কিছুদিন আগে আমাদের বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ইসলামী সংগঠন ‘হেফাজতে ইসলাম’-এর আমীর আল্লামা মুহিব্বুল্রাহ বাবুনগরী দা.বা. বাংলাদেশের তথাকথিত ‘জামায়াতে ইসলামী’-এর ব্যাপারে একটি মন্তব্য করে বলেছিলেন– ”আমরা জামায়াতে ইসলামকে ইসলামি দল মনে করি না। জামায়াতে ইসলাম মদিনার ইসলাম চায় না, তারা মওদুদীর ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চায়।” -দৈনিক যুগান্তর, ২৮ অক্টোবর ২০২৪
এ ছাড়াও আমাদের আকাবীর ও আসলাফ সর্বদা বলে এসেছেন– নীল নদের পানি যেমন নীল নয়, জামায়াতে ইসলামীও তেমন ইসলাম নয়। আমাদের আকাবীর ও আসলাফ জামায়াতের আসল রূপ তারা জেনেছেন, আর তাদের আসল বাস্তবতা দেখেই তারা এ ধরনের মন্তব্য করেছেন। অতীতের ইতিহাস আপাতত রাখছি, আজ সম্প্রতি সময় ঘটে যাওয়া নতুন একটি বিষয় আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।
জুলাই আন্দোলনের পর বাংলাদেশের সংবিধান সংস্কার করার ব্যাপারে একটি কমিশন গঠন করা হয় এবং সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়ার ব্যাপারে প্রস্তাব দেওয়া হয় বেশ জোরালোভাবে। এরপর বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এব্যাপারে মত পেশ করতে থাকে। কোন দল কী অভিমত পেশ করেছে চলুন একটু নজর দেওয়া যাক। গত দুদিন আগে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোর একটা রিপোর্ট আমার সামনে এসেছে। ‘দৈনিক মানবজমিন’-এর রিপোর্টে ‘বাংলাদেশের ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ যুক্তরাষ্ট্রের’ শিরোনামে তারা লিখেছে–
“সংবিধান সংস্কারে একটি কমিশন গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। যার সুপারিশ ঘিরে বিতর্ক দানা বেঁধেছে। কমিশনের সুপারিশে সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি বাদ দিয়ে ‘বহুসংস্কৃতিবাদ’ বা ‘বহুত্ববাদ’-এর প্রস্তাব এসেছে। এ নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি। প্রস্তাবিত শব্দের পরিবর্তে ‘আল্লাহর ওপর অবিচল আস্থা’ শব্দবন্ধ সংবিধানে যুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছে দলটি। এদিকে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ইসলাম-ভিত্তিক রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী ও আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্রদের নবগঠিত ন্যাশনাল সিটিজেনস পার্টি বা জাতীয় নাগরিক দল (এনসিপি) আংশিক সমর্থন জানিয়ে ‘বহুত্ববাদ’-এর পরিবর্তে বাংলা বিকল্প বা ‘বহুসংস্কৃতিবাদ’ শব্দ ব্যবহারের পক্ষে মত দিয়েছে।” – দৈনিক মানবজমিন ২৯ জুলাই ২০২৫, মঙ্গলবার, ১৪ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ৩ সফর ১৪৪৭ হিঃ
এ রিপোর্ট থেকে জানতে পারলাম–বিএনপির মত একটি মানবরচিত তন্ত্রে বিশ্বাসী সংগঠনও সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’–এর স্থানে ‘বহুত্ববাদ’-এর পরিবর্তে ‘আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ ফিরিয়ে আনার পক্ষে মত দিয়েছে। কিন্তু নিজেদের ‘আল্লাহর আইনে বিশ্বাসী’ বলে গলাফাটনো তথাকথিত ‘জামায়াতে ইসলামী’ নামক এই সংগঠন বিএনপির মতো ‘আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ ফিরিয়ে আনার দাবি না করে, বরং সেখানে ‘বহুসংস্কৃতিবাদ’ নামক আরেকটি কুফরী মতবাদের দাবি তুলেছে।
‘বহুসংস্কৃতিবাদ’-এর রূপকার কারা?
‘বহুসংস্কৃতিবাদ’ মূলত কতক বেঈমানদের তৈরি একটি কুফরী ব্যবস্থা। যার মূল ভূমিকায় যারা ছিলেন, তাদের কয়েকজন হলেন–উইল কিমলিকা (Will Kymlicka), চার্লস টেলর (Charles Taylor), ব্রাইন বেরি (Brain Barry), ভিখু পারেখ (Bhikkhu Parekh) প্রমুখ।
‘বহুসংস্কৃতিবাদ’–এর রূপ কী?
বহুসংস্কৃতিবাদ হলো এমন একটি ধারণা বা মতাদর্শ বা একটি তত্ত্ব যা সমাজে বসবাসকারী প্রত্যেকের নিজস্ব সংস্কৃতির স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ও তাদের স্বীকৃতির ওপর বিশেষ জোর দেয়। বিশেষ করে সমাজের পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠী যেমন ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠী বা ভাষাগত, জাতিগত, নৃকুলগত যে কোনও গোষ্ঠীভুক্ত মহিলা, ভিন্ন যৌনতাকামী মানুষ তথা LGBT, প্রতিবন্ধী প্রভৃতি গোষ্ঠীভুক্ত মানুষজন সমাজে যাতে নিজ নিজ সংস্কৃতি নিয়ে স্বমহিমায় বসবাস করতে পারে তা সুনিশ্চিত করার কথা বলে।
এ ব্যাপারে আরও জানতে চাইলে যাদবপুর, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘অজয় বর’–এর লেখা ‘বহুসংস্কৃতিবাদের আলোকে সংখ্যালঘু অধিকারের ধারণা’-বইয়ের ২১৭ থেকে ২২৫ পৃষ্ঠা পর্যন্ত পড়তে পারেন।
‘বহুসংস্কৃতিবাদ’–ক্ষতিকারক দিক
যদি এ দেশে ‘বহুসংস্কৃতিবাদ’ প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে অশোভ্যতা, নোংড়ামী ও নির্লজ্জতা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়বে মুহুর্মুহুভাবে। যেমন LGBT তথা সমকামীতার মত নির্লজ্জ ও রুচিহীন কাজটাও স্বীকৃতি দিতে আপনি বাধ্য থাকবেন। এটা তাদের সাংবিধানিক অধিকার বলে বিবেচিত হবে। আপনি চাইলেও তখন আর সমকামীদের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামতে পারবেন না, কারণ এটা তাদের সাংবিধানিক অধিকার বলে বিবেচিত হবে। এমনিভাবে নাস্তিক্যবাদী সংস্কৃতি চর্চা রাজকীয়ভাবে পালন হলেও আপনি তাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে পারবেন না। পহেলা বৈশাখের নামে হিন্দয়ানী কুফরী সংস্কৃতি রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন হতে থাকবে বিনা বাঁধায়। কাদিয়ানী নিষিদ্ধের দাবি করাটাও সংবিধান বিরোধী কাজ হয়ে দাঁড়াবে। ‘ট্রান্সজেন্ডার’-এর মতো একটি অবান্তর ও আল্লাহর সৃষ্টি সিস্টেমের সাথে যুদ্ধ ঘোষণাকারী লোকদের এই অধিকারও রক্ষা করার জন্য আমাদেরই আন্দোলন করতে মাঠে যেতে হবে।
শুধু এখানেই শেষ নয়, বরং আমি আমার সন্তানকে ইসলামী মূল্যবোধে বাধ্য করতে পারবো না। সে যে সংস্কৃতির চর্চা করতে চায়, আমি তার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হতে হবে। তাছাড়া আমার স্ত্রীকে বোরখার অধীনে রাখার অধিকার আমার আর থাকবে না। আমার প্রতিষ্ঠানের বাচ্চারা যদি দাড়ি কেটেও আসে, তবুও আমি তাকে শাসন করতে পারবো না। কারণ সবাই তখন নিজ অধিকারে যেকোনো সংস্কৃতি চর্চা করতে পারবে সাংবিধানিক অধিকার বলে। আমরা ৯০% মুসলিম দেশে ইসলামী মূল্যোবোধে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে সীমাবদ্ধ করতে পারবো না। যদি করি তাহলে এটা সংবিধান অনুযায়ী আমি অন্যায়কারী বলে বিবেচিত হবো। তারা চাইলে তখন আমাদের নামে মামলা করলে সংবিধান অনুযায়ী আমাদেরকে গ্রেফতার করা হবে।
আমার প্রশ্ন হলো–’জামায়াতে ইসলামী’ যদি সত্যিকারের ইসলামিক দল হয়, তাহলে তারা সংবিধানে সংস্করণে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’-এর স্থানে ‘বহুত্ববাদ’-এর পরিবর্তে বিএনপির মতো ‘আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ বাক্যটি ফিরিয়ে আনার দাবি না করে ‘বহুসংস্কৃতিবাদ’-এর মত একটি কুফরী মতবাদের দাবি কেন করলেন? কাদের খুশি করতে চান তারা? ‘আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’-এর মত একটি চমৎকার বাক্য যাদের পছন্দ হয় না, বরং ‘বহুসংস্কৃতিবাদ’-এর মতো একটি কুফরী মতবাদ যাদের এতটাই প্রিয় পুরো দুনিয়া তাদের ইসলামী দল বললেও আমি অন্তত বলতে পারলাম না৷।