1. info@izharehaq.com : MZakir :
রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ০৩:৫৯ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :
গোয়েবলসীয় নীতি : হিটলারের ঐ মুখপাত্রও ”জামাত-শিবিরের মিথ্যাচারের কাছে হার মানায়”: পর্ব ১ ইক্বামাতে দ্বীনের তাৎপর্য এবং বাতিলপন্থীদের বিকৃত ব্যাখ্যা সাহাবাগণ রাঃ সত্যের মাপকাঠি এবং তাদের ইজমা সর্বসিদ্ধান্ত মতে শরীয়তের দলীল সাহাবা রাঃ গণ সত্যের মাপকাঠি খোলাফায়ে রাশেদীনগণের সোনালী আদর্শ সর্বসম্মতিক্রমে শরিয়তের দলীল শায়খ আলিমুদ্দীন দুর্লভপুরী”র ঐতিহাসিক ও তাত্বিক বক্তব্য: “তাঁরাই সত্যের মাপকাঠি” শায়খ আলিমুদ্দীন দুর্লভপুরী”র ঐতিহাসিক ও তাত্বিক বক্তব্য: সাহাবায়ে কেরাম “সত্যের মাপকাঠি: মিয়ারে হক: সত্যের মাপকাঠি: কুরআন-হাদীস এবং মওদূদী সাহিত্যের আলোকে: পর্ব-৬ মিয়ারে হক: সত্যের মাপকাঠি: কুরআন-হাদীস এবং মওদূদী সাহিত্যের আলোকে: পর্ব-৫ মিয়ারে হক: সত্যের মাপকাঠি: কুরআন-হাদীস এবং মওদূদী সাহিত্যের আলোকে: পর্ব-৪ জামায়াতে ইসলামী’র গোমরাহী বিষয়ক “শায়খ আলিমুদ্দীন দুর্লভপুরী”র ঐতিহাসিক ও তাত্বিক বক্তব্য: ৩য় পর্ব আবুল আ’লা মওদূদী মরহুম যেভাবে হাদীস অস্বিকারকারীদের কাতারে নাম লেখালেন! মিয়ারে হক: সত্যের মাপকাঠি: কুরআন-হাদীস এবং মওদূদী সাহিত্যের আলোকে: পর্ব-৩ মিয়ারে হক: সত্যের মাপকাঠি: কুরআন-হাদীস এবং মওদূদী সাহিত্যের আলোকে: পর্ব-২ মিয়ারে হক: সত্যের মাপকাঠি: কুরআন-হাদীস এবং মওদূদী সাহিত্যের আলোকে: পর্ব-১ জামায়াতে ইসলামী’র গোমরাহী বিষয়ক “শায়খ আলিমুদ্দীন দুর্লভপুরী”র ঐতিহাসিক ও তাত্বিক বক্তব্য: ২য় পর্ব মিথ্যাচারের উপর দাঁড়িয়ে আছে কারা? কওমী শিক্ষাব্যবস্থা না জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাস? কুরআন ও হাদীসের আলোকে সাহাবায়ে কিরামের পরিচিতি ও মর্যাদা জামায়াতে ইসলামী’র গোমরাহী বিষয়ক “শায়খ আলিমুদ্দীন দুর্লভপুরী”র ঐতিহাসিক ও তাত্বিক বক্তব্য মওদূদী সাহেব ও জামায়াতে ইসলামীর সাথে আলেম সমাজের বিরোধিতার প্রকৃত কারণ:

পারভেযী মতবাদ বা ফিতনায়ে ইন্‌কারে হাদীস

নাম:
  • আপডেট সময় : শুক্রবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩
  • ৩৪৮ বার পড়া হয়েছে

পারভেযী মতবাদ বা ফিতনায়ে ইন্‌কারে হাদীস

ইসলামের বিরুদ্ধে ইয়াহুদী চক্রান্তের অংশ হিসাবে কুচক্রী মুনাফিক সর্দার আবদুল্লাহ ইবনে সাবা ও তার দলবল ইসলামের ইতিহাসে সর্বপ্রথম হিফাযতে কুরআন এবং আদালতে সাহাবা সম্পর্কে আপত্তি উত্থাপন করে। তারাই প্রথমে হাদীসের উপর কুঠারাঘাত করে এবং আহলে বায়ত ছাড়া অন্য সকল সাহাবী থেকে বর্ণিত হাদীসকে অস্বীকার করে। এরপর সিফফীনের ময়দানে সালিশ নির্ধারণ করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে হাদীস অস্বীকার করার ব্যাপারে নতুন আরেক সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। ইসলামের ইতিহাসে এরা খারিজী সম্প্রদায় হিসাবে পরিচিত। এ সম্প্রদায় তাহকীম বা সালিশে বিশ্বাসী সকল সাহাবীকে কাফির ফতোয়া দিয়ে তাদের বর্ণিত সকল রিওয়ায়েত এবং হাদীসসমূহকে অগ্রহণযোগ্য বলে ঘোষণা দেয়। এদের মোকাবিলায় আত্মপ্রকাশ করে রাফিযী ও শীয়া সম্প্রদায়। তারা কুরআনে কারীম বিকৃত এ দাবী উত্থাপন করার সাথে সাথে নবী পরিবার ব্যতীত অন্য সকল সাহাবীর রেওয়ায়েতকে অনির্ভরযোগ্য বলে এসব হাদীসের প্রতি অস্বীকৃতি প্রকাশ করে এবং দীনকে নিজেদের ইমামগণের অনুসরণ ও অনুকরণের মাঝে সীমাবদ্ধ বলে প্রচার করতে থাকে। এ সব কিছু হওয়া সত্ত্বেও ইসলাম তার নিজস্ব গতিতে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। দলে দলে ইসলামের পতাকাতলে সমবেত হতে থাকে বিভিন্ন চিন্ত ধারার, বিভিন্ন আকীদার, বিভিন্ন মাযহাবের বিভিন্নপন্থী লোক। এ কারণে তদানীন্তনকালে মুসলিম সমাজে কতিপয় মানব মেধা প্রসূত যুক্তিবিদ্যাগত জটিলতা দেখা দেয়। উত্থাপিত হয় কিছু দার্শনিক প্রশ্ন। সীমিত জ্ঞানের কারণে এসব সমস্যার সমাধানে ব্যর্থ হয়ে ইসলাম সম্পর্কে অনভিজ্ঞ কতিপয় লোক হাশর-নশর, আল্লাহর দর্শন, মীযান, পুলসিরাত, জান্নাত, জাহান্নাম অনুরূপ আরো অনেক কিছু কুরআন, হাদীস, ইজমা, কিয়াস তথা শরীয়তের মৌলিক চার দলীলের দ্বারা স্বীকৃত ও সমর্থিত প্রভৃতি বিষয়গুলোকে অস্বীকার করে বসে। ফলে সংযোজন হয় মুনকিরীনে। হাদীসের তালিকায় আরেকটি দলের। ইসলামের ইতিহাসে এ দলটিই মুতাযিলা সম্প্রদায় নামে পরিচিত।
মুনকিরীনে হাদীসের এ সব ফিতনা চিরতরে স্তব্ধ করে মুসলমানদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য মুহাদ্দিসীন, মুজাদ্দিদীন ও ফুকাহায়ে উম্মত আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন। তাদের এ অক্লান্ত পরিশ্রমের বদৌলতে হিজরী তৃতীয় শতাব্দীতে হাদীস অস্বীকারকারী সম্প্রদায়ের দৌরাত্ম বন্ধ হয়ে যায়, নস্যাৎ হয়ে যায় তাদের সকল ষড়যন্ত্র ও সমুদয় কারসাজি। তখন থেকে নিয়ে হিজরী ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত এ ফিতনা আর মাথাচাড়া দিয়ে উঠেনি কোথাও। তবে ক্রুসেড যুদ্ধে পরাজিত হয়ে খৃষ্টান জগত যখন বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল, প্রতিহিংসার অগ্নিশিখা যখন তাদের মনে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছিল, পরাজয়ের গ্লানি যখন তাদেরকে উস্‌কে দিচ্ছিল তখন সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হয়ে লড়াই করার সাহস না পেয়ে তারা ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয়। দাঁড় করায় অরিয়েন্টালিস্টদের এক বিরাট দল। তারা ইসলাহে মাযহাব, ইসলাহে দীনে ইসলাম, সায়েন্টিফিক রিচার্স ও ইসলামে নতুন সংস্কার প্রভৃতির নামে কায়েম করে বহু সংস্থা ও সংগঠন। উদ্দেশ্য হল, মনীষীদের ব্যক্তিত্বকে ক্ষুণ্ণ করে দেয়া, ইসলামের মৌলিক আকীদায় কুঠারাঘাত করা এবং ইসলামের এ অগ্রযাত্রাকে ব্যর্থ করে দেয়া।

অভিশপ্ত অরিয়েন্টালিস্ট সম্প্রদায়ের লিটারেচার ও তাদের ক্ষুরধার লিখনির সামনে নতজানু হয়ে এবং পাশ্চাত্য চিন্তাধারায় প্রভাবান্বিত হয়ে মুসলিম নামধারী তথাকথিত প্রগতিশীল কতিপয় লোক তাদের এ পদক্ষেপকে মুবারকবাদ জানায় এবং সর্বাত্মকভাবে তাদের সাথে প্রচেষ্টা ও সহযোগিতা চালিয়ে যেতে থাকে। মূলত ভারত উপমহাদেশে সাম্রাজ্যবাদ পুষ্ট এ আন্দোলনকে সর্বপ্রথম মুবারকবাদ এবং শুভাগমন জানিয়েছিলেন জনাব স্যার সৈয়দ আহমদ খান এবং তার সাথী মৌলভী মুহাম্মদ চেরাগ আলী। তারাই এ উপমহাদেশে ইনকারে হাদীসের বীজ বপন করার লক্ষ্যে এমন এমন পুস্তক পুস্তিকা প্রণয়ন করেছেন যার প্রতিটি অক্ষর থেকে গোলামী এবং দাসত্বমূলক মানসিকতারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। এ পথ ধরেই জনাব স্যার সৈয়দ আহমদ খান জান্নাত, জাহান্নাম, জিন, ফিরিশতা, মুজিযা এবং অলৌকিক ঘটনাবলীকে অস্বীকার করে সুদ এবং পাশ্চাত্য ধ্যান-ধারণাকে মুসলিম সমাজে চালু করার চরম দুঃসাহসিকতা প্রদর্শন করেছেন।

এরপর ক্রমান্বয়ে আবদুল্লাহ চকড়ালুভী, আসলাম জারাজপুরী, মৌলভী আহমদ দীন আমরসতরী, মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ সাম্রাজ্যবাদীদের আজ্ঞাবহ গোলাম হিসাবে এ ফিতনার নেতৃত্ব দিয়েছেন বলিষ্ঠভাবে। পরিশেষে এ সব গোমরাহী, যালালাত এবং খুরাফাতের যোগ্য উত্তরসূরী হিসাবে আবির্ভূত হন গোলাম আহমদ পারভ্যে। তারই নেতৃত্বে এ ফিতনার প্রচার, প্রসার এবং ইশাআত হয়েছে সর্বাধিক বেশি। তার লিখিত পুস্তক বর্তমান যুব সমাজকে করে দিয়েছে সম্পূর্ণভাবে বিভ্রান্ত। হাদীস অস্বীকার করা, হাদীস সম্পর্কে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করা, হাদীসের প্রতি উপহাস করা এবং পরিহাস করা, হাদীসের অপব্যাখ্যা দেয়া প্রভৃতি বদদীনি কাজগুলো আজ তাদেরই দ্বারা সংঘটিত হচ্ছে এবং এর পেছনে রয়েছে তাদেরই কালো হাত। হাদীস অস্বীকার করার প্রবণতা এবং এ ইরতিদাদী সয়লাব মূলত তিনটি মূলনীতির উপর নির্ভরশীল। নিম্নে এগুলোর বিবরণ পেশ করা হল :

১. হাদীস অস্বীকারকারী সম্প্রদায়ের দাবী হল- ওহীয়ে মাতলু বা কুরআন শরীফই হল একমাত্র ওহী। ওহীয়ে গায়রে মাতলু তথা হাদীস শরীফ কোন ওহীই নয়। কুরআনের তাবলীগ এবং কুরআন প্রচার ও প্রসারই হল একমাত্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দায়িত্ব। কুরআনের অনুসরণ এবং অনুকরণই কেবল আমাদের জন্য ওয়াজিব। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসরণ না সাহাবীদের জন্য ওয়াজিব ছিল, না বর্তমানে আমাদের জন্য ওয়াজিব। অধিকন্তু তাদের দাবী হল, কুরআন বুঝা হাদীস বুঝার উপর নির্ভরশীল নয়। কারণ, কুরআনকে আল্লাহ তাআলা সহজ ভাষায় নাযিল করেছেন। কুরআন পাঠ করে যে কোন মানুষই তা হৃদয়ঙ্গম করতে পারে এবং বুঝতে পারে ।

২. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী সমস্ত সাহাবীর জন্য হুজ্জত ও দলীল হিসাবে গণ্য ছিল। কিন্তু তাঁর এ বাণী আমাদের জন্য

হুজ্জত ও দলীল হিসাবে গণ্য নয় ।

৩. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী সমস্ত মানুষের জন্য হুজ্জত এবং নাজাতের অন্যতম উপায় হিসাবে মেনে নিলেও আমাদের সামনে বিদ্যমান হাদীসসমূহ যেহেতু কোন নির্ভরযোগ্য সূত্রে আমাদের নিকট পৌছেনি তাই আমরা এ সমস্ত হাদীস মানার জন্য মুকাল্লাফ বা বাধ্য নই।

কর্মপন্থা

হাদীস অস্বীকারকারী সম্প্রদায় নিজেদের ভ্রান্ত ধারণাকে সর্বসাধারণের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে এবং সর্বসাধারণকে এ গলদ দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি ধাবিত করার উদ্দেশ্যে কতিপয় অপকৌশল অবলম্বন করে। কয়েকটি অপকৌশলের বর্ণনা উদাহরণস্বরূপ নিয়ে পেশ করলাম ।

→ কুরআন মজলুম ও নির্যাতিত এবং দীর্ঘদিন পর্যন্ত গোটা উম্মত কুরআনের সঠিক অর্থ উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়নি- এ সব কথা প্রচার করার পাশাপাশি নিজেদেরকে কুরআনের সঠিক সমঝদার এবং ধীমান চিন্তাবিদ হিসাবে সমাজের সামনে পেশ করা।

→ কুরআন ও হাদীসের মাঝে বৈপরীত্য প্রমাণ করে মানুষের মধ্যে এ ধারণা সৃষ্টি করা যে, হাদীস কুরআনের ব্যাখ্যা নয়। বরং বিপরীত দুই মেরুতে অবস্থিত পরস্পর মুখানিফ দুটি গ্রন্থ।

→ কুরআনের মনগড়া ব্যাখ্যা করা যা আজ পর্যন্ত কেউ করেনি।

→ পাশ্চাত্য থেকে আমদানীকৃত ভ্রান্ত মতাদর্শগুলোকে ইসলামী মতাদর্শ

হিসাবে সমাজে চালু করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া ।

→ বিভিন্ন মাযহাবের ফুরূঈ এবং আঙ্গিক ইখতিলাফকে মৌলিক ইখতিলাফে পরিণত করে এ কথা প্রমাণ করা যে, হাদীসই হল এসব ইখতিলাফ এবং বিচ্ছিন্নতার একমাত্র কারণ। যদি এগুলোকে জ্বালিয়ে ভষ্মীভূত করা যায় (নাউযুবিল্লাহ) তাহলে লেশমাত্র ইখতিলাফও আমাদের মাঝে আর থাকবে না।

। যুক্তিবহির্ভূত কোন জিনিসই গ্রহণযোগ্য নয়। তাই অলৌকিক ঘটনাবলীও আমাদের জন্য অলীক, অবাস্তব এবং কল্পনাপ্রসূত কাহিনী।

• বুযুর্গানেদীন, আকাবিরে উম্মত, সলফে সালেহীন এবং পূর্বসূরি আলিমদের লোভী, মিথ্যাবাদী, দালাল ইত্যাদি প্রমাণ করা, তাদের প্রতি ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা, তাদের সমালোচনার লক্ষ্যরূপে নিরূপন করা এবং তাদের প্রতি এমন আচরণ করা যাতে তাদের ব্যক্তিত্ব ক্ষুণ্ন হয়ে যায় এবং মানুষ তাদেরকে অনির্ভরযোগ্য বলে ধারণা করতে থাকে।
* ইসলামের মৌলিক আহকাম, আকায়েদ, ইবাদত, মুআমালাত প্রভৃতি বিষয়ের ক্ষেত্রে জনমনে সন্দেহ সৃষ্টি করা। * সুস্পষ্ট ইবাদত ও নুসূসের মাঝে তাহরীফ করা এবং এগুলোর ভুল

ব্যাখ্যা প্রদান করা।

→ হাওয়ালা বা বরাত দেয়ার ক্ষেত্রে ইবারত কাটছাঁট করে পেশ করা

এবং গোপনীয়তার আশ্রয় নিয়ে অসম্পূর্ণ ইবারত নকল করা।

→ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পারিবারিক জীবনের ঘটনাগুলো নকল করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ব্যক্তিত্বের উপর অশ্লীলতা এবং বেহায়াপনার অপবাদ আরোপ করে সর্বসাধারণের নিকট এ কথা প্রচার করা যে, এ সমস্ত অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা সম্বলিত গ্রন্থাদি আমাদের জন্য কোনক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয় ।

→ হাদীসের নির্ভরযোগ্য কিতাবসমূহকে বাদ দিয়ে সাহিত্য, ইতিহাস, গল্প এবং কাহিনীর পুস্তকাদি থেকে ঘটনাবলী মানুষের সামনে হরহামেশা বয়ান করা।

অরিয়েন্টালিস্ট সম্প্রদায় শুধু দীনের কোন অংশের মাঝে নয়, শুধু কোন হুকুমের মধ্যে নয়, শুধু কোন একটি হাদীসের ব্যাপারে নয়; বরং গোটা শরীয়ত তথা ইবাদত, মু’আমালাত, মু’আশারাত, সিয়াসাত প্রভৃতি বিষয়কে তারা নিজেদের মনগড়া তাহরীফ এবং বিকৃতির লক্ষ্যরূপে নিরূপণ করে নিয়েছে। যাতে মানুষ এ সব লেখা পড়ে মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে দীন থেকে মুনহারিফ হয়ে যায় বা দীন থেকে বিমুখ হয়ে যায়। বর্তমান যুগে হাদীস অস্বীকারকারী সম্প্রদায় নিম্ন বর্ণিত দাবীগুলো পোষণ করছে :

● আল্লাহ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অর্থ হল মারাকাযে মিল্লাত বা ধর্মীয় কেন্দ্র এবং উলুল আমর-এর মর্ম হল অধীনস্থ অফিসারবৃন্দ ।

→ আল্লাহ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনুগত্যের অর্থ হল- মারকাযী হুকুমত বা কেন্দ্রীয় হুকুমতের আনুগত্য।

● খতমে নবুওয়াতের অর্থ- বর্তমানে বিপ্লব কোন ব্যক্তির হাতে নেই। বরং চিন্তা-ভাবনা এবং কল্পনার মাধ্যমেই এ বিপ্লব সাধিত হবে। আর মানব সভ্যতার বাগডোরও কোন ব্যক্তির ক্ষমতায় নেই বরং মানব সভ্যতা নিযাম এবং সিস্টেমের সাথেই তা ওৎপ্রোতভাবে জড়িত।

→ উত্তরাধিকারী সম্পদ, ঋণ, লেনদেন, সাদকা-খয়রাত ইত্যাকার বিষয়গুলো প্রাথমিক যুগের সাথে সম্পর্কিত, বর্তমান যুগের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই ।

খোদা ঐ সমস্ত উন্নত গুণাবলীর নাম যা মানুষ নিজের মাঝে আনয়নের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে হরহামেশা। ” জান্নাত ও জাহান্নাম নিকৃষ্ট কোন স্থানের নাম নয়। বরং এ হল

মানুষের একটি কাইফিয়াত বা অবস্থার নাম।

→ কুরআন অতীতের চেয়ে ভবিষ্যতের দৃষ্টি রাখার জোর দাবী জানিয়েছে। এরই নাম হল ঈমান বিল আখেরাত। → ফিরিশতা বলে আভ্যন্তরীণভাবে মানুষের মনের মাঝে আলোড়ন

সৃষ্টিকারী সত্তাকেই বুঝানো হয়েছে। মূলত পৃথকভাবে মালাইকা বা

ফিরিশতার কোন অস্তিত্ব নেই।

● জান্নাত থেকে বেরিয়ে আসা আদম নির্ধারিত কোন ব্যক্তি নয়। বরং এ হল ইনসানিয়্যাতের এক তামছীলী নুমায়েন্দা বা প্রতীকী প্রতিনিধি । → কুরআন ব্যতীত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আর

কোন মুজিযা দেয়া হয়নি।

) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মিরাজ স্বপ্নযোগে সংঘটিত হয়েছে স্ব-শরীরে নয়। আর যদি স্ব-শরীরে হয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়। তাহলে আমরা বলব যে, এ ঘটনা মূলত হিজরতেরই ঘটনা। হিজরতের ঘটনাকেই মিরাজের ঘটনা বলে অভিহিত করা হয়েছে। পবিত্র কুরআন শরীফে মসজিদে নববীকেই মসজিদে আকসা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

• কুরআন শরীফে নামা : পড়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়নি। বরং নামায

কায়েম করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

• ইসলামী হুকুমতের পক্ষ হতে আরোপিত ট্যাক্সই হল মূলত যাকাত। শরীয়তের পক্ষ হতে এর কোন সীমা নির্ধারণ করা হয়নি।
• প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় রাষ্ট্রের তরফ থেকে নির্ধারিত করাকেই কুরআন শরীফে সাদকা বলে অভিহিত করা হয়েছে।

● হজ ইসলামী রাষ্ট্রসমূহের একটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্স। এর উদ্দেশ্য

হল, কুরআনের আলোকে গোটা মুসলিম বিশ্বের সার্বিক সমস্যার

সমাধান করা।

→ আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে সমবেত জনতার খাওয়া দাওয়ার সুব্যবস্থা করার লক্ষ্যেই কুরআনে কুরবানী করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এটাই হল কুরবানীর হাকীকত না বুঝে কুরআন পড়লে সওয়াব হয় কথাটি একেবারে অনৈসলামিক আকীদাপ্রসূত কথা।

→ কুরআনের দৃষ্টিতে শুধু মৃত জানোয়ার, প্রবাহিত খুন, শূকরের গোশত এবং গায়রুল্লাহর নামে জবেহকৃত জানোয়ারই কেবল হারাম। এ ছাড়া আর কোন কিছু খাওয়া বা ভক্ষণ করা হারাম নয় ।

পর্যালোচনা

মানুষের জ্ঞান সসীম। এ সসীম ও সামান্য জ্ঞানের মাধ্যমে অসীম ও অফুরন্ত জ্ঞানের অধিকারী বিশ্ব স্রষ্টা আল্লাহ তাআলার পরিচিতি লাভ করা এবং নিজেকে সুপথে পরিচালিত করা মানুষের পক্ষে কখনো সম্ভব নয়। তাই আল্লাহ তাআলা মানুষের হিদায়াত এবং রাহনুমায়ীর জন্য ान করেছেন বিশুদ্ধতম জ্ঞানের উৎস তথা ওহীর এক সুমহান সিলসিলা। এ আসমানী হিদায়েত এবং নির্দেশনার আলোকে মানবতার শিক্ষা এবং সুষ্ঠু তরবিয়াতের জন্য পাঠিয়েছেন তিনি যুগে যুগে বহু নবী এবং রাসূল। তাঁরা আল্লাহর মর্জি ও ইচ্ছার বাইরে কোন কথা বলেন না। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন-

*সে মনগড়া কোন কথা বলে না। এ তো ওহী যা তার প্রতি প্রত্যাদেশ হয়।’ (নজম ৩-৪ আয়াত)

মূলত ওহী দুই প্রকার। প্রথমটিকে বলা হয় ওহীয়ে মাতলু বা কালামুল্লাহ। আর অপরটিকে বলা হয় ওহীয়ে গায়ের মাতলু বা কালামুর রাসূল। যেমনিভাবে কালামুল্লাহর প্রতি ঈমান আনা এবং এর অনুকরণ করা আমাদের জন্য ফরয, অনুরূপভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর প্রতিটি আদেশ-নিষেধের উপর আমল করাও আমাদের জন্য অপরিহার্য। বিষয়টিকে সহজবোধ্য করার জন্য কয়েকটি দলিল নিম্নে পেশ করলাম।

১. পয়গামে ইলাহী আল্লাহ তাআলা কখনো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হৃদয়ে ইলকা করেছেন, আবার কখনো হযরত জিবরাঈল (আ.)-এর মাধ্যমে পৌছিয়েছেন। হযরত জিবরাঈল (আ.) কখনো আল্লাহরই নির্দেশ মুতাবেক আল্লাহর মূল বক্তব্যকে নিজের ভাষায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট প্রকাশ করেছেন, আবার কখনো আল্লাহর শিখানো শব্দ এবং বাক্যসমূহকে হুবহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট পৌছিয়েছেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে শিখানো ও সংরক্ষিত শব্দসমূহকে যা হযরত জিবরাঈল (আ.) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট পৌছিয়েছেন এটাকেই ওহীয়ে মাতলু বলা হয়। আর বাকী অন্যগুলোকে ওহীয়ে গায়রে মাতলু বলা হয়। এদিকে ইংগিত করেই আল্লাহ তাআলা বলেন-

‘মানুষের এমন মর্যাদা নেই যে, আল্লাহ তার সাথে কথা বলবেন ওহীর মাধ্যম ব্যতিরেকে, অথবা পর্দার অন্তরাল ব্যতিরেকে অথবা এমন দূত প্রেরণ ব্যতিরেকে যে দূত তার অনুমতিক্রমে তিনি যা চান তা ব্যক্ত করেন, তিনি সমুন্নত, প্রজ্ঞাময়।’ [সূরা- ৫১ আয়াত]

২. আকীদায়ে তৌহিদের পর নামাযই হল সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ আমল। মি’রাজের ঘটনার অনেক পূর্ব থেকেই মুসলমানগণ সকাল ও সন্ধ্যায় দুই ওয়াক্ত নামায আদায় করতেন। অথচ প্রচলিত সূরাতে নামায আদায় করার নির্দেশ ঐ সময় পর্যন্ত কুরআনে কোথাও বর্ণিত হয়নি। সাহাবীগণ শুধু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদেশের উপর ভিত্তি করেই এ আমল তখন আরম্ভ করেছিলেন। এর দ্বারা বুঝা যায় যে, ওহীয়ে মাতলুর মত ওহীয়ে গায়র মাতলুও অনুসরণীয় এবং উম্মতের জন্য একান্তভাবে অপরিহার্য।

৩. কুরআন শরীফে ইকামতে সালাতের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রচলিত নামায তথা তাকবীরে তাহরীমা, কিয়াম, কিরাত, রুকু, সিজদা, বৈঠক ইত্যাদি ওয়ালা নামাযের তালীম কুরআনে কোথায়ও নেই। বরং প্রচলিত পদ্ধতিতে নামায আদায় করা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কথা ও আমলের দ্বারাই ছাবিত হয়েছে। এর দ্বারাও ওহীয়ে গায়র মাতলু উম্মতের জন্য অবশ্য পালনীয় কথাটি পরিষ্কারভাবে বুঝা যাচ্ছে।

৪. পবিত্রতা নামাযের জন্য পূর্বশর্ত। এ কথা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই প্রথমে বয়ান করেছেন। অবশ্য হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বর্ণনার ১৮ বছর পর গোসল সম্পর্কিত সূরায়ে মাঈদার আয়াতটি নাযিল হয়েছে। এর দ্বারাও ওহীয়ে গায়র মাতলু হুজ্জত হওয়ার বিষয়টি পরিষ্কারভাবে আমরা বুঝতে পারছি।

৫. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় হিজরত করার পর মুসলমানদেরকে মসজিদে আকসার দিকে মুখ ফিরিয়ে নামায পড়ার নির্দেশ দেন। দীর্ঘ ১৬-১৭ মাস এদিকে ফিরে নামায পড়ার পর আল্লাহ তাআলা বায়তুল্লাহ শরীফের দিকে মুখ করে পড়ার নির্দেশ দেন। অথচ মসজিদে আকসার দিকে মুখ ফিরিয়ে নামায পড়ার নির্দেশ কুরআনে কোথায়ও নেই। এর দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, মসজিদে আকসার দিকে মুখ ফিরিয়ে নামায পড়ার নির্দেশ ওহীয়ে গায়র মাতলুর মাধ্যমেই প্রদান করা হয়েছে। এমনকি আল্লাহ পাক এ ঘোষণাকে নিজের ঘোষণা বলে কুরআন শরীফে উল্লেখ করেছেন-

এ যাবত তুমি যে কিবলার অনুসরণ করছিলে তা এ উদ্দেশ্যেই আমি প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম যাতে জানতে পারি কে রাসূলের অনুসরণ করে এবং কে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে।’ [সূরা বাকারা : ১৪৩ আয়াত]

এ আলোচনার প্রেক্ষিতে এ কথাই প্রতীয়মান হচ্ছে যে, ওহীয়ে গায়র মাতলুও ওহীরই একটি প্রকার।

৬. বনী নবীর গোত্রের ইহুদীদের সাথে লড়াই চলাকালে যুদ্ধের কৌশল হিসাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের গাছপালা কেটে ফেলার জন্য মুসলিম বাহিনীর প্রতি নির্দেশ দেন। এ কাণ্ড দেখে ইহুদীরা যখন হৈ চৈ আরম্ভ করে তখন আল্লাহ তাআলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এ কাজের বৈধতার সমর্থনে আয়াত নাযিল করে বললেন- ‘তোমরা যে খেজুর বৃক্ষগুলো কর্তন করেছ এবং যেগুলো কাণ্ডের উপর স্থির রেখেছ, তা তো কেবল আল্লাহরই অনুমতিক্রমে; তা এ জন্য যে, আল্লাহ তাআলা পাপাচারীদেরকে লাঞ্ছিত করবেন। [হাশর: ৫ আয়াত !
উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমেও ওহীয়ে মাতলুর হুজজিয়্যাত এবং ওহীয়ে গায়র মাতলুও মূলত ওহীরই এক প্রকার- এ কথাই সুস্পষ্ট প্রতিভাত হচ্ছে। ‘শুধু কুরআনের তাবলীগ করাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দায়িত্ব’ হাদীস অস্বীকারকারী সম্প্রদায়ের এ কথাটিও ঠিক নয়। কারণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মৌলিক দায়িত্ব কি? বিষয়টির বর্ণনা দিতে গিয়ে স্বয়ং আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন-

“তাদের নিজেদের মধ্য থেকে তাদের নিকট রাসূল প্রেরণ করে আল্লাহ তাআলা মুমিনদের প্রতি অবশ্য অনুগ্রহ করেছেন, সে তার আয়াত তাদের নিকট আবৃত্তি করে, তাদেরকে পরিশোধন করে, কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেয়া। যদিও তারা পূর্বে স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে ছিল।’ [আল ইমরান : ১৬৪ আয়াত]

“কুরআনের ফাহুম এবং কুরআনের বিশুদ্ধতম সময় হাদীসের উপর নির্ভরশীল নয়’ কথাটিও একেবারে অবাস্তব। কারণ নামায রোযা হজ যাকাত ইত্যাদি বিষয়ের আসল রূপরেখা আমরা হাদীস থেকেই সংগ্রহ করেছি। তাই জনৈক মুহাদ্দিস বলেছেন, কুরআন বুঝা হাদীস বুঝা ব্যতীত সম্ভব নয়। আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মিরী (রহ.) বলেছেন, হাদীস ব্যতীত কুরআনের উপর ঈমান আনয়ন করাও সম্ভব নয় এবং আমল করাও সম্ভব নয়।

“হাদীস না সাহাবীদের জন্য অনুসরণীয় ছিল এবং না আমাদের জন্য অনুসরণীয়’ দাবীটি একেবারেই অসম্ভব। কারণ, নবীদেরকে ইলাহী নেগাহবানী ও কড়া নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে প্রতিপালিত করে মাসুম এবং নিষ্পাপ রাখার অন্যতম উদ্দেশ্য হল তাঁদেরকে তৎকালীন উম্মতের জন্য উসওয়া বা আদর্শরূপে গড়ে তোলা। যে আদর্শ অনুসরণ এবং অনুকরণ ব্যতীত মুক্তির বিকল্প কোন ব্যবস্থা নেই। এ মহাসত্যটিকে প্রকাশ করার লক্ষ্যেই কুরআন ঘোষণা করেছে- ‘আমি এ উদ্দেশ্যেই রাসূল প্রেরণ করেছি যেন আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে তাঁর আনুগত্য করা হয়।’ [সূরা নিসা :

শুধু তাই নয়, বরং বিশ্ব স্রষ্টা মহাগ্রন্থ আল কুরআনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনুগত্য করাকে খোদা নিজের আনুগত্য বলে ঘোষণা করেছেন। ইরশাদ হয়েছে- ‘কেউ রাসূলের আনুগত্য করলে সে তো আল্লাহরই আনুগত্য করল।’ [সূরা নিসা : ৮০]
এমনকি আল্লাহর ভালবাসা লাভের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনুগত্য হল পূর্বশর্ত। এ শতটির প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে আল্লাহ বলেছেন- ‘বল, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালবাস, তবে আমাকে অনুসরণ কর, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করে দিবেন। আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমতাশীল ও দয়ালু। [সূরা আল ইমরান : ৩১]

রাসূলের ইতাআত ব্যতীত মুসলমান হওয়াও সম্ভব নয়। তাই বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করার লক্ষ্যে কুরআন বারবার ঘোষণা করেছে- বল, আল্লাহ ও রাসূলের অনুগত হও, যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে জেনে রাখ, আল্লাহ কাফিরদেরকে ভালবাসেন না।’ [সূরা আল ইমরান ৩২/

আল্লাহ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনুগত্যই সফলতার একমাত্র চাবিকাঠি। ইরশাদ হয়েছে- ‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, আল্লাহকে ভয় করে ও তাঁর অবাধ্যতা হতে সাবধান থাকে তারাই মূলত সফলকাম।’ [সূরা নূর : আয়াত ৫২]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনুগত্যই হিদায়েত লাভের অন্যতম উপায়। এ দিকে জোর দিয়ে আল্লাহ বলেছেন- “বল, আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর। অতঃপর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও তাহলে তার উপর অর্পিত দায়িত্বের জন্য সে দায়ী এবং তোমাদের উপর অর্পিত দায়িত্বের জন্য তোমরা দায়ী এবং তোমরা তাঁর (রাসূলের আনুগত্য করলে সৎপথ লাভ করবে, রাসূলের কাজ তো কেবল স্পষ্টভাবে পৌঁছিয়ে দেয়া।’ [সূরা নূর : ৫৪]

আনুগত্যের আহ্বান জানিয়ে কুরআন বারবার বলেছে- ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে ও নিজেদের মধ্যে বিবাদ করবে না। করলে তোমরা সাহস হারাবে এবং তোমাদের শক্তি লুপ্ত হবে। তোমরা ধৈর্য ধারণ করবে, আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে রয়েছেন।’ [সূরা আনফাল : আয়াত ৪৬]

নামায ও যাকাতের সাথে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনুগত্যের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে মহাগ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহ তাআলা দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন- ‘সালাত কায়েম কর, যাকাত দাও এবং রাসূলের আনুগত্য কর, যাতে তোমরা অনুগ্রহভাজন হতে পার।’ [সূরা নূর : আয়াত ৫৬]
কেবল ইবাদতের ক্ষেত্রেই নয় বরং পরস্পর বিবাদ বিসম্বাদের ক্ষেত্রেও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সিদ্ধান্ত অবনত মস্তকে মেনে নিতে হবে। অন্যথায় পূর্ণাঙ্গ মুমিন হওয়া কোনক্রমেই সম্ভব নয়। ‘কিন্তু না, তোমাদের প্রতিপালকের শপথ! তারা মুমিন হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের নিজেদের বিবাদ বিসম্বাদের বিচারভার তোমার উপর অর্পণ না করে। অতঃপর তোমার সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে তাদের মনে কোন দ্বিধা

না থাকে এবং সর্বান্তকরণে তা মেনে না নেয়।’ [সূরা নিসা : আয়াত ৬৫) অধিকন্তু হাদীস অমান্যকারী ব্যক্তির ঠিকানা জাহান্নাম। এ সম্পর্কে কুরআন নিশ্চিতভাবে ঘোষণা করেছে- ‘কারো নিকট সৎপথ প্রকাশ হওয়ার পর সে যদি রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং মুমিনদের পথ ব্যতীত অন্য পথ অনুসরণ করে তবে যেদিকে সে ফিরে যায় সেদিকেই তাকে ফিরিয়ে দেব এবং জাহান্নামে তাকে দগ্ধ করব, আর তা কতই না মন্দ আবাস!’ [সূরা নিসা : ১১৫]

‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী সাহাবীদের জন্য হুজ্জত আমাদের জন্য হুজ্জত নয়’- হাদীস অস্বীকারকারী সম্প্রদায়ের এ দাবীটিও যুক্তিহীন। কারণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন বিশ্বনবী, কিয়ামত পর্যন্তের জন্য নবী এবং গোটা বিশ্ব ধরিত্রীর জন্য নবী। তাঁর নবুওয়াত ও রিসালাতের উপর ঈমান আনা ব্যতিরেকে কারো ঈমানই গ্রহণযোগ্য নয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রিসালাতের ব্যাপকতা গোটা বিশ্বব্যাপী। এ বিষয়টির প্রতি দিক নির্দেশনা করে জোরকণ্ঠে কুরআন বলছে- ‘বল, হে মানুষ! আমি তোমাদের সকলের জন্য আল্লাহর রাসূল।’ [সূরা আরাফ : আয়াত ১৫৮]

কুরআন আরো বলছে-

‘আমি তো তোমাকে সমগ্র মানব জাতির প্রতি সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না।’ [সূরা সাবা : আয়াত ২৮]

আরো বর্ণিত আছে- ‘আমি তো তোমাকে বিশ্ব জগতের প্রতি কেবল রহমতরূপেই প্রেরণ করেছি।’ [সূরা আম্বিয়া : আয়াত ১০৭ আরো ইরশাদ হয়েছে- কত মহান তিনি, যিনি তাঁর বান্দার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ করেছেন, যাতে সে বিশ্ব জাহানের জন্য সতর্ককারী হতে পারে। [সূরা ফুরকান : আয়াত ১)

*রাসূলের হাদীস বিশ্ববাসীর জন্য হুজ্জত। তবে বর্তমান হাদীস ভাণ্ডার যেহেতু কোন নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে আমাদের নিকট পৌঁছেনি তাই আমরা এ সব হাদীস মানার জন্য বাধ্য নই’- হাদীস অস্বীকারকারী সম্প্রদায়ের এ দৃষ্টিভঙ্গিও সহীহ নয়। কারণ, ‘আমিই কুরআন অবতীর্ণ করেছি এবং আমিই এর সংরক্ষক’- এ আয়াতে আল্লাহ পাক শব্দগত দির থেকে কুরআনের হিফাযতের প্রতিশ্রুতি দেয়ার সাথে সাথে অর্থ ও ব্যাখ্যার দিক থেকেও এর হিফাযতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মৌলিকভাবে। কারণ, শব্দ এবং অর্থ উভয়ের নামই হল কুরআন। আর হাদীসের মধ্যে মূলত কুরআনের অর্থকেই প্রকাশ করা হয়েছে সর্বোতভাবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর তেইশ বছরের জিন্দেগী হল কুরআনের আমলী নমুনা এবং কুরআনের এক জীবন্ত মিছাল। এ কারণেই হযরত আয়েশা (রা.) বলেছেন, কুরআনই হল তাঁর আখলাক ।

বিদআতী সয়লাব

আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সমস্ত বিষয়কে দীনের অন্তর্ভুক্ত করেননি, যে সমস্ত বিষয়ের তাঁরা নির্দেশ দেননি সেগুলোকে দীনের কাজ বলে নির্ধারণ করা, এর অঙ্গ বলে ঘোষণা দেয়া, সওয়াব এবং নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে এ ধরনের কোন আমল করা, শরীয়তের কোন নির্দেশ ও আমলের পাবন্দীর মত এ ধরনের কাজের স্বকপোল কল্পিত রীতি ও পদ্ধতি নির্ধারণ করে নিয়ে সেগুলোর পাবন্দী করা, এ ধরনের সবকিছুই বিদআত বলে গণ্য। বিদআত মূলত আল্লাহর নির্ভেজাল দীনের মাঝে মানবকল্পিত তথাকথিত নয়া এক শরীয়তের উদ্ভব ঘটানোরই নামান্তর। এ যেন নির্ভেজালের মাঝে ভেজালের সংমিশ্রণ এবং এক রাষ্ট্রের ভেতরে অপর রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটানোর মত। এ সমস্ত কল্পিত শরীয়ত ও রীতির রয়েছে আলাদা ফিকাহ্ ও স্বতন্ত্র ব্যবহার মাত্র। এর করণীয়, এর ফরয, ওয়াজিব, এর সুন্নত-মুস্তাহাব সবকিছুই আলাদা। আল্লাহর দীনের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। এ জামাতের কর্ণধার ছিলেন জনাব আহমদ রেযা খান। রেযা খানীদের চাকচিক্যময় আকর্ষণীয় শ্লোগানে অল্পবিদ্যাসম্পন্ন বহু সাদাসিধে মুসলমান এ সয়লাবে ভেসে চলছে দারুণভাবে এবং ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে অত্যন্ত তৎপরতার সাথে বিদআতী ফিতনা এগিয়ে চলছে।

মৌলিকভাবে বিদআতী ফিতনা চারটি মৌল আকীদার উপর নির্ভরশীল : ১. বিদআতীদের আকীদা : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জাতি। নূরের তৈরি। তিনি বশর নন।

২. রিযাখানীদের বিশ্বাস : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গায়ব

জানেন।

৩. বিদআতী সম্প্রদায়ের ধারণা : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বত্রই হাজির-নাজির ।

৪. তাদের আকীদা : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন মুখতারে কুল অর্থাৎ এ পৃথিবীর সর্বময় ক্ষমতা একমাত্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাতে। আল্লাহর হাতে কোন ক্ষমতা নেই। এ ছাড়াও কবরপূজা, মাজার পূজা, কবরে শিরনী দেয়া, কবরে আলোকসজ্জা করা, কবরে গিলাফ দেয়া, মিলাদে কিয়াম করা ইত্যাদি তাদেরই বাড়াবাড়ির অন্যতম ফসল। বস্তুত আল্লাহর দীনের সাথে এগুলোর কোন সম্পর্ক নেই।

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকীদা

১. কুরআন ও হাদীসের দৃষ্টিতে : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষ, তিনি বশরিয়্যাতের ঊর্ধ্বে নন। তবে তিনি আমাদের মত সাধারণ মানুষ নন। তিনি হচ্ছেন সর্বোৎকৃষ্ট মহামানব। তিনিই হচ্ছেন নবীদের সর্দার এবং নবী জামাতের দলপতি। আল্লাহর পর তাঁরই মর্যাদা, তাঁরই শ্রেষ্ঠত্ব অন্যান্য নবীর মত তিনিও ধন্য হয়েছেন আল্লাহর প্রত্যাদেশ পেয়ে । মর্যাদার দিক থেকে কেউ তাঁর সমতুল্য নয়। অর্থাৎ আল্লাহর পর সম্মানিত তুমিই হে রাসূল! সংক্ষেপে এ কথাই আমরা তাঁর সম্পর্কে বলতে চাই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষ কি না, বাস্তবতার নিরীখে এর সুষ্ঠু সমাধান দেয়ার লক্ষ্যে কুরআন ঘোষণা করেছে—

বল, আমি তোমাদের মতই একজন মানুষ। আমার প্রতি প্রত্যাদেশ হয়
যে, তোমাদের ইলাহ একমাত্র আল্লাহ। সুতরাং যে তার প্রতিপালকের সাক্ষাত কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম করে ও তার প্রতিপালকের ইবাদতে কাউকে শরীক না করে।’ [সূরা কাহফ : ১১০)

২. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ তাআলা যে পরিমাণ

ইলম দান করেছেন, অন্য কাউকে তিনি সে পরিমাণ ইলম দান করেননি।

সৃষ্টি জগতের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্তের ইলম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি

ওয়াসাল্লাম-এর জ্ঞান সমুদ্রের তুলনায় এক ফোঁটা পানির মতই মাত্র; এর

চেয়ে বেশি কিছু নয় ।

তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গায়ব জানেন’ এ কথা বলা ঠিক নয়। কারণ, গায়েবের মালিক একমাত্র আল্লাহ তাআলা। এ মহাসত্যটির প্রতি সুস্পষ্ট ইংগিত করে মহাগ্রন্থ আল কুরআন বলছে- বল, আল্লাহ ব্যতীত আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে কেউই অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান রাখে না এবং তারা জানে যে, কখন তারা পুনুরুত্থিত হবে।’ [সূরা নামল : আয়াত ৬৫)

অদৃশ্যের খবরপত্র তালাবদ্ধ কুঠরীতে আবদ্ধ। আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না এর আসল তথ্য। তাই আল্লাহ বলেন- “তাঁরই নিকট রয়েছে অদৃশ্যের কুঞ্জি, তিনি ব্যতীত কেউ জানে না এ সম্পর্কে আর।’ [সূরা আনআম : ৫৯]

তিনি আরো বলেছেন- ‘বল, আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তা ব্যতীত আমার নিজের ভাল-মন্দের উপরও আমার কোন অধিকার নেই। আমি যদি অদৃশ্যের খবর জানতাম, তবে তো আমি প্রভূত কল্যাণই লাভ করতাম এবং কোন অকল্যাণই আমাকে স্পর্শ করতে পারত না। আমি তো শুধু মুমিন সম্প্রদায়ের জন্য সতর্ককারী ও সুসংবাদবাহী।’ [সূরা আ’রাফ : ১৮৮

৩. আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকীদা : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাজির-নাজির নন। কারণ, হাজির-নাজির শব্দ দুটি আরবী। এর দ্বারা এমন এক সত্তাকেই বুঝান হয় যিনি সর্বদা ও সর্বত্র বিরাজমান এবং যিনি সম্যক দ্রষ্টা। এ কেবল আল্লাহ তাআলারই শান এবং তাঁরই এক বিশেষ গুণ। এ গুণের অধিকারী হওয়া আল্লাহ ব্যতীত কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। এ চিরসত্য কথাটিকেই অংকন করে বিশ্বস্রষ্টা আল্লাহ বলেছেন- ‘তোমরা যেখানেই থাক না কেন তিনি (আল্লাহ) তোমাদের সঙ্গে আছেন। [সূরা হাদীদ : ৪]
এ আয়াতে আল্লাহ যেন একই কথা বলতে চাচ্ছেন যে, সর্বদা সর্বত্র বিরাজ থাকা এবং সমস্ত কিছুর প্রত্যক্ষভাবে নেগরানী করা বা দেখাশোনা করা এ আমারই কেবল খাস সিফাত এবং আমারই এক বিশেষ গুণ। তোমরা যতই কিছু হও না কেন, এ গুণের অধিকারী হতে পারবে না কেউ। ইফকের ঘটনা, মধু পান করার ঘটনা, বিষ মিশ্রিত বকরীর গোশত ভক্ষণ করার ঘটনা প্রভৃতি ঘটনাবলী ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সর্বদা ও সর্বত্র হাজির-নাজির নন’ এ বিষয়টির প্রতিই জ্বলন্ত স্বাক্ষর হয়ে ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ আছে। অধিকন্তু উলামায়ে কেরাম ও মাশায়েখে ইযাম ‘আল্লাহু হাজিরী এবং আল্লাহু নাজিরী’ অযীফা আদায় করে দৈনন্দিন এ কথাই ঘোষণা করে আসছেন যে, আল্লাহ ছাড়া আর কেউ হাজির-নাজির নন । তিনিই হলেন এ গুণে গুণান্বিত এক অদ্বিতীয় সত্তা।

৪. মুখতারেকুল বা এ পৃথিবীর সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী একমাত্র আল্লাহ তাআলা। হযরত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নন। বিশ্ব জাহানের সুষ্ঠু প্রতিপালন এবং পরিচালনাও কেবল তাঁরই হাতে। সকল বস্তুর উপর তিনিই একমাত্র ক্ষমতাশালী। এ নিখিল বিশ্বের শৃঙ্খলা বিধান ও সবকিছুর প্রতিপালনে কেউ বা কোন কিছুই তাঁর শরীক নেই। তিনি যা চান তাই হয়, আর যা চান না তা হয় না। চাওয়া পাওয়ার একমাত্র আশ্রয়স্থল তিনিই। তকদীর, ভাল ও মন্দ সবকিছুই আল্লাহর তরফ থেকেই আসে। এ কারণেই হযরত আদম (আ.) থেকে নিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত যুগে যুগে আগত সকল নবী-রাসূলই তাঁর দরবারে আরাধনা, প্রার্থনা ও মুনাজাত জানিয়েছেন এবং তাঁকেই সকলে নিজের কল্যাণ ও অকল্যাণের মূল মালিক বলে মেনে নিয়েছেন। এ সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ভাষ্য অত্যন্ত সুস্পষ্ট। হযরত ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (আমাকে লক্ষ্য করে) ইরশাদ করেছেন-

“হে বৎস! আল্লাহর হকসমূহের সংরক্ষণ কর, তবে আল্লাহও তোমার হক সংরক্ষণ করবেন। যদি তুমি হুকুকুল্লাহ’র হিফাযত কর তাহলে আল্লাহকে তুমি নিজের সামনেই পাবে। যখন কিছু চাইবে তখন তুমি আল্লাহর নিকট চাইবে আর যখন তোমার সাহায্যের প্রয়োজন হবে তখন তাঁরই নিকট সাহায্য প্রার্থনা করবে। মনে রাখবে, যদি সমস্ত মানুষও একত্রিত হয় তোমাকে উপকার করার জন্য তাহলে তারা আল্লাহর মর্জির বাইরে তোমাকে কিছুই উপকার করতে পারবে না। আর যদি সমস্ত মানুষ একত্রিত হয় তোমাকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য তাহলে তারাও তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না আল্লাহর নির্ধারিত ফয়সালার বাইরে। [মেশকাত শরীফ : ৪৫৩]

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের অন্যতম ভাষ্যকার বড়পীর হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) বলেছেন, মাখলুক একেবারে অসহায়। এ নিতান্তই অক্ষম। হিফাযত-হালাকাত, কল্যাণ-অকল্যাণ, ভাল-মন্দ, রোগ-শোক, উপকার-অপকার, হায়াত-মউত, ধন-দৌলত, রিযক-কসমত ইত্যাদি কোন কিছুই তার হাতে নেই। সবকিছুই আল্লাহর হাতে। তবে মাঝে মধ্যে কোন অলৌকিক ঘটনার বহিঃপ্রকাশ হতে দেখে নবী-রাসূলদেরকে খোদায়িত্বের শরীক করা এবং তাঁদেরকে মুখতারে কুল বলে মনে করা চরম বোকামী এবং ধৃষ্টতা ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ, অলৌকিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো কোন নবী-রাসূলের আয়ত্বাধীন নয়। আল্লাহ তাআলা আল কুরআনে ঘোষণা করেছেন-

‘যখন আমার সুস্পষ্ট আয়াতগুলোকে তাদের নিকট পাঠ করা হয়, তখন যারা আমার সাক্ষাতের আশা পোষণ করে না, তারা বলে- অন্য এক কুরআন এছাড়া, অথবা এটাকে বদলাও। বল, নিজ হতে এটা বদলানো আমার কাজ নয়। আমার প্রতি যা ওহী হয়, আমি কেবল তারই অনুসরণ করি। আমি আমার প্রতিপালকের অবাধ্যতা করলে আমি আশংকা করি মাহদিবসের শাস্তি।’ [সূরা ইউনুস : ৫]

তাই মুজিযা বা অলৌকিকতার বহিঃপ্রকাশের কারণে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মুখতারে কুল বলে মনে করা খৃষ্টান মতবাদেরই নামান্তর। সুতরাং কোন মুসলমানের জন্য এ ধরনের আকীদা পোষণ করা কোনক্রমেই বৈধ নয়।

বিদআতের কুফল কুরআন ও হাদীসের আলোকে

ইসলাম একটি মুকাম্মাল জীবন বিধান। সওয়াবের নিয়তে এতে নতুন কিছু আবিষ্কার করা শিরক। এ শিরক তৎপরতায় লিপ্ত না হওয়ার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেছেন- ‘তোমরা মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না, যারা নিজেদের দীনে মতভেদ সৃষ্টি করেছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে। প্রত্যেক দলই নিজ নিজ মতবাদ নিয়ে উৎফুল্ল।’ [সূরা রুম : ৩১-৩২]

আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত আয়শা (রা.) বলেছেন, বিভিন্ন দলে বিভক্ত হওয়ার প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ মূলত বিদআতীদের প্রতিই ইংগিত করা হয়েছে।

বিদআতী সম্প্রদায় যতই আমল করুক না কেন, এ আমল তাদের জন্য

কোন কল্যাণ নিয়ে আসবে না কখনো। বরং ধ্বংস এবং ক্ষতিগ্রস্ততাই হল

এ আমলের নিশ্চিত পরিণাম। এ পরিণামটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেই

আল কুরআন বলেছে- বল, আমি তোমাদেরকে সংবাদ দিব কর্মে বিশেষ ক্ষতিগ্রস্তদের? এরাই তারা, যাদের প্রচেষ্টা পণ্ড হয়ে গিয়েছে পার্থিব জীবনে, যদিও তারা মনে

করে যে, তারা সৎকর্ম করছে।’ [সূরা কাহাফ : ১০৩-১০৪]

দীন চিরন্তন; অর্থাৎ সকল যুগ এবং সকল স্থানে এর আমল ও বিধানসমূহের রূপ একই। এ চিরন্তনতার প্রতি লক্ষ্য রেখেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদেরকে বিদআত থেকে বেঁচে থেকে সুন্নতকে আঁকড়ে ধরার বলিষ্ঠ তাগিদ দিয়ে জোরকণ্ঠে বলেছেন- ‘যদি কেউ আমাদের এ দীনে নয়া কোন বিষয়ের উদ্ভাবন করে যা মূলত এতে নেই, তা অবশ্যই পরিত্যাজ্য ও প্রত্যাখ্যাত।’ [বুখারী ও মুসলিম শরীফ।

অন্য এক হাদীসে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- “তোমরা বিদআত থেকে সতর্ক থাকবে। কারণ, প্রতিটি বিদআতই গোমরাহী। আর প্রত্যেক গোমরাহীর পরিণাম হল জাহান্নাম।’ [আবু দাউদ, আহমদ।
আলো আর অন্ধকারের মাঝে যেমন বৈপরীত্য, তেমনিভাবে সুন্নাত ও বিদআতের মাঝেও বৈপরীত্য। এ কারণে বিদআত যে পরিমাণে হতে থাকে, সুন্নাতও সে পরিমাণে সমাজ থেকে বিলুপ্ত হতে থাকে। এ হিকমতপূর্ণ কথাটির প্রতি ভবিষ্যদ্বাণী করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইदি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

যখন কিছু সংখ্যক লোক দীনের বিষয়ে কোন বিদআতের প্রবর্তন করে পরিণামে তখন সে অনুপাতে সুন্নাতসমূহেরও অবশ্যই বিলুপ্তি (মুসনাদে ইমাম আহমদ।

বিদআতী ব্যক্তি চরমভাবে অভিশপ্ত এ কথাটি চিহ্নিত করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- ‘যখন আমার উম্মতের মাঝে বিদআতের উদ্ভব ঘটবে এবং আমার সাহাবীদেরকে যখন (লোকেরা) গালমন্দ বলা আরম্ভ করবে তখন আলেমের জন্য উচিত হল নিজের ইলমকে প্রকাশ করে দেয়া। যদি সে তা না করে তাহলে তার প্রতি আল্লাহর লা’নত, ফিরিশতার লা’নত এবং সমস্ত মানুষের লা’নত।’ (আল ইতিসাম)

হযরত আয়শা সিদ্দীকা (রা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোন বিদআতীর নিকট গেল এবং তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করল সে ইসলাম ধ্বংস করার পথে সহযোগিতা করল। [আল ইতিসাম)

বিদআত সম্পর্কে মনীষীদের বাণী

সাহাবায়ে কেরাম এবং পরবর্তীতে ইমাম, ফকীহ, মুজাদ্দিদ, সংস্কারক এবং আল্লাহওয়ালা আলিমে দীনগণ সব সময়ই স্ব স্ব যুগের বিদআত ও প্রচলিত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কঠোর মুকাবিলা করেছেন। ইসলামী সমাজ এবং ধর্মীয় পরিবেশসমূহে এ সমস্ত বিদআতের প্রচলন ও গ্রহণীয় হওয়ার মারাত্মক প্রবণতাকে রুখবার তাঁরা প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন। ইমাম মালিক (রহ.)-এর ফতোয়া আজো এর জ্বলন্ত স্বাক্ষর হয়ে আছে। তিনি বলেছেন-

‘যে ব্যক্তি ইসলামের মাঝে বিদআতের প্রচলন করে সে মূলত এ কথাই বলতে চাচ্ছে যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর রিসালাত ও মানুষকে আল্লাহর পয়গাম পৌঁছাতে (নাউযুবিল্লাহ) খিয়ানত করেছেন। অথচ আল্লাহ তাআলা বলেছেন, তোমাদের দীন আমি তোমাদের জন্য পরিপূর্ণ করে দিয়েছি। সুতরাং যে সমস্ত বিষয় তখন দীন হিসাবে গণ্য ছিল না আজ তা দীন হিসাবে গণ্য হতে পারে না।’

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেছেন, হে লোক সকল! তোমরা বিদআত করবে না, ইবাদতে অতিরঞ্জিত করবে না, আকাবিরদের পথ আঁকড়ে ধর এবং যে বিষয়টিকে সুন্নত জান তাকে অবলম্বন কর আর যে বিষয়টিকে সুন্নত বলে তোমার জানা নেই তা বর্জন কর।

হযরত আবু আমর শায়বানী (রা.) বলেছেন, বিদআতী ব্যক্তির জীবনে

তাওবা নসীব হয় না। কারণ, সে তো গুনাহকে গুনাহই মনে করে না।

তার জন্য আবার তাওবা কিসের?

হযরত ফুযায়ল ইবনে ইয়ায (রা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি বিদআতী লোকের সাথে উঠাবসা করে তার হিকমত নসীব হয় না ।

বিদআতের অপকারিতা অত্যন্ত ভয়াবহ। এ সম্পর্কে উলামায়ে কেরাম সর্বদাই সতর্ক ছিলেন। তাঁদের এ সতর্ক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সরল বিশ্বাসী অজ্ঞ সাধারণ মানুষ বিদআতের চাকচিক্যময়তার প্রভাব থেকে কখনো মুক্ত থাকতে পারেননি। কারণ, কিছু সংখ্যক দুনিয়াদার ধর্ম ব্যবসায়ী তথাকথিত ধর্মীয় আলখেল্লাধারী ব্যক্তি নিজেদের জাগতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য সর্বদাই লোকদেরকে বিদআতের এ ভয়াল পথে পরিচালিত করার জন্য সচেষ্ট ছিলেন। তাদের এ ঘূর্ণিত পদক্ষেপের তীব্র সমালোচনা করে আল কুরআন বলছে-

“হে ঈমানদারগণ! (ইহুদী ও খৃষ্টান) পণ্ডিত ও সাধুদের অধিকাংশই অন্যায়ভাবে মানুষের সম্পদ ভক্ষণ করে আর আল্লাহর পথ থেকে তাদেরকে বাধা দিয়ে রাখে।’ [সূরা তাওবা : আয়াত ৩৪]

সুতরাং বিদআতের এ ভয়াবহতা এবং ধ্বংসাত্মক পরিণতি থেকে বাঁচতে হলে আমাদেরকে বিদআতীদের সঙ্গ বর্জন করে হক্বানী আলিমদের সোহবত অবলম্বন করতে হবে এবং সাথে সাথে সুন্নাতের আমলও অত্যন্ত ইহতিমামের সাথে আঁকড়ে ধরতে হবে।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ ক্যাটাগরির আরো
© All rights reserved © 2019 www.izharehaq.com
Theme Customized BY Md Maruf Zakir