1. info@izharehaq.com : MZakir :
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:০৪ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
গোয়েবলসীয় নীতি : হিটলারের ঐ মুখপাত্রও ”জামাত-শিবিরের মিথ্যাচারের কাছে হার মানায়”: পর্ব ১ ইক্বামাতে দ্বীনের তাৎপর্য এবং বাতিলপন্থীদের বিকৃত ব্যাখ্যা সাহাবাগণ রাঃ সত্যের মাপকাঠি এবং তাদের ইজমা সর্বসিদ্ধান্ত মতে শরীয়তের দলীল সাহাবা রাঃ গণ সত্যের মাপকাঠি খোলাফায়ে রাশেদীনগণের সোনালী আদর্শ সর্বসম্মতিক্রমে শরিয়তের দলীল শায়খ আলিমুদ্দীন দুর্লভপুরী”র ঐতিহাসিক ও তাত্বিক বক্তব্য: “তাঁরাই সত্যের মাপকাঠি” শায়খ আলিমুদ্দীন দুর্লভপুরী”র ঐতিহাসিক ও তাত্বিক বক্তব্য: সাহাবায়ে কেরাম “সত্যের মাপকাঠি: মিয়ারে হক: সত্যের মাপকাঠি: কুরআন-হাদীস এবং মওদূদী সাহিত্যের আলোকে: পর্ব-৬ মিয়ারে হক: সত্যের মাপকাঠি: কুরআন-হাদীস এবং মওদূদী সাহিত্যের আলোকে: পর্ব-৫ মিয়ারে হক: সত্যের মাপকাঠি: কুরআন-হাদীস এবং মওদূদী সাহিত্যের আলোকে: পর্ব-৪ জামায়াতে ইসলামী’র গোমরাহী বিষয়ক “শায়খ আলিমুদ্দীন দুর্লভপুরী”র ঐতিহাসিক ও তাত্বিক বক্তব্য: ৩য় পর্ব আবুল আ’লা মওদূদী মরহুম যেভাবে হাদীস অস্বিকারকারীদের কাতারে নাম লেখালেন! মিয়ারে হক: সত্যের মাপকাঠি: কুরআন-হাদীস এবং মওদূদী সাহিত্যের আলোকে: পর্ব-৩ মিয়ারে হক: সত্যের মাপকাঠি: কুরআন-হাদীস এবং মওদূদী সাহিত্যের আলোকে: পর্ব-২ মিয়ারে হক: সত্যের মাপকাঠি: কুরআন-হাদীস এবং মওদূদী সাহিত্যের আলোকে: পর্ব-১ জামায়াতে ইসলামী’র গোমরাহী বিষয়ক “শায়খ আলিমুদ্দীন দুর্লভপুরী”র ঐতিহাসিক ও তাত্বিক বক্তব্য: ২য় পর্ব মিথ্যাচারের উপর দাঁড়িয়ে আছে কারা? কওমী শিক্ষাব্যবস্থা না জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাস? কুরআন ও হাদীসের আলোকে সাহাবায়ে কিরামের পরিচিতি ও মর্যাদা জামায়াতে ইসলামী’র গোমরাহী বিষয়ক “শায়খ আলিমুদ্দীন দুর্লভপুরী”র ঐতিহাসিক ও তাত্বিক বক্তব্য মওদূদী সাহেব ও জামায়াতে ইসলামীর সাথে আলেম সমাজের বিরোধিতার প্রকৃত কারণ:

মিয়ারে হক: সত্যের মাপকাঠি: কুরআন-হাদীস এবং মওদূদী সাহিত্যের আলোকে: পর্ব-২

নাম:
  • আপডেট সময় : বৃহস্পতিবার, ২৯ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪
  • ১৭২ বার পড়া হয়েছে

এখন যেটা নিয়ে আলোচনা করব, তা মওদূদী সাহিত্যের কোনো শাখা-প্রশাখাগত মাসআলা নয়, যেটাকে মওদূদী সাহেবের ব্যক্তিগত মত বা তার নিজস্ব ইজতিহাদ ও কিয়াসের ফলাফল আখ্যা দিয়ে দলটির মাথা থেকে বোঝা হালকা করে দেয়া যায়, আর এই জাতীয় পরিস্থিতিতে সাধারণত এমনই করা হয়ে থাকে, বরং জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্রের বুনিয়াদী উসূল নিয়ে আলোচনা করবো যা দলটির নেতাকর্মী সবার জন্য সমানভাবে গ্রহণীয় দলীল এবং মাপকাঠির মর্যাদা রাখে। জামাতে ইসলামীর গঠনতন্ত্র বা সংবিধান যদি দলটি স্বীকার করে থাকে (অবশ্যই স্বীকার করে, কারণ দলটির অস্তিত্ব ও তাশকীল এ সংবিধানের ভিত্তিতেই হয়েছে), তাহলে নিঃসন্দেহে গঠনতন্ত্রের দফা— ‘রাসূলে খোদা ব্যতীত কাউকে মিয়ারে হক বানানো যাবে না’— দলটির একটি স্বীকৃত আকীদা ও বুনিয়াদী উসূল প্রমাণিত হয়। তাই উক্ত বুনিয়াদী আকীদার বিশ্লেষণ করে শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে যা আলোচনা করা হবে, নিঃসন্দেহে তা পুরো দলটির প্রত্যেক সদস্যের জন্য প্রমাণপত্র হবে। তাই গোটা জামাতকে সকল প্রকার সংকীর্ণতা ও গোঁড়ামীর উর্ধ্বে উঠে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করার দরকার। কারণ বিষয়টা আকীদার। পার্থিব নয়, সম্পূর্ণ পারলৌকিক; যা বেশি মনঃসংযোগের মুখাপেক্ষী।
মওদূদী সাহেব রাসূলে খোদা হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যতীত অন্য কাউকে সত্যের মাপকাঠি বানাতে নিষেধ করেছেন। এই নিষেধাজ্ঞা তখনই যথার্থ হবে, যখন শরীয়তসম্মতভাবে রাসূল ছাড়া আর কেউ হক-বাতিলের মাপকাঠি প্রমাণিত হন না। যদি শরীয়তসম্মতভাবে কেউ মিয়ার হন এবং হতে পারেন, তবে তাকে সত্যের মাপকাঠি স্বীকার করা কোন অপরাধ হতে পারে না। কিন্তু মওদূদী সাহেবের আকীদা হল, ‘রাসূলে খোদা ব্যতীত আর কেউ হক-বাতিলের মিয়ার হতে পারে না।’ তারপরেও কেউ যদি আপনা থেকে কাউকে মিয়ারে হক নির্ধারণ করে নেয়, তাহলে সে মওদূদী আকীদা অনুযায়ী কেবল অপরাধীই নয়, পাপীও হবে। তাই আমাদের আলোচনা হবে মওদূদী সাহেবের এ দৃষ্টিভঙ্গির উপর যে, ‘রাসূলে খোদা ব্যতীত আর কেউ হক-বাতিলের মিয়ার হতে পারে না।’
মওদূদী সাহেবের আকীদাকে যদি সকল ব্যাপকতার সাথে কিছুক্ষণের জন্য তার শাব্দিক অর্থে মেনে নেয়া হয় যে, ‘রাসূলে খোদা ব্যতীত আর কেউই সত্যের মাপকাঠি নন’— তবে প্রশ্ন হবে যে, স্বয়ং রাসূলে খোদা যদি কাউকে মিয়ারে হক নির্ধারণ করে দেন বা তার ব্যাপারে মিয়ারে হক হওয়ার সাক্ষ্য প্রদান করেন কিংবা মিয়ারে হক হওয়ার নীতিমালা বর্ণনা করেন এবং সে নীতিমালার আলোকে কাউকে মিয়ারে হক সাব্যস্ত করা হয়, তাহলেও কি তিনি মিয়ারে হক হতে পারবেন না? যদি পারেন, তাহলে উক্ত নীতি ‘রাসূলে খোদা ব্যতীত কেউই মিয়ারে হক হতে পারে না’ ভুল প্রমাণিত হবে। আর যদি রাসূলে খোদার ইরশাদ সত্ত্বেও তিনি ব্যতীত আর কেউ মিয়ারে হক না হন, তাহলে রাসূলে খোদার কথা খেলাফে হক হওয়ার কারণে (আল্লাহ না করুন) স্বয়ং রাসূলে খোদার মিয়ারে হক বাতিল হয়ে যায়। সুতরাং উভয় সূরতেই দলটির গঠনতন্ত্রের উক্ত দফা ভিত্তিহীন হয়ে যায়। এক সূরতে তার নেতিবাচক দিক ‘রাসূলে খোদা ব্যতীত কেউ মিয়ারে হক নয়’ বাতিল হয়ে যায় এবং দ্বিতীয় সূরতে ইতিবাচক দিক ‘কেবল রাসূলে খোদাই মিয়ারে হক’ গলত প্রমাণিত হয়। এ সংকট থেকে উত্তীর্ণ হওয়ার একক ও একমাত্র পথ হল— আমরা রাসূলে খোদা ব্যতীত অন্য নির্দিষ্ট ব্যক্তিগণকেও রাসূলেরই ইরশাদ অনুযায়ী মিয়ারে হক মানবো এবং সমালোচনার উর্ধ্বে স্বীকার করবো; যাতে রাসূলে খোদা সত্তাগতভাবে মিয়ারে হক থাকেন এবং আর অন্যরা রাসূলের ইরশাদ অনুযায়ী মিয়ারে হক হন।
★ মিয়ারে হক :: সত্যের মাপকাঠি—
এখন এ প্রশ্ন রয়ে যায় যে- রাসূলে খোদা কাউকে মিয়ারে হক নির্ধারণ করেছেন কি না?
এর সংক্ষিপ্ত জবাব হল, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নাম উল্লেখ করে যাঁদেরকে হক ও বাতিলের মিয়ার ঘোষণা করেছেন, যাঁদের সমালোচনা ও জেরা থেকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন এবং যেহনকে যাঁদের গোলামীর জন্য প্রস্তুত করেছেন, তাঁরা হলেন সাহাবায়ে কিরামের পূত-পবিত্র জামাআত। তাঁদেরকে মিয়ারে হক ঘোষণা করার জন্য রাসুল অত্যন্ত সরল, দ্ব্যর্থহীন ও সুস্পষ্ট হেদায়েত দিয়েছেন। সুতরাং সাহাবীগণের মিয়ারে হক হওয়া কোন কিয়াসী কিংবা ইজতেহাদী বিষয় নয়; বরং হাদীস দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত। এ ব্যাপারে হুযুর সা. স্বীয় এক শাশ্বত হাদীসে ইরশাদ করেছেন :
عن عبد الله بن عمرو بن العاص رضي الله عنهما قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم تفترق امتى على ثلث وسبعين ملة كلهم في النار الا واحدة قيل من هم يا رسول الله قال ما انا عليه و اصحابی – مختصرا عن المشكوة
অর্থাৎ আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. ইরশাদ করেন, আমার উম্মত তিহাত্তর মিল্লাতে বিভক্ত হবে। এক মিল্লাত ছাড়া সবাই জাহান্নামী হবে। প্রশ্ন করা হল- তাঁরা (নাজাতপ্রাপ্ত) কারা? ইরশাদ হল- যারা আমার ও আমার সাহাবীগণের পথে প্রতিষ্ঠিত থাকবে। [মিশকাত থেকে সংক্ষেপিত]
১. উক্ত হাদীসে রাসূল সা. ইসলামী ফিরকাগুলোর মুক্তি ও ধ্বংস, অন্যকথায় তাদের হক ও বাতিল হওয়ার মাপকাঠি বলে দিয়েছেন যে, তা হচ্ছে আমার ও আমার সাহাবীগণের পথ। তিনি সাহাবীগণকে পৃথক রেখে কেবল নিজেকে সেই পথের মাপকাঠি বলেন নি; বরং স্বীয় বরকতময় সত্তা এবং তাঁর সাহাবীগণের পবিত্র সত্তার সাথে সম্পৃক্ত করে মিয়ার ঘোষণা করেছেন যে, ঐ পথ সেসব ব্যক্তিগণের মাধ্যমে পাওয়া যাবে। অন্যথায় মিয়ার নির্ধারণের ক্ষেত্রে ঐ নিসবত ও মনোনয়নের আদৌ প্রয়োজন ছিল না; বরং من هم ‘নাজাতপ্রাপ্ত কারা?’— এ প্রশ্নের জবাবে ما انا عليه ‘আমি যে পথে আছি’ এর পরিবর্তে ما جئت به ‘আমি যা নিয়ে এসেছি’ ছিল অতি সহজ উত্তর অর্থাৎ আমি যে শরীয়ত নিয়ে এসেছি, তা হল মিয়ারে হক। তবুও ঐ শরীয়তকে সাহাবায়ে কেরাম থেকে পৃথক করে বলার পরিবর্তে তাঁদের সাথে সম্পৃক্ত করে উল্লেখ করার অর্থ এছাড়া আর কি হতে পারে যে, কেবল কাগজের কালো নকশা মিয়ার হতে পারে না; বরং সে পবিত্র সত্তাগণ হলেন মিয়ারে হক, কাগজের কালো চিত্র ও অক্ষর যাঁদের মজ্জাগত ও সহজাত প্রবৃত্তিতে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। আর এমনভাবে মিশ্রিত হয়েছে যে, এখন কেউই তাঁদের ব্যক্তিসত্তাকে দীন থেকে এবং দীনকে তাঁদের ব্যক্তিসত্তা থেকে পৃথক করে দেখাতে পারবে না। যার ফলাফল এই বের হল যে, কেবল লিটারেচার (বই-পুস্তক) মিয়ারে হক হতে পারে না ; বরং তাঁরাই হলেন মিয়ারে হক যারা এই লিটারেচারের বাস্তব ধারক-বাহকে পরিণত হয়েছেন।
بل هو آيات بينات في صدور الذين اوتوا العلم وما يجحدوا باياتنا الا الظلمون
অর্থাৎ বরং যাদেরকে জ্ঞান দেয়া হয়েছে, তাদের অন্তরে এটা স্পষ্ট নিদর্শন। কেবল যালিমরাই আমার নিদর্শন অস্বীকারকারী। [আনকাবুত ৪৯]
অতঃপর সেই তরিকাকে ব্যক্তির সাথে সম্পৃক্ত করার পরম্পরায় স্পষ্টত ما এর পর انا বলে দেওয়া যথেষ্ট ছিল এবং এই বলে ক্ষান্ত থাকা যথেষ্ট ছিল যে, মুক্তি ও ধ্বংসের পথ চেনার তরিকা আমার পবিত্র সত্তা। এতে মিয়ারে হক কেবলমাত্র রাসূলে খোদার পবিত্র সত্তাই বিবেচিত হত। কিন্তু হুযুর সা. নিজের সাথে তাঁর সাহাবায়ে কিরামকেও অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তাতে দিবালোকের ন্যায় উদ্ভাসিত হয় যে, বিভিন্ন ফিরকা এবং চিন্তাধারার হক ও বাতিল নির্ণয় করার ক্ষেত্রে রাসূলে খোদার সত্তা যেমন মিয়ার (মাপকাঠি), ঠিক তেমনি রাসূলের সাহাবাও মিয়ার। সুতরাং রাসূলে খোদার উপস্থিতি কিংবা অনুপস্থিতিতে কোন ফিরকা এবং চিন্তাধারার ব্যক্তি বা গোষ্ঠিকে যাচাই করার জন্য এটাই দেখে নেয়া যথেষ্ট যে, তারা সাহাবায়ে কিরামের পথের মোতাবিক চলছে, না উল্টোদিকে চলছে? তাঁদের আনুগত্য করছে, না বিরুদ্ধাচরণ করছে? তাঁদের সম্পর্কে সুধারণা রাখছে, না কুধারণা ও অনাস্থা পোষণ করছে? আর এসব বিষয় যে কোন বস্তুর নিরিখের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এ থেকে সুস্পষ্টভাবে রাসূলে খোদার সাথে রাসূলের সাহাবীগণের মিয়ারে হক হওয়া প্রতীয়মান হয়ে যায়। আর উক্ত হাদীস এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট দলিল, যার উদ্দেশ্যই হল এই দাবিকে মজবুত করা।
২. আর এর যে কারণটা স্বয়ং উক্ত হাদীস থেকে সুস্পষ্ট হয় তা হল, রাসূলে আকরাম সা. এ হাদীসে নিজের মত ও পথকে অবিকল সাহাবায়ে কিরামের মত ও পথ বলে উল্লেখ করেছেন। এর সারবত্তা হল, তাঁদের পথে চলা মানে আমার পথে চলা এবং তাঁদের অনুসরণ মানে আমার অনুসরণ। এটি যেন এমন, যেমন হক তাআলা শানুহু স্বীয় রাসূলে পাক সম্পর্কে ইরশাদ করেছেন-
من يطع الرسول فقد اطاع الله
অর্থ: যে রাসূলের অনুসরণ করল, সে আল্লাহর অনুসরণ করল। [নিসা ৮০]
একজনের আনুগত্যকে অবিকল অন্যের আনুগত্য বাতলানো এ আয়াতের উদ্দেশ্য, যার পরিষ্কার অর্থ হল খোদা এবং তাঁর রাসূলের পথ পৃথক পৃথক নয়। রাসূলের পথ যেটি সেটিই আল্লাহর পথ। সুতরাং আল্লাহর আনুগত্য জানার মাপকাঠি হল রাসূলের আনুগত্য দেখা। যদি রাসূলের আনুগত্য হয়, তাহলেই খোদার আনুগত্য হবে; অন্যথায় নয়।
এখানেও ব্যাপারটা তাই। সাহাবায়ে কিরামের আনুগত্য ও অনুসরণকে রাসূলে খোদা হুবহু নিজের আনুগত্য ও অনুসরণ বলে ঘোষণা করেছেন। এর অর্থ দাঁড়ায়, রাসূলের আনুগত্য প্রত্যক্ষ করতে হলে সাহাবায়ে কিরামের আনুগত্য লক্ষ করতে হবে। সাহাবীদের অনুসরণ করা হলে রাসূলে খোদার অনুগত্য কায়িম থাকবে; অন্যথায় নয়। সারমর্ম এ দাঁড়ায় যে, রাসূল এবং তাঁর সাহাবার পথ পৃথক পৃথক নয়; বরং যেটি রাসূলের পথ সেটিই তাঁর সাহাবার পথ। এ কারণে রাসূল যেমন বিভিন্ন ফিরকার হক-বাতিলের মিয়ার, তেমনি রাসূলের সাহাবীগণও হক-বাতিলের মিয়ার; যাঁদের আলোকে অন্য সবার হক ও বাতিল অতি সহজেই যাচাই করা সম্ভব। যাইহোক, উল্লেখিত হাদীস থেকে কেবল সাহাবায়ে কিরামের ফজিলত ও মর্যাদাই প্রমাণিত হয় নি, কেবল তাঁদের অনুসরণীয়তা ও গ্রহণযোগ্যতাই প্রমাণিত হয় নি; বরং উম্মতের হক ও বাতিলের জন্য তাঁদের মিয়ারী শানও প্রমাণিত হয়েছে। তাঁরা কেবল হকের উপর প্রতিষ্ঠিতই নয়, বরং হক যাচাই করার মাপকাঠিও বটে; যার মাধ্যমে অন্যান্যদের জন্য হক ও বাতিল সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়ে যায়। অতএব, সাহাবীগণের মিয়ার হওয়ার এ শান নিছক তাঁদের অনন্য ফজিলত থেকে রায় ও ইজতিহাদের মাধ্যমে আবিষ্কার করা হয় নি; বরং আল্লাহর রাসূল সা. স্বীয় সত্তার সাথে মিলিয়ে তাঁদের হক ও বাতিলের মিয়ার হওয়ার সাক্ষ্যও দিয়েছেন। এর ফলে তাঁরা উম্মতের ভিন্ন ভিন্ন চিন্তা-চেতনা লালনকারীদের হক ও বাতিল যাচাই করার কষ্টিপাথর প্রমাণিত হয়েছেন। সুতরাং তাঁদের হক ও বাতিলের মিয়ার হওয়া কিয়াসী নয়; বরং হাদীসের নস দ্বারা সুপ্রমাণিত।
৩. যখন রাসূলে খোদার সাথে রাসূলের সাহাবা সমগ্র উম্মতের হক-বাতিল যাচাই-বাছাইর মাপকাঠি প্রমাণিত হলেন, তখন কি তাঁদেরকে সমালোচনার অধিকার উম্মতের থাকবে? ছিদ্রানুসন্ধানের মাধ্যমে তাঁদের ভুল ধরতে শুরু করবে?
না, বরং উম্মতের সহীহ-গলতের ফয়সালা দেয়ার অধিকার তাঁদের। কে জানে না যে, সমালোচনার অধিকার একমাত্র মিয়ারের হয়ে থাকে, যিনি স্বয়ং যাচাই-বাছাই কিংবা বিচার-বিশ্লেষণ ক্ষমতাসম্পন্ন। অন্য কোনো তদন্তকারীর মুখাপেক্ষী নন। আখের এ কি করে সম্ভব যে, যে স্বীয় ভাল-মন্দ যাচাই করা ও ফায়সালার জন্য কোন বিচারকের উদ্দেশ্যে পথ চলতে শুরু করল। চলতে চলতে হঠাৎ পথিমধ্যে নিজেই বিচারক সেজে বসল এবং নিজের উপর ফরমান জারির পরিবর্তে বিচারকের বিরুদ্ধে আসন গ্রহণ করল। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, রাসূলে খোদা যেমন হক-বাতিলের মিয়ার হওয়ার কারণে সকল সমালোচনার উর্ধ্বে, তেমনি রাসূলের সাহাবা রাসূলেরই ফায়সালার মাধ্যমে হক-বাতিলের মিয়ার হওয়ার সুবাদে সকল বিচার-বিশ্লেষণের উর্ধ্বে। অন্যথায় কাউকে মিয়ারে হক স্বীকার করে নেয়ার পর আবার তার দোষ খোঁজা অর্থাৎ খেলাফে হক বোঝানোর জন্য তার উপর আপত্তি তোলা কিংবা তার উপর খেলাফে হক হওয়ার অপবাদ দেয়া, তাকে মিয়ারে হক মেনে নেয়ার নামে অস্বীকার করার নামান্তর; যা প্রকাশ্য স্ব-বিরোধিতা বৈ অন্য কিছু নয়। এ কারণে যদি হযরাত সাহাবায়ে কিরাম রাযি. উম্মতের ফিরকাসমূহের হক ও বাতিল ফায়সালা করার মিয়ার হন এবং হাদীস অনুযায়ী অবশ্যই মিয়ার হবেন, তাহলে তাঁরা নিঃসন্দেহে সেসব ফিরকার সমালোচনার উর্ধ্বেও হবেন। অন্যথায় তাঁদের মধ্যে মিয়ার হওয়ার মাহাত্ম্য বাকী থাকবে না, যেটা প্রতিষ্ঠিত থাকা হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী জরুরি।
৪. সাহাবায়ে কিরাম মিয়ারে হক এবং সমালোচনার উর্ধ্বে প্রমাণিত হয়ে যাওয়ার পর এই সূক্ষ্ম বিষয় মাথায় রাখতে হবে যে, সাহাবায়ে কিরাম হক-বাতিলের কষ্টিপাথর হওয়ার অর্থ এটা হতেই পারে না যে, কষ্টিপাথর তো সোনার খাদ-নিখাদ হওয়াকে সুস্পষ্ট করে দেয়, কিন্তু পাথর নিজে খাদ-নিখাদ কোনটাই নয়; এমনিভাবে সাহাবীগণও এ অর্থে মিয়ারে হক যে, অন্যান্যদের হক-বাতিল হওয়া তো তাঁদের মাধ্যমে নির্ণিত হবে, কিন্তু স্বয়ং তাঁরা হকও নয়, বাতিলও নয় (মাআযাল্লাহ)। কারণ, রাসূল সা. হুকুমের মাধ্যমে তাঁদেরকে নিজের সাথে মিলিয়ে উম্মতের জন্য মিয়ারে হক ঘোষণা করেছেন। আর এটা সুস্পষ্ট যে, রাসূলের মিয়ার হওয়ার অর্থ হল— তিনি হক ও সাদাকাতের মূর্ত প্রতীক। তাঁর আপাদমস্তক সিদক ও আমানতে পরিপূর্ণ; যেখানে বাতিলের সামান্যতম আঁচড় লাগাও অসম্ভব। এ কারণে সাহাবীগণের মিয়ার হওয়ার অর্থ এটাই হবে যে, তাঁরাও নির্ভেজাল হকের জ্যান্ত ছবি এবং হক ও সাদাকাতের জীবন্ত নমুনা, যেখানে বাতিলের অনুপ্রবেশ থাকে না। অতএব, রাসূলে কারীম সা. এবং সাহাবায়ে কিরামের মিয়ারে হক হওয়ার এ মাহাত্ম্য স্পষ্ট হয় যে, তাঁদেরকে সামনে রাখার ফলে হক-বাতিলের পরিপূর্ণ ব্যবধানও সুস্পষ্ট হয়ে উঠে এবং হক হাসিলও হয়ে যায়। কারণ, তাঁরা যখন হকের পূর্ণাঙ্গ নমুনা হয়েছেন এবং এই উম্মতের হকের প্রথম নমুনা হয়েছেন, তখন হকের পরিচয় তাঁদের মাধ্যমেই জানা যাবে এবং তাঁদের কাছ থেকে হক পাওয়া যাবে। তবে শর্ত হল তাঁদের অনুসরণ করতে হবে। সাহাবীগণের মিয়ারে হক হওয়া এবং উম্মতের ভিন্ন ভিন্ন চিন্তাধারার ফিরকাগুলোর হক-বাতিলের কষ্টিপাথর হওয়ার মর্ম এ দাঁড়ায় যে, যে ফিরকা তাঁদের অনুসরণকে জরুরি মনে করবে, তারাই হকের উপর থাকবে এবং সে নিকষে পুরোপুরি উত্তীর্ণ হবে। আর যারা সাহাবীদের থেকে বিমুখ হয়ে উল্টো পথে চলবে, তারাই বাতিলের উপর থাকবে এবং তারা কখনো উক্ত মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হতে পারবে না। আর প্রকাশ থাকে যে, আনুগত্যের সর্বনিম্ন স্তর হল তাঁদেরকে জেরা ও সমালোচনা করার পরিবর্তে স্বীকৃতি দেওয়া, ভুল ধরা ও ছিদ্রান্বেষণ করার পরিবর্তে তাঁদের সত্যায়ন করা, মন্দ ধারণার পরিবর্তে তাঁদের প্রতি সুধারণা পোষণ করা আর মিথ্যা ইত্যাদি ঘৃণ্য অপবাদ আরোপের পরিবর্তে তাঁদেরকে সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত মনে করা। যদি তাঁদের পরবর্তী শ্রেণীর উম্মতের মধ্যে আনুগত্যের এ নিম্নস্তরও বিদ্যমান না থাকে এবং উপরোল্লিখিত অনুপাতে সাহাবীদের আদর্শকে সামনে না রাখে, তাহলে নিশ্চিতরূপে না তাদের হক হাসিল করা সম্ভব হবে, আর না তাদের দিলের মধ্যে হক ও বাতিলের মধ্যে প্রভেদ করার অনুভূতি সৃষ্টি হবে। কারণ সাহাবায়ে কিরামই রাসূলের পরে এই উম্মতের প্রথম মুমিন এবং উম্মতের মধ্যে তাঁরাই দীনের প্রথম মুবাল্লিগ। দীনের কিছু অংশ কতকের মাধ্যমে পৌঁছেছে, আরো কিছু অংশ অন্য কতকের মাধ্যমে। হাদীসে রাসূলের কিছু ভান্ডার কতকের মাধ্যমে হাসিল হয়েছে, আরো কিছু অংশ অন্য কতকের মাধ্যমে। কুরআনে হাকীমের কিছু অংশ কতকের মাধ্যমে পাওয়া গেছে, আরো কিছু অংশ অন্য কতকের মাধ্যমে; যেগুলো কুরআন লিপিবদ্ধকারী সাহাবীগণ জমা করেছিলেন। সুতরাং কোন এক সাহাবীর ইত্তিবা থেকে বিমুখতা বা তাঁর জেরা-সমালোচনা বস্তুতঃ দীনের সে অংশকে অস্বীকার করা বুঝায়, যা ঐ সাহাবী থেকে বর্ণিত হয়ে উম্মত পর্যন্ত পৌঁছেছে। বর্ণনাকারী যদি সন্দেহযুক্ত ও অনির্ভরযোগ্য হন, তবে তাঁর থেকে বর্ণিত দীনের অংশও সন্দেহযুক্ত এবং অনির্ভরযোগ্য হবে। আল্লাহ না করুন, যদি লাগামহীনভাবে সাহাবায়ে কিরামের ছিদ্রান্বেষণ ও সমালোচনা করা এবং তাঁদেরকে অনুসরণ অযোগ্য আখ্যা দেয়ার অধিকার দিয়ে দেয়া হয়, আর তা সবার মধ্যে জারি ও প্রচলিত থাকে, যেটা করার জন্য আমাদেরকে প্ররোচিত করা হচ্ছে যে, ‘রাসূলে খোদা ব্যতীত কাউকে সমালোচনার উর্ধ্বে মনে করা যাবে না, কারো যিহনী গুলামীতে লিপ্ত হওয়া যাবে না’- তাহলে দীনের কোন একটি অংশও সন্দেহমুক্ত ও নির্ভরযোগ্য থাকবে না এবং উম্মতের কোন একজন ব্যক্তিও দীনদার বা দীনের দাবিদার বনতে পারবে না। এ কারণে সাহাবার উপর তানকীদকে বৈধ বিবেচনাকারীদের, বরং এটাকেই স্বীয় দীনের মূলনীতি বানানোর কারিগরদেরকে প্রথমত নিজেদের দীনের খবর নেয়া উচিত যে, তা বাকী আছে, না শেষ হয়ে গেছে। মোদ্দা কথা নিরঙ্কুশ আনুগত্য ও যেহনী গোলামীর সর্বনিম্ন স্তর হল সাহাবায়ে কিরামের ব্যাপারে অন্তরে সুধারণা পোষণ করা এবং তাঁদের জেরা ও সমালোচনা থেকে জবানকে বিরত রাখা। তাঁদেরকে দোষী মনে করে আনুগত্যের প্রতীক মানা সম্ভব নয়। কারণ দোষকে দোষ জেনে তার আনুগত্য করা যায় না। এ কারণে উক্ত হাদীসের আলোকে উম্মতের মাঝে কেবল ঐ জামাআত হকপন্থী, যারা সর্বদিক দিয়ে সাহাবায়ে কিরামের সমর্থন ও সত্যায়ন করেন এবং সাহাবার সংশোধন ও পবিত্র হওয়ার জযবা নিজেদের অন্তরে লালন করেন। আর নিঃসন্দেহে সে অনুগত শ্রেণী বা যেহনী গোলামীর পৃষ্ঠপোষক হলেন একমাত্র আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআত; যাঁদের আকীদাই হল সাহাবায়ে কিরাম সবাই নির্বিশেষে নির্বিচারে সম্পূর্ণ আদিল এবং পূত ও পবিত্র। তাঁদের প্রত্যেক কাজের প্রেরণা সৎ, নিয়ত সহীহ এবং ইরাদা সাচ্ছা ছিল। তাঁদের আপসে বিবাদও হয়েছে। তবে তাঁদের বিবাদে অন্যায় ছিল না। তাঁদের বিরোধও আমাদের ঐক্য থেকে মধুর ছিল। তাঁদের সবার নফস আম্মারাহ নয়, বরং মুতমায়িন্নাহ ছিল। তাঁদের অন্তর তাকওয়া-ত্বাহারাতের প্রাণকেন্দ্র ছিল। যাঁদেরকে স্বয়ং আল্লাহ তাআলা পরীক্ষা করেছেন, তাঁদের নিসফে মুদ সদকা আমাদের পাহাড়সম সদকা থেকে উত্তম ছিল। তাঁরা লৌকিকতা ও কৃত্রিমতা মুক্ত ছিলেন। তাঁদের ইলম ছিল সুগভীর এবং স্বচ্ছ। তাঁদের তাওহীদ ও ইখলাসের মাকামের সাথে গোটা উম্মতের তাওহীদ ও ইখলাসের কোন তুলনাই হয় না। হাসান বসরী রাহিমাহুল্লাহর বক্তব্য অনুসারে আমীরে মুআবিয়ার ঘোড়ার নাকের ডগার বালিও হাজার হাজার উমর ইবনে আব্দুল আযীযের চেয়ে উত্তম। কারণ মুআবিয়া সাহাবী, উমর ইবনে আব্দুল আযীয তাবেয়ী। [রুহুল মাআনী]
উল্লেখিত গুণাবলী আকীদারূপে মানসপটে উপস্থিত থাকার পর সাহাবায়ে কিরামের জেরা ও সমালোচনার তো কোন প্রশ্নই অন্তরে উঁকি মারতে পারে না। তবে যেহনী গোলামীর প্রশ্ন অবশ্য উদিত হতে পারে। কাজেই এ ধারাবাহিক বর্ণনাগত দীনে মুসলমান জাতি রেওয়ায়েত এবং দেরায়েত, তিলাওয়াত এবং তালীম-তাযকিয়া, ইজমাল এবং তাফসীর সর্বক্ষেত্রে যে আউয়ালীন জামাআতের মুখাপেক্ষী, আখের তাঁদের যেহনী গোলামী করবে না তো কী করবে? যাইহোক, রাসূলে খোদা তাঁদেরকে উম্মতের বিভিন্ন ফিরকার হক ও বাতিলের মাপকাঠি নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আর ঐ মাপকাঠির শান এই যে, তাঁদের মাধ্যমেই হক ও বাতিল পৃথক হয় এবং তাঁদের সাথেই হক মিলিত হয়। এমতাবস্থায় তাঁদের যেহনী গেলামী ব্যতিরেকে কি উপায় থাকবে? ফলশ্রুতিতে হকপন্থী হওয়ার পরিবর্তে মানুষ বাতিলের দিকে ধাবিত হবে। রাফিয়ী, খারিজী, মুতাযিলী সহ এ জাতীয় অন্যান্য ফিরকাগুলো বাতিল এজন্য ঘোষিত হয়েছে যে, তাঁরা সাহাবায়ে কিরামকে সমালোচনার উর্ধ্বে মনে করত না, তাঁদের যেহনী গোলামীর প্রতি সহমত ছিল না এবং তাঁদের নিন্দা ও ছিদ্রান্বেষণ করা থেকে বিরত থাকত না। অথচ এগুলো থেকে আল্লাহর রাসূল সা. সুস্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করেছেন। ইরশাদ করেছেন, ‘আমার সাহাবীদের উপর অভিসম্পাত করো না; আমার সাহাবীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর।’ ছিদ্রান্বেষণ, সমালোচনা, যাচাই-বাছাই এ সবকিছু উক্ত নিষেধাজ্ঞার আওতায় এসে যায়। তাঁরা হেদায়েতের নক্ষত্র; তাঁদের মাধ্যমে পথের দিশা লাভ হবে। তাঁদেরকে পথ দেখানো লাগবে না; তাঁদের অনুসরণ করতে হবে। তাঁদেরকে ভুল ধরিয়ে দিয়ে অনুসরণ শিখানো লাগবে না। সুতরাং যারা তাঁদের সমালোচনার পরিধি সে পবিত্র জামাআত পর্যন্ত বিস্তৃত করতে চায়, যারা খেলতে খেলতে পাকা শশ্রুমণ্ডিত মুরুব্বির সাথেও খেলা করার ন্যায় তাঁদের উপরও জেরা ও তানকীদকে জায়িয করতে চায়, এই একটি জিনিসই তাদের পথটা বাতিল হওয়ার ও আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের বিপরীত হয়ে তাঁদের থেকে ছিটকে পড়ার উপযুক্ত দলীল। এখন চাই তারা নতুন বাতিল হোক বা পুরাতন বাতিলের যেহনী গোলামীতে লিপ্ত হয়ে তাদের অনুসারী হোক। কিন্তু আহলে হক নয় তারা।
৫. উক্ত হাদীস থেকে এটাও প্রতীয়মান হয় যে, যেহেতু সাহাবায়ে কিরাম হক-বাতিলের মিয়ার, সেহেতু তাঁদের বিরোধিতার মাধ্যমেই নতুন ফিরকা জন্ম নিবে: সাদৃশ্যতার মাধ্যমে কোন নতুন ফিরকার প্রাদুর্ভাব ঘটবে না। বরং সে পুরাতন মুক্তিপ্রাপ্ত জামাআতই বহাল থাকবে যেটি সাহাবায়ে কিরামের মাধ্যমে নিজেদের রূহানী সম্পর্ক রাসূলের সাথে সম্পৃক্ত রাখতে সক্ষম হবে। কারণ রাসূলে খোদার যুগে একটি দলই মুক্তিপ্রাপ্ত ছিল এবং তাঁরা ছিলেন সাহাবায়ে কিরামের জামাআত। তাঁরা বরহকও ছিলেন, আবার হকের মিয়ারও ছিলেন। এ কারণে পরবর্তীতে যত দল-উপদল সৃষ্টি হয়েছে, তাঁদের বিপরীত পথে চলেই হয়েছে। তারা মিয়ারে হক সাহাবায়ে কিরাম থেকে পৃথক হওয়ার কারণেই নাহক সাব্যস্ত হয়েছে। সুতরাং যারা আযমত ও ভক্তি-শ্রদ্ধার সাথে বিনা দ্বিধায় সকল সাহাবীকে অনুসরণ করবে, কটাক্ষ ও সমালোচনার উর্ধ্বে মনে করবে, তারা নিঃসন্দেহে কোন ফিরকা নয়, বরং আসল জামাআত হবে, যারা তাদের আকীদা-আমলের রশ্মি সনদের সাথে প্রথম যুগের সে পূত-পবিত্র জামাআতের সাথে সম্পৃক্ত করে নিয়েছে। আর ভক্তি-শ্রদ্ধা ও আযমতের সাথে সুন্নতের উপর অটল থাকার কারণে ঐ জামাআতই প্রকৃত অর্থে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআত নামে অভিহিত হওয়ার যোগ্য। সুতরাং সাহাবায়ে কিরামের বিরোধিতাকারী, জেরা-সমালোচনাকারী বরং এটাকে আকীদা হিসেবে বিশ্বাসকারী মূলত দীনের মধ্যে শিকড়বিহীন আগাছা উৎপন্ন করে এবং নয়া নয়া আকর্ষণীয় লেবেলে দীনের ব্যাখ্যা করে শতধা বিভক্ত উম্মতের মধ্যে ফাটল ও বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি করছে। আর উম্মতকে দীনের নামে কাহিল ও দুর্বল বানাতে যাচ্ছে। বস্তুত এরাই ফিরকা; জামাআত নয়। এমনকি তারা যতই নিজেদের নামের সাথে জামাআত শব্দ যোগ করে হাঁকডাক করুক না কেন।
فاولئك الذين سماهم الله
যাহোক, উল্লেখিত হাদীস থেকে একথা সুস্পষ্ট হয়ে গেল যে, সাহাবায়ে কিরামকে মিয়ারে হক ঘোষণা করেছেন স্বয়ং রাসূলে খোদা সা. এবং রাসূলের ইচ্ছানুযায়ী তাঁরা মিয়ারে হক প্রমাণিত হয়েছেন। এর উপরই নির্ভর করে আজ পর্যন্ত উম্মতে মরহুমা স্বীয় ভাল-মন্দ ও হক-বাতিল নির্ণয় করে আসছে। এ কারণেই রাসূলে খোদা তাঁদের উপর পূর্ণ ভরসা রেখে তাঁদের তরিকাকে স্বীয় তরিকা এবং স্বীয় তরিকাকে তাঁদের তরিকা বলেছেন এবং গোটা উম্মতের জন্য তাঁদেরকে প্রত্যক্ষ প্রমাণ সাব্যস্ত করেছেন। আর কিয়ামত তক উম্মতের হক-বাতিলের ফায়সালা তাঁদের ইলম-আমলের মাপকাঠির ভিত্তিতে হতে থাকবে।
প্রকৃতপক্ষে জামাতে ইসলামীর গঠনতন্ত্রের মৌলিক ধারায় সাধারণভাবে শর্ত ছাড়া মওদূদী সাহেবের এই দাবি যে, রাসূলে খোদা ব্যতীত আর কেউ হকের মাপকাঠি এবং সমালোচনার উর্ধ্বে নন— যেখানে প্রথমেই সাহাবায়ে কিরামকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, অতঃপর তাঁদের উপর জেরা ও সমালোচনার অস্ত্র প্রয়োগ করে তাঁদেরকে যাচাই করার যে ধৃষ্টতা দেখানো হয়েছে, তা কেবল হাদীসে রাসূলের বিরোধিতাই নয়, বরং এক ধরনের নিজে নিজেকে মিয়ারে হক দাবী করার নামান্তর। বস্তুত যে নীতিকে আন্দোলনের ভিত্তি হিসেবে ব্যাপকভাবে ঘোষণা করা হয়েছে, নিজের বেলায় এসে সর্বপ্রথম সেটাই লঙ্ঘন করা হয়েছে এবং রাসূল ব্যতীত পূর্বসূরী-উত্তরসূরী সবার জন্য নিজেই মিয়ারে হক সেজে বসার অপচেষ্টা করা হয়েছে।
ولا تكونوا كالذين نسوا الله فانساهم انفسهم
অর্থাৎ তোমরা তাদের মত হয়ো না, যারা আল্লাহকে ভুলে গিয়েছিল। ফলে আল্লাহ তাদেরকে আত্মভোলা করে দিয়েছেন। [হাশর ১৯]
৬. এদিকে হাদীসের শব্দ থেকে এটাও সুস্পষ্ট হচ্ছে যে, রাসূলে খোদা ব্যতীত কোন নির্দিষ্ট দু-একজন সাহাবীকে মিয়ারে হক বানানো হয় নি, বরং اصحابی এই বহুবচন শব্দ ব্যবহার করে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, রাসূল ছাড়াও সমস্ত সাহাবী মিয়ারে হক হওয়ার সুবাদে অবশ্য অনুকরণীয়। সেজন্য হাদীসে একদিকে যেমন ইজমালীভাবে সকল সাহাবীর অনুসরণের হুকুম দেয়া হয়েছে, অপরদিকে পৃথক পৃথকভাবে নাম নিয়ে নিয়েও তাঁদের অনুসরণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কারণ, মিয়ার হওয়ার পরও মিয়ারের অনুসরণ যদি জরুরি না হয়, তবে সে মিয়ার মিয়ারই থাকে না। আর সাহাবীদের পুরো জামাআতকে যেহেতু মিয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে, সেহেতু কোন প্রকার তারতম্য ছাড়া সবার অনুসরণকেও আবশ্যকীয় করা হয়েছে। কোন সন্দেহকারীর সন্দেহের উদ্রেক হওয়া অসম্ভব নয় যে, যখন সাহাবায়ে কিরামের মাঝে বিভিন্ন শাখাগত মাসআলায় মতবিরোধ পরিলক্ষিত হয় এবং এই মতভিন্নতায় দ্বন্দ্বও দেখা যায়, তখন অনিবার্যভাবে একজনের অনুসরণ করে অন্যদের অনুসরণ ছেড়ে দিতে হবে, অন্যথায় দুটি বিপরীত জিনিসের সমন্বয় হয়ে যাবে যা অসম্ভব, তাহলে সব সাহাবীর ইত্তেবা-অনুসরণ রইল কোথায়? আর সম্ভবই বা কখন হল? জবাব এই যে- একজনের অনুকরণ যদি অন্যদের প্রতি ভর্ৎসনা ও সমালোচনা থেকে বিরত থেকে এবং সবার আযমত ও শ্রদ্ধাবোধ রেখে হয়, তবে এটা সবার অনুকরণ বলে গণ্য হবে। যেমন নুবুওয়াতের ক্ষেত্রে কার্যত অনুসরণ করা হয় এক রাসূলের, কিন্তু সবাইকে মিয়ারে হক মানা হয়; মহিমা, প্রশংসা ও পবিত্রতা সবার জন্য সমানভাবে করা হয়। একজন নবীর সমালোচনা ও ছিদ্রান্বেষণ সব নবীর অবাধ্যতা বিবেচিত হয়। আর এটা সমস্ত নবীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অন্যথায় কোন একজন নবীর নিন্দা-সমালোচনার ব্যাপারে স্বেচ্ছাচারী হয়ে হাজার নবীর অনুসরণও অনুসরণ নয়, বরং সবার অবাধ্যতা ও বিরুদ্ধাচরণের শামিল বলে গণ্য হয়। আর ফুরুয়ী মাসআলায় সাহাবায়ে কিরামের মাঝে মতভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও আপসে একে অপরের আযমত-ইহতিরামকে ওয়াজিব ও আবশ্যকীয় মনে করতেন এবং এর বিপরীতকে বরদাশত করতে পারতেন না। যেমন আম্বিয়ায়ে কিরাম আলাইহিমুস সালাম শরীয়তের ক্ষেত্রে বিভিন্ন হয়েও একে অপরের সত্যায়নকে ঈমানের অঙ্গ মনে করতেন। অতএব, কোন নিন্দুক ও ছিদ্রান্বেষণকারী যখন তাঁদের সামান্য পরিমাণ বিরোধিতা করে, তখন তা সবার বিরোধিতা ও সবার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের নামান্তর হয়। নিম্নোক্ত হাদীসে নববীতে এই বিষয়বস্তুর প্রতি আলোকপাত করা হয়েছে,
اصحابی کالنجوم بأيهم اقتديتم اهتديتم
অর্থাৎ আমার সাহাবীগণ নক্ষত্রতুল্য। যে কারো অনুসরণ করবে, হেদায়েত পেয়ে যাবে।
আরবি ‘ايهم’ শব্দ দ্বারা অনুসরণকে উন্মুক্ত রাখা হয়েছে অর্থাৎ তাঁদের যে কোন একজনেরও অনুসরণ করা হলে হেদায়েত পাওয়া যাবে। কিন্তু নক্ষত্র শব্দ দ্বারা সবাইকে নূরান্বিত বুঝা ও পথপ্রদর্শক মানা অত্যাবশ্যকীয় ঘোষণা করা হয়েছে। এ অর্থ নয় যে, যার অনুসরণ করা হবে, হেদায়েত ও নূরের পথিকৃৎ কেবল তিনিই। সুতরাং অনুসরণের আমল দু’একজন সাহাবী পর্যন্ত সীমাবদ্ধ হতে পারে। কিন্তু নূরের দিশারী হওয়ার বিশ্বাস দু’একজন সাহাবী পর্যন্ত সীমাবদ্ধ হতে পারে না ; সাহাবীগণের সবাইকে আলোর দিশারী এবং আলো বিতরণকারী মানা অত্যাবশ্যকীয়।
যাহোক, সাহাবায়ে কিরামের মর্যাদা তো এই যে, তাঁদের পুরো জামাআতের নাম নিয়ে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদেরকে উম্মতের ভিন্ন ভিন্ন চিন্তাধারার ফিরকাসমূহের হক ও বাতিলের মাপকাঠি ঘোষণা করেছেন, তাঁদেরকে সমালোচনার উর্ধ্বে বলেছেন এবং তাঁদের যেহনী গোলামী বা আনুগত্য ও অনুসরণ জরুরি আখ্যা দিয়েছেন। তাঁদের পরবর্তী আর কোন শ্রেণীকে জামাআত আকারে উল্লেখ করে মিয়ার ঘোষণা করেন নি। তবে হ্যাঁ, মিয়ার হওয়ার পরিপূর্ণ ফরমুলা এবং মিয়ারের মানদণ্ড নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, যা সামনে রেখে প্রত্যেক যুগেই মোটের উপর মিয়ারী ব্যক্তিদের শনাক্ত করা সম্ভব।
এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, শ্রেষ্ঠ যুগত্রয়ের পর মানবীয় দুর্বলতার সম্ভাবনাও বিদ্যমান আছে এবং মাঝেমধ্যে এসব দুর্বলতা কার্যক্ষেত্রে প্রকাশিতও হয়েছে। তবে এ ধরনের সাময়িক দুর্বলতার দ্বারা মিয়ারী ব্যক্তিদের মিয়ার হওয়ার মাঝে কোন তারতম্য ঘটবে না। কারণ প্রথমত মুত্তাকী উম্মতের মধ্যে কারো জীবনকে পবিত্র জীবন ঘোষণা করার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, তার জীবনের বৃহদাংশ তাকওয়া-ত্বাহারাতের ভিত্তিতে গড়ে উঠবে। দ্বিতীয়ত পরবর্তী লোকেরা কেবল এ অর্থে মিয়ারে হক ও বাতিল হবেন যে, তাঁদের সমষ্টিগত জীবনকে সামনে নিয়ে নিজের দীনের আমলী জিন্দেগীর জন্য একটি নকশা তৈরী করা সম্ভব হয় এবং সে নকশাকে তাঁদের পবিত্র আমলী নকশার উপর ফিট করে নিজের হক-বাতিলের ফয়সালা করা সম্ভব হয়। এ অর্থে তারা মিয়ারে হক নয় যে, তাঁদের প্রত্যেক কথা ও কাজ শরীয়তের দলীল। কাজেই এ ধরনের পবিত্র লোক এবং মিয়ারী ব্যক্তিত্ব প্রত্যেক যুগে বিদ্যমান থাকবেন এবং উম্মতের জন্য আলোর মিনার প্রমাণিত হবেন। যতক্ষণ ব্যক্তি লিটারেচারের বাস্তব নমুনারূপে সামনে না আসবে, ততক্ষণ রুশদ ও হেদায়েতের পথে কেবল লিটারেচারের (বই-পুস্তক) নির্দেশনা যথেষ্ট নয়। অন্যথায় আসমানী কিতাবের সাথে আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামকে প্রেরণের আদৌ প্রয়োজন ছিল না। বস্তুত আসমানী কিতাবের অর্থ ও মর্মের নির্ধারণের জন্যই এসব পবিত্র সত্তাগণ মিয়ারে হক হয়ে থাকেন। তাঁরা না হলে কিতাবুল্লাহর অর্থ নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রত্যেক খাহিশপূজারী লাগামছাড়া ও স্বেচ্ছাচারী হয়ে যেত এবং হক-বাতিলের কোন ফয়সালা করা কখনো সম্ভব হত না। তাই রাসূলে খোদার পরে কিয়ামত পর্যন্ত মুজাদ্দিদ, মুহাদ্দিস, ইমাম, মুজতাহিদ, রাসিখ ফিল ইলম, মুনীব, ফকীহ প্রভৃতি নামে মিয়ারী ব্যক্তিদের আগমন অব্যাহত থাকা অত্যাবশ্যকীয় যাঁদের নিরিখে আম-খাস নির্বিশেষে সমস্ত উম্মত স্বীয় দীনি আকীদা ও কর্মকান্ডকে যাচাই করতে পারে এবং মোটামোটিভাবে নিজেদেরকে তাঁদের মত বানিয়ে আত্মিক শান্তি ও প্রশান্তি লাভ করতে পারে।
মওদূদী সাহেব তো রাসূলে খোদা ব্যতীত অন্য কোন মানুষকে মিয়ারে হক মানতে রাজি নন। অথচ কিতাব-সুন্নাহর ফয়সালা হল রাসূলে খোদার পরও কিয়ামত পর্যন্ত মিয়ারী ব্যক্তিত্বের আগমন অব্যাহত থাকবে। তাঁরা স্তরবিন্যাস হিসেবে হক ও বাতিলের মাপকাঠি প্রমাণিত হবেন এবং যারাই কিতাব-সুন্নাহর শব্দ থেকে হীন স্বার্থ চরিতার্থের প্রয়াস চালাবে, তখনই তাঁরা সমকালীন যুগের ভাষায় তাদের অপব্যাখ্যার অপনোদন করে দীনের প্রকৃত দীপ্তিমান চেহারা দেখাতে থাকবেন। যেমন হাদীসে ইরশাদ হয়েছে,
يحمل هذا العلم من كل خلف عدوله ينفون عنه تحريف الغالين
وانتحال المبطلين وتأويل الجاهلين – مشكوة
অর্থাৎ এ (দীনি) ইলমকে (প্রত্যেক জমানার) ন্যায়-নিষ্ঠাবান লোকেরা (স্বীয় পূর্বসূরীদের কাছ থেকে) বহন করবে। তাঁরা দীন থেকে (সীমালঙ্ঘনকারী) উগ্রপন্থীদের অপব্যাখ্যা, বাতিলপন্থীদের মিথ্যাচার এবং মূর্খদের মর্মবিকৃতি দূরীভূত করবেন। [মিশকাত শরীফ]
আল্লাহ তায়ালা যেন আমাদেরকে দীনের সঠিক বুঝ হাসিল করার তৌফিক দান করেন। আমীন।

মাওলানা মুতিউর রহমান খান সাহেব থেকে সংগৃহিত

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ ক্যাটাগরির আরো
© All rights reserved © 2019 www.izharehaq.com
Theme Customized BY Md Maruf Zakir