হাদীসে উল্লেখ আছে।
(১) সহীহ বুখারী শরীফ। ২/১০৯২, মুসলিম শরীফঃ ২/৭৬।
(২) মুজতাহিদগণের যোগ্যতা ও শর্তাবলি আমার লিখিত “রাসূলুল্লাহর নামায বলতে কি বুঝায়?” নামক পুস্তিকায় সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ আছে।
(৩) শরহে আক্বাইদ: ১২৫।
যেমন বনী কুরাইসা যুদ্ধে যাওয়ার সময় রাসূল সা. তাঁর সাহাবাগণকে তাড়াতাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে আয়রের নামায পড়তে বলেছিলেন। কিন্তু যাত্রাপথে দেরি হয়ে যাওয়ায় তাঁদের মধ্যে বিলত হয়ে একদল আছরের সময় থাকাকালে রাস্তায় সামায আদায় করলেন। আরেক দল রাসুলের নির্দেশের বাহ্যিক অর্থ বজায় রেখে গন্তব্যস্থলে পৌছে সন্ধ্যার পর আছরের নামায কাযা পড়লেন। এ বিষয় অবগত হওয়ার পর রাসূল সা. তাঁদের কোন পক্ষেরই প্রতিবাদ করেননি (১)
এ ছাড়া পবিত্র কুরআনের সূরায়ে নিসা এর ৫৯ নং আয়াতের ব্যাখ্যাত তাফসীরে কবীর এ উল্লেখ আছে, এ আয়াতেও আল্লাহ পাক কুরআন, হাদীস, ইজমা ও ন্ড্রিয়াসকে ইসলামী ফিল্মাহ শাস্ত্রের যথাক্রমে চারটি সলীল সাব্যস্ত করে দিয়েছেন।
সুতরাং ফিক্বাহ শাস্ত্র বা আমলগত যে বিষয়ের সুস্পষ্ট সমাধান কুরআন হাদীসে পাওয়া যাবে না, মুজতাহিদগণ কেবল সে বিষয়ের সমাধানই ক্রিয়াসের মাধ্যমে বের করবেন। এটাই কুরআন হাদীসের নির্দেশ। আর এটা করতে গিয়ে তাঁরা ঐকমত্যে পৌছাতে না পারলে একেক জনের মত বা দ্বিয়াসকেই একেকটা মাযহাব বলা হয়।
এ ব্যাপারে বিশিষ্ট সাহাবী হযরত মুয়ায রা, সম্পর্কিত হাদীস প্রসিদ্ধ
قال – عليه الصلوة والسلام – معاذ بن جبل حين بعثه إلى اليمن بم تقصى يا معاذا قال بكتاب الله تعالى، قال: فإن لم تجد، قال: بسنة رسول الله – صلى الله عليه وسلم – قال: فإن لم تجد قال: اجتهد برای فضربه رسول الله – صلى الله عليه وسلم – فقال: الحمد لله الذي وفق رسول رسول الله على ما يحب وبرضاء
অর্থাৎ, হযরত মুয়ায রা.-কে ইয়ামন (এর শাসনকর্তা, মুফতী এবং বিচারক বানিয়ে) পাঠাবার সময় রাসূল সা. তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, সেখানে তুমি কিসের দ্বারা ফায়সালা করবে? উত্তরে মুয়ায রা. বলেন, আল্লাহর কিতাব অর্থাৎ কুরআন দ্বারা।
(১) পাসওয়াতুন্নাবী ও ৩৮৩।
রাসূল সা. জিজ্ঞেস করেন, যে বিষয়ের মীমাংসা কুরআনে পাবে না, সে বিষয়ে কিসের দ্বারা মীমাংসা করবে? মুয়ায রা. বলেন, সুন্নতে রাসূল বা রাসূলের হাদীস দ্বারা। রাসূল সা. বলেন, কোন বিষয়ের মীমাংসা হাদীসেও যাদি না পাও? উত্তরে মুয়ায বলেন, আমি নিজে ইজতেহাদ করব। তখন রাসূল সা. তাঁর এ জবাবকে সঠিক সাব্যস্ত করে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন (১)
এ হাদীসেও মুজতাহিদগণকে সে বিষয়ের মীমাংসা ইজতেহাদের মাধ্যমে বের করার দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে, যার পরিষ্কার মীমাংসা কুরআন, হাদীসে পাওয়া যাবে না। আর এটা করতে গিয়ে তাঁরা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারলে তাকে ইজমা, আর ভিন্ন ভিন্ন মুজতাহিদের ভিন্ন ভিন্ন মীমাংসাকে তাঁদের কিয়াসের ফলাফল বা মাযহাব বলা হয়। এভাবে প্রসিদ্ধ চার ইমামের চার মাযহাব পবিত্র কুরআন-হাদীস সমর্থিত হওয়ায় মাযহাব চতুষ্টয়ই আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’তের অন্তর্ভুক্ত। এক প্রশ্নের জবাব প্রসঙ্গে এ বিষয়ে কিঞ্চিত আলোচনা পূর্বেও করা হয়েছে এবং সেখানে প্রসিদ্ধ চার মাযহাবে সীমাবদ্ধ হওয়ার কারণও উল্লেখ করা হয়েছে।
(১) নূরুল হাওয়াশী শরহে উসুলুশ শাশী: ১৫৬।
ইসলামী আমলের ক্ষেত্রে বিদয়াতীদের চক্রান্ত
কিন্তু বিদয়াতী রেজভীরা ইসলামী আমলের ক্ষেত্রেও শরীয়তের চার দলীল উপেক্ষা করে, ঐগুলির অপব্যাখ্যার মাধ্যমে, অথবা মুজতাহিদ ইমামগণের পারিভাষিক ‘ক্বিয়াস’ এর পরিবর্তে নিজেদের মনগড়া অনুমানকেই দলীল সাব্যস্ত করতঃ জনগণকে ধোঁকা দিয়ে বিদয়াতী কর্মকাণ্ডও চালিয়ে দেয়।
এ বিষয়েও বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ এখানে নেই। তাই উদাহরণস্বরূপ শুধু এতটুকু বলতে চাই যে, আজকালকার বিদয়াতীদের “ঈদে মীলাদুন্নবী” উদযাপনের মহড়া সম্পর্কে তাদের পূর্বসূরীদের এক বড় মাপের নেতা মৌলভী আব্দুস সামী রামপুরী তার “আনোয়ারে সাতেয়া” নামক পুস্তকে লেখেন, এটা খৃষ্টান সমাজ থেকে আমদানি করা অনুষ্ঠান।
এএভাবে তাদের অনেকেই নিজেদের বই-পুস্তকে স্বীকার করেছেন, প্রচলিত মীলাদ অনুষ্ঠান, এ অনুষ্ঠানের কিয়াম বা দাঁড়ানো এবং মীলাদুন্নবী (বা মহানবীর জন্ম) উপলক্ষে ঈদ উদযাপন ও তার জসনে জুলুস বা আনন্দ মিছিল সাহাবা, তাবেঈন ও মুজতাহিদ ইমামগণের যুগে ছিল না; বরং হিজরী সপ্তম শতাব্দীর প্রথম থেকে এগুলির সূচনা। সুতরাং এগুলি যে ইসলামী শরীয়তের চার দলীল দ্বারা প্রমাণিত নয়, তা দিবালোকের ন্যায় পরিষ্কার।
আর ইসলামের নামে এমন নব উদ্ভাবিত কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তাফসীরে ইবনে কাসীরে উল্লেখ আছে:-
وأما أهل السنة والجماعة فيقولون في كل فعل أو قول لم يثبت عن الصحابة رضي الله تعالى عنهم هو بدعة، لأنه لو كان خيرا لسبقونا إليه، لأنه لم يتركوا خصلة من خصال الخير إلا وقد بادروا إليها .
অর্থাৎ, যে সমস্ত কথা বা কাজ সাহাবায়ে কেরাম থেকে প্রমাণিত নয়, সেগুলিকেই আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’ত বিদয়াত বলে। কারণ ইসলামের দৃষ্টিতে এগুলিতে যদি কোন মঙ্গল থাকত, তাহলে আমাদের আগে তাঁরাই এগুলি করতেন। কেনন তাঁরা ভাল যে কোন কাজই বর্জন না করে; বরং তা পালনে অগ্রগামী রয়েছেন (১)
অথচ ইদানিংকালের বিদয়াতীদের পূর্বসূরীরা আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’তের উপরোক্ত মূলনীতি উপেক্ষা করতঃ তাদের স্বীকারোক্তিমতেই খৃষ্টান সমাজ থেকে আমদানী কৃত কার্যকলাপকে ইসলামের নামে চালিয়ে দিয়েছে। আর এদের বর্তমান উত্তরসূরীরা তাদের পূর্বসূরীদের স্বীকারোক্তিকে অন্ধের মত ভুলে গিয়ে কেউ কুরআন হাদীসের অপব্যাখ্যার আশ্রয়ে, আর কেউ মনগড়া যুক্তি ও চাপাবাজির আশ্রয়ে এ সকল বিদয়াত চালু করার চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে।
এহেন চক্রান্ত সম্পর্কে হযরত উমর বিন আব্দুল আযীয র. (২) বলেন:-
أوصيك بتقوى الله والاقتصاد في أمره، واتباع سنة نبيه – صلى الله عليه وسلم – وترك ما أحدث المحدثون بعد ما جرت به سنته وكفوا مؤنته، فعليك بلزوم السنة؛ فإنها لك بإذن الله عصمة، ثم اعلم أنه لم يبتدع الناس بدعة إلا قد مضى قبلها ما هو دليل عليها أو عبرة فيها، فإن السنة إنما سنها من قد علم ما في خلافها من الخطأ والزلل والحمق والتعمق، فارض لنفسك ما رضي به القوم لأنفسهم، فإنهم على علم وقفوا، ويبصر نافذ كفوا، وهم على كشف الأمور كانوا أقوى، وبفضل ما كانوا فيه أولى، فإن كان الهدى ما أنتم عليه لقد سبقتموهم إليه.
অর্থাৎ, আমি তোমাকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে নির্দেশ দিচ্ছি, আল্লাহকে ভয় করার ব্যাপারে নিষ্ঠাবান হওয়ার এবং তাঁর রাসূলের সুন্নতের অনুসরণ করার। আর রাসূলের সুন্নত চালু হওয়ার পর বিদয়াতীরা যেসব বিদয়াতের উদ্ভাবন করতঃ সুন্নত পালনের ত্যাগ স্বীকার থেকে বিরত রয়েছে, সে সব বিদয়াত বর্জন করার। সুতরাং তোমার জন্য সুন্নতকে আঁকড়ে থাকা জরুরি; কারণ আল্লাহর নির্দেশ মতে এটাই মুক্তির পথ।
(১) তাফসীরে ইবনে কাসীরঃ ৪/১৫৬।
(২) জন্মঃ ৬১ হি. ওফাত: ১০১ হি.।
অতঃপর জেনে রেখ, লোকেরা তাদের উদ্ভাবিত বিদয়াতসমূহের পক্ষে যেসব দলীল বা উপকারিতা পেশ করে, ঐগুলি তো পূর্ব থেকেই বিদ্যমান ছিল। তথাপি যাঁরা সুন্নত চালু করেছেন, তাঁরা এগুলি গ্রহণ করেননি। কারণ তাঁরা জানতেন যে, বিদয়াতের মধ্যে কি কি ভুল, পদস্খলন, মূর্খতা ও বাড়াবাড়ি আছে।
তাই তুমি নিজে তাতেই তুষ্ট থাক, যাতে তাঁরা নিজেরা তুষ্ট থেকে বিদয়াতকে গ্রহণ করেননি। কারণ তাঁরা প্রকৃত ইল্ম সম্পর্কে ওয়াকেফহাল ছিলেন, দূরদৃষ্টির মাধ্যমেই বিদয়াত থেকে বিরত ছিলেন, গভীর বিষয়সমূহের উদঘাটনে অধিক শক্তিশালী ছিলেন এবং উত্তম অবস্থানে ছিলেন। তাই হে বিদয়াতীরা! তোমাদের কার্যকলাপ যদি সঠিক পথ হয়ে থাকে তবে কি তোমরা তাঁদের চেয়ে উত্তম হয়ে গেলে? (১)
(১) আবু দাউদ শরীফ: ২/২৭৭।
হযরত উমর বিন আব্দুল আযীয র.-এর উপরোক্ত বিবরণ দ্বারা পরিষ্কার হয়ে গেল যে, সুন্নতের প্রবর্তক ও এর সঠিক অনুসারী হলেন সালাফে সালেহীন বা সাহাবা, তাবেঈন ও তাবে তাবেঈন। তাই তাঁদের পরবর্তী যুগের বিদয়াতীরা তাদের উদ্ভাবিত বিদয়াত সমূহকে যেসব আয়াত ও হাদীস দ্বারা প্রমাণ করার অপচেষ্টা করছে, সেসব আয়াত ও হাদীস তো সালাফে সালেহীনের যুগেও বিদ্যমান ছিল।
তাই এগুলি বিদয়াত সমূহের পক্ষে দলীল হলে, সকলের আগে তাঁরাই এসব দলীল দ্বারা একাজগুলোকে প্রমাণিত করতেন। কারণ তাঁরা ছিলেন পবিত্র কুরআন-সুন্নাহর জ্ঞানে সঠিক জ্ঞানী। তাঁরা যেহেতু এমনটা করেননি, তাই পরবর্তীদের যারা এটা করছে, তাদের পদক্ষেপ যে নিশ্চিত ভুল পথ, তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
এরপরও যদি কেউ সালাফে সালেহীনের পথ ও পদ্ধতি বাদ দিয়ে বিদয়াতীদের পথ ও পদ্ধতিকে সঠিক মনে করে, তাহলে এর দ্বারা তারা এ কথাই বুঝাতে চায় যে, এসব বিদয়াতীরা নেক কাজে সালাফে সালেহীনের চেয়ে অগ্রগামী হয়ে গেছে! অর্থাৎ, পবিত্র কুরআনের কোন্ আয়াত এবং রাসূলের কোন্ হাদীস ধর্মের কোন্ কাজের জন্য কিভাবে দলীল হতে পারে, তা রাসূলের, সাহাবা, তাবেঈন ও তাবে তাবেঈনের চেয়ে বিদয়াতীরা বেশি বুঝেছে? (নাউযুবিল্লাহ।)
এ মর্মে আল্লামা শাতেবী র. বলেন:-
إنك لا تجد مبتدعا ممن ينسب إلى السنة إلا وهو يستشهد على بدعته بدليل شرعي، فينزله على ما وافق عقله وشهوته.
অর্থাৎ, যেসব বিদয়াতী নিজেদের সুন্নী বলে দাবি করে, তারা শরী’য়তের দলীলের মনগড়া ও প্রবৃত্তির অনুকূলে ব্যাখ্যা করতঃ স্বীয় বিদয়াতী কর্মকাণ্ডের সমর্থনে দলীল পেশ করে থাকে। (১)
এ ব্যাপারে হযরত মুজাদ্দিদে আলফেসানী র. লেখেন:-
ہر مبتدع وضال عقائد فاسد خود را بزعم فاسد خود از کتاب و سنت اخذ می کند بس ہر معنی از معانی مفهومه از بینها معتبر نه باشد.
অর্থাৎ, প্রত্যেক বিদয়াতী এবং পথষ্টই নিজেদের ভ্রান্ত মতবাদ প্রমাণ করার জন্য পবিত্র কুরআন-হাদীসের মনগড়া ব্যাখ্যা করে দলীল হিসেবে পেশ করে থাকে। সুতরাং কুরআন-সুন্নায় তাদের কল্পিত ব্যাখ্যা গহণযোগ্য নয়। (১)
(১) মাক্বাত: ৩/৮ মাকতুব নং ১৯৩।
বাড়াবাড়ির শেষ কোথায়
আমাদের সমাজের বিদয়াতী রেজভীরা নিজেদের আস্ত দলীল ও চাপাবাজির মাধ্যমে শুধু যে আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’তের নীতি ও আদর্শ লংঘন করে এর বিপরীতে বিভিন্ন ভ্রান্ত মতবাদ, শিরকি আত্মীদা এবং ফিকাহ শাস্ত্রের চার মূলনীতি বিবর্জিত বিভিন্ন বিদয়াতী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে তাই নয়, বরং এ সমস্ত ভ্রান্ত মতবাদ ও বিদয়াতী কর্মকাণ্ড যারা মানতে রাজি নন তাদেরকে ওয়াহাবী, কাফির, বেঈমান, রাসুল বিদ্বেষী, রাসূলের দুশমন ইত্যাকার গালিগালাজ করতঃ মুসলমান সমাজে চরম বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে বেড়াচ্ছে।
যেমন দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকার ৪ঠা এপ্রিল ২০০৭ সংখ্যার দ্বাদশ পৃষ্ঠার শিরোনামে এবং অষ্টম পৃষ্ঠার বিবরণে তারা পরিষ্কার ভাষায় লিখেছে, “ঈদে মীলাদুন্নবীর শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে যারা বিতর্ক তোলে তাদের ঈমান নেই।”
তাই প্রশ্ন জাগে, এ বাড়াবাড়ির শেষ কোথায়? একেই বলে “একে তো চুরি, তার উপর সিনাজুরি।” তাদেরই স্বীকারোক্তিমতে যে ঈদে মীলাদুন্নবী অনুষ্ঠান প্রায় ছয়শ বছর পর্যন্ত ইসলাম ধর্মে ছিল না। অতঃপর তারা তা খৃষ্টান সমাজ থেকে আমদানি করেছে, (যা উদ্ধৃতিসহ পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে।) সেই খৃষ্টানী অনুষ্ঠানকে ইসলামী অনুষ্ঠানে রূপান্তরিত না করলে যদি ঈমানই না থাকে অর্থাৎ, বেঈমান বা কাফির হয়ে যায়, তাহলে স্বয়ং রাসূল সা. সহ লক্ষাধিক সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন, তাবে তাবেঈন, চার মাযহাবের ইমাম চতুষ্টয়, আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’তের আক্বাইদের দুই ইমাম, তাঁদের সকল অনুসারী তথা রাসুলের যুগ থেকে পরবর্তী ছয়শ’ বছরের সমস্ত মুসলমানকে কাফির বলার বাকি রইল কোথায়? এই ধৃষ্টতার শেষ কোথায়??
বিদয়াতী রেজভীদের উদযাপিত ঈদে মীলাদুন্নবী নামক অনুষ্ঠান সম্পর্কে এদের দলের বড় নেতা মৌলভী আ. সামী রামপুরী তার প্রণীত “আনোয়ারে সাতেয়া” নামক গ্রন্থে নিজেই স্বীকার করেছেন, এ অনুষ্ঠান ইসলাম ধর্মে না থাকায় এটা তারা খৃষ্টান সমাজ থেকে আমদানী করেছেন।
তাই এ ব্যাপারে-
প্রথম কথা হল, এ অনুষ্ঠান আমদানির পূর্ববর্তী প্রায় ছয়শ বছরের মুসলমান সঠিক পথে ছিলেন, না ভুল পথে ছিলেন? তাঁরা সঠিক পথে থাকলে এখন যারা এ বিদয়াতটা গ্রহণ করবেন না তাঁরা ঈমান হারাবেন কোন কারণে? আর এ বিদয়াতটা না করার কারণে যদি প্রথম ছয়শ বছরের মুসলমানও কাফির হয়ে গিয়ে থাকেন, তাহলে বর্তমান যুগের এই ফতোয়াবাজরা ঈমান পেল কোথায়? অথচ হাদীস শরীফে উল্লেখ আছে:-
عن ابن عمر – رضي الله عنه أنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: أيما رجل قال لأخيه كافر، فقد باء بها أحدهما .
অর্থাৎ, হযরত আব্দুল্লাহ বিন উমর রা. বর্ণিত হাদীসে হযরত রাসূলে করীম সা. বলেন, কেউ কাউকে কাফির বললে, তাদের একজন অনিবার্য কাফির হয়ে যায়। (১)
অর্থাৎ, যাকে কাফির বলল, সে কাফির না হলে, যে কাফির বলল সে- ই কাফির হয়ে যায়।
সুতরাং স্বয়ং রাসূল সা. এবং তাঁর সাহাবাগণ থেকে নিয়ে ইসলামের প্রথম ছয়শ’ বছরের মুসলমান ঈদে মীলাদুন্নবী সহ বিদয়াতীদের যেসব কর্মকাণ্ড করেননি, এগুলি না করা বা না মানার কারণে কাউকে কাফির বলার মানেই হল, সালাফে সালেহীন (সাহাবা, তাবেঈন ও তাবে তাবেঈন)কে কাফির বলা। আর তাঁরা যে কাফির ছিলেন না এটা সর্বজন স্বীকৃত চূড়ান্ত সত্য।
সুতরাং তাঁদেরকে যারা কাফির সাব্যস্ত করে, উপরোক্ত হাদীসের বিবরণ অনুযায়ী তারাই যে কাফির হয়ে যায়, এ কথা দিবালোকের মত পরিষ্কার।
(১) সহীহ বোখারী: নং-৬১০৪, মুসলিম নং-২২৪, মিশকাত শরীফ: ২/৪১১।
দ্বিতীয় কথা হল, সুন্নতে রাসূল এবং জমা’তে সাহাবা দ্বারা যেসব আক্বীদা প্রমাণিত নয়, এবং কুরআন, হাদীস ইজমা ও ক্বিয়াস দ্বারা যেসব আমল প্রমাণিত নয়, এগুলিকে ইসলামী আক্বীদা ও আমল বা সাওয়াবের কাজ মনে করলে আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’ত হয়, না বিদয়াতী হয়? এভাবে সুন্নী নামে বিদয়াতী কর্মকাণ্ড চালিয়ে দেয়াই রেজভীদের আসল কাজ।
তৃতীয় কথা হল, বর্তমান যুগের যেসব রেজভী টানা হেঁচড়া করে এসব বিদয়াতী কর্মকাণ্ডের পক্ষে বিভিন্ন দলীল পেশ করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, এসব দলীল সঠিক হয়ে থাকলে অনুসরণীয় তিন যুগের মুসলমানগণ অর্থাৎ, সাহাবা, তাবেঈন ও তাবে তাবেঈন কি এসব দলীল বুঝেননি? বুঝে থাকলে তাঁরা এসব কর্মকাণ্ডের পক্ষে এ দলীলগুলি উল্লেখ করেননি কেন? তবে কি তাঁরা ইসলামী দলীলের বেলায় কম জ্ঞানী ছিলেন, আর রেজভীরা তাঁদের চেয়ে বেশি জ্ঞানী হয়ে গেল?
চতুর্থ কথা হল, রেজভীদের বিদয়াতী কর্মকাণ্ড যদি সাওয়াবের কাজ হয়ে থাকে, তাহলে সালাফে সালেহীন এগুলি করলেন না কেন? তবে কি রেজভীরা সওয়াবের কাজে তাঁদের চেয়েও অগ্রগামী?
মোট কথা, হযরত রাসূলে করীম সা.-কে আলিমুল গাইব ও হাযির- নাযির বিশ্বাস করা যেমন আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’তের আক্বীদা নয়; বরং কুফ্রি ও শিকি আক্বীদা। কারণ এগুলি আহলে সুন্নতের মূলনীতি অর্থাৎ, সুন্নতে রাসূল ও জমা’তে সাহাবা দ্বারা প্রমাণিত নয়, তাই আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’তের আক্বাইদের কিতাবাদিতে এগুলির কোন অস্তিত্ব নেই; বরং আহলে সুন্নতের আক্বাইদের কিতাবে পরিষ্কার ভাষায় উল্লেখ আছে, রাসূলকে আলিমুল গাইব বিশ্বাস করা কুরি আক্বীদা। যা উদ্ধৃতিসহ পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে।
তেমনিভাবে রাসূলের পবিত্র জন্ম উপলক্ষে বিদয়াতীদের প্রচলিত মীলাদ অনুষ্ঠান, এ অনুষ্ঠানের কিয়াম, তথাকথিত “ঈদে মীলাদুন্নবী” ও ‘জশনে জুলুস” এগুলিও ইসলামী ফিক্বাহ শাস্ত্রের চার মূলনীতি (অর্থাৎ, কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও ক্বিয়াস) দ্বারা প্রমাণিত নয়। তাই ইলমে ফিক্বাহ এর কিতাবাদিতে এগুলির নাম গন্ধও নেই। সুতরাং এগুলি আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’তের আমলসমূহের অন্তর্ভুক্ত নয়; বরং বিদয়াতীদের মনগড়া সংযোজন তথা বিদয়াত ও কুসংস্কার।